![]() |
Ei Samay Bardhaman Suppliment, 24th July 2017 |
বর্ধমান
মিউনিসিপালিটির অনতিদূরেই
বর্ধমানেশ্বর শিবমন্দির খুব
প্রাচীন নয় । বাংলার ১৩৭৯
সালের শ্রাবণমাসেই এঁকে
আবিষ্কার করা হয়। বিশাল পরিধির
এই শিবলিঙ্গটি না কি চাঁদসওদাগরের
আরাধ্য গৃহদেবতা। এনাকে "মোটা
শিব" ও
বলা হয়। আরেকটি হল নবাবহাটের
তালিতের ১০৮ শিব মন্দির। এটি
ন্যাশানাল হাইওয়ের ধারেই।
বর্ধমানের মহারাজা তিলকচাঁদের
বিধবা স্ত্রী বিষ্ণুকুমারী
নাকি স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে এই
১০৮ শিবমন্দির তৈরী করেছিলেন।
১৭৮৮সালে
এই মন্দির নির্মাণ কার্য শেষ
হয়।
শ্রাবণমাসে
মনসাপূজা, অরন্ধন
ছাড়াও বর্ধমানেশ্বর আর তালিতের
১০৮ শিব মন্দিরে সারাটা
শ্রাবণমাস ধরে চলে বিশেষ শিব
পূজা।
শ্রাবণের
মেঘজাল ভেদ করে শুক্লা একাদশীর
চাঁদ বেরিয়ে আসবে। ধীরে ধীরে
তার ষোলকলা পূর্ণ করবে। তারপর
সেই পূর্ণ চাঁদের জ্যোৎস্না
চুঁইয়ে পড়বে সমস্ত চরাচরে।
শ্রাবণের ধারাজলে ধৌত সবুজ
প্রকৃতি, বৃষ্টি
স্নানে আপ্লুত পাখীকুল সেই
শেষ বর্ষার পূর্ণিমার আলো
দেখবে । ধানচারা রোপণের আনন্দে
কৃষকের মনে পরম তৃপ্তি আর
তৃষ্ণার্ত চাতক চাতকীর মন
যেন কানায় কানায় পূর্ণ ।
বিশ্বনাথের
জন্মমাস নাকি শ্রাবণ।
শ্রাবণীপূর্ণিমাতে সেই জন্মমাস
উদযাপিত হয় শিবলিঙ্গে জলধারা
বর্ষণ করে । আসেপাশের নদী,
নালা,
সমুদ্র,
কুন্ড যা
আছে সবই তো বর্ষার জল পেয়ে
ফুলে ফেঁপে ওঠা জলাধার। এবার
শিবভক্তদের বাঁক কাঁধে নিয়ে
খালি পায়ে সেই জলাধার থেকে
মাটির ঘটি কিম্বা কলসী ভর্তি
করে আবারো পায়ে হেঁটে শিবমন্দিরে
গিয়ে শিবলিঙ্গকে সেই জলে সিক্ত
করা....এ
তো চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। সোমবার
নাকি শিবের বার । তাই শ্রাবণের
সপ্তাহান্ত গুলো জমজমাট থাকে
শিবভক্তদের কোলাহলে। নতুন
গৈরিকবাস, নতুন
মাটির কলস, বাঁক
আরো আনুষাঙ্গিক কতকিছু!
আবালবৃদ্ধবণিতা
সামিল হয় কাঁবর কাঁধে এই পথচলায়।
কিসের এই পথচলা?
কিসের এই
আকুতি? মহাদেব
নাকি ভক্তের বয়ে আনা এই জলেই
তুষ্ট হন। কাঁধে বাঁক নিলেই
কঠোর সংযম। বাঁক রাখলেই আবার
শুদ্ধ হয়ে তবেই পুনর্যাত্রা।
ভাল, মন্দ,
সৎ অসৎ সকলেই
পাপ স্খালনের আশায় এই ব্রত
করে।
"ভোলেবাবা
পার লাগাও,
ত্রিশূলধারী
শক্তি জাগাও,
ব্যোম্,
ব্যোম্
তারক ব্যোম্,
ভোলে ব্যোম্,
তারক ব্যোম্
…' এই
সম্মিলিত বাণী ছড়িয়ে যায় তারা।
তাদের পথচলায় অনুরণিত হয় এই
শব্দগুলো বারেবারে আর সেই
সাথে থাকে টুং টাং ঘন্টাধ্বনি।
পুরাণে
বলে সমুদ্র মন্থন হয়েছিল এই
শ্রাবণেই। মহাদেব সেই মন্থনের
ফলে উঠে আসা গরল নিজকন্ঠে ধারণ
করে নীলকন্ঠ হয়েছিলেন। তাঁর
এই বিষের জ্বালা নিরাময়ের
কারণেই শিবলিঙ্গে অনর্গল জল
ঢালার রীতি।দল বেঁধে প্রতিটি
পাড়া থেকে জনায় জনায় কত মানুষ
এই শিবলিঙ্গে জলঢালা আর শ্রাবণী
পূর্ণিমার মেলায় সামিল হবার
আশায় জমায়েত হন বছরের এই সময়টায়।
জলযাত্রীদের জন্য পসরা নিয়ে
আশপাশের গ্রাম থেকে দোকানিরাও
বসে পড়ে। প্লাস্টিকের ঘট,
মাটির কলসি,
ফুল বেলপাতা,
গেরুয়া
পোশাক, বাঁক,
গামছা,
তোয়ালে,
বাঁক সাজানোর
উপকরণ হিসেবে ঘণ্টা,
কী থাকে না
সেখানে? এভাবেই
বুঝি বছরের পর বছর টিকে থাকে
হিন্দুদের শিবমহিমা,
তাদের
ধর্মবিশ্বাস। শ্রাবণ যে
মহাদেবের বড়ো প্রিয় মাস।
ভক্তের ঢল নামাতে তিনিও খুশি
হন যে!
বৈষ্ণবদের
ঝুলনপূর্ণিমার মহামিলনে অথবা
শিবমন্দিরগুলির প্রাঙ্গণে
শৈবদের এই শ্রাবণী পূর্ণিমাটিও
মহামিলনের বার্তা দেয় ।
এছাড়াও
মায়েদের হাতের পাঁচ হল শ্রাবণমাসের
শুক্লপক্ষের তিথিতে ধুমধাম
করে হয় লোটনষষ্ঠীর পুজো। এর
ব্রতকথাটিও চমৎকার।
লোটন
মানে নোটন, মানে
ঝুঁটিওলা পায়রা। একপাল নাতিপুতি
নিয়ে কাদম্বিনীর ভরভরন্ত
সুখি গৃহকোণ।পাড়ার প্রৌঢ়া
বিমলিমাসিও নিমন্ত্রিত।তিনি
আবার একটু আধটু ক্লেপট্যোম্যানিয়াক।
সকলের অজান্তে টুকটাক জিনিসপত্র
সরানোর অভ্যেস আছে তাঁর।
গাঁয়ের অনেক লোকের ভীড়ে
বিমলিপিসি প্রসাদ খেয়ে বাড়ি
ফেরেন। সাথে হাতসাফাই করেন
কাদম্বিনীর সোনার তিনটি খুদে
লোটন। এই ষষ্ঠীর পুজোতে মাষষ্ঠীর
পায়ের কাছে রাখা থাকে ছটি
সোনার লোটন । কৌটোর মধ্যেই
থাকে লোটনগুলি। সকলে যখন
প্রসাদ বিতরণে ব্যস্ত বিমলিপিসি
তখনই কাজটি সেরে নেন। ওনার
এই স্বভাবটির কথা জানেন গাঁয়ের
সকলে। পুজো শেষে জিনিষপত্র
গুছিয়ে রাখতে গিয়ে কাদম্বিনী
টের পেলেন তিনটি লোটন কৌটোর
মধ্যে থেকে চুরি গেছে। তখুনি
কাদম্বিনীর সন্দেহ হয়।
বিমলিপিসির তলব করলেন তিনি
কিন্তু বিমলিপিসি মানলেন না।
অতঃপর কাদম্বিনী মাষষ্ঠীকে
ডেকে কেঁদে কেটে একশা। মা
ষষ্ঠী ভক্তের আকুল আহ্বানে
বিচলিত হলেন ও বিমলিপিসির
তিনটি ছেলেকে কঠিন রোগে ফেললেন।
স্বপ্নাদেশ পেলেন বিমলিপিসি
এবং শীঘ্র ঐ চুরি করা লোটন
তিনটিকে ফেরত দিতে বললেন।
এবার বিমলিপিসি কাদম্বিনীর
বাড়িতে লোটন ফেরত দিতে গেল
আর ষষ্ঠীর পুজোর নিয়ম জানতে
চাইল। টাইমট্রাভেল করে আবারো
ফিরে এল শ্রাবণের শুক্লাষষ্ঠী।
বিমলিপিসি লোটনষষ্ঠীর পুজো
করে তার ছেলেদের নীরোগ শরীর
পেল। লোটন চুরি গেছিল বলে এই
ষষ্ঠীর আরেক নাম লুন্ঠন ষষ্ঠী।
সারা
বাংলার অগণিত মন্দির চত্বরে
ষষ্ঠীতলা থাকবেই। আর সেখানে
বট, অশ্বত্থ
কিম্বা পাকুড় গাছের নীচে,
মাটীর বেদীতে,
অথবা নদীর
ধারে পড়ে থাকবেই পরিত্যক্ত,
বিসর্জিত
মা ষষ্ঠী, শীতলা,
মনসার মূর্তি।
মানুষের অগাধ বিশ্বাস,
পুজো করে
জলে ফেলতেও মন চায়না। আজকাল
আবার জলদূষণের জন্য নদীতে
ফেলতেও মানা আছে। আর সেই
পরিত্যক্ত মাটীর মূর্তিতেই
ষষ্ঠী পুজোর সুতো বেঁধে ফলমূল
নিবেদন করে আসে মায়েরা। সংসারের
মঙ্গল কামনায়। সন্তানের
কল্যাণে। অথবা কেবলমাত্র
মনের শান্তিতেই মা ষষ্ঠীর
আরাধনাতে মগ্ন থাকেন একটি
দিন। উপোস করে পয়সা তুলে রাখেন
তাকের ওপর। ব্রতকথার পুঁথিটিতে
মাথা ঠেকিয়ে সেদিনের মত ফলাহার
করেন। প্রত্যেক ষষ্ঠীই আসলে
মা দুর্গার পুজো। মায়ের এক
অঙ্গে বহু রূপ। মা কখনো চন্ডী,
কখনো ষষ্ঠী,
কখনো শীতলা।
তবে ষষ্ঠীমাতা শুধুই সন্তানবতীদের
দেখেন সেটাই বড়ো একচোখোমি।
শ্রাবণমাসে
শুধুই কি শিবের পুজো হবে?
তাই মা দুর্গা
এগিয়ে আসেন নিজের পুজো নিতে।
আর তাই বুঝি এইমাসে লুন্ঠন
ষষ্ঠীর এত চল। আর সেখানেই
পুরুষ আর প্রকৃতির জয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন