১৯ ডিসে, ২০১২

১৯শে ডিসেম্বর


১৯শে ডিসেম্বর সকাল সকাল ফেসবুকের ইনবক্সে উড়ে আসা একরাশ জন্মদিনের শুভেচ্ছা মনে করিয়ে দেয় আজকের দিনটার কথা । আজ আবার ৪র্থ বাংলা ব্লগ দিবস ও । এতটা বছর পার করতে করতে এই দিনটাতে নানারকমের অভিজ্ঞতা কুড়িয়ে নিলাম আঁচল ভরে ।
একবার ছোটবেলায় বাবা হাতে তুলে দিয়েছিলেন  "ছোটদের বুক অফ নলেজ" ।ব‌ইখানা আমার থেকে বড় ও ভারী ছিল তাই সে ব‌ই যখন হাতে করে পড়তে শিখলাম তখন আরো অনেকগুলো জন্মদিন পেরিয়ে গেছে ।  

 ১৯৮৫ সাল  ; তখন বেথুন কলেজের থার্ড ইয়ার । পার্ট-টু পরীক্ষা দিয়ে ছুটিতে রয়েছি বাড়িতে ।  রেজাল্ট বেরুনোর অপেক্ষায় । গান শিখতে গেছি ঐ দিন বিকেলে । বাড়ি ফিরে দেখি একপাল বন্ধুরা বাড়ীতে অপ্রত্যাশিত ভাবে আমার জন্মদিনের সারপ্রাইজ পার্টি দিতে হাজির । আমার কুড়ি বছর পূর্ণ হওয়ায় একুশটা রসোমালাই ভর্তি হাঁড়ি আর একুশটা হলদে গোলাপ নিয়ে সেদিনের সন্ধ্যেবেলায় আমার বাড়ির ড্র‌ইংরুম জমজমাট হল । বিয়ের ঠিক হল ১৯৮৮ সালে । পৃথ্বীশ তখন ডালাসে পিএইচডি স্টুডেন্ট । জন্মদিনের প্রথম লাভলেটার এল নীলখামে বন্দী হয়ে বিদেশ থেকে । সাথে গ্রিটিংস কার্ড ও একটা ছোট্ট উপহারের বাক্সে ছোট্ট ছোট্ট রকমারি পারফিউমের  সুদৃশ্য বোতল ।   সে এক অনুভূতি । জীবনের প্রথম প্রেমিক বন্ধু, হবু স্বামীর কাছ থেকে উপহার ! আবিষ্কার করেছিলাম নতুন করে নিজেকে । আবিষ্ট হয়েছিলাম অন্য রকম এক ভালোলাগায় । এরপর বিয়ে । তারপর ছেলে ও একে একে সংসারের ঝুট-ঝামেলায় জড়িয়ে পড়া ।  
বিয়ের পর জন্মদিনের কোনো সুখস্মৃতি আমার মনের কোণায় থিতিয়ে পড়ে নেই । আমি কে, আমি কেন আর আমি কি জন্যে জন্মে এই বাড়িটায় এসে হাজির হয়েছিলাম বিয়ের পরে প্রথম কয়েক বছর তা আমাকে কেবলি তাড়া করে বেড়াত । সে সময় চাইলেও আমাকে ওর মত করে পেত না আর আমাকে ওর ইচ্ছেমত ভরিয়েও দিতে পারত না । আমার জন্য কিছু নিয়ে আসা মানেই বাড়িতে তুফানি ঝড় বয়ে যেত আর আমাকে ঘিরে এক অশান্তির বাতাবরণ তৈরী হয়ে যেত নিমেষের মধ্যে । তাই ভুলে যেতে বাধ্য হতাম ঐ বিশেষ দিনটাকে । একবারের ঘটনা খুব মনে পড়ে । আমাকে সারপ্রাইজ দিয়ে  জেমস বন্ডের সিনেমা "টুমরো নেভার ডাইসের" নাইট শোয়ের টিকিট কাটিয়ে রেখেছিল আমাদের ড্রাইভারকে দিয়ে । রাতে বাড়ি এসে ডিনার খেয়ে আমাকে তৈরী হয়ে নিতে বলল " প্রিয়ায় টিকিট কাটা আছে, এই বলে "  চলেও গেলাম অপ্রত্যাশিত একরাশ আনন্দ সঙ্গে করে । রাতে বাড়ি ফিরে দরজা খুলে দিতে হল বলে মুখ ভার দেখলাম তাঁর আর পরদিন চায়ের টেবিলে আমার জন্য অপেক্ষা করে র‌ইল সেই কাল মাঝরাতে না বলা বকুনির কথা । " বৌ কে নিয়ে আদিখ্যেতা !!! যত্তসব ! " ভুলে গেলাম জন্মদিনের স্মৃতি ।  এভাবেই পেরিয়ে গেছে বাইশটা বছর এই বাড়িটায় । কিন্তু আমার জন্যে মায়ের মত পায়েস রেঁধে বা ছোট্ট কোনো উপহার নিয়ে কখনো সারপ্রাইস দেয়নি জন্মদিন; যে মানুষটা ভালোবেসে কিছু দিতে চেয়েছে আমাকে তার জন্য তাকে শুনতে হয়েছে অনেক কিছু, স‌ইতে হয়েছে শতেক । কারণ আমি যে অন্য বাড়ির মেয়ে তাদের বাড়ির উত্তরসুরীর জন্মদাত্রী! আজ তারিখটা এলেই মনে পড়ে সেই সব দুঃখের স্মৃতিগুলো । শিউরে উঠি আর বলি,  জন্মদিন, তুমি অন্যের হও, কিন্তু এসো না তুমি আমার হয়ে ।
 ২০১০ এ ভাইয়ের বাড়িতে  পুণায় ছিলাম এইদিনটিতে ।   আগের দিন  দুপুরের খাওয়াদাওয়া, যত্নাআত্তির কোনো ত্রুটি ছিলনা । বিকেল হল । সন্ধ্যে হল । আমরা হৈ হৈ করে বেরুলাম.. মন্দিরে গেলাম । ক্রসওয়ার্ড এ গেলাম । সেখান থেকে পিতজা হাট । খুব খাওয়া হল ।  ফেরার পথে গ্রিন আপেলের ভদকা হল সঙ্গের সাথী । ফিরে এসে রাত বারোটা ছুঁইছুঁই । আমার জন্মদিনের ঘন্টা বাজবে এই বুঝি । টলোমলো পায়ে সে এল গিফট হাতে  ।  ভাইয়ের ছেলে গুগ্‌লের কাছ থেকে "হ্যাপি বার্থ ডে পিসিমণি ( খুতুন)" শুনে আমার ভরে গেছিল মন ।   এত আনন্দ বুঝি কোনো জন্মদিনে হয় নি আমার !
 গতবছর ২০১১ তে জন্মদিন পালন হয়েছিল ট্রেনের মধ্যে । আমরা অমরকন্টক যাচ্ছিলাম । সেও এক অন্যরকমের অনুভূতি ।   এবছর ২০১২ তে আমার ছেলে তার পকেটমানি দিয়ে  আমার জন্য একটা কাঠের কাজ করা   সুন্দর রাজস্থানী মশাল এনেছে । ও জানে মা ঘর সাজাতে ভালোবাসে । তাই এই সারপ্রাইজ । প্রতিবছর আমার জন্মদিন আসতে না আসতেই ৩৬৫দিনের পুরোণো একটা বছরের পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাবার তোড়জোড় ।  

জীবনের আলপথগুলো গুলো চলতে চলতে অনেক বন্ধু এল চারপাশে । একঘেয়েমি কাটল ফেসবুকের একচিলতে ব্যালকনিতে । কেউ ভালোবেসে ছুঁড়ে দিল একরাশ জুঁইভেজা বৃষ্টিকবিতা । কেউ দিল একগোছা শুকনো রজনীগন্ধা । কেউ আবার শিশিরসিক্ত শিউলির গন্ধ নিয়ে সামনাসামনি এসে দাঁড়ালো। আলতো করে ধরে আছি বন্ধুত্বের হাত । ভয় হয়, পাছে দুঃখ পেয়ে বসি । আলগোছে পছন্দ করি বন্ধুর ছবি ।  ভয় হয়, যদি আঘাত পাই।  বন্ধুকে প্রতিদানে হয়ত ফিরিয়েও দি একমুঠো সত্যি শিউলি কিম্বা জুঁইভেজা সন্ধ্যেটা ।

চলতে থাকে জীবন। আলগোছে, আলতো পায়ে । মনের কার্ণিশ বেয়ে নিঃশব্দে উঁকি দেয়  এসেমেস। বেজে ওঠে মুঠোফোন ঝন্‌ঝন্‌ । আমার মনোবীণায় সে ঝঙ্কারে হয়ত সামিল হয় অচেনা কোনো পাখি । সে শুধু বলে তুমি একা নও ।  ইনবক্সে উড়ে আসে অচেনা মেল, হঠাত মেল ।
চলতেই থাকে জীবন ছেঁড়া ছেঁড়া কবিতার ঘ্রাণ নিয়ে, অলস সময় পেরিয়ে যায় বৃষ্টিপথ, ভাবনার গদ্যেরা ভেসে যায় আপন খেয়ালিপথে, আলগোছে, আলতো পায়ে...

কখনো খেয়ালপোকা কিলবিল করে ওঠে । বলে "চল্‌, কোথাও ঘুরে আসি"
কখনো টেষ্টবাড গুলো লক্‌লক্‌ করে ওঠে "বলে চল্‌ ! ভালো কিছু খাই"
এদের নিয়েই  আমার ভালোমন্দ । এদের সাথে ওঠাবসা ।  আর রয়ে গেলে তোমরা । পুরোণো সেই আমির সাথে । চেনা চেনা রোদ্দুরে, অচেনা রাস্তায়, ভালোবাসার ফুটপাথে.......
একমুঠো কুচোনো কবিতার কলি দিয়ে জীবনপাত্রটি ভরে চলেছি । দুফোঁটা গান নিয়েছি সাথে। তিন-চার চামচ বৃষ্টি আর ছড়ানো ছেটানো শিশির ফেলেছি সেই জীবনপাত্রে । কথামালার টুকরো আখরগুলো দিয়ে  উথলে উঠি উঠি পূর্ণপাত্র । সবশেষে গার্ণিশ করলাম ভালোলাগার ঝর্ণাকলমের ফোঁটা দিয়ে । আর ভালোবাসার ঢাকনি দিয়ে বন্ধ করলাম আজকের রেসিপি ।
ভাগ্যি ব্লগ লিখতে শুরু করেছিলাম । তাই আজকের এই বিশেষ দিনে মন খুলে কটা কথা লিখতে পেরে ধন্য হলাম । এটাই এবারের  জন্মদিনের সবচেয়ে বড় পাওয়া !  


১৬ ডিসে, ২০১২

" আকবর ও আইপড "


-->
তার স্কুলের নাম বীরব্রত । বাড়ির আদুরে নাম বীরু । ক্লাসে বন্ধুরা সকলে ডাকে বীর বলে । অঙ্কের মাষ্টারমশাই ডাকেন বীরবল । খুব গর্ব বোধ করে তখন বীরু মনে মনে । আকবরের রাজসভার বীরবল চরিত্রটা হল বীরুর আইকন । বীরু নিজে যেমন বুদ্ধিদীপ্ত আর চালাক তেমনি আবার মজার মজার কথা বলে মানুষকে একদম সম্মোহিত করে ফেলে ।
তখন বীর বছর তিনেকের । সবে শ্লেটে চকের আঁচড় কাটছে । মা নিজের কাজ সারবে বলে সিমেন্টের মেঝেতে রঙীন চক দিয়ে বীরকে এবিসিডি লিখতে বলে রান্নাঘরে চলে গেছে । রান্নাঘর আর শোবার ঘরের মাঝে এক বিস্তর দালান । সিমেন্টের চকচকে মেঝে । বীর এ লিখে পাশে একটা ট্যারা বেঁকা আপেল, বি লিখে তার পাশে একটা মস্ত ব্যাট এঁকে, যেই সি লিখেছে মনে হল রোজ তো ম্যাওপুষি আঁকি । আজ ক্যাটার পিলার আঁকলে কেমন হয় ? যা কথা সেই কাজ । ক্যাটার পিলারের তিন খন্ড দেহ এঁকে দুটো জম্পেশ শুঁড় দিয়ে আর পেল্লায় দুটো চোখ মাথায় বসিয়েই মনে হল মা'কে ডাকে । মা কি আর রান্নাঘর থেকে ডাকলেই আসতে পারে ! " মাম্‌মাম্‌ দ্যাখো, দ্যাখো বলেও সাড়া না পেয়ে সোজা শোবার ঘর থেকে দালান হয়ে রান্নাঘর অবধি বীর তখন মন দিয়ে ক্যাটার পিলারটার দেহ একখন্ড করে বাড়িয়েই চলল নীচের দিকে । কাছাকাছি এসে সে পৌঁছে গেছে তার ক্যাটার পিলারকে নিয়ে । চীত্কার করে মাকে বলল " তুমি তো আর ক্যাটারপিলারকে দেখতে গেলে না , ও তোমার সঙ্গে দ্যাখা করতে চলে এসেছে" এই সেই একরত্তি বীরব্রত ।
স্কুলে ভর্তি হবার পর বাংলা ক্লাসে প্রথম ইউনিট টেষ্ট পিকচার কম্পোজিশানের । বিষয় বাড়ি । বীর মন দিয়ে বাড়ি এঁকেছে একটা । দেওয়ালে ইঁট । জানলায় গরাদ । আধা ভেজানো দরজা । মাথায় টালির চাল আর সেখান থেকে বেরিয়েছে স্মোকলেস উনুনের পাইপ । দশ লাইন লিখতে হবে বাড়ি নিয়ে । মোটে পাঁচ লাইন লিখে মন দিয়ে বাড়ি রঙ করছে বীর । একটা একটা করে লাল ইঁট, জানলা দরজা, গরাদ, সিঁড়ি সব রঙ করে ধোঁয়ার পাইপের মুখ দিয়ে কুচকুচে কালো ধোঁয়া এঁকে সেই ধোঁয়া বের করতে করতে ঘন্টা পড়ে গেল ! লেখা শেষ হল না । টিচার দশের মধ্যে তাকে পাঁচ দিয়েছেন দেখে বীর গিয়ে বলল " মিস, আমাকে পাঁচ দিলেন ? আমি এত কষ্ট করে বাড়িটা রঙ করলাম ! " মিস্‌ খুশি হয়ে আরো দুটো নম্বর বাড়িয়ে দিলেন । এই ছিল একফোঁটা ছেলের কান্ড !


যত বড় হতে লাগল বীরব্রত তত তার অঙ্কে মাথা খুলতে লাগল । মা-বাবা কখনো তাকে অঙ্ক পরীক্ষা নিয়ে মাতামাতি বা জোরাজুরি করেনি বলেই বোধহয় সে অঙ্ক করতে বড্ড ভালবাসত । বরং অঙ্ক পরীক্ষার আগের দিন মা'কে বলত মা, তুমি আমাকে একটু অঙ্ক প্র্যাকটিস করাবেনা ? বন্ধুদের মায়েরা কত কত ব‌ই ঘেঁটে অঙ্ক করায় ওদের। কি জানি হয়ত মা তার অঙ্ক পরীক্ষা নিয়ে বাড়াবাড়ি করেনি বলেই বোধহয় সে অত ভালো নম্বর পায় অঙ্কে । অঙ্ক পরীক্ষা মানেই অন্য বন্ধুদের যেন যত টেনশান । আর ক্লাসে সকলে তাকে বলে "উইজার্ড অফ ম্যাথস্" । তাকে যা অঙ্কই দেওয়া হোক যেমন করেই হোক সে করে দেয় ।
বীরব্রত এখন ক্লাস সেভেনে পড়ে । লেখাপড়ার পাশাপাশি গান শোনা আর ব‌ই অন্ত প্রাণ তার । বাংলাব্যান্ডের গান এফ এমের কৃপায় ঠোঁটস্থ । জন্মদিনে, পুজোয় কেউ তাকে কি উপহার নেবে জিগেস করলে বীর একবাক্যে বলে ব‌ই কিম্বা গানের সিডি । এবার ছোটমামা তাকে দিয়েছে বাংলাব্যান্ডের সিডি, মাসী দিয়েছে একটা সায়েন্স ফিকশান, আর একটা আকবর-বীরবলের গল্পের মজাদার ব‌ই । পুজোটা বেশ কেটে গেল হৈ হৈ করে গল্পের ব‌ই পড়ে, ঠাকুর দেখে গান শুনে আর মজা করে । পুজোর পর বাড়ি খালি । মন খারাপের পার্টির শুরু । তার ওপর স্কুল খুলেই ইউনিট টেষ্টগুলো সব হাত নেড়ে নেড়ে বলবে আজ বাংলা, কাল হিষ্ট্রি, পরশু ইভিএস । তবে পরীক্ষা দিতে, পড়াশুনো করতে বীরের খারাপ লাগেনা কিন্তু পুজোর ছুটি আর গরমের ছুটির পর স্কুল যেতে মোটেই ভাল্লাগেনা । তারপর স্ক্র্যাপবুক, ক্রাফট, নেচার ক্লাবের চার্ট তৈরী, স্কুলের অত্তবড় মাঠ থেকে রোজ প্লাসটিক তোলা, স্কুল ম্যাগাজিনের জন্য ছোটদের কাছ থেকে লেখা আদায় করা ... কত কাজ ! ভাগ্যিস তাকে রাহুল, সোহাগের মত টিউশানে যেতে হয়না । ক্রিকেট খেলতে হয়না । তাহলে তো আরো বাঁধাধরা জীবন হত তার । সে কথা ভেবে মনে মনে খুশী হয় বীরু । স্পোর্টস সে একটাই করে তা হল সাঁতার কাটা । নিয়ম করে ভোরবেলায় বাবার সাথে সাঁতার কাটতে যায় । পড়াশুনোয় বীরু এক্সেল নয় কিন্তু একেবারে খারাপও নয় ।

পুজোর ছুটির শেষদুপুরে ঘুম পেল বীরের । হাতে মাসীর দেওয়া আকবর-বীরবল আর কানে লাগানো আইপড । সিডি থেকে গান গুলো মামা সব আইপডে ট্রান্সফার করে দিয়ে গেছে । নাকের ওপর চশমা আর তার ওপর জোরসে আকবর-বীরবল-চিত্র-কথা আছাড় খেল । তো কি, তার দুচোখে নিদ্রাদেবী তখন ভর করেছেন । আর সে তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে সোজা এসে দাঁড়াল আকবরের রাজসভায় । এই সেই ইতিহাস.. এই সেই দিল্লির মুঘল সম্রাটের দেওয়ানি আম ? কি বিশাল রূপোর দরজা ! ঠাম্মা যেমন রাজার গল্প শোনাতেন! নবরত্ন খচিত লাল পলা, নীলা, সাদা মুক্তো, হীরে, পোখরাজ, পান্না, বৈদুর্যমণি.. আরো কত সব পাথর থেকে জ্যোতি ঠিকরে পড়ছে দেওয়ালে! কানে লাগানো আইপডে তখন বেজে চলেছে... আসছে সে এক রাজার রাজা ..ক্যাকটাসের "রাজার রাজা" এলবামের হিট গান । ছোট্ট ছেলে বীরু, পরণে তার সিক্স পকেটস, সাদা জিনসের প্যান্ট আর গায়ে কালো রঙের স্পাইডারম্যানের টিশার্ট । পায়ে একজোড়া ফ্লোটার্স । আকবার বাদশার জমজমাট রাজসভায় রবাহুত, অনাহুতের মত ঢুকে পড়েছে বীরু। নবরত্নের আসন আলোকিত করে রয়েছেন জ্ঞানী-গুণী ন'জন তারকা ।
আকবরই হবেন ইনি ! সিংহাসনে বসে আছেন সকলের থেকে দূরে, একা..কি চকমকে বেশভূষা, আর মণিমাণিক্য খচিত রাজ সিংহাসন তার ! কত গয়না পরেন না জানি রাজা মহারাজারা.. ভাবল। বীরুকে দেখেই সভার কার্যকলাপ স্থগিত হয়ে গেল।বীরুর আর কোনো সন্দেহ নেই ! ইনি মুঘলসম্রাট শাহেনশা আকবর বাদশা হতে বাধ্য । কি চকমকে পোশাক, কত সুন্দর পাগড়ী মাথায় ! কত গয়নাগাটি পরেছেন সম্রাট! রাজাদের বেশভূষা, চালচলন এমনই হয় সে জানে । স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সব রাজারাই রাজার মত হ'ন ।
একবার মনে হল গিয়ে সেলাম করে আসে । একবার ভাবল নিজের পরিচয় দেয় । তারপরেই মনে হল নাম না জিগেস করলে বলবে কেন সে ? ইচ্ছে হল তাঁকে গিয়ে জিগেস করে, আচ্ছা এখানে বাবর, হুমায়ুনের ছবি কোথায় ? রাজসভা আলো করে অর্ধচন্দ্রাকৃতি ভাবে বসে আছেন সব মন্ত্রীর মত ব্যক্তিরা । বীরব্রতর মনে পড়ল বিক্রমাদিত্যের মত আকবরের রাজসভাতেও তো নবরত্ন ছিল । ভাবতে ভাবতে হঠাত দেখে, একজন তালপাতার পুঁথি থেকে আবৃত্তি করছে.. কি সব আওড়াচ্ছেন শ্লোকের মত ; ও তাহলে ইনি পন্ডিত আবুল ফজল যিনি লিখেছিলেন আকবরের জীবনী "আকবরনামা" । আর তাঁর পাশেই ফৈজী হবেন নিশ্চয়ই যিনি ছিলেন আবুল ফজলের ভাই । গণিতে পারদর্শী ছিলেন আর কবি ছিলেন । আকবরের রাজসভার সব চেয়ে বড় সাহিত্যিক, জ্ঞানী মানুষ ...ইতিহাসে পড়েছে বীর ।
ঐ দূরে কত কত বাদ্যযন্ত্র পরিবেষ্টিত হয়ে বসে আছেন যিনি উনি নিশ্চয়ই মিঞা তানসেন । আকবর যাঁর সঙ্গীতের কদর করেছিলেন । বীর মনে মনে বলল । অভাবনীয় ক্ল্যাসিকাল শিল্পী তানসেন, যিনি দীপক রাগ গেয়ে আগুণ জ্বালাতেন, মেঘমল্লার রাগ গেয়ে বৃষ্টি নামিয়েছিলেন ...বীর সব পড়েছে এসব । সঙ্গীতশিল্পী দেখলে বীরের কেবল অটোগ্রাফ নিতে মন চায় ! ইস্‌ একটা কাগজ পেন নেই তার সাথে ! আকবর বাদশার পাশে বসে আছেন ঐ মানুষটা কে হতে পারে, খুব মন দিয়ে সম্রাটের সাথে গুরুতর আলোচনায় ব্যস্ত উনি । কি সব হিসেব নিকেশের কাজকর্ম চলছে বলে মন হল তার । বোধহয় রাজা টোডরমল উনি । আকবরের খাস দেওয়ান ছিলেন । যত দেখছে বীরু ততই খুশি খুশি হয়ে উঠছে তার মনটা । জমজমাট একটা রাজপ্রাসাদের মন্ত্রীমহল । সেবার দিল্লী-আগ্রা বেড়াতে গিয়ে বিশাল বিশাল রাজপ্রাসাদ দেখে মনে হয়েছিল শূণ্যতা আর শূণ্যতা ! রাজা,মন্ত্রী আর তাদের পার্ষদ না থাকলে রাজবাড়ী কেমন যেন বিষণ্ণতায় ভরা থাকে । হঠাত রাজসভায় টুংটাং আওয়াজ হতে শুরু হল । মিঞা তানসেন মিহি করে গান ধরেছেন তখন । বীরু দেখল আরেকজন মানুষকে । খুব সাদামাটা পোষাকে খুব হাসিখুশি মুখে বসে বসে কি যেন বিড়বিড় করে চলেছেন তিনি আর পাশের মানুষগুলিও তার কথার অংশীদার হয়ে হেসে উঠছে জোরে জোরে । ইনি দরিদ্র ব্রাহ্মণপুত্র বীরবল হতে বাধ্য । যার নাম ছিল মহেশদাস । সম্রাট আকবর এনার নাম দিয়েছিলেন বীরবল । খুব পছন্দ করতেন আকবর এনাকে । এনার বুদ্ধিমত্তার প্রকৃত তারিফ করেছিলেন ইনি । বীরু সব জানে এসব । ঐ চরিত্রটি তার যে বড্ড পচ্ছন্দ । জাঁকালো সব জোকস জানে বীরু । আকবর-বীরবলের ব‌ইতে পড়েছে । সেই উটের দেহ কেন বাঁকাচোরা ? বাগানে ক'টা কাক দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ? এসব মনে পড়লে হেসে কুটিপাটি হয় আর মাম্‌মাম্‌, বাবাইয়ের সাথে শেয়ার করে । কিন্তু আকবরের নবরত্ন সভার আরো কয়েকজনের নাম আর মনে পড়ছেনা সেই মূহুর্তে তার । আরো কয়েকজন আছেন এই নাইন-জেমস ক্লাবে কি যেন নাম বাকীদের মনে মনে হিস্ট্রি ব‌ইয়ের পাতা থেকে বলতে লাগল..
হঠাত মনে হ'ল বাদশার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে । তাহলে তিনিই তো বলে দেবেন বাকী ক'জনের নাম । চিনিয়ে দেবেন তাদের একে একে ।
এক উর্দিপরা এক চাপরাশি এসে তাকে টেনিস বলের সাইজের লাড্ডু আর একবাটি ক্ষীর খেতে দিল ।
বীরু তো মিষ্টি খেতে ওস্তাদ অত বড় লাড্ডু হাতে নিয়ে মনে পড়ে গেল গুপিবাঘার সেই রাজার আদরের কথা । ঠিক অত্তবড় রসগোল্লা দেখেছিল সিনেমায় ।
মাথায় তখনো ঘুরছে তার আকবর-বীরবলের গল্প । লাড্ডু হাতে নিয়ে দৌড়ে চলে এল রাজার সামনে । সম্রাট আকবর বীরব্রতকে দেখে একগাল হেসে বললেন " তোমার নাম কি , তুমি কোথা থেকে এসেছ ইত্যাদি ইত্যাদি । বীরব্রত সব জবাব দিতে দিতে আকবরকে মন দিয়ে নিরীক্ষণ করতে লাগল ।
সম্রাট আকবর বীরব্রতর কানে দুটো সাদা সূতো ঝুলছে দেখে অবাক হয়ে জিগেস করলেন " আচ্ছা এটা কি বস্তু বালক? "
বীরব্রত বলল "এটা হল গান শোনার তার, "আইপড" আছে না ? তার থেকে বের হয়ে কানে লাগানো থাকে" এই বলে পকেট থেকে ছোট্ট গানযন্ত্রটি বের করে দেখাল আর রাজার কানে হেডফোন লাগিয়ে দিয়ে গান শোনাতে লাগল ।
রাজার খুব ভাল লাগল । বললেন "এটা আমাকে এনে দিতে পারবে"
বীরব্রত বললে "তুমি এটাই নাও না, তোমার জন্য আমি তো কিচ্ছু আনিনি হাতে করে, যতক্ষণ ব্যাটারী আছে তুমি গান শুনতে পারবে, কিন্তু চার্জ দেবে কোথায় ? তোমার এখানে তো ইলেকট্রিসিটি নেই" গল্পের ব‌ইতে পড়েছি, রাজাদের সাথে দেখা করতে গেলে ভেট দিতে হয় , না হয় এটাই দিলাম তোমাকে রাজা মশাই"
বীরব্রত বললে "আমাকে অটোগ্রাফ দেবে রাজামশাই?"
"সে আবার কি বস্তু?" আকবর বললেন
"অটোগ্রাফ হল নিজের হাতে লেখা স‌ই বা ছাপ যাই বল" বীরব্রত বললে
আচ্ছা, আমরা যাকে স্বাক্ষর বলি, আকবর বললেন

"এই যা:,আমি কাগজ পেন আনিনি । আমাকে একটা কাগজে তোমার নাম স‌ই করে দেবে রাজামশাই? আমার বন্ধুদের গিয়ে দেখাব" বীরব্রত বললে
আকবর বললেন " কাগজ কি বস্তু? আমি একটা তালপাতা দিচ্ছি , আমার সভার ন'জন রত্নকে নাম স‌ই করে তোমাকে দিতে বলছি"
খুশি হয়ে বললেন "আমার রাজত্বকালে মুদ্রিত, আমার নাম লেখা এই স্বর্ণমুদ্রাটি তোমাকে উপহার দিলাম ” বীরব্রত সেটিকে সযত্নে পকেটের মধ্যে পুরে রাখল ।

মন্ত্রীমশাই রাজার কাছ থেকে একটা তালপাতা, একটা খাগের কলম ও কালির দোয়াত এনে একে একে ন'জন নবরত্নের কাছ থেকে সেই তালপাতায় স‌ই করাল ও সব শেষে আকবরের কাছ থেকে তালপাতাটায় যেই মাত্র তাঁর স‌ই নেবার জন্যে আসবে তখুনি তার ঘুম ভেঙে গেল

ঘুমটা ভেঙে যাওয়ায় খুব আপসেট। কেন এমন হয় ? কেন রাজার অটোগ্রাফ নেওয়া হল না ? দূর একটুও ভালো লাগছেনা এখন তার; কেবল মাথায় ঘুরছে আকবরের রাজসভা, নবরত্ন, ফতেপুর সিক্রির সেই দেওয়ানি আম দরবার । আবার স্কুল খুলে যাবে । দুপুরে আর ঘুমোতে পারবে না সে । উতসব শেষ, স্বপ্ন দেখাও শেষ ।
কিন্তু এবার উতসবের ছুটিতে ফতেপুর সিক্রির সেই দেওয়ানি আম দরবার বেড়ানো... বীরকে এক ভালোলাগায় পেয়ে বসল ।

মনে পড়ল পুজোর ছুটিতে বাংলা মিস একটা রচনা লিখে আনতে বলেছেন পুজোর ছুটির দুপুরবেলা নিয়ে । ঘুম ভাঙতেই মা বললেন "বীর, আয় পাস্তা বানিয়েছি, খেয়ে নে"
পাস্তা তার খুব প্রিয় । বীর বলল "দাঁড়াও মা, ভুলে যাব এক্ষুণি না লিখে ফেললে"
বাংলাখাতা আর পেন নিয়ে বসে পড়ল ছুটির দুপুরের রচনা লিখতে "আমার দুপুরবেলার ইচ্ছে স্বপ্নেরা"...
ডান হাতে কলম আর বাঁ হাতে পাস্তার চামচ। চলতে লাগল সব্যসাচীর দুহাত সমান তালে ।
মা দেখতে লাগল দুচোখ ভরে বীরপুরুষকে । কানে আইপডটা গেল কোথায় ? "নিশ্চয়ই, হারালি তো এই বারে ?" মা বলল
"কোথায় আবার যাবে, আছে তো পকেটের মধ্যেই । দিচ্ছি দাঁড়াও । একটু লিখতে দাও না মা তারপর দিচ্ছি" বলল সে
মা ব্যস্ত হয়ে বললেন "নির্ঘাত হারিয়েছিস ওটা, আমি জানতাম একদিন হারাবেই"
বীর পকেট  হাতড়াল, পেলনা । "জানো মা আজ কি হয়েছিল?” বলল সে ।
মা বললেন "বুঝেছি আইপড হারানোর একটা গল্প ফাঁদছিস তো?"
বীর আবার পকেটের মধ্যে হাত দিয়ে খুঁজল তার গানযন্ত্রটিকে  ।
পেল অন্য একটা জিনিষ । স্বয়ং মুঘল সম্রাটের দেওয়া  উপহার । সেই আকবরী মোহরটিকে
পকেট হাতড়ে সোনার কয়েনটা মায়ের হাতে দিয়ে  বললে "এটা নাও"
মা তো হতবাক ! আইপডের বদলে সোনার কয়েন ? "কোথায় পেলি ?"
"ঐ জন্যেই তো লিখছি তাড়াতাড়ি যাতে তুমি সব জানতে পারো । নয়তো সব ভুলে যাব যে"
মা উলটেপালটে দেখতে লাগল সোনার কয়েনে কি সব লেখা রয়েছে তাতে ।
অনাবিল আনন্দে বীর ততক্ষণে ডুবে গেছে তার বাংলা রচনার মধ্যে । 

 আনন্দমেলা ৫ই নভেম্বর ২০১২ তে প্রকাশিত   


২ ডিসে, ২০১২

পটমায়া @ পিঙ্গলা


আজ খড়গপুর থেকে পশ্চিম মেদিনীপুরের পিঙ্গলা গেছিলাম । খুব খারাপ  গ্রামের রাস্তা, যেতে প্রায় ঘন্টাদুয়েক লাগল ।হাতের মুঠোয় স্মার্টফোনে উন্মুক্ত  একভর্তি গুগল ম্যাপ । দিশা দেখাল আমাদের । 
খড়গপুর আইআইটি ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে ষ্টেশনের দিকে না গিয়ে ঝপেটাপুর, ছোটা ট্যাংরা দিয়ে কৌশল্যার মোড় পড়ে । সেখান দিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের বারবেটিয়া, ধরে চওড়া পিচের রাস্তা দিয়ে একে একে পেরোতে লাগলাম চাঙ্গুয়াল, দক্ষিণ গেড়িয়া, মাওয়া হাটতলা, দুজিপুর বাজার  । ডাইনে বাঁয়ে ধূ ধূ ধানজমি । অঘ্রাণের শেষের মাঝামাঝি ধান উঠেছে একপ্রস্থ । পিচের রাস্তায় ধান শুখোচ্ছে । আর পথের দুধারে স্তূপিকৃত খড়ের আঁটি । এল জামনা । তারপর আরো গিয়ে পিঙ্গলা । সেখানে নয়া নামে এক ছোট্ট গ্রামে বাংলানাটক-ডটকম আয়োজিত "পট-মায়া" দেখতে যাওয়া । 


পটশিল্পীদের গ্রাম নয়ায় আয়োজিত "পট মায়া" দেখলাম ঘুরে ঘুরে। নীল আকাশের নীচে, শীতের মিঠে রোদ্দুরে পা ছড়িয়ে  গ্রামের ঘরে ঘরে পটুয়া, চিত্রকরেরা মাটীর ঘরের দাওয়ায় মেলে বসেছিল পটশিল্পের পসরা । ঘরের ঝি, বৌ, ছেলে সকলে মিলে এঁকে চলেছে । অবলীলাক্রমে এরা আঁকে । বংশ পরম্পরায় ধরে রাখে বাংলার এই ঐতিহ্যকে ।  প্রাকৃতিক রং দিয়ে আঁকছে তারা । শীলে বেটে নিচ্ছে কাঁচা হলুদ, শিমপাতার সবুজ, অপরাজিতা ফুলের নীল, গাঁদাফুলের পাপড়ি আর জাফরন বলে একটা কাঁটাওলা ফল যার ভেতরের লাল বীজগুলো থেকে লালরং বের করছিল ওরা । রংয়ের সঙ্গে কাঁচা বেলের আঠা মিশিয়ে তুলির টানে ফুটিয়ে তুলছে অভিনব শিল্পকর্ম । আর ছবি তৈরীর পর গান গেয়ে ব্যাখ্যা করছে ছবির বিষয়বস্তু।  পটশিল্পীরা মাটীর পট, ফুলদানী হাতপাখা, টিশার্ট বানিয়ে সাজিয়ে রেখেছে । ঘরে ঘরে সকলের আজ মহামেলা ।  অনেক মানুষ এসেছিলেন কলকতা থেকে । ৩০শে নভেম্বর থেকে ২রা ডিসেম্বর অবধি চলল এই মেলা ।

২৭ নভে, ২০১২

জেরিয়াট্রিক সেই মহানগর !

ওরা পরিত্যক্ত জঞ্জালের মত অথবা নালীর মুখে জড়ো হওয়া দশ মাইক্রন পলিথিনের নোংরা ক্যারিব্যাগের মত । ওদের কেউ চায়না । ওরা বাজারে যায় টলোমলো পায়ে। পোষ্ট অফিসের এম আই এস কাউন্টারে লাইন দিয়ে সুদ তোলে । কখনো টাল খেয়ে যায় মাথা। সোডিয়াম-পটাসিয়াম ব্যালেন্সটা ঠিক হয়না আজকাল ।  চোখের ছানিটা পেকে যায় ধীরে ধীরে । খবরের কাগজটা পড়তে হয় বাইফোকাল চশমাটাকে এদিক ওদিক সামলিয়ে । কানেও কম শোনে ওরা । রাস্তায় সাইকেল ধাক্কা মেরে দেয় তাই । হর্ণ শুনতে পায়না । জিভের স্বাদটা আছে কিছুটা । তবে দাঁতগুলোর জন্যে নরম খেতে চায় আজকাল । স্মৃতিটুকুনিও তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে । পুরোণো কথা সব মনে আছে, নতুন কথা ভুলে যায় ওরা । সেটাও ওদের দোষ । কখনো বা এদের রোজ রোজ সুগারের ওষুধ খেতে খেতে হাইপো গ্লাইসিমিক শক হয়ে যায় । নিঃসাড়ে চিনির কৌটো হাতড়ে মুখ ভর্তি চিনি খেয়ে এরা বিছানায় শুয়ে পড়ে চুপিচুপি । আবার কিছু পরে স্বাভাবিক হয়ে যায় ।   কোনোদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে বাঁ পা' টা ফুলে  গেছে । মনে ভাবে এই বুঝি লেফট ভেন্ট্রিকুলার ফেলিওর হবে । বাঁচা গেল বাবা মরে যাব । কিন্তু সেদিনটা আর আসেনা ।  ওরা বারবার এক কথা বলে যায় অনর্গল । স্মৃতির চোরাকুঠরির নুড়িপাথর গুলো নিয়ে খেলতে চায় ওরা । কিন্তু শুনতে চায়না কেউ ওদের কথা । ওদের কথায় বিরক্তি প্রকাশ করে ।  
এইভাবে ওরা বেঁচে থাকে দিনের পর দিন এই শহরের অলিগলিতে, উঁচু ফ্ল্যাটে একচিলতে ব্যালকনির আরামকেদারাতে, বিশাল বাড়ির বারান্দায় রোদের ওম নিতে নিতে, কুঁচকে যাওয়া চামড়ার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ... কেউ স্মৃতির ঘাটতি নিয়ে, কেউ অধরা রাতঘুম নিয়ে কিম্বা কেউ পঙ্গু জীবনখানা নিয়ে । 
এ শহরে শুধু পড়ে র‌ইলাম তুমি, আমি আর সেই জেরিয়াট্রিক মানুষগুলো । আমার বন্ধুত্ত্ব এই মানুষগুলোর সাথেই । ওদের এই বয়সের দোষ-গুণ গুলো আমি মানিয়ে গুনিয়ে নিয়ে চলি কারণ আমারো তো এমন হবে একদিন সেই কথা ভেবে । আমার চিরটাকাল পটে এই বয়স্ক মানুষগুলোর সাথে । আমার ঠাকুমা, দিদা আমার খুব বন্ধু ছিলেন একসময়। তারপর বাবা-মা । আমার পিসি শাশুড়ি, দিদিশাশুড়ি, জেঠি শাশুড়ি,  সকলেই ছিলেন আমার অনুরাগী।  পিসিশাশুড়ি ছিলেন তীর্থপতি ইনসটিটিউশানের অঙ্কের দিদিমণি । শেষবয়সে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে বিছানায় পড়েছিলেন বহুদিন । তিনি ছিলেন অনূঢ়া । মনে খুব দুঃখ ছিল তাঁর । সুখের একখানা ঝাঁ চকচকে সংসারের মুখ দেখতে পাননি বলে ।   আমি অনেক স্নেহ পেয়েছি এঁদের থেকে । আমার মাসী শাশুড়ি তখনকার দিনে কেমিষ্ট্রিতে এমএসসি পাশ করেছিলেন । আমার খুব পটত ওনার সাথে । এখন তাঁর একিউট ডিমেনশিয়া ।  আমার জেঠি শাশুড়ির কোনো সন্তান ছিলনা । আমাদের কাছেই থাকতেন চিরকাল । এক একসময় খুব বিরক্তিও আসত। এদের রেগুলার ডাক্তারের চেক আপ, আয়া ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে, খাবারদাবার ঠিকমত করে বানিয়ে রাখতে ও ঠিকঠাক খাচ্ছেন কিনা তার তদারকি করতে । কিন্তু যত আমার বয়স বাড়তে লাগল তত বুঝলাম অনেক ভালো এই বৃদ্ধ মানুষ গ্যুলো । এদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। রান্নাবান্নার তাকবাক থেকে ঘর গেরস্থালির টুকটাক।  সেই থেকে বয়স্ক মানুষরাই  আমার বেশি কাছের  । আর যাই হোক । এঁরা স্নেহপ্রবণ । এরা আমার কোনো ক্ষতি করেনা। আমাকে হিংসে করেনা বা আমার ভালো দেখলে এরা আর যাই হোক পরশ্রীকাতরতায় ভোগেনা । তাই এদের সাথে মিশতেই আমার বেশি ভালো লাগে আজকাল ।  এদের দেখলে আমি দুঃখ পাই কিন্তু এরা আমাকে দুঃখ দেয়না । পুরোণো কথাবার্তার আলপচারিতার মধ্যে দিয়ে আমি অনেক কিছু শিখি এখনো । হয়তো একসময় এরা আমাকে কেউ কেউ আঘাত দিয়েছিল কিন্তু বয়সের ভারে কুব্জ ও স্মৃতির টানাপোড়েনে ন্যুব্জ এই মানুষগুলোর জন্যে আমি মনে মনে খুব ব্যথা পাই । এদের কত দাপট ছিল একসময়! এরা কত সুন্দর করে শাড়ি-গয়না পরতেন্! কিম্বা কেউ নিজে গাড়ি চালিয়ে অফিস যেতেন অথবা পার্টিতে গিয়ে এক আধ পেগ ভদকা বা জিনও খেতেন ! 
 আমরা না হয় ইন্টারনেট বুঝি, ব্লগ লিখি, স্মার্ট ফোন দিয়ে সর্বক্ষণ স্ট্যেটাস আপডেট করি তাই বলে এরা কি ফ্যালনা?   
আমার শ্বশুর মশায়ের বন্ধুরা আমার ঘনিষ্ঠ । এমন একজনের নাম মনে পড়ে তিনি হলেন অসীমদেব গোস্বামী । 
-->
অঞ্জুমাসি , অসীম মেসো  আমাদের পাড়ার বহুকালের বাসিন্দা। ওনাদের একমাত্র পুত্র আমার স্বামীর সাথে একই স্কুলে পড়াশুনো করার কারণে দুই পরিবারের মধ্যে একটি হৃদ্যতার সম্পর্ক আছে। অসীমমেসো বিলেতফেরত চাটার্ড-একাউন্টেন্ট ও অবসরপ্রাপ্ত মাল্টিন্যাশানাল এক্সিকিউটিভ | একমাত্র পুত্রকে স্বেচ্ছায় আমেরিকাতে ডাক্তার হতে পাঠিয়ে পুত্র বিগলিত প্রাণ মাসি-মেসোর মনোকষ্টের শেষ নেই | তাঁরা বছরে একবার ছেলের কাছে যান মাসতিনেকের জন্য আর সারাবছরের রসদ সংগ্রহ করে আনেন স্মৃতির ক্যানভাসে। এই ভাবেই বেশ চলছিল। একাকিত্বের বিষন্নতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে ক্লাব,আত্মীয়-বন্ধু, এই সব নিয়ে বার্ধক্যের বারাণসিতে সুখেই ছিলেন তাঁরা। হঠাত চিকিত্সা-বিভ্রাটের কবলে পড়ে অঞ্জুমাসির একটি পায়ের সব কটি আঙ্গুল একে একে বাদ দিতে হল। আমেরিকাতেও বিশেষ সুরাহা হল না । বিশেষজ্ঞের পরামর্শে বিশেষ ধরনের সিলিকোন আস্তরণ দেওয়া জুতো , ওয়াকার এসবের সাহায্যে অঞ্জুমাসি কালাতিবাহিত করছেন । স্বামীর সাহচর্য, আর সহমর্মিতা তাঁকে কখোনই বুঝতে দেয় না পুত্রের অভাব , ও তাঁর এহেন বিপর্যয়। অঞ্জুমাসি অনেক বেশী পরনির্ভর এখন। যখন ঘরে-ঘরে ধৈর্য্য-সহ্য,পারষ্পরিক বোঝাপড়া এসবের মতো তুচ্ছ কারণে বহু বছর একসাথে ঘর করার পরেও স্বামী-স্ত্রীর মধুর সম্পর্ক ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে , ঠিক তখনই ক্লাবে গিয়ে দেখি অসীমমেসো একহাতে নিজের জন্যে হুইস্কি আর অন্যহাতে অঞ্জুমাসির জন্যে অরেঞ্জ-জুস নিয়ে ফুড্- কোর্টে খাবার, অর্ডার করেছেন হাসিমুখে ।  বিজয়াদশমীর প্রণাম করতে গিয়ে দেখি অসীমমেসো ডাক্তারের নির্দেশমত অঞ্জুমাসির কাটা পা'টিতে গরম-ঠাণ্ডাজলের স্পঞ্জ দিচ্ছেন । তারপরে মুছিয়ে নিখুঁতভাবে এলোভেরা-ভিটামিন ই সমৃদ্ধ ক্রিম লাগিয়ে সবশেষে সেই বিশেষ জুতোটি পরিয়ে তার ফিতে বেঁধে দিলেন । পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধের অসহায় ,প্রতিবন্ধী বৃদ্ধা স্ত্রীর জন্য প্রতি মূহুর্তে এরূপ সাহায্যের হাতবাড়িয়ে দেওয়া দেখে মনে হয় ভালবাসার কি অপূর্ব 'অসীম-অঞ্জলি' !! 
সেই অসীমমেসোর এখন ক্যানসার হয়েছে শুনলাম । দেখা করতে গেলে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন । অঞ্জুমাসীর স্মৃতিবিভ্রম হয়েছে । ছেলে কিছুদিন নিয়ে গেছিল কিন্তু আবার দিয়ে গেছে ওঁদের কোলকাতায় । দুজনেই দিন গুনছেন । কিন্তু বিধাতা কানে শুনতে পাননা এদের ডাক । 
উচ্চশিক্ষার জন্য আমরাও মরিয়া হয়ে ছেলেপুলেদের মানুষ করছি । কিন্তু হায়রে পোড়া শহর্! কি র‌ইলো তোর? না হল শিল্প, না হল উন্নয়ন । আবার পিছিয়ে পড়লাম আমরা । মেধাবী ছাত্রগুলো পাড়ি দিল অন্যরাজ্যে, বিদেশে । কোলকাতায় পড়ে র‌ইল শুধু জং ধরা, তামাটে হয়ে যাওয়া রং চটা, চামড়া কুঁচকে যাওয়া সেই বুড়িবুড়িগুলো।  তাই তো এই মহানগর আজ জেরিয়াট্রিক এক বৃদ্ধাবাস! আমার শাশুড়িমা একসময় আমাকে খুব একটা যে স্নেহ করতেন তা নয় । আমিও খুব ডিষ্টার্বড দিন কাটিয়েছি সে সময় । কিন্তু এখন উনি আমার খুব ভালো বন্ধু একজন । কোলকাতায় আমার মা এবং শাশুড়ি যে মহিলা সংস্থাগুলির সাথে যুক্ত সেই "জননী সংঘ" , মিলনমেলা" "পাঠচক্র", "শরত্সমিতি"র এমন সদস্যা বহু এমন মাসীমারা আছেন যাদের ছেলে-বৌ, মেয়ে-জামাইরা বিদেশে কিম্বা ভিনরাজ্যে ।  ওনাদের জন্য ফিল করি । যাঁরা দুজনে আছেন অর্থাত স্বামী-স্ত্রী তাঁরা তবুও একরকম আছেন বেঁচে বর্তে কিন্তু যাঁরা একলা হয়ে গেছেন তাঁদের জন্য বড্ড কষ্ট হয় । কি ভবিষ্যত এই মানুষগুলোর! কেনই বা এদের বেঁচে থাকা ?  

প্রতিবার "প্যাপিরাস" ওয়েব ম্যাগাজিনে এদের মধ্যে থেকে কারোকে দিয়ে আমি লিখিয়ে নি তার জীবনের কথা, বেড়ানোর কথা । তারপর ম্যাগাজিন প্রকাশের পর ল্যাপটপ তুলে ধরি তাদের চোখের সামনে । নিজের লেখা প্রকাশের সে কি আনন্দ ! লক্ষ্য করি তাদের চোখেমুখে । 
আমি যাই এঁদের মনোরঞ্জনের জন্য । গান শোনাই কিছু সময় । এবার পূজোয় ওদের কজনকে নিয়ে অনুষ্ঠান করলাম একটা । ওরা কনফিডেন্স পেলেন । আমার ভালো লাগল । ওরাও যে কিছু করতে পারেন এখনো সেই আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দেওয়া । নয়ত সেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সামিল হওয়া মনুষগুলোর জীবনে তো আর কিছুই নেই। একটু ভালোবাসা চায় এরা। একটু সম্মান চায় । আর চায় একটু ভালো ব্যবহার । আর কিই বা চাওয়ার আছে এদের্? এদের জীবনে না আছে সেক্সলাইফ, না মাল্টিপ্লেক্সে ফূর্তিফার্তা, না কেউ আদর করে এদের  ক্যান্ডেললাইট ডিনার খাওয়ায় । কারই বা অত সময় আছে এদের নিয়ে ভাববার? কেই বা শুনবে সেই ঘুণ ধরা শরীরের হাজার একটা সমস্যার কথা । 
সময়ের খেয়া বয়ে এদের পার করে দেয় জীবনের শেষপ্রান্তে । ধুঁকতে থাকে মানুষগুলো। স্মৃতি হাতড়ে মরে  তখনো। " কি ক্ষমতা ছিল আমার!, কত বড় চাকরী করেছি আমি! একা হাতে চল্লিশজনের রান্না করেছি একসময়! সাঁতরে গঙ্গায় করেছি এপার-ওপার".. ইত্যাদি ইত্যাদি। সে তো এখন ইতিহাস তার মতে।  
মনে মনে ভাবি আমাদের এই কলকাতায় একটা জেরিয়াট্রিক সোশ্যাইটি খুললে কেমন হয় যেখানে এক আকাশের নীচে সবাই বন্ধু হয়ে থাকবে এরা আর এই সোশ্যাইটি দেখভাল করবে এই অতিরিক্ত নাগরিকগুলোর?  যাদের কোনো ভবিষ্যত নেই আছে শুধু স্বর্ণালী একটা অতীত!  

মনে মনে গেয়ে উঠি "ঝরাপাতা গো, আমি তোমারি দলে" অথবা বলি "শেষের সেদিন কি ভয়ংকর মনে করো" !!!   

২৪ নভে, ২০১২

dutta vs. dutta



  যারা অঞ্জন দত্তের die-hard ফ্যান তারা পছন্দ করবে " দত্ত ভার্সেস দত্ত " । "ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে" শঙ্কর চক্রবর্তী আর অর্পিতা পাল বহুত চেষ্টা করেও বেশ মাখিয়েছেন ।  " উঠগো ভারত লক্ষ্মী " দীপঙ্কর দে, রীতা কয়রাল এবং অন্যান্যদের বলিষ্ঠ পরিবেশনেই উতরে যায় ।  গানের চিত্রায়ণটি অসাধারণ । ঐ একটি দৃশ্যে যেন বলতে ইচ্ছে হয় " মেড মাই ডে "  ...অসাধারণ সিকোয়েন্স, পরিচালনায় কোনো ত্রুটি নেই ঐ দৃশ্যটিতে ।  বরং অভিনব এবং নতুনত্ব । ইংরেজী গানের দৃশ্যটিও বেশ সুখকর । তবে তিনটি নারীচরিত্র  রূপা গাঙ্গুলি, পার্ণো মিত্র এবং অর্পিতা পাল সুযোগ পাননি তেমন অভিনয় দেখানোর । সেই অনুপাতে রীতা কয়রাল দারুন ফুটিয়েছেন ওনার চরিত্রটি । অটোবায়োগ্রাফিকে সিনেমার রূপদান অবিশ্যি তাদেরই ভালো লাগবে যারা অঞ্জন দত্তের ফ্যান । আর  গল্পে তো বাস্তবের ছোঁয়া অঞ্জন দত্তের ছবির প্রধান শর্ত ।   অঞ্জন দত্ত অনবদ্য এক বেপরোয়া ঊকিল । শুভাশিস পাগলের ভূমিকায় বেশ মনে রাখার মত অভিনয় করেছেন । এছাড়া মধ্যবিত্ত বাঙালী বাড়িতে ভাই-ভাই বা জ্ঞাতির সাথে সম্পর্কের খুঁটিনাটি দিকগুলি পরিচালকের সফলতায় আরো সুন্দরভাবে প্রকট ।   রণদেবের ভূমিকায় নবাগত রণদীপ বোস কে দেখে মনে হল সে    আরো উঠবে । অঞ্জন দত্তের বাচন ভঙ্গিমায় আগাগোড়া ভাষ্যপাঠ ও সাথে ফ্ল্যাশব্যাকে সাদাকালো প্রেক্ষাপট বেশ মনে ধরে । অটোগ্রাফ ও ২২শে শ্রাবণ খ্যাত সৃজিতের রোলটিও বেশ পজিটিভ তবে অত্যাধিক সিগারেট, এলকোহল এমনকি গাঁজার  ব্যবহার মাঝেমাঝে বিরক্তি আনে । তবে বলিষ্ঠ চিত্রনাট্য , অঞ্জন দত্তের উদাত্ত কন্ঠস্বর ও অভিনয়ের দাপটে   বাংলা ছবির একঘেয়ে  genre থেকে একটু মুক্তি দেয় dutta vs. dutta ।  কয়েকটি মামুলি  চুম্বন দৃশ্য সম্বলিত  (A) মার্কা বাংলাছবির  এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করবে কি না জানিনা । 

১৩ নভে, ২০১২

দীপাবলী- ২০১২


কার্তিকের হিমপড়ার শুরু হয়েছে দুর্গাঠাকুর জলে যাবার ঠিক পরে পরেই । বিজয়া দশমী আর কোজাগরী উত্সবের শেষরেশটুকুনি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমাদের দেশের এক প্রাচীন শহর বারাণসীতে ।বারাণসীর পূর্বের নাম ছিল আনন্দবন । তারপর  কাশী ।   বরুণা আর অসি এই দুই নদীর সঙ্গম তীর্থ বারাণসী বা বেনারস । গঙ্গায় এসে পড়েছে এই দুই ছোটনদী ঠিক এইখানে । কত বড় বড় মানুষ ঘাট বাঁধিয়েছেন গঙ্গার ধারে ধারে । তাঁদের নামে ঘাটের অধুনা নামকরণ । সবশুদ্ধ ৩৬৫ টি ঘাট রয়েছে এখানে । নৌকা করে কিম্বা পায়ে হেঁটে হেঁটে বেশ কয়েকটি পরিক্রমা ও করা যায় নদীর ধার দিয়ে । কত কত তীর্থপ্রেমী মানুষের আনাগোনা এই চির প্রাচীন মন্দিরময় শহরে । দেশবিদেশের পর্যটকরা কিসের আকর্ষণে সমবেত হন জানা নেই তবে দেশী তীর্থযাত্রীদের ভীড় ও নেহাত কম নয় এখানে । দশাশ্বমেধ ঘাটের পাশেই রাণী অহল্যাবাঈ হোলকার  প্রতিষ্ঠিত  কাশী বিশ্বনাথ মন্দির আর পাশেই অন্নপূর্ণা মায়ের মন্দির । কথিত আছে বহুযুগের প্রাচীন বিশ্বনাথ মন্দিরটি প্রথমে মহম্মদ ঘোরী, তারপর কুতুবুদ্দিন আইবক, ফিরোজ শাহ তুঘলক ও সবশেষে   মোগল সম্রাট ঔরঙজেবের হুকুমে বিনষ্ট করে একটি মসজিদ তৈরী করা হয়েছিল । প্রাচীন শিবলিঙ্গকে পাশ্বর্বর্তী   জ্ঞান ব্যাপী কুন্ডের মধ্যে পুরোহিতরা লুকিয়ে ফেলেছিলেন কিন্তু সেটিকে আর পুনরুদ্ধার করা সম্ভব যায়নি । মুঘল ও মুসলমান শাসনের অবসানের পর এবং হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবনের স্বরূপ হিসেবে রাণী অহল্যাবাঈ হোলকারের সৌজন্যে নবনির্মিত বিশ্বনাথ মন্দিরে বিশ্বনাথের নতুন শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এই শিবলিঙ্গই আজ চুম্বকের মত দেশ ও পৃথিবীর কোণা কোণা থেকে মানুষকে বারাণসীর এই মন্দির তলে টেনে নিয়ে আসে । হাওড়া থেকে অমৃতসর মেলে বারাণসী পৌঁছেই আমরা একটি হোটেলে মালপত্র রেখে অটোরিক্সা নিয়ে চলে যাই কালভৈরব মন্দিরে । এই কালভৈরবকে বলা হয় বারাণসীর কোতোয়াল বা বডিগার্ড যিনি বারাণসীকে বাঁচিয়ে আসছেন যুগ যুগ ধরে বহির্শত্রুর আক্রমণ থেকে । সরু গলি প্রধান এই পুরোণো শহরের পেল্লায় ষাঁড় গুলি রাজকীয় । তারা স্বমহিমায় গলির আনাচেকানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দন্ডায়মান । শহরের ভীড়ভাট্টা, অটোরিক্সার হর্ণ, মোটরবাইকের ধাক্কাতেও তাদের কোনো হেলদোল নেই ।  গলি জুড়ে আর রয়েছে দর্শনার্থীদের লাইন । কোনো মতে কালভৈরবের মাথায় ফুল-বেলপাতা চড়িয়ে বেরিয়ে এসে ঘাটের দিকে রওনা দিলাম । কেদারঘাটে এসে নৌকো নিলাম । নৌকো চড়ে ওপারে রামনগর প্যালেস দেখতে যাওয়া ।  প্রায় এক ঘন্টা মোটর বোটে চড়ে ঘাট পেরোতে লাগলাম একে একে । কাশীর রাজা চৈত সিং নির্মিত ঘাট, প্রভুঘাট, নিরঞ্জনী ঘাট , পঞ্চকোট ঘাট, মহানির্বাণ ঘাট, হরিশচন্দ্র ঘাট, শ্রী নিষাদরাজ ঘাট, মীরঘাট ( যেখানে মীরাবাঈ স্বয়ং তপস্যা করেছিলেন ) দিগম্বর জৈন ঘাট, সুপার্শ্বনাথের জন্মভূমি প্রসিদ্ধ ; সুপার্শ্বনাথ ঘাট,  আনন্দময়ী ঘাট,  মাতা ভদারিণি ঘাট  হিন্দী  রামায়ণ রচয়িতা তুলসী দাসের নামে তুলসী ঘাট, রীবা ঘাট  প্রভৃতি কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘাট দেখতে দেখতে মাথায় কার্তিকের সূর্য নিয়ে গঙ্গা পরিক্রমণ করতে করতে অবশেষে পৌঁছলাম রামনগর । কার্তিক পূর্ণিমায় সব ঘাট  গুলির সিঁড়িতে মাটির প্রদীপ জ্বলে একসাথে । তখন না জানি কি সুন্দর হয় ঘাটের শোভা ! গঙ্গা উত্সব পালিত হয় তখন মহাধূম করে । গঙ্গার জলে প্রদীপের আলোর সেই প্রতিফলন কি অপূর্ব আলোর জলছবি সৃষ্টি করে তা কল্পনা করে নিলাম মনে মনে । দীপাবলীর প্রাক্কালে ঘাটের সিঁড়িগুলির মেরামতি চলছিল সেই কারণে ।

রামনগর প্যালেস ও ফোর্ট

কাশীর রাজার রাজবাড়ী এবং স্বাধীন  ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর জন্মস্থান এই রামনগর  । রাজবাড়ি, ফোর্ট এবং মিউজিয়ামটি ঘুরে দেখবার মত । 
অতি উপাদেয় পাওভাজি-চাট এবং লস্যি সহ দুপুরের আহার হল এখানে । লসিতে জল মেশায়না বারাণসীতে । টাটকা টক দৈ ফেটিয়ে তার মধ্যে রাবড়ি দেয় এবং ওপর থেকে খানিকটা ঘন ক্ষীর ছড়িয়ে মাটির ভাঁড়ে সার্ভ করে । 

কাশী-বিশ্বনাথ এবং অন্নপূর্ণা মন্দিরে

সন্ধ্যেবেলায় যাওয়া হল কাশীবিশ্বনাথ এবং অন্নপূর্ণা মন্দিরে পুজো দিতে । ফেরার পথে রাস্তার ধারে  ফুটন্ত গরম  দুধ এবং রাবড়ি খাওয়া হল । তারপর বেনারসী পান ।

সারনাথ

পরদিন সকালে অটো চড়ে সোজা সারনাথ । বুদ্ধ যেখানে প্রথম বাণী প্রচার করেছিলেন । তাই সারা বিশ্বের সকল দেশ যেমন জাপান, তিব্বত, শ্রীলঙ্কা থেকে বহু মানুষের ভীড় দেখলাম সারনাথে । পরিচ্ছন্ন শহর সারনাথ ।  আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার রক্ষণাবেক্ষণে সারনাথ এবং তার সংলগ্ন মিউজিয়ামটি একটি দ্রষ্টব্য স্থান । 

মণিকর্ণিকা

বেনারসে গঙ্গার তীরে অন্যতম ঘাট হল মণিকর্ণিকা এবং তার সংলগ্ন মহা শ্মশান । এখানে চিতার আগুণ কখনো নেভে না । চব্বিশ ঘন্টা জ্বলতেই থাকে । ঘাটে ঢুকেই লক্ষ্য করলাম বেল, আম প্রভৃতি গাছের শুকনো গুঁড়ি সারেসারে রাখা রয়েছে স্তুপাকারে । আর দূর থেকে ভেসে আসছে সেই শবপোড়া গন্ধ । জ্বলছে লাল চিতা । এখানে মৃত্যু হলে নাকি পরলোকযাত্রা হয় আত্মার । তাই বুঝি পূর্বে কাশীবাসী হতেন অনেকেই বৃদ্ধ বয়সে । মৃত্যু এখানে মঙ্গলময়ের চরণে ঠাঁই দেয় আত্মাকে । তাই মণিকর্ণিকা মহাশ্মশান একটী পুণ্যতীর্থ । এখানে সতীর কুন্ডল এবং মহাদেবের মণি পড়েছিল দক্ষযজ্ঞের সময় । তাই মণিকর্ণিকা একটি একান্ন পিঠের অন্যতম পিঠস্থান ।  সতীর অপূর্ব মন্দিরটি এখন গঙ্গার জলে অনেকটাই নিমজ্জিত । কিন্তু উপরের অংশটী এখনো দৃশ্যমান । মণিকর্ণিকার ঘাট থেকে নৌকো চড়ে দীপবলীর ভূত চতুর্দশীর রাতে মাঝ গঙ্গায় গিয়ে গঙ্গারতি দেখলাম । নৌকোয় ভাসমান হয়ে লাইভ কীর্তন-ভজন কনসার্টের সাথে আরতি দেখিনি কখনো । নৌকো থেকে গঙ্গার জলে পদ্মপাতায় ফুলের ভেলায় দীপ জ্বেলে ফুল-আলোর ছোট্ট নৌকা ভাসিয়ে মা গঙ্গার পুজো দিলাম । সারে সারে অগণিত ভক্তের ভাসানো আলোর ভেলা নিয়ে তির তির করে প্রদীপ জ্বলতে জ্বলতে ধীরে ধীরে এগিয়ে চল
পুণ্যতোয়া গঙ্গার বুকে দক্ষিণ থেকে উত্তরে । 

৩০ অক্টো, ২০১২

ফেলে আসা ছেলেবেলার পুজোর সাক্ষী

কোলকাতায় আমার ছেলেবেলার পুজোর স্মৃতি  আনন্দবাজার ইন্টারনেট সংস্করণে কলeকাতা বিভাগে পুজো ২০১২ তে প্রকাশিত "আমার শহর" কলমে ।




আমার ছোটবেলা কেটেছে বরাহনগরের আলমবাজারে। পুজোর মাস দুয়েক আগে কোনও একটা সপ্তাহান্তে বাবা আমাদের কলকাতায় নিয়ে যেতেন পুজোর বাজার করতে। সে ছিল আমাদের সব চাইতে বড় উত্তেজনার দিন— সারাদিনের ‘প্রোগ্রাম’। সকালবেলা ভারী জলখাবার খেয়ে বেরোনো হত আর ফেরা হত সেই রাতে। বাড়ির সামনে থেকে সরকারি স্পেশাল বাস ‘এস ১৭’য় চেপে বসতাম আমরা চার জন। তার পর গিয়ে নামা হত লিন্ডসে স্ট্রিট। প্রথমেই ঠান্ডা পানীয়— ক্যাম্পাকোলা। তার পর সোজা হেঁটে বেন্টিঙ্কট স্ট্রিটে গিয়ে চিনে বাজারের জুতো কেনা হত। চিনেপাড়ার উস্তাদদের হাতে বানানো জুতোতে নাকি পা ভাল থাকে, তাই এত কষ্ট করা! সেই জুতোর বাক্স বয়ে যাওয়া হত নিউমার্কেটে। আমার ফ্রক কেনা হত স্টাইল টেক্স থেকে। মা প্রতিটি ফ্রকের ঝুল আর ডিজাইন খুঁটিয়ে দেখতেন যাতে পোশাকে শালীনতার মাত্রা বজায় থাকে। ভাইয়েরটা কেনা হত রহমান স্টোর্স থেকে। গঙ্গাদীন গুপ্তার অর্গ্যান্ডি আর কোটা শাড়ি, জয়সওয়াল স্টোর্স থেকে মায়ের তাঁতের শাড়ি, ঠাম্মার দুধ সাদা ফাইন থান, দিদিমার ইঞ্চিপাড়ের সাদা শাড়ি, মা দুর্গার লালপেড়ে শাড়ি, জ্যাঠামশাইদের জন্য ফাইন ধুতি— সব কিনে যাওয়া হত নাহুম’স-এ। নিউমার্কেটের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ নাহুম’স-এর চিজ প্যাটি আর ডি গামার কেক। কেক, প্যাটি খাওয়ার পর বাড়ির জন্যও কিছু নিয়ে নেওয়া হত। তার পর যাওয়া হত লিন্ডসে স্ট্রিটের হ্যান্ডলুম হাউসে। এখানে তখন তো আর আনাচে কানাচে এত বুটিক ছিল না! তাই এক্সক্লুসিভ পিওর সিল্ক শাড়ি কিনতে মা ওখানেই যেতেন। আর সেখানে এক ঢিলে দুই পাখি! পর্দার কাপড়, বেডশিট সব কিছুই মিলত ন্যায্য দামে। বাবার জন্য প্রায় জোর করে মহাদেবী এন্ড মেহতা থেকে শার্ট প্যান্টের পিস কিনতেন মা।

তখন শহর কলকাতায় হাতে গোনা খাবারের দোকান ছিল। কিন্তু এ পাড়ায় সঠিক দামের ছোট বড় রেস্তোরাঁ ছিল বেশ কিছু। ছোলা বাটুরে আর স্পেশাল কুলফি মালাই খেতাম ইন্দ্রমহলে। র‌্যালি’স-এর সিরাপ আর সিমাইয়ের পায়েস সহযোগে এমন সুন্দর কুলফি মালাই বোধহয় আর কোথাও তখন পাওয়া যেত না। এর পর সিম্ফনিতে আমাদের অভিযান। নতুন পুজোর গানের এলপি রেকর্ড। আর তখন এইচএমভি থেকে শিল্পীদের গানের রেকর্ড কিনলে একটা গানের লিরিকসের বই দিত। মায়ের নজর থাকত ওই বইয়ের দিকেই। তত ক্ষণে ফুটপাতের দোকান থেকে ভাই মায়ের আঁচলে গেরো দিয়ে একটা গাড়ি বা মোটরসাইকেল বা একটা ক্যাডবেরি বাগিয়ে বসে আছে। আমার একটা হেয়ারব্যান্ড, জামার সঙ্গে ম্যাচ করে দু’টো ক্লিপ আর রিবনও কেনা হয়ে গিয়েছে। বাবা রেগেমেগে বলছেন ‘‘এ বছরই শেষ। তোমাদের নিয়ে আর আসা যাবে না এখানে। এত বায়না!” কথাগুলো বাবা যে এমনিই বলতেন সেটা আমি বুঝতাম। কিন্তু ভাই বেচারা খুব ভয় পেয়ে যেত।

বিকেলের চায়ের জন্য ঢোকা হত অনাদি কেবিনে। সঙ্গে অবশ্যই অনাদির স্পেশাল মোগলাই পরোটা। এই একটা দিন বাবা বাইরের খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে আমাদের লাগাম ছেড়ে দিতেন। আর তখন কলকাতা এত পরিচ্ছন্ন ছিল যে বাইরের খাবার খেয়ে অসুস্থ হওয়ার ভয় কম ছিল। এখন বাইরে খেতে গেলেই ভাবি ভাল জায়গায় যেতে হবে, এসি থাকতে হবে, ভাজাভুজি মোটেই না— হেলথ রুল মেনে খেতে হবে। খোলা জিনিস খাওয়া চলবে না ইত্যাদি।

এক বার বাবা আমাদের চাইনিজ রেস্তোরাঁ কারকো-য় নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন কলকাতায় চিনে খাবারের চল সবে হচ্ছে। চাংওয়া, জিমিস কিচেন, পিপিং আর কারকো— এই ক’টি রেস্তোরাঁতেই সাবেকি চিনে খাবার মিলত। আর চাইনিজ খাবারে ইন্ডিয়ানত্বের ছোঁয়াও ছিল অল্প, তাই আমাদের বরং অসুবিধেই হত। কেবল গোল্ডেন ফ্রায়েড প্রন ছাড়া আর কোনও পদই ভাল লাগত না। বাবা বলতেন, চাইনিজ খাবারের অভ্যেস করতে— সহজ পাচ্য, তেল মশলাও কম। আর সস্ ভিত্তিক রান্না, তাই মুখ বদলানোর পক্ষে আদর্শ। কিন্তু আমরা তিন জন সে কথা মানতাম না। শুধুই গোল্ডেন ফ্রায়েড প্রনের দিকে হাত বাড়াতাম।

আমাদের স্কুল ছুটি পড়ে যেত পঞ্চমীর দিন। আর খুলত ভাইফোঁটার পর। পুজোর ক’দিন বইপত্র শিকেয় তোলা থাকত।

পুজোর প্রতি দিন সকালে বাবা নিয়ম করে চালাতেন গ্রামাফোন চেঞ্জার। আর একে একে সানাই, শরদ, সেতার, নতুন গানের এলপি রেকর্ড— কলের গান বাজত। বছরের এই সময়টা নিয়ম করে বাবা সেই শব্দ যন্ত্রটির পরিচর্যা করতেন পুজোর কয়েক দিন আগে থেকেই। আজও সেই পুরনো আধুনিক গানগুলো রেডিওতে শুনলে মনটা যেন কেঁদে ওঠে। শিউলির গন্ধ, পুজোর ঢাকের আওয়াজ, শিশির ভেজা শরত্কাল ছুট্টে এসে মনের দরজায় কড়া নাড়ে। এক বার কেনা হয়েছিল হেমন্ত, মান্না, আরতি, প্রতিমা, শ্যামল, সন্ধ্যা, অনুপ ঘোষালের সাতটা ছোট ৪৫ আরপিএম-এর রেকর্ড, এইচএমভি থেকে বেরিয়েছিল। আর সবচেয়ে মজা হল দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর সাতটা ছোট রেকর্ড এক সঙ্গে ওই চেঞ্জারে বসিয়ে সেট করে ঘুমিয়ে পড়লে নিজের থেকেই একটা একটা করে বাজতে থাকবে। খুব মজা হত— নতুন গান যা প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে বাজছে তা আবার আমাদের বাড়িতেও বাজছে। অনুপ ঘোষালের ‘বিয়ে করবই না’, আরতি মুখোপাধ্যায়ের ‘বন্য বন্য এ অরণ্য ভাল’, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘আমিও পথের মতো হারিয়ে যাব’, মান্না দের “ক’ ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ”, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘গহন রাতি ঘনায়’— এই গানগুলো আমাকে তখন ছুঁয়ে গিয়েছিল, তাই বোধ হয় আজও মনের কোটরে পড়ে রয়েছে। সে বার এই গানগুলোই কিন্তু বেরিয়েছিল পুজোর গান হিসেবে, সালটা বোধ হয় ১৯৭৩ কি ১৯৭৪ হবে, ঠিক মনে নেই। এখনকার ছোটরা দেখি পুজোর সময়েও কম্পিউটার গেম খেলছে নয়তো টিভি খুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কার্টুন দেখছে। তাদের ঠেলেঠুলে প্যান্ডেলে পাঠাতে হয় আরতি দেখতে আর অঞ্জলি দিয়ে প্রসাদ খেয়ে আসার জন্য।

সপ্তমীর দিন সকাল থেকেই সব প্যান্ডেলে পড়ে যেত নবপত্রিকার স্নান করানোর ধুম। আলমবাজার গঙ্গার ঘাট খুব কাছে বলে সকাল থেকেই শোনা যেত ঢাকের আওয়াজ। প্রত্যেক বার মা বলতেন নবপত্রিকার পুজো মানে আসলে মা দুর্গার পুজোই। অত বড় মৃন্ময়ী মূর্তি তো আর গঙ্গায় নিয়ে গিয়ে স্নান করানো যায় না, তাই নব পত্রিকা বা কলাবউকে নিয়ে যাওয়া হয়। আর ভাই কেবল বলত, ওটা তো গণেশের পাশে থাকে তাই গণেশের বৌ। মা দুর্গা কেমন করে গাছ হবে? মা তখন আবার ব্যাখ্যা করে দিতেন যে ন’রকমের উদ্ভিদ, যেমন, বেল, ডালিম, কচু, মান কচু, হরিদ্রা, অশোক, ধান, কদলী, আর জয়ন্তী গাছের চারাকে শ্বেত অপরাজিতা গাছ দিয়ে বেঁধে নবপত্রিকা বানানো হয়। শস্যপূর্ণ বসুন্ধরার প্রতীক রূপে চার দিন ধরে মা পূজিত হন।

সপ্তমীর দিন বিশেষ আমিষ পদ রান্না হত— মাছের মাথা দিয়ে ডাল, ফুলকপি দিয়ে ভেটকি মাছ, চিংড়ির মালাইকারি, আরও কত কি! সে দিন বিকেলে আড়িয়াদহে আর দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর দেখতে যেতাম রিকশা ভাড়া করে। বিরাট বিরাট পুজো হয় ওই দু’টি অঞ্চলে। মাঝে মাঝে ‘হল্ট’ দেওয়া হত মামারবাড়িতে আর জ্যাঠামশায়ের বাড়িতে। জল যোগ এবং বিয়োগ করে ঠাকুর দেখার পর্ব চলত।
অষ্টমীর দিন ভোর থেকেই চলত অঞ্জলির প্রস্তুতি। একে একে স্নান সেরে সবচেয়ে ভাল আর দামি জামাটি পরে অঞ্জলি দিতে যেতাম। বিয়ের আগে পর্যন্ত এ ভাবেই কাটত ষষ্ঠী, সপ্তমী আর অষ্টমী।

বিয়ের পর প্রথম বছর কেটেছিল দক্ষিণ কলকাতার পুজো দেখে। ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্যুরিজমের বাসে চেপে দেখতে গিয়েছিলাম কলকাতার বনেদি বাড়ির পুজো। আধুনিক থিমের দুর্গাপুজোর চেয়ে অনেক মন কাড়ে এই পুজোগুলি। সে বার সপ্তমীর দিন ধর্মতলা থেকে বাসে চড়ে দেখেছিলাম বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের পুজো, জানবাজারে রানি রাসমণির বাড়ির পুজো, শোভা বাজারের রাজবাড়ির পুজো, উত্তর কলকাতার বিখ্যাত লাটুবাবু-ছাতুবাবুদের পুজো। ডাকের সাজের প্রতিমা, চণ্ডীমণ্ডপে সুদৃশ্য চালচিত্রে বিশাল আয়োজন, বাড়ির মহিলাদের সাবেকি গয়না ও বেনারসি শাড়ি পরে মায়ের পুজো গোছানো— সব কিছুতেই ঐতিহ্যের ছাপ।
আর এক বার আমরা একটা গাড়ি নিয়ে বেলুড় মঠে কুমারী পুজো দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানেও খুব নিষ্ঠার সঙ্গে পুজো হয়। তবে আজকাল ধর্মের নামে যে হুজুগের স্রোতে আপামর বাঙালি মেতে উঠেছে তা বেলুড় মঠের ভিড় দেখলেও বোঝা যায়।

পুজো এখন ফ্যাশানেবল হয়ে উঠেছে। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে আলোর রোশনাইয়ের সঙ্গে অনুরণিত হয় এক দিকে মহিষাসুরমর্দিনীর স্তোত্র আর ডিজিট্যাল এলসিডি স্ক্রিনে রংচঙে বিজ্ঞাপন। আর সেই সঙ্গে থরে থরে সাজানো ফাস্টফুডের গরমাগরম হাতছানি। এক একটি বারোয়ারি পুজো এখন ‘স্পনসর্ড’ পুজো— কোনও এক কোম্পানির সম্পত্তি, কোনও একটি টেলিভিশন চ্যানেল তাদের কিনে নিয়েছে ওই পাঁচটি দিনের জন্য। প্রতিযোগিতার মাপকাঠিতে মা আসেন একটা প্যাকেজে! সেরা প্যান্ডেল, সেরা প্রতিমা, সেরা দর্শক শ্রীমতি, সেরা আরও কত কিছুর ভিড়ে কিন্তু আসল পুজো একটু একটু করে সরে যাচ্ছে। সরে যাচ্ছে পুজোর মূল, অনাদি আবেদন।


১৫ অক্টো, ২০১২

মহালয়ায় পিতৃপক্ষের অবসানে মাতৃপক্ষের সূচনা !!!

 রক্তবীজ বধে দেবী চন্ডমুন্ড বিনাশিনী রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি  !!!

আশ্বিনের পূর্ণিমার পর থেকে যে কৃষ্ণপক্ষ শুরু হয় তা হল পিতৃপক্ষ । সূর্য তখন কন্যারাশিতে অবস্থান করে । হিন্দুধর্মের বিশ্বাস অনুসারে   পিতৃলোক থেকে আমাদের পূর্বপুরুষের আত্মা তখন অবতরণ করেন স্বর্গ্য লোক থেকে মর্ত্যে ।   অর্থাত আমাদের আশেপাশে তাঁরা বিরাজ করেন । তাই আমরা এই সময় তাঁদের তুষ্ট করি তর্পণের মাধ্যমে ।  একপক্ষকাল অর্থাত গণেশ চতুর্থীর পর যে পূর্ণিমা তার পরদিন থেকে এই কৃষ্ণপক্ষ চলে মহালয়া অবধি । আর এই পক্ষকাল আমরা বাস করি আমাদের পরম আত্মীয় পূজনীয় বন্ধুদের  স্মৃতিতর্পণ করে ।   কিংবদন্তী অনুসারে রামচন্দ্র  রাবণ বধ করার জন্য দুর্গাপুজো করবেন স্থির করেন ।  কিন্তু তখন দেবলোক ঘুমন্ত ছিল ।  ঘুমন্ত দেবলোককে জাগ্রত  করার উদ্দেশ্যে অকালবোধন করেছিলেন । তাই সেই অর্থে এই সময়ে প্রতিবছর দুর্গাপুজোর ঠিক আগেই স্বর্গলোকে আমাদের পিতৃপুরুষদেরও জাগ্রত করি ।   হিন্দুধর্মের বিশ্বাস, মহালয়ার পরদিন মা দুর্গা স্বর্গলোক থেকে অবতরণ করেণ মর্ত্যলোকে এবং পিতৃপক্ষের অবসান হয়ে দেবীপক্ষের   শুভ সূচনা হয় তখনি । 
মহালয়ার  অমাবস্যা তিথিতে দেবদেবীরা জাগ্রত হ'ন  এবং মাদুর্গার মৃন্ময়ী মূর্তিতে ঐ দিন চক্ষুদান করা হয় ।   

২২ সেপ, ২০১২

জীবাশ্মে আর শ্বেতপাথরে




আমাদের টিকিট হাওড়া থেকে বিলাসপুর। জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসে । রাতের ট্রেন ছাড়ল ভোর সাড়ে চারটেয় । বিকেল চারটে নাগাদ বিলাসপুর পৌঁছলাম । ভাড়ার গাড়িতে উঠে এবার যাত্রা শুরু অমরকন্টকের উদ্দেশ্যে ।
দুপুর গড়িয়ে বিকেলেবেলায় আমরা তখন অমরকন্টক থেকে আরো পশ্চিমে চলেছি ন্যাশানাল হাইওয়ে ১১ ধরে জবলপুরের দিকে । ডিন্ডোরি আর শা'পুর পেরিয়ে একটি মোড় থেকে বাঁদিকে ১৪ কিমি এগিয়ে চেয়ে দেখি ঘুঘুয়া ন্যাশানাল পার্কের বিশাল গেট । ভারতবর্ষের একমাত্র ফসিল পার্ক এটি ।আমেরিকার এরিজোনার পেট্রিফায়েড ফরেস্ট ন্যাশানাল পার্কের পর পৃথিবীতে বোধহয় এটাই একমাত্র পেট্রিফায়েড ফরেস্ট যা কয়েক মিলিয়ন বছর আগে ফসিলাইজড হয়ে রকগার্ডেনে রূপান্তরিত হয়েছে । কার্বন ডেটিং পরীক্ষায় জানা যায় এই স্থানের বিশাল ট্রপিকাল চিরসবুজ বৃক্ষের জঙ্গল ছিল । যার বয়স ৬৫ মিলিয়ন । তাই এই ন্যাশানাল পার্কের প্রবেশ দ্বারে রয়েছে কংক্রীটের বিশাল ডাইনোসরাস । 
 

তক্ষুণি মনে হল রাজোসরাস নর্মোডেনসাসের কথা । ইন্ডিয়ান অরিজিনের এই ডাইনোসরের ফসিল তো নর্মদার তীরেই আবিষ্কৃত হয়েছিল । ভারতবর্ষ যুগে যুগে রাজারাজড়ার দেশ বলে এখানকার ডাইনোসরের নামকরণেও সেই রাজকীয়তার ছোঁয়া । কে জানে হয়ত এই ঘুঘুয়াতেই ঘুরে বেড়াতো নর্মোডেন্সাসের পরিবার ।
                                 সরকারী কেয়ারটেকার । আমাদের ঘুরে ঘুরে সবটা পরিদর্শন করিয়েছিলেন যিনি 
১৯৮৩ সালে মধ্যপ্রদেশ সরকার ঘুঘুয়াকে ন্যাশানাল পার্কের সম্মান প্রদান করে। ঘুঘুয়া এবং পার্শ্ববর্তী গ্রাম উমারিয়া নিয়ে এই ফসিল পার্কের সমগ্র ব্যাপ্তি ২৭ হেক্টর জুড়ে । এখনো অবধি ৩১ টি প্রজাতির উদ্ভিদ সনাক্ত করা গেছে । প্রধানতঃ পাম ও দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদ এরা । ইউক্যালিপ্টাস, খেঁজুর, কলা, রুদ্রাক্ষ, জাম, এই সব ট্রপিকাল সবুজ গাছকেই চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে । 
                                                          ইউক্যালিপ্টাস
সরকারী কেয়ারটেকার আমাদের নিয়ে ঘুরে ঘুরে সব দেখালেন । কিছু শামুক জাতীয় অর্থাত খোলসযুক্ত বা মোলাস্কা পর্বের প্রাণীর ফসিল দেখা গেল । এর থেকে বোঝা যায় যে স্থানটি আর্দ্র ছিল এবং পর্যাপ্ত বৃষ্টিও হত এখানে । তারই ফলস্বরূপ চির সবুজ বৃক্ষের সমারোহ ছিল । 

                                  অপর্যাপ্ত ফসিলাইজড চিরসবুজ বৃক্ষের জীবাশ্মের সাক্ষী হয়ে আমরা 

স্থানীয় মানুষ এই অঞ্চলকে বলে "পাত্থর কা পেড়" অর্থাত পাথরের গাছ । আমি বলব গাছ-পাথর । কথায় বলে বয়সের গাছ-পাথর নেই । তার মানে এতদিনে বুঝলাম । যে কত পুরোণো হলে গাছ পাথরে রূপান্তরিত হয় । 
                                                     গাছ-পাথর

অমরকন্টকে এসে পৌঁছলাম বেশ রাত্তিরে । এম পি ট্যুরিসমের লাক্সারি টেন্টে থাকবার ব্যবস্থা । রাতের খাবার খেয়ে এসে বরাদ্দ তাঁবুতে সেরাতের মত আমরা আশ্রয় নিলাম ।



পরদিন ভোরে উঠে এবার আমাদের যাওয়া লাইমস্টোনের দেশে । বিখ্যাত জবলপুর মার্বেল রকস্‌ দেখতে । প্রথমে ভেরাঘাট । জবলপুরের ২২ কিমি দূরে নর্মদা নদী একটি গর্জের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এখানে । দুধসাদা পাথরের ওপর দিয়ে ঝরণার মত আছড়ে পড়ছে নর্মদা এই গর্জটির দৈর্ঘ্য ৩ কিমি । নদীর কিনারা দিয়ে, বুকের ভাঁজে মিনারের মত সারে সারে উঠে এসেছে শ্বেতপাথরের স্তম্ভেরা । কি অপূর্ব সেই রূপ । আর নদীর উচ্ছলতায় পুরো পরিবেশটাই যেন ভিন্নস্বাদের অনুভূতি সৃষ্টি করে । ভেরাঘাট পৌঁছে কেবলকারের টিকিট কিনে রোপওয়েতে যাওয়া হল মাঝ নর্মদায় ধূঁয়াধার জলপ্রপাতের এক্কেবারে গায়ের কাছে । কেবলকারের ঘেরাটোপে ডিজিটাল ক্লিকে বন্দী হতে লাগল আমার নর্মদা । চারিদিকে যেন ফোটোশপড নীল আকাশ । আর ক্যালসিয়াম-ম্যাগনেসিয়াম কার্বনেটের গাঁটছড়া । কি অপূর্ব সেই রূপ ! আর নদীর উচ্ছলতায় পুরো পরিবেশটাই যেন ভিন্নস্বাদের । পুব থেকে পশ্চিমে বহতী নর্মদা । সাদা ফেনা হয়ে জল পড়ছে গর্জের মধ্যে আর পুরো জায়গাটি ধোঁয়াময় । 
 
এবার পঞ্চবটী ঘাটে এসে নৌকাবিহারে বান্দরকুঁদনী । দুপাশে মার্বল রক্‌স এর অলিগলি রাজপথের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত নর্মদা নদী । নৌকো চড়ে ঘন্টাখানেক যেন ভুলভুলাইয়ার মধ্যে ভাসমান হলাম । পাথরের কত রকমের রঙ । পরতে পরতে যেন সৃষ্টির প্রলেপ । নৌকার মাঝির স্বরচিত কবিতায় বলিউড থেকে টুজি স্ক্যাম সবই উঠে এল স্বতস্ফূর্ত ভাবে । দুপুর সূর্য্যি তখন মাথার ওপরে । আদুড় গায়ে ডাইভ মারছে স্থানীয় কিশোর নর্মদার বুকে ।

 বর্ষার পর যেন আরো ঝাঁ চকচকে পাথরের রং আর নর্মদাও যেন থৈ থৈ রূপ নিয়ে খুশিতে ডগমগ । লাইমস্টোনের স্তবকে স্তবকে গাম্ভীর্য আর নদীর হাসি মিলেমিশে একাকার । কে যানে পূর্ণিমার রাতে এখানকার নিসর্গ কেমন হয় ! কোজাগরীর রাতে আবার আসতে হবে এই বলে প্রণাম জানালাম মা নর্মদাকে । 


সকালবেলা, "ঘুরেআসি"  সংবাদপত্রে প্রকাশিত বৃহস্পতিবার,  ১৩ই সেপ্টেম্বর ২০১২ তে প্রকাশিত "সৃষ্টিপাথরের উপাখ্যান"   ঘুঘুয়া ফসিল ন্যাশানাল পার্ক এবং জব্বলপুর মার্বল রকস নিয়ে ভ্রমণ বৃত্তান্ত