২৪ জুন, ২০২৩

আষাঢ়ী চিঠি

 

image courtsey: https://india.postsen.com/

প্রিয়া মেঘবতী, 

তোমার কথা আজ খুব মনে পড়ছে। নতুন বর্ষা, আকাশের মেঘমেদুরতার অনুষঙ্গে। এখন তখন এলোমেলো বৃষ্টির ছিটেফোঁটা গায়ে এসে পড়লেই মনে পড়ছে তোমার সঙ্গে প্রথম বৃষ্টি দেখার কথা। দুজনের স্বাধীনভাবে বৃষ্টিতে বিচরণের মুহূর্তগুলো তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে আজ আমায়। কেন সেদিন কাজে মন দিলাম না? কেন সেদিন বিস্মৃত হলাম শিবপুজোর জন্য আমার প্রভু কুবেরের বাগানের ফুল তুলতে ?  তুমি তো ছিলেই, থাকতেই আমার সঙ্গে। বড় ভুল হয়ে গেল প্রিয়া। সেদিন শুনিনি তোমার বারণ। 

মনে পড়ে প্রিয়া? সেই রুদ্রাক্ষ গাছের নীচে? যেদিন শেষ ছুঁয়েছিলাম তোমায়? তুমি হাতে হাতে রেখে বলেছিলে, "এভাবেই থাকবে তো সারাটা জীবন?" 

হ্যাঁ, প্রিয়া। থাকতে তো চেয়েই ছিলাম, থাকতে তো চাই এখনও। কিন্তু কী যে সব হয়ে গেল আমাদের! জীবনটা তছনছ হয়ে গেল। এসব কথা আর কাকেই বা বলি? এই ক' মাসেই হাক্লান্ত, রিক্ত আমি, শূন্য আমি। তোমায় ছাড়া। 

দেখতে দেখতে আবারও এসেছে বর্ষা। আবার পাহাড়ের আকাশে ঘন মেঘ জমেছে। আমার মনের দুঃখের ভার, বিরহ বেদনা আর বিচ্ছেদ যন্ত্রণা একটুও লাঘব হলনা প্রিয়া। 

তুমি বিহনে আমি শীর্ণ আমার হাতের সেই বালাজোড়া খুলে পড়ে যাচ্ছে। মনে পড়ে? যেদিন তোমায় প্রথম আলিঙ্গন করেছিলাম সেদিন ঐ বালাজোড়া খুলে রেখেছিলাম পাছে তোমার আঘাত লাগে। 

এখানে বাতাসিয়া পাহাড়ে সর্বক্ষণ কেতকী, কদম্ব আর কুড়চি ফুলের সুবাস ভেসে আসে আর কেবলই তোমার কথা মনে করিয়ে দেয়। আমি জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে গেলাম প্রিয়া। এর নামই বুঝি প্রেম? কিন্তু আমাদের প্রেম পূর্ণতা পাবার আগেই সমূলে কেউ কুঠারাঘাত করে দিল। 


দূরত্ব প্রেম কে অন্য মাত্রা দেয়। এই বিরহ যন্ত্রণা আমাদের প্রেম কে আরও ঘনীভূত করবে কিন্তু আমি যে আর এই বিচ্ছেদ কে মেনে নিতে পারছি না প্রিয়া। তার মধ্যেই আবার আমার এই অভিশপ্ত জীবনে আষাঢ় এল ফিরে। আবারও সেই গিরিমল্লিকা ফুটেছে থরে থরে। আমি চোখ সার্থক করছি আর ঘ্রাণ নিচ্ছি তার। মনে হচ্ছে যদি এই কুড়চি ফুলের মালা গেঁথে তোমার কবরীতে পরিয়ে দিতে পারতাম! সেইসঙ্গে আকাশের মেঘের দিকে চেয়ে থাকি একদৃষ্টে আর ভাবি আহা! যদি এই মেঘ ভেসে ভেসে তোমার কাছে যায় আর একটিবার আমার কথা বলে? সেই মেঘের কাছে তুমিও যদি এক টুকরো বার্তা দিয়ে পাঠাতে ! 

বল না প্রিয়া, পারবে আমার এই চিঠির উত্তর দিতে? আচ্ছা, মেঘ কী আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছে? না কী এসব আমার মনের ভুল? 

মেঘ কেও সম্বোধন করে, করজোড়ে রোজ তার কাছে প্রার্থনা করে চলেছি। কুবেরপুরীর বাইরের উদ্যানে যে মহাদেব বাস করেন তিনিও কী শুনতে পান না আমার আর্তি ? তোমরা যাকে ঈশ্বর বল, তিনিই তো সৃষ্টি করেছেন প্রেম, বিরহ সবকিছু। তাকে একবার ডেকে বল প্রিয়া, আমার এ অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে। 


প্রিয়া, তুমি কী আমার মত বিরহবিধূরা নও? যেসব স্ত্রীলোকের স্বামীরা প্রবাসে থাকেন আসন্ন বর্ষায় তাদের সবার স্বামীরাও দীর্ঘদিন পর্যটনে ক্লান্ত হয়ে একসময় দেশে ফিরবেন নির্ধারিত দিনক্ষণে । শুধু আমি ছাড়া। কারণ আমি এখন রামগিরির নির্বাসিত অ-তিথি। তিথি না মেনেই এখানে এসে পড়েছি নিজের ভুলে। 


আমার মনে হয় এই মেঘ যেন পাকেচক্রে আমাদের একপ্রকার শাস্তি দিয়ে জব্দ করছে জানো ? এই মেঘের দল হাওয়ার আনুকূল্যে কোথায় যেন ভেসে ভেসে যাচ্ছে দল বেঁধে । তুমি শুনতে পাচ্ছো না প্রিয়া? বর্ষার আগমনে আকাশে ভেসে চলা সারেসারে চাতকের দলের মধুর সুরে গান অথবা দলে দলে আকাশের বুকে বকের সারি দেখতে পাচ্ছো? মেঘমিনারে ধাক্কা খাবেনা বলে কত সতর্ক ওরা।  ওদের গর্ভাধানের সময় যে আসন্ন। বর্ষার আগমনে কী আনন্দ ওদের চোখেমুখে! 

যক্ষের প্রিয়া বিরহে মরে যাবে, এ আশঙ্কা করিনা আমি। আমার মত মিলনের অদম্য আশায় ঠিক বেঁচে থাকবে সে। এ আমার বিশ্বাস। 

আমি কেমন কল্পনা করছি তোমার সঙ্গসুখ । তুমি যেন এই উত্তুঙ্গ রামগিরি পর্বতের সানুদেশ দিয়ে ধীরে ধীরে আমার কাছে আসছ। আলিঙ্গন করছ পাহাড় কে। পর্বতের কটিদেশে দাঁড়িয়ে আমি তোমায় প্রথম দেখতে পেলাম যেন। আর পাহাড় যেন তোমার স্পর্শে তার সব গাম্ভীর্য ছেড়ে বেরিয়ে এল অনেকদিন পর। তোমায় কাছে পেয়ে যেন উষ্ণ বাষ্প মোচন করে পাহাড় মধুর সম্ভাষণ জানাল। ঠিক যেমন দারুণ গ্রীষ্মে পাহাড়ের গায়ে যেদিন প্রথম বৃষ্টির ফোঁটা ঝরে উষ্ণ হয় তেমনি কিছুটা। আসবে প্রিয়া আমার কাছে? এই রামগিরি পর্বতে? তুমি কিন্তু ইচ্ছে থাকলেই আসতে পারো। আসার পথে শ্রান্ত হলে পাহাড়ে পাহাড়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে পারো। কত ছোটো , বড়, মাঝারি নদী পড়বে সেই যাত্রাপথে। সেখানে জল পান করে শীতল হতে পারো। 

এই দেখ প্রিয়া, আমি কেমন আজব বায়না করে বসছি তোমার কাছে। তার চাইতে বরং মেঘকেই তোমার কাছে পাঠাই আমি? আসলে আমার কল্পনায় তুমিই যেন মেঘ হয়ে বারেবারে ফিরছো আমার কাছে। মেঘের দিকে চোখ পড়লেই যে তোমায় মনে পড়ে যায়। আজ থেকে তাই তোমার নতুন নাম দিলাম আমি। মেঘবতী। 

এসো তবে মেঘবতী। মেঘের ভেলায় ভেসে এসো আমার কাছে। আমার ঘরে। আমার নিবিড় সান্নিধ্যে। 

আসার পথে পাহাড়ের দিকে তুমি যতই এগুবে , ততই লক্ষ্য করবে নবাগত বর্ষায় উর্বরা জমির হলাকর্ষণে মুগ্ধ সরল গ্রাম্যবধূদের চোখেমুখে উপচে পড়া খুশি । তারাও তোমায় সতৃষ্ণ নয়নে দেখবে আর অভিবাদন জানাবে। আম্রকূট পর্বতে তখন সুপক্ব আম্রফলের ভারে সব গাছ অবনত। পর্বতের বিশাল পাদদেশ ঐসময় পক্ব ফলের কারণে পাণ্ডুবর্ণ ধারণ করবে। এরপর বিন্ধ্য পর্বত পেরুতে হবে তোমায়। রেবা নদীর রব শুনতে পাবে তুমি। সেই নদীর মিষ্টি জল পান করতে ভুলোনা। অরণ্যে মৃত্তিকার অতিমধুর সুগন্ধ পেলে জানবে তা নিশ্চয়ই বর্ষার ফুল কদমের। বায়ু তোমায় পরাভূত করতে পারবে না। দূরত্ব তোমায় পরাস্ত করতে পারবে না। 


তবে আর দেরী কেন কর মেঘবতী? আমার কাছে একটিবার হাজির হও মেঘের সাম্পানে চড়ে। 

সজল নয়ন ময়ূরের কেকারব শুনতে শুনতে। 

সুশান্ত সারঙ্গের পাল তোমার দিকে ধাবিত হবে। তবে ওরা বড় নিরীহ। সলজ্জে চেয়ে থাকবে কেবলই। এরা সকলেই তোমার মত সুন্দরীর সন্দর্শনের আনন্দে আত্মহারা হবে। তবে এত আদর যত্ন পেলে আবার যাত্রাপথে যতিচিহ্ন এঁকো না যেন। 


জানো মেঘবতী? বিদিশা রাজনগরী তে পা দিলেই তোমার মনে হবে যেন প্রেম নগরীতে এসেছো। সেখানে সব বেতসলতার মত সুন্দরী বারাঙ্গনারা থাকে। তবে তাদের চকিত, চপল চাহনির দিকে তাকিয়ে বিলম্বিত নাহয় যেন যাত্রা। এই দেখ, বারাঙ্গনাদের কথা বললাম বলে আমায় যেন আবার ভুল বুঝোনা। তবে তোমার সঙ্গে আমার সেই ভুল বোঝাবুঝিগুলোর পুঙ্খ, অনুপুঙ্খ রাগ-অনুরাগ অধ্যায় গুলো আমি জীবনেও ভুলি না। কেমন সুন্দর লাগত তোমার সেই অভিমানী মুখশ্রী! নিজেকে বড় ভাগ্যবান মনে হত তখন। 

তা যা বলছিলাম, বিদিশায় প্রবেশকালে তরঙ্গায়িত বেত্রবতী নদীর জলে বিশ্রাম নিতে ভুলোনা। কী সুস্বাদু সে নদীর জল! নদীও তোমার স্পর্শে রোমাঞ্চিত হবে দেখো। ঠিক যেমন আমি হতাম তোমায় পেয়ে শিহরিত। আমি যে এখনও স্বপ্নে, জাগরণে তোমার সেই স্পর্শ সুখে কাতর হই মেঘবতী! 


এরপর তুমি অবন্তী প্রদেশে প্রবেশ করে রাজধানী বিশালায় হাজির হবে যার অপর নাম উজ্জয়িনী। বড়ই শ্রীবৃদ্ধিশালিনী নগরী। সেখানে পা দিলেই মনে হয় যেন স্বর্গে এসেছি। সেখানে ঊষাকালে শিপ্রা নদীর তীরে সারসদের সম্মিলিত সুতীক্ষ্ণ কূজন আর সরোবরে প্রস্ফুটিত থিক থিকে পদ্মের সৌরভ সুবাসিত করবে তোমার যাত্রাপথ। এক আদি অকৃত্রিম মন্দিরময়তা আচ্ছন্ন করে রাখবে তোমায়। তুমি ধন্য হবে চন্ডীশ্বর, মহাকাল মন্দির দর্শনে। 

সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় অবধি থেকো মন্দিরে। মহাকালেশ্বর মন্দির চত্বরে সন্ধ্যায় মহাদেব উদ্দাম নৃত্য পরিবেশন করে থাকেন। বর্ষার মেঘের গুরুগম্ভীর গর্জনে সেই নৃত্যশৈলী কে আরও আরও সমৃদ্ধ করে তুলতে পারো তুমি তোমার নূপুরের ঝঙ্কারে । অন্ধকার রাতে উজ্জয়িনীর পথে তুমি দেখতে পাবে অভিসারিকাদের। যাদের নীল নিচোল দেহবাস মিশে যায় অন্ধকারের মধ্যে। প্রণয়ীর সান্নিধ্য উপভোগ করবে বলে তারা সব ফেলে ছুটে চলে। 

বিশ্বাস কর প্রিয়া, আমার জন্য কেউ দাঁড়ায় নি কোনোদিন। তুমি আসার পরে আমার জীবন ছন্দে ফিরেছিল। তুমিই সেই নীলাম্বরী অভিসারিকা যার জন্য আমি এত কষ্টে আছি আজ। মেঘবতী, তুমিই আমার সেই বিদ্যুৎলতা প্রেয়সী। আকাশের গায়ে মেঘের মধ্যে দিয়ে যে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলে যায় বিদ্যুতের তরঙ্গের মত । আমি তো ন্য নারীতে আসক্ত হই নি। তোমায় পাবার পরে অন্য পুরুষেরা আমার প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিল। তাই বুঝি নজর লেগে গেল আমাদের দাম্পত্যে।  


এই দেখ, আবার আমি কেমন আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছি। 

অন্ধকার রাতে যে বাসগৃহের ছাদে পারাবতেরা সুখে সুপ্ত আছে সেখানে গিয়ে একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হতে পারো। 

আবার ভোরবেলায় একটা নতুন দিনের সূচনালগ্নে তুমি পথ চলতে থাকবে। গম্ভীরা নদীর জলে তোমার স্নিগ্ধ ছায়া পড়বে। তা দেখে নদীও সচকিত হবে। 

তখন তুমি চলেছ দেবগিরি অভিমুখে। নববর্ষার বারিধারা বর্ষণে প্রকৃতি যেন তন্ময় তখন। উচ্ছ্বসিত বসুধা যেন সুগন্ধি ফুলের সুবাস ছড়িয়ে শীতল বাতাস ব্যজন করবে তোমায়। 

জানো মেঘবতী? এই দেবগিরি পর্বতে কার্তিকেয়র বাস। তুমি আর্দ্র পুষ্পধারায় সম্পৃক্ত করবে দেব সেনাপতি কে। এরপর পর্বতে প্রতিধ্বনিত হবে মেঘমালার সম্মিলিত গুরুগম্ভীর গর্জন। কার্তিকেয়র বাহন ময়ূর সেই শব্দে কেকারব তুলে দাপুটে নৃত্যকলায় তোমায় ভুলিয়ে রাখবে। 

এইভাবেই পথ চলতে চলতে একসময় তুমি হাজির হবে ব্রহ্মাবর্ত জনপদ ক্ষত্রিয়দের স্বনামধন্য সেই কুরুক্ষেত্রে। যেখানে মহামান্য রাজন্যবর্গ একদা শত শত শাণিত শর বর্ষণ করেছিলেন। মেঘবতী তুমি ধন্য হবে সেই স্থান পরিদর্শন করে। পুণ্যসলিলা সরস্বতীর জল পান করবে। অন্তরে বাইরে শুদ্ধ হবে। এই করতে করতেই কনখল এসে পড়বে। দেখবে সেখানে হিমালয় পর্বত থেকে স্বয়ং অবতীর্ণ গঙ্গা। মেঘবতী, তুমি জানো? এই গঙ্গা আবার ছিলেন মা গৌরীর সপত্নী? শিবের প্রতি তাই গৌরী রুষ্ট ছিলেন। তবে গৌরীর এই সপত্নীর কারণে ঈর্ষা তো অস্বাভাবিক কিছুই নয়। মেয়েদের মন তো এমনই হয়। আচ্ছা শোনো প্রিয়া, আমি যদি এমন করি? মানে তোমার জন্য ঘরে সপত্নী আনি? তুমি আমায় ক্ষমা করবে তো?

যাক। বাদ দাও সে কথা। আগে তো তোমার সঙ্গে দেখা হোক তারপর অন্য কারোর জন্য ভাববো নাহয়। 

তবে গঙ্গার উৎপত্তিস্থলে এসে তার রূপ লাবণ্য দেখে তুমি বিস্ময়ে হতবাক হবে, এ আমার স্থির বিশ্বাস। তখন নিজেই নিজেকে শুধিও। কেন শিবের মতিভ্রম হয়েছিল। গৌরীর মত সুরূপা, সর্বগুণান্বিতা সহধর্মিণী থাকতেও কেন তিনি গঙ্গার প্রতি দুর্বল হয়েছিলেন । 

কী আশ্চর্য! দেখ মেঘবতী! গৌরী, গঙ্গা উভয়েই হিমালয় তনয়া। আর সেই পিতা হিমালয়ের কোলেই চির, দেবদারু বৃক্ষের আশ্রয়েই তুমি তখন বিশ্রামরত। 

সেখানে জলদগম্ভীর মেঘের গগনভেদী তর্জনে, গর্জনে পশুপতি শিবের পুজো হবে সমারোহে। দেখবে কিন্নরীগণ তখন পর্বত কন্দর থেকে বাইরে এসে উদাত্ত কণ্ঠে ত্রিপুরবিজয় গাইতে শুরু করেছে। ত্রিপুর হল তিন অসুর ভ্রাতার নগর। শিব যা ধ্বংস করেছিলেন। 


এবার তুমি এসে দাঁড়ালে হিমালয়ের তটদেশে। কার্তিকেয়র সঙ্গে দ্বন্দে যেখানে পরশুরাম শরনিক্ষেপ করেছিলেন। বড়ই মনোরম এই স্থানের নাম ক্রৌঞ্চপর্বত। হিমশৈলের চূড়া হংসের সারি দেখতে পাবে সেখানে। আর তখনি বুঝবে তুমি কৈলাসে এসে গেছো। এই সেই কৈলাস। স্বয়ং মহাদেবের বাসস্থান। এখানেই আমার প্রভু কুবেরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসেছিলেন রাক্ষসরাজ রাবণ। রাবণের দুরভিসন্ধি ছিল কৈলাস পর্বত সমেত শিব কে লঙ্কায় তুলে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু অসমর্থ হন। হ্যাঁ, এখানেই শিব গৌরীর ভয় নিবারণের জন্য নিজের সর্প বলয় খুলে ফেলে গৌরীর হাত ধরেন। 

মেঘবতী, তুমি আদি অকৃত্রিম মানস সরোবরের দুগ্ধশুভ্র জল গ্রহণ করতে ভুলোনা। মহার্ঘ্য স্বর্ণকমল ফুটে থাকে সেখানে। দুষ্প্রাপ্য ব্রহ্মাণী হাঁসেদের আহার, নিদ্রা, মৈথুন যাপন সেই জলে। 


যাও মেঘবতী যাও। আর দেরী না করে ভূভারত পরিক্রমণান্তে আমার কাছে আবার প্রত্যাবর্তন কর। মেঘের কাছে আকুতি জানাই, আমার প্রিয়া কে বায়ুর সাহায্যে আকর্ষণ করে যেন অচিরেই আমার কাছে এনে দেয় । 

মেঘাবরণ মুক্ত হয়ে অনেকদিন পর আবারও নির্মল চন্দ্রকিরণে সিক্ত হবে ধরিত্রী। সিক্ত, স্নাত হব আমরা দু'জন। চাঁদের আলোয় বানভাসি সেই নিশীথে আমরা আবারও আগের মত মিলিত হবে মেঘবতী। চন্দ্ররশ্মির রজতশুভ্র তন্তুজাল ভেদ করে আবারও তোমার ওষ্ঠে ওষ্ঠ রাখব কবে মেঘবতী? আবারও আমাদের মিলনে কিন্নরগণ উচ্ছ্বসিত হয়ে আমার প্রভু কুবেরের জন্য মধুর কণ্ঠে যশোগান করবে তখন। আমার জন্য ব্যস্ততায় নৈশ অভিসারের পথে তোমার করবী থেকে খসে পড়বে মন্দার পুষ্পগুচ্ছ। শেষ বর্ষার বিন্দু বিন্দু জলকণা তোমার স্তনের ওপর যেন বহুমূল্য রত্নহার হয়ে এলিয়ে পড়ে শোভা পাবে। সূর্যোদয়ের প্রথম আলোকরশ্মির ছটায় সেই হার তোমায় আরও সুন্দর, আরও মোহময় করে তুলবে। 


মনে পড়ে প্রিয়া মেঘবতী? সেই আমার প্রভু ধনপতি কুবেরের প্রাসাদের উত্তরে ইন্দ্রধনু তুল্য চারু তোরণ বিশিষ্ট তোমার আমার স্বপ্নের সেই আগার? আমাদের ভালোবাসা, মন্দবাসার সংসার। 

যার পাশেই ছিল সেই থোকা থোকা পুষ্পগুচ্ছে আবৃত মন্দার বৃক্ষটি? সেখানে একরত্তি সেই পান্না পাথরের মত টলটলে সবুজ পুষ্করিণী? যার ঘাটের সিঁড়ি মরকত শিলায় সযত্নে বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন আমার প্রভু। তুমি আমি সেই ঘাটে বসে আবারও কত গল্পগাছা করব। আচ্ছা হাঁসগুলো এখনও তেমনি বিচরণ করে সেই পুষ্করিণীর জলে? সেখানে এখনও সেই রক্তবর্ণ অশোকগাছটা আছে? আর জোরে বাতাস বইলে মাধবীলতার পত্রপুষ্প এখনও তেমনি চঞ্চল, চপল হয়ে ওঠে? আর সেই ঝাঁটি ফুলের গাছটা? জানো প্রিয়া? প্রবাদ আছে, সুন্দরী রমণী সেই গাছে পা দিয়ে আঘাত করলে সে গাছ নাকি মঞ্জরিত হয়। 


আমার বিহনে আমাদের সেই আগার, বাগান, পুস্করিণী ক্ষীণপ্রভ হয়নি তো প্রিয়া? সে যাই হোক। আমার প্রিয়া আমার অদর্শনে তন্বী, শিখরা, শ্যামা... ঠিক যেমন আগে ছিল তেমনি আছে। এ আমার বিশ্বাস। আমার বিরহে মোটেও তুমি শ্রীহীনা অন্যরূপা হয়ে যাও নি। আচ্ছা প্রিয়া, তুমি কী আগের মতোই স্বল্পভাষী আছো? আমার জন্য এতদিন তোমার উৎকণ্ঠা ছিল? তা আমি বুঝব কেমন করে? না কী প্রবল রোদন হেতু তোমার স্ফীতনেত্র অথবা নিঃশ্বাসের উষ্ণতা হেতু আজ তোমার ওষ্ঠদ্বয় বিবর্ণ ? 

এই চিঠি শেষ করার আগে আরও কয়েকটা কথা জিগেস করি তোমায়। আমাদের এই বিচ্ছেদকালের শুরুর মুহূর্ত থেকে শেষ অবধি বিস্তৃত দিনগুলোয় তুমি তোমার দেহলীতে প্রতিদিন একটি করে পুষ্প ভূতলে রাখতে? আমাদের বিচ্ছেদকালের হিসাব রাখতে ? আমি কিন্তু গিয়ে মাত্রই প্রতিদিন চৌকাঠে তোমার রাখা সেই শুষ্ক পুষ্প গুণতে বসব। 

আর তারপরই চন্দ্রকিরণ সংপৃক্ত গবাক্ষপথে তোমায় আলিঙ্গন করব সেই রাতে। তোমায় নতুন করে পাবো ভেবেই শিহরিত আমি। তুমিও আশাকরি রোমকূপে এমনই শিহরণের আভস ইঙ্গিত পাচ্ছো? 

আর যেন কেউ আমাদের পৃথক না করতে পারে প্রিয়া। আর কোনোদিন আমি প্রভু কুবেরের কর্তব্যে অবহেলা করব না। কথা দিলাম। ভালো থেকো মেঘবতী প্রিয়া আমার। 


ইতি 

অফুরান ভালোবাসায় 

মিলনোন্মুখ তোমার দয়িত যক্ষ  


(মহাকবি কালিদাসের "মেঘদূত" অবলম্বনে নিজ পত্নী কে লেখা যক্ষের কাল্পনিক  আষাঢ়ী চিঠি ) 


১৫ জুন, ২০২৩

লৌকিক দেবী পেরিয়াচি আম্মান

 







দক্ষিণ ভারতের এক অত্যন্ত জনপ্রিয় লৌকিক দেবী পেরিয়াচি কালী আম্মান। দেবী পার্বতী, মা কালীর আরেক উগ্ররূপী অবতার এই দেবী। যাকে ঘিরে এক লোকগল্প রয়েছে। সিঙ্গাপুরে এসে লিটল ইন্ডিয়ায় ঘুরতে ঘুরতে রাস্তার ধারে এই পেরিয়াচিআম্মান মন্দির দেখে টুক করে ঢুকে পড়ি। মারাত্মক এক গল্প এই দেবী কে ঘিরে। যিনি নিজের মাহাত্ম্যেই বলীয়ান। আদতে ছিলেন এক ধাত্রী। আর কিভাবে এই মিডওয়াইফ থেকে তাঁর দেবীতে উত্তরণ, সেই নিয়েই এই গল্প।

তামিল ডাকাতরাজা বল্লরাজনের রানী কারকুজালি।জ্যোতিষী গণনায় জানা গেল তাঁদের সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে রাজার সমূহ বিপদ। অমঙ্গলের আশঙ্কা রয়েছে তাই গর্ভস্থ সন্তানকে ভূমিস্পর্শ না করিয়েই প্রসব করাতে হবে। ডাক পড়ল পেরিয়াচি আম্মানের। তাই রাজা চাইলেন শিশুটিকে তো বটেই, এমনকি যে নবজাতককে স্পর্শ করেছে, তাকেও হত্যা করা উচিত! পেরিয়াচি উগ্র মূর্তি ধারণ করলেন। ত্রিশূল এবং তরবারির সাহায্যে একে একে বল্লভনের সব সেনাদের হত্যা করে অবশেষে মেরে ফেলেন রাজাকেও। রাণীর পেট চিরে বের করলেন গর্ভস্থ শিশুটি কে। এ যেন ঠিক আজকের যুগের সিজেরিয়ান সেকশন। শিশুর যাতে কোনো ক্ষতি নাহয় তাই ভেবেই হয়ত এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

এ সময়ে কারকুজালি তাঁকে বাধা দিতে এলে পেরিয়াচি তাঁকেও ছাড়লেন না। রাণীর মধ্যে লক্ষ্য করলেন সন্তানস্নেহের অভাব। তাই রাণীকেও হত্যা করলেন।

প্রসূতির গর্ভাবস্থা এবং জন্মের পরে মা ও সন্তানের সুরক্ষার জন্য উপাসনা করা হয় তাঁর। পাথরের উপরে উপবিষ্ট এই দেবী পদতলে দলিত করেন এক মন্দবুদ্ধি রাজাকে। তাঁর কোলের উপরে দেখা যায় রাণীর শব যার পেট চিরে নাড়িভুড়ি বের করে এনে দুই হাতে তা ধরে চেবান পেরিয়াচি। ষড়ভুজা দেবীর হাতে একটি নবজাত শিশু, ত্রিশূল, নাগপাশে বাঁধা ডমরু, পাশ, তরবারি এবং একটি রক্তপূর্ণ পাত্র থাকে।

একদিকে সিজারিয়ান সেকশন, অন্যদিকে আমাদের ষষ্ঠীদেবীর মত gurdian spirit বা শিশু রক্ষয়িত্রী দেবী এই পেরিয়াচি। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন মনে করায় অত্যাচারী রাজা হিরণ্যকশিপু আর তাঁর পুত্র প্রহ্লাদের গল্প। সেখানে বিষ্ণুর নরসিংহ অবতার হিরণ্যকশিপুর বুক চিরেছিলেন। প্রহ্লাদ বেঁচে গেছিল। আমাদের শিশুজন্মের পরে যেমন ষষ্ঠীপুজো হয় তেমনি দক্ষিণ ভারতে হয় পেরিয়াচির পুজো।

ইতিহাস বলছে আজ থেকে ৬০০ বছর আগে (1400 AD) সত্যিই ছিলেন পেরিয়াচি নামের এক বয়স্ক মহিলা। প্রসূতির সুখপ্রসব করানোর কারণে যার খুব নামডাক ছিল। তামিলভাষায় যাকে বলে Maruthuvachi (doctor)। অধুনা চেন্নাইয়ের Thondai Nadu অঞ্চলের Kondithoppu গ্রামের এই ধাত্রী রীতিমত অস্ত্রশস্ত্র চালনায় পারদর্শী ছিলেন।১৪০৬ সালে রাজা বল্লভরাজন আর তাঁর স্ত্রী কারকাজুলি নামেও ছিলেন সেখানকার এক অত্যাচারী রাজা। বাকীটুকু মিথ না মিথ্যে তা যাচাই করার স্পর্ধা বা দুঃসাহস কোনটাই নেই আমার তবে গতকাল রাতে ন'টার পরেও ব্যস্তসমস্ত, আধুনিক সিঙ্গাপুরের পেরিয়াচি কালী আম্মান মন্দিরে ভীড় দেখে মালুম হল, যা রটে তা হয়তবা কিছু বটে।