প্রথমে
বেড়ানো ছিল রেলগাড়ি করে ।
কুঝিকঝিক করতে করতে বিশাল
ট্রেনকে টেনে নিয়ে যেত স্টিম
ইঞ্জিন । তারপর এল ইলেকট্রিক
ট্রেন । ডিজেল থেকে বিদ্যুত
উত্পাদন করে তা দিয়ে ট্রেন
যা আমরা এখনো চড়ছি । তবে স্থান
কাল পাত্রভেদে ট্রেনের জার্ণি
বড্ড আরামদায়ক হয়ে ওঠে যখন
রিজার্ভড আসন থাকে এবং ট্রেনটি
পরিচ্ছন্ন থাকে । আশপাশের
অনবরত বদলে যাওয়া দৃশ্যপট এই
যাত্রার আনন্দকে আরো বাড়িয়ে
তোলে । সেই সবুজ ধানক্ষেত বা
গ্রামের চালাঘর কিম্বা দূরের
সেই তালদীঘি কেমন যেন নস্ট্যালজিক
করে তোলে । এখন সময়ের অভাবে
ট্রেনে না গিয়ে হয়ত প্লেনে
যেতে হয় আমাদের কিন্তু যে যাই
বলুক ট্রেনে চলার সাথে সাথে
কেমন যেন গ্রাম্যগন্ধ ওতোপ্রতোভাবে
জড়িয়ে থাকে আর ষ্টেশন এলেই
সেই চা'ওয়ালার
ডাক কিম্বা নিষিদ্ধ সব
ডিপফ্রায়েডের হাতছানি ?
এখন চা ওয়ালার
সফিষ্টিকেশন লেভেল অনেক ওপরে
। ফোটানো চায়ের পরিবর্তে
টিব্যাগ এসেছে । জনগণের
কল্যাণার্থে, চা-কফির
পাশে জায়গা করে নিয়েছে ঠান্ডা
পানীয়ের বোতল ও খনিজলবণ সমৃদ্ধ
পানীয় জল । মনে মনে ভালোলেগেও
যায় এই সব দেখেশুনে । নিজের
দেশটাকে কে না ভালো দেখতে চায়
!
প্লেনে
কেমন যেন একটু বেশি শহর-শহর
গন্ধ । চেনা শহরটা হুস করে
পেরিয়ে যাবার আগেই একফালি
বিকিনি জানলায় চোখ রেখে একচিলতে
নীল নদীটাকে সি অফ করে চলা ।
শহরের আলুলায়িত নীলচে সবুজ
নিকেল সালফেটের মত ল্যান্ডস্কেপটাকে
টপকে টপকে মেঘের মধ্যে দিয়ে
ভাসতে ভাসতে মনে হত এই যে নীচের
শহরটাকে দেখছি সেখানে কোথাও
একটা বিন্দুর মত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র
আমার বাড়ি । ভাবতে ভাবতেই
নিমেষের মধ্যে হারিয়ে যেত
আমার শহর, নীল
নদী, সবুজ গড়ের
মাঠ, সবুজ ঘেরা
লেকের জল । মেঘের বাড়ির জানলা
একে একে বন্ধ হয়ে যেত । পাইলট
প্লেন ঘুরিয়ে দিত গন্তব্যের
নিশানায় । আরবান ল্যান্ডস্কেপ,
ব্যস্ত জীবনযাত্রা
আমার চোখের আড়ালে তখন । প্রথম
প্রথম প্লেনে উঠে মনে হ'ত
সত্যি সত্যি এটা আমার শহর ছিল
তো ! এছিল শেষ আশির
দশকের ভাবনা ।
তারপর
হাইরাইজ, শপিং
মল আরো ঝকঝকে সবুজ ল্যান্ডস্কেপ্,
ম্যানিকিওর্ড
টাউনশিপের সবুজ, তারমধ্যে
একরত্তি সুইমিংপুলের নীল
প্লেনের জানলায় ধরা দিল ।
এরোপ্লেনে উঠে ককপিটে গিয়ে
পাইলটের কেরামতি দেখা হত ।
দক্ষিণদিকে যাবার সময় পাইলট
আর কেবিন ক্রু'কে
রিকোয়েষ্ট করা হত বঙ্গোপসাগর
এলেই জানান দিতে, যেন
পুরীর মন্দিরকে ওপর থেকে একটা
ঢিপ করে পেন্নাম করে নিতে পারি
কিম্বা উত্তর দিকে গেলে বেনারসের
কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরকে ।
তখন পাইলটের দুনিয়া, প্লেন
চালানোর কেরামতি আর ঐ এক স্কোয়ার
ফুট জানলার মধ্যে দিয়ে নিজের
দেশের খুঁটিনাটি ঐশ্বর্য্যটাকে
তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করাটাই
ছিল বিরাট আনন্দের । আর রোদঝলমলে
দিনে হিমালয়ের মাথায় রূপোর
ঝালর ? সেটা দেখলে
মনে হ'ত প্লেনে
চড়ার পয়সা উশুল । মনে মনে
বিজ্ঞানকে ধন্যবাদ দিতাম ।
মুঠোফোনের
দুনিয়াটা কেমন ধীরে ধীরে বদলে
দিল জীবনকে ।
এল বেশ
গোদামাপের মুঠোফোন । তখন
এয়ারপোর্ট পৌঁছে বাড়িতে সংবাদ
দেওয়াটা ছিল আরো রোমাঞ্চকর
ব্যাপার । তারপর প্লেন ছাড়ার
ঠিক আগের মূহুর্তে সেলফোন অফ
করার আগে আরেকবার ফোন করে
জানানো...
এ কথাই
শেষ কথা নয়তো!
তারপর
সংক্ষিপ্ত বার্তাবিনিময় বা
এসেমেস চালু হল । আরো সুবিধে
হল । কম খরচে যোগাযোগ । মনে
মনে বিজ্ঞানের কাছে আমার
কৃতজ্ঞতার শেষ নেই ।
এবার
রঙীন সেলফোন । স্লিম এন্ড
ট্রিম । ক্যামেরাও আছে । ছবি
তুলে এমএমএস পাঠানো যায় ।
অপব্যবহারে বেশী কাটতি হলনা
এই এমএমএস প্রযুক্তির । মনে
মনে বিজ্ঞানকে কটাক্ষ করলাম
।
টেলিফোনে
সেলফোন প্রযুক্তির দুটি দিক
আছে । একটি হল হ্যান্ডসেটের
প্রযুক্তি আন্যটি হল সেলফোন
পরিষেবার প্রযুক্তি । এই দুটি
প্রযুক্তির মেলবন্ধনে গ্রাহক
নানারকম সুযোগ সুবিধে পেয়ে
থাকেন । গোড়ার দিকে সেলফোন
পরিষেবার যে প্রযুক্তি ছিল
সেটি ভয়েস বা কথা বহন করতে
পারত । সেই যুগের হ্যান্ডসেটের
প্রযুক্তি তা কেবল একটি রঙ (
মোনো ক্রোম্যাটিক)
অক্ষর এবং সংখ্যা
( আলফা নিউমারিক
তথ্য ) স্ক্রিনে
দেখাতে পারত । এর পরে পরিষেবার
প্রযুক্তি উন্নত হয়ে 2G বাঅ
দ্বিতীয় জেনারেশনে পৌঁছল ।
এই 2G পরিষেবা (GSM
বা CDMA)কথার
সঙ্গে ডেটা বা তথ্য বহন করতে
পারল ।
হাতের
তালুতে সেলফোনটি নিয়ে কেন
জানি বারবার মনে পড়ে যায়,
কোনো
এক টেলিকম কোম্পানির একদশকের
পুরোণো সেই বিখ্যাত শ্লোগানটিকে....
"কর
লো দুনিয়া মুঠ্ঠি মে"
সত্যি
তো এই মুঠোফোন পুরো দুনিয়াটাকে
হাজির করেছে আজ আমাদের হাতের
নাগালের মধ্যে । মোবাইলের
জন্মলগ্নে তার আকৃতি ছিল বেশ
বড়সড় । তারপর টেকনোলজির উন্নতির
সাথে সাথে সেটিও স্লিম হতে
শুরু করল ।
সেলফোন
হল যন্ত্র । মোবাইল পরিষেবা
তার যন্ত্রী । দুটিই উপচে
পড়ছে কারিগরী কৌশলে । এ বলে
আমায় দেখ তো ও বলে আমাকে । এই
দুটি প্রযুক্তির মেলবন্ধনে
গ্রাহক নানারকম সুযোগ সুবিধে
পেয়ে থাকেন ।
গোড়ার
দিকে সেলফোন পরিষেবার যে
প্রযুক্তি ছিল সেটি ভয়েস বা
কথা বহন করত । পরিষেবাটি 1G
বা
প্রথম জেনারেশান । সেই যুগের
হ্যান্ডসেটের প্রযুক্তি কেবল
একটি রঙ (
মোনোক্রোম্যাটিক)
অক্ষর
এবং সংখ্যা (
আলফা
নিউমারিক তথ্য )
স্ক্রিনে
দেখাত । এরপরে পরিষেবার
প্রযুক্তি উন্নত হয়ে 2G
বা
দ্বিতীয় জেনারেশনে পৌঁছল ।
এই 2G পরিষেবা
কথার সঙ্গে ডেটা বা তথ্য বহন
করল । সমতুল্য ভাবে হ্যান্ডসেট
প্রযুক্তি একরঙা স্ক্রিন এবং
অক্ষর ও অঙ্কের যুগপত গন্ডী
পেরিয়ে কম্পিউটারের মতন
গ্রাফিকাল আইকন ব্যবহার শুরু
করল ।
কিন্তু
যেহেতু পরিষেবা প্রযুক্তি
তথ্য বহনে সক্ষম সেই কারণে
কিছু নতুন সুযোগ সুবিধে পেল
গ্রাহক । যেমন এসেমেস এবং
সীমিতভাবে ইন্টারনেট ব্রাউসিং
।
এইভাবে
আন্তর্জালের সাথে মোবাইল
ফোনের গাঁটছড়া বাঁধা হল ;
মুঠোফোন
হ্যান্ডসেট নির্মাতারা নতুন
সুযোগ সুবিধে দেওয়া শুরু করল
যেমন ব্রাউসিং এর সাথে সাথে
ইমেল বা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং
। অসুবিধে হল একটাই । এই সব
আকর্ষণীয় সুযোগ সুবিধা ব্যবহার
করতে গেলে যতটুকু তথ্য বিনিময়
করতে হয় সেটি 2G
পরিষেবা
প্রযুক্তি সামাল দিতে পারল
না । পরিষেবা প্রযুক্তি আরো
একধাপ এগুলো ।
2G
গন্ডী
পেরিয়ে এইবার মাঠে নামল 3G
বা
তৃতীয় জেনারেশান মোবাইল
পরিষেবা। 3G
পরিষেবার
বিশাল তথ্যবহনকারী ক্ষমতাকে
উপযুক্ত কাজে লাগানোর জন্য
হ্যান্ডসেট প্রযুক্তি উন্নত
হল ; আইফোন
এবং এন্ড্রয়েড ভিত্তিক মুঠোফোন
বাজারে ছেয়ে গেল । এই আইফোন
বা এন্ড্রয়েড ভিত্তিক
স্মার্টফোনগুলি আদতে এক একটি
ন্যানো কম্পিউটার যা ল্যাপটপ
বা ডেস্কটপের তুলনায় কোনো
অংশে কম নয় । 3G
বা
2Gপরিষেবা
ব্যবহার করে ইন্টারনেটের
সমস্ত সুযোগ সুবিধে যেমন
ফেসবুক,
ইউটিউব,
গুগল
ম্যাপস,
গুগল
সার্চ ,
জি
মেল,
ট্যুইটার
ও অসম্ভব মনোরঞ্জন কারক গেম
গ্রাহকের হাতের মুঠোয় পৌঁছে
গেল । 3G
তথ্যবহনকারী
ক্ষমতার পরিষেবা থাকলে সুবিধা
বেশী কিন্তু পুরোণো 2G
তেও
কাজ চলতে লাগল । এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র
কম্পিউটারের দুটো অসুবিধে
। তার ছোট স্ক্রিন আর ছোট
কিবোর্ড । কিন্তু 'কুছ
খোয়া কুছ পায়া'
।
কিন্তু কেয়া পায়া ?
যদি
বলি "নখদর্পণ"
? কারণ
কিবোর্ডের অভাবে এখন সমস্ত
হ্যান্ড সেট নির্মাতারা
অত্যাধুনিক টাচস্ক্রিন
প্রযুক্তি এনে দিয়েছেন যার
ফলে আঙুলের একটুকু ছোঁয়াতেই
নদী-পাহাড়-সমুদ্র
আমাদের নখদর্পণে ।
প্রাচীনকালে
যে অলৌকিক বিদ্যার সাহায্য
নিয়ে কোনো দূরের বস্তু বা
ব্যক্তির প্রতিবিম্ব নিজের
নখে প্রতিবিম্বিত করে দেখার
গল্প শোনা যায় সেই কি এই প্রযুক্তি
?
তুফানি
আড্ডার ফাঁকে,
সেদিনের
তিথি নক্ষত্র নিয়ে তুমুল তর্ক
বেঁধে গেলে,
সন্দেহ
নিরসনের কায়দায় এই মুঠোফোনটি
পঞ্জিকার ভূমিকাও পালন করতে
পারেল হিন্দু ক্যালেন্ডার
এপ্লিকেশনটির কৃপায় ।
"ইউরেকা"
বলে
জিতে গিয়ে বলেও দিতে পারেন
"হাতে
পাঁজি মঙ্গলবার"
!
বেড়াতে
গিয়ে সমুদ্রের ধারে সূর্যোদয়
দেখার কাঙাল আমি । কিন্তু
ভোরের ঘুমও যে ছাড়েনা দুচোখকে
। তাই গুগল সার্চ করে টাইম
এন্ড ডেট ডট কম থেকে সানরাইজ
@ পুরী
পেয়ে গেলাম আগের দিন রাতে ।
ঐ স্থানের সূর্যোদয়ের নির্ঘন্ট
জেনে রেখে ঘড়িতে এলার্ম । ফলে
সমুদ্রের ধারে গিয়ে ঘুমচোখে
সূর্যদেবের আরাধনা করতে হ'লনা
। আমি গেলাম সময়মত । উনিও টুক
করে উঠে আমাকে দেখা দিলেন ।
রঙ ছড়াতে শুরু করলেন আকাশের
ভাঁজে ভাঁজে । মনে মনে বললাম
"ভাগ্যি
স্মার্টফোন ছিলি আমার হাতে
"!!!
কিন্তু
গল্প এখানেই শেষ নয়,
দিন
আগত ঐ !
যদি
ভারত সরকার সৌভাগ্যক্রমে 2G
আইনিজট
খুলতে পারেন তবে 4Gকে
আমাদের স্বাগত জানাতেই হবে
!!!