৪ জুল, ২০২১

কোভিড ডায়েরি

 


প্রিল মাসের মাঝামাঝি। সাবধানেই ছিলাম। একটা ভ্যাকসিনের ডোজ ঢুকেছে আমার দেহে। দু সপ্তাহ আগেই। আচমকা অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউ সজোরে আছড়ে পড়ল আমার শরীরে। গলার মধ্যে, নাসারন্ধ্রে কাঠি ঢুকিয়ে আমারও তবে লালারস পরীক্ষায় যাবে? হ্যাঁ, গেল। ততক্ষণে উপসর্গ দেখেশুনে বুঝে গেছি। সারা বিশ্ব তথা আমার দেশ,তথা আমার রাজ্য, তথা আমার কলকাতা শহরের কোভিড মহামারীর পরিসংখ্যানে আমার নাম থাকবে। স্বাদ গন্ধহীন উত্তাল দেহ পরিস্থিতি, উত্তপ্ত দেহ, ঘন ঘন কাশির দমক, শরীরে প্রচণ্ড ব্যথাবিষ। তার মাঝেই ডাক্তারবন্ধুদের সঙ্গে হোয়াটস্যাপে ঘন ঘন পরামর্শ। সাগরপারে বৈজ্ঞানিক পুত্রবধূর ভিডিও কলে কেবলই জিজ্ঞাসা একটাই, অক্সিজেন স্যাচুরেশন জানতে চেয়ে। কিপ ইয়োরসেলফ হাইড্রেটেড। ছেলের প্রশ্ন একই, শুধু মজার কথা বলে আমায় ভালো রাখে তারা। আর প্রোটিন খাওয়ার আর্জি জানায় আমার সেই অরুচির মুখে। দরজায় টোকা দিয়ে আমার কর্তামশাই পানীয়, পথ্য, খাবার রেখে চলে যান। আমি কেবলই তার মাঝেই আলো খোঁজার চেষ্টা করি। আমার স্টাডি টেবিলেই কিছু বই ছিল ভাগ্যিস। ডুবে যাই বইয়ের পাতায়। পারিনা ক্লান্তিতে। জ্বর ছাড়লে, মন ভালো লাগলে ল্যাপটপ খুলে বসি। লিখতে শুরু করেও পারিনা। গিয়ে লম্বা হই বিছানায়। স্পিকারে রবীন্দ্রসঙ্গীত চালিয়ে দিই। একটু ভালো তো আধটু খারাপ।  

আমার আটতলার বন্দীদশার নিভৃতবাসের লম্বা কাচের জানলায় সন্ধের কলকাতায় ফুটফুটে আলোজ্বলা দেখি। দূরে শাঁখের আওয়াজ। বাড়ির লাগোয়া মন্দিরে কাঁসর ঘণ্টা বাজেনা এখন। ঈশ্বর স্বয়ং দুয়ার এঁটে বসে আছেন অতিমারীর প্রথম ঢেউয়ের মতোই। উত্তর দিতে পারবেন না বলেই হয়ত। দিকে দিকে অতিমারির প্রকোপে আমার মতও সবাই অছ্যুত। আমার নিজের ধোয়া বাসনগুলো বারান্দায় রেখে আসি সাবান জলের মধ্যে ডুবিয়ে। পরদিন আমার কাজের মেয়ে ধোবে। ভালো থাকুক সে। সেই আশায়। 

আমার নীচের ঘরেই তিরাশি বছরের শাশুড়িমা আছেন। শোয়া রোগী। পড়ে গিয়ে স্মৃতিভ্রষ্ট। শুধু আমার খোঁজ নেওয়া চাইই তাঁর। কারণ আমি হলাম সংসারের ত্রাণকর্ত্রী। আমার এহেন ব্যাধির কারণে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত নেই দিন চারেক হল। সবসময়ের পরিচারিকার কাছে সদুত্তর পেয়েছিলেন কিনা জানা নেই। তবে হঠাত করেই তাঁর শারীরিক অবনতি ঘটল। খাওয়া বন্ধ হল। কথা বন্ধ হল। অন্যান্য শারীর বৃত্তীয় কাজকর্ম নিশ্চুপ এক্কেবারে। ওপর থেকে ভিডিও কলে আমি এটা, ওটা সেটার পরামর্শ দিয়ে চলেছি তখনও। কিন্তু তিনি বুঝি ক্রমশই অত্যন্ত দ্রুত খারাপ থেকে খারাপতর র দিকেই এগিয়ে চলেছেন তখন। মনে ভাবছি শুয়ে শুয়ে। উদ্বেগ মানুষকে কিভাবে শেষ করে দেয়! হাতেনাতে প্রমাণ পেয়েছিলাম সেদিন। 


টুং করে নোটিফিকেশন এল হোয়াটস্যাপে। আমার রিপোর্ট পজিটিভ এল কোভিড পঞ্চমীর সন্ধেয়। দূরে আকাশের ব্যাকড্রপে মহানগরের ফুটফুটে আলো দেখতে দেখতে ডাউনলোড করছি রিপোর্টের পিডিএফ। ফরোয়ার্ড করতেই হাজারও ফোনকল। কাশির দাপটে পারছিনা রিসিভ করতে। নীচে তখন মা ক্রিটিকাল। কম্পাউন্ডার এসে স্যালাইন, ক্যাথিটার ইন্সটল করতে ব্যস্ত। আমি কিছুই করতে পারছিনা। শুধু ভিডিও কলে দেখছি আর শুনছি। মুঠোফোনে একের পর এক কাছে দূরে বন্ধুবান্ধব, নিকট আত্মীয়ের সংক্রমণের খবর। কেউ চলে গেলেন তক্ষুনি। কেউ সংকটজনক। অক্সিজেন পাওয়া যাচ্ছেনা। খাস দক্ষিণ কলকাতার বুকে আমাদের এক আত্মীয় অক্সিজেন না পেয়েই চলে গেলেন ততক্ষণে। আমার কিছুই করার নেই সেই মুহূর্তে। আমি আলো খুঁজে চলেছি তখনও । ভালোর দিকে যাওয়ার পথ খুঁজছি। ছেলে বৌমা পজিটিভ ভাইবস দিয়ে আমায় ভালো রাখার চেষ্টা করে চলেছে। 

গর্ভধারিণী মায়ের সিওপিডি আমার টেনশনে বেড়ে চলেছে ক্রমান্বয়ে। ওরে ঠিকমত খাচ্ছিস তো? ফোন ধরছিস না কেন মা? তোর মাথায় হাত রাখতেও পারলাম না। দেখিস, সব ঠিক হয়ে যাবে, আমি নারায়ণ কে রোজ তুলসী দিচ্ছি তোর নামে। মায়ের তো প্রাণ! এমনি হয় বুঝি। 

মাঝরাতে ফোন। আমি অবিশ্যি কোভিডের প্রকোপে পড়ে থেকে আদ্দেক রাত জেগেই থাকছিলাম। অত ওষুধপালা! ইনসমনিয়া আমায় তখন গ্রাস করেছে। 

শাশুড়ি মা কে ভিডিও কলে দেখলাম হাপর টানার মত। শ্বাস উঠেছে তাঁর। মাল্টি অরগ্যান ফেলিওরের দিকেই তিনি তখন। তাঁর গীতাখানি নিয়ে কর্তামশাই কে বললাম পাঠ করতে। ব্রাহ্ম মুহূর্ত এগিয়ে এল। পাশের কাচের জানলায় অন্ধকার চরাচর ফেটে সূর্যের রঙ বেরিয়ে আসছে, একটু নীল। একটু কমলা। এক চিলতে লালের আভা আকাশের বুক চিরে। মায়ের মুখে তাঁর ছেলে গঙ্গাজল দিল। বিদেশ থেকে নাতির ভিডিও কল আসতেই তিনি শেষবারের মত শ্বাস ছাড়লেন। বুকের ওঠানামা চিরকালের মত থেমে গেল। মায়ের সঙ্গে আমার আর দেখা হল না। শেষবারের মত প্রণাম করাও হল না। তাঁর জন্য আমার আনা প্রিয় লেমন টার্ট ফ্রিজের মধ্যেই আমার মতোই বন্দী হয়ে পড়ে রইল। আমার হাতে খেতে চাইতেন। হলনা। ওপর থেকে দেখলাম কাচের গাড়ী আবাসনের বাইরে বেরিয়ে গেল। মা কে নিয়ে ওরা তখন শেষ যাত্রায়। আমি দূর থেকে প্রণাম জানালাম। আমার কোভিড ষষ্ঠী সেদিন পড়ে গেছে। জানলা দিয়ে নীচের তলায় মায়ের জন্য জ্বালা ধূপের গন্ধ পেলাম যেন। এ কি! এ এক আশ্চর্য সমাপতন! সংসারের শুভাকাঙ্ক্ষী আমার অশীতিপর শাশুড়িমা তাঁর সব আয়ুটুকু বুঝি আমায় দিয়ে চলে গেছেন ততক্ষণে। হোয়াটস্যাপে ডাক্তারবাবু কে জানালাম ক্ষীণ ঘ্রাণশক্তি ফিরে আসার কথা। তিনি জানালেন আমি নাকি হিলিংপাথে প্রবেশ করছি এবার। কেউ আবার লিখছে সপ্তম-অষ্টম দিন না পেরুলে কিছুই বোঝা যাবে না। ওষুধের প্রভাবে হই হই করে ইমিউনিটি বাড়তে বাড়তে রক্তে সাইটোকাইন ঝড় উঠতে পারে। শংকায় প্রহর গুনি আমি। 

কেউ বলে দশমী পেরুলে আর ভয় নেই। তবে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে। নাহ! সব ঝড় কে জয় করবই আমি। আমার পরমায়ু দিয়ে এ যাবত আশীর্বাদ করা আমার সংসারের শুভার্থী নেই। হাইসেনবারগ আনসারটেন্টি প্রিন্সিপল মানি আমি। মনের জোরে আমি বাঁচবই। অক্সিজেন লেভেল ৯৭-৯৮। আমি নিয়মিত প্রাণায়াম করি । করি ডিপ ব্রিডিং এক্সারসাইজ। আমায় ভালো থাকতেই হবে। কিন্তু কাশির জেরে আমি খান খান। বন্ধু ডাক্তার বদলে দেন ওষুধ। কোভিড একাদশীর দিনে সামান্য রুচি ফেরে। সেই এক নাগাড়ে প্রবল ১০৩ জ্বর আসনা  না আর। গরম খিচুড়ি ভালো লাগে মুখে। দ্বাদশী থেকে বুঝি দুর্বলতার জের। কিন্তু শাশুড়ি মা চলে যাবার পরেই তাঁর সেবায় ব্রতী পরিচারিকা নিজের কোভিডের ভয়ে বাড়ি চলে যায়। তবে সংসারের কোনও কাজ কি পড়ে থাকে? ঈশ্বরের অঙ্গুলি হেলনে সব ঠিক হয়ে যায়। এ আমার বিশ্বাস। একদিকে চরম স্বার্থপরতা সেই পরিচারিকার অন্যদিকে আমার ঠিকের রাঁধুনি সব ফেলে দুবেলা এসে সংসারের হাল ধরে। নীচের তোলায় রোগীর ফল কাটা থেকে দুধ জ্বাল, রান্নাবাড়া করে  রোগীর পথ্যি সাজিয়ে গুছিয়ে টেবিলে রেখে কর্তামশাই কে বলে বুঝিয়ে চলে যায় সে। চোখে জল আসে আমার। রবিঠাকুর সেই যুগে প্রবাসে প্রভুর দায়িত্ব নেওয়া পুরাতন ভৃত্যের কথা লিখেছিলেন। আমার রান্নার দিদি আমায় ছেড়ে চলে যায়নি সেদিন। দুই পরিচারিকার দুই বৈপরীত্যের পরিচয় পেলাম সেদিন আমি। 

আমার বন্দীদশা মুক্ত হতেই রান্নার দিদি তার জ্বর আসার কথা জানাতে আমি আরও ভালোবেসে ফেললাম তাকে। দুর্বল শরীরে মনের জোরে, বুক বেঁধে নিজে রান্নাঘরে ঢুকেছিলাম সেদিন। একমাস পরে সে কাজে এল। আমি এবার তার পোষ্ট কোভিড খেয়াল রাখতে শুরু করলাম। দুজনে একত্রে সেলফি তুলে আত্মীয় পরিচিতের হোয়াটস্যাপে পাঠাতে লাগলাম। দু মাস হতে চলল আমার। এখনও ও আমাকে জল খাওয়ার কথা মনে করায়। আমিও ওকে গরম দুধে এনসিওর গুলে দিই। ও রান্নাঘরে গরমে থকে গেলে আমি গিয়ে ওকে পাখার হাওয়ায় বসতে বলি। আমি ততক্ষণে সামাল দিই খুন্তি কড়াইয়ের লড়াইয়ে। মা'কে জানাই এই দেখ, আগের থেকে আমরা ভালো আছি মা। কোভিড মায়োপ্যাথি শুরু হয় আমার। কোমর থেকে সারাক্ষণ ঝিনঝিনে কাঁপুনি। নার্ভের ওষুধ দিলেন ডাক্তারবাবু। আবারও ভালো হই। ভালো থাকার চেষ্টা করি। শরীরে দুর্বলতার খামতি নেই পেট পুরে খেয়েদেয়েও। রান্নার দিদি কে জিগেস করি, ভিটামিন খাচ্চো তো রোজ? ফ্রিজ থেকে পাওরুটি আর চিকেনের টুকরো বের করে দিয়ে কৌটো ভরে দিয়ে বলি স্যুপ করে খেও। এভাবেই পেরিয়ে চলেছি অতিমারির ঢেউয়ের দাপট। এখনও সে ফুঁসছে। আগের থেকেও নাকি বেশী। দ্বিতীয় ভ্যাকসিনের ডোজ পিছিয়ে গেল আমার। এখন নাকি শরীরে অ্যান্টিবডি থইথই। এমন সেফ পিরিয়ড যদি আজীবন চলত! রান্নার দিদি হেসে বলে সত্যিই তাই গো দিদি। আমরা কেউ কারোর হাসি দেখতে পাইনা কারণ এখনও দুই করোনা ওয়ারিয়ার, আমাদের মুখের মুখবন্ধনী আছে যে!   


বন্ধুবান্ধবের শুভেচ্ছা, সুস্থতার বার্তা তো ছিলই আমার সঙ্গে। এমনকি কিছু ঈর্ষাকাতর মানুষও কোত্থেকে জেনেশুনে আমায় সুস্থতার বার্তা পাঠিয়েছিল সেসময়। আবার অনেক বন্ধু, আত্মীয়স্বজন(?) সব জেনেও মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিল। চিনে নিয়েছিলাম তাদেরও! এই তো মানুষের নশ্বর জীবন ! সেখানেও এত দ্বন্দ্ব! এত পরশ্রীকাতরতা! কোভিড আমার চোখনাক, কান খুলে দিল আবারও!