৫ মে, ২০১৩

অক্ষয় তৃতীয়া


বৈশাখমাসের ব্রত/ বর্ধমান সমাচার   

বৈদিক মতে বৈশাখ মাসের শুক্লা তৃতীয়া তিথিটি বিশেষ শুভ।  এর নাম অক্ষয় তৃতীয়া।কোনও শুভারম্ভের দিন হিসেবে এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। অক্ষয় শব্দটির অর্থ হল যার কোনও ক্ষয় নেই অর্থাৎ চিরস্থায়ী। এই তিথিতে কোনও কাজে হাত দিলে তার শুভ ফল অনন্ত কাল ধরে চলতে থাকে। কারও মতে বেদব্যাস এই দিনে মহাভারত লেখায় হাত দেন। কেউ বলেন শ্রী কৃষ্ণ এইদিনে দরিদ্র বন্ধু সুদামা ও দ্রৌপদীকে অক্ষয়পত্র হাতে তুলে দিয়ে ধনসম্পদে ভরিয়ে দিয়েছিলেন। 


মহাভারতে আছে সূর্যদেব এইদিনে পাণ্ডবদের অক্ষয় পাত্র দান করেছিলেন। অক্ষয় পাত্র এমনি এক মন্ত্রপূত পবিত্র পাত্র যা ঘরে থাকলে কোনোদিন অন্নাভাব হয়না। 

এই দিন বর্ধমান সহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে লক্ষ্মী নারায়ণ এবং কুবেরের পুজো হয়।মানুষের অগাধ বিশ্বাস এই তিথির ওপর। শুভ মহরত বা সর্ব সিদ্ধ মহরত হবে এই আশায়। কারও হয় সেদিন দোকানের হালখাতা খোলা। 
পুরাণে বলে সত্য এবং ত্রেতা যুগের সূচনা হয়েছিল এই তিথিতে। জৈনদের মতে এই দিন আখের রস খেয়ে তাঁর এক বছরের উপবাস ভঙ্গ করেছিলেন তীর্থঙ্কর ঋষভ। স্বর্গের দেবতা ধনপতি কুবের এই দিন তার হৃতসম্পদ ফিরে পেয়েছিলেন। 

ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির একবার  মহামুনি শতানিককে অক্ষয় তৃতীয়া তিথির মাহাত্ম্য কীর্তন করতে বললেন ।
শতানিক বললেন পুরাকালে খুব ক্রোধসর্বস্ব, নিষ্ঠুর এক ব্রাহ্মণ ছিলেন । ধর্মকর্মে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিলনা । একদিন এক দরিদ্র ক্ষুধার্ত ব্রাহ্মণ তার নিকট অন্ন এবং জল ভিক্ষা চাইলেন । রণচন্ডী হয়ে ব্রাহ্মণ কর্কশ স্বরে তাঁর দুয়ার থেকে ভিখারীকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন  আর বললেন যে অন্যত্র ভিক্ষার চেষ্টা করতে ।
ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর ভিখারী চলে যেতে উদ্যত হল ।
ব্রাহ্মণ পত্নী সুশীলা অতিথির অবমাননা দেখতে না পেরে  দ্রুত স্বামীর নিকট উপস্থিত হয়ে ভরদুপুরে অতিথি সত্কার না হলে সংসারের অমঙ্গল হবে এবং গৃহের ধন সমৃদ্ধি লোপ পাবে, একথা জানালেন ।  
স্বামীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে  ভিখারীকে তিনি ডাক দিলেন এবং ভিখারীর অন্যত্র যাবার প্রয়োজন নেই সে কথা জানালেন । সুশীলা ত্রস্তপদে তার জন্য অন্নজল আনবার ব্যবস্থা করলেন । কিছুপরেই তিনি অতিথি ভিক্ষুকের সামনে সুশীতল জল এবং অন্ন-ব্যঞ্জন  নিয়ে হাজির হলেন । ভিখারী বামুন অতীব সন্তুষ্ট হলেন এবং সে যাত্রায় সুশীলাকে আশীর্বাদ করে সেই অন্নজল দানকে অক্ষয় দান বলে অভিহিত করে চলে গেলেন ।
বহুবছর পর সেই উগ্রচন্ড  ব্রাহ্মণের অন্তিমকাল উপস্থিত হল । যমদূতেরা এসে তার শিয়রে হাজির ।  ব্রাহ্মণের দেহপিঞ্জর ছেড়ে তার প্রাণবায়ু বের হ'ল বলে। তার শেষের সেই ভয়ঙ্কর সময় উপস্থিত । ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় তার কন্ঠ ও তালু শুকিয়ে গেল । তার ওপর যমদূতেদের কঠোর অত্যাচার । ব্রাহ্মণ তাদের কাছে দুফোঁটা জল চাইল এবং তাকে সে যাত্রায় উদ্ধার করতে বলল ।
 যমদূতেরা তখন একহাত নিল ব্রাহ্মণের ওপর ।
তারা বলল " মনে নেই ? তুমি তোমার গৃহ থেকে অতিথি ভিখারীকে নির্জ্জলা বিদেয় করেছিলে ?"
বলতে বলতে তারা ব্রাহ্মণকে টানতে টানতে ধর্মরাজের কাছে নিয়ে গেল ।

ধর্মরাজ ব্রাহ্মণের দিকে তাকিয়ে বললেন " এঁকে কেন আমার কাছে এনেছ্? ইনি  মহা পুণ্যবান ব্যক্তি । বৈশাখমাসের শুক্লা তৃতীয়া তিথিতে এনার পত্নী তৃষ্ণার্ত অতিথিকে অন্নজল দান করেছেন ।  এই দান অক্ষয় দান ।   
সেই পুণ্যে ইনি পুণ্যাত্মা । আর সেই পুণ্যফলে এনার নরক গমন হবেনা । ব্রাহ্মণকে তোমরা জল দাও । এনার প্রাণবায়ু নির্গত হতে দাও । শীঘ্রই ইনি স্বর্গে গমন করবেন "এমনও হত সেই পিতৃতান্ত্রিক যুগে? সতীর পুণ্যে পতির পুণ্যলাভ। 
আমাদের ঘটি বাড়ীতে দেখেছি অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে কালো সরষে জলে ধুয়ে তা শুকিয়ে নিয়ে শুকনো বাটতে। সদ্য ওঠা কাঁচা আম ছাড়িয়ে থেঁতো করে নুন হলুদ মাখিয়ে রোদে দিতে। তারপর কাঁচের শিশিতে ভরে নেওয়া হত সেই জারানো আম, সরষে গুঁড়ো, তেঁতুলের ক্বাথ, চিনি আর সর্ষের তেল । দিন কয়েক রোদে ফেলে রাখলেই তৈরী হত আম কাসুন্দি। চলতি কথায় বলে আমের কাসন।