Ei Samay Bardhaman Suppliment 12th JUne 2017 |
বাঙলামায়ের বারোমাসে তেরো পার্বণ । আর সেই তেরো পার্বণে হাজারো বারব্রত । পূর্ববঙ্গে এই রীতির কিছুটা ছাড় কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মায়েরা নাছোড় এই বারব্রত পালনে । ঋতুর হাওয়াবদলের সাথে সাথে বর্ধমানের ঘরে ঘরে এই বাঙালীয়ানাটুকুকে সম্বল করে এখানকার মহিলারা বেশ হুল্লোড়ে থাকেন ঐ দিনগুলোতে । যারা অফিস করেন তাঁরাও শুনি উপোসটুকুনি ছাড়তে নারাজ । ভোরবেলা ব্রতকথার বইখানিতে পেন্নাম ঠুকে কথকতায় চোখ বুলিয়ে তারপর দশটা-পাঁচটায় সামিল হন । সেদিন শিকেয় তোলা মাছের ঝোলভাত-ডাল-চচ্চড়ি। দুপুরে ফলাহার রাতে ময়দার ভাজা সব সুস্বাদু । কারোকে আবার বলতে শুনেছি মায়েদের মুখ বদলানোর সব উপায় করে দেওয়া হয়ে আসছে অনন্তকাল ধরে । কিন্তু সত্যি কি তাই? আসলে প্রতিটি ব্রতকথার আড়ালে যে ছোট উপাখ্যানগুলি আছে সেগুলি প্রচলিত হলেও লোকশিক্ষার মোড়কে হাজির করা হয় আমাদের সামনে । আর বিশেষ দিনগুলি পালনের অর্থ হল সেগুলিকে বারবার নিজেদের সাংসারিক টানাপোড়েনে ঝালিয়ে নেওয়া ।
মনে মনে তাঁরা বলেন "বারব্রত নিষ্ফল হয়না, ধর্মকর্ম যাই কর ঈশ্বরে বিশ্বাস চাই"
জ্যৈষ্ঠমাসের প্রতি মঙ্গলবারে কুমারী ও এয়োস্ত্রীরা সংসারের মঙ্গলকামনায় স্মরণ করেন মা মঙ্গল চণ্ডীকে। বর্ধমানের মায়েরা এইদিন কাঁঠালপাতায় দুব্বোঘাস, ধান, যব ও মুগকলাই রেখে খিলি বানিয়ে মা চন্ডীকে নিবেদন করেন ও পরে কলার মধ্যে সেই ধান-যব পুরে "গদ" গিলে খান। আমলা বাটা আর হলুদ দিয়ে স্নান করানো হয় মা'কে এবং পাঁচটি ফল দান করতে হয়।
মঙ্গলচণ্ডীর এই ব্রতকথায় আছে, জয়দেব ও জয়াবতীর কথা। দেবীমাহাত্ম্য বিস্তারের জন্য স্বয়ং মা দুর্গাই বুড়ী ব্রাহ্মণীর বেশ ধরে মর্ত্যে চলেন।
"মায়া করি ধরে মাতা জরাতীর বেশ, হাতে লাঠি কাঁধে ঝুলি উড়ি পড়ে কেশ'
উজানী নগরে এক সওদাগরের বাড়িতে তিনি হাজির হন। প্রখর রোদে হঠাত গিয়ে ভিক্ষা চাইলেন। বেনেবৌ থালায় করে চাল আর টাকা দিয়ে সিধে দিলেন। কিন্তু ব্রাহ্মণীর সাতটি মেয়ে, একটিও পুত্র নেই। বুড়ি সেই শুনে আর ভিক্ষে নিলেন না। দিনে দুপুরে ভিক্ষা না নিয়ে চলে যাওয়ায় সংসারের অকল্যাণ হবে জেনে বেনেবৌ কান্নায় ফেটে পড়লেন। এদিকে সওদাগর খোঁজ করে সেই বুড়ির কাছে গেলেন । বুড়ি তার হাতে একটি ফুল দিয়ে বললে, সেই ফুলটি যদি তার বৌ ধুয়ে জল খায় তবে সে সুপুত্রের জননী হবে। বুড়ো বয়সে বেনেবৌ আবার গর্ভবতী হল। ফুটফুটে ছেলে হল তার। তার নাম রাখা হল জয়দেব। এবার সেই ব্রাহ্মণী হাজির হল আরেক সওদাগরের গৃহে। তার সাতটি পুত্র, কন্যা নেই। তাই ভিক্ষে নিলেন না তাঁর ঘরে। এবারে কারণ হল কন্যাসন্তানকে প্রাধান্য দেওয়া। ঠিক আগের মতই এই গৃহেও ফুল ধোয়া জলপান করে গৃহিণীর কন্যাসন্তান হল। তার নাম রাখা হল জয়াবতী। পাশাপাশি দুটি গ্রামে জয়দেব আর জয়াবতী বড় হয় ।
তারা খেলে বেড়ায়, আপনমনে ছেলেখেলার ছলে মঙ্গলচন্ডীর পুজো করে। জয়দেবের বিশ্বাস নেই কিন্তু জয়াবাতীর অগাধ বিশ্বাস। এভাবেই একদিন জয়দেবের পায়রা এসে বসে জয়াবতীর কোলে। জয়াবতী দিতে নারাজ । জয়দেব প্রশ্ন করে, সে কি পুজো করছে? জয়াবতী বলে এই চন্ডীপুজো করলে
"হারালে পায়, মলে জিওয় খাঁড়ায় কাটেনা। আগুণে জলে ফেলে দিলে মরণ ঘটে না। সতীন মেরে ঘর পায়, রাজা মেরে রাজ্য পায়'
জয়দেবের তা শুনে ভাল লাগে। জয়াবতীকে সে বিয়ে করতে চায়, মা'কে জানায়। জৈষ্ঠ্যমাসের মঙ্গলবারে তাদের বিয়ে হয় । সেদিন জয়াবতী আঁচল থেকে গদ বের করে গিলে খায়। এবার জয়দেবের জয়াবতীকে পরখ করার পালা। অঢেল ধনরত্ন, গয়নাগাটি নিয়ে জয়াবতী জলপথে শ্বশুরঘরে যাত্রা করে। মাঝপথে জয়দেব জয়াবতীকে বলে ডাকাতের উপদ্রবের কথা। কাপড়ের পুঁটুলিতে সব গয়নাগাটি বেঁধে জয়দেব সেটিকে জলে ফেলে দেয়। জয়াবতী তা দেখে মা চন্ডীকে স্মরণ করে। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে পরদিন বৌভাতে অতিথি আপ্যায়নের জন্য নদীতে জাল ফেলে যে মাছ ধরে আনা হয় সেই মাছ কাটতে গিয়ে লোকজন হিমশিম। বঁটি, দা, কুড়ুল কিছু দিয়েই সেই বোয়ালমাছ টি কাটা যায় না। তখন জয়াবতীর ডাক পড়ে। জয়াবতী মা মঙ্গলচন্ডীকে স্মরণ করে অতি অনায়াসেই বঁটিতে মাছের পেট কেটে ফেলে আর তার গয়নাশুদ্ধ পুঁটুলিটা পায়। তখন জয়দেবও বুঝতে পারে দেবী মাহাত্ম্য। তাই বুঝি মঙ্গলচন্ডীর পুজোয় এখনো মেয়েরা আওড়ায় এই মন্ত্র
আটকাটি, আটমুঠি সোনার মঙ্গলচন্ডী রূপোর পা, কেন মাগো মঙ্গলচন্ডী হল এত বেলা?
হাসতে খেলতে, তেলহলুদ মাখতে, আঘাটায় ঘাট করতে, আইবুড়োর বিয়ে দিতে,
অন্ধের চক্ষু দিতে, বোবার বোল ফোটাতে, ঘরের ঝি বৌ রাখতে ঢাকতে হল এত বেলা।
এভাবেই ব্রত উদযাপনের মাধ্যমে সংসারের রমণীটি সংসারের সার্বিক সুখ শান্তি কামনা করে থাকে ।
আরেকটা কারণ হল গ্রীষ্মের দাবদাহে ফুটিফাটা বাংলার মাঠঘাট। মা চন্ডীর পুজোয় যদি সময় মত বর্ষা নামে তবে বাংলার কৃষিপ্রধান বর্ধমান জেলাটির শস্যভান্ডারটিও ফুলে ফেঁপে উঠবে সেই আশায় বুঝি মা চন্ডীর শরণাপন্ন হওয়া। অন্যদিকে এই সময়টা রোগভোগের প্রকোপও নিদারুণ। তাই সংসারে যাতে সেই প্রাদুর্ভাব না হয় তার খেয়াল ও রাখেন গৃহকর্ত্রী। বাকীটুকুনি মায়ের কৃপা। আসলে ঘরে ঘরে এই শীতলা, ষষ্ঠী, চন্ডীর প্রতিমাসে পুজো তো আর কিছুই নয়। মা দুর্গা বা কালীর শরণ নেওয়া।
মহাযানী বৌদ্ধধর্মের অবলোকিতেশ্বর কোয়াননের মধ্যে একটি দেবীমূর্তির পূজা হয়। জাপানীভাষায় এই দেবীর নাম “চনষ্টী”। এই চনষ্টী শব্দটি সংস্কৃত শব্দ চন্ডীর অনুরূপ। সুকুমার সেনের মতে চন্ডী শব্দটি এসেছে চান্ডী থেকে। চান্ডী একজন অনার্যা দেবী, যিনি ওঁরাও, বীর, হোড়দের দ্বারা পূজিতা।আর তাই বুঝি বিরচিত চন্ডীমঙ্গলে আমরা ওরাঁও উপজাতিদের দ্বারা পূজিতা দেবীদুর্গার এই চান্ডী রূপটিই পাই। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর এই চন্ডীমঙ্গল সর্বজনবিদিত।তাঁর জন্ম বর্ধমানের দামুন্যা গ্রামে। চন্ডীমঙ্গলে আমরা যে উজানি গ্রামের কথা পাই সেখানে একটি চন্ডীমন্দির আজো আছে। এছাড়া অজয়নদীর তীরে কোগ্রামেও রয়েছে বর্ধমানের পল্লীপ্রেমী কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের বিখ্যাত চন্ডীমন্দিরটি।