১৪ ডিসে, ২০১৪

আমার শারদীয়া ২০১৪

১৭ নভে, ২০১৪

কার্তিক কান্ড!

কার্তিক কান্ড!
তারকাসুরের অত্যাচারে সমগ্র দেবকুল অতিষ্ঠ। কে বধিবে তারে? দরকার হল অমিত পরাক্রমশালী এক যোদ্ধার যে কিনা অনায়াসে বধ করবে তাকে এবং দেবতাদের রক্ষা করবে।
ব্রহ্মার আদেশ মাথায় নিয়ে ভোলাবাবা পার্বতীকে নিয়ে মহাসুখে দরজায় খিল আঁটলেন। চলতে লাগল সম্ভোগ পর্ব। ওদিকে হর-গৌরীর বিলম্বিত রতিক্রিয়ায় অধৈর্য হয়ে দেবগণ মদনদেবকে প্রথমে পাঠালেন তাদের বেডরুমে তলব করতে। ভোলেবাবা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে মদনকে বাণ মেরে ভস্মীভূত করলেন। আবারো দরজায় খিল। এবার পাঠানো হল অগ্নিকে। শিবের অবস্থা তখন নালে-ঝোলে। পার্বতীকে ইমপ্রেগনেট করা তো দূরের কথা মৈথুনরত শিবের রেতঃ স্খলিত হল অগ্নির সম্মুখে। অগ্নি তা নিয়ে গঙ্গায় ফেলে এলেন।
এবার সেখান থেকে দেবশিশু স্কন্দের জন্ম হল। তাই গঙ্গা হল কার্তিকের জন্মদাত্রী জননী।
এবার কে দেখবে এই সদ্যোজাতকে?গঙ্গার তো অবৈধ শিশু কার্তিক। উপায় ও হল সাথে সাথে.... ছ'জন কৃত্তিকা, মানে আয়ার সমতুল্য ঐ শিশুকে স্তন্যদান করে পালন করতে লাগলেন। পার্বতী জানতে পেরে রেগে অগ্নিশর্মা।ছেলে বলে কথা!!! যেহেতু ঐ পুত্র শিবের ঔরসজাত ঐ পুত্রের মা হবেন তিনিই । তাই তো মাদুর্গা না বিইয়ে কানাইয়ের থুড়ি "কার্তিকের মা" হয়ে গেলেন। আর তারকাসুর বধ করে ফেমাস হয়ে গেলেন দেবসেনাপতি বা দেবলোকের আর্মির মেজর জেনারেল ।
টেকনিক্যালি গঙ্গার গর্ভে জন্ম তাই কার্তিকের এক নাম গাঙ্গেয়। থিওরিটিকালি কৃত্তিকারা মায়ের মত পালন করেছিল তাই আরেক নাম কার্তিকেয় ।
আর বেসিকালি মহাদেবের পুত্র তাই আরেক নাম শিবসুত ।
( abridged মত্স্যপুরাণ )

৬ নভে, ২০১৪

রাস, c/o ভাগবত

রাস, c/o ভাগবত
"তোমরা আমাকে ভালোবাসা দাও, আমি তোমাদের ভালোবাসা দিব" কানুদা এমনটি বলতেন। আমজনতাকে অবিশ্যি নয়। গোপিনীদের। গোপবালারা এক সে বড় কর এক সুন্দরী, অদ্বিতীয়া প্রেমিকা আর সারাক্ষণ কৃষ্ণপ্রেমে হাবুডুবু খাওয়া বৃন্দাবনের কিছু রমণী। এই বৃন্দাবনের গোপবালারা ভক্তিযোগে কানুকে পাবার জন্য আমরণ চেষ্টা করে গেছেন। রাধার সাথে কানুর পিরীতি তাদের বুকে শেল হয়ে বাজত। রাধা একাই কেন পাবে কানুকে? তাদের যুগলে দেখতে পেলে ঝলসে যেত গোপিনীদের চোখ, ফেটে যেত বুক। এহেন কূটনৈতিক কানু যাদবের চিন্তা হল। এত কষ্টের তৈরী ব্র্যান্ড। যুগে যুগে সেই ব্র্যান্ডকে বাজিয়েই চলেছে আম আদমী। কিন্তু বৃন্দাবনের গোপিনীরা কানুর পিরীতি থেকে বঞ্চিত থেকে যদি সেই আদি অনন্ত দুধ সাদা ব্র্যান্ডে কালি ছিটিয়ে দেয়? অগত্যা মধুসূদন। কানু যাদব ফন্দী আঁটলেন। শারদীয়া উত্সবের পরপর আম আদমীর মনখারাপ থাকে।গোপিনীদেরো ঘরের কাজকর্মে একটু ঢিলাঢালা ভাব থাকে। উত্সবের হ্যাঙ ওভার কাটতে না কাটতেই কার্তিকের পূর্ণিমায় আয়োজন করবেন রাস উত্সব... এই ছিল প্ল্যান। তিনিই স্বয়ং ইভেন্ট ম্যানেজার। c/o ভাগবত !
অতএব সতীলক্ষ্মী সব গোপিনীদের সঙ্গে কানুদার একান্তে গেট টুগেদার হল রাসলীলা। আর তাই তো কানুদা হলেন রাসবিহারী। এ হল দ্বাপরের বেত্তান্ত। তারপর কলিতেও সেই ট্র্যাডিশন অব্যাহত। বৃন্দাবনের আনাচেকানাচে কানুগত প্রাণ গোপিনীদের হৃদয়যন্ত্রে সেদিন বেজে উঠেছিল ভালোবাসার সেই সুর যা এখনো হৃদয়ঙ্গম করছেন সারা দেশের মানুষ। অতএব কানুদার রাধার সাথে পরকীয়ায় নিজের দাপুটে ব্র্যান্ডে কেউ কালি ছেটাতে পারেনি। 
ঠিক যে মূহুর্তে গোপিনীরা "নাহ্‌, ঐ বাঁশী শুনে আর কাজ নাই" ভাবল তখনি কানুদা রাসলীলার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করলেন। মানে একপ্রকার গোপিনীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেই বসলেন বিচক্ষণ কানুদা। আগে বাজাতেন ভৈরবী, ইমন, শুদ্ধ বিলাবল, ভূপালী এইসব রাগ-রাগিনী। এখন বাজালেন আহির ভৈরব, পুরিয়া ধ্যানেশ্রী, আশাবরী ...যত করুণ রসে সিঞ্চিত সুরের ঝর্ণা তত‌ই পাগলপ্রায় গোপিনীদের অবস্থা। অভিসারের কথা না জানিয়েই ছুটে যেতে ইচ্ছে হল প্রাণ। সবকিছু দিতে ইচ্ছে হল কানু-দয়িতের জন্যে।
কেউ তখন দুধ দুইছিল, কেউ দুধ জ্বাল দিচ্ছিল, কেউ রাঁধছিল খিচুড়ি। কেউ নিজের সন্তানকে দুধ খাওয়াতে ব্যস্ত ছিল। কেউ স্বামীকে দফতরে পাঠানোর জন্য দেখভাল করছিল। যে যেমন অবস্থায় ছিল ঠিক তেমন অবস্থায় সবকিছু ফেলে রেখে ছুটল সেই বাঁশীর পিছুপিছু।
"কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো, আকুল করিল মন-প্রাণ"
একজন গোপিনী স্নানের পর চন্দন দিয়ে অঙ্গরাগ করতে ব্যস্ত ছিল। একজন পরছিল কাজল। একজন সবেমাত্র কাঁচুলি পরেছে, ভুলে গেল উত্তরীয় পরিধানের কথা। একজন আবার এক কানে কুন্ডল পরেই দৌড়ল। "উথালিপাথালি ওদের বুক, মনেতে নাই সুখ রে, আমায় ডুবাইলি রে , আমায় ভাসাইলি রে"
লাজলজ্জা বিসর্জন দিয়ে কানুর কুঞ্জবন রূপ বৈঠকখানায় ছুটল তারা।
চুলোয় যাক্‌ সংসার! রসাতলে যাক স্বামী-পুত্র! "রইতে নারে, বাঁশীতে ডেকেছে যারে"
বাঁশীওয়ালার ডাকে সাড়া দিয়েও বিপদ হল গোপিনীদের। কানু বাঁশীওয়ালা পরীক্ষা নেন সতত‌ই। গোপিনীরা পূর্ণিমার রজতশুভ্র জ্যোত্স্নায় বৃন্দাবনের কুঞ্জে এসেছে সব ছেড়েছুড়ে। এর মধ্যে কে কানুকে সত্যি ভালোবাসে আর কে লোক দেখানো সেটা যাচাই করতে তিনি বললেন, ভয়ঙ্কর রাতে, বনে বাদাড়ে হিংস্র বন্যপ্রাণী আছে। অতএব তোমরা ঘরে ফিরে যাও। গোপিনীরা বলল, চাঁদের আলোয় আঁধার তো দিন হয়েছে আর বৃন্দাবনের জন্তু জানোয়ার বন্ধুপূর্ণ অতএব আমরা আজ ফিরবনা এরাতে। কানুদা আবারো বললেন, তোমাদের পরিবারের লোকেরা কি বলবে? তাদের অহেতুক চিন্তা বাড়িওনা। কিন্তু গোপিনীরা নারাজ। "রহিল মোর ও ঘর দুয়ার".... কেষ্টারে লয়েই থাকবেন তেনারা।
নিজেদের মধ্যে তারা বলাবলি করতে লাগল" আজ সব ছেড়ে চলে এলাম তার জন্যে, আর এখন কিনা তিনি বলছেন ফিরে যেতে?" এদিকে প্রেমের অনুঘটক রূপে কাজ করল কার্তিকের মৃদুমন্দ হিমেল বাতাস, আকাশে রূপোর থালার মত পূর্ণচন্দ্র, আর ভেসে এল নানা ফুলের গন্ধ।
দিশেহারা হয়ে গেল সতীলক্ষ্মী গোপিনীরা। তন্ময় হয়ে গেল কানুচিন্তায়। ভুলে গেল দেহ-গেহ। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে তারা একদৃষ্টে চেয়ে কেমন যেন সম্মোহিত হয়ে গেল একে একে। কানুর রূপ, বাঁশীর সুর, প্রেমের অনুকূল প্রকৃতি সবকিছু মিলেমিশে একাকার তখন। তাদের পরপুরুষের হাবভাব, চালচলন, চটূল হাসি, অকপট অনুরাগ, মধুর বাক্যালাপ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগে ব্যস্ত তারা।
"ভিতর বাহিরে, অন্তর-অন্তরে আছো তুমি, হৃদয় জুড়ে"
তারা যারপরনাই হারিয়ে ফেলল নিজ নিজ পৃথক সত্ত্বা। প্রগাঢ় প্রেমে বুঝি এমনটিই হয়ে থাকে। পাগলপ্রায় গোপিনীরা উচ্চৈস্বরে গাইতে লাগল গান... "হরিনাম লিখে দিও অঙ্গে"
ছবিঃ রুচিরা চ্যাটার্জী 
 কানুর দুষ্টুমি শুরু হল তখন। অশোক, নাগকেশর, চাঁপা গাছের আড়ালে চলে গিয়ে পরখ করতে লাগলেন তাদের প্রেমের আকুতি। লুকোচুরি চলল কিছুক্ষণ। কানুর প্রিয় ছোট ছোট ফুলগাছ, কুর্চি, মালতী, জাতি। এদের কাছে গিয়ে গোপিনীরা জিগেস করল তারা... কানুকে দেখেছ ?
এভাবে চলল কিছুক্ষণ। অবশেষে বৃন্দাবনের তরুলতার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে তারা লক্ষ্য করল কানুর খালিপায়ের ছাপ। ওরা ভাবল আবারো বুঝি কানু সেই রাধার সাথে দেখা করতে চলে গেছে। খুব অভিমান হল তাদের। হঠাত তারা দেখল কিছুদূরেই রাধা মূর্ছিত হয়ে পড়ে আছে। তা দেখে চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হল গোপিনীদের। সখীদের সেবায় রাধার জ্ঞান ফিরল। তাকে নিয়ে গোপিনীরা চাঁদের আলোয় যতদূর পর্যন্ত যাওয়া যায় ততদূর গেল। তন্ন তন্ন করে খুঁজল কানুকে। তবু তার দেখা নাইরে। তার দেখা নাই। তারপর কানুর স্তুতি শুরু হল।
তারপর কিছুটা মান-অভিমানের পালা। যার জন্য আমাদের সব ছেড়ে চলে আসা, যার বাঁশীর শব্দে আকৃষ্ট হয়ে আমরা এই গভীর বনে চলে এলাম, যার কষ্টে আমরা এতদিন কষ্ট পেলাম, যাকে ভালোবেসে আমরা সকলের কাছে খারাপ হলাম সেই কানু কিনা আমাদের বুঝলনা? অতএব কানু একজন শঠ ব্যক্তি। তিনি মিথ্যাচার করেছেন। তিনি কপট। কানু বেচারা তখনো ইনভিজিলেটরের ভূমিকায়। পরীক্ষা তিনি নিয়েই চলেছেন।
আচমকা অতর্কিতে কানু বেরিয়ে এলেন বনের মধ্যে থেকে। গলায় বনমালা আর পরণে পীতাম্বর পট্টবস্ত্র। আকস্মিক মৃত সঞ্জীবনীর কাজ হল। গোপিনীরা প্রাণ ফিরে পেলেন যেন। এবার শুরু প্রকৃত লীলার ।
সংস্কৃত গোপী শব্দটির অর্থ হল রাখালি বালিকা যাঁরা গো-সেবা করেন। কেউ বলেন গোপিনী, কেউ আবার বলেন গোপীকা। এঁরা হলেন ভক্তিমার্গে বিচরণকারী ব্রজের রমণী। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন কৃষ্ণের একশো আটজন সখী...এঁরা হলেন বৃহত্তর বলয়ের নিবিড় সাথী... চন্দ্রাবলী এঁদের মধ্যে অন্যতম। আরো নিবিড়তর বলয়ের অষ্টসখী হলেন চম্পকলতা, চিত্রা, ইন্দুলেখা ,রঙ্গদেবী, সুদেবী, তুঙ্গবিদ্যা, ললিতা, বিশাখা.......। আর সবচেয়ে কাছের এবং অন্যতমা হলেন শ্রীরাধিকা। শ্রীকৃষ্ণচরিতামৃত অনুযায়ী সব মিলিয়ে বৃন্দাবনে তখন কৃষ্ণের সাথে ষোলোহাজার গোপিনী সঙ্গ করেছিলেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার দূত ছিলেন তাদের প্রভুর। কেউ কেউ ছিলেন পরিচারিকা বা সেবাদাসী।
শ্যামলী তার চন্দনচর্চিত বাহুদুটি দিয়ে কানুকে জড়িয়ে ধরল। চন্দ্রাবলী বিনয়ের সাথে হাতজোড় করে প্রেমের পরিচয় দিল। শৈব্যা অঞ্জলিপুটে কানুর চর্বিত পান গ্রহণ করল।পদ্মাবতী নিজের বুকের মধ্যে কানুর চরণযুগল রাখল । ললিতা অনিমেষ নয়নে কানুর শ্রীমুখ দর্শন করতে করতে বিহ্বল হয়ে পড়ল। বিশাখা কানুকে নিজের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা করে চোখ বুঁজে পরম তৃপ্তি লাভ করল। আর যে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে কানু আমার, আমি কানুর ন‌ই সেই রাধিকা অভিমানে ক্ষোভে ফেটে পড়ল। বৃন্দার কানুকে দেখে পাগলপ্রায় অবস্থা। বিদ্যুত্লতার মত দেহবল্লরী নিয়ে চম্পকলতা স্থানুবত দাঁড়িয়েই র‌ইল। কখন প্রভু কৃপা করে তার হাতটা ধরবেন একটু! একটু হবে স্পর্শসুখ। বহু প্রতিক্ষীত একটুকু ছোঁয়া লাগা স্মৃতি নিয়ে ফিরে যাবেন আবার গৃহকাজে।
অতঃপর প্রাণে খুশীর জোয়ার এল। কেঁপে কেঁপে উঠল গোপবালারা। সায় দিয়েছে কানুর মন। বিরহের অবসান হল। দেবতারা বিমানে চড়ে উপস্থৈত হলেন স্বর্গলোকে। পুষ্পবৃষ্টি হতে লাগল। দুন্দুভি বেজে উঠল। রাসমন্ডল শতশত ব্রজবালার নূপুরের সিঞ্জিনী, বলয়ের কিঙ্কিনীতে তোলপাড় হতে লাগল। এ যেন এক স্বর্গীয় লীলাখেলা। সকল গোপিনীরাই অনুভব করল যে কানু তাদের দুহাত দিয়ে কন্ঠ আলিঙ্গন করছেন। নিজের মহিমাবলে কানু তখন একই অঙ্গে বহুকৃষ্ণে লীলা করতে লাগলেন তাদের সাথে। প্রত্যেকেই খুশি তখন। সম্মোহন শক্তিতে আপ্লুত তারা। সকলের মনে হল কৃষ্ণ শুধু তার্, আর কারো নয়। নিজের নিজের কাছে প্রিয়তমকে দেখে সকলেই উদ্বেলিত তখন। ব্রজবালারা কটিবন্ধের চাদর কষে বেঁধে নিলেন। কঙ্কন-বলয়ে রোল তুলে, মল-নূপুর, বিছুয়া বাজিয়ে উদ্দাম নৃত্য করতে লাগলেন সেই একমেবাদ্বিতীয় কৃষ্ণকে ঘিরে। গাইতে লাগলেন শ্রুতিমধুর গান। কানু নিজের গলা থেকে মল্লিকাফুলের মালা ছুঁড়ে দিলেন গোপিনীদের দিকে। দীর্ঘায়ত হল সে রাত। নক্ষত্রমন্ডল রাস দেখতে দেখতে বিস্মৃত হল অস্ত যেতে।
এখন আমাদের প্রশ্ন হল শ্রীকৃষ্ণ কেন পরস্ত্রীদের সাথে এহেন পরকীয়ায় লিপ্ত হলেন? আদৌ কি এ পরকীয়া প্রেম না কি অন্যকিছু? না কি দেবতা বলে তাঁর সাতখুন মাপ? ভাগবত অনুযায়ী তিনি মায়ায় বশ করেছিলেন। নিজের সাথেই নিজে খেলা করেছেন। যে ব্যক্তি শ্রদ্ধাশীল হয়ে তাঁকে একান্ত আপনার করে পেতে চায় তাঁর সাথে তিনি এমন লীলাই করেন। গোপবালারা উপলক্ষ্য মাত্র। শ্রীধর স্বামী তো বলেইছেন
"রাসলীলায় শৃঙ্গাররস ছলনামাত্র। আসলে এই লীলা মুক্তিপ্রদায়িনী।" আর তাই তো তিনি এখনো বৃন্দাবন তথা সমগ্র বিশ্বের একমেবাদ্বিতীয় ব্র্যান্ড এম্বাস্যাডার!!!

৩১ অক্টো, ২০১৪

জগত্+ধাত্রী == জগদ্ধ্বাত্রী

মেয়ে যুদ্ধ করে জিতে এয়েচে, মানে দশহাতে অসুর বধ করেচে, দেশ জুড়ে সবাই মেয়েটাকে বাহবা দিতেছে.... মাদুগ্গা কৈলাসে ফিরে গেচেন মাস খানেক হল। দেবতারা বসে সেখানে গোঁফে তা দিতেছেন।
একা মেয়েছেলের কত ক্ষেমতা বাপু, কেষ্টদা অকপটে মেনে নিল।
কেউ বলছে, ধুস্‌ তবুও যদি বুঝতুম একা সামলেছে সব।
ধার করা সব অস্ত্র শস্ত্র পেলে আমারাও অমন দশটা অসুর মারতে পারতি, ইন্দর দাদাবাবুতো কোনো রাখঢাক নেই, বলেই ফেল্ল।  
তবে যাই বলো বাপু দুগ্গাটা দেকিয়ে দিল! শিবুদা বৌয়ের প্রশংসায় আরো কয়েক ছিলিম বেশী গাঁজা নিয়েছে ।
এখন কৈলাসে মহিষাসুর বধের দ্বিতীয় ইনিংসের তোড়জোড়। বড়াখানার আয়োজন হচ্ছে। দুর্গার অনারে। তবে অহংকারে পা পড়তেচেনা কারো। যেন তেনারাই যুদ্ধ করে এয়েচেন। তাই দেখে শুনে শিবুদা বললেন তা তোমাদের বৌয়েরা তো সব পাটরাণী। বলি আমার বৌ অসুর মেরেচে তো তোমাদের এত গর্বের কি! এমন ভাবখানা কচ্চো যেন তোমরাই মেরেচো!
ব্রহ্মা সেই শুনে একটা ফন্দী আঁটলেন। ব্রাহ্মণের রূপ ধরে রাজসভায় এসে সকলের সামনে একটা তৃণ মানে কচি দুব্বোঘাসের টুকরো রেখে বললেন, দেখি কত্ত ক্ষেমতা বাপু তোমাদের্? এই তৃনটাকে উড়িয়ে দাওতো যেমন করেই হোক!
পবনদেব এলেন। বললেন্, এ আর এমন কি! কিন্তু শত চেষ্টা করেও পারলেন না ঐ ঘাসের টুকরোকে হটাতে। এরপর অগ্নিদেব এলেন তৃণকে পুড়িয়ে দেবার জন্যে। সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও বিফল হলেন।
তখন ব্রহ্মা স্বয়ং নিজের রূপ ধরে বল্লেন, কি করে পারবে তোমরা? সারাটা জগতকে যিনি ধারণ করে রয়েছেন তিনিই তো মায়া-মমতা-স্নেহ দিয়ে আগলে রেখেছেন ঐ তৃণটুকুনিকে। অতএব স্বীকার করলে তো ঐ জগদ্ধ্বাত্রীর কত্ত ক্ষেমতা? আর তোমরা কিনা দুর্গার অসুরবধ নিয়ে বুক ফোলাচ্ছ্, গোঁফে তা দিছ, পার্টির আয়োজন কচ্চো যেন তোমরাই অসুরটাকে মেরেচো!!!

অতএব এখন দুর্গা=জগদ্ধ্বাত্রীর অনারে আরো একবার পার্টি হৌক্! কেষ্টদা বলে উঠলেন!!!  

২২ অক্টো, ২০১৪

প্রাক্‌-কালীপুজো কথন


কোজাগরীর ঘোর কাটতে না কাটতেই কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর পরদিনেই ভূতচতুর্দশী। শুক্লপক্ষে আকাশ আলো করা রূপোর থালার মত চাঁদ, হিম ঝরানো জ্যোত্স্না আর শারদীয়ার মনখারাপ। দিন পনেরো কাটতে না কাটতেই কৃষ্ণপক্ষের সূচনা। ভূত চতুর্দশীর প্রস্তুতি। আমেরিকার হ্যালোউইন আর ভারতবর্ষের আকাশ প্রদীপ জ্বলা ভূত চতুর্দশীর ঘোর অন্ধকার। সেই পূর্ণিমার চাঁদ এখন ঘুমোতে গেছে। ঝুপসি অন্ধকার আকাশের গায়ে। শহরে অবিশ্যি আসন্ন দীপাবলীর আলোর রোশনাই আর আকাশছোঁয়া ঘরবাড়ির আলোয়, বাজির গন্ধকী গন্ধে ভরপুর বাতাস। হিমের পরশ, ঝিমধরা নেশাগ্রস্ত ... ঋতু বৈচিত্র্যময়তায় । কার্তিক মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী। আকাশের ফুটফুটে তারা সেই অন্ধকারে দৃষ্টিগোচর হয়। হ্যালোউইন পালিত হয় সেদেশে মৃত আত্মার শান্তি কামনায়। ঠিক যেমন আমরা আমাদের মহলায়ায় প্রিয়জনের মৃত আত্মার প্রতি স্মৃতিতর্পণ জানিয়ে পিতৃপক্ষের অবসান ঘটিয়ে দেবীপক্ষের শুরু করি। 
 মহালয়ার দিনে আমরা যে পিতৃপুরুষকে স্মরণ করে  তাঁদের মর্ত্যে অবতরণ ঘটিয়েছিলাম । ঠিক একমাস পরের অমাবস্যায় তাঁদের আবার স্বর্গে ফিরে যাবার কথা। তাঁদের যাত্রাপথকে আলো দেখানোর জন্য এই একমাস আকাশপ্রদীপ জ্বলেছে প্রতিবাড়ির ছাদে। এবার তাঁদের যাত্রাপথকে আলোকিত করার জন্য দীপাবলী উত্সব। তাঁরা আবারো শান্তিতে  আলোয় আলোয় ফিরে যাবেন স্বর্গলোকে।   

ভূত চতুর্দশীর অন্ধকারে মৃত আত্মারা নাকি ঘুরে বেড়ায়। তাদের আত্মার শান্তি কামনায় চৌদ্দ রকম শাক (ওল, কেঁউ, বেতো, সরিষা, কালকাসুন্দে, নিম, জয়ন্তী, শাঞ্চে, হিলঞ্চ, পলতা, শৌলফ, গুলঞ্চ, ভাটঁপাতা, সুষণী ) ভেজে খাওয়ার রীতি। আর সন্ধ্যেবেলায় বাড়ির আনাচে কানাচে চৌদ্দ প্রদীপ জ্বালার নিয়ম। কোথাও যেন কোনো অন্ধকার না থাকে। বৈদিক মতে এর ঠিক একমাস আগে মহালয়ার দিন পরিবারের আত্মীয় বন্ধুদের মৃত আত্মার শান্তি কামনা করে তর্পণ করা হয় তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। আবার তন্ত্র মতে ঠিক এক মাস পরে এই কার্তিক অমাবস্যার আগের দিন মৃত আত্মাদের আলো জ্বালিয়ে স্মরণ করা হয়। মূল কথা একটাই ,তোমরা সুখে থাকো, ভালো থাকো। কারো কোনো অনিষ্ট কোরোনা। 

ছবিঃ শিল্পী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় 

 

পুরাণকথায় পাই দেবী কালী নাকি কার্তিকমাসের এই চতুর্দশীর রাতে ভয়ানক অত্যাচারী নরকাসুরকে বধ করেন। তাই তামিলনাডুতে এই চতুর্দশীর রাতেই দীপাবলি পালিত হয়। কিন্তু অন্য সব রাজ্যে পরের দিন অর্থাত অমাবস্যার রাতেই কালীপুজো হয়। গোয়ায় নরকাসুরের কুশপুত্তলি পোড়ানো হয় মহা সমারোহে। কাগজের তৈরী এই কুশপুতুলে নানারকম বাজি বেঁধে তাতে অগ্নিসংযোগ করে জ্বালানি হয়। কারণ কিংবদন্তীর কড়চা বলে গোমন্তেশ্বর বা গোয়াতেই নাকি নরকাসুরের দাপট অতিবৃদ্ধির জন্য স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ তা রুখতে সেখানে হাজির হন সুদর্শন চক্র সমেত। তবে নরকাসুর বলি হন মা কালীর হাতে।
গুজরাট, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র উত্তরপ্রদেশ সহ সর্বত্র দেওয়ালী পালন করা হয় আলোর উত্সব, ধনতেরস ইত্যাদির সাথে । আত্মীয় বন্ধুদের সাথে উপহার আদানপ্রদান হয়, মোমবাতি, প্রদীপের আলো দিয়ে ঘরবাড়ি সাজানো হয়।
দক্ষিণ ভারতে যেমন নরকাসুর বধের আনন্দোত্সব হল দীপাবলী উত্তর ভারতে রামচন্দ্রের রাবণ বধ করে অযোধ্যায় ফিরে আসার বিজয়োত্সব।আলো দিয়ে অযোধ্যা নগরীর কোণা কোণা সাজানো হয়েছিল। তাই আলোর উত্সব দীপাণ্বিতা বা দীপাবলী বা দেওয়ালি। মূল কথা আলো আর তাকে কেন্দ্র করেই নতুন পোষাক, সুখাদ্য আর উপহার আদানপ্রদান। সেই কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীকা, কামরূপ থেকে কাথিয়াবাড় সর্বত্রই অশুভ শক্তির বিনাশ আর শুভ শক্তির বরণোত্সব হল দীপাবলীর মদ্যা কথা।
ধনাগমের জন্য মানুষ করে ধনতেরস ও লক্ষ্মী-গণেশের পুজো। মূল উদ্দেশ্য একটাই। শ্রীবৃদ্ধি আর উন্নতি। আলোয় আলোয় সব ঘুচে যাক্‌, মুছিয়ে দে মা মনের কালি।
পশ্চিমবাংলায় অনেকের রীতি কালীপুজোর বিকেলে দীপাণ্বিতা লক্ষ্মীপূজো করে অলক্ষ্মী বিদেয় করা হয় । সংসারে সারাবছর যাতে শ্রীবৃদ্ধি হয়, ধনাগম হয় সেই আশায় । লক্ষী, নারায়ণ আর ধনপতি কুবেরের পুজো হয় । পিটুলি বাটা দিয়ে মা তাঁর নিপুণ হাতে তৈরী করেন তিন পুতুল.... সিঁদুর দিয়ে পিটুলির তৈরী লালরঙের লক্ষ্মী পুতুল, নীলের গুঁড়ো দিয়ে নীল নারায়ণ পুতুল, আর অপরাজিতা পাতা বাটা দিয়ে সবুজ কুবের পুতুল । কলার পেটোতে সেই পুতুল তিনটিরই আসলে পূজো হয় ঐদিন । আর একটি কলার পেটোতে মাথা থেকে আঁচড়ানো চুলের নুড়ি, একটু গোবর আর একটা ভাঙা মোমবাতি রেখে তৈরী হয় অলক্ষী । চাটাই পিটিয়ে, মোমবাতি জ্বেলে অলক্ষীকে বাড়ির বাইরে বের করে পূজো করে, লক্ষী, নারায়ণ আর ধনপতি কুবেরকে শাঁখ বাজিয়ে বরণ করে প্রতিষ্ঠা করা হয় ।

চাটাই বাজাতে বাজাতে বলা হয়,

 " অলক্ষ্মী বিদেয় হোক, ঘরের লক্ষ্মী ঘরেই থাক্" আসলে কুললক্ষ্মীর পুজো এই দীপাণ্বিতা লক্ষ্মীপুজো। ........

সারা ভারতবর্ষ জুড়ে চতুর্দশীর আগের দিন অর্থাত ত্রয়োদশীর দিন ধনতেরস নামে উত্সব পালন হয় । পুরাণের গল্পে আছে সমুদ্রমন্থনের সময়কালীন এক গল্প। ঐশ্বর্যের ভারে অহংকারী দেবরাজ ইন্দ্র সকলকে খুব হেয় করছিলেন। একদিন দুর্বাশা মুনি তাঁর গলার পারিজাতের মালাটি অত্যন্ত স্নেহের সাথে হাতির পিঠে চড়া ইন্দ্রকে গলায় পরিয়ে দিতে যান। মালাটি ইন্দ্রের গলায় না পড়ে হাতির দাঁতের ওপর গিয়ে পড়ে ও হাতি ততক্ষণাত সেই মালাটিকে শুঁড়ে করে মাটিতে ফেলে দেয়। তা দেখে দুর্বাসা অতীব ক্রুদ্ধ হন ও দেবরাজকে "লক্ষ্মী চ্যুত হও" এই বলে অভিশম্পাত করেন। মুনির এই অভিশাপে দেবরাজ ইন্দ্র অসুরদের পরাজয় লাভ করেন ও রাজ্য, সিংহাসন, লোকবল সব হারান। অসুররা তখন স্বর্গের মালিকানা পান ও লক্ষ্মীদেবী সহ সমগ্র দেবতাকুল পালিয়ে গিয়ে সমুদ্রের অতলে আশ্রয় নিলেন। দেবকুলের এহেন সমূহ বিপদে দেবরাজ ইন্দ্র প্রজাপিতা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। তিনি সব শুনে বললেন একমাত্র বিষ্ণুই পারেন দেবতাদের বিপন্মুক্ত করতে। আর তখনি শুরু হল সেই মহাকার্য যার নাম সমুদ্রমন্থন। সমুদ্রের গভীরে নাকি "অমৃত" নামে এক অমোঘ সঞ্জিবনী সুধা আছে যা পান করলে দেবতারা অমরত্ব লাভ করবেন। বিষ্ণুর আদেশে মন্দার পর্বত হল সমুদ্রমন্থনের দন্ড। আর নাগরাজ বাসুকী হল মন্থনের রজ্জু। মন্দার পর্বতকে বাসুকী তার সমগ্র শরীর দিয়ে বেষ্টন করে র‌ইল আর দেবতারা দুইদিক থেকে তার মুখ ও লেজ ধরে টানতে লাগলেন। শুরু হল ভয়ানক সমুদ্রমন্থন প্রক্রিয়া। ইন্দ্রের বাহন ঐরাবত নামে হস্তী, চন্দ্র, উচ্চৈঃশ্রবা নামক অশ্ব, বৈচিত্রময় মণিমাণিক্য, পারিজাত নামক স্বর্গের নান্দনিক পুষ্পবৃক্ষ সব উঠে আসতে লাগল একে একে । এরপর অমৃতের ভান্ড হাতে উঠলেন দেবতাদের চিকিত্সক ধ্বন্বন্তরী। আর সবশেষে বাসুকীরাজের সহস্র ফণারূপ ছত্র মাথায় উঠে এলেন মা লক্ষ্মী।
প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী কার্তিকমাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশীতেই সমুদ্র থেকে উঠে এসেছিলেন ধ্বন্বন্তরী। তাই এই তিথির নাম হল ধনতেরস। তাই এই দিনটিতে ধনের উপাসনা করতে হয়। আর তার ঠিক পরেপরেই লক্ষ্মীর পুজো করতে হয়। সমুদ্রের ক্ষীরসাগর থেকে উঠে এসেছিলেন মহালক্ষ্মী। সেদিন নাকি ছিল কার্তিক অমাবস্যা। তাই লক্ষ্মীকে বরণ করে স্বর্গে ফিরিয়ে নেওয়ার অনুষ্ঠানটিতে আলোকমালায় সুসজ্জিত করা হয়েছিল স্বর্গকে।

২৬ সেপ, ২০১৪

প্যাপিরাস পুজোসংখ্যা






মিশন সাকসেসফুল! মঙ্গল হি মঙ্গল! মঙ্গলে ঊষা, বুধে পা !
তাই মঙ্গলযানের উপকক্ষপথে সফল প্রতিস্থাপনে প্যাপিরাসের পুজোসংখ্যার প্রকাশ! দেশ ও দশের মঙ্গলবার্তা পাথেয় হোক!

প্যাপিরাস ই-পত্রিকা পড়ুন এবং পড়ান। প্যাপিরাসের পাঠক এবং লেখক বন্ধুদের দুর্গাপুজোর জন্য অনেক শুভকামনা জানাই! 



১৪ আগ, ২০১৪

স্বাধীনতা ???

আমার স্বাধীন কলম  ৬৭ বছরের পুরোণো স্বাধীনতার পরেও  প্রতি মূহুর্তে প্রশ্নবাণে ক্ষতবিক্ষত করে আমাকে   ।
স্বাধীনদেশে জন্মেছি তাই ভাগ্যবতী কিন্তু প্রশ্নের জটগুলো ছিঁড়ে বেরোব কবে? বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠে উল্লিখিত দেশমাতৃকা যাকে আমরা প্রণাম করে বলি "বন্দেমাতরম্‌"  !   সেই মা ছিলেন, আছেন ও থাকবেন  । কিন্তু কতটা ভালো থাকবেন আর কেমন করে আমাদের ভালো রাখবেন সেটাই হল প্রশ্ন । 
সেসময়  রক্তমাংসের মা ছিলেন ধূলোমুঠি শাড়িতে, কোলজুড়ে ছেলেপুলের বাত্সল্যে উথলে ওঠা নিপাট ঘরের বৌটি । সংসার সামলানো যার জীবনজুড়ে । ম্যাটিনি শোয়ের সিনেমা যার বিলাসিতা  আর সরাদিনের তেলহলুদ মাখা শাড়ি পরা হেঁশেল অন্তপ্রাণ । হাসিমুখে থোড়-বড়ি-ডাঁটার জঞ্জাল সামলাতে সিদ্ধহস্ত এহেন মা'টি  ছিলেন ঈষত লাজুক স্বভাবের ।
কালের চক্রে অবগুন্ঠনা মায়ের উত্তরণ ঘটল । মা অসূর্যম্পশ্যা থেকে আলোর মুখ দেখলেন । শিক্ষার ধারাপাত তাঁর হাতে । মুখে প্রচ্ছন্ন বুদ্ধিদীপ্ততা , চোখে উদ্ভাসিত উচ্চাকাঙ্খা । আধুনিকা তিনি আবার পুরাতনীও কিছুটা ।
আবার উত্তরণ এই মায়ের । আলোর দিশা নিজেতো দেখলেনই আবার পৃথিবীকেও দেখালেন ।
কিন্তু প্রাপ্য সম্মনটুকুনি কি আদায় করতে পারলেন সেই মা ?   আর তাই বুঝি আমাদের সমাজে মায়ের এত অবহেলা ? কন্যাভ্রূণের প্রতি অবিচার থেকে নারীপাচার, কিশোরী ধর্ষণ থেকে  স্বাধীনভাবে নিজের মনোভাব ব্যক্ত করতে গিয়ে লাঞ্ছিত হতে হয় সেই মা'কে? আবার এই বিশ্বায়নের যুগে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়
"বেকার হোমমেকার" "মা" টিকে ভিখারি, বারবণিতা, এবং বন্দীর সাথে একই আসনে রাখা হয় কারণ এরা সকলে "নন প্রোডাক্টিভ" পপুলেশনের আওতায় পড়ে ।  এই মা'র জন্য‌ই কেউ গিয়ে নাসায় রকেট চড়ছে, কেউ জীবনদায়ী ওষুধ তৈরী করছে, কেউ বানাচ্ছে  অটোমোবাইল, কেউ বা হচ্ছে সৌরভ, লিয়েন্ডার-বিশ্বনাথনের মত  কিম্বা রবীন্দ্রনাথ, অমর্ত্য সেনের মত নোবেল লরিয়েট অথবা অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ আনছে মেরি কমের মত !  
তাই আমার অন্তঃসলিলা মনের ধারা বলে উঠলঃ

এই কি আমার স্বাধীনতা, যা বলে "উন্নত মম শির"
এই কি সেই স্বাধীনতা, সে তো পদ্মপাতায় নীর !
এই কি আমার স্বাধীনতা, না কি নিছক দেশপ্রেম ?
এই কি আমার স্বাধীনতা
যা তোমার আমার ভালোয় মন্দে রোদের কণায় হেম?

দূর থেকে সেই স্বাধীনতা আমরা উপভোগ করে যাব ? রোদের কণা যেমন ছোঁবার স্বাধীনতা আমাদের নেই ঠিক তেমনি?  

৭ আগ, ২০১৪

বাইশে শ্রাবণ

আজ অরণ্যমেধ যজ্ঞের সামিল হয়ে মানুষ যখন পরিবেশ সচেতনতার বাণী আওড়ায় তখন মনে হয় বাইশে শ্রাবণের কথা। মরণশীল রবিঠাকুরের মৃত্যুদিন বাইশে শ্রাবণকে তার আশ্রমের বৃক্ষরোপণের দিন হিসেবে ধার্য করেছে বিশ্বভারতী। যেন তিনি ঐ উত্সবের মধ্যে দিয়ে নবজীবন লাভ করেন প্রতিবছর। ১৯৪২ সাল থেকে এমনটি হয়ে আসছে অথচ বিষয়টির ওপর বিশেষ আলোকপাত দেখিনা। 

শ্রাবণের ধারায় সিক্ত মাটিতে উদ্ভিদ তার সঞ্জিবনী শক্তি পায় ও ধীরে ধীরে  মহীরুহে রূপান্তরিত হয়। তাই তার নবীন জীবন বরণের এই উত্সবে কবির গতজীবন স্মরণ-মননের এবং বৃক্ষের নবজীবন বরণের। শান্তিনিকেতনে বিগত এই এতগুলি বছর ধরে কত নামী মানুষের হাতে পোঁতা বৃক্ষের তালিকাসূচি পাওয়া যায় । শ্রাবণ যেন দিনের শেষে যেতে গিয়েও যেতে পারেনা। বাইশেও তাকে নতুন করে ফিরে পাওয়া আমাদের। প্রকৃতিপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে ছিলেন। তাঁর ছিন্নপত্রে তার উল্লেখ পাই আমরা। 

কবি বলছেন্" এই পৃথিবীটি আমার অনেক দিনকার এবং অনেক জন্মকার ভালোবাসার লোকের মত আমার কাছে চিরকাল নতুন। আমি বেশ মনে করতে পারি, বহুযুগ পূর্বে তরুণী পৃথিবী সমুদ্রস্নান থেকে সবে যখন মাথাতুলে উঠে তখনকার নবীন সূর্যকে বন্দনা করছেন তখন আমি এই পৃথিবীর  নূতন মাটিতে কোথা থেকে এক প্রথম জীবনোচ্ছ্বাস গাছ হয়ে পল্লবিত হয়ে উঠেছিলেম।"

 বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানের সূচনা কবি প্রথম করেছিলেন তাঁর জন্মদিনে। আর কেন এই উত্সব সেই কারণ হিসেবে কবি বলেন" পৃথিবীর দান গ্রহণ করবার সময় মানুষের লোভ বেড়ে উঠল। অরণ্যের হাত থেকে কৃষিক্ষেত্রকে সে জয় করে নিলে, অবশেষে কৃষিক্ষেত্রের একাধিপত্য অরণ্যকে হটিয়ে দিতে লাগল। নানা প্রয়োজনে গাছ কেটে কেটে পৃথিবীর ছায়াবস্ত্র হরণ করে তাকে নগ্ন করে দিতে লাগল। তার বাতাস হল উত্তপ্ত, মাটির ঊর্বরতার ভান্ডার নিঃস্ব হল।"

এই কথা মাথায় রেখেই বৃক্ষরোপণ বা বনমহোত্সব্ বা তাঁর ভাষায় " অপব্যায়ী সন্তান কতৃক মাতৃভান্ডার পূরণের কল্যাণ উত্সব"  

তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। কবির পরিবেশ বান্ধব মনের কোণে জেগে থাকা কত ইচ্ছে পূরণ হয়নি। তাঁর ইচ্ছেগুলোর সুবিচার হয়েও হয় নি। বিচারের বাণীগুলি নীরবে, নিভৃতে কেঁদেছে। সোনাঝুরির খালপাড়ে কত চাঁদ-সূয্যি উঠে অস্ত গেছে। আশ্রমের আম্রকুঞ্জ থেকে ছাতিমতলা অবধি কত গৃহবাসী দ্বার খুলেছে। কত বসন্ত, কত পৌষ দেখেছে। গোয়ালপাড়া থেকে তালতোড়, ফুলডাঙা থেকে শ্যামবাটিতে কত জনসমাগম হয়েছে। খোয়াইহাটে কত কত কাঁথা বাটিকের পসরা সেজেছে। ভুবনডাঙায় কত টেরাকোটার ঢোলক, নোলক নাড়াচাড়া হয়েছে । কত আউল বাউল গাইল মন প্রাণ ঢেলে। হৃদমাঝারে তবুও ধরে রাখতে পারলনা তাদের কবিগুরুকে । একরত্তি কোপাইয়ে যে জল সেই জলই রয়ে গেল যেন। আজ তিনিও পণ্য। বসন্ত উৎসবে, পৌষ মেলায় তাঁকে বেশী করে স্মরণ, মনন, তাও নিজেদের স্বার্থে। বৃক্ষরোপণ আজও হয় বাইশে শ্রাবণে তবু আরও সবুজায়ন হয়েছে কি? শান্তিনিকেতনের চারিপাশে আবর্জনার দূষণ কমেছে কি? গুরুকুলে শিক্ষার মান বেড়েছে কি? বিশ্বভারতী তেমন করে আর কবির ঠাটঠমক ধরে রাখতে পারল কই? 


 তথ্যসূত্রঃ রবীন্দ্রনাথ ও মানুষ ছিলেন, আবদুস শাকুর ( দীপ প্রকাশন্ )

২৭ জুল, ২০১৪

"লাউপাতায় ইলিশ পাতুড়ি"


শাউড়ি কটা কচি কচি লাউপাতা তুলে আনল মাচা থেকে। বৌ ততক্ষণে জ্যান্ত ইলিশমাছটাকে বঁটিতে কাটতে বসল। আর নাতবৌটা বসল কালো সরষে, পোস্ত আর নারকেল কোরা নিয়ে শিলে বাটতে। গিন্নী চেঁচিয়ে বললে" ওরে তুলসী মঞ্চের পাশে লঙ্কাগাছটা থেকে কটা টাটাকা কাঁচালঙ্কা তুলে আন দিকি। নাতবৌ চেয়ে নিল খান ছয়েক। বৌ বললে মাছের পিস পিছু একটা করে লঙ্কা নিবি বৌ। আর কটা লঙ্কা চিরে রাখবি। সরষের তেল বের করেছিস কৌটো থেকে? বৌ মাছগুলো ধুতে যাবে, শাউড়ি বললে, উঁহু কেটে ধুতে বলেছিলাম।  একবারের পর আর ধুবিনে বৌ। এবার ধবধবে সাদা সেই রূপোলী শস্যগুলো বৌয়ের হাত থেকে সোজা এল একটা টিফিনকৌটোর মধ্যে। তারপর তাতে পড়ল নুন ছিটেফোঁটা হলুদ, সর্ষে-পোস্ত-নারকেল-কাঁচালঙ্কা বাটা। বৌ মাখতে লাগল আর নাতবৌ ওপর থেকে ঢেলে দিল এক খাবলা সরষের তেল। এভাবে পড়ে র‌ইল সেই রূপোলী শস্য ঘন্টা দুয়েক। তারপর শাউড়ির পেড়ে আনা লাউপাতার মধ্যে একটা করে মাছ, একটা করে চেরা কাঁচালঙ্কা দিয়ে বন্দী হল পাতার মোড়কে। তারপর খড়কে কাঠি আটকে তাওয়ায় তেল মাখিয়ে রেখে দিল বৌ। দুমিনিট পরে উল্টে দিল। তারপর আবার পাল্টে  দিল বৌ খুন্তি দিয়ে আরো দুমিনিট ঐ ভাবে। সবশেষে গরম গরম ভাতের মাছে সোজা সেই রূপোলী শস্য এসে পড়ল ওদের থালার পরে। 
আমার দিদিমা নাম দিয়েছিলেন "লাউপাতায়  ইলিশ পাতুড়ি" দিদিমা অবিশ্যি গরমভাতের মধ্যে লাউপাতা গুলোকে রেখে দিতেন। তাতেই সেদ্ধ হয়ে যেত। পাতা-মাছ-মশলা-তেল শুদ্ধ ভাতে মেখে খেয়ে ফেলা যায়। কিছুই যায়না ফেলা। আমি তাওয়ার বদলে টেফলন কোটেড ননস্টিক প্যানে করলাম আজ। নাম দিলাম "হিলসা-টেফ্লোরা"  খুব সহজপাচ্য এই  ইলিশ পাতুড়ির  । আর তেল খুব কম লাগে ।

২৩ জুল, ২০১৪

আমার স্কুলের স্মৃতি


বৃষ্টির গন্ধে মন কানায় কানায় ভরপুর। মনে পড়ে যায় স্কুলের বনমহোত্সবের কথা। নামকরা মেয়েদের স্কুল ।

স্কুলের নাম : বরানগর রাজকুমারী মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুল

ঠিকানাঃ ২ এবং ৩ শশীপদ ইনস্টিট্যুট লেন

কলকাতা ৭০০০৩৬



মফঃস্বলের স্কুল কিন্তু পুরোণো কোলকতার মেয়েদের স্কুলগুলোর মধ্যে অন্যতম । মেয়েদের স্কুলে এখানেই প্রথম চালু হয়েছিল বিজ্ঞান শাখা । আর ছিল কেতাদুরস্ত ল্যাবরেটারি । লাইব্রেরীতেও ছিল বিশাল ব‌ইয়ের সম্ভার । ছিল খেলার মাঠ । একটা প্রকান্ড চেরী গাছ, আর ছিল ডালিম,জামরুল আর আতাগাছ । বড়দির ঘরের পেছনে ছিল লিলিপুল । মাঠের একদিকে গ্রিণ হাউস । অনামা সব ফুলেল ক্যাকটাস থাকত সেই গ্রিণহাউসে। স্কুলের দুটো গেট । একটা কেবল সকালে খুলত প্রাথমিক সেকশানের জন্য আর দুপুরে খুলত দুটোই । দুই গেটের মাথায় জুঁইফুল গাছের আর্চ আর গেট পেরিয়ে স্কুল অফিসে ঢোকার মুখে দুপাশে গোলাপের কেয়ারি । কি সুন্দর পরিবেশ !
স্কুলের দুটো বিল্ডিং । একটা পুরোণো আর একটা নতুন । পুরোণো বিল্ডিংয়ে সকালবেলায় প্রাইমারীর ক্লাস হয় আর দুপুরে সেকেন্ডারির । নতুন বিল্ডিংয়ে হায়ার সেকেন্ডারির ক্লাস হয় আর সেই সাথে ল্যাব, অফিস সব চলতে থাকে । দুই বিল্ডিংয়ের মাঝে বেশ কিছুটা জমি আছে স্কুলের । সেখানটা বন্ধ । ছোট্ট একটা গেটও আছে এবাড়ি থেকে ওবাড়ি যাবার ; টিফিনের সময় ফুচকা-আলুকাবলি ওয়ালারা ঐ গেটের কাছটাতেই হেলান দিয়ে বিক্রি করে সব । কিন্তু সেই গেটটা সচারচর খোলা থাকেনা । ছুটির দিনে বোধ হয় মালি গিয়ে সেই জমির আগাছা সাফ করে আসে ।
ঐ জায়গাটায় একটা ফ্যামিলি সেমেটরি । স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা খ্রীষ্টান ছিলেন। রাজকুমারী দেবীর স্মৃতি রক্ষায় ঐ স্কুল।
ওনাদের পরিবারের সকলের কবরখানা ঐটে ।
ওনার ভাই বোনেদের ও কত ছোট ছোট সব ক্রস দেওয়া সিমেন্টের বেদী করা রয়েছে । ভালো করে দেখলে ওনাদের পুরো ফ্যামিলি ট্রি টা লক্ষ্য করা যায় । কত ধূপের কাঠি আর মোমবাতির টুকরো পড়ে থাকত। আমরা টিফিন খেতাম সেখানে। ওনার নাকি খুব গাছপলার শখ ছিল । আর তাই তো প্রতিবছর বর্ষার সময় আমাদের স্কুলে বনমহোত্সব বা বৃক্ষরোপণ হয় ঘটা করে ।গ্রীষ্মের ছুটির পরেই বৃক্ষরোপণ উত্সবের তোড়জোড় চলত ।
দস্তুর মত রিহার্সাল চলত কমন রুমে । বনমহোত্সবের একটা স্ক্রিপট বছর বছর হয়ে আসছে । একটু রদ বদল করে কয়েকটা গান এদিক ওদিক করে নৃত্যনাট্য দাঁড় করানো হয়। সবুজ গাছ লাগানো হয় । খুব উত্সাহে মেয়েরা নাচ গান প্র্যাকটিস করে প্রতিবছর । অনুষ্ঠান শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের গান 'আয় আমাদের অঙ্গনে, অতিথিবালক তরুদল ' দিয়ে আর শেষ হয় 'মরুবিজয়ের কেতন ওড়াও, এ শূন্যে ওড়াও ওড়াও হে প্রবল প্রাণ' দিয়ে । প্রথম দৃশ্যে একদল মেয়ে নেচে নেচে মঞ্চে এসে প্রবেশ করে আর শেষ দৃশ্যে তারাই আবার প্রত্যেকে হাতে একটা করে সবুজ চারা গাছ নিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে এসে খোলা স্কুল মাঠের ধার দিয়ে নেচে নেচে চলে । গাইতে থাকে বাকি সকলে যারা এতক্ষণ ধরে গান পরিবেশন করছিল । নাচের মেয়েদের মেঘ রংয়ের শাড়ি আর সবুজ উড়নি মাথায় । গানের মেয়েরা কচিকলাপাতা রঙের শাড়ি আর মেঘ নীল ব্লাউজে । আগে থেকে স্কুলের মালি যেখানে যেখানে নতুন গাছ পোঁতা হবে তার জন্য মাটি খুঁড়ে নির্দ্দিষ্ট ব্যাবধানে গর্ত করে রাখে । নাচের মেয়েরা নাচ করতে করতে একে একে গাছগুলি সেইখানে রেখে দেয় আর গানের মেয়েরা জলঝারি দিয়ে জল দান করে সেই নতুন গাছের চারায় । এভাবেই হয়ে আসছে বছরের পর বছর ।


আমার রবীন্দ্রনাথের গানের চর্চা স্কুল দিয়েই শুরু। ধরণীর গগনের মিলনের ছন্দে, এক আকাশের তলায গীতবিতানের ছন্দে গন্ধে মুখর হয়ে উঠত তিনটে মাস। কিশোরী হৃদয়ে মেঘের ডমরু, আসন্ন শরতের জন্য উশখুশানি আর পড়াশুনোর ভার তো ছিল‌ই। এখনো বর্ষায় রবীন্দ্রনাথকে আমার মত করে ফিরে পাই সেই বনমহোত্সবের গানে, কবিতায়। নিজের মনে আবৃত্তি করে উঠি.... ত্রস্তপায়ে চুপিচুপি চলে যাওয়া রাইকিশোরীর বনে-উপবনে অভিসার যাত্রার সাক্ষী হয়ে। আমার ভাবনাগুলো বর্ষার হাওয়ায় এখনো মেতে ওঠে মুকুলিত গাছের মত, কেঁপে ওঠে কচি কিশলয়গুলো, জলভেজা জুঁইয়ের গন্ধ, শ্রাবণের ধারার সাথে চুঁইয়ে পড়ে মনের কার্ণিশে।

photo courtesy: Google

১২ জুল, ২০১৪

দিন বদলের পালা


প্রথমে বেড়ানো ছিল রেলগাড়ি করে । কুঝিকঝিক করতে করতে বিশাল ট্রেনকে টেনে নিয়ে যেত স্টিম ইঞ্জিন । তারপর এল ইলেকট্রিক ট্রেন ।  ডিজেল থেকে বিদ্যুত উত্পাদন করে তা দিয়ে ট্রেন  যা  আমরা এখনো চড়ছি । তবে স্থান কাল পাত্রভেদে ট্রেনের জার্ণি বড্ড আরামদায়ক হয়ে ওঠে যখন রিজার্ভড আসন থাকে এবং ট্রেনটি পরিচ্ছন্ন থাকে । আশপাশের অনবরত বদলে যাওয়া দৃশ্যপট এই যাত্রার আনন্দকে আরো বাড়িয়ে তোলে ।  সেই সবুজ ধানক্ষেত বা গ্রামের চালাঘর কিম্বা দূরের সেই তালদীঘি কেমন যেন নস্ট্যালজিক করে তোলে । এখন সময়ের অভাবে ট্রেনে না গিয়ে হয়ত প্লেনে যেতে হয় আমাদের কিন্তু যে যাই বলুক ট্রেনে চলার সাথে সাথে কেমন যেন গ্রাম্যগন্ধ ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে থাকে আর ষ্টেশন এলেই সেই চা'ওয়ালার ডাক কিম্বা নিষিদ্ধ সব ডিপফ্রায়েডের হাতছানি ?  এখন চা ওয়ালার সফিষ্টিকেশন লেভেল অনেক ওপরে । ফোটানো চায়ের পরিবর্তে টিব্যাগ এসেছে । জনগণের কল্যাণার্থে, চা-কফির পাশে জায়গা করে নিয়েছে ঠান্ডা পানীয়ের বোতল ও খনিজলবণ সমৃদ্ধ পানীয় জল । মনে মনে ভালোলেগেও যায় এই সব দেখেশুনে । নিজের দেশটাকে কে না ভালো দেখতে চায় ! 
আমাদের ঠাকুমা দিদিমারা রেলগাড়িতে চড়ে হাওয়া পরিবর্তনের যেতেন, দেওঘর কিম্বা জসিডি, ঘাটশিলা কিম্বা দার্জিলিংয়ে। সাথে যেত ইকমিক কুকার। দেদার রান্নাবাটিও চলত রেলগাড়িতে। ম্যারিনেটেড মাংস, ডাল, চাল সব স্তরে স্তরে সাজিয়ে দিয়ে ইকমিক কুকারে বন্দী করে তারা তাসের আড্ডায় মেতে উঠতেন ট্রেন ছাড়ার পর। আমাদের প্রজন্মে লুচি-তরকারী-মিষ্টি বাড়ি থেকে বানিয়ে নিয়ে ট্রেনে ওঠা হত। আর এখন স্টুডেন্টরা মহা খুশিতে ইন্সট্যান্ট কাপ-ও-নুডলসে কিম্বা ডিহাইড্রেটেড বিরিয়াণির প্যাকেট খুলে দিব্যি গরম জল ঢেলে খেতে অভ্যস্ত । আরো ব্যাস্ততা বাড়ছে। জীবন হয়ে উঠছে শর্টকাট। তারা কিচেনের তেলকালিকে বাইপাস করে জয় মা বলে ভাসায় তরী।   

প্লেনে কেমন যেন একটু বেশি শহর-শহর গন্ধ ।  চেনা শহরটা হুস করে পেরিয়ে যাবার আগেই একফালি বিকিনি জানলায় চোখ রেখে একচিলতে নীল নদীটাকে সি অফ করে চলা । শহরের আলুলায়িত নীলচে সবুজ নিকেল সালফেটের মত ল্যান্ডস্কেপটাকে টপকে টপকে মেঘের মধ্যে দিয়ে ভাসতে ভাসতে মনে হত এই যে নীচের শহরটাকে দেখছি সেখানে কোথাও একটা বিন্দুর মত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আমার বাড়ি  । ভাবতে ভাবতেই নিমেষের মধ্যে হারিয়ে যেত আমার শহর, নীল নদী, সবুজ গড়ের মাঠ,  সবুজ ঘেরা লেকের জল । মেঘের বাড়ির জানলা একে একে বন্ধ হয়ে যেত । পাইলট প্লেন ঘুরিয়ে দিত গন্তব্যের নিশানায় ।  আরবান ল্যান্ডস্কেপ, ব্যস্ত জীবনযাত্রা আমার চোখের আড়ালে তখন ।  প্রথম প্রথম প্লেনে উঠে মনে হ'ত সত্যি সত্যি এটা  আমার শহর ছিল তো ! এছিল শেষ আশির দশকের ভাবনা ।

তারপর হাইরাইজ, শপিং মল আরো ঝকঝকে সবুজ ল্যান্ডস্কেপ্, ম্যানিকিওর্ড টাউনশিপের সবুজ, তারমধ্যে একরত্তি সুইমিংপুলের নীল প্লেনের জানলায় ধরা দিল । এরোপ্লেনে উঠে  ককপিটে গিয়ে  পাইলটের কেরামতি দেখা হত ।   দক্ষিণদিকে যাবার সময় পাইলট আর কেবিন ক্রু'কে রিকোয়েষ্ট করা হত বঙ্গোপসাগর এলেই জানান দিতে, যেন পুরীর মন্দিরকে ওপর থেকে একটা ঢিপ করে পেন্নাম করে নিতে পারি কিম্বা উত্তর দিকে গেলে বেনারসের কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরকে ।    তখন পাইলটের দুনিয়া, প্লেন চালানোর কেরামতি আর ঐ এক স্কোয়ার ফুট জানলার মধ্যে দিয়ে নিজের দেশের খুঁটিনাটি ঐশ্বর্য্যটাকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করাটাই ছিল বিরাট আনন্দের ।  আর রোদঝলমলে দিনে হিমালয়ের মাথায় রূপোর ঝালর ? সেটা দেখলে মনে হ'ত প্লেনে চড়ার পয়সা উশুল । মনে মনে বিজ্ঞানকে ধন্যবাদ দিতাম ।

মুঠোফোনের দুনিয়াটা কেমন ধীরে ধীরে বদলে দিল জীবনকে ।

এল বেশ গোদামাপের  মুঠোফোন ।  তখন এয়ারপোর্ট পৌঁছে বাড়িতে সংবাদ দেওয়াটা ছিল আরো রোমাঞ্চকর ব্যাপার । তারপর প্লেন ছাড়ার ঠিক আগের মূহুর্তে সেলফোন অফ করার আগে আরেকবার ফোন করে  জানানো... এ কথাই শেষ কথা নয়তো!

তারপর সংক্ষিপ্ত বার্তাবিনিময় বা এসেমেস চালু হল । আরো সুবিধে হল । কম খরচে যোগাযোগ । মনে মনে বিজ্ঞানের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই ।

এবার রঙীন সেলফোন । স্লিম এন্ড ট্রিম ।  ক্যামেরাও আছে । ছবি তুলে এমএমএস  পাঠানো যায় । অপব্যবহারে বেশী কাটতি হলনা এই এমএমএস প্রযুক্তির । মনে মনে বিজ্ঞানকে কটাক্ষ করলাম ।   

হাতের তালুতে সেলফোনটি নিয়ে কেন জানি বারবার মনে পড়ে যায়,কোনো এক টেলিকম কোম্পানির একদশকের পুরোণো সেই বিখ্যাত শ্লোগানটিকে.... "কর‌ লো দুনিয়া মুঠ্ঠি মে"

সত্যি তো এই মুঠোফোন পুরো দুনিয়াটাকে হাজির করেছে আজ আমাদের হাতের নাগালের মধ্যে । মোবাইলের জন্মলগ্নে তার আকৃতি ছিল বেশ বড়সড় । তারপর টেকনোলজির উন্নতির সাথে সাথে সেটিও স্লিম হতে শুরু করল ।

সেলফোন হল যন্ত্র । মোবাইল পরিষেবা তার যন্ত্রী । দুটিই উপচে পড়ছে কারিগরী কৌশলে । এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমাকে । এই দুটি প্রযুক্তির মেলবন্ধনে গ্রাহক নানারকম সুযোগ সুবিধে পেয়ে থাকেন ।

গোড়ার দিকে সেলফোন পরিষেবার যে প্রযুক্তি ছিল সেটি ভয়েস বা কথা বহন করত । পরিষেবাটি1Gবা প্রথম জেনারেশান । সেই যুগের হ্যান্ডসেটের প্রযুক্তি কেবল একটি রঙ(মোনোক্রোম্যাটিক)অক্ষর এবং সংখ্যা(আলফা নিউমারিক তথ্য)স্ক্রিনে দেখাত । এরপরে পরিষেবার প্রযুক্তি উন্নত হয়ে2Gবা দ্বিতীয় জেনারেশনে পৌঁছল । এই2Gপরিষেবা কথার সঙ্গে ডেটা বা তথ্য বহন করল । সমতুল্য ভাবে হ্যান্ডসেট প্রযুক্তি একরঙা স্ক্রিন এবং অক্ষর ও অঙ্কের যুগপত গন্ডী পেরিয়ে কম্পিউটারের মতন গ্রাফিকাল আইকন ব্যবহার শুরু করল ।

কিন্তু যেহেতু পরিষেবা প্রযুক্তি তথ্য বহনে সক্ষম সেই কারণে কিছু নতুন সুযোগ সুবিধে পেল গ্রাহক । যেমন এসেমেস এবং সীমিতভাবে ইন্টারনেট ব্রাউসিং ।

এইভাবে আন্তর্জালের সাথে মোবাইল ফোনের গাঁটছড়া বাঁধা হল;মুঠোফোন হ্যান্ডসেট নির্মাতারা নতুন সুযোগ সুবিধে দেওয়া শুরু করল যেমন ব্রাউসিং এর সাথে সাথে ইমেল বা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং । অসুবিধে হল একটাই । এই সব আকর্ষণীয় সুযোগ সুবিধা ব্যবহার করতে গেলে যতটুকু তথ্য বিনিময় করতে হয় সেটি2Gপরিষেবা প্রযুক্তি সামাল দিতে পারল না । পরিষেবা প্রযুক্তি আরো একধাপ এগুলো ।

2Gগন্ডী পেরিয়ে এইবার মাঠে নামল3Gবা তৃতীয় জেনারেশান মোবাইল পরিষেবা।3Gপরিষেবার বিশাল তথ্যবহনকারী ক্ষমতাকে উপযুক্ত কাজে লাগানোর জন্য হ্যান্ডসেট প্রযুক্তি উন্নত হল;আইফোন এবং এন্ড্রয়েড ভিত্তিক মুঠোফোন বাজারে ছেয়ে গেল । এই আইফোন বা এন্ড্রয়েড ভিত্তিক স্মার্টফোনগুলি আদতে এক একটি ন্যানো কম্পিউটার যা ল্যাপটপ বা ডেস্কটপের তুলনায় কোনো অংশে কম নয় ।

3Gবা2Gপরিষেবা ব্যবহার করে ইন্টারনেটের সমস্ত সুযোগ সুবিধে যেমন ফেসবুক,ইউটিউব,গুগল ম্যাপস,গুগল সার্চ,জি মেল,ট্যুইটার ও অসম্ভব মনোরঞ্জন কারক গেম গ্রাহকের হাতের মুঠোয় পৌঁছে গেল ।3Gতথ্যবহনকারী ক্ষমতার পরিষেবা থাকলে সুবিধা বেশী কিন্তু পুরোণো2Gতেও কাজ চলতে লাগল । এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কম্পিউটারের দুটো অসুবিধে । তার ছোট স্ক্রিন আর ছোট কিবোর্ড ।

কিন্তু'কুছ খোয়া কুছ পায়া'। কিন্তু কেয়া পায়া?

যদি বলি"নখদর্পণ" ?কারণ কিবোর্ডের অভাবে এখন সমস্ত হ্যান্ড সেট নির্মাতারা অত্যাধুনিক টাচস্ক্রিন প্রযুক্তি এনে দিয়েছেন যার ফলে আঙুলের একটুকু ছোঁয়াতেই নদী-পাহাড়-সমুদ্র আমাদের নখদর্পণে ।

প্রাচীনকালে যে অলৌকিক বিদ্যার সাহায্য নিয়ে কোনো দূরের বস্তু বা ব্যক্তির প্রতিবিম্ব নিজের নখে প্রতিবিম্বিত করে দেখার গল্প শোনা যায় সেই কি এই প্রযুক্তি?

তুফানি আড্ডার ফাঁকে,সেদিনের তিথি নক্ষত্র নিয়ে তুমুল তর্ক বেঁধে গেলে,সন্দেহ নিরসনের কায়দায় এই মুঠোফোনটি পঞ্জিকার ভূমিকাও পালন করতে পারেল হিন্দু ক্যালেন্ডার এপ্লিকেশনটির কৃপায় ।

"ইউরেকা"বলে জিতে গিয়ে বলেও দিতে পারেন"হাতে পাঁজি মঙ্গলবার" !

বেড়াতে গিয়ে সমুদ্রের ধারে সূর্যোদয় দেখার কাঙাল আমি । কিন্তু ভোরের ঘুমও যে ছাড়েনা দুচোখকে । তাই গুগল সার্চ করে টাইম এন্ড ডেট ডট কম থেকে সানরাইজ@পুরী পেয়ে গেলাম আগের দিন রাতে । ঐ স্থানের সূর্যোদয়ের নির্ঘন্ট জেনে রেখে ঘড়িতে এলার্ম । ফলে সমুদ্রের ধারে গিয়ে ঘুমচোখে সূর্যদেবের আরাধনা করতে হ'লনা । আমি গেলাম সময়মত । উনিও টুক করে উঠে আমাকে দেখা দিলেন । রঙ ছড়াতে শুরু করলেন আকাশের ভাঁজে ভাঁজে ।

মনে মনে বললাম "ভাগ্যি স্মার্টফোন ছিলি আমার হাতে"!!!

কিন্তু গল্প এখানেই শেষ নয়, দিন আগত ঐ! 
ক্রমে খুলে যাচ্ছে  2G জট। 3G হাতের মুঠোয়। আর 4G ধরে ফেলেছে তাদের।  নেটওয়ার্কের মধ্যে আমরা ক্রমশঃ প্রবেশ করে যাচ্ছি। বদলে যাচ্ছে জীবন। 

১৫ এপ্রি, ২০১৪

কলকাতার বোশেখ, বোশেখের কলকাতা

বার দেখতে দেখতে আমরা নতুন বছরের দোরগোড়ায়। নতুন বাড়ির হাউস ওয়ার্মিং পার্টির তোড়জোড় শুরু। সারা বছরের পুরনো খাতাপত্তর ঝেড়েঝুড়ে তাকে গুছিয়ে, সকলের বাড়িতেই এখন বসন্ত বিদায়ের তোড়জোড়। আবার গরমের বিকেলে গা ধুয়ে পরে নেব মলমল শাড়িখানা, বরষার সান্ড্যাক চটিজোড়া যত্ন করে রেখে দেব, ভাদ্রের রোদে পুরনো বালুচরি রোদ খাওয়াব, শীতের পশমিনা-বালাপোশ মথ বলের গন্ধে ভরপুর করবে। ফাগুনের আগুন নিভে যাবে দোলের সঙ্গে সঙ্গে আর তার সঙ্গেই চৈত্রসেলের চিত্কার! চৈত্রমাস পড়তে না পড়তেই পুরনো বছরটার পাততাড়ি গোটানোর ধান্ধা। নতুন বছর আসবে বলে ঘর ঝাড়াপোঁছা, সেই অছিলায় নতুন জামা, আনন্দে হইহই করে হ্যাং আউটের প্ল্যান, নবপঞ্জিকা, হালখাতা আর নতুন ক্যালেন্ডার। সেইসঙ্গে বাঙালির ঝালিয়ে নেওয়ার পালা সেই বং-কানেকশন। কী করে ভুলি আমরা? যত‌ই ইংরেজি ছবি দেখি, ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে অনর্গল কথা বলি আর গোগ্রাসে কন্টিনেন্টাল খাবারদাবার গিলি না কেন, আদতে আমরা ঝোল-ঝাল-অম্বলের ভক্ত।

চৈত্রশেষে অকালবোশেখি পাওয়ার মতো বাঙালির আরও একটা বড় প্রাপ্তি হল পয়লা বৈশাখের অপ্রত্যাশিত নতুন জামাকাপড়, নিদেন একটা গানের সিডি অথবা একখানা ব‌ই। ঠিক তক্ষুণি মনে হয় ছোটবেলার কথা। মনে মনে আমাদের বয়স কিন্তু বাড়ে না। সেই পয়লা বৈশাখের দিন বাবার সঙ্গে দোকানের হালখাতার চিঠি নিয়ে, বরফকুচি দেওয়া কাচের গ্লাস ওপচোনো অরেঞ্জ স্কোয়াশ আর সঙ্গে বগলদাবা করে মিষ্টির বাক্স। ঠাকুমার জন্য বাড়ি নিয়ে যেতে হবে সোনার গয়নার দোকানে নতুন বাংলা ক্যালেন্ডার। দিদিমার জন্য বুকস্টল থেকে নতুন পঞ্জিকা, তা-ও নিতে হবে মনে করে। কমপক্ষে চারটি দোকানের মিষ্টির বাক্স একত্র জড়ো করে বাড়ি ফিরে বসবে আমাদের সান্ধ্য বৈঠকি। সঙ্গে গান তো হাতের পাঁচ। সবচেয়ে মজা লাগত মাছের বাজারেও হালখাতার মৌরসী পাট্টা দেখে। সে দিন মাছবাজার ধুয়েমুছে সাফ এক্কেবারে। মাছের আঁশটে গন্ধ কাটানোর জন্য ফিনাইল, ধূপ-ধুনো কত্ত সব কায়দা। আর মাছওয়ালাও ধবধবে পাজামা-পাঞ্জাবি চড়িয়ে বসেছেন জম্পেশ করে। আমি আছি বাবার হাত ধরে লেসের ফ্রিল দেওয়া, নতুন ছিটের নরম ফ্রকে। প্রথম বার গিয়ে ভেবেছিলাম সে বুঝি মাছ দেবে ফ্রি-তে। সে গুড়ে বালি! পয়লা নম্বর মিষ্টির বাক্স নিয়ে থরে থরে বসে আছে সে-ও!

পয়লা বোশেখের কথা মনে হলেই বেশি করে মনে পড়ছে হাতিবাগান বাজারের কথা। আমার কলেজবেলার পাঁচ-পাঁচটা বছরে এই হাতিবাগানের শাড়ির দোকানগুলো থেকে হইহই করে ভিড় মাথায় নিয়ে বন্ধুরা মিলে শাড়ি কিনতে যাওয়া, সে-ও এক দারুণ অভিজ্ঞতা। আর সেই সঙ্গে রূপবাণী-তে উত্তম-সুচিত্রার ছবি দেখে সিলভার ভ্যালির মুচমুচে কবিরাজি কাটলেট? ফড়িয়াপুকুরের টকি শো হাউসে তখন ভাল ভাল ইংরেজি ছবিগুলো আসত। বাবা নিয়ে যেতেন দেখাতে। টাওয়ারিং ইনফার্নো, টোয়েন্টি থাউসেন্ডস লিগস আন্ডার দ্য সি, টেন কমান্ডমেন্টস, বেনহার— কত ছবি না দেখা হয়েছে ওই হলে। আর ফেরার পথে ফড়েপুকুরের সেই অমৃতর পয়োধি?

আর মনে পড়ে স্টার থিয়েটারের কথা। সে বার কলেজ থেকে ফেরার পথে সুপ্রিয়াদেবীর "বালুচরী" নাটকের টিকিট কেটে নিয়ে এলাম বাড়ির সকলের জন্য। পর দিন পয়লা বৈশাখে সকলে মিলে নাটক দেখে বাড়ি আসা হল। কি দারুণ নাটক! যেমন কাহিনি তেমনই অভিনয়। ফিনিক্স পাখীর মতো আগুনে ভস্মীভূত হয়ে আবার সেই ছাই থেকে উঠে এসেছে স্টার। স্টার থিয়েটারের সিনেমায় উত্তরণ হয়েছে। ভাবলেও নস্ট্যালজিয়ায় সেই নাটক শুরু হওয়ার মিউজিকাল সোনাটা কানে বাজে।

হেদুয়ায় কলেজ গেটের পাশে রোজ সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা অবধি দাঁড়িয়ে থাকত মতিদা। এ পাড়ার বিখ্যাত ফুচকাওয়ালা। তার ফুচকা যেমন বড় বড়, গোল্লা গোল্লা ও মুচমুচে আর তেমনই সুস্বাদু তার যাবতীয় অনুপান। একদম ঠিকঠাক টক, ঝাল ও নুনের কম্বিনেশন। আমাদের অনেক গবেষণা হত সেই তেঁতুল জলের রসায়ন নিয়ে। বাড়িতে অনেক বকুনিও খেতাম রোজ রোজ ফুচকা খাওয়া নিয়ে। কিন্তু মতিদা মানুষটা আর তার ফুচকার টানকে কিছুতেই এড়াতে পারতাম না। মতিদার ছিল একটাই স্লোগান, "ইয়ে ফুচকা খাইয়ো তো মতিদাকা গুণ গাইও", "আমার ফুচকায় অসুখ করবে না। কলেজের ফিল্টারের জলে তৈরি এই তেঁতুলজল।"

আমার দিদি তখন পড়ত অন্য কলেজে। দিদিকে বলতাম "এক দিন তোকে মতিদার ফুচকা খাওয়াব।" তা সে আর হয়ে উঠত না। সে বার পয়লা বোশেখের ঠিক আগে মা নতুন জামাকাপড় কেনার টাকা দিলেন। আমরা দু'বোনে হাতিবাগান থেকে জামাকাপড় কিনে একটা চায়ের দোকানে এসে চা-জলখাবারের অর্ডার দিয়ে দেখি, পার্সের সব টাকা শেষ। মাত্র একটা কয়েন পড়ে আছে। এই হল পয়লা বৈশাখের হাতিবাগান! যেখানে অজস্র জিনিস আর তার হাতছনিকে উপেক্ষা করা যায় না। এ দিকে প্রচন্ড খিদে পেয়েছে আর বাড়িও ফিরতে হবে। হাঁটা লাগালাম কলেজের দিকে। বাসে উঠব যে সে পয়সাও নেই। হাঁটতে হাঁটতে দুজনে পৌঁছলাম কলেজ অবধি। সেখানে মতিদা তখনও দাঁড়িয়ে। দিদিকে দেখামাত্রই মতিদা যথারীতি তার স্লোগান আওড়াল, "ইয়ে ফুচকা খাইয়ো তো..."

দিদিকে কথা দিয়েছিলাম এক দিন ফুচকা খাওয়াব। মতিদা শালপাতা ভাঁজ করে এগিয়ে দিল আমাদের সামনে। আমি বললাম, "না, মানে একটা কথা ছিল মতিদা।" মতিদা বলল, "খাও খাও, কিচ্ছু হবে না।" বললাম, "না না, সে কথা নয়।" মতিদা  বলল, "মা বকবে?” বললাম, "না না, পয়সা ফুরিয়ে গেছে যে।" মতিদা বলল, "কাল দিও, আগে তো খাও।" আমি বললাম, "বাড়ি ফেরার পয়সাও নেই।" মতিদা বলল, "আমি দিচ্ছি, কাল দিও।" আমরা পেট পুরে ফুচকা খেলাম। এত ভাল বোধ হয় আগেও লাগেনি কখনও। আরও যেন বড়বড়, গোল্লা গোল্লা, মুচমুচে ফুচকা! আরও পার্ফেক্ট টক-ঝাল-নুনের কম্বিনেশন!

এই পয়লা বোশেখ এলেই আমার মতিদার কথাও ভীষণ মনে পড়ে!

আনন্দবাজার পত্রিকা, ইন্টারনেট এডিশান ১৫ই এপ্রিল, ২০১৪ 

১৩ এপ্রি, ২০১৪

বৈশাখী শুভেচ্ছা !

আবার ৩৬৫ দিনের পুরোণো একটা বাংলা বছর পাততাড়ি গোটাতে ব্যাস্ত । একদিকে লোকসভা ভোটের উত্তেজনার পারদ চড়ছে। অন্যদিকে গ্রীষ্ম তার চোখরাঙানি দেখাতে শুরু করেছে।  তার মাঝে চৈত্রসেলের রমরমা। ফুটপাথে “সেল, সেল”  চীতকারে ঝালাপালা শ্রবণেন্দ্রিয়ের দুদন্ড জিরেন হয় শপিংমলের “বাই ওয়ান-গেট ওয়ানে” চোখ বুলিয়ে।  আইসক্রিম, ঠান্ডাইয়ের সুখে আত্মহারা পাবলিক। সবকিছু অনুষঙ্গের সখ্যতা একটাই কারণে। তা হল বাংলা বর্ষবরণ।  ঠান্ডা পানীয়, ফ্রুট জুস, আইসক্রিম, নতুন জামা, স্প্রিং ক্লিনিং সবকিছুই মনে করিয়ে দেয় বৈশাখের আগমনী আর চৈত্রের স্মৃতি ঝেড়ে ফেলে দেওয়াকে।  মনে করিয়ে দেয় আবার সেই দাবদাহের কথা অথবা রবীন্দ্রজয়ন্তীর কথা। অকালবোশেখির হঠাত মেঘ কিম্বা কালবৈশাখির পরিকল্পনা। ঝোড়ো হাওয়ার দাপটে ভেসে আসে সাদা ফুলের গন্ধ। মেঘ-বৃষ্টি-রোদ্দুর সূচনা করে নতুন দিনের। নতুন বছরের। প্রকৃতি সতী গ্রীষ্মের সাজ সেজে বসে থাকেন রৌদ্রের ধুনি জ্বালিয়ে।
কারণ সে না এলে তো বর্ষার নো এন্ট্রি । তাই তো এই বর্ষবরণ অথবা বৈশাখ-উত্সব।  এই  নববর্ষের প্রাক্কালে মহানগরের ফুটপাথে   হকারময়তার বাড়বাড়ন্ত  । ঠিক গরমের দাবদাহের মত সহ্য করতে হয় যা। ভোটের রাজনীতি উচ্ছেদ করেনা তাদের। কারণ সবার উপর মানুষ সত্য। সবার ওপরে ভোটব্যাঙ্ক। কারো নতুন ব‌ইখাতা কারো হালখাতা। লক্ষ্মী-গণেশের জোড়া পুজো, শুভলাভের আশায়। আবারো হিপোক্রেসি। লোক ঠকানোর কৌশলে ঠাকুরকে বছরের শুরুতেই অগ্রিম দাদন। সেও মেনে নিতে হয় গরমের অসহনীয় তাতের মত। বাজারের থলিতে চৈত্রের বুড়ো সজনে ডাঁটায় ফ্যাশন আউট কারণ সদ্য সমাপ্ত গাজনের ঢাকের কাঠি পড়ে গেছে। আসলে তা বুড়িয়ে যায়, বাঙালির চিবুতে কষ্ট হয় কিন্তু দোহাই ভগবানের। আমরা বাপু নববর্ষের শুভ মহরত বুঝি নতুন খাওয়াদাওয়ায়, নতুন ব‌ই রিলিজে, নতুন ছবি মুক্তিতে। প্যাপিরাসের নববর্ষের প্রাক্‌কথন সেই কারণেই।  তাই সকলের জন্য র‌ইল নতুন বছরের বৈশাখী শুভেচ্ছা ।

২৩ মার্চ, ২০১৪

লড়াকু লেখিকা'র মনোলগ


 
ফেসবুকে আমার প্রোফাইল ডেসিগনেশন হল "লড়াকু লেখিকা" । সেই নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। আর কৌতুহলী জনগণ প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছেন ইনবক্সে। "আচ্ছা দিদি, আচ্ছা ম্যাম, আচ্ছা বন্ধু !!! এই "লড়াকু লেখিকা"র অর্থটা কি স্পষ্ট করে বলবেন? আপনি কি লড়াই করে লেখেন না কি লেখার জন্য লড়াই করেন ? অথবা দুটোই..." ব্যাপারটা যদি বুঝিয়ে বলেন। আমিও বেশ মজা পাই এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে। কিন্তু আমার ফেসবুকের লেখক-কবি বন্ধুরা হয়ত এই "লড়াকু লেখিকা" শব্দ দুটির অর্থ বেশ ভালোই বোঝেন আশা করি। বাংলাভাষায় লেখক-কবির সংখ্যা এত‌ই বেশী যে আমাদের প্রকৃত অর্থেই প্রতিনিয়ত লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। ওয়েবে লিখি আমরা অনেকেই। ছাপ পত্রিকাতেও লিখি অনেকে। কিন্তু ওয়েব পত্রিকার সম্পাদকরা সেই অর্থে অনেক বেশি লিবারাল ও বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যাবহার করেন লেখকদের সাথে। অন্যদিকে ছাপা কাগজে বা ম্যাগাজিনে বছরের পর বছর এল্খা জমা পড়ে থাকে। ফোন করে বা মেল করে নিজের লেখাটি প্রকাশের যোগ্য কিনা তা জিগেস করাটাও তাদের নাপসন্দ। কেউ কেউ আবার জিগেস করলে চোখ রাঙাতেও দ্বিধা করেন না। উঠতি লেখকরা যেন অপাঙতেয়। আর নামীদামী লেখকদের সাথে পঙতি ভোজনে বসানোটাও যেন তাঁদের কাছে একটা ছুঁতমার্গের আওতায় পড়ে। ছাপা পত্রিকায় লেখা থাকে..."লেখা পাঠান এই বিষয়ে, এত শব্দের মধ্যে..."
তাদের মত করে কাস্টমাইজড সার্ভিস দিয়েও সেই লেখা যখন প্রকাশিত হয় তখন লেখক তো আশা করতেই পারেন তাঁর উপযুক্ত সাম্মানিক। কিন্তু বহুদিন বাদে প্রশ্ন করলে তাঁরা উত্তর দেন "আমরা কেবল মাত্র আমন্ত্রিত লেখকদেরই সাম্মানিক দি " তাহলে মাননীয় সংবাদপত্র বা ম্যাগাজিন প্রায়শঃই কেন লেখা পাঠাতে অনুরোধ করেন তা বুঝতে পারলামনা। তাহলে কি কেবলমাত্র চেনা-পরিচিত লেখকদের লেখা ছাপা হলেই তাঁরা সাম্মানিক আশা করবেন?  অবিশ্যি ব্যাতিক্রমী কিছু পত্রিকাও আছে । যাঁদের কাছ থেকে না চাইতেও বাড়ির ঠিকানায় সাম্মানিক হাজির হয়ে যায়।  
 এই ধরণের ছোটখাটো লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে আমাদের মত লেখকদের তো জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যেতেই হয় তাই নয় কি! আর চলতেই থাকে কাগুজে পত্রিকা ভার্সেস ই-পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলীর লড়াইও।
আমার মত এহেন "লড়াকু লেখিকা"র একটি সাক্ষাতকার সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে একটি ই-পত্রিকায়। আশাকরি যারা আমাকে ইনবক্সে প্রশ্ন করেন তারা এর সদুত্তর পাবেন।  

১০ ফেব, ২০১৪

ভীম-একাদশী


মাঘমাসের শুক্লা একাদশীতে দক্ষিণ বঙ্গের একটি বহুপ্রচলিত গ্রাম্যরীতি হল ভৈম-একাদশীর ব্রত পালন । মাহাভারতের ভীম এবং একাদশীর এই যোগসূত্র কি এবং কেন সেই নিয়ে এই আলোচনা । 
হিন্দুঘরের বিধবা কুন্তী নেয়েধুয়ে একাদশীর উপবাস করেন । মাঘমাসের প্রচন্ড ঠান্ডায় পুকুরের ঠান্ডাজলে কেমন করে স্নান করবেন তা ভেবে কুল পান না । কিন্তু সাতপাঁচ ভেবেও ঐ ঠান্ডা জলে তাঁকে নামতে হ'ল । স্নান সেরে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে কুন্তী ঘরের  দিকে আসছেন । তাঁর মধ্যমপুত্র ভীমের সাথে দেখা হল । ঠান্ডায় কাবু মা'কে দেখে শীতের ওপর ভীমের বড় রাগ হ'ল ।  সে তখন লাঙ্গল কাঁধে ক্ষেতে যাচ্ছিল । মায়ের কষ্টকে বরদাস্ত করবেন না তাঁর মত বড় বীর । ফাল থেকে লাঙ্গলকে খুলে নিয়ে আগুণে কশকশে করে গরম করে "জয় কৃষ্ণ" বলে সেই লাঙ্গলের ফালকে পুকুরের ঠান্ডা জলে ডুবিয়ে দিলেন । আর দেখতে দেখতে শীত পালিয়ে গেল যেন । পান্ডবসখা কৃষ্ণ ভক্ত ভীমের মনস্কামনা পূর্ণ করলেন । হঠাত ভীম মায়ের দিকে চেয়ে দেখেন, কুন্তী খুব আরাম বোধ করছেন । 

এদিকে জলের দেবতা হলেন বরুণদেব ।  পুকুরের জলে আগুণ গরম লাঙলের ফাল ডুবিয়ে জলের গরম তাত সহ্য হয়নি একটুও । বরুণ সেই রাগে দ্বারকায় গিয়ে শ্রীকৃষ্ণের কাছে দৌড়ে গেলেন পুকুরের জলের তাত জুড়োনোর আর্জি জানিয়ে । কৃষ্ণের পায়ে লুটিয়ে পড়লেন বরুণদেব ।  কৃষ্ণের দয়া হল ।
কৃষ্ণ বললেন :  বরুণ তোমার গায়ের জ্বালা জুড়োনোর একটাই উপায় । মাঘমাসের শুক্লা একাদশীতে ভীম যদি এই ব্রতের পালন করে তবে তোমার জ্বালা জুড়োবে । তাপমাত্রা বৃদ্ধি জনিত দেহতাত কমে যাবে ।
এই কথা শোনামাত্র শ্রীকৃষ্ণকে প্রণাম করে বরুণদেব  দৌড়ে গেলেন ভীমের কাছে । বনের মধ্যে দেখা হল ভীমের সাথে । একাদশীর ব্রতের কথা ভীম  অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন । অগ্নিদগ্ধ বরুণদেবের গাত্রজ্বালা উপশম হল । 
মহাভারতের ভীম নাকি দক্ষিণবঙ্গে বেশ কিছুদিন ঘুরে বেড়িয়েছিলেন । 
 পঞ্চপান্ডব এই গহিন অরণ্যের মধ্য দিয়ে বনবাসে চলেছিলেন । সে কথার উল্লেখ কাশীরাম দাস অনুদিত মহাভারতে পাওয়া যায় ।  কুন্তী পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিতে বসলেন সেই জঙ্গলেই । আর সেখানেই উপজাতি পরিবারের রাক্ষস হিড়িম্ব আর তার বোন হিড়িম্বা এসে উপস্থিত হল ।  মহা উল্লাসে নরখাদক হিড়িম্ব তার কাজ সারতে পঞ্চপান্ডব সহ মাতা কুন্তীকে সংহার করতে উদ্যত হল আর মহাবলী ভীমসেন তার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন ।   হিড়িম্বকে বধ করে ভীমসেন তার দেহ রেখে এলেন খড়গেশ্বর শিবের মন্দিরের সামনে আর হিড়িম্বা রাক্ষসীর সাথে তার পর ভীমের প্রণয় ও গান্ধর্ব মতে তাকে বিয়ে ( এবং অবশ্যই সেই সময় বিয়ে না করে উপায়ও ছিলনা ভীমের, কারণ অরণ্যে শয্যা পেতে উপজাতিদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহবাস না করে কি উপায় থাকে! ) স্থানীয় মানুষরা বিশ্বাস করেন প্রাচীনকালে "মেদ" উপজাতির বাসভূমি হিসেবে মেদিনীপুর ভূখন্ডর নাম  এই ঘটনার সাক্ষী বহন করছে খড়গেশ্বর ও তার অনতিদূরেই হিড়িম্বেশ্বরী কালীর মন্দির যা পুজো করতেন মহাভারতের ভীমের পত্নী হিড়িম্বা । অতএব উপজাতির আবাসস্থল হিসেবে এই তথ্যটিও ফেলে দেবার নয় ।   

হিড়িম্বার সাথে এইখানেই  তার আলাপ । তাই ভীমের পুজো করার জন্যই ঐ অঞ্চলের গ্রামবাসীরা ভীম-একাদশীর ব্রত পালন করেন ।  
এই প্রচলিত গল্পের মধ্য দিয়ে আমরা যেমন দেখি ভীমের মাতৃভক্তি ঠিক তেমনি দেবলোকেও দেবতাদের মধ্যে ক্ষমতার প্রতিপত্তি বা এখনকার "দাদাগিরি" ও বারবার মনে করিয়ে দেয় আমাদের  ।   
  বাংলার লোকসংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে ভীমপুজোয় এই বিপুল আয়োজন আর আড়ম্বর দেখে মনে মনে বাঙালী বলে গর্বিত বোধ হয় । দশাস‌ই ভীমসেনের এই মূর্তি যেন মেলার একাই একশো। মাথাভর্তি কুঞ্চিত কেশ, শ্বশ্রূগুম্ফ সম্বলিত পৌরুষ যেন চিরন্তন বীরত্বের প্রতীক । কোথাও ইনি ভীমসেন, কোথাও বা খেত্তী ভীম, হালুয়া ভীম আবার কোথাও হুলা ভীম কিম্বা চাষী ভীম । কিন্তু সেই মহাভারতের মধ্যমপান্ডব স্থান-কাল-পাত্রভেদে যুবশক্তির বহিঃপ্রকাশ।  আর সর্বোপরি ভীমের এই পুজো যেন সমগ্র দক্ষিণবাংলার কৃষিপুজো কারণ তিনি তো আদতে পবনপুত্র ।  বায়ু আর বৃষ্টির হাত ধরে উর্বর হবে বাংলার মাটি। সবুজে সবুজ হয়ে উঠবে আবাদীজমি এই আশায় গাঁয়ের মানুষের এই বিশ্বাসে নতজানু হয়ে ভীমকে প্রণাম জানাই মনে মনে ।  
  এখন প্রশ্ন হল দক্ষিণবঙ্গে কেন ভীমপুজোর এত জনপ্রিয়তা? কৃষি ছাড়াও এখানকার বন্দর নরী তমলুকে একসময় বহু জাহাজ সমাগম হত। চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙার মত অনেক ব্যবসায়ীর পণ্যবোঝাই জাহাজ এসে ভিড়ত হলদিয়া বন্দরে । আবার রফতানি হত ভারতীয় সামগ্রী যবদ্বীপ, সুমাত্রা, বালির দিকে । বাতাসের আনুকুল্যে নিরাপদে,  নির্বিঘ্নে যাতে জাহাজ যাত্রা বা আগমন সফল হয় তাই পবনপুত্র ভীম সহায় । জাহাজ যাত্রা যাতে অগস্ত্যযাত্রার মত শেষযাত্রা না হয় তাই জলদস্যুর আক্রমণের স্বীকার না হওয়ার উদ্দেশ্যে ভীমের পুজো করে পাঠানো হত জাহাজগুলিকে । তাই সেই কারণে দক্ষিণবঙ্গের এই পবনপুত্রের ওপর ব্যবসায়ীদের ছিল প্রগাঢ় আস্থা ।  

২৫ জানু, ২০১৪

জাতিস্মর.. a musical of memories

জানিনা, আমার ভিতর বাহিরে অন্তর অন্তরে সে আছে অর্থাত গান আর লেখা আছে বলেই  জাতিস্মর আমার কাছে একটা কিংবদন্তী বাংলাছবি হয়ে র‌ইল কিনা ।  আমি এই ছবিকে সঙ্গীতের জাতিস্মরময়তা না জাতিস্মরের সঙ্গীতময়তা বলব ভেবে পাচ্ছিনা তবে কাহিনীকার তথা চিত্রনাট্য ও পরিচালক সৃজিতকে অভিনন্দন । 
আমার মাথা থেকে আপাততঃ উত্তম-তনুজার সেই জলসাঘরের যামিনীময়তা উধাও । অনেকেই হয়ত সমালোচনা করবেন প্রসেনজিত ভার্সেস উত্তমকুমারের, মান্না দে আর শ্রীকান্ত আচার্যের। আমি সে সব বিতর্কে না গিয়েই বলছি দেশ-কাল-পাত্র বদলেছে এবং সৃজিত সফল হয়েছেন । প্রসেনজিত, যীশু সবটুকু দিতে পেরেছেন।  আর সর্বোপরি কবীর সুমন ছবির সঙ্গীতের ব্যান্ডমাষ্টার হয়ে প্রমাণ করে দিলেন যে তিনি আরো পারেন । তাঁর জাতিস্মরে এই মেটামরফোসিস সৃজিত ছাড়া সম্ভব হত কি না জানিনা ।
ছবিতে দুএকটা লুপহোল চোখে পড়লেও সৌমিক হালদারের ক্যামেরার কারসাজি নিমেষে আটকে রেখেছে ছবির টানটান চিত্রনাট্যকে । অনবরত বদলেছে বর্তমান রঙীন থেকে সুদূর অতীতের সাদাকালো  দৃশ্যপট। সাথে সাথে বদলে গেছে কুশীলবেরা । কিন্তু একটুও বুঝতে দেয়নি সেই ট্রানজিশান।  আর সবচেয়ে মনকাড়া হল সেকালে এন্টনিদের কবিগান বা তরজার সাথে এযুগের ব্যান্ডেমোনিয়াম ২০১৪ সমান্তরালভাবে যুগপত ঘটে গেছে দর্শকের চোখের পলক ফেলার অবকাশে । একটুও প্যান্ডেমোনিয়াম নেই । বাংলাব্যান্ডের রকসঙ্গীত থেকে খেউড়-খেমটা,  আধুনিক থেকে এন্টনীর আগমনী, লালন থেকে কীর্তন সব উঠে এসেছে সেই অনবদ্য ট্রানজিশানের মধ্যে দিয়ে । একবার একঝলক রবির ঝলক পেলাম "মাঝে মাঝে তব দেখা পাইয়ের" সেটাও নাড়া দিল মনটাকে  । সুমনের গলায় সেই ওল্ড ওয়ান ইন নিউ বটলের তলানিটুকুও(যতবার তুমি জননী হয়েছ ততবার আমি পিতা....  ) সবশেষে আস্বাদ করতে গিয়ে দুফোঁটা জল ফেলে  চোখ মুছে নিলাম আঁচলে আর  একুশে ফেব্রুয়ারীর জন্য মনে মনে প্রণাম জানালাম টিম জাতিস্মরকে । স্মৃতির সরণী বেয়ে কুশল হাজরা পেরুচ্ছিলেন ঢেউ খেলানো সবুজ বাংলা । স্মৃতির মিছিলে হাঁটতে গিয়ে বারবার ঠোক্কর খাচ্ছিলেন বর্তমান ও অতীতের টানাপোড়েনে । তাই ছবির নাম জাতিস্মর সেক্ষেত্রে ফুলমার্ক্স দাবী করে । 
ছবির ট্যাগ লাইন  A Musical of Memories দেখেই মনে হয়েছিল এতসব ।  রূপে ভোলাননি সৃজিতরা, ভালোবাসাতেও নয়। প্যানপানানি প্রেম দিয়েও নয় সত্যিকারের গান দিয়েই দ্বার খুলেছেন ।  তবে রেডিও জকি মহামায়ার সাথে এন্টনির সৌদামিনী মিলে মিশে এক না হলেও বুঝি মন্দ হতনা । 
আমি বাঙালীর  মন কেঁদে উঠেছে বেজাতের এন্টনীর ঘর পুড়েছে তাই । আমি বাঙালী ঘৃণা করেছি মনে মনে সে যুগের বাঙালীদের যাঁরা সেই অনবদ্য কবিয়ালকে ঈর্ষা করেছিলেন । আমি বাঙালী, বাঙালী হয়েও আমার মাতৃভাষার সম্মান করতে পারিনা যা পারে ভিনরাজ্যের রোহিত মেহতা, "গানে ভুবন ভরিয়ে দেব" অনুষ্ঠানের রেডিও জকি মহামায়া আর সর্বোপরি বিজাতীয় এন্টনী ফিরিঙ্গী ওরফে কুশল হাজরারা । প্রতিটি পুঙ্খ-অনুপুঙ্খ ছুঁয়েছে এহেন আমি বাঙালীর মন । আর এক আকাশের নীচে অনেক আলোর মাঝে  কালিকাপ্রসাদ, খরাজ, শ্রীকান্ত আচার্য, অনুপম, রূপঙ্কর,আর আমাদের ঘরের সব ছেলেগুলো যেমন চন্দ্রবিন্দুর অনিন্দ্য, লক্ষ্মীছাড়ার গাবু, ক্যাকটাসের সিধু, ফসিলসের রূপম ইসলাম  সকলে মিলে বাংলাগানের হালটা যেন আরো শক্ত হাতে ধরে র‌ইলেন ...এ যেন ছবির সাথে বোনাস পাওনা । আর সবার উপরে থেকে গেলেন সেই বংলাগানের কান্ডারী হয়ে কবীর সুমন যিনি একদিন দিশা দেখিয়েছিলেন নবীন প্রজন্মকে।  বানভাসি নক্ষত্র সমাবেশের মাঝে গানভাসি ছবিময়তা । 
তাই সবশেষে বলি বাংলা গানের জয়, বাংলাভাষার জয়জয়াকার নিয়ে এভাবেও ছবি করা যায়!