১৯ মার্চ, ২০১৮

যিনি বাসন্তী তিনিই অন্নপূর্ণা আবার তিনিই মা দুর্গাশোকা

এইসময় ১৯ শে মার্চ ২০১৮

 বাসন্তীপুজো এবং অথ অশোকষষ্ঠী কথা

আমাদের দেশে শীতের শেষে চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষে মাদুর্গার পুজোকে বাসন্তীপুজো বলে। শাস্ত্রে শরত ও বসন্ত এই দুই ঋতুকে বলা হয় "যমদংষ্ট্রা" অর্থাত এই দুই ঋতুতে মানুষ দুরারোগ্য ব্যাধি ভোগ করে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। শরত এবং বসন্ত এই দুই ঋতুর আগমনেই ভারতবর্ষের মত গ্রীষ্মপ্রধান দেশে ঋতু পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। ফলে রোগের প্রকোপ বাড়ে। দুর্গা দুর্গতিনাশিনী তাই আবির্ভূতা হন এই দুই সময়ে।
সূর্যের গতিপথে সূর্য ছয়মাস উত্তরদিকে ও ছয়মাস দক্ষিণদিকে গমন করে। উত্তরায়নের সময় দেবকুলের দিন আর দক্ষিনায়নে তাদের রাত্রি।
 বসন্তকালেই দুর্গাপূজা নির্দ্দিষ্ট ছিল কারণ এই সময় সূর্যের উত্তরায়ণের ফলে দেবতারা জাগ্রত থাকেন। কিন্তু  শরতকাল হল সূর্যের দক্ষিণায়নের সময়। রামচন্দ্র রাবণ বধের জন্য এইসময় দেবতাগণকে জাগ্রত করে দুর্গাপূজা করেছিলেন। তাই রামচন্দ্র প্রবর্তিত শরতকালীন দুর্গাপুজোকে অকালবোধন বলা হয়।  
শস্যাধিষ্ঠাত্রী দেবীর আরেক নাম শাকম্ভরী।  একবার দুর্ভিক্ষের সময় দেবী দুর্গা তাঁর অর্থাত পৃথিবীর সমস্ত উত্পন্ন শাক দিয়ে জগত পালন করেছিলেন। শাককে এখানে সমস্ত প্রকার শস্যের প্রতিনিধি বলা হযেছে।  দেবী শাকম্ভরীর আরেক প্রকাশ হল অন্নপূর্ণা বা অন্নদা। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। 
পন্ডিতেরা আমাদের অন্নপূর্ণা ও দুর্গার সাথে মিশরের আইসিস ও গ্রীসের সিরিসের সাদৃশ্য খুঁজে পান। সিরিয়া, গ্রীস, সাইপ্রাস, এথেন্স ও ক্রীটে আমাদের দেশের মত শস্যদেবীর পূজা দেখা যায়। শরতকালে বাসন্তী বা দুর্গাপূজার মত পাশ্চাত্যে ইস্তারাদেবীর পূজা হয়। এই ইস্তারাদেবীর রূপটি অনেকাংশেই আমাদের দুর্গার মত। তিনিও সিংহারূঢ়া ও অসুর নিধনে মগ্ন। এই ইস্তারাদেবীর উত্সব সেখানে হয় বসন্তকালে ইষ্টারের সময়। মন্ডি থার্সডে , গুডফ্রাইডে, হোলি স্যাটারডে, ইষ্টার সানডে ও ইষ্টার মানডে এই পাঁচদিন ধরে আমাদের দুর্গাপুজোর মত উত্সব চলে। 

বাসন্তীপূজার দিন পশ্চিমবাংলার রীতি অশোক ষষ্ঠী পালনের। কি এবং কেন এই অশোক ষষ্ঠী?  




বহুযুগ আগে অশোকবনের মধ্যে এক ঋষির পর্ণকুটীর ছিল ।

একদিন সেই ঋষি স্নান সেরে ফেরার পথে অশোকগাছের নীচে এক সদ্য প্রসূতা কন্যাকে কাঁদতে দেখলেন । দৈবযোগে ধ্যানের মাধ্যমে ঋষি জানতে পারলেন কন্যাটি এক শাপভ্রষ্টা হরিণী মায়ের । ঋষি মেয়েটিকে আশ্রমে এনে লালন করতে লাগলেন । তার নাম দিলেন অশোকা । ঋষিকন্যা বড় হতে লাগল । যৌবনে উত্তীর্ণ হল  ।

এক রাজপুত্র মৃগয়ায় বেরিয়ে ঐ পরমাসুন্দরী অশোকাকে একদিন দেখতে পেয়ে তার পরিচয় জানতে পারলেন । ঋষিকন্যার সঙ্গে রাজপুত্রের কথোপকথনের মধ্যেই ঋষির আগমন হল সেই স্থানে । রাজপুত্র অশোকার পাণিপ্রার্থী হয়ে ঋষিকে অনুরোধ জানালে ঋষি যারপরনাই আনন্দিত হয়ে তাতে সম্মতি দিলেন ।

অশোকাকে রাজপুত্রের হাতে সঁপে দিয়ে ঋষি বললেন  :

" আজ থেকে তুমি রাজার ঘরণী হ'লে কন্যা । যদি কখনো বিপদে পড় আশ্রমে চলে এস । আর রাজপুরী থেকে চিনে একাএকা এই আশ্রমে যাতে আসতে পারো তাই এই অশোকফুলের বীজ তোমাকে দিলাম । এখন যাবার সময় এই বীজ ছড়াতে ছড়াতে যেও । পরে কখনো প্রয়োজন হলে এই বীজ থেকে উত্পন্ন অশোকগাছ বরাবর   চিনে পায়েহেঁটে তুমি চলে আসতে পারবে "

অশোকফুলের বীজ  সযত্নে আঁচলে বেঁধে নিয়ে অশোকা রাজপুত্রের সাথে পতিগৃহে যাত্রা করল । যাত্রাপথে বীজ ছড়াতে ছড়াতে চলল অশোকা । রাজপুরীতে পৌঁছালে রাজা-রাণী সস্নেহে তাদের বরণ করে ঘরে তুললেন । অশোকা আর রাজপুত্রের বাড়বাড়ন্ত সংসারে সুখের বন্যা । অশোকা ক্রমে সাত ছেলে ও এক মেয়ের মা হল । অশোকার শ্বশুর রাজামশাই মারা গেলেন শ্রাদ্ধের দিন অশোকষষ্ঠীর কথা বিস্মৃত হল অশোকা । ভাত মুখে দিয়েই মনে পড়ল ষষ্ঠীর কথা । রাতে শুয়ে পড়ল মনখারাপ নিয়ে । পরদিন ভোরে উঠে দেখল সাতছেলে-বৌ যার যার ঘরে মরে পড়ে আছে আশোকা তা দেখে ঋষির কথা ভাবলে । রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে আশ্রম বরাবর চলতে লাগল ।

ততদিনে বীজ থেকে অশোকগাছ মহীরুহের আকার ধারণ করেছে । চৈত্রমাসে ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে তার শাখাপ্রশাখা । ঋষির আশ্রমের কাছে এসেই  অশোকা ঋষিকে দেখে কেঁদে উঠলো । ঋষি ধ্যানের বলে সব অবগত ছিলেন । কন্যাকে সাথে করে রাজবাড়ী ফিরে গেলেন । কমন্ডুলু থেকে জল ছিটিয়ে  দিলেন  অশোকার মৃত ছেলে বৌ নাতিপুতির গায়ে  । দৈবগুণে সকলে চোখ মেলে চাইল ।

ঋষি বললেন অশোকষষ্টীর ব্রত পালন করলে  কখনো শোক প্রবেশ করবেনা সংসারে ।