২৪ জুল, ২০১৭

মঙ্গলচণ্ডী আজও

Ei Samay Bardhaman Suppliment 12th JUne 2017

বাঙলামায়ের বারোমাসে তেরো পার্বণ । আর সেই তেরো পার্বণে হাজারো বারব্রত । পূর্ববঙ্গে এই রীতির কিছুটা ছাড় কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মায়েরা নাছোড় এই বারব্রত পালনে । ঋতুর হাওয়াবদলের সাথে সাথে বর্ধমানের ঘরে ঘরে এই বাঙালীয়ানাটুকুকে সম্বল করে এখানকার মহিলারা বেশ  হুল্লোড়ে থাকেন ঐ দিনগুলোতে ।  যারা অফিস করেন তাঁরাও শুনি উপোসটুকুনি ছাড়তে নারাজ । ভোরবেলা ব্রতকথার ব‌ইখানিতে পেন্নাম ঠুকে কথকতায় চোখ বুলিয়ে তারপর দশটা-পাঁচটায় সামিল হন । সেদিন শিকেয় তোলা মাছের ঝোলভাত-ডাল-চচ্চড়ি। দুপুরে ফলাহার রাতে ময়দার ভাজা সব সুস্বাদু । কারোকে আবার বলতে শুনেছি মায়েদের মুখ বদলানোর সব উপায় করে দেওয়া হয়ে আসছে অনন্তকাল ধরে । কিন্তু সত্যি কি তাই? আসলে প্রতিটি ব্রতকথার আড়ালে যে ছোট উপাখ্যানগুলি আছে সেগুলি প্রচলিত হলেও লোকশিক্ষার মোড়কে হাজির করা হয় আমাদের সামনে । আর বিশেষ দিনগুলি পালনের অর্থ হল সেগুলিকে বারবার নিজেদের সাংসারিক টানাপোড়েনে ঝালিয়ে নেওয়া ।

মনে মনে তাঁরা বলেন "বারব্রত নিষ্ফল হয়না, ধর্মকর্ম যাই কর ঈশ্বরে বিশ্বাস চাই"

 জ্যৈষ্ঠমাসের প্রতি মঙ্গলবারে  কুমারী ও এয়োস্ত্রীরা সংসারের মঙ্গলকামনায় স্মরণ করেন মা মঙ্গল চণ্ডীকে।  বর্ধমানের মায়েরা এইদিন কাঁঠালপাতায় দুব্বোঘাস, ধান, যব ও মুগকলাই রেখে খিলি বানিয়ে মা চন্ডীকে নিবেদন করেন ও পরে কলার মধ্যে সেই ধান-যব পুরে "গদ"  গিলে খান। আমলা বাটা আর হলুদ দিয়ে স্নান করানো হয় মা'কে এবং পাঁচটি ফল দান করতে হয়। 
মঙ্গলচণ্ডীর এই  ব্রতকথায় আছে, জয়দেব ও জয়াবতীর কথা। দেবীমাহাত্ম্য বিস্তারের জন্য স্বয়ং মা দুর্গাই বুড়ী ব্রাহ্মণীর বেশ ধরে মর্ত্যে চলেন। 

"মায়া করি ধরে মাতা জরাতীর বেশ, হাতে লাঠি কাঁধে ঝুলি উড়ি পড়ে কেশ'  

উজানী নগরে এক সওদাগরের বাড়িতে তিনি হাজির হন। প্রখর রোদে হঠাত গিয়ে ভিক্ষা চাইলেন। বেনেবৌ থালায় করে চাল আর টাকা দিয়ে সিধে দিলেন। কিন্তু ব্রাহ্মণীর  সাতটি মেয়ে, একটিও পুত্র নেই। বুড়ি সেই শুনে আর ভিক্ষে নিলেন না।  দিনে দুপুরে ভিক্ষা না নিয়ে চলে যাওয়ায় সংসারের অকল্যাণ হবে জেনে বেনেবৌ কান্নায় ফেটে পড়লেন।  এদিকে সওদাগর খোঁজ করে সেই বুড়ির কাছে গেলেন । বুড়ি তার হাতে একটি ফুল দিয়ে বললে, সেই ফুলটি যদি তার বৌ ধুয়ে জল খায় তবে সে সুপুত্রের জননী হবে। বুড়ো বয়সে বেনেবৌ আবার গর্ভবতী হল। ফুটফুটে ছেলে হল তার। তার নাম রাখা হল জয়দেব।  এবার সেই ব্রাহ্মণী হাজির হল আরেক সওদাগরের গৃহে। তার সাতটি পুত্র, কন্যা নেই। তাই ভিক্ষে নিলেন না তাঁর ঘরে। এবারে কারণ হল কন্যাসন্তানকে প্রাধান্য দেওয়া। ঠিক আগের মত‌ই এই গৃহেও ফুল ধোয়া জলপান করে গৃহিণীর কন্যাসন্তান হল। তার নাম রাখা হল জয়াবতী। পাশাপাশি দুটি গ্রামে জয়দেব আর জয়াবতী বড় হয় । 
তারা খেলে বেড়ায়, আপনমনে ছেলেখেলার ছলে মঙ্গলচন্ডীর পুজো করে। জয়দেবের বিশ্বাস নেই কিন্তু জয়াবাতীর অগাধ বিশ্বাস। এভাবেই একদিন জয়দেবের পায়রা এসে বসে জয়াবতীর কোলে। জয়াবতী দিতে নারাজ । জয়দেব প্রশ্ন করে, সে কি পুজো করছে? জয়াবতী বলে এই চন্ডীপুজো করলে

"হারালে পায়, মলে জিওয় খাঁড়ায় কাটেনা। আগুণে জলে ফেলে দিলে মরণ ঘটে না। সতীন মেরে ঘর পায়, রাজা মেরে রাজ্য পায়'

জয়দেবের তা শুনে ভাল লাগে। জয়াবতীকে সে বিয়ে করতে চায়, মা'কে জানায়। জৈষ্ঠ্যমাসের মঙ্গলবারে তাদের বিয়ে হয় । সেদিন জয়াবতী আঁচল থেকে গদ বের করে গিলে খায়। এবার জয়দেবের জয়াবতীকে পরখ করার পালা। অঢেল ধনরত্ন, গয়নাগাটি নিয়ে জয়াবতী জলপথে শ্বশুরঘরে যাত্রা করে। মাঝপথে জয়দেব জয়াবতীকে বলে ডাকাতের উপদ্রবের কথা। কাপড়ের পুঁটুলিতে সব গয়নাগাটি বেঁধে জয়দেব সেটিকে জলে ফেলে দেয়। জয়াবতী তা দেখে মা চন্ডীকে স্মরণ করে।  শ্বশুরবাড়ি গিয়ে পরদিন বৌভাতে অতিথি আপ্যায়নের জন্য নদীতে জাল ফেলে যে মাছ ধরে আনা হয় সেই মাছ কাটতে গিয়ে লোকজন হিমশিম। বঁটি, দা, কুড়ুল কিছু দিয়েই সেই বোয়ালমাছ টি কাটা যায় না।  তখন জয়াবতীর ডাক পড়ে। জয়াবতী মা মঙ্গলচন্ডীকে স্মরণ করে অতি অনায়াসেই বঁটিতে মাছের পেট কেটে ফেলে আর তার গয়নাশুদ্ধ পুঁটুলিটা পায়। তখন জয়দেবও বুঝতে পারে দেবী মাহাত্ম্য। তাই বুঝি মঙ্গলচন্ডীর পুজোয় এখনো মেয়েরা আওড়ায় এই মন্ত্র

আটকাটি, আটমুঠি সোনার মঙ্গলচন্ডী রূপোর পা, কেন মাগো মঙ্গলচন্ডী হল এত বেলা?
হাসতে খেলতে, তেলহলুদ মাখতে, আঘাটায় ঘাট করতে, আইবুড়োর বিয়ে দিতে,
অন্ধের চক্ষু দিতে, বোবার বোল ফোটাতে, ঘরের ঝি বৌ রাখতে ঢাকতে হল এত বেলা। 

এভাবেই ব্রত উদযাপনের মাধ্যমে সংসারের রমণীটি সংসারের সার্বিক সুখ শান্তি কামনা করে থাকে ।

আরেকটা কারণ হল গ্রীষ্মের দাবদাহে ফুটিফাটা বাংলার মাঠঘাট। মা চন্ডীর পুজোয় যদি সময় মত বর্ষা নামে তবে বাংলার কৃষিপ্রধান বর্ধমান জেলাটির শস্যভান্ডারটিও ফুলে ফেঁপে উঠবে সেই আশায় বুঝি মা চন্ডীর শরণাপন্ন হওয়া।  অন্যদিকে এই সময়টা রোগভোগের প্রকোপও নিদারুণ। তাই সংসারে যাতে সেই প্রাদুর্ভাব না হয় তার খেয়াল ও রাখেন গৃহকর্ত্রী। বাকীটুকুনি মায়ের কৃপা। আসলে ঘরে ঘরে এই শীতলা, ষষ্ঠী, চন্ডীর প্রতিমাসে পুজো তো আর কিছুই নয়। মা দুর্গা  বা কালীর শরণ নেওয়া।  
মহাযানী বৌদ্ধধর্মের অবলোকিতেশ্বর কোয়াননের মধ্যে একটি দেবীমূর্তির পূজা হয়। জাপানীভাষায় এই দেবীর নাম “চনষ্টী”। এই চনষ্টী শব্দটি সংস্কৃত শব্দ চন্ডীর অনুরূপ। সুকুমার সেনের মতে চন্ডী শব্দটি এসেছে চান্ডী থেকে। চান্ডী একজন অনার্যা দেবী, যিনি ওঁরাও, বীর, হোড়দের দ্বারা পূজিতা।আর তাই বুঝি বিরচিত চন্ডীমঙ্গলে আমরা ওরাঁও উপজাতিদের দ্বারা পূজিতা দেবীদুর্গার এই চান্ডী রূপটিই পাই।  কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর এই চন্ডীমঙ্গল সর্বজনবিদিত।তাঁর জন্ম বর্ধমানের দামুন্যা গ্রামে। চন্ডীমঙ্গলে আমরা যে উজানি গ্রামের কথা পাই সেখানে একটি চন্ডীমন্দির আজো আছে। এছাড়া অজয়নদীর তীরে কোগ্রামেও রয়েছে বর্ধমানের পল্লীপ্রেমী কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের বিখ্যাত চন্ডীমন্দিরটি। 

  

শ্রাবণী পূর্ণিমা এবং লুন্ঠন ষষ্ঠী

Ei Samay Bardhaman Suppliment, 24th July 2017


বর্ধমান মিউনিসিপালিটির অনতিদূরেই বর্ধমানেশ্বর শিবমন্দির খুব প্রাচীন নয় । বাংলার ১৩৭৯ সালের শ্রাবণমাসেই এঁকে আবিষ্কার করা হয়। বিশাল পরিধির এই শিবলিঙ্গটি না কি চাঁদসওদাগরের আরাধ্য গৃহদেবতা। এনাকে "মোটা শিব" ও বলা হয়। আরেকটি হল নবাবহাটের তালিতের ১০৮ শিব মন্দির। এটি ন্যাশানাল হাইওয়ের ধারেই। বর্ধমানের মহারাজা তিলকচাঁদের বিধবা স্ত্রী বিষ্ণুকুমারী নাকি স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে এই ১০৮ শিবমন্দির তৈরী করেছিলেন।
১৭৮৮সালে এই মন্দির নির্মাণ কার্য শেষ হয়।

শ্রাবণমাসে মনসাপূজা, অরন্ধন ছাড়াও বর্ধমানেশ্বর আর তালিতের ১০৮ শিব মন্দিরে সারাটা শ্রাবণমাস ধরে চলে বিশেষ শিব পূজা।

শ্রাবণের মেঘজাল ভেদ করে শুক্লা একাদশীর চাঁদ বেরিয়ে আসবে। ধীরে ধীরে তার ষোলকলা পূর্ণ করবে। তারপর সেই পূর্ণ চাঁদের জ্যোৎস্না চুঁইয়ে পড়বে সমস্ত চরাচরে। শ্রাবণের ধারাজলে ধৌত সবুজ প্রকৃতি, বৃষ্টি স্নানে আপ্লুত পাখীকুল সেই শেষ বর্ষার পূর্ণিমার আলো দেখবে । ধানচারা রোপণের আনন্দে কৃষকের মনে পরম তৃপ্তি আর তৃষ্ণার্ত চাতক চাতকীর মন যেন কানায় কানায় পূর্ণ ।
বিশ্বনাথের জন্মমাস নাকি শ্রাবণ। শ্রাবণীপূর্ণিমাতে সেই জন্মমাস উদযাপিত হয় শিবলিঙ্গে জলধারা বর্ষণ করে । আসেপাশের নদী, নালা, সমুদ্র, কুন্ড যা আছে সবই তো বর্ষার জল পেয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠা জলাধার। এবার শিবভক্তদের বাঁক কাঁধে নিয়ে খালি পায়ে সেই জলাধার থেকে মাটির ঘটি কিম্বা কলসী ভর্তি করে আবারো পায়ে হেঁটে শিবমন্দিরে গিয়ে শিবলিঙ্গকে সেই জলে সিক্ত করা....এ তো চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। সোমবার নাকি শিবের বার । তাই শ্রাবণের সপ্তাহান্ত গুলো জমজমাট থাকে শিবভক্তদের কোলাহলে। নতুন গৈরিকবাস, নতুন মাটির কলস, বাঁক আরো আনুষাঙ্গিক কতকিছু! আবালবৃদ্ধবণিতা সামিল হয় কাঁবর কাঁধে এই পথচলায়। কিসের এই পথচলা? কিসের এই আকুতি? মহাদেব নাকি ভক্তের বয়ে আনা এই জলেই তুষ্ট হন। কাঁধে বাঁক নিলেই কঠোর সংযম। বাঁক রাখলেই আবার শুদ্ধ হয়ে তবেই পুনর্যাত্রা। ভাল, মন্দ, সৎ অসৎ সকলেই পাপ স্খালনের আশায় এই ব্রত করে।

"ভোলেবাবা পার লাগাও, ত্রিশূলধারী শক্তি জাগাও, ব্যোম্‌, ব্যোম্‌ তারক ব্যোম্‌, ভোলে ব্যোম্‌, তারক ব্যোম্‌ …' এই সম্মিলিত বাণী ছড়িয়ে যায় তারা। তাদের পথচলায় অনুরণিত হয় এই শব্দগুলো বারেবারে আর সেই সাথে থাকে টুং টাং ঘন্টাধ্বনি।

পুরাণে বলে সমুদ্র মন্থন হয়েছিল এই শ্রাবণেই। মহাদেব সেই মন্থনের ফলে উঠে আসা গরল নিজকন্ঠে ধারণ করে নীলকন্ঠ হয়েছিলেন। তাঁর এই বিষের জ্বালা নিরাময়ের কারণেই শিবলিঙ্গে অনর্গল জল ঢালার রীতি।দল বেঁধে প্রতিটি পাড়া থেকে জনায় জনায় কত মানুষ এই শিবলিঙ্গে জলঢালা আর শ্রাবণী পূর্ণিমার মেলায় সামিল হবার আশায় জমায়েত হন বছরের এই সময়টায়। জলযাত্রীদের জন্য পসরা নিয়ে আশপাশের গ্রাম থেকে দোকানিরাও বসে পড়ে। প্লাস্টিকের ঘট, মাটির কলসি, ফুল বেলপাতা, গেরুয়া পোশাক, বাঁক, গামছা, তোয়ালে, বাঁক সাজানোর উপকরণ হিসেবে ঘণ্টা, কী থাকে না সেখানে? এভাবেই বুঝি বছরের পর বছর টিকে থাকে হিন্দুদের শিবমহিমা, তাদের ধর্মবিশ্বাস। শ্রাবণ যে মহাদেবের বড়ো প্রিয় মাস। ভক্তের ঢল নামাতে তিনিও খুশি হন যে!

বৈষ্ণবদের ঝুলনপূর্ণিমার মহামিলনে অথবা শিবমন্দিরগুলির প্রাঙ্গণে শৈবদের এই শ্রাবণী পূর্ণিমাটিও মহামিলনের বার্তা দেয় ।

এছাড়াও মায়েদের হাতের পাঁচ হল শ্রাবণমাসের শুক্লপক্ষের তিথিতে ধুমধাম করে হয় লোটনষষ্ঠীর পুজো। এর ব্রতকথাটিও চমৎকার।
লোটন মানে নোটন, মানে ঝুঁটিওলা পায়রা। একপাল নাতিপুতি নিয়ে কাদম্বিনীর ভরভরন্ত সুখি গৃহকোণ।পাড়ার প্রৌঢ়া বিমলিমাসিও নিমন্ত্রিত।তিনি আবার একটু আধটু ক্লেপট্যোম্যানিয়াক। সকলের অজান্তে টুকটাক জিনিসপত্র সরানোর অভ্যেস আছে তাঁর। গাঁয়ের অনেক লোকের ভীড়ে বিমলিপিসি প্রসাদ খেয়ে বাড়ি ফেরেন। সাথে হাতসাফাই করেন কাদম্বিনীর সোনার তিনটি খুদে লোটন। এই ষষ্ঠীর পুজোতে মাষষ্ঠীর পায়ের কাছে রাখা থাকে ছটি সোনার লোটন । কৌটোর মধ্যেই থাকে লোটনগুলি। সকলে যখন প্রসাদ বিতরণে ব্যস্ত বিমলিপিসি তখনই কাজটি সেরে নেন। ওনার এই স্বভাবটির কথা জানেন গাঁয়ের সকলে। পুজো শেষে জিনিষপত্র গুছিয়ে রাখতে গিয়ে কাদম্বিনী টের পেলেন তিনটি লোটন কৌটোর মধ্যে থেকে চুরি গেছে। তখুনি কাদম্বিনীর সন্দেহ হয়। বিমলিপিসির তলব করলেন তিনি কিন্তু বিমলিপিসি মানলেন না। অতঃপর কাদম্বিনী মাষষ্ঠীকে ডেকে কেঁদে কেটে একশা। মা ষষ্ঠী ভক্তের আকুল আহ্বানে বিচলিত হলেন ও বিমলিপিসির তিনটি ছেলেকে কঠিন রোগে ফেললেন। স্বপ্নাদেশ পেলেন বিমলিপিসি এবং শীঘ্র ঐ চুরি করা লোটন তিনটিকে ফেরত দিতে বললেন। এবার বিমলিপিসি কাদম্বিনীর বাড়িতে লোটন ফেরত দিতে গেল আর ষষ্ঠীর পুজোর নিয়ম জানতে চাইল। টাইমট্রাভেল করে আবারো ফিরে এল শ্রাবণের শুক্লাষষ্ঠী। বিমলিপিসি লোটনষষ্ঠীর পুজো করে তার ছেলেদের নীরোগ শরীর পেল। লোটন চুরি গেছিল বলে এই ষষ্ঠীর আরেক নাম লুন্ঠন ষষ্ঠী।

সারা বাংলার অগণিত মন্দির চত্বরে ষষ্ঠীতলা থাকবেই। আর সেখানে বট, অশ্বত্থ কিম্বা পাকুড় গাছের নীচে, মাটীর বেদীতে, অথবা নদীর ধারে পড়ে থাকবেই পরিত্যক্ত, বিসর্জিত মা ষষ্ঠী, শীতলা, মনসার মূর্তি। মানুষের অগাধ বিশ্বাস, পুজো করে জলে ফেলতেও মন চায়না। আজকাল আবার জলদূষণের জন্য নদীতে ফেলতেও মানা আছে। আর সেই পরিত্যক্ত মাটীর মূর্তিতেই ষষ্ঠী পুজোর সুতো বেঁধে ফলমূল নিবেদন করে আসে মায়েরা। সংসারের মঙ্গল কামনায়। সন্তানের কল্যাণে। অথবা কেবলমাত্র মনের শান্তিতেই মা ষষ্ঠীর আরাধনাতে মগ্ন থাকেন একটি দিন। উপোস করে পয়সা তুলে রাখেন তাকের ওপর। ব্রতকথার পুঁথিটিতে মাথা ঠেকিয়ে সেদিনের মত ফলাহার করেন। প্রত্যেক ষষ্ঠীই আসলে মা দুর্গার পুজো। মায়ের এক অঙ্গে বহু রূপ। মা কখনো চন্ডী, কখনো ষষ্ঠী, কখনো শীতলা। তবে ষষ্ঠীমাতা শুধুই সন্তানবতীদের দেখেন সেটাই বড়ো একচোখোমি।

শ্রাবণমাসে শুধুই কি শিবের পুজো হবে? তাই মা দুর্গা এগিয়ে আসেন নিজের পুজো নিতে। আর তাই বুঝি এইমাসে লুন্ঠন ষষ্ঠীর এত চল। আর সেখানেই পুরুষ আর প্রকৃতির জয়।

৩ জুল, ২০১৭

সর্বমঙ্গলা বিপদতারিণী মা দুর্গা


Ei Samay Burdwan Suppliment 3rd July 2017


বর্ধমানের মানুষজনের বিশ্বাস দেবী বিপত্তারিণী হলেন মা দুর্গার অনেকগুলি অবতারের মধ্যে একটি। আষাঢ়মাসে শনি-মঙ্গলবারে মহা ধুম করে এখানে মেয়েরা বিপদতারিণীর পুজো করেন। অবিভক্ত বাংলার প্রথম নবরত্ন রীতিতে এ নির্মিত মন্দির হল বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা মন্দির । ১৭০২ খ্রীষ্টাব্দে বর্ধমানের মহারাজ কীর্ত্তিচাঁদ হলেন এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠিতা  । 
এখানে দেবী কষ্টি পাথরে অষ্টাদশভুজা সিংহবাহিনী মহিষমর্দ্দিনী। এই সেই মন্দির যেখানে দুর্গাপুজোর সন্ধিপুজোয় কামান দাগার ক্ষণটিতে সারা জেলা জুড়ে একযোগে অষ্টমী-নবমী সন্ধিক্ষণে সন্ধিপূজা হয়। সপ্তদশ শতাব্দীর অন্যতম বর্ধমানের কবি রূপরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গল কাব্যেও উল্লেখ আছে এই সর্বমঙ্গলা দেবীর । 

স্থানীয় মানুষদের কিংবদন্তী  বলে বর্ধমানের উত্তরে সর্বমঙ্গলা পল্লীতে ছিল বাগদী সম্প্রদায়ের বাস। সেখানেই নাকি ছিল এই কষ্টিপাথরের বিগ্রহটি। তারা না জেনে বুঝে এই পাথরটির ওপরে তাদের খাবার জন্য গেঁড়ি, গুগলি, শামুক, ঝিনুক রেখে ভাঙত প্রতিদিন। আর চুনোলী মানে যারা চুন তৈরী করে তারা এসে খোলাগুলি পরিষ্কার করে নিয়ে যেত। একদিন তারা খোলার সাথে সেই পাথরটিও নিয়ে যায় আর চুনভাটির মধ্যে পাথরটিকেও পুড়তে দেয়। কিন্তু পাথরটি পোড়ে না। পরে তারা দামোদর নদে পাথরটি ফেলে আসে। দামোদর নদের  বিছানায় পাথরটি পড়ে থাকতে দেখে এক ব্রাহ্মণ সেটিকে ধুয়ে মুছে এনে সেটির গায়ে দেবীমূর্তির সকল চিহ্ন দেখতে পান ও তক্ষুনি তাকে গর্ভগৃহে প্রতিষ্ঠা করেন ।  
প্রতিবছর এখানকার মেয়েরা নিজেদের বিশ্বাসে হাজির হয় এই জাগ্রত মন্দিরে। কেউ কেউ নদীতে স্নান করে দন্ডী কাটে বিপদ কেটে যাবার আশায়।  ভাবলে অবাক হতে হয়, এই বাংলায় দেবী দুর্গা তবে শুধুই আশ্বিন মাসে পূজিতা হন না । প্রতিমাসেই তাঁর আরাধনা নিয়ে থাকে বাঙালী, সংসারের মঙ্গলকামার্থে, বিপদের হাত থেকে বাঁচবে বলে।
বিপত্তারিণী পুজোর ব্রতকথাটি ঘাঁটলে দেখতে পাই তেমনি এক গল্প যেখানে ধর্মশীল বৈদর্ভ রাজ্যের রাজার রাণী সুরূপা অগাধ বিশ্বাসে মা বিপদতারিণীর ব্রত করেছিলেন । রাজা অনেক দান-ধ্যান,  যাগ-যজ্ঞ করতেন এবং প্রজাপালক রূপে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন । তাঁর রাণী  সুরূপাও ছিলেন ধর্মপরায়ণা। তিনি জাতপাঁতের বিচার না করে সমাজের আপামর স্ত্রীলোকের সাথে সমানভাবে  মিশতেন । এক নিম্ন শ্রেণীর চামার বৌয়ের সাথে তিনি স‌ই পাতিয়েছিলেন । ফলে রাজবাড়িতে এই চামার বৌটির খুব যাতায়াত ছিল । রাণী সুরূপা ভালোভালো খাদ্যদ্রব্য তাকে দিতেন এবং তার বিনিময়ে সেই চামার বৌ রাণীকে নানাবিধ ফলমূল এনে দিত । এইভাবে বেশ চলছিল উভয়ের বন্ধুতা ।

একদিন সুরূপার সাধ হ'ল গোমাংস কেমন হয় তা চাক্ষুষ দেখতে । চামার বৌ তাকে বারবার নিষেধ করল কিন্তু রাণী তাঁর জেদ ধরে বসে র‌ইলেন। অতঃপর চামার বৌ পরদিন একটি থালায় করে চাপা দিয়ে কিছুটা গোমাংস নিয়ে যেমনি রাজবাড়িতে প্রবেশ করবেন তখুনি দ্বারীর তা নজর পড়ল । রাজাকে গিয়ে তত্ক্ষণাত সে নালিশ করলে । প্রহরীকে বেঁধে রেখে রাজা স্বয়ং রাজ অন্দরমহলে গেলেন সত্যতা  যাচাই করতে। রাণী সেই সময় তাঁর স‌ই কে আদেশ দিচ্ছিলেন, সেই গোমাংস পূর্ণ থালাটি  খাটের নীচে লুকিয়ে রাখার জন্য ।
রাজা এসে রাণীকে জিজ্ঞাসা করলেন "তোমার স‌ই তোমার জন্য কি উপহার এনেছে আমাকে দেখাও"
রাণী তো রাজাকে দেখে ভয়ে চোখে অন্ধকার দেখলেন এবং বিপদগ্রস্ত হয়ে মা বিপদতারিণীকে স্মরণ করলেন । কারণ বাড়ীতে গোমাংস ঢুকেছে  জানলে রাজা  রাণীর গর্দান নেবেন।
মাদুর্গার আসন রাণী সুরূপার আর্তিতে টলে উঠল । তিনি রাণীকে যেন কানেকানে বললেন ঐ চাপা দেওয়া থালাটির মধ্যে তার স‌ইয়ের দেওয়া চৌদ্দটি ফল  রাজাকে দেখিয়ে দিতে এবং স্নান সেরে রাজাকে সেই ফলগুলি ব্রাহ্মণকে দান করতে ।  রাণী সুরূপা তো অবাক! থালার চাপা সরিয়ে রাজাকে দেখালেন সেই চৌদ্দটি ফল । মাদুর্গার কৃপায় গোমাংসের চৌদ্দটি ফলে রূপান্তরিত হওয়ার ঘটনা দেখে রাজা এবং  রাণী সুরূপা নিজে তো বিস্ময়ে হতবাক । মাদুর্গা রাণীকে আরো বললেন যে তিনি স্বয়ং বিপদতারিণী মা । যে তাঁকে স্মরণ করবে তার কোনো বিপদ আপদ হবেনা ।
রাণীকে যাবজ্জীবন এই ব্রত পালন করতে বলে তিনি অন্তর্হিত হলেন। রাণী এভাবে বিপদ থেকে মুক্তি পেলেন।
রাজা স্নান সেরে এসে সেই ফলগুলি ব্রাহ্মণসেবায় দিলেন । মা বিপদতারিণীর অলৌকিক ক্ষমতায় সেদিন সুরূপা প্রাণে বেঁচে গেছিলেন।   
সেই থেকে বর্ধমান তথা সারা বাংলার এয়োতিরা এই বিপদতারিণী পুজোয় সামিল হয়ে নিষ্ঠাভরে দেবী দুর্গার পুজো করেন।  শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া থেকে দশমী অবধি যে যে শনি ও মঙ্গলবার পড়ে সেগুলিতে এই ব্রত পালনের নিয়ম। একটি চুপড়িতে তেরো রকমের ফল (দুটি খণ্ড করা), তেরো গাছা লাল সুতো, তেরো রকমের ফুল, তেরোটি মিষ্টি, পান, সুপারী হল এই পুজোর উপাচার। পুজো শেষে ব্রাহ্মণকে দক্ষিণা দিয়ে তেরোটি গাঁট দেওয়া লাল সুতো বা তাগা  মেয়েদের বাঁহাতে আর ছেলেদের ডান হাতে বেঁধে দেবার  নিয়ম।
আর পুজো শেষে যেনতেনপ্রকারেণ তেরোটি নুন না দেওয়া লুচি খেতেই হবে উপোসী ব্রতীকে। তাই দেখেছি এই পুজোর দিনে ছোট্ট ছোট্ট লুচি বানাতে, পেট ভরে গেলেও যাতে শেষ করা যায় তেরোটি।  আর সারাদিনে পুজো করে ঐ একবারই খেতে পারবে সে। কোনও তরকারী খাওয়া চলবে না ঐদিন।
বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। এভাবেই মা বিপত্তারিণী একাধারে সংকট হারিণী আবার বাংলায় অবশ্য কর্তব্য আষাঢ় মাসের দুর্গা পুজোও বটে।