১৪ এপ্রি, ২০১১

আমাকে আমার মতো থাকতে দাও : রেখা মিত্র


বাসে যেতে হবে এক ঘন্টার পথ।পেছনের চারজন বসার লেডিস সিটে বসেছি ভালো করে।পা রাখার জায়গাটা এই অংশটাতে বাড়তি পাওনা।অন্য সিটগুলোয় বেশীক্ষণ পা ঝুলিয়ে বসে থাকায় সত্যিই খুব অসুবিধে।ভাবলাম অনেকদিন বাদে আজ বেশ একটা সুন্দর অবকাশ পাওয়া গেল।এতোটা সময় দারুণ কাটবে,মাঝেমাঝে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে,মাঝেমাঝে মনের গভীরে ডুব দিয়ে।নিজের মনকে তেপান্তরে ছোটাবার মতো এমন অবকাশ আজকাল আর মেলে কই ?টার্মিনাসে দাঁডিয়ে থাকা শূন্য বাসটায় উঠে আমি বেছে নিয়েছিলাম সবচেয়ে সুবিধাজনক আসনটি।তারপর এক-এক করে যাত্রীরা উঠতে থাকলেন।একটু আনমনা হয়ে পড়েছিলাম।হঠাৎ চমক ভাঙলো সুতীব্র চিৎকারে ! “আমি অনেকদিন ধরেই দেখছি,আমার কথা শোনার জন্য তোমার হাতে পাঁচটা মিনিট সময়ও থাকছে না”।আমার গা ঘেঁষে বসে পড়ে মেয়েটা।উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে তার সারা দেহ। বসেই সে চিৎকার করে উঠলো, “আমি কোনো কথা শুনতে চাই না”।কয়েক মিনিটের মধ্যে গোলগাল ‘স্নেহময়ী’ মার্কা একজন এলেন এবং ধপাস করে আসন নিলেন প্রেমিকার পাশটিতে।ইতিমধ্যে রাগী প্রেমিকার চোখে অশ্রুবাদল নেমেছে।সে বাঁ-হাতে মোবাইল আর ডানহাতে রুমাল ধরে তার বক্তব্যের পরবর্তী অংশে প্রবেশ করেছে।অনেকবারের চেষ্টার পর মেয়েটির পার্শ্ববর্তিনী ‘স্নেহময়ী’ মোবাইলের অন্যপ্রান্তের সাড়া পেলেন।তিনি তার সি-সার্পে মেলানো গলায় বলে উঠলেন, “ও সোনা,তুমি ফোনটা ধরছিলেনা কেন ?সেই তখন থেকে যতোবার করছি বেজেই যাচ্ছে।তুমি জানোনা সোনা এতে আমার কী ভীষণ টেনশন হয়?....সে যাই হোক আমি তোমায় বলছি তুমি স্যুপটা গরম করে এখুনি খেয়ে নাও...... ও মা,সে কি কথা সোনা !-হা-হা তোমাকে কি গ্যাস জ্বালতে হবে ?মাইক্রোতেই তো করে নিতে পারবে......

বাস ছুটছে।রাগী প্রেমিকার ফর্সা মুখ এখন চোখে পড়ার মতো রক্তিম।মেয়েটি অতি-স্পষ্ট উচ্চারণে ‘শালা’ বললো।আমার কানে যেন হাতুড়ির ঘা পড়লো।এর আগে এই প্রেমিকার মতো পোশাকপরিচ্ছদে আপাদমস্তক রুচিশীলা কোনো মেয়েকে প্রকাশ্যে এই শব্দটি নিক্ষেপ করতে দেখিনি।নিজেকে এ-সব থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চেষ্টা করি বারবার।সফল হই না। কান পাতার বিন্দুমাত্র আগ্রহ না থাকলেও ওই ব্যক্তিগত কলহের এইপ্রান্তের প্রবল কল্লোল বারবার আমার আপন চিন্তাজাল ছিন্ন করে আমাকে সংক্রামিত করতে থাকে।ওদিকের স্নেহময়ীও দেখলাম ছাড়বার পাত্রী নন।তিনি সমানে তর্ক চালিয়ে যেতে থাকেন তার ‘সোনা-মোনা’র সঙ্গে।
আগে কতোবার এক ঘন্টার বাস বা ট্রেণ যাত্রায় একমনে নিজের প্রিয় বিষয় নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে করতে গেছি।কথা বলেছি নিজের সঙ্গে।হঠাৎ মনে এসে গেছে কলেজজীবনের বন্ধুদের সাথে সেই পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার মধুর স্মৃতি।
আজ এই দুই সহযাত্রিণীর আপন-আপন ব্যক্তিগত জীবনের এমন নিনাদমুখরিত প্রকাশ আমাকে কিছুতেই আমার মতো থাকতে দিচ্ছে না।
একদিনের কথা।আগের রাতে রান্না করে রেখেছি।ঘরদোর কাপড়চোপড় নিয়ে কোনো কিছু পেণ্ডিং নেই।আমার মনোগত বাসনা,আজ সারাদিন শুধু পড়বো।মারে হরি,রাখে কে?সাতসকালেই শুরু হয়ে গেল অখণ্ড হরিনামের ওয়ান ডে প্রোগ্রাম।গান যে এতোটাই ভয়ঙ্কর আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠতে পারে তা এলাকার এইধরণের প্রোগ্রাম বক্স ও চোঙাযোগে সারাদিন বাড়ির আনাচেকানাচে প্রবাহিত হবার অভিজ্ঞতা না থাকলে ধারণা করা শক্ত।সারাজীবন আপন-আপন কণ্ঠের প্রবল বেসুরো বেতালা ভাব বজায় রেখে এইসব অনুষ্ঠানের সিংহভাগ চিৎকারক আমাকে কোনোমতেই আপন ঘরে আমার মতো থাকতে দেয় না।কে আর মাপছে ওদের চিৎকারের ডেসিবেল মাত্রা !আমি হতাশ চোখে তারাশংকরের ‘আমার সাহিত্য জীবন’এ চোখ রাখি।অক্ষরগুলো আর হৃদয়ে প্রবেশ করে না।বুঝতে পারি আজ আর আমাকে আমার মতো থাকতে দেয়া হবে না।

রেখা মিত্র
মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক, বেঙ্গল স্টুডিও









[ ১ম পাতায় ফেরত ]

৫টি মন্তব্য:

সুশান্ত কর বলেছেন...

ভূমিকা আর রেখা মিত্রের এই লেখাটা পড়লাম। দারুণ লাগল। প্রেমিকের 'শালা'তে অবনমনের ছবি ভালো এঁকেছেন!

মেঘ বলেছেন...

ভালো লাগল।
মেঘ

Indira Mukhopadhyay বলেছেন...

খুব সুন্দর লিখেছেন রেখাদি । ঠিক যেন আটপৌরে একটা কথাবর্তা ! ভালো লাগে এমনটি !

madhumita বলেছেন...

Darun bhalo laglo....soros..sahaj...bastob! khub moja pelam....

সংঘমিত্রা বলেছেন...

Rekhadir lekhata pore besh bhalo laglo. jharjhare sundar gadya.