সেবারও অতিবৃষ্টি হয়েছিল । থৈ থৈ শ্রাবণের পথঘাট । উপছে পড়া জলের ভারে নদীনালা বানভাসি । গাছপালা ফুলপাতার মনে হয়েছিল হাঁফ ছেড়ে বাঁচি । আর চাইনে বৃষ্টি ! এবার থামবি তোরা ? মেঘ বিদায় দিবি? টুপটাপ, ঝরা বকুলও সিক্ত, কদম ঝরা সন্ধ্যে নিঝুম শান্ত । মাটি মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ছিল জলের থেকে । মেঘ মিনারে ফাটল ধরেছিল । বৃষ্টি কেঁদে চলেছিল অঝোরে । রোদের মুখ দেখেনি সবুজ ঘাস বহুদিন । এই বার্তা বোধহয় পৌঁছে গেছিল বৃষ্টির দেবতার কাছে । মেঘের কাছে চিরকূট পৌঁছেছিল । তাই বুঝি বৃষ্টি এবার থেমেছে । বুকের কষ্ট চেপে রেখেছে মেঘ অতিকষ্টে । কোথায় থামতে হবে বুঝতে পেরেছে এতদিনে । প্রকৃতির এমনটি যদি প্রাণীকুল বুঝে নিত ! কোন্ এক অদৃশ্য মেল এসে যদি জীবজগতকে বুঝিয়ে দিত ! তাহলে না হত কোনো অপ্রয়োজনীয় টানাপোড়েন বা মনকষাকষি । তাহলে সব সম্পর্কের খুঁটিনাটিগুলো নিয়ে সারাজীবন নিয়ে চলা যেত । আর সম্পর্কের কাঁটাতারের বেড়া না ডিঙিয়েও বেশ সুন্দর বেঁচে থাকা যেত ।
এই সম্পর্কের "কাঁটাতারের বেড়া" শব্দযুগল প্রথম পড়েছিলাম জয় গোস্বামীর "জলঝারি" বইখানিটিতে। কাঁটাতারের বেড়া বড়ো ভয়ানক বস্তু। ক্রস করতে গেলেই বিপদ । ক্রস করলে জয় হলেও হতে পারে কিন্তু জয় না করেও তো এপারেও দিব্যি কাটানো যায়। রামায়ণের লক্ষণরেখা ক্রস করে সীতার কি বিপদ হয়েছিল তা আমাদের সকলেরি জানা। কিন্তু আমরা হলাম জ্ঞানপাপী। প্রতিনিয়ত সামাজিক, রাজনৈতিক এমনকি নিজেদের আপনজনের সাথেও ডিল করার সময় সেই লক্ষণরেখা ক্রস করে যাই। ফলে নেমে আসে বিপর্যয়, মন কষাকষি, সম্পর্কের টানা ও পোড়েন।
এখন না হয় ছেলেবুড়ো অনুপম রায়ের জন্য বলতে শিখেছে "আমাকে আমার মত থাকতে দাও"
আদতে সব মানুষেরি কিন্তু মনের কথা এটি। সে শিশু বা কিশোর, যুবক বা বৃদ্ধ সকলেই মনে মনে চায় এই স্বাধীনতা।
আমার ছেলে যখন খুব ছোট এক ডাক্তারবাবুর কাছে ওকে নিয়ে গেছিলাম পেটখারাপের চিকিত্সা করাতে। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন একটা দামী কথা।
-বাচ্ছাকে মানুষ করতে গিয়ে একটা কথা মাথায় রাখুন, "কেয়ারফুলি কেয়ারলেস" !
আমি বললাম -মানে?
ডাক্তারবাবু বলেছিলেন "মানে সে সারাক্ষণ কি করছে সে ব্যাপারে নাক না গলিয়ে কেয়ারফুলি তাকে আড়াল থেকে অবসার্ভ করুন কেয়ারলেস ভাবে যাতে সে বুঝতে না পারে যে আপনি ওর ওপর খেয়াল রেখেছেন।"
খুব কাজে দিয়েছিল কথাগুলো।
শৈশব পেরোনো , কৈশোরের শিশুটিও কি চায় এমনটি? তার পড়ার টেবিল এলোমেলো, বইয়ের তাক অগোছালো। তার নিজের বৃত্তের মধ্যে একভুবন পৃথিবী আর বাইরের জগতে আপনজন। কিন্তু আপনজন তার ঐ অন্তর্বৃত্তটিতে নাক গলাতে গেলেই বিপদ। হঠাত সদ্য টিন পেরোনো কিশোরের সেলফোনে চোখ রাখতে যান অনেক অভিভাবক। বিস্তর আর এন্ড ডি করেন সে কাকে ফোন করছে, কাকে কি মেসেজ পাঠাচ্ছে, বন্ধুদের সাথে কোথায় যাচ্ছে...এইসব নিয়ে। মানছি সন্তানকে মানুষের মত মানুষ করার দায়িত্ব তাদের কিন্তু কোথায় থামতে হবে আর লক্ষণরেখা পেরিয়ে তার অন্তর্বৃত্তে প্রবেশ করব কিনা সেটা ভেবেচিন্তে করলেই কিন্তু অনেক মুশকিল আসান। সারাক্ষণ কানের কাছে কানাইয়ের বাসা যেন! মায়ের রাতে ঘুম নেই। ছেলেটা আমার কি করছে, কার সাথে মিশছে.....প্লিজ সেটা একটু দূর থেকে খেয়াল রাখুন মা, অত কাছ থেকে নয়। ছেলের সাথে সম্পর্কটা একবার খারাপ হয়ে গেলে পস্তাবেন পরে। বন্ধু হয়ে উঠুন, অভিভাবক নয়।
ছেলে আরো বড়ো হয়ে যখন চাকরী পেল তখন তার রোজগারের টাকায় সে অহোরাত্র অনলাইনে অর্ডার দিয়ে কি কিনছে জানতে চাইবার দরকার নেই আপনার। দেখবেন সে নিজে থেকেই দেখাবে আপনাকে। বারবার তার কাঁধের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে জানবার দরকারো নেই সে ফেসবুকে কার সাথে কি চ্যাট করছে। তার ক'জন গার্লফ্রেন্ড হল, তার উইকএন্ডের কি প্ল্যান, কোন রেস্তোঁরায় সে হ্যাঙাউটে যাচ্ছে সে....কি হবে আপনার নাক গলিয়ে? আপনি নিজের নিয়ে থাকুন। একটা সময়ের পর যার যার নিজের জীবন তারই। বেশী প্রশ্ন করলে আপনার অপমানিত হবার সম্ভাবনাই বেশী। সেই থেকে আপনি ভুগবেন আত্মগ্লানিতে। বরং ডিনার টেবিলে একসাথে খেতে বসার সময় একটু আধটু পুছতাছ হোক হাসিমুখে...ঠিক যেন সাপো মরলো অথচ লাঠিও ভাঙলোনা তেমন করে। বেশী খোঁচানোর প্রয়োজন নেই। বেশী কিউরিওসিটি কিন্তু তাকে আপনার থেকে অনেক দূরে ঠেলে দেবে। সে কি কখনো জানতে চেয়েছে আপনার কাছ থেকে আপনি কতবার কলেজ কেটে এ মার্কা ছবি দেখতে গিয়েছিলেন কিম্বা ইউনিভার্সিটির ক'জন ছেলেকে ফ্লার্ট করেছিলেন? বরং আপনিও চলে যান তার সাথে হ্যাঙাউটে। জমিয়ে মুভি দেখুন, কব্জি ডুবিয়ে খান একসাথে। কিন্তু সেদিন বান্ধবীর সাথে সে বিয়ার খেয়েছিল কিনা বা রোজ রোজ পাবে যাস কেন, এসব কথা নৈব নৈব চ!
তারপর সেই ছেলেটির টেটুম্বুর যৌবনে যখন তার সঙ্গী হয়ে এল অন্য পরিবারের একটি মেয়ে তখনো কিন্তু নিজেকে প্রতিমূহুর্তে গ্রুম করুন।
এমনো অনেকের কথা শুনেছি স্বামী সারাদিন পর অফিস থেকে বাড়ি ফিরলে তার মা পুত্রবধূটিকে অন্য কাজে পাঠিয়ে দিয়ে ছেলের সাথে গল্পগুজব করতেই থাকেন...দুটি প্রাণ খুব কষ্ট পায় তখন। মা ছাড়তে পারেননা তাঁর অধিকারবোধ। এতে কিন্তু তিনি ছেলে-বৌ দুজনের কাছ থেকেই অনেকটা দূরে সরে যান...সেটা বুঝতে পারেন না।
নারীশিক্ষার প্রসার হয়েছে আমাদের দেশে । বালিকা আর বধূ হয় না শিক্ষিত সমাজে । শাশুড়িমাও কিন্তু শিক্ষিতা আজকের যুগে, কিন্তু পারস্পরিক বোঝাপড়ায় উভয়ই হিমশিম খান আজকের যুগেও । তার মূল কারণ কিন্তু এই লক্ষণরেখা ডিঙিয়ে অহেতুক অশান্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা।
ছেলে-বৌ কোথায় গেল, কি খেয়ে বাড়ি ফিরল অথবা শ্বশুরবাড়ির জন্য কি উপহার নিয়ে এল বিদেশ থেকে এসব জেনে আপনার কি লাভ মশাই? একবার ভাবুন তো আপনার শাশুড়ি যদি আপনাদের দাম্পত্য জীবনে এভাবে অহোরাত্র মাথা গলাতেন ভালো লাগত কি আপনার?
এবার আসি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে। নিজেদের পারষ্পরিক বোঝাপড়ায় সম্পর্কের ঘানি টানতে টানতে ফেসবুকে আপনাদের বন্ধু হল অনেক। এবার স্বামীটির গার্লফ্রেন্ড তাকে কি মেসেজ পাঠাচ্ছে বা স্ত্রীয়ের বয়ফ্রেন্ড তার সাথে রাতে কতক্ষণ অনলাইন হচ্ছে, জানতে চাইলেই কিন্তু বিপদ হতে পারে। তার চেয়ে বলি আবারো বন্ধুতার মধ্য দিয়ে জেনে নিন কোনো দুর্ঘটনার আভাস-ইঙ্গিত পাচ্ছেন কিনা। সকলেই সকলের কমন ফ্রেন্ড হয়ে যান, রিস্ক ফ্যাক্টর কমে যাবে। আর কখনোই একে অন্যের মেলবক্সে কোথা থেকে মেইল উড়ে এল কিম্বা চ্যাটবক্সে কার মেসেজ সবচেয়ে বেশী আছে এসব নিয়ে আর এন্ড ডি মোটেও নয় কিন্তু।
একবার এক আত্মীয়ের বাড়িতে গেছি তার ছেলের বিয়ে উপলক্ষে। সেদিন তার বৌভাতের সকালবেলা। নবপরিণীতা বৌটির বাড়ির থেকে ফোন এসেছে। বৌটি তার সেলফোনটি নিয়ে যতই আড়ালে যায়, তার শাশুড়িমাটি ছুতোয়নাতায় ততই তার আশেপাশে ঘুর ঘুর করতে থাকে। আমি আর না পেরে সেই শাশুড়িমাটিকে অন্য ঘরে নিয়ে চলে এলাম এক অছিলায়। এখনতো তবু মোবাইল ফোনের যুগে। আমার বিয়ের পর আমার স্বামীকে তখন প্রায়শই অফিসের কাজে বিদেশ যেতে হত। তখন নব্বইয়ের গোড়ার দিকে মোবাইল ফোন নেই। ল্যান্ডলাইনে বিদেশ থেকে বহুমূল্যের ফোন কলটির অপেক্ষায় থাকতাম আমি। আর ফোন এলেই সব কাজ ফেলে যেই সেই ফোনটি ধরতে যেতাম আমার দুই পিসিশাশুড়ি, জ্যেঠিশাশুড়ি সকলে সব কাজ ফেলে রেখে আমার কাছে মানে ঐ টেলিফোনটির চৌহর্দ্দির মধ্যে ঘুরপাক খেতেন। অবশেষে আমি খুব ডিষ্টার্বড হয়ে ফোন রেখে দিতাম।
বিয়ের সময় আমার বয়স ২৩ আর আমার স্টুডেন্ট স্বামীর ২৭। একান্নাবর্তী বাড়ির এরা আমাকে দেখেশুনেই এনেছিলেন বৌ করে। বাড়িতে আমার শ্বশুরমশাই আর শাশুড়ি ছাড়াও ছিলেন নিঃসন্তান জ্যেঠশ্বশুর ও জ্যেঠিশাশুড়ি আর দুজন অবিবাহিত পিসিশাশুড়ি। আর ছিলেন শ্বশ্রুমাতার দিদি মানে আমার মাসীশাশুড়ি আর তাঁদের মা অর্থাত দিদিশাশুড়ি। এঁরা কিছুটা দূর থেকে রিমোট কন্ট্রোল করতেন । আমরা ছিলাম বাড়ির মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ দম্পতি তাই কেন জানিনা আমাদের ওপর সকলেই ছড়ি ঘুরিয়ে অপার আনন্দ পেতেন সেই সময়ে মানে ১৯৮৯-৯০ সালে। দক্ষিণের খোলা বারান্দায় দুজনে পাশাপাশি দাঁড়ালে সমালোচনা হত। অফিস থেকে তিনি ল্যান্ডলাইনে ফোন করলে প্যারালাল লাইনে কেউ একজন আমাদের ট্যাপ করত। এছাড়া অফিস থেকে তিনি ফিরলে তাঁর সামনে দাঁডানোর জো ছিলনা। আমাকে কেউ সেখানে দেখলেই তুরন্ত রান্নাঘরে খাবার গরম করতে পাঠিয়ে দিতেন। সে অফিস যাবার সময় আমার বাই করার তো কোনো কোশ্চেন নেই! নো ওয়ে! টিফিনের সুস্বাদু খাবার খেয়ে আমার স্বামী ফোন করলেন একবার দুপুরে। কেউ একজন বললেন" যত্তসব! আদিখ্যেতা!" রবিবারের সকালে তাঁরা একজোট হয়ে মহাভারত দেখছেন। আমরা তখন আমাদের ঘরে গল্পে-আড্ডায় মশগুল। ছুতোয় নাতায় ঘরে ঢুকে আমাদের অনাবিল শান্তি হরণ করে নিতেন। এমনকি নবদম্পতির ছুটির দুপুরে দিবানিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য ফোন করে অযাচিত অতিথিকে আপ্যায়ণ করতেও ছাড়তেন না তাঁরা। উদ্দেশ্য একটাই আমাদের অবাধ মেলামেশায় যতিচিহ্ন টেনে দেওয়া। আমি যেন পরপুরুষের সাথে গল্প করছি নিজের বেডরুমে বসে। আজ ভাবি তখন কেন whatsapp ছিলনা রে? শত্রুমুখে ছাই উড়িয়ে দেদার প্রেমালাপ করতে পারতি দুজনে!!!
সবশেষে বলি
জীবনে এমনিতেই অনেক কমপ্লিকেশনস। তাই চারিপাশের আপনজনের সাথে বোঝাপড়াটাও একটু বুদ্ধি করে করুন। তাহলেই সকলের কাছেই আপনার ওয়ার্ম অ্যাকসেপটেন্স।
জয়জয়ন্তী সিনেমার বিখ্যাত গানটি মনে আছে? "আমরা তো আর ছোট নেই, আর ছোট নেই, যেখানেই থাকি সেখানেই ভালো থাকব....."
সত্যি সত্যিই ভালো থাকব তাহলে । আর এত কথা শোনার পরেই যদি ভবি ভোলার না হয় তবে চালাও পানসি বেলঘরিয়া। ক্রস করেই ফেলুন লক্ষণরেখা, বিপদের ঝুঁকি নিয়ে। হয় এস্পার, নাহয় ওস্পার..য়া থাকে কপালে, একটাই তো জীবন, লড়ুন নিজেনিজেই, ডিঙিয়ে ফেলুন কাঁটাতারের অতিকষ্টের বেড়া। পা দিয়েই ফেলুন মনের মানুষটির, কাছের মানুষটির একান্ত আপন ঘেরাটোপের অন্তর্বৃত্তে। তবে মাথায় রাখুন
"চলো লেটস গো" সিনেমায় রূপম ইসলামের সেই গানটি...
কাম ক্রস দ্যা লাইন,
মনের চৌকাঠ
কাম ক্রস দ্যা লাইন
সময়ের বিভ্রাট
কাম ক্রস দ্যা লাইন
আমার হাতটা ধরো
কাম ক্রস দ্যা লাইন
তুমি চাইলেই পারো ।
প্রকাশিত কলকাতা ২৪x৭
এই সম্পর্কের "কাঁটাতারের বেড়া" শব্দযুগল প্রথম পড়েছিলাম জয় গোস্বামীর "জলঝারি" বইখানিটিতে। কাঁটাতারের বেড়া বড়ো ভয়ানক বস্তু। ক্রস করতে গেলেই বিপদ । ক্রস করলে জয় হলেও হতে পারে কিন্তু জয় না করেও তো এপারেও দিব্যি কাটানো যায়। রামায়ণের লক্ষণরেখা ক্রস করে সীতার কি বিপদ হয়েছিল তা আমাদের সকলেরি জানা। কিন্তু আমরা হলাম জ্ঞানপাপী। প্রতিনিয়ত সামাজিক, রাজনৈতিক এমনকি নিজেদের আপনজনের সাথেও ডিল করার সময় সেই লক্ষণরেখা ক্রস করে যাই। ফলে নেমে আসে বিপর্যয়, মন কষাকষি, সম্পর্কের টানা ও পোড়েন।
এখন না হয় ছেলেবুড়ো অনুপম রায়ের জন্য বলতে শিখেছে "আমাকে আমার মত থাকতে দাও"
আদতে সব মানুষেরি কিন্তু মনের কথা এটি। সে শিশু বা কিশোর, যুবক বা বৃদ্ধ সকলেই মনে মনে চায় এই স্বাধীনতা।
আমার ছেলে যখন খুব ছোট এক ডাক্তারবাবুর কাছে ওকে নিয়ে গেছিলাম পেটখারাপের চিকিত্সা করাতে। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন একটা দামী কথা।
-বাচ্ছাকে মানুষ করতে গিয়ে একটা কথা মাথায় রাখুন, "কেয়ারফুলি কেয়ারলেস" !
আমি বললাম -মানে?
ডাক্তারবাবু বলেছিলেন "মানে সে সারাক্ষণ কি করছে সে ব্যাপারে নাক না গলিয়ে কেয়ারফুলি তাকে আড়াল থেকে অবসার্ভ করুন কেয়ারলেস ভাবে যাতে সে বুঝতে না পারে যে আপনি ওর ওপর খেয়াল রেখেছেন।"
খুব কাজে দিয়েছিল কথাগুলো।
শৈশব পেরোনো , কৈশোরের শিশুটিও কি চায় এমনটি? তার পড়ার টেবিল এলোমেলো, বইয়ের তাক অগোছালো। তার নিজের বৃত্তের মধ্যে একভুবন পৃথিবী আর বাইরের জগতে আপনজন। কিন্তু আপনজন তার ঐ অন্তর্বৃত্তটিতে নাক গলাতে গেলেই বিপদ। হঠাত সদ্য টিন পেরোনো কিশোরের সেলফোনে চোখ রাখতে যান অনেক অভিভাবক। বিস্তর আর এন্ড ডি করেন সে কাকে ফোন করছে, কাকে কি মেসেজ পাঠাচ্ছে, বন্ধুদের সাথে কোথায় যাচ্ছে...এইসব নিয়ে। মানছি সন্তানকে মানুষের মত মানুষ করার দায়িত্ব তাদের কিন্তু কোথায় থামতে হবে আর লক্ষণরেখা পেরিয়ে তার অন্তর্বৃত্তে প্রবেশ করব কিনা সেটা ভেবেচিন্তে করলেই কিন্তু অনেক মুশকিল আসান। সারাক্ষণ কানের কাছে কানাইয়ের বাসা যেন! মায়ের রাতে ঘুম নেই। ছেলেটা আমার কি করছে, কার সাথে মিশছে.....প্লিজ সেটা একটু দূর থেকে খেয়াল রাখুন মা, অত কাছ থেকে নয়। ছেলের সাথে সম্পর্কটা একবার খারাপ হয়ে গেলে পস্তাবেন পরে। বন্ধু হয়ে উঠুন, অভিভাবক নয়।
ছেলে আরো বড়ো হয়ে যখন চাকরী পেল তখন তার রোজগারের টাকায় সে অহোরাত্র অনলাইনে অর্ডার দিয়ে কি কিনছে জানতে চাইবার দরকার নেই আপনার। দেখবেন সে নিজে থেকেই দেখাবে আপনাকে। বারবার তার কাঁধের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে জানবার দরকারো নেই সে ফেসবুকে কার সাথে কি চ্যাট করছে। তার ক'জন গার্লফ্রেন্ড হল, তার উইকএন্ডের কি প্ল্যান, কোন রেস্তোঁরায় সে হ্যাঙাউটে যাচ্ছে সে....কি হবে আপনার নাক গলিয়ে? আপনি নিজের নিয়ে থাকুন। একটা সময়ের পর যার যার নিজের জীবন তারই। বেশী প্রশ্ন করলে আপনার অপমানিত হবার সম্ভাবনাই বেশী। সেই থেকে আপনি ভুগবেন আত্মগ্লানিতে। বরং ডিনার টেবিলে একসাথে খেতে বসার সময় একটু আধটু পুছতাছ হোক হাসিমুখে...ঠিক যেন সাপো মরলো অথচ লাঠিও ভাঙলোনা তেমন করে। বেশী খোঁচানোর প্রয়োজন নেই। বেশী কিউরিওসিটি কিন্তু তাকে আপনার থেকে অনেক দূরে ঠেলে দেবে। সে কি কখনো জানতে চেয়েছে আপনার কাছ থেকে আপনি কতবার কলেজ কেটে এ মার্কা ছবি দেখতে গিয়েছিলেন কিম্বা ইউনিভার্সিটির ক'জন ছেলেকে ফ্লার্ট করেছিলেন? বরং আপনিও চলে যান তার সাথে হ্যাঙাউটে। জমিয়ে মুভি দেখুন, কব্জি ডুবিয়ে খান একসাথে। কিন্তু সেদিন বান্ধবীর সাথে সে বিয়ার খেয়েছিল কিনা বা রোজ রোজ পাবে যাস কেন, এসব কথা নৈব নৈব চ!
তারপর সেই ছেলেটির টেটুম্বুর যৌবনে যখন তার সঙ্গী হয়ে এল অন্য পরিবারের একটি মেয়ে তখনো কিন্তু নিজেকে প্রতিমূহুর্তে গ্রুম করুন।
এমনো অনেকের কথা শুনেছি স্বামী সারাদিন পর অফিস থেকে বাড়ি ফিরলে তার মা পুত্রবধূটিকে অন্য কাজে পাঠিয়ে দিয়ে ছেলের সাথে গল্পগুজব করতেই থাকেন...দুটি প্রাণ খুব কষ্ট পায় তখন। মা ছাড়তে পারেননা তাঁর অধিকারবোধ। এতে কিন্তু তিনি ছেলে-বৌ দুজনের কাছ থেকেই অনেকটা দূরে সরে যান...সেটা বুঝতে পারেন না।
নারীশিক্ষার প্রসার হয়েছে আমাদের দেশে । বালিকা আর বধূ হয় না শিক্ষিত সমাজে । শাশুড়িমাও কিন্তু শিক্ষিতা আজকের যুগে, কিন্তু পারস্পরিক বোঝাপড়ায় উভয়ই হিমশিম খান আজকের যুগেও । তার মূল কারণ কিন্তু এই লক্ষণরেখা ডিঙিয়ে অহেতুক অশান্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা।
ছেলে-বৌ কোথায় গেল, কি খেয়ে বাড়ি ফিরল অথবা শ্বশুরবাড়ির জন্য কি উপহার নিয়ে এল বিদেশ থেকে এসব জেনে আপনার কি লাভ মশাই? একবার ভাবুন তো আপনার শাশুড়ি যদি আপনাদের দাম্পত্য জীবনে এভাবে অহোরাত্র মাথা গলাতেন ভালো লাগত কি আপনার?
এবার আসি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে। নিজেদের পারষ্পরিক বোঝাপড়ায় সম্পর্কের ঘানি টানতে টানতে ফেসবুকে আপনাদের বন্ধু হল অনেক। এবার স্বামীটির গার্লফ্রেন্ড তাকে কি মেসেজ পাঠাচ্ছে বা স্ত্রীয়ের বয়ফ্রেন্ড তার সাথে রাতে কতক্ষণ অনলাইন হচ্ছে, জানতে চাইলেই কিন্তু বিপদ হতে পারে। তার চেয়ে বলি আবারো বন্ধুতার মধ্য দিয়ে জেনে নিন কোনো দুর্ঘটনার আভাস-ইঙ্গিত পাচ্ছেন কিনা। সকলেই সকলের কমন ফ্রেন্ড হয়ে যান, রিস্ক ফ্যাক্টর কমে যাবে। আর কখনোই একে অন্যের মেলবক্সে কোথা থেকে মেইল উড়ে এল কিম্বা চ্যাটবক্সে কার মেসেজ সবচেয়ে বেশী আছে এসব নিয়ে আর এন্ড ডি মোটেও নয় কিন্তু।
একবার এক আত্মীয়ের বাড়িতে গেছি তার ছেলের বিয়ে উপলক্ষে। সেদিন তার বৌভাতের সকালবেলা। নবপরিণীতা বৌটির বাড়ির থেকে ফোন এসেছে। বৌটি তার সেলফোনটি নিয়ে যতই আড়ালে যায়, তার শাশুড়িমাটি ছুতোয়নাতায় ততই তার আশেপাশে ঘুর ঘুর করতে থাকে। আমি আর না পেরে সেই শাশুড়িমাটিকে অন্য ঘরে নিয়ে চলে এলাম এক অছিলায়। এখনতো তবু মোবাইল ফোনের যুগে। আমার বিয়ের পর আমার স্বামীকে তখন প্রায়শই অফিসের কাজে বিদেশ যেতে হত। তখন নব্বইয়ের গোড়ার দিকে মোবাইল ফোন নেই। ল্যান্ডলাইনে বিদেশ থেকে বহুমূল্যের ফোন কলটির অপেক্ষায় থাকতাম আমি। আর ফোন এলেই সব কাজ ফেলে যেই সেই ফোনটি ধরতে যেতাম আমার দুই পিসিশাশুড়ি, জ্যেঠিশাশুড়ি সকলে সব কাজ ফেলে রেখে আমার কাছে মানে ঐ টেলিফোনটির চৌহর্দ্দির মধ্যে ঘুরপাক খেতেন। অবশেষে আমি খুব ডিষ্টার্বড হয়ে ফোন রেখে দিতাম।
বিয়ের সময় আমার বয়স ২৩ আর আমার স্টুডেন্ট স্বামীর ২৭। একান্নাবর্তী বাড়ির এরা আমাকে দেখেশুনেই এনেছিলেন বৌ করে। বাড়িতে আমার শ্বশুরমশাই আর শাশুড়ি ছাড়াও ছিলেন নিঃসন্তান জ্যেঠশ্বশুর ও জ্যেঠিশাশুড়ি আর দুজন অবিবাহিত পিসিশাশুড়ি। আর ছিলেন শ্বশ্রুমাতার দিদি মানে আমার মাসীশাশুড়ি আর তাঁদের মা অর্থাত দিদিশাশুড়ি। এঁরা কিছুটা দূর থেকে রিমোট কন্ট্রোল করতেন । আমরা ছিলাম বাড়ির মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ দম্পতি তাই কেন জানিনা আমাদের ওপর সকলেই ছড়ি ঘুরিয়ে অপার আনন্দ পেতেন সেই সময়ে মানে ১৯৮৯-৯০ সালে। দক্ষিণের খোলা বারান্দায় দুজনে পাশাপাশি দাঁড়ালে সমালোচনা হত। অফিস থেকে তিনি ল্যান্ডলাইনে ফোন করলে প্যারালাল লাইনে কেউ একজন আমাদের ট্যাপ করত। এছাড়া অফিস থেকে তিনি ফিরলে তাঁর সামনে দাঁডানোর জো ছিলনা। আমাকে কেউ সেখানে দেখলেই তুরন্ত রান্নাঘরে খাবার গরম করতে পাঠিয়ে দিতেন। সে অফিস যাবার সময় আমার বাই করার তো কোনো কোশ্চেন নেই! নো ওয়ে! টিফিনের সুস্বাদু খাবার খেয়ে আমার স্বামী ফোন করলেন একবার দুপুরে। কেউ একজন বললেন" যত্তসব! আদিখ্যেতা!" রবিবারের সকালে তাঁরা একজোট হয়ে মহাভারত দেখছেন। আমরা তখন আমাদের ঘরে গল্পে-আড্ডায় মশগুল। ছুতোয় নাতায় ঘরে ঢুকে আমাদের অনাবিল শান্তি হরণ করে নিতেন। এমনকি নবদম্পতির ছুটির দুপুরে দিবানিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য ফোন করে অযাচিত অতিথিকে আপ্যায়ণ করতেও ছাড়তেন না তাঁরা। উদ্দেশ্য একটাই আমাদের অবাধ মেলামেশায় যতিচিহ্ন টেনে দেওয়া। আমি যেন পরপুরুষের সাথে গল্প করছি নিজের বেডরুমে বসে। আজ ভাবি তখন কেন whatsapp ছিলনা রে? শত্রুমুখে ছাই উড়িয়ে দেদার প্রেমালাপ করতে পারতি দুজনে!!!
সবশেষে বলি
জীবনে এমনিতেই অনেক কমপ্লিকেশনস। তাই চারিপাশের আপনজনের সাথে বোঝাপড়াটাও একটু বুদ্ধি করে করুন। তাহলেই সকলের কাছেই আপনার ওয়ার্ম অ্যাকসেপটেন্স।
জয়জয়ন্তী সিনেমার বিখ্যাত গানটি মনে আছে? "আমরা তো আর ছোট নেই, আর ছোট নেই, যেখানেই থাকি সেখানেই ভালো থাকব....."
সত্যি সত্যিই ভালো থাকব তাহলে । আর এত কথা শোনার পরেই যদি ভবি ভোলার না হয় তবে চালাও পানসি বেলঘরিয়া। ক্রস করেই ফেলুন লক্ষণরেখা, বিপদের ঝুঁকি নিয়ে। হয় এস্পার, নাহয় ওস্পার..য়া থাকে কপালে, একটাই তো জীবন, লড়ুন নিজেনিজেই, ডিঙিয়ে ফেলুন কাঁটাতারের অতিকষ্টের বেড়া। পা দিয়েই ফেলুন মনের মানুষটির, কাছের মানুষটির একান্ত আপন ঘেরাটোপের অন্তর্বৃত্তে। তবে মাথায় রাখুন
"চলো লেটস গো" সিনেমায় রূপম ইসলামের সেই গানটি...
কাম ক্রস দ্যা লাইন,
মনের চৌকাঠ
কাম ক্রস দ্যা লাইন
সময়ের বিভ্রাট
কাম ক্রস দ্যা লাইন
আমার হাতটা ধরো
কাম ক্রস দ্যা লাইন
তুমি চাইলেই পারো ।
প্রকাশিত কলকাতা ২৪x৭