১৭ই মে ২০১২
প্রতিবার
পাহাড় না সাগর এই বিতর্কে হেরে
যাই আমি । গরমের ছুটির ফাঁদে
পা দিলেই হিমালয় টেনে নিয়ে
যায় তার কাছে । এবারেও তার
ব্যতিক্রম হল না ।
আমরা
তিনজনে দিল্লী থেকে আবার
শ্রীনগরের উড়ানে ।
ভূস্বর্গ কাশ্মীর কে
তুলনা করা হয় ইউরোপের
সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে ।
কয়েকদিনের জন্যে না হয় তোলা
থাক সে তুলনা । সুইস আলপ্সের
স্মৃতি তোলা থাক এলবামে । ওরে
হিমালয় যে আলপ্সের চেয়ে কিছু
কম নয় ...এই
বলতে বলতে এগিয়ে চললাম ফোটোশপড
নীল আকাশের দেশে । এমন নীল যে
কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি!
এয়ারপোর্ট
থেকে গাড়ি চলল হৃদয়পুরা দিয়ে
।
ঝাউগাছ
আর লতানে গোলাপের গুল্মের
মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে বারবার
মনে পড়ছিল ওপি নায়ারের কাশ্মীর
কি কলির গানের সিকোয়েন্স ।
স্লোপিং রুফের বাড়িগুলো দেখে
মনে পড়ে গেল খবরের কাগজের
তুষারপাতের কথা । পথে চাপদাড়ি
যুবক,
বোরখা
ঢাকা যুবতী আর মোড়ে মোড়ে সিআর
পিএফ জওয়ানদের ভ্যান গাড়ি
দেখে অনুভব করলাম কাশ্মীরের
প্রতিকূলতা ।
পথে পড়ল রাজবাগ
পার্ক । ঝিলামকে দেখলাম একঝলক
। একে বলে বিতস্তা । ড্রাইভার
মুক্তেয়ার বলল "দরিয়া
ঝালেম"
।
ঝিলাম
সেতু পেরিয়ে ডাল ঝিলে এলাম
আমরা । একদৃষ্টে চেয়ে থাকতে
হয় কিছুক্ষণ ।
লেক যে এত বড় হয়
আগে কখনো দেখিনি । শিলং এ বড়াপানি
লেক দেখেছিলাম,
সুইজারল্যান্ডের
লুগানো লেক দেখেছিলাম । কিন্তু
তাই বলে এত হৈ হৈ হাউসবোটের
পসরা আর কূলে কূলে এত শিকারা
?
শিকারার সারি বাঁধা ডাল লেকের ধারে.......
ডালঝিলের মধ্যে ভাসমান পোষ্ট অফিস দেখে যারপরনেই অবাক আমরা !
নেহরুগার্ডেনে
অবতরণ গোলাপের বাগানে । একটু
ছবি তোলা ।
নেহেরু গার্ডেন থেকে ডাললেকের প্যানোরমিক লুক !!!
ডাললেকে ভোরের আলোয় একরকম ।
আবার ঝুপ করে নেমে আসা সন্ধ্যের ঝুলে তার রূপ অন্যরকম । আবার রাতের বেলা যেন পরী সেজে দাঁড়িয়ে রয়েছে রঙীন আলোর হাউসবোটের পসরা নিয়ে সেই একই ডাললেক সুন্দরী ।
আবার ভাসমান শিকারায়
। মাছ খেগো বক, সারস আরো কত কি সেই ডাললেকের জলে ।
আশপাশে ভাসমান সবজী বাগানের
মধ্যে দিয়ে লিলিপুলের মধ্যে
দিয়ে ।
হাউসবোটের
রোয়াক ঘেঁষে ।
১৮ই
মে ২০১২
শ্রীনগরের
ডাললেকের ধারে হোটেলের কামরা
থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শব্দে
ঘুম গেল ভেঙে । মেঘ না মৌসুমী
? কাঁচের
জানলায় অন্ধকারের থাবা ।
ভূস্বর্গ বৃষ্টিস্বর্গে
পৌঁছে গেল না কি !
মনখারাপের
পার্টির শুরু । জানলার ভারী
পর্দা সরিয়ে দেখি কালো মেঘে
আকাশ ঢেকে গেছে ।
প্রথমে
টুথব্রাশ তারপর চায়ের কাপ
হাতে আমি চোখ রেখেছি পাহাড়ের
মাথায় । কখনো মেঘ উড়ে গেলে
তুষারশিখর মুখ বেরে করছে আবার
মেঘের চাদর তার গায়ে । আমাদের
মনের চাপা টেনশনে ঘরের তাপমাত্রা
বেড়ে গেছে ততক্ষণে । রুম হিটার
বন্ধ করলাম । হঠাত চানঘর থেকে
এসে দেখি রোদ উঠেছে । পাহাড়ের
চূড়ো হাসতে শুরু করেছে খিলখিল
করে । সবজী পরোটা আর দৈ সহযোগে
ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়া
হল পহেলগামের উদ্দেশ্যে ।
হালকা ঠান্ডা তখন চিনার বনের
মধ্যে । ঝিলামের ধারে ধারে
চিনারের এই অভিভাবকত্ব মুঘল
আমল থেকে । চিনারকে কেউ কুড়ুল
মারতে পারবেনা । এই ইকোফ্রেন্ডলি
চিনারকে নিয়ে কাশ্মীরিদের
খুব গর্ব ।
এই সেই ঐতিহাসিক চিনার বৃক্ষ । সবুজতায় আর রাজকীয়তায় পূর্ণ ! চিনার পাতা কাশ্মীরের শিল্পকর্মের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত ।
পথে
পড়ল পান্থচক । পাথরের সব কারখানা
। কারিগরেরা সেখানে খুদে খুদে
বানাচ্ছে শিল নোড়া,
খলনুড়ি,
হামান
দিস্তা । কিনে ফেললাম একটা
খলনুড়ি । বেশ অন্যরকম দেখতে
। এটাই কাশ্মীরের ট্র্যাডিশানাল
মশলা পেষার কল ।
লিডারভ্যালির
ওপর দিয়ে চলেছি আমরা । মেঘ এসে
ভাসিয়ে দিচ্ছে কখনো ।
টোলবুথে
পয়সা ফেলে বেলাবেলি পহেলগামে
প্রবেশ করলাম ।
দাঁড়কাকের
কর্কশ স্বর নির্জনতাকে ছাপিয়ে
দিল । রাখাল ভেড়ার পাল লয়ে যায়
মাঠে । ঘোড়া সওয়ারি নিয়ে ঘন্টি
নেড়ে হাঁটে । হোটেলে পিটস্টপ
। মালপত্র রেখেই বিলেটেড লাঞ্চ
। তারপরই দরদস্তুর করে ঝিরিঝিরি
ঝাউয়ের মাথায় টুপটাপ বৃষ্টি
নিয়ে আমাদের ঘোড়ায় চেপে বৈশরণ
এডভেঞ্চার । তিনটে জবরদোস্ত
ঘোড়া , দুই
সহিস আর আমরা তিন মূর্তি । ঘন
বাদামী আট বছরের বুলডোজার্,
হালকা
বাদামী দশ বছরের চেতক আর আমার
সফেদ ঘোড়া মাত্র তিন বছরের
বাদল ।
বৈশরণ
এল বুঝি । পাইনগাছের সারি দিয়ে
ঘেরা সবুজ প্রান্তর । দূর
দিগন্তে নীল আকাশের পৃথিবী
। পৃথিবীর নীচে ঐ প্রান্তর
যার নাম সুইত্জারল্যান্ড
পয়েন্ট । ছবি তুলে তফাত করা
যাবেনা আল্পসের বরফচূড়ো আর
হিমালয়ের বরফচূড়োয়। ভিউপয়েন্টও
বটে । নো প্লাস্টিক জোন ।
পরিচ্ছন্ন চা-কফির
ঠেক । ঘোড়া থেকে নেমে গরম চায়ে
চুমুক । ননস্টপ ডিজিটাল ক্লিকে
বন্দী হল ভারতের সুইস পয়েন্ট
।
পহেলগামে টিপিক্যাল কাশ্মীরি ডিনার হল এক পথ-হোটেলে । অসাধারণ সুস্বাদু কাশ্মীরি খানা । গরগরে, মশলাদার মাটন গুস্তাবা আর রিস্তা । সাথে গরম রুটি । গ্যাস্ট্রোনমিক আনন্দে উদরপূর্তি ।
১৯শে
মে ২০১২
পাহাড়চূড়োয় বরফ
। বরফচূড়োয় রোদ পড়েছে । মেঘমুক্ত
আকাশ । গরমজলে স্নান সেরে
ব্রেকফাস্ট আর তারপরেই বেরিয়ে
পড়া মেঘমুক্ত আকাশের উদ্দেশ্যে
। কখন আবার বৃষ্টির কবলে পড়ে
যাই । আজ আমরা গাড়ি নিয়ে আবার
লিডার উপত্যকায় বেড়াব । নদীকে
ছুঁয়ে দেখব ;
তার
উষ্ণতায় আজ গরমদেশের মানুষের
আহ্লাদে আটখানা হবার ।
২০শে
মে ২০১২
কাশ্মীর
ভ্যালি এল ।
পৃথিবীর সর্বোচ্চ
গল্ফকোর্স । ঠুকঠাক গলফ বল
মারছে কোনো খেলাড়ি । গাড়ী সেই
গল্ফকোর্স কে পাশ কাটিয়ে আরো
আরো পাইন আর দেওদারের মধ্যে
দিয়ে এসে পৌঁছাল মস আর ফার্ণ
ঘেরা কাঠের হোটেল ঘরে ।
গুলমার্গ এডভেঞ্চার শুরু !
২১শে মে ২০১২
গন্ডোলা অভিযান @ গুলমার্গ ! লাইন দিয়ে গন্ডোলা রাইডের টিকিট কাটা হল ।
কেবল কার রোপওয়ে দিয়ে উঠবে পাহাড়ের মাথায় । এখানে তাকে বলে গন্ডোলা রাইড ।
২২শে মে ২০১২
সোনমার্গ অভিযান ! ছুঁতে
হবে বরফকে । টবোগানিং ! অনাস্বাদিত রোমাঞ্চকর অনুভূতি হল । বরফ থেকে গড়িয়ে পড়ার । সেই উঁচু থেকে নীচে ।
শ্রীনগর থেকে সোনমার্গের পথ.....
৪ঠা আগষ্ট ২০১২, শনিবার আনন্দবাজার পত্রিকার "ব্যাগ গুছিয়ে" বিভাগে প্রকাশিত
২৩শে মে ২০১২
ডাল লেকের এক
হাউসবোটে বন্দী হলাম আপাততঃ দুদিন, দুরাতের জন্য । হাউসবোটের মালিক
কাশ্মিরী । তার নিজস্ব হাউসবোটের নাম "হোটেল ক্যালিফোর্ণিয়া" !
সেই হাউসবোটের ডাইনিং টেবিলে বসে গুগল ম্যাপে খোঁজা হচ্ছে আমাদের হাউসবোটের অস্তিত্ব ।
রাহুল সেই গৃহ নৌকার মধ্যে ঢুকেই বসে পড়েছে ব্লগ লিখতে..
আমার অন্তরে তখন বাজছে সেই গিটারের সুর... বহুযুগ আগে ঈগলস্ এর সেই বিখ্যাত গান ।
কেশর, আখরোট, শিলাজিত, উইলোকাঠের ক্রিকেট ব্যাট আর কাশ্মিরী কাঠের কারুকার্য , শাল-আলোয়ানের এম্ব্রয়ডারি, আর পশমিনার সম্ভারে এখানকার মানুষজন অনেক প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে বেঁচে রয়েছে । তবে মনে মনে এদের খুব গুমর কাশ্মীর কে নিয়ে, তার ঐশ্বর্য নিয়ে । আর কেনই বা হবেনা ?