-->
তার স্কুলের নাম বীরব্রত । বাড়ির আদুরে নাম বীরু । ক্লাসে বন্ধুরা সকলে ডাকে বীর বলে । অঙ্কের মাষ্টারমশাই ডাকেন বীরবল । খুব গর্ব বোধ করে তখন বীরু মনে মনে । আকবরের রাজসভার বীরবল চরিত্রটা হল বীরুর আইকন । বীরু নিজে যেমন বুদ্ধিদীপ্ত আর চালাক তেমনি আবার মজার মজার কথা বলে মানুষকে একদম সম্মোহিত করে ফেলে ।
তখন বীর বছর তিনেকের । সবে শ্লেটে চকের আঁচড় কাটছে । মা নিজের কাজ সারবে বলে সিমেন্টের মেঝেতে রঙীন চক দিয়ে বীরকে এবিসিডি লিখতে বলে রান্নাঘরে চলে গেছে । রান্নাঘর আর শোবার ঘরের মাঝে এক বিস্তর দালান । সিমেন্টের চকচকে মেঝে । বীর এ লিখে পাশে একটা ট্যারা বেঁকা আপেল, বি লিখে তার পাশে একটা মস্ত ব্যাট এঁকে, যেই সি লিখেছে মনে হল রোজ তো ম্যাওপুষি আঁকি । আজ ক্যাটার পিলার আঁকলে কেমন হয় ? যা কথা সেই কাজ । ক্যাটার পিলারের তিন খন্ড দেহ এঁকে দুটো জম্পেশ শুঁড় দিয়ে আর পেল্লায় দুটো চোখ মাথায় বসিয়েই মনে হল মা'কে ডাকে । মা কি আর রান্নাঘর থেকে ডাকলেই আসতে পারে ! " মাম্মাম্ দ্যাখো, দ্যাখো বলেও সাড়া না পেয়ে সোজা শোবার ঘর থেকে দালান হয়ে রান্নাঘর অবধি বীর তখন মন দিয়ে ক্যাটার পিলারটার দেহ একখন্ড করে বাড়িয়েই চলল নীচের দিকে । কাছাকাছি এসে সে পৌঁছে গেছে তার ক্যাটার পিলারকে নিয়ে । চীত্কার করে মাকে বলল " তুমি তো আর ক্যাটারপিলারকে দেখতে গেলে না , ও তোমার সঙ্গে দ্যাখা করতে চলে এসেছে" এই সেই একরত্তি বীরব্রত ।
স্কুলে ভর্তি হবার পর বাংলা ক্লাসে প্রথম ইউনিট টেষ্ট পিকচার কম্পোজিশানের । বিষয় বাড়ি । বীর মন দিয়ে বাড়ি এঁকেছে একটা । দেওয়ালে ইঁট । জানলায় গরাদ । আধা ভেজানো দরজা । মাথায় টালির চাল আর সেখান থেকে বেরিয়েছে স্মোকলেস উনুনের পাইপ । দশ লাইন লিখতে হবে বাড়ি নিয়ে । মোটে পাঁচ লাইন লিখে মন দিয়ে বাড়ি রঙ করছে বীর । একটা একটা করে লাল ইঁট, জানলা দরজা, গরাদ, সিঁড়ি সব রঙ করে ধোঁয়ার পাইপের মুখ দিয়ে কুচকুচে কালো ধোঁয়া এঁকে সেই ধোঁয়া বের করতে করতে ঘন্টা পড়ে গেল ! লেখা শেষ হল না । টিচার দশের মধ্যে তাকে পাঁচ দিয়েছেন দেখে বীর গিয়ে বলল " মিস, আমাকে পাঁচ দিলেন ? আমি এত কষ্ট করে বাড়িটা রঙ করলাম ! " মিস্ খুশি হয়ে আরো দুটো নম্বর বাড়িয়ে দিলেন । এই ছিল একফোঁটা ছেলের কান্ড !
যত বড় হতে লাগল বীরব্রত তত তার অঙ্কে মাথা খুলতে লাগল । মা-বাবা কখনো তাকে অঙ্ক পরীক্ষা নিয়ে মাতামাতি বা জোরাজুরি করেনি বলেই বোধহয় সে অঙ্ক করতে বড্ড ভালবাসত । বরং অঙ্ক পরীক্ষার আগের দিন মা'কে বলত মা, তুমি আমাকে একটু অঙ্ক প্র্যাকটিস করাবেনা ? বন্ধুদের মায়েরা কত কত বই ঘেঁটে অঙ্ক করায় ওদের। কি জানি হয়ত মা তার অঙ্ক পরীক্ষা নিয়ে বাড়াবাড়ি করেনি বলেই বোধহয় সে অত ভালো নম্বর পায় অঙ্কে । অঙ্ক পরীক্ষা মানেই অন্য বন্ধুদের যেন যত টেনশান । আর ক্লাসে সকলে তাকে বলে "উইজার্ড অফ ম্যাথস্" । তাকে যা অঙ্কই দেওয়া হোক যেমন করেই হোক সে করে দেয় ।
বীরব্রত এখন ক্লাস সেভেনে পড়ে । লেখাপড়ার পাশাপাশি গান শোনা আর বই অন্ত প্রাণ তার । বাংলাব্যান্ডের গান এফ এমের কৃপায় ঠোঁটস্থ । জন্মদিনে, পুজোয় কেউ তাকে কি উপহার নেবে জিগেস করলে বীর একবাক্যে বলে বই কিম্বা গানের সিডি । এবার ছোটমামা তাকে দিয়েছে বাংলাব্যান্ডের সিডি, মাসী দিয়েছে একটা সায়েন্স ফিকশান, আর একটা আকবর-বীরবলের গল্পের মজাদার বই । পুজোটা বেশ কেটে গেল হৈ হৈ করে গল্পের বই পড়ে, ঠাকুর দেখে গান শুনে আর মজা করে । পুজোর পর বাড়ি খালি । মন খারাপের পার্টির শুরু । তার ওপর স্কুল খুলেই ইউনিট টেষ্টগুলো সব হাত নেড়ে নেড়ে বলবে আজ বাংলা, কাল হিষ্ট্রি, পরশু ইভিএস । তবে পরীক্ষা দিতে, পড়াশুনো করতে বীরের খারাপ লাগেনা কিন্তু পুজোর ছুটি আর গরমের ছুটির পর স্কুল যেতে মোটেই ভাল্লাগেনা । তারপর স্ক্র্যাপবুক, ক্রাফট, নেচার ক্লাবের চার্ট তৈরী, স্কুলের অত্তবড় মাঠ থেকে রোজ প্লাসটিক তোলা, স্কুল ম্যাগাজিনের জন্য ছোটদের কাছ থেকে লেখা আদায় করা ... কত কাজ ! ভাগ্যিস তাকে রাহুল, সোহাগের মত টিউশানে যেতে হয়না । ক্রিকেট খেলতে হয়না । তাহলে তো আরো বাঁধাধরা জীবন হত তার । সে কথা ভেবে মনে মনে খুশী হয় বীরু । স্পোর্টস সে একটাই করে তা হল সাঁতার কাটা । নিয়ম করে ভোরবেলায় বাবার সাথে সাঁতার কাটতে যায় । পড়াশুনোয় বীরু এক্সেল নয় কিন্তু একেবারে খারাপও নয় ।
পুজোর ছুটির শেষদুপুরে ঘুম পেল বীরের । হাতে মাসীর দেওয়া আকবর-বীরবল আর কানে লাগানো আইপড । সিডি থেকে গান গুলো মামা সব আইপডে ট্রান্সফার করে দিয়ে গেছে । নাকের ওপর চশমা আর তার ওপর জোরসে আকবর-বীরবল-চিত্র-কথা আছাড় খেল । তো কি, তার দুচোখে নিদ্রাদেবী তখন ভর করেছেন । আর সে তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে সোজা এসে দাঁড়াল আকবরের রাজসভায় । এই সেই ইতিহাস.. এই সেই দিল্লির মুঘল সম্রাটের দেওয়ানি আম ? কি বিশাল রূপোর দরজা ! ঠাম্মা যেমন রাজার গল্প শোনাতেন! নবরত্ন খচিত লাল পলা, নীলা, সাদা মুক্তো, হীরে, পোখরাজ, পান্না, বৈদুর্যমণি.. আরো কত সব পাথর থেকে জ্যোতি ঠিকরে পড়ছে দেওয়ালে! কানে লাগানো আইপডে তখন বেজে চলেছে... আসছে সে এক রাজার রাজা ..ক্যাকটাসের "রাজার রাজা" এলবামের হিট গান । ছোট্ট ছেলে বীরু, পরণে তার সিক্স পকেটস, সাদা জিনসের প্যান্ট আর গায়ে কালো রঙের স্পাইডারম্যানের টিশার্ট । পায়ে একজোড়া ফ্লোটার্স । আকবার বাদশার জমজমাট রাজসভায় রবাহুত, অনাহুতের মত ঢুকে পড়েছে বীরু। নবরত্নের আসন আলোকিত করে রয়েছেন জ্ঞানী-গুণী ন'জন তারকা ।
আকবরই হবেন ইনি ! সিংহাসনে বসে আছেন সকলের থেকে দূরে, একা..কি চকমকে বেশভূষা, আর মণিমাণিক্য খচিত রাজ সিংহাসন তার ! কত গয়না পরেন না জানি রাজা মহারাজারা.. ভাবল। বীরুকে দেখেই সভার কার্যকলাপ স্থগিত হয়ে গেল।বীরুর আর কোনো সন্দেহ নেই ! ইনি মুঘলসম্রাট শাহেনশা আকবর বাদশা হতে বাধ্য । কি চকমকে পোশাক, কত সুন্দর পাগড়ী মাথায় ! কত গয়নাগাটি পরেছেন সম্রাট! রাজাদের বেশভূষা, চালচলন এমনই হয় সে জানে । স্থান-কাল-পাত্র ভেদে সব রাজারাই রাজার মত হ'ন ।
একবার মনে হল গিয়ে সেলাম করে আসে । একবার ভাবল নিজের পরিচয় দেয় । তারপরেই মনে হল নাম না জিগেস করলে বলবে কেন সে ? ইচ্ছে হল তাঁকে গিয়ে জিগেস করে, আচ্ছা এখানে বাবর, হুমায়ুনের ছবি কোথায় ? রাজসভা আলো করে অর্ধচন্দ্রাকৃতি ভাবে বসে আছেন সব মন্ত্রীর মত ব্যক্তিরা । বীরব্রতর মনে পড়ল বিক্রমাদিত্যের মত আকবরের রাজসভাতেও তো নবরত্ন ছিল । ভাবতে ভাবতে হঠাত দেখে, একজন তালপাতার পুঁথি থেকে আবৃত্তি করছে.. কি সব আওড়াচ্ছেন শ্লোকের মত ; ও তাহলে ইনি পন্ডিত আবুল ফজল যিনি লিখেছিলেন আকবরের জীবনী "আকবরনামা" । আর তাঁর পাশেই ফৈজী হবেন নিশ্চয়ই যিনি ছিলেন আবুল ফজলের ভাই । গণিতে পারদর্শী ছিলেন আর কবি ছিলেন । আকবরের রাজসভার সব চেয়ে বড় সাহিত্যিক, জ্ঞানী মানুষ ...ইতিহাসে পড়েছে বীর ।
ঐ দূরে কত কত বাদ্যযন্ত্র পরিবেষ্টিত হয়ে বসে আছেন যিনি উনি নিশ্চয়ই মিঞা তানসেন । আকবর যাঁর সঙ্গীতের কদর করেছিলেন । বীর মনে মনে বলল । অভাবনীয় ক্ল্যাসিকাল শিল্পী তানসেন, যিনি দীপক রাগ গেয়ে আগুণ জ্বালাতেন, মেঘমল্লার রাগ গেয়ে বৃষ্টি নামিয়েছিলেন ...বীর সব পড়েছে এসব । সঙ্গীতশিল্পী দেখলে বীরের কেবল অটোগ্রাফ নিতে মন চায় ! ইস্ একটা কাগজ পেন নেই তার সাথে ! আকবর বাদশার পাশে বসে আছেন ঐ মানুষটা কে হতে পারে, খুব মন দিয়ে সম্রাটের সাথে গুরুতর আলোচনায় ব্যস্ত উনি । কি সব হিসেব নিকেশের কাজকর্ম চলছে বলে মন হল তার । বোধহয় রাজা টোডরমল উনি । আকবরের খাস দেওয়ান ছিলেন । যত দেখছে বীরু ততই খুশি খুশি হয়ে উঠছে তার মনটা । জমজমাট একটা রাজপ্রাসাদের মন্ত্রীমহল । সেবার দিল্লী-আগ্রা বেড়াতে গিয়ে বিশাল বিশাল রাজপ্রাসাদ দেখে মনে হয়েছিল শূণ্যতা আর শূণ্যতা ! রাজা,মন্ত্রী আর তাদের পার্ষদ না থাকলে রাজবাড়ী কেমন যেন বিষণ্ণতায় ভরা থাকে । হঠাত রাজসভায় টুংটাং আওয়াজ হতে শুরু হল । মিঞা তানসেন মিহি করে গান ধরেছেন তখন । বীরু দেখল আরেকজন মানুষকে । খুব সাদামাটা পোষাকে খুব হাসিখুশি মুখে বসে বসে কি যেন বিড়বিড় করে চলেছেন তিনি আর পাশের মানুষগুলিও তার কথার অংশীদার হয়ে হেসে উঠছে জোরে জোরে । ইনি দরিদ্র ব্রাহ্মণপুত্র বীরবল হতে বাধ্য । যার নাম ছিল মহেশদাস । সম্রাট আকবর এনার নাম দিয়েছিলেন বীরবল । খুব পছন্দ করতেন আকবর এনাকে । এনার বুদ্ধিমত্তার প্রকৃত তারিফ করেছিলেন ইনি । বীরু সব জানে এসব । ঐ চরিত্রটি তার যে বড্ড পচ্ছন্দ । জাঁকালো সব জোকস জানে বীরু । আকবর-বীরবলের বইতে পড়েছে । সেই উটের দেহ কেন বাঁকাচোরা ? বাগানে ক'টা কাক দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ? এসব মনে পড়লে হেসে কুটিপাটি হয় আর মাম্মাম্, বাবাইয়ের সাথে শেয়ার করে । কিন্তু আকবরের নবরত্ন সভার আরো কয়েকজনের নাম আর মনে পড়ছেনা সেই মূহুর্তে তার । আরো কয়েকজন আছেন এই নাইন-জেমস ক্লাবে কি যেন নাম বাকীদের মনে মনে হিস্ট্রি বইয়ের পাতা থেকে বলতে লাগল..
হঠাত মনে হ'ল বাদশার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে । তাহলে তিনিই তো বলে দেবেন বাকী ক'জনের নাম । চিনিয়ে দেবেন তাদের একে একে ।
এক উর্দিপরা এক চাপরাশি এসে তাকে টেনিস বলের সাইজের লাড্ডু আর একবাটি ক্ষীর খেতে দিল ।
বীরু তো মিষ্টি খেতে ওস্তাদ অত বড় লাড্ডু হাতে নিয়ে মনে পড়ে গেল গুপিবাঘার সেই রাজার আদরের কথা । ঠিক অত্তবড় রসগোল্লা দেখেছিল সিনেমায় ।
মাথায় তখনো ঘুরছে তার আকবর-বীরবলের গল্প । লাড্ডু হাতে নিয়ে দৌড়ে চলে এল রাজার সামনে । সম্রাট আকবর বীরব্রতকে দেখে একগাল হেসে বললেন " তোমার নাম কি , তুমি কোথা থেকে এসেছ ইত্যাদি ইত্যাদি । বীরব্রত সব জবাব দিতে দিতে আকবরকে মন দিয়ে নিরীক্ষণ করতে লাগল ।
সম্রাট আকবর বীরব্রতর কানে দুটো সাদা সূতো ঝুলছে দেখে অবাক হয়ে জিগেস করলেন " আচ্ছা এটা কি বস্তু বালক? "
বীরব্রত বলল "এটা হল গান শোনার তার, "আইপড" আছে না ? তার থেকে বের হয়ে কানে লাগানো থাকে" এই বলে পকেট থেকে ছোট্ট গানযন্ত্রটি বের করে দেখাল আর রাজার কানে হেডফোন লাগিয়ে দিয়ে গান শোনাতে লাগল ।
রাজার খুব ভাল লাগল । বললেন "এটা আমাকে এনে দিতে পারবে"
বীরব্রত বললে "তুমি এটাই নাও না, তোমার জন্য আমি তো কিচ্ছু আনিনি হাতে করে, যতক্ষণ ব্যাটারী আছে তুমি গান শুনতে পারবে, কিন্তু চার্জ দেবে কোথায় ? তোমার এখানে তো ইলেকট্রিসিটি নেই" গল্পের বইতে পড়েছি, রাজাদের সাথে দেখা করতে গেলে ভেট দিতে হয় , না হয় এটাই দিলাম তোমাকে রাজা মশাই"
বীরব্রত বললে "আমাকে অটোগ্রাফ দেবে রাজামশাই?"
"সে আবার কি বস্তু?" আকবর বললেন
"অটোগ্রাফ হল নিজের হাতে লেখা সই বা ছাপ যাই বল" বীরব্রত বললে
আচ্ছা, আমরা যাকে স্বাক্ষর বলি, আকবর বললেন
"এই যা:,আমি কাগজ পেন আনিনি । আমাকে একটা কাগজে তোমার নাম সই করে দেবে রাজামশাই? আমার বন্ধুদের গিয়ে দেখাব" বীরব্রত বললে
আকবর বললেন " কাগজ কি বস্তু? আমি একটা তালপাতা দিচ্ছি , আমার সভার ন'জন রত্নকে নাম সই করে তোমাকে দিতে বলছি"
খুশি হয়ে বললেন "আমার রাজত্বকালে মুদ্রিত, আমার নাম লেখা এই স্বর্ণমুদ্রাটি তোমাকে উপহার দিলাম ” বীরব্রত সেটিকে সযত্নে পকেটের মধ্যে পুরে রাখল ।
মন্ত্রীমশাই রাজার কাছ থেকে একটা তালপাতা, একটা খাগের কলম ও কালির দোয়াত এনে একে একে ন'জন নবরত্নের কাছ থেকে সেই তালপাতায় সই করাল ও সব শেষে আকবরের কাছ থেকে তালপাতাটায় যেই মাত্র তাঁর সই নেবার জন্যে আসবে তখুনি তার ঘুম ভেঙে গেল
ঘুমটা ভেঙে যাওয়ায় খুব আপসেট। কেন এমন হয় ? কেন রাজার অটোগ্রাফ নেওয়া হল না ? দূর একটুও ভালো লাগছেনা এখন তার; কেবল মাথায় ঘুরছে আকবরের রাজসভা, নবরত্ন, ফতেপুর সিক্রির সেই দেওয়ানি আম দরবার । আবার স্কুল খুলে যাবে । দুপুরে আর ঘুমোতে পারবে না সে । উতসব শেষ, স্বপ্ন দেখাও শেষ ।
কিন্তু এবার উতসবের ছুটিতে ফতেপুর সিক্রির সেই দেওয়ানি আম দরবার বেড়ানো... বীরকে এক ভালোলাগায় পেয়ে বসল ।
মনে পড়ল পুজোর ছুটিতে বাংলা মিস একটা রচনা লিখে আনতে বলেছেন পুজোর ছুটির দুপুরবেলা নিয়ে । ঘুম ভাঙতেই মা বললেন "বীর, আয় পাস্তা বানিয়েছি, খেয়ে নে"
পাস্তা তার খুব প্রিয় । বীর বলল "দাঁড়াও মা, ভুলে যাব এক্ষুণি না লিখে ফেললে"
বাংলাখাতা আর পেন নিয়ে বসে পড়ল ছুটির দুপুরের রচনা লিখতে "আমার দুপুরবেলার ইচ্ছে স্বপ্নেরা"...
ডান হাতে কলম আর বাঁ হাতে পাস্তার চামচ। চলতে লাগল সব্যসাচীর দুহাত সমান তালে ।
মা দেখতে লাগল দুচোখ ভরে বীরপুরুষকে । কানে আইপডটা গেল কোথায় ? "নিশ্চয়ই, হারালি তো এই বারে ?" মা বলল
"কোথায় আবার যাবে, আছে তো পকেটের মধ্যেই । দিচ্ছি দাঁড়াও । একটু লিখতে দাও না মা তারপর দিচ্ছি" বলল সে
মা ব্যস্ত হয়ে বললেন "নির্ঘাত হারিয়েছিস ওটা, আমি জানতাম একদিন হারাবেই"
বীর পকেট হাতড়াল, পেলনা । "জানো মা আজ কি হয়েছিল?” বলল সে ।
মা বললেন "বুঝেছি আইপড হারানোর একটা গল্প ফাঁদছিস তো?"
বীর আবার পকেটের মধ্যে হাত দিয়ে খুঁজল তার গানযন্ত্রটিকে ।
পেল অন্য একটা জিনিষ । স্বয়ং মুঘল সম্রাটের দেওয়া উপহার । সেই আকবরী মোহরটিকে ।
পকেট হাতড়ে সোনার কয়েনটা মায়ের হাতে দিয়ে বললে "এটা নাও"
মা তো হতবাক ! আইপডের বদলে সোনার কয়েন ? "কোথায় পেলি ?"
"ঐ জন্যেই তো লিখছি তাড়াতাড়ি যাতে তুমি সব জানতে পারো । নয়তো সব ভুলে যাব যে"
মা উলটেপালটে দেখতে লাগল সোনার কয়েনে কি সব লেখা রয়েছে তাতে ।
অনাবিল আনন্দে বীর ততক্ষণে ডুবে গেছে তার বাংলা রচনার মধ্যে ।
আনন্দমেলা ৫ই নভেম্বর ২০১২ তে প্রকাশিত