২১ মে, ২০১৮

যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক" / জেনে শুনে বিষ করেছি পান




ভোর ভরেছি ভেজালে । শুরু ভেজাল দুধ দিয়ে । তাতে নাকি মিশ্রিত চকের গুঁড়ো, ডিটারজেন্ট,এমোনিয়াম সালফেট, বোরিক এসিড, কস্টিক সোডা। হাঁস মুরগীর খাবারে Astaxanthin মিশিয়ে ডিমের কুসুম টুকটুকে কমলা করার পদ্ধতিও বহুদিনের। আর ব্রেড?  ময়দা নাকি সবচেয়ে বড় শত্রু  আমাদের শরীরের। কারণ প্রোসেসিং এর সময় সব নিউট্রিয়েন্টস ঝেড়ে পুছে ফেলে দেওয়া হয়। তবে ব্রাউন ব্রেড ? বেশীর ভাগ দোকানেই ব্রাউন ব্রেড ময়দা দিয়েই বানান হয় । আর বাদামীর কারণ ক্যারামেল। জানতেন না? কি করে জানবেন? উইক এন্ডে লঙ ড্রাইভে গিয়ে ধাবার খাটিয়ায় বসে মনের সুখে তন্দুরি রুটি আর মাংস খেয়ে সুখ ঢেকুর তোলেন নি? তখন জানতেন ওই মাংস ভাগাড়ের মৃত পশুর? 
তাহলে মুড়িই খান। সেখানেও মুড়িভাজার আগে নাকি ইউরিয়া মেশানো হয়। লম্বা লম্বা ধবধবে সাদা, ফুরফুরে জুঁইফুলের মত মুড়ি দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়ি আমরা। অথচ গ্রামের মেয়েরা যে মুড়ি নিয়ে বাজারে বসে সেগুলি অপেক্ষাকৃত মোটা, লাল মুড়ি। সেগুলোর দিকে ফিরে চাই না। পহেলে দর্শণধারী চাই যে আমাদের।       
চা' পাতায় রং করা কাঠের গুঁড়ো, লোহার গুঁড়ো । এবার চাল সেখানেও পাউডার মেশানো । নয়ত পোকা লেগে যাবে । সবজী তে পর্যাপ্ত পেস্টিসাইড। ফলন হবেনা যে। তুঁতে গোলা জলে সবজী ? টাটকা, সবুজ দেখাবে যে বহুক্ষণ। মাছ? সেখানেও বাইরে থেকে রোডামিন বি  ইঞ্জেক্ট করা কানকোর মধ্যে। মাছ কে তাজা দেখাবে তাই।
আর বিশেষ রোগে আক্রান্ত মরা মাছ সস্তায় কিনে এনে সস্তায় বিক্রি করা?  বা মরা চিকেন ফরমালিন দিয়ে তাজা রাখার কৌশল? ব্যাবসায়ীরা খুব ভালই আয়ত্ত করেছেন এসব।
মাংস? যাকে খাসি বলে ভাবছ, সে আসলে মেয়ে ছাগল। সরকারি নীল ছাপ মেরে ঝুলছে চোখের সামনে। মুরগী? তার মৃত্যু যে কবে হয়েছে না জেনে কিনলেই মরেছ তুমি। নতুন হাইপ। তাহলে খাবটা কি? হাওয়া খেয়ে থাকব?  পওহারী বাবার মত।

এই সেবার ম্যাগি নিয়ে গেল গেল রব উঠল। হেলে ধরতে পারিনা, কেউটে ধরতে যাই আমরা।

ফুড সেফটি এন্ড স্ট্যান্ডার্ডস অথোরিটি অফ ইন্ডিয়া নামে একটি খাদ্য নিয়ামক সংস্থা আছে।  কিছুদিন আগে যারা ম্যাগির মধ্যে নিষিদ্ধ সীসে আর আজিনামোতোর উপস্থিতিতে ম্যাগির গুষ্টির তুষ্টি করে ছাড়ল।  আচ্ছা তারা দেখতে পান না রাস্তার মোড়ের তেলেভাজা কিম্বা কচুরিভাজার দোকানের তেলের রং? বারেবারে উচ্চ তাপমাত্রায় তেল কে গরম করলে HNE(বা ৪-হাইড্রক্সি ট্রান্স-২ ননেনাল্) নামক যৌগটি ডিপ ফ্রায়েড ফুডে শোষিত হতে থাকে যা দীর্ঘদিন সেবন করলে কার্ডিওভাসকুলার এবং নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের সৃষ্টি করে।
সব্জির বাজারে উচ্ছে, পটল বা কাঁকরোল কে তুঁতের জলে ডোবানো ?  তুঁতে মানে কপার সালফেট। নির্ভেজাল বিষ মশাই। পোকা মারার অব্যর্থ দাওয়াই। মানে যাকে বলে ইনসেকটিসাইড। 
মাঝেমাঝেই কর্মকর্তারা নড়েচড়ে বসেন খাদ্যের মান নির্ধারণ নিয়ে। কমিটি গঠন হয়। সব্জিতে রং মিশিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে ব্যাপারী।  টিভি চ্যানেলে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়।  এগুলি জামিন অযোগ্য অপরাধ বলে। তারপর চুপচাপ । কোয়ালিটি কন্ট্রোল হবে, অপরাধীর সাজা হবে। স্তোক দেওয়া অব্যাহত থাকে। পরিকাঠামোর অভাব আছে বুঝি? কেন্দ্র দেবেন না অনুদান? ভাইটাল ব্যাপার।

নাগরিক স্বাস্থ্য বলে কথা। আর অনুদান পেলে বেসরকারী সংস্থারা এগিয়ে আসছেন না কেন? ফুটপাথীয় ফার্ষ্টফুডের রমরমা চলতেই থাকবে?  মরুক মানুষ। মরুক সমগ্র জাতি। তৃতীয় বিশ্বে এমনি হবেক। বিদেশে কিন্তু খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের বিশেষ সেল থাকে। তারা গুণমান দেখে। আর আমরা কিনা দেখি হোটেলের সিংকের নীচে স্তূপীকৃত নুডলস সেদ্ধ তে আরশোলার সানন্দে চরে বেড়ানো।  নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাব প্রায়শ‌ই দেখি নড়েচড়ে বসেন। লম্বাচওড়া বাতেলা আওড়ান । কিন্তু তারপরেও কচুরীর ভাজার তেলটি বদলানো হয় না দিনের পর দিন। আমাদের আর্থসামাজিক পরিস্থিতিটা এমনি থাকবে মশাই?  আমরাও  ঘুমে অচেতন থাকব।  আমাদের উচিত তর্পণে গাঙ শুকোয় । এত কাজ কে করবে বলুন তো?

হলুদ গুঁড়োর সঙ্গে মিশ্রিত থাকে হলুদের চেয়েও উজ্জ্বল কার্সিনোজেনিক লেড ক্রোমেট। আর টকটকে লাল লঙ্কার গুঁড়োয়  ? লাল cayenne পাউডার মেশানো হয়।  এই রং না মেশালেই নয়? আজ কি তাই ঘরে ঘরে এত কিডনির অসুখ ?  রান্নাঘরে এমন থৈ থৈ ভেজাল আমাদের। এছাড়া ঐ সব মনোহারী শরবত, দর্শনধারী বোতলবন্দী পানীয়? গ্রিন ম্যাঙ্গোয় ম্যালাকাইট গ্রিন, টুকটুকে লাল গোলাপের মত পানীয়ে কঙ্গো রেড বা এলিজারিন? এ সব রাসায়নিক আমাদের শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক । ভোজ্য সর্ষের তেলে রেড়ির তেল, শিয়ালকাঁটার তেল, আর্জিমোন অয়েলের  উপস্থিতি তো সর্বজনবিদিত।? সেও তো ড্রপসি, অষ্টিও আরথাইটিসের কারণ। বেসনের মধ্যে খেসারির ডালের গুঁড়ো? সেও তো মারাত্মক। গোলমরিচের মধ্যে পেঁপের শুকনো বীজ মিশিয়ে দেওয়া? জানেন এইসব কারণেই লিভারের সমস্যা থেকে দৃষ্টিশক্তি, নার্ভ থেকে আর্থাইটিস এসব রোগ অপ্রতিরোধ্যভাবে বেড়েই চলেছে। মিষ্টির দোকানে রূপোলী তবক দেওয়া মিস্টিগুলি দেখেই কিনতে ছোটেন তো? একদম না। ওগুলি তো ক্রেতা কে আকৃষ্ট করার উপায়। যাহা চকচক করে তাহা বিষ। জেনেশুনে বিষ পান করবেন কেন? অন্য মিষ্টি নিন। এই এলুমিনিয়াম ফয়েলে পেটের সমস্যা হয়। এযুগের আরেকটা হাইফাই ব্যাপার হল সুগারফ্রি মিষ্টি? চিনির বিকল্প হিসেবে ব্যাবহৃত স্যাকারিন সস্তা কিন্তু ব্যানড বহুদিন। আর এসপার্টেম অথবা সুক্রালোজ? কোনোটাই দরকার নেই আমাদের শরীরে। চিনি বাদ দিন। বিকল্প খাবেন না। আর মন না মানলে একটু চিনি ই খান। সুগার ফ্রি নৈব নৈব চ। 
টালা থেকে টালিগঞ্জে, বালি থেকে বালিগঞ্জে, খিদিরপুরে অথবা ভবানীপুরে, মল্লিকবাজার কিম্বা বাগবাজারে সর্বত্র‌ই জেনেশুনে বিষ পানের বিশাল আয়োজন কিন্তু। টিভি বলবে জাগো গ্রাহক জাগো। ক্রেতা সুরক্ষার কচকচি আওড়াবেন নেতারা। কিন্তু শরীর আমার। স্বাস্থ্য‌ও আমার। সেখানে নো কম্প্রোমাইজ। 

বিশ্বসংস্থার স্বাস্থ্য রিপোর্টে আবারো হুঁশিয়ারি। চাপান উতোর। জলঘোলা। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশেও ভবি ভোলার নয়। অতএব জুভেনাইল হৃদরোগ, স্নায়ুরোগ, ক্যানসার ইত্যাদি মারণরোগের বাড়বাড়ন্ত, এটাই সত্য। ওবেসিটি আজকের সমাজের অভিশাপ। এও সত্য।

এখন আবার শুনছি একজনের এঁটো পাতকুড়োনোও দিব্য চালান হচ্ছে অন্যের প্লেটে। রেস্তোঁরার ফ্রিজের খাবারদাবারে নাকি পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাংগাস। টেলিভিশনে টক শো। হট কেক টপিক। দেখেছেন তো? হ্যান করেঙ্গা, ত্যান করেঙ্গা। রেস্তোঁরার ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করেঙ্গা। চার্জশিট পেশ। জরিমানা, কারাবাস। আবার সব ধামাচাপা। 
আরো কত বলব? স্বনামধন্য ফুড ব্র্যান্ডে চানাচুরে নাকি বহুদিন কুড়মুড়ে রাখার জন্য মার্বেল ডাস্ট মেশানো হয়? অথবা কেশরী বিরিয়ানী কিম্বা রাবড়ি তে মেটানিল ইয়েলো? এটি ক্যানসারকারক কেমিক্যাল। তবে এবার যারা সক্কলকে ঘোল খাইয়েছেন ভাগাড়ের পচা মাংস বেচে তাদের রাজ্য-শ্রী এওয়ার্ড দেওয়াই যায় সত সাহসের জন্য।
হিমঘরে উদ্ধার হওয়া এই মাংসের মধ্যে কুকুরের মাংসও রয়েছে। বজবজ থেকে রাজাবাজার, ধাপার মাঠ থেকে সোনার পুর, এমনকি বিহার অবধি ব্যাপ্তি এই মাংস চক্রের।   এজেন্ডা হল এমনি। পশুর মৃত্যু, কোল্ড স্টোরেজ, কেমিক্যালস প্রয়োগ, আবারো হিমঘর তারপর প্যাকেজিং। ব্যাস! আম আদমীর ঘরে পৌঁছে যাবার সুনিপুণ ব্যবস্থা।
লজ্জা, ঘেন্না, ভয়, এই তিনের কোনোটিই নেই এই চক্রের। অতএব ব্যবসার খাতিরে গো এহেড!  যতদিন না ধরা পড়ছি লজ্জাই বা কিসের্, ভয় ই বা কেন আর ঘেন্না? ওসব থাকলে কেউ ভাগাড়ের মাংস মানুষের খাবারের জন্য ভাবতে পারে?  ছিঃ আমার তো ভেবেই ঘেন্না করছে। 
কিছু মানুষের অবিশ্যি ভাবখানা এমন যে, ভাগাড় থেকে মৃত পশুর টন টন মাংস সস্তায় বিকোচ্ছে বুঝি? ঠিক আছে ক'দিন মাংস খাব না বাবা। তারপর? তার আর পর নেই। পচন ধরা আমিষ অথবা কৃত্রিম রং মেশানো খাবারদাবার। সব গা সওয়া আমাদের। অতএব যা চলছে চলুক। তৃতীয় বিশ্বের চতুর্থ শ্রেণীর নাগরিকদের এমনি প্রাপ্য।
আবার স্যাম্পেল এনালিসিস হবে। ঠগ বাছার প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে । কসাই ধরপাকড় হবে । ফরেনসিক এক্সপেরিমেন্ট হবে। উদ্দিষ্ট চক্র ছাড়াও পাবে। আপনার আমার নাকের ডগায় আবার বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে তারা । একদিন এ ঝড় ঠিক থেমে যাবেই। পৃথিবী আবার শান্ত হবেই। 
মাংসাশী মানুষ তখন আবার জোর কদমে ঘেন্না, ভয় ভুলে মাংসের ঝোল খাবে কব্জি ডুবিয়ে। বলবে খেয়ে তো নি আগে, তারপর দেখা যাবে। জেনে শুনে বিষ পান? ওসব রবিঠাকুরের কাব্যেই হয়। আমাদের কি এসে যায়?

যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক"

যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক" / কে দেবে গো মায়েদের বেকারভাতা ?

মায়ের দিন? সে ত রোজদিন। মা-দিবসের প্রাক্কালে এ আর এমন কি? দেশের অগণিত মায়েদের জন্যই এ লেখা।  সেই আসনতলে, মাটির পরে তাদের স্থানটি বেশ শক্তপোক্ত তো এখনো? না মানে আজ কেবলই গৃহবধূ মায়েদের কথাই মনে করছি। এক একটা দিন এই অবলা গৃহবধূদের কথা খবরের কাগজে শিরোনামে স্থান পায়। মনে পড়ে? উত্তরপ্রদেশের গৃহবধূ রেণু আগরওয়ালের রোড একসিডেন্টে মৃত্যু? তার স্বামী অরুণ আগরওয়াল আদালতের দ্বারস্থ হয়ে ইন্সিওরেন্স কোম্পানির থেকে  ক্ষতিপূরণ স্বরূপ ১৯.২ লক্ষ টাকা দাবী করেন আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে। এলাহাবাদ হাইকোর্ট, এবং মোটর একসিডেন্ট ক্লেম ট্রাইব্যুনাল সেটি মেনে নিল না এবং তখনই শুরু গৃহবধূ ওরফে হোমমেকার চ্যাপটার । একজন গৃহবধূর ন্যাজ্য মূল্য কি হতে পারে সেই নিয়ে চাপানউতোর ।  গৃহবধূর প্রাণের মূল্য থেকে একজন হোমমেকারের income potential সব উঠে এল। পার্লামেন্টে ও চিন্তা ভাবনা শুরু হল।  এই হোমমেকারের সঠিক মূল্য কত হওয়া উচিত?  আর সংসারে তার অবদান কড়ায় গন্ডায় হিসেব করে একটি ন্যাজ্য মাপকাঠিতে তার জন্য একটি পে-রোল স্ট্রাকচার খাড়া করা যায় না কি?  তাহলে রেণুর মত কোনো গৃহবধূর পথ দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলে তার স্বামী যাতে ন্যাজ্যমূল্যের অঙ্কটি ক্ষতিপূরণ রূপে পান ।
অন্যথায় সেনসাস 2001 অনুযায়ী ৩৬কোটি এরূপ গৃহবধূ মা' কে ভিখারিণী, বারবণিতা এবং বন্দিনীর সঙ্গে একই আসনে সেবার রাখা হল কারণ এই চার ধরণের মায়েরা নাকি অকর্মার ঢেঁকি এবং দেশের nonproductive population এর মধ্যে পড়ে তারা । এর অর্থ মায়েরা তবে র‌ইলেন অবহেলিতা, স্থান পেলেন না সেই আসনতলে? পেলেন না তাঁর কাজের প্রাপ্য মূল্য ।

ভিখারীনি মা দেশের অর্থনীতিতে কিছু contribute করেনা। কিন্তু ভিখারীনি তার লোটা-কম্বল সম্বল করে ফুটপাথের স্নিগ্ধ সুশীতল ছায়াতরু তলে লালন করেন তার সংসার। কেউ কি স্বেচ্ছায় ভিক্ষা করে ? তাঁর প্রাপ্য মর্যাদাটুকু কে দেবেন?
বন্দিনী মা ? সেও তো অর্থনীতিতে এক নয়া পয়সা contribute করে না বরং উল্টে তার জন্য সরকারের প্রচুর টাকা ব্যয় হয় । বারবণিতা মা, ত স্টেজ পারফর্মারের মত মনোরঞ্জন করছেন জনতার । তিনি  সমাজে না থাকলে ঘরের মায়েদের রাস্তায় টেনে আনা হত। তিনি নৈতিক না অনৈতিক কাজ করছেন সেটা আলোচনার বিষয় বস্তু নয় কিন্তু তিনি উত্‌পাদনে তথা দেশের জিডিপিতে পরোক্ষভাবে কিছু contribute করছেন  । তাকে আন-প্রোডাক্টিভ বললে তো সিগারেট বা লিকার মার্চেন্টদেরও সেই পর্যায়ে ফেলতে হয়  ।
এদের সঙ্গে একবার হোমমেকারদের পঙতিভোজনে বসানো হয়েছিল সেবার। আজ মা দিবসের প্রাক্কালে কেবলই এই প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে। দেশের গ্রস ডোমেষ্টিক প্রোডাক্ট বাড়া কমায় একজন হোমমেকারের অবদান তবে কি শূন্য ?
এবার বলি ?  "শিশুরাই জাতির ভবিষ্যত'।  তা বলি এই শিশুদের দশমাস দশদিন নিজের জঠরে ধারণ করে, তারপর জন্মের পর থেকে  মায়ের স্নেহটি দিয়ে লালন করেন সেই মা । আবার তাকে স্কুলের জন্য তৈরী করে, পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করে তাকে কত টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে মানুষ করেন কে শুনি ? আর ঘর গেরস্থালী? বাড়িতে কাজের লোক না এলে, বাড়ির সব লোকের দেখাশুনো করা থেকে শুরু করে ইলেকট্রিক বিল, টেলিফোনবিল জমা দেওয়া, ডাক্তার ডাকা, প্রত্যেক সদস্যের জন্য কাস্টমাইজড সার্ভিস দেন এই মা । কথায় বলে "খুজরো কাজের মুজরো নেই' । তাই  গৃহবধূ মা'দের কাজের কোনো দাম নেই । অনেকে বলেন  "বাড়িতে থাকো, কি আর কর, আমাদের মত  দশটা-পাঁচটা তো আর করতে হয়না'  বা "বুঝতে ঠেলা যদি বাইরে বেরোতে হত, তুমি আর কি কর, রান্না ? সে  কাজ তো সবাই পারে'।
অতএব মা তার দৈনন্দীন কৃতকর্মের জন্য  অর্থনৈতিক ভাবে উতপাদনশীল বলে আখ্যা পাক অন্ততঃ । নয়ত তারা কেবলই দেশের জনসংখ্যা বিস্ফোরণের দায়টি মাথায় তুলে নিয়ে তাদের উত‌পাদনহীনতার মুকুট পরে বসে থাকবে  আজন্মকাল । একটি কোম্পানির সারাবছরের হিসাবের খাতাটিকে বলে অ্যানুয়াল রিপোর্ট যেখানে দুটি টেবল থাকে একটি ব্যালেন্সড শিট অন্যটি লাভ-ক্ষতির হিসাব; এই মা  সেই দেশের অর্থনৈতিক হিসাবের খাতায় ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রতিপালন করে জাতীয় সম্পদ বা capital asset তৈরী করছেন । চুলোয় যাক বাসন মাজা, ঘরপোঁছা, রান্না করা, ঝুল ঝাড়া । লাভ-ক্ষতির একাউন্টে তাকে না আনাই শ্রেয় । তিল তিল করে সঞ্চিত হচ্ছে সেই সব ধনরত্ন সেই শিশু নাগরিকের মধ্যে । যার মধ্যে থেকেই কেউ গিয়ে নাসায় রকেট চড়ছে, কেউ বৈজ্ঞানিক হয়ে জীবনদায়ী ওষুধ তৈরী করছে, কেউ বানাচ্ছে  অটোমোবাইল, কেউ বা হচ্ছে সৌরভ, লিয়েন্ডার-বিশ্বনাথনের মত কিম্বা রবীন্দ্রনাথ, অমর্ত্য সেনের মত নোবেল লরিয়েট !
আর সেই মা যিনি নেপথ্যের নায়িকা? ভোর থেকে রাত্রি পর্যন্ত সংসারের স্টিয়ারিংটি হাতে নিয়ে সংসারটিকে চালনা না করতেন তাহলে জানিনা কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়াত । তাঁর প্রতিপক্ষ বলবে কারোর জন্য কারোর আটকায় না কিন্তু যতক্ষণ দাঁত থাকে ততক্ষণ দাঁতের মর্যাদা বোঝা যায় না । বাড়ির যে খরচাগুলি সেই মহিলা বাঁচান ততটাই টাকা রোজগারের সমতুল্য ।

আর মা তাঁর সেই ব্যস্ততায় ছেলের জ্বরে মাথায় জলপটিতে ওডিকোলন, নুন-হলুদ মাখা আঁচলে পোঁছেন মেয়ের টিফিনকৌটোটি, স্বামীর ওয়ালেট্, রুমাল, কলম হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন অফিসের তাড়ায়, তারপর বাজারের ব্যাগ হাতে বেরোন ইলেকট্রিক, টেলিফোন বিল, গ্যাসের দোকান, ওষুধের দোকান,  আর এটিএম মেশিনের লাইনে ।

মায়েদের জীবন অনেকটাই বহুজন হিতায়, সুখায় চ। এ নারীর বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না । তাই চালু হোক গৃহবধূ মায়ের বেকারভাতা।

যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক"

যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক" / তথ্যচুরি ভুরিভুরি


গেল গেল রব উঠল। সব ডেটা নাকি উধাও। ফেসবুক থেকে সব তথ্য নাকি চুরি হচ্ছে। এমন কি অ্যান্ড্রয়েড ফোনে লোকেশান অন্  করলেও গুগল আমাদের সব গতিবিধি জেনে যাচ্ছে। জি-মেইল এর প্রত্যেকটি ই মেইলের অ্যালগরিদম নাকি ওরা পড়ে । আর সেই বুঝে আমাকে অ্যাড দেখায়।  হোয়াটস্যাপের প্রত্যেকটি মেসেজ নাকি ফেসবুক কর্তাদের রেকর্ডে থাকে। কি জ্বালা রে বাবা! অথচ আমরা এখন প্রত্যেকেই সোশ্যালনেটওয়ার্কিং সাইটের দলদাস। আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা। তাই বলে আমার একান্ত আপন জীবনপঞ্জীতে নাক গলানোর কে হে তুমি ? কোথাকার হরিদাস পাল ই বা আমি যে আমার সবকিছু ডেটা তোমার নখদর্পণে রাখাটা জরুরী? সেদিন এই নিয়ে একজন ডেটা সায়েন্টিস্ট এর পোস্ট টা মনে রাখার মত । “if you are not paying for the product then you are the product” আর তাই বুঝি এইসব ফ্রি সার্ভিস। যা কিছু ফ্রি তাই সস্তার। কথায় বলে সস্তার তিন অবস্থা। তাই বলে আলাপচারিতার তথ্যও সস্তা। হ্যাঁ, ওদের মারফত তথ্য যখন অবাধে বিকোচ্ছে তখন সস্তা ত বটেই । যত্তসব ধান্দাবাজের কারবারি। ফ্রি তে পাওয়া বলেই এত বাড়বাড়ন্ত ওদের। অতএব  যখনি ফ্রি কোনো পরিষেবা পাচ্ছ তখনি কেয়ারফুল। আমাকে কেন সে দিচ্ছে এই পরিষেবা? নিশ্চয়‌ই বিনিময়ে আমাকে ইউজ করছে। আমাকে মানে আমার প্রোফাইল সম্বলিত ডেটাকে বা তথ্যপঞ্জী কে।

হঠাত সেদিন ঘুম ভেঙে গেল মাঝরাত্তিরে। চোর ঢুকেছে। রাতবিরেতে চোর ঢুকলে চীত্কার করে সিকিউরিটি ডেকে, থানায় ফোন করে কিছু একটা ব্যবস্থা নিতে পারি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখছি গুগল, ট্যুইটার, ফেসবুক, হোয়াটস্যাপ এ আমার ডেটা বেস থেকে আমার ডেটাগুলো নিয়ে ওরা কিসব করছে। শুধু আমার নয়। সকলেরি এই প্রবলেম। ইউজারদের তথ্য ভান্ডারে উঁকি দিচ্ছে ওরা প্রতিনিয়ত। শুধু উঁকি নয়। রীতিমত হানা দিয়ে তথ্য চুরি করে বিজনেস অ্যানালিসিস করাই ওদের কাজ। ডেটা পরখ করেন এইসব ডেটা অ্যানালিস্ট রা।  কি করেন ডেটা পরখ করে? মেঘের মধ্যে বসে আছি আমি আর আমার সোশ্যাল নেটের বন্ধুবান্ধবরা। আড্ডা জমে উঠেছে। কেউ ব্লগ লিখছিলাম মনের সুখে। কেউ ইমেইল পাঠাচ্ছি দরকারে। কেউ ফেসবুক অলিন্দে কমেন্টের ফোয়ারা ছোটাচ্ছি। কেউ হোয়াটস্যাপে গুলতানি । আর ডেটা সায়েন্টিস্ট রা আমাদের আড্ডা মহলের প্রলোভন দেখানোর সুযোগে সব ডেটা মাইনিং করে ফেলছে। আসলে এটাই তাদের রুজি রোজগার। থৈ থৈ ডেটা চাই তাদের।
আমরা কি তবে এদের হাতে বিক্রী হয়ে যাচ্ছি প্রতি মূহুর্তে?  
এইসব ছাইপাঁশ ভাবছিলাম আর ঘন নীল মেঘ সমুদ্রে বোঝাই করছিলাম তথ্য। কেউ কবিতা, কেউ গল্প, ভ্রমণবেত্তান্ত, কেউ রাজনীতির কূটকাচালী আর ছবি। তথ্য প্রযুক্তির ভাষায় একেই কয় ক্লাউড কম্পিউটিং। নিজের মেশিনে ডেটা না বোঝাই করে মেঘের মধ্যে মানে ডিজিটাল মেঘ সমুদ্রে থরে থরে ভরে দাও তথ্য। দরকার মত ঘাড় ধরে মেঘের মধ্যে ঢুকে বের করে নাও তোমার ডেটা। সবই ত ক্লাউড কম্পিউটিং।  ওরা জানছে। আর সেইজন্যেই তো আমাকে টার্গেট করে সুতীক্ষ্ণ বিজ্ঞাপন দেখিয়ে প্রভাবিত করছে। ক্লিক করলেই রেভিনিউ পাচ্ছে। ব্যাবসার প্রোটোকল। ধরুণ আমি একটি বিশেষ ব্র্যান্ডের পোষাক পচ্ছন্দ করি। ফেসবুকে ঢুকলেই তাদের রঙচঙে সেই বিজ্ঞাপনে ক্লিক করি। আর সেই সুযোগ নেয় ওরা। যতবার আমি ফেসবুকে ঢুকি সেই বিজ্ঞাপন ওরা আমাকে দেখাতে বাধ্য। ই কমার্সের সুযোগ নেব কি নেব না সেটা অন্য কথা।জিনিষটি কিনলে লাভ সেই কোম্পানির।কিন্তু এক ক্লিকেই তথ্য প্রযুক্তির কৌশল "আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স' প্রযুক্ত হল আমার ওপর। এ আই এর চোখ ঘুরছে অহোরাত্র। ফেসবুক ইউজারের ক্লিক ক্লিক মানেই তাদের ফেসবুক থেকে রেভিনিউয়ের ঝুড়ি উপচে ওঠা। এই ত সুযোগ মুরগী করার।
আসলে "ব্যাবসার জাল পাতা যন্ত্রজালে, কখন কে ধরা পড়ে তলে তলে'  
এর সঙ্গে রয়েছে  গরগরে প্রলোভনে পা দেবার তথ্যচক্র। তোমার প্রিয়, প্রিয়তর, প্রিয়তম বন্ধু কে,  মানের ক্রমানুসারে উঠে আসবে মাত্র একটি ক্লিকে। তুমি যাকে যত বেশী মেসেজ কর সে প্রিয়তম হতে বাধ্য। যার ছবি বা স্টেটাস আপডেটে নিয়মিত কমেন্ট কর সে প্রিয়তর আর যার পোষ্ট কেবল বুঝে বা না বুঝে লাইক মেরে পালাও সে থাকছেই প্রিয়র তালিকায়। জানো কি? 
আরো আছে। তুমি কোন বলিউড সুন্দরীর মত দেখতে অথবা কোন সেলিব্রিটি কে তোমার সবচেয়ে পছন্দ, শচীন না সৌরভ এসব জানতে চেয়েও ফাঁদে ফেলা যায়। একটাই উদ্দেশ্য কাজের ফাঁকে মুঠোফোনের এক ক্লিকে ফেসবুক বা গুগল আইডি দিয়ে লগ ইন, দেন স্টার্ট(ওদের কাছে তোমার ডেটা পৌঁছচ্ছে কিন্তু)। আর তারপর বিন্দাস! উতল হাওয়া। ঝলমল করে উঠল চিত্ত। উত্তর দেখে চমকিত আমি ও তুমি। আর মাঝখান থেকে ওদের ডেটা কালেকশান আর তারপর মাইনিং বা হান্টিং যাই বল।
মেঘের কোলে বসে ভাবছিলাম আবারো। তবে কে আমি ? বা আমার মত নগন্যের এহেন ডেটাবেস? হাতে স্মার্ট ফোন, কোলে ল্যাপটপ, ব্লগ লিখছি আমি। হাত নিশপিশ ক্লিকের জন্য। কিন্তু আর নয়। ক্লাউডে ভাসছে সব ডেটা। ওরা খুঁড়ে ফেলছে ডেটার খনি। ফেসবুকের নীল স্ক্রীনে আমার চোখ। মেঘের আড়াল থেকে বিভীষণ যুদ্ধ করেছিলেন না? আমিও তাই করি? নক্ষত্রপুঞ্জ ধেয়ে আসছে আমার দিকে। মহাস্থবির গ্রহেরা হাঁ করে গিলছে আমাকে।  সতর্কবাণী তাদেরঃ বুঝেসুঝে চলো হে! কেয়ারফুল্! তাই বলে কেয়ারলেস নয় কিন্তু'
 আমি কি তবে চুরি হয়ে গেলাম? ঘুম ভেঙে যায়। স্বপ্নের জাল ছিঁড়ে দেখি ধুস্! আমার মত নগন্য পাবলিকের গোলাপ না পলাশ কি প্রিয় জানতে চেয়ে প্রশ্নবাণ আবারো ধেয়ে আসছে আমার দিকে। আমি এড়িয়ে যাই এবার। কারণ কয়েক বছর আগেই  নীল রং না লাল রং সেটা সাধারণ লোকেদের কাছে জানতে চেয়েই ক্ষুদ্রতর স্বার্থ বৃহত্তর স্বার্থে প্রতিপন্ন হয়েছিল। সে ডেটা হান্টিং ছিল নীল পার্টি না লাল পার্টির পক্ষে না বিপক্ষে জানার কৌশল। আর তলে তলে আমেরিকার ভোটযুদ্ধে ফেসবুক ইউজারদের রাজনৈতিক প্রেম কোন দলে সেই তথ্যটুকুনি ওরা কাজে লাগিয়ে নিল সুকৌশলে। অর্থাত ভোটদাতারা প্রভাবিত হল এভাবেই। বিজ্ঞাপনের দ্বারা। এবার বুঝুন আপনি। কি করবেন। 
যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক"

যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক" / পরীক্ষা বাতিল

 
এখন পরীক্ষা হয়ে যাবার পর ক্যান্সেল শুনলেই  মনে পড়ে যায় ১৯৮৪ সালের কথা। সে আশির কথা ভাবলে এখনো বিস্ময়ে হতবাক হ‌ই। আশি না আশীবিষ এ শহরের বুকে? আমি তখন ঊণিশ-কুড়ি। আমার গর্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম পরীক্ষা পার্ট ওয়ান অনার্স শুরু। তারিখ ৫ইজুন, সাল ১৯৮৪। ৪ঠা জুন থেকে প্রচন্ড বৃষ্টির দাপটে পুরো শহর জলমগ্নতায় ।  সিট পড়েছিল কলেজস্ট্রীটের জলজমার আড়ত সংস্কৃত কলেজে। খবরে শেষ অবধি কোনো ঘোষণা হলনা পরীক্ষা স্থগিতের। অগত্যা চাল-চিঁড়ে বেঁধে সব বন্ধুরা হাজির হতে শুরু করলাম সংস্কৃত কলেজের দোরগোড়ায়। পরীক্ষা দিয়ে উদ্ধার হব আমরা। উদ্ধার করবেন আমাদের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়। 
হরিপাল থেকে দত্তপুকুর, আলমবাজার থেকে বাগবাজার, নিমতলা থেকে শ্যামবাজার....সকলেই চলেছি এক‌ই দিকে। মাথায় অনার্স পরীক্ষার চিন্তার জটগুলো ক্রমশঃ পাকিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্নপত্র সোজা না কঠিন হবে সে প্রশ্নটা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়ে আপাততঃ শ্যামবাজারে বাস থেকে নেমে পড়তে হল। বাস আর যাবেনা। বিধানসরণী, ভূপেন বোস এভিন্যু, সার্কুলার রোড, সর্বত্র জলময়। পরীক্ষা শুরু দুপুর বারোটায়। চারঘন্টা মেয়াদ তার।  সমুদ্রে পেতেছি শয্যা, শিশিরে কি ভয়! কলকাতায় জন্মে অবধি জলজমা দেখে আসছি, তাই বানভাসি শহর নতুন নয়।  
এক টানা রিকশোতে চড়ে বসলাম। রিকশার পাদানিতে জল থৈ থৈ । আকাশটা থমথমে। বৃষ্টি নেই কিন্তু মেঘ আছে । আমাদের পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে  আকাশেরো যেন চাপা দুঃখ । ব্যাগে এক্সট্রা পোষাক আছে অতএব চিন্তা নেই। এখন ধ্যান, জ্ঞান শুধু সংস্কৃত কলেজে আমার জন্য নির্ধারিত বেঞ্চিটি। হাজির হলাম ফড়িয়াপুকুর, হাতিবাগান, হেদুয়ার বন্যা পেরিয়ে। তখন বাজে সকাল সাড়ে দশটা। ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে থাকল। বারোটার আশেপাশে পরীক্ষা শুরু হবার কোনো লক্ষণ দেখলাম না। এবার ঘোষণা হল, প্রশ্নপত্র হাজির হয়নি তাই পরীক্ষা মনে হচ্ছে স্থগিত হবে। তখন দেখি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বন্ধুবান্ধবরা জলে ভিজে এসে গেছে ঠিক সময় মত। বাড়ি চলে যাবার ধান্দা করছি, তখন ঘোষণা হল প্রশ্নপত্র এসেছে, পরীক্ষা শুরু হবে বেলা দুটোর সময়। আমাদের পেটে তখন ভুখছানি। চারঘন্টা ধরে মাথা খাটিয়ে কেমিষ্ট্রি অনার্স পেপার ওয়ান দেব। জীবনে প্রথম। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা, পার্ট ওয়ান বলে কথা!
ঠিক দুটোর সময় যখন হলে প্রবেশ করলাম তখন ইলেকট্রিকের কেবল ফল্ট হল। ঝুপসি অন্ধকার ক্লাসরুম। টেবিলে একটা করে মোমবাতি এল। পরীক্ষা শুরু হল। জানা জিনিষগুলো তখন মনে হতে লাগল অজানা। সোজা উত্তরগুলো মনে হচ্ছিল ভীষণ কঠিন। পেরোলাম চারটে ঘন্টা। খাতা জমা দিয়ে এলাম । খাওয়াদাওয়া নেই। জল জমে আছে তখনো। বাড়ি ফিরলাম একরাশ মনখারাপ নিয়ে। শরীরটাও যেন ট্রমাটাইজড। পার্ট ওয়ান শুরুটা মনের মত হলনা। বাড়ি ফিরে দূরদর্শনের খবরে ঘোষণা করা হল সেদিনের সেই কাঠ খড় পোড়ানো পাহাড়ে ওঠার  পার্ট ওয়ান পরীক্ষা ক্যানসেল হয়েছে।  এই হল আমাদের  শিক্ষা ব্যবস্থা। নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়নি রক্ষে!
উতরেছিলাম ঠিকই কিন্তু সেবারের পার্টওয়ান এই ঘটনা আমার জীবনকে নাড়া দিয়েছিল।  পরেরবছর পার্ট টু পরীক্ষা। থিওরির পর প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার সিট পড়েছিল আরেক নাম করা ছেলেদের কলেজে।  সেখানে পৌঁছে রোল নাম্বার অনুয়ায়ী লটারীতে নির্ধারিত স্যাম্পল সল্ট অ্যানালিসিসের শিশিটি  হাতে নিয়ে ল্যাবরেটরিতে প্রবেশ করতে যাব, এমন সময় ল্যাবের একজন অ্যাসিট্যান্ট আমাকে চুপুচুপি ডেকে বলল
"তোমার অজানা সল্টের স্যাম্পলে কি আছে জানতে চাও? পার সল্ট চল্লিশ টাকা লাগবে।" তাহলে আমি আর টেস্ট না করেই শুধু লিখে খাত জমা দিয়ে ফুল মার্ক্স পেয়ে বেরিয়ে যাব। রোল নাম্বার সাঁটা শিশির গায়ে। রেজিষ্টার খুলে সেই ল্যাব অ্যাসিট্যান্ট যেন হাঁ করে বসে আছে। প্রত্যেককেই সে এমন প্রস্তাব দিচ্ছিল। কেউ টোপ গিলছে কেউ গিলছেও না। সাদা, লাল, নীল, সবুজ, কমলা...কত রংবেরংয়ের সল্ট স্যাম্পল। দুটি করে রাসায়নিক যৌগ আছে যার মধ্যে । নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টেস্ট করে বের করতে হবে সেই দুই যৌগের নাম। কেমিষ্ট্রি যারা পড়েছে তারা জানে এ হল সবচেয়ে কঠিনতম প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা।  
অন্যায়ের সঙ্গে কোনোদিনো আপোষ করিনি তাই নিজে নিজেই লড়ে সেই সল্ট অ্যানালিসিস উতরে গেছিলাম কিন্তু মনের কোণায় সেই যে একটা খেদ, গ্লানি আর ন্যায়ের জন্য  যুদ্ধ শুরু হল সেই যুদ্ধ আমার এখনো চলছে। মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে গেছে সেদিন থেকে, অন্যায়ের সঙ্গে  আপোষ না করা । সেদিন পরীক্ষা হলের বাতাবরণে হয়ত প্রতিবাদী হয়ে উঠিনি কিন্তু যতটুকুনি পড়াশুনো করেছি সেটুকুনি কাজে লাগিয়েছি, তাই মনে মনে আজো গর্ববোধ করি।  আশীর দশকের এই দুটো শিক্ষা সম্বন্ধীয়  ঘটনা মনকে আজো নাড়া দেয় আর এখনো ভাবি কিসের শিক্ষা? কেন এই শিক্ষা? সেখানেও রাজনীতি না কি অন্য কোনো ছক কষাকষি থাকে? উত্তরটা খুঁজে চলেছি এখনো ।
তাই আজ যখন বোর্ডের প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য পরীক্ষা ক্যান্সেল হল তখন মনের মধ্যে তোলপাড়। বেচারা পড়ুয়াদের জন্য। যারা কেউ ভেবেছে পরীক্ষা দিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচবে। কেউ ভেবেছে বেড়াতে বেরুবে, তা না তাদের আজ ট্রমায় দিন কাটছে। উপযুক্ত শাস্তি পাক এই চক্র তবে রিএক্সাম কি এর সমাধান? জানি হয়ত রিটেস্ট তাদের দিতেই হবে কিন্তু যারা নির্বিবাদে পরীক্ষা দিল, যারা ঘুণাক্ষরে টের পেল না তারা কেন এই যজ্ঞে আবার সামিল হবে? রিএক্সামের ট্রমা যে কি জিনিষ তা আমার মত সেই ৮৪ র পরীক্ষার্থীরা সকলেই হাড়েহাড়ে বুঝি।
যারা এই প্রশ্নপত্র ফাঁস কাণ্ডের  মধ্যমণি তাদের যেনতেনপ্রকারেণ জবরদস্ত শাস্তি হোক। আর যাই করুণ ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন না দয়া করে। এবছরের প্রশ্নপত্রে যা সম্ভাব্য ছিল তা  ত এসেই গেল। পরীক্ষা দেওয়া হয়েই গেছে। আবার পরীক্ষা হলে ওরা পারবে ত?    
যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক"

যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক" / কালবোশেখি

 প্রতীক্ষা এক অদ্ভূত রকমের প্রচ্ছন্ন আবেগ। আর সে যদি অনিশ্চিত প্রতীক্ষা হয় তবে উথালপাথাল। চৈত্র বৈশাখ মাসের অপরাহ্নিক ঝড়, ঈশান কোণে কালো মেঘ জড়ো হওয়া আর সেই নিকষ কালো, ঘুটঘুটে ঘন মেঘ ? এদের সমন্বয়ে যদি শান্তিধারা নামে তাহলে বাঙালীর বছরের প্রথম বরফ কুচি ছড়ানো আমপান্নায় কে যেন জল ঢেলে দেয়। আচমকা বহু কাঙ্খিত নাভিশ্বাস আবার সর্বনাশ! 
দুপুর থেকেই ছমছমে আকাশ, গুমরে মরছিল।তারপরেই কালভৈরব ঝড়ের তান্ডব আর কিছুপরেই শান্তির ধারাবর্ষণ। পুরুষ আর প্রকৃতির খেলা যেন। সবুজ আর সজীবের প্রাণ ফিরে পাওয়া। দরজার পাল্লা পড়ছে, জানলার কাঁচ ভাঙছে। কত শব্দ। আর সবচেয়ে দাপট দেখায় শালপ্রাংশু বৃক্ষগুলি। একবার আটকে গেছিলাম  চিলেকোঠায়। নীচে নামতে না পেরে দু চার লাইন কাব্যি করেছিলাম। কবিতার নাম দিয়েছিলাম কালবোশেখি। অকালবোশেখির মত আমার কাছে সব কালবোশেখিই যেন বড় অকালে আসে। তাকে বুঝতে না বুঝতেই সে এসে চলে যায় দুমদাম পা ফেলে।    
এখনো কালবোশেখির স্মৃতি মেদুর বিকেলগুলোয় চোখ বুঁজলে কিউটিকিউরা পাউডারের হালকা গন্ধ পাই কালবৈশাখীর বিকেলে । গা ধুয়ে নরম ছাপা শাড়ি পরে মায়েদের দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেই মাদুর নিয়ে ছাদ সংসার পাতার তোড়জোড় । মায়ের হাতে একটা হাতপাখা আর অন্যহাতে বাড়িতে পাতা টক দ‌ইয়ের ঘোল। ওপরে কাগচিলেবুর সুবাস । ফ্রিজ তখনো ঢোকেনি বাড়িতে। বরফ যেন আমাদের কাছে সোজা হিমালয় পৌঁছনোর মত ব্যাপার। বাজারে একটা দোকানে সন্ধ্যের ঝুলে বরফ বিকত। সেখান থেকে বরফ কিনে এনে শরবত খাওয়া হত। সেদিন যেন চাঁদ হাতে পাওয়া। তখন "হিমক্রিম' পাওয়া যেত।  সেও যেন এক অতি আশ্চর্য রকমের প্রাপ্তি। মিষ্টির দোকানে আইসক্রিম মিলত। কোয়ালিটির আইসক্রিমের কাপ।কোনোকোনো দিন দুধের বড় ক্যানের মধ্যে বরফ দিয়ে সেই আইসক্রিম আসত গরমের ছুটির বিকেলে। ছাদের ওপর হয়ে যেত আমাদের ছোট্টবেলার আইসক্রিম পার্টি। বাবা একবার সেই আইসক্রিম আনতে গিয়ে কালবোশেখির ঝড়ে পড়লেন। কি চিন্তা আমাদের! যত না চিন্তা মানুষটির জন্য তত চিন্তা আইসক্রিমের জন্য। মা খুব বকুনি দিয়েছিলেন। আগে বাবা না আগে আইসক্রিম এই বলে।

তখন আমাদের স্কুলজীবনে গরমকালের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল লোডশেডিং।  ইনভার্টার ছিলনা । রোজ নির্দ্দিষ্ট সময়েই পাওয়ার কাটের পূর্বাভাস পেয়ে যেতাম আমরা। আর কালবোশেখি হলেও ঝড়ের তাণ্ডবে পাওয়ার চলে যেত। তখন দখিণের খোলা বারান্দাই ভরসা। সেখানেই জ্যামিতি, পরিমিতি আর উপপাদ্যে নিয়ে জোর কসরত চলত । সকাল থেকেই হ্যারিকেনে কেরোসিন ভরে, ঝেড়ে পুঁছে রেখে, তার সলতে ঠিকমত কেটে সমান করে দেওয়া হত । এখন শিল্পের বাড়বাড়ন্ত অতটা নেই তাই বিদ্যুতের চাহিদাও নেই। অবশ্য বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে শপিং মলে, মেট্রো রেলে। মাল্টিপ্লেক্সে, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে, সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে।  বিশ্বায়নের স্বীকার আমাদের শহর।আর সেই সঙ্গে আমরাও। তবে কলকারখানাও নেই বড় একটা তাই লোডশেডিং মুক্ত আমরা । তাই স্কুলের শিশুরা আরামেই গ্রীষ্মের ছুটির হোমওয়ার্ক করে । হোম মেকারের বাতানুকূল দিবানিদ্রা দিব্য যাপন।

রাতে লোডশেডিংয়ে মা টানতেন হাতপাখা। শাড়ির পাড় দিয়ে মোড়া থাকত হাতপাখাটি। টেঁকশ‌ই হবে বলে । ছোটদের বেয়াদপির দাওয়াই ছিল এই পাখার বাড়ি। যে খায়নি এই পাখার বাড়ি সে জানেওনা তা কেমন খেতে । সেই তালপাতার পাখাখানি টানতে টানতে বাইচান্স আমাদের গায়ে ঠুক করে লেগে গেলেই মায়ের যেন একরাশ মনখারাপ। যেন কি ভুলই না করেছেন। সেই পাখা সাথে সঙ্গে সঙ্গে ঠকাস করে মাটিতে ঠুকে তিনবার আমাদের কপালে, চিবুকে হাত রেখে চুক চুক করে ক্ষমা চাইতেন। দোষ কাটিয়ে নিতেন। সন্তানের গায়ে হাতপাখা লেগে যাওয়া যেন দন্ডনীয় অপরাধ।  মাটির কুঁজো বা জালার জল ছিল আরেক প্রাণদায়ী বন্ধু সে গরমে। মা আবার এক ফোঁটা কর্পূর দিয়ে রাখতেন জালার জলে। জীবাণুনাশক আবার সুন্দর গন্ধ হবে বলে। জলের লীনতাপকে ধাক্কা দিয়ে বাইরে বের করে দেবার জন্য সকাল থেকেই লাল শালু ভিজিয়ে জড়িয়ে দেওয়া হত মাটির জালার বাইরে। এখন গর্বিত বাঙালির ঘরে ঘরে ফ্রিজ। সে মাটির কুঁজোও নেই আর নেই সেই হাতপাখা। 

এখন সকলে বলে গরম বেড়েছে। কারণ নাকি বিশ্ব উষ্ণায়ণ। পরিবেশের নাকি বেজায় দম্ভ। বাড়ীর গরম, গাড়ীর গরম। সেই সঙ্গে মানুষের মাথাও গরম। টিভির চ্যানেলে অহোরাত্র ঘটি গরম। তাই মেঘ জমে কালবোশেখি হবার আগেই সব মেঘ বাষ্পমুক্ত হয়ে শুকিয়ে যায়। মায়ের এখন থাইরয়েড তাই গরম আরো বেশি। হোমমেকারের হটফ্লাশ তাই গরম বেশি। বাজারদরের আগুণ নেভেনা তাই বাবার কপালের ঘাম শুকোতে চায়না। ছেলেপুলেরা জন্মেই ফ্রিজ দেখেছে তাই ফ্রিজে জল না থাকলে তারাও অগ্নিশর্মা। ওরা শিখল মকটেল। পেপসি। বাড়ীতে সফট ড্রিংক্স রাখা যায় এসব ছিল আমাদের ধারণার বাইরে। বাড়ীতে পাতা টক দৈয়ের ঘোলের স্বাদ ওরা পেল না। কি জানি লোডশেডিং, মাটির জালা, হাতপাখার বাতাস, ছাদে বসে বরফকুচি দেওয়া সীমিত শরবত এগুলোই বোধ হয় ভালো ছিল। তাই বুঝি এত গরম অনুভূত হতনা। আর কালবোশেখির প্রতীক্ষাও ছিল না। তিথি নির্ঘণ্ট মেনে ঠিক ঈশানকোণে মেঘ জমে উঠত। 
আর কালবোশেখি এলেই কাঁচা আম ঝরে পড়া? ঝড়ে আম কুড়োয় এখনো কোনো দস্যি ছেলে। তবে পথেঘাটে নয়। শিলাজিতের গানেই। এখন ওদের আর রাখাল সাজা হয় না। কারণ তারাও এখন চাপে। তাই ঠাম্মার কপালে ভাঁজ। আমকাসুন্দি বানাতে হবে। আমবারুণীর পুজো করতে হবে না গঙ্গায় গিয়ে?  কিন্তু কে কুড়োবে সেই আম। আম পাড়ার নেশা যে কি জিনিষ তা যে পেড়েছে সেই জানে। এখন রিয়েল এস্টেটের রমরমায় নেই সেই আমগাছ। নেই সেই আম রাজত্ব। বাজারের কেনা আমে সাধ মেটাও হে বঙ্গললনা। 
তাই কালবোশেখি আসুক আর না আসুক গ্রীষ্মকাল সমাগত!

যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক"

যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক" / পহেলা নেশা

আবার পহেলা নেশা। বাঙালীর বৈশাখ বিলাস। কি পেয়েছি আর কি যে পেলাম ভাববার অবকাশ নেই। 
একদিকে রাজনীতির রঙ্গ । পহেলা উত্তেজনার পারদ তুমুলে । অন্যদিকে তাপমাত্রার পারদ চড়চড় করে উঠছে সেই ভয়ে কুপোকাত বাঙালী। তবুও  বিরিয়ানি, পোলাও কালিয়া, কোর্মা, পটলের দোলমা, নতুন জামা, নতুন ছবি, নতুন ম্যাগাজিন আত্মপ্রকাশ, সিডি রিলিজ, বর্ষ বরণের ঢালাও আয়োজন । বৈশাখের আগমনী আর চৈত্রের স্মৃতি ঝেড়ে ফেলে আবার রবীন্দ্রজয়ন্তীর রিহার্সাল। কেন বাপু কাজকম্ম নেই ? পাড়ায় পাড়ায় রাজনৈতিক এজেন্ডা। মঞ্চ প্রস্তুত। শিল্পীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে প্রোগ্রাম। নামীদামী শিল্পীকে পার্টি ফান্ড থেকে সাম্মানিক দেওয়া হয় অবশ্যি। ছোট ছোট ম্যাগাজিনের বর্ষ পূর্তি সংখ্যা প্রকাশেও তাই। ছোট ছোট লেখক নিজের লেখা ছাপার অক্ষরে দেখবেন বলে কিনছেন । কি জ্বালা!
আর আছে অকালবোশেখির হঠাত মেঘ কিম্বা কালবৈশাখির পরিকল্পনা।সেটা অবিশ্যি ওপরওয়ালার। ঝোড়ো হাওয়ার দাপটে বানভাসি বৈশাখ বিলাস বেল-জুঁই এর গন্ধ এ ভরপুর । বর্ষবরণ বা বৈশাখ-উত্সব চৌপাট তখন। যতসব!

আমরা বাপু নববর্ষের শুভ মহরত বুঝি নতুন খাওয়াদাওয়ায়। বাঙালির ঝালিয়ে নেবার পালা সেই চিরাচরিত বং-কানেকশান । যত‌ই ইংরেজী ছবি দেখি, ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করে অনর্গল কথা বলি আর গোগ্রাসে কন্টিনেন্টাল খাবারদাবার গিলি না কেন আদতে আমরা ঝোল-ঝাল-অম্বলের ভক্ত ।
আমারা যেমন নিউইয়ারে কেকও কাটি, দোলে ঠাণ্ডাইতেও চুমুক দি আবার পহেলা বৈশাখে কব্জি ডুবিয়ে বাঙ্গালী খানা খাই। এ বোধহয় আমাদের মত হুজুগে বাঙালির পক্ষেই সম্ভব ।কিন্তু হুজুগই কি শেষ কথা বাঙ্গালীর?
সেই পয়লা বৈশাখের দিন বাবার সঙ্গে দোকানের হালখাতার চিঠি নিয়ে, বরফকুচি দেওয়া কাঁচের গ্লাস উপচোনো অরেঞ্জ স্কোয়াশ আর বগল দাবা করে মিষ্টির বাক্স নিয়ে ফেরা? ঠাকুমার জন্য নিয়ে যেতে হবে সোনার গয়নার দোকানে নতুন বাংলা ক্যালেন্ডার । দিদিমার জন্য বুকষ্টল থেকে নতুন পঞ্জিকা । সবচেয়ে মজা লাগত মাছের বাজারেও হালখাতার মৌরসী পাট্টা দেখে । সেদিন মাছবাজার ধুয়ে মুছে সাফ এক্কেবারে । লক্ষ্মী গণেশের একযোগে পুজোয় মাছের আঁশটে গন্ধ কাটানোর জন্যে ফিনাইল, ধূপ ধুনো । আর মাছওয়ালাও ধবধবে পাজামা-পাঞ্জাবী চড়িয়ে বসেছে জম্পেশ করে । আমি বাবার হাত ধরে লেসের ফ্রিল দেওয়া,  নতুন ছিটের নরম ফ্রকে ।   প্রথমবার গিয়ে ভেবেছিলাম সে বুঝি মাছ দেবে ফ্রি তে । সে গুড়ে বালি! পয়লা নাম্বার মিষ্টির বাক্স নিয়ে থরে থরে বসে আছে সেও ! তার মানে বুঝলাম মিষ্টিমুখ না করলে বাঙালির শুভ কাজ হয়না । এই ছোটখাটো বাঙালিয়ানা গুলোই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে বহুযুগ ধরে। নিকুচি করেছে। এই নিয়েই পড়ে থাকল বাঙ্গালী। শুধু ধুয়ে ধুয়ে জল খেল আর পেট ফোলাল।

রেস্তোরাঁয়  বৈশাখী হেঁশেলের তোড়জোড়। মোচ্ছব সেখানেও। রসিক বাঙালীর বৈশাখী রসনা বিলাস। শুরুতেই কাঁচা আমের জুসের সঙ্গে ভদকার অভিনব ককটেল। অথবা তরমুজের লাল রসে পুদিনার সবুজ। ওপর থেকে আধ পেগ হোয়াইট রাম। যাকে বলে ফিউশান শরবত। তারপরেই লুচি, বেগুনভাজা, শাক-শুক্তো-ছ্যাঁচড়া-মুড়িঘন্ট। পরের দফায় ঘি ভাত, তপসে ফ্রাই। নির্গুণ, নির্গন্ধা বেগুণ দিয়ে বেগুণ বাসন্তী থেকে শুরু করে সারাবছর অচল পটলের দোলমা। ঘিভাতের কত রকম নাম হয় আজকাল! মোরগ পোলাও থেকে আফগানী জাফরানি মোতি পলান্ন। মানে পল অর্থাৎ মাংস মিশ্রিত অন্ন মানে যাকে বিরিয়ানি বলি আমরা। একই অঙ্গে ভাতের কত রূপ! সে কখনো দারুচিনি দেশে, কখনো মখমলি জুঁইফুলের বাগিচায়। মানে যাকে বলে সিনামন রাইস অথবা জেসমিন রাইস।
চিতলমাছের অনুকরণে গাছপাঁঠার মুইঠ্যা তো পনীর পসন্দ।  যশুরে তেল কৈ কিম্বা বরিশালী ইলিশ। কোথাও মৈথিলী ভেটকি, কোথাও আবার মাটন মনোহরা। শুধু চমকে যাওয়া নামের অভিনবত্বে।  আবার কোথাও মশলা মাখানো ভেটকি ফিলের পাতুড়ি কলাপাতায় আবার কোথাও লাউপাতায় ।
বাঙালী রেস্তোরাঁগুলো এই একটা মাস ষোলো আনা বাঙালী । মধুরেণ সমাপয়েত ম্যাজিক মিহিদানার বেকড ভার্সন  অথবা রসোগোল্লার পুডিং দিয়ে। অথবা  কোকো দিয়ে চোকোগোল্লার পাশাপাশি কফি গোল্লাও চলছে দিব্যি । এমন ইনোভেশনে আছে বাঙালী! সন্দেশের সঙ্গে ফ্রুট ফিউশানে কিম্বা জলভরা জলপরী কিম্বা দৈ কলসের ঠান্ডা ছোঁয়ায় । মাটির ছোট্ট কলসে প্রথমে দৈ, তারপর মাখা সন্দেশ আর টপিং এ গারণিশ করা এক চামচ রাবড়ি। পেস্তা কুচিয়ে দাও ব্যাস! অনবদ্য বং মিষ্টি । আর তারপরেও চালিয়ে দেওয়া যায় কেশরীয়া মালপোয়া কিম্বা গুলাবী জিলিপিকে। রামকৃষ্ণদেবের কথায় ভরাপেটেও জিলিপি জিভ থেকে টুকুস করে, অতি অনায়াসে গলার মধ্যে দিয়ে সোজা পেটে চালান করা যায় । যেমন খুব ভীড়ে লাটসাহেবের গাড়ির চাকা ফাঁকফোকর দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে যায় সাবলীল গতিতে। 
এসব রেস্তোঁরায় খেতে যায় বহু মানুষ পয়লা বৈশাখে। আমাদের তো আসলে রোজ রোজ বৈশাখী। রোজ রোজ পয়লা নম্বর ভুরিভোজ চাই-ই। মাদার্স ডে, ফাদার্স ডে, ভ্যালেন্টাইন্স ডে' র মত বেঙ্গলি নিউইয়ার্স ডে আমাদের রোজ রোজ। বাকী যেটুকু করি সবটাই হুজুগে। তবে যাই বলুন মিডিয়ার দৌলতে পয়লা বৈশাখের একটা দিব্যি ব্র্যান্ড তৈরী হয়ে গেছে। সেটাই যা ভালোলাগার। গর্ব বোধ করার। কিন্তু এসব আর কদ্দিন! উত্তিস্থিত জাগ্রত বাঙ্গালী! বেলা বয়ে যায় যে!

এবারের বৈশাখী শ্লোগান ছিল নোট বাতিলের একবছর পর বাঙালির উত্থান । থুড়ি কেউ বলছে পতন । ডিজিটাল ভারতের স্বপ্ন দেখতে দেখতে  ডিজিটাল শপিংও করেছে বাঙ্গালী । বৈশাখে খাদ্যবিলাসেও সামিল হয়েছে । আমিও  হোমমেকারের হেঁশেলের চাক্কা বন্ধ করেছি পয়লা বৈশাখে। রাঁধছিনা, রাঁধবনা। স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ সব সঁপেছি  পয়লা বৈশাখকে।
এসব ত ভাল কথা কিন্তু এবার নতুন বছরের পহেলা রেজলিউশান কি হবে জানেন কেউ?

যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক"

যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক" / যদি মন চৈত্র সেলে, ফ্রকের ঝুলে

 " যদি মন মেঘলা দিনে ওড়ায় নিজের মন পাখীকে?' অথবা "যদি মন গড়িয়াহাটে চৈত্র সেলে ফ্রকের ঝুলে?'  
মনে পড়ে রূপঙ্করের সেই বিখ্যাত গান? আর হ্যাঁ, বছরের এই একটা সময় যদি মন আস্কারা পায় যখন তখন মাথায় চড়ে হাত পা ছোঁড়ে। চৈত্রসেলের জন্য । ভিনরাজ্যে গিয়ে থেকে তো দেখেছি । এই চৈত্তসেলের জন্যে ফাগুণ পড়তেই মন কেমন উশখুশ করে! আনচান করে। এমন সেলের পসরা কোথাও দেখিনি আমি ।
সেবার সেই বাম জমানায় সুভাষ চক্কোত্তির তাড়ায় অপারেশন সানশাইনের কবলে পড়ে রাতারাতি গড়িয়াহাট খালি। ফাগুণে সে বিরহব্যথা যে কি জিনিষ তা আমি হাড়েহাড়ে বুঝেছিলাম । কোথায় বাবার পায়জামার দড়ি! কোথায় গেল জামাকাপড় শুকোনোর ক্লিপ্! কোথায় পাই আমার সাধের জাঙ্ক জুয়েলারি, টিপ-ক্লিপ আর কুশন কভার? আর পয়লাবৈশাখে বাড়ির দোরে নতুন ডোরম্যাট? কিনব‌ না? বলুন ত? সব চাই যে আমাদের এই চৈত্রেই।
পথেঘাটে প্রাক্‌বৈশাখী প্রস্তুতি। চাদ্দিকে চৈত্তসেলের হাতছানি। নানান অফার বর্ষবিদায়ের আনন্দে। এক চিত্র গড়িয়াহাটার মোড়ে, হাতিবাগানের ধারে কিম্বা নিউমার্কেটের আশেপাশে । বছরের বস্তাপচা জিনিষ পত্তরের স্টক ক্লিয়ারেন্স সেল।  কোথায় লেডিজ প্রিমিয়াম টপস  "বাই ওয়ান, গেট ওয়ান' । কুর্তা, কুর্তি কেপরি, প্যালাজোয় প্রচুর ছাড় । কারে ছেড়ে কারে ধরি!  আনারকলি, নূরজাহান সকলেই আছেন এক ছাদের নীচে। শুধু অপেক্ষা পার্স খোলার।
পোলকা ডটের কুশন কভার, হালকা-পুলকা কস্টিউম জ্যুয়েলারি, প্যাস্টাল শেডের সুদৃশ্য বেডস্প্রেড এমন কি গৃহসজ্জার দৃষ্টিনন্দন আর্টিফ্যাক্টসও।  বুদ্ধ-গান্ধী-বিবেকানন্দ সকলেই উপস্থিত! সখের পোশাকী চটি জোড়া থেকে গুরুগম্ভীর স্নিকার্স, রান্নাঘরের ঘটিবাটি থেকে ময়লা ফেলবার ভ্যাট। সবেতেই সেল ।

কি ভালো আমার সেই হকার ভাইদের অমায়িক আমন্ত্রণ !  থরে থরে সাজানো সেলের পসরা। আর মধ্যে মধ্যে গলা ফাটিয়ে চীৎকার। মাঝবয়সী একজন আমাকে এখনো বৌদি বলে ডাকে। একবাক্যে জিনিষের দাম আর্ধেক করে হাসিমুখে বলে, নিয়ে যান, পরে দাম দেবেন। এত আন্তরিকতা কোথায় পাব বলুন ত ? তাই ওদেরি আমার এত পছন্দ।
মায়ের জন্য ফাইন মলমলের ফুল ফুল ছাপাশাড়ি আর শ্বশুরমশাইয়ের হাফপাঞ্জাবি না হয় কিনলাম দোকান থেকে। তাই বলে নিজের হাউসকোট কিম্বা কাজের মেয়ের ম্যাক্সি? কক্ষণো নয়। বেঁচে থাক আমার ফুটপাথ! আমার প্রাণের মাঝে চলে গেলে আর পাব না তারে। আর ওখানে কেনার চার্মটাই আলাদা! কত্ত চয়েস! কত্ত আন্তরিকতা হকার ভাইদের! এদের চাকরীবাকরী জোটেনি তাই হকার দলে নাম লিখিয়েছে এরা। এই আমিও ত টুকটাক লিখি আর টিউশানির পয়সায় আমার গুড টাইমপাস করি চৈত্র সেলে ।বড়বড় দোকানের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত উইন্ডোয় চোখ রাখি আর উইন্ডো শপিং করি। কিন্তু কিনি ফুটপাথ থেকে। আমার হকার ভাইটিও বি এ পাস করে হকার হয়েচে। গর্বের সঙ্গে বলে সে। তাই আমি এদেরকেই পেট্রনাইজ করি। আমার এই হকার ভাইকেই খুব দরকার এই চৈত্তসেলে, কুর্তির ঝুলে। এইজন্যেই তো পড়ে র‌ইলাম কলকাতায়। ম্যাটিনি শোয়ে সিনেমা দেখে লেবু চা খেয়ে বিকেলে নন্দন চত্বরে কবিতা পড়ব আর ফেরার পথে সেলের পসরায় ঢুঁ মারব একটিবার। এই ত জীবন।

এই শহরটার জন্মলগ্নে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৃহস্পতি তুঙ্গে জানেন তো? তাই কর্তা অফিস ফেরত নামেন বালিগঞ্জ স্টেশনে, গিন্নী নামেন গড়িয়াহাটে। তারপর ছুঁচোয়  ডন বৈঠক দেওয়া পেটে ঐ ফুটপাথের এগরোল কিম্বা চাউমিন, মোমো কিম্বা ফিশফ্রাই সাবাড় করে চৈত্তসেলে পথ পেরোন তাঁরা। আহা কি আনন্দ তখন সেই পথ চলায়! যিনি মেট্রো করে নামেন রাসবিহারী তাঁর জন্য আছে রাসবিহারীর বিস্তীর্ণ দুপারের প্লাসটিক বালতি, মেলামিনের বাসন থেকে কাটগ্লাসের সুরাপাত্র, বাথরুম সেট, পুরণো ম্যাগাজিন থেকে পাইরেটেড সিডি, রেডিমেড ব্লাউজ, সায়া থেকে শার্ট-প্যান্টের পিসে ঢালাও সেল। কি চাই! রাসবিহারীর মোড় থেকে রসা রোডের দিকে কালীঘাট  পেরিয়ে হাজরা আর এপাশে দেশপ্রিয় পার্ক পর্যন্ত সেলে ডুবে আছে মহানগরী। ভেতরের জামা, বাইরের জামা, পর্দার কাপড়  সবেতেই সেল। গয়নার মজুরি ফ্রি। আবার সোনা কিনলে সম ওজনের রূপো ফ্রি! ভাবা যায় এইআসন্ন পয়লা বৈশাখে চৈত্র সেলের  কি মহিমা?

ওদিকে গেরস্ত বঙ্গললনার এখন টেলিভিশনে মাস্টারশেফ দেখেবড় সাধ জাগে একবার কন্টিনেন্টাল বানানোর। বিশ্বায়নের ঢেউ লাগা রাস্তার আনাচেকানাচে  এখন বাটন মাশরুম থেকে বেবিকর্ণ, সুইট কর্ণ থেকে ব্রকোলি, তেরঙ্গা সিমলা মির্চ কি না পাওয়া যায়!
কেউ নামেন শ্যামবাজার মেট্রো স্টেশনে। তাঁর গার্ল ফ্রেন্ড হয়ত কলেজ ফেরত আসেন সেথায়। তারপর শুরু হয় সেল পরিক্রমা। আদিগন্ত হাতীবাগান জুড়ে সেল, সেল, সেল।
আর সে যুগে যারা স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের অমোঘ বাণীকে পাথেয় করে ব্যবসায় নেমেছিলেন তাদের দোকানে হাহুতাশ! নিউমার্কেটে তারা নাকি অবস্থান করছেন হকারদের বিরুদ্ধে। আরে বাবা ! বোঝেনা সে বোঝেনা।  তার বাপ-ঠাকুরদার এদ্দিনের ব্যাবসাপাতি নাকি হকারদের কল্যাণে লাটে ওঠার উপক্রম! ক্রেতা বলেন  যেখানে সস্তা পাব, সেখানে যাব। বিক্রেতা বলেন এসি দেব, জিএসটি নেব, রসিদ দেব। আর নেতা বলেন হকার আমার মাটি। হকার আমার ভোট। হকার আমার ভাগ্যনিয়ন্তা। "সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই".... চন্ডীদাসের অমোঘ বাণী । সুভাষবাবুর অপারেশন সানশাইনের পর হকার পুনর্বাসন হয়েছিল। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি জানেন? কেউ যায়নি নতুন বাড়িতে। ক্রেতা খোঁজে সস্তার জিনিষ। বিক্রেতা চায় বিকোতে। কারণ এ শহরে শিল্পের জোয়ার আসেনি তেমন করে। তাই ইকনমিক গ্রোথ নেই । তাই ক্রয় ক্ষমতা বাড়লনা বোধহয়। তাই ফুটপাথেই উঁকিঝুঁকি আর হাতড়ে মরা সাধের জিনিষগুলোর জন্যে।
ওদিকে উঁচু উঁচু শপিং মলের বাতানুকুল বায়ুমন্ডলে ম্যানেকুইন ডুকরে কাঁদে। পথিক আসে দর্শক হয়ে। চোখ বুলায়, হাত বুলায়। পিছন পানে চায়।

যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক"