১২ জানু, ২০১৫

১২ই জানুয়ারি ! নমি গুরু বিবেকানন্দম্‌ !



খন্ডন ভব বন্দন জগ বন্ধন বন্দি তোমায় !!!

সেই একরত্তি বিলে থেকে পূর্ণযুবক নরেন ও সেখান থেকে সচ্চিদানন্দ বিবিদিষানন্দ বা স্বামী বিবেকানন্দ বলে আমরা যাঁকে জানি তিনি হলেন আধুনিক ভারতবর্ষের যুবজাগরণের পথিকৃত । সেই যুগনায়ক  মহাসন্ন্যাসী ভারতবাসীকে বিশ্বের দরবারে হাজির করেছিলেন এক লহমায়..  হিন্দুত্বের দাবী নিয়ে, বেদান্তের প্রচার নিয়ে ।শিকাগো ধর্ম মহাসভায়  সকল ধর্মগ্রন্থের নীচে ভাগবদ-গীতার অধিষ্ঠানকে সকল ধর্মের ধারক রূপে ব্যখা করেছিলেন  । 
সমগ্র বিশ্বকে যিনি দেখেছিলেন এক ব্যয়ামাগার রূপে এবং মানুষকে সেই বিশেষ ব্যয়ামাগারে বলিষ্ঠ মানুষ হয়ে উঠতে বলেছিলেন ।
ছোটবেলা থেকে গরীবের দুঃখে যাঁর প্রাণ কেঁদে উঠত সেই বিলে আলনা থেকে মায়ের কাপড়চোপড় ভিখারীকে দান করেছিলেন সেইদিনই প্রমাণ হয়ে গেছিল তাঁর সারাটিজীবন ধরে "শিবজ্ঞানে জীবসেবা"র   অমোঘ বাণীটি কতটা সত্যি । 
 দুর্বার গতিতে দুরন্ত  ঘূর্ণির পাকে সমাজের রং বদলে যায় । স্বামীজির অগ্নিমন্ত্রের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে । 
নারীজাতিকে সম্মান করার কথা বলেছেন স্বামীজি । বেলুড়মঠে দুর্গাপুজোর মহাষ্টমীতে কুমারীপূজার প্রচলন করেন তিনি । কিন্তু আমরা এই শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও সেই কুমারীদের অবহেলা করি । কন্যাভ্রূণ হত্যা করে চলি । ধর্ষণে, অপমানে লাঞ্ছনার স্বীকার কন্যারা।  
স্বামীজি অশিক্ষা এবং কুশিক্ষাকে সমাজের অগ্রগতির প্রধান বাধা বলেছিলেন ।  কিন্তু আমরা এখনো বুঝি দূর করতে পারলামনা অশিক্ষা ও কুশিক্ষার প্রসার । তাহলে আজকের দিনটিতে সার্ধশতবর্ষের জন্মদিনে কি উপহার দেব তাঁকে ? 
"জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর"   কিন্তু কোথায় মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা? কোথায় বা মানুষের কর্মযোগ । স্বামীজি বিলেত-আমেরিকায় যে প্রকান্ড কর্মকান্ড দেখে এসেছিলেন সেই   কর্মোদ্দীপনার বীজ ছড়িয়েছিলেন সারা ভারতের মাটীতে  এবং রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সেই বীজকে মহীরুহে পরিণত করতে চেয়েছিলেন । তিনি সফল । স্বামীজি কিন্তু নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য মিশন প্রতিষ্ঠা করেননি । প্লেগরোগীদের দুদর্শা, অনাহারী, আর্ত মানুষের  দুঃখ   মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন । সেবায় নিয়োজিত  করেছিলেন নিজেকে । জীবে প্রেম ও জীবের সেবা করার উদ্দেশ্যই কেবল  লক্ষ্য ছিল তাঁর । তাই শুধু সন্ন্যাসী নয় গৃহীদের ওপরেও ভার দিয়েছিলেন সেই সেবার । তাঁর ধর্ম নিষ্ক্রিয় বেদান্ত ছিলনা । ফলিত বেদান্তে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি । হাতেকলমে বেদান্তের প্রচার চেয়েছিলেন তিনি । তাঁর মূল কথা ছিল কি গৃহী অথবা সন্ন্যাসী সকলকেই কাজ করে যেতে হবে দেশের উদ্দেশ্যে, দশের সার্বিক উন্নয়নে ।   তাঁর  মিশন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে স্বাধীন ভারত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অধ্যাত্ম চেতনার নতুন দিশা দেখতে পেয়েছে ভারতবাসী । কিন্তু আজ বড় বেশি করে মনে হয় তাঁর মত দেশ নেতা এবং কর্মযোগী এক মানুষের এই মূহুর্তে খুব প্রয়োজন ছিল আমাদের । তিনি আরো কিছুদিন বেঁচে থাকলে তা আমাদের বাংলার তথা দেশের জন্য মঙ্গলকর হতে পারত । তিনি যা চেয়েছিলেন তার কিছুটা হয়ত সার্থক ভাবে রূপায়িত হয়েছে কিন্তু আমাদের প্রকৃত মানুষ হবার খুব প্রয়োজন ছিল এই মূহুর্তে । কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ এবং রাজযোগের সারকথা পুঁথিতেই সীমাবদ্ধ থেকে গেল । আমরা না হতে পারলাম তাঁর উপযুক্ত উত্তরসুরী না পারলাম উপরের চারটি  যোগের একটিরো আলোকবর্তিকা বহন করতে । শুধু রামকৃষ্ণ-মিশনের দীক্ষা নিয়ে, ১২ইজানুয়ারীর প্রভাতফেরী করে আর বিবেকমেলা প্রাঙ্গণে হাজির হলেই তো প্রকৃত মানুষ হওয়া যাবেনা ।
 পাশ্চাত্যের সারটুকু নিয়ে প্রাচ্যে বিলিয়েছিলেন তিনি । এই দুই সংস্কৃতির মেলবন্ধনে আমরা যেন হারিয়ে গেলাম । আমরা কি পারলাম দেড়শো বছর পর তাঁকে  উপহার দিতে এমনি এক দেশকে যেখানে দারিদ্য নেই, হাহাকার নেই, ধর্মের ভেদাভেদ, হানাহানি নেই ?
তিনি বলে ছিলেন "উত্তিষ্ঠত, জাগ্রত, প্রাপ্যবরাণ নিবোধত"  প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই নিহিত থাকে অফুরান শক্তি  শুধু তাকে জাগ্রত করার অপেক্ষায় । তাই মানুষের কুলকুন্ডলিনী যেদিন সদবুদ্ধি দিয়ে জাগ্রত হবে সেদিন হবে সত্যিকারের  জয় ।   কিন্তু সত্যি কি আমরা উঠে দাঁড়াবো কিম্বা জাগব ? কোথায় যাবো আমরা ? কি আমাদের উদ্দেশ্য ?  রামকৃষ্ণ মিশনের লক্ষ্য তো সঞ্চারিত হতে পারত দেশের প্রতিটি কোণে কোণে, মানুষের চরিত্র গঠনে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে । তাহলে সমগ্র দেশ ঐ মিশনের অনুগামী হত হয়ত । স্বার্থত্যাগী দেশনেতা কি আছেন যিনি সেই সর্বত্যাগী অমিতবীর্য মহাসন্ন্যাসীর মত দুইটি ডানা দিয়ে আগলে থাকবেন সমগ্র দেশবাসীকে, অভয় দেবেন আর ভালোবাসা দিয়ে জয় করবেন মানুষকে। কাজ করবেন নিজের দেশের জন্য, ভাববেন দেশের আপামর জনসাধারণের জন্য । যাতে দেশটা দেখে  পাশ্চাত্যের সূর্যোদয় । যে সূর্যটা আকাশে সাতটি রং ছড়ায় কিন্তু একটি মাত্র একতার সূর্যরশ্মি দিয়ে মানুষকে ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যের বন্ধনে আবদ্ধ করে ।  সমগ্র দেশের "ভালো"র স্বার্থে মানুষ সেই একরজ্জুতে  বাঁধা হয়ে এককাট্টা থাকেন ।  
তাই আবারো স্বামীজির কথায় বলি " Arise, awake and stop not till the goal is reached " 
বারে বারে ফিরে আসুক আমার প্রিয় স্বামীজির জন্মদিন, ১২ই জানুয়ারি।


৯ জানু, ২০১৫

মৃগদাব গড়চুমুকে, পিকনিক ২০১৫

সেদিন ছিল রোদ গলে পড়া শীতভোর। সেদিন ছিল নদীর জলের ঠান্ডা ভোর। পোষের পিঠে চড়ে রোদ এসে নেমেছিল গড়চুমুকে। মৃগদাব গড়চুমুকে। আমাদের চড়ুইভাতির সকাল তখন অমৃতকমলার দেশে পাড়ি দিয়েছে। সাদাসাদা ফুলকো লুচি আর নতুন আলুর সাদা চচ্চড়ির গন্ধে মাত গড়চুমুকের নদীর ধার। আমরা একদল শহুরে গিয়ে হাজির হলাম। শীতের সব অনুষঙ্গ যেমন নলেনগুড়, কমলালেবু, মটরশুঁটি, লেপ-বালাপোষ, পশমিনা-পুলওভার নিমেষে উধাও চড়ুইভাতির আনন্দে। শুধুই  শান্তি জলের ধার। শুধুই শান্তি নীল আকাশ। নীল আকাশ গিয়ে চুমু খেয়ে নিল দামোদরের পাড়কে।  নদের জল উছলে উঠল ছলাত করে। একটু ছুঁয়ে নিল নদের পাড়ের ক্যাসুরিনার নুয়ে পড়া সবুজ পাতা ভরা ডালকে। এখানেও সেই পোষমাস। যা এসেছে আমাদের শহরেও। এখানেও সেই শীত যা আছে আমাদেরো। এখানেও পারদ নামে প্রতিবারের মত। শীত আসে, শীত যায়। চড়ুইভাতি ফুরিয়ে যায়। আমরাও পরিযায়ীর মত ঘরে ফিরে যাই । শীতঘুমিয়ে ফুরিয়ে যায় শীত।

ভাগীরথী ও দামোদর মিশেছে হাওড়া জেলার গড়চুমুকে।   ৫৮ গেট বলে জল ধরে রাখার ও ছাড়ার বিশাল স্লুইসগেট। ডিয়ারপার্ক। জমপেশ উদরপূর্তি,গানের লড়াই,কুইজ,খেলা । সবমিলিয়ে শীতের অমৃত কমলার দুপুর জমজমাট!


৬ জানু, ২০১৫

কার্তিকেয় বৃত্তান্ত

কার্তিকঠাকুর আসলে কে ?
কেউ তাঁকেে বলে স্কন্দ, কেউ বলে মুরুগন আবার কেউ ডাকে সুব্রহ্মণ্য বলে। তিনি আসলে দেব সেনাপতি, যুদ্ধের দেবতা । আমাদের কাছে জনপ্রিয় কার্তিকেয় বা কার্তিক নামে, শিব ও পার্বতীর পুত্র রূপে। দেবলোকে যেখানেই যুদ্ধ হয় সেখানেই কার্তিকের ডাক পড়ে।
পুরাণ অনুসারে হলুদবর্ণের কার্তিকের ছটি মাথা। তাই তাঁর অপর নাম ষড়ানন। যুদ্ধের দেবতা বলে নাকি তাঁর ছটি মাথা। চারিদিক থেকে তাঁর লক্ষ্য অবিচল। পাঁচটি ইন্দ্রিয় অর্থাত চোখ, কান, নাক, জিভ ও ত্বক ছাড়াও একাগ্র মন দিয়ে তিনি যুদ্ধ করেন। । তাঁর হাতে থাকে বর্শা-তীর-ধনুক।
আবার কারো মতে মানব জীবনের ষড়রিপু- কাম(কামনা), ক্রোধ (রাগ), লোভ(লালসা),মদ(অহং), মোহ (আবেগ), মাত্সর্য্য (ঈর্ষা)কে সংবরণ করে দেব সেনাপতি কার্তিক যুদ্ধক্ষেত্রে সদা সজাগ থাকেন। এই ষড়রিপু মানুষের জীবনের অগ্রগতির বাধা তাই জীবনযুদ্ধে জয়লাভ করতে গেলেও কার্তিকের মত সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে।
পুরাণমতে তিনি তরুণ সদৃশ, সুকুমার, শক্তিধর এবং সর্বসৈন্যের পুরোভাগে অবস্থান করে । তাই মাদুর্গার যুদ্ধযাত্রায় এমন শৌর্যবীর্য সম্পন্ন পুত্র সঙ্গী না হয়ে যায় কোথায় !
বলতো কেন কার্তিকের বাহন ময়ূর?

কার্তিকের বাহন আমাদের জাতীয় পাখী আলস্যহীন ময়ূর । ময়ূরের পায়ে একটি সাপ অর্থাত অহংবোধ ও কামনা বাসনা বলি দিয়ে তিনি যুদ্ধ করতে ব্যস্ত। ময়ূর অত্যন্ত সজাগ এবং কর্মচঞ্চল পাখী । সৈনিক কার্তিকের সবগুণগুলি সে বহন করে ।
কোনো কোনো মতে রণ-দেবতা কার্তিক হলেন আকুমার ব্রহ্মচারী। আবার কোনো কোনো পুরাণ মতে কার্তিকের পত্নী হলেন ইন্দ্রের কন্যা দেবসেনা বা লক্ষ্মীরূপিণী ষষ্ঠী।
তাঁর নাম কার্তিক কেন ?
কৃত্তিকা নক্ষত্রে তাঁর জন্ম হয়েছিল এবং ছয় কৃত্তিকার দ্বারা তিনি পুত্ররূপে গৃহীত ও প্রতিপালিত হন বলে তাঁর নাম কার্তিকেয় বা কার্তিক। তাঁর আরো অনেক নাম আছে যেমন গুহ, পাবকি, মহাসেন, ষন্মুখ,কুমার, কুমারেশ, গাঙ্গেয়, বিশাখ, মহাসেন, কুক্কুটধ্বজ, নৈগমেয়।
কেন তাঁকে আমরা পুজো করি জানো?
ব্রহ্মার বরে মহাবলী তারকাসুরের নিধনের জন্যই নাকি অমিতবিক্রম যোদ্ধা কার্তিকের জন্ম হয়েছিল। কেউ বধ করতে পারছিলনা তারকাসুরকে। তার অত্যাচারে দেবকুল অতিষ্ঠ । আর দৈববলে অজেয় শক্তি সম্পন্ন এই দেবশিশু কার্তিকেয় তারকাসুর নিধন করেছিলেন ।
আর এই তারকাসুর নিধন করে দেবকুলে কার্তিক গেলেন দেবসেনাপতি। তাই কার্তিকের পুজো হয় মহাসমারোহে।
দেবতারূপে কার্তিক একসময়ে সারা ভারতীয় উপমহাদেশেই খুব জনপ্রিয় ছিলেন। ভারতীয় পুরাণগুলির মধ্যে স্কন্দ পুরাণে কার্তিকের বিষয়ে সবিস্তারে লেখা আছে। তাছাড়াও মহাভারতে এবং সঙ্গম তামিল সাহিত্যে কার্তিকের নানা বর্ণনা রয়েছে। আমাদের জাতীয় যাদুঘরে ( ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে) বারোটি হাত যুক্ত কার্তিকের একটি অভিনব মূর্তি রক্ষিত আছে।

কিন্তু সময়ের সাথে সাথে উত্তর ভারতে কার্তিকের প্রভাব কমে আসে। আরাধ্য দেবতা রূপে কার্তিক উত্তর ভারতীয়দের থেকে অনেক বেশি জনপ্রিয় দক্ষিণ ভারতে। তামিলদের কাছে তিনি মুরুগন নামে, আর অন্ধ্রপ্রদেশ ও কর্ণাটকে তনি সুব্রহ্মণ্য নামের পুজিত হন। তামিলদের কাছে মুরুগন প্রধান আরাধ্য দেবতাদের মধ্যে একজন। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে যেখানেই তামিলদের সংখ্যা বেশি, যেমন শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মরিশাস- সেখানেই মুরুগন পরিচিত এবং সাড়ম্বরে পুজিত হন।
আধুনিক বাঙালিদের মধ্যে কার্তিক ঠাকুর পুজো নিয়ে খুব বেশি হইহুল্লোড় হয় না। দুর্গাপুজোর পরেপরেই কিছুদিনের মধ্যেই কার্তিকমাসের সংক্রান্তিতে হয় কার্তিকের পুজো। কোন কোন প্রাচীন পরিবারে ধারাবাহিকভাবে, এবং এক-দুটি বিশেষ অঞ্চলে খুব হইচই করে এই পুজো হয়; কিন্তু সর্বজনীন পুজো হিসাবে কার্তিকপুজো বাঙালি সমাজে এখন আর সেরকম জনপ্রিয় নয়।
সেই কমে আসা উৎসাহ থেকেই সম্ভবতঃ মুখে মুখে তৈরি হয়েছে এই ছড়া -

"কার্তিক ঠাকুর হ্যাংলা,
একবার আসেন মায়ের সাথে,
একবার আসেন একলা।"

এটা কিন্তু খুব অন্যায়। একলা কার্তিকই খালি দুবার আসেন নাকি? মা-দুর্গার বাকি ছেলেমেয়েরাও কি আলাদা করে আরেকবার আসেন না?



ইচ্ছামতীতে প্রকাশিত