২৮ মার্চ, ২০১৫

রামায়ণ না কি সীতায়ণ ???


চৈত্রমাস নাকি মধুমাস। কারণ রামায়ণের হিরো রামের জন্মমাস।আজ শুক্লা চৈত্রনবমীতে রামচন্দ্রের জন্মদিন? যে মানুষটা গণতান্ত্রিক স্বার্থে বৌকে ত্যাগ দিয়েছিল ? রাবণের ঘরে সীতার দিনযাপনকে কলঙ্কিত করে সীতাকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে বাধ্য করেছিল তার জন্য ঘটা করে জন্মদিন? মানতে বড় কষ্ট হয়। আদর্শবান পুরুষচরিত্র হয়েও সীতার দুঃখ বুঝতে পারেনি সে হেন পুরুষনায়কের জন্য ছেলের মায়েরা রামনবমীর উপবাস করেন। ভাবতে কষ্ট হয়। মনে মনে বলি, রামের চৈত্রমাস, সীতার সর্বনাশ।
কৈ সীতার আত্মত্যাগের জন্য কেউ তো সীতার জন্মদিন পালন করেনা? রামকে নিয়ে কত ভজন গান হয়। কিন্তু সীতার জন্য ক'জন ভজন গান? এমনকি "পঞ্চকন্যা"... অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তী, তারা ও মন্দোদরীর সাথে এক আসনেও সীতা স্মরেণ্যা ও বরেণ্যা নন। রাম নাকি দ্বাপরে কৃষ্ণের অবতার। তাই তার সাতখুন মাপ? এই রাম রাবণকে যুদ্ধে হারিয়ে বধ করবে বলে ধনুকভাঙা পণ করেছিল। মা দুর্গার স্তব করেছিল। আর শরতকালে দুর্গাপুজো করবে বলে দেবতাদের ঘুম পর্যন্ত ভাঙিয়েছিল অকালবোধন করে। রাম ঘরের সম্মান রাখতে পারলনা অথচ নিজের স্বার্থে দুর্গা নামে আরেক শক্তিশালী নারীর পুজো করতেও পিছপা হলনা!
হায়রে! হিপোক্রেসি ভারতের ধর্মের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নিজের প্রয়োজনে এক নারীর পায়ে একশো আট পদ্ম দিয়ে পুজো হল অথচ রাবণ বধ করে সীতাকে লাভ করে অন্যের কথায় বৌকে ত্যাগ দিল! সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে বাল্মীকির আশ্রমে পাঠাতে যার একটুও বুক কাঁপলনা !

এ হেন রামের অয়ন অর্থাত গমন পথকে কেন্দ্র করেই রচিত হয়েছিল আমাদের মহাকাব্য রামায়ণ। কিন্তু সীতার পাতাল প্রবেশ কিম্বা অগ্নিপরীক্ষা কি তাকে মনে রাখেনা? সীতা মাটির কন্যা আবার মাটিতেই মিশে গেছিলেন। তাই সীতায়ণ (কবি মল্লিকা সেনগুপ্তর দেওয়া এই নাম, আজ তাঁর জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করে মনে মনে বলি) বা সীতার গমন পথও তো হতে পারত এই মহাকাব্যের নাম।
 মাটির কন্যা সীতা লাঙ্গলের ফলা বা "সীত" থেকে উঠে এসেছিলেন। আবার অত্যাচারে, লাঞ্ছনায় অতিষ্ঠ হয়ে বসুন্ধরার কোলেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাই  নিজের জীবনচক্র তো নিজেই সমাপ্ত করলেন। তাই সীতার গমন পথ নিয়ে নতুন রামায়ণ লিখলে হয়না??? রাম কে এত প্যাম্পার করে, আদর্শের মুন্ডপাত করে হোক না সীতায়ণ!!!  

৪ মার্চ, ২০১৫

বাসন্তী ধৌতিকরণ ও দোল

গোর দ্বন্দ। কিসের ইগো?  বাপ্-বেটার ইগো। কেন ইগো? এ হল ধর্মান্ধতার ইগো।   বাপ হলেন স্বৈরাচারী দৈত্য রাজা হিরণ্যকশিপু আর ব্যাটা হল বিষ্ণুর আশীর্বাদ ধন্য প্রহ্লাদ। আর বাপ হলেন গিয়ে anti-বিষ্ণু।  বাপ রাজা তাই can do no wrong। ব্যাটা ঠিক উল্টো। বিষ্ণুর সমর্থক, বিষ্ণু অন্ত প্রাণ।
 কশ্যপমুনির স্ত্রী দিতির দুই পুত্র। দৈত্য হিরণ্যাক্ষ ও হিরণ্যকশিপু। এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সমগ্র দেবকুল তখন সন্ত্রস্ত  । বিষ্ণু বধ করলেন হিরণ্যাক্ষকে।  এবার হিরণ্যকশিপু ভ্রাতৃহন্তা বিষ্ণুর ওপর প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে উঠল। মন্দার পর্বতে কঠোর তপস্যা করে ব্রহ্মার বর পেল সে। দেব, দৈত্য, দানব কেউ তাকে বধ করতে পারবেনা। এইবার খেলার শুরু। 

  শুরু হল একুশে আইন। হিরণ্যকশিপুর আপন দেশে বলবত্‌ হল নয়া আইন। কেউ বিষ্ণুপুজো করতে পারবেনা। এদিকে তার ছেলেই তো পরম বৈষ্ণব। তাহলে? তাহলে আর কি মার ডালো। আবার যে কেউ মারতে পারবেনা তার ছেলে প্রহ্লাদকে। রাজ্যের সব বিষ্ণুভক্তকে তিনি শূলে চড়িয়ে মৃতুদন্ড দিয়েছেন। কিন্তু ছেলের বেলায় কি করবেন? বুদ্ধি খাটালেন বাপ। সুইসাইড বম্বার চাই তাঁর। কে হবে সেই আত্মঘাতী ঘাতক যে কিনা নিমেষে শেষ করবে তার পুত্রকে? বাপের দুষ্টু পাজী এক বোন ছিল। তার নাম হোলিকা। যুগে যুগে যেমন থাকে আর কি! সংসারে ভাঙন ধরায় তারা, দুষ্টু বুদ্ধিতে ছারখার করে ভাইয়ের  সংসার। হোলিকার কাছে ছিল এক মায়া-চাদর।  

 
তৈরি হল বিশেষ ঘর। সেই ঘরে হোলিকা প্রবেশ করল প্রহ্লাদকে নিয়ে।  হোলিকা ভাইপো প্রহ্লাদকে তার কোলে নিয়ে  বসবে। আগুণ জ্বালানো হবে এমন করে যাতে ঐ মায়া চাদর হোলিকাকে রক্ষা করবে আর প্রহ্লাদের গায়ে আগুণ লেগে সে পুড়ে মরে যাবে। কৌশল, ছলনা সবকিছুর মুখে ছাই দিয়ে মাহেন্দ্রক্ষণ এগিয়ে এল।  অগ্নি সংযোগ হল । মায়া চাদর হোলিকার গা থেকে উড়ে গিয়ে নিমেষের মধ্যে প্রহ্লাদকে জাপটে ধরল। হোলিকা পুড়ে ছাই হল আর প্রহ্লাদ তখনো অক্ষত। 

হোলিকা দহনের সময় আখের গায়ে সপ্তধান্য বা ধান, গম, যব, ছোলা এমন সাতরকম শস্যের গাছ বেঁধে অগ্নিতে আহুতি দেওয়া হয়। প্রহ্লাদকে রক্ষা করেছিলেন বলে অগ্নিদেবকে এই শস্যদান।  
পুরাণের এই হোলিকা দহন বা আমাদের আজকের ন্যাড়াপোড়া বা বুড়ির ঘর জ্বালানোর কারণ হল অশুভ শক্তির বিনাশ আর পরেরদিনে দোল উত্সবে আনন্দ সকলের সাথে ভাগ করে নিয়ে শুভ শক্তিকে বরণ করা। অথবা যদি ভাবি বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে? বছরের শেষে  পুরণো স্মৃতি, জীর্ণ, দীর্ণ সবকিছুকে জ্বালিয়ে দিয়ে নতুন বছরকে সানন্দে বরণ করার আগাম তোড়জোড়? কিম্বা বসন্তে ঋতু পরিবর্তনে রোগের বাড়াবাড়িকে নির্মূল করতে এই দহনক্রিয়া??? আর সামাজিক কারণ হিসেবে শীতের শুষ্ক, পাতাঝরা প্রাকৃতিক বাতাবরণকে পুড়িয়ে সাফ করে কিছুটা  বাসন্তী ধৌতিকরণ। যাকে আমরা বলে থাকি  spring cleaning। সে যাইহোক দোল পূর্ণিমার আগের রাতে খেজুরপাতা, সুপুরীপাতা আর শুকনোগাছের ডালপালা জ্বালিয়ে আগুণের চারপাশে ছোটছোট ছেলেমেয়েদের মহা উত্সাহে নৃত্য  করে করে গান গাওয়াটাই যেন আরো সামাজিক।
"আজ আমাদের ন্যাড়াপোড়া, কাল আমাদের দোল, পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে বল হরিবোল"
এবার সেই হরিবোলের সূত্র ধরে মনে পড়ে যায় মথুরা-বৃন্দাবন সহ ভারতের সর্বত্র দোলের পরদিন হোলি উত্সবের কথা। রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা আর রং খেলার আনন্দে সব কালিমা , বৈরিতা মুছিয়ে দেওয়া আর বার্ষিক এই উত্সবের আনন্দ সকলের সাথে ভাগ করে নেওয়া। বাংলার দোলযাত্রা আরো একটি কারণে বিখ্যাত । নবদ্বীপে দোলপূর্ণিমার দিনে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু বা শ্রীচৈতন্যদেব। তাই এই পূর্ণিমার অপর নাম চৈতন্যপূর্ণিমা। বাংলার ৮৯১ সনে, ১৪০৭ শকাব্দে ও ১৪৮৫ খ্রীষ্টাব্দে এই ফাল্গুনী পূর্ণিমায় নবদ্বীপের জগন্নাথ মিশ্রের স্ত্রী শচীদেবীর কোল আলো করে এসেছিলেন তিনি  । একটি প্রাচীন নিমগাছের নীচে জন্ম হল তাই নাম রাখা হল নিমাই। আবার গৌরকান্তির জন্য কেউ নাম দিল গৌরাঙ্গ। জগন্নাথ ডাকলেন বিশ্বম্ভর ও আত্মীয়েরা ডাকলেন গৌরহরি। এ যেন দুর্জনদের হাত থেকে সমাজকে বাঁচানোর তাগিদে কলিযুগের মাটিতে অবতার হয়ে জন্ম নেওয়া শ্রীকৃষ্ণের।  তাই নবদ্বীপে এই দোলযাত্রা আজো মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হয়।