মজিলপুরের পুতুল "গণেশ জননী" |
স্কন্দপুরাণে একটি গল্প আছে গণেশের জন্ম নিয়ে।
মা দুর্গা একদিন কৈলাসে বসে স্নানের পূর্বে তেল হলুদ মেখে গাত্রমার্জণা করছিলেন। মায়ের দুই সহচরী জয়া-বিজয়া কাঁচা হলুদ বেটে তার মধ্যে সরষের তেল দিয়ে মায়ের সর্বাঙ্গে মাখিয়ে দিতে ব্যস্ত। মা সেই আরাম পাবেন কি, মনে তাঁর খুব দুঃখ। মহাদেব কত নারীকে পুত্র দিয়ে তাদের আকাঙ্খা পূর্ণ করেন আর দুর্গাই স্বপুত্র থেকে বঞ্চিত। কার্তিককে পেয়েছেন যদিও কিন্তু সে তো তাঁর গর্ভের নয়। সে শিবের ঔরসজাত, গঙ্গার কানীনপুত্র আর ছয় কৃত্তিকার দ্বারা পালিত।
আমাদের নিজেদের বংশের কেউ তো রইলনা দেব। কে আমাদের পারলৌকিক ক্রিয়াদি সম্পন্ন করবে? অতএব একবার আমরা চেষ্টা করেই দেখি। আমার গর্ভে আপনার ঔরসে সন্তান আসুক একটা।
"অদৈব ময়ি সঙ্গম্য ঔরসং জনায়াত্মজম্"
বিবাগী শিব এমন কথা শুনে বিচলিত হয়ে বললেন, আমি তো গৃহস্থ নই, চালচুলো নেই আমার, তোমার সঙ্গে আমার বিয়েটাও তো দেবতাদের ইচ্ছায়। গৃহস্থ মানুষেরা বংশোলোপ পাবার ভয়ে পুত্র কামনা করে, আমি তো অমর। এই তো বেশ আছি আমরা বন্ধুর মতন। পার্বতীর মাতৃহৃদয় শান্ত হলনা।
গাত্রমার্জণা শেষের দিকে। মা জয়া-বিজয়াকে বললেন, তোরা যা দেখি একটু ওদিকে, বাবার সঙ্গে আমাকে একটু একা থাকতে দে। মা নিজের তেলহলুদ মাখা গায়ের ময়লাগুলি তুলতে তুলতে মহাদেবকে বলেই ফেললেন
" আজ আমার একটা ছেলে থাকলে..."
মহাদেব বললেন,
" তুমি ত্রিলোকের যত পুত্রসন্তান আছে তাদের সকলেরি মা"
মা বললেন,"তবুও, একটুতো দুঃখ হয়, বুঝলেনা"
মহাদেব বললেন" কত ঝামেলা করে চন্দ্রলোক থেকে কৃত্তিকাদের অমতেও কার্তিককে এনে দিলাম তাও তোমার দুঃখ ঘুচলোনা?"
মা বললেন " ঠিক আছে আর বলবনা" বলতে বলতে নিজের গায়ের ময়লাগুলি তুলে তুলে মাটিতে ফেলছিলেন মনের দুঃখে। হঠাত তাঁর কি মনে হল, সেই ময়লাগুলি দিয়ে একটি পুতুল গড়ে ফেললেন মাদুর্গা। নারায়ণ সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি ঐ পুতুলের মধ্যে সূক্ষ্ম শরীরে প্রবেশ করা মাত্রই পুতুলটি প্রাণ পেল আর মাদুর্গাকে "মা, মা" বলে ডেকে উঠল। মায়ের বুকের ওপরে উঠে তাঁর দুধ খেতে শুরু করে দিল। দুর্গা আনন্দে আত্মহারা হয়ে সেই ছেলেকে কোলে নিলেন। মহাদেব আবার কার্তিককে এনে তাঁর আরেক কোলে দিলেন। । এবার কৈলাসে মহাভোজ। দুর্গার সুখ আর দ্যাখে কে! দুই পুত্র, দুই কন্যা নিয়ে সুখের সংসার শিব-দুর্গার। কৈলাসের সেই মহাভোজে সব দেবতারা নিমন্ত্রিত হলেন। সকলেই নির্ধারিত দিনে এলেন কেবল শনি মহারাজ ছাড়া। শিব ক্ষুণ্ণ হলেন শনি না আসায়। শনি সম্পর্কে দুর্গার ভাই। একবার দুর্গা শনিকে বর দিয়েছিলেন, সে যার দিকে চাইবে সঙ্গে সঙ্গে তার মাথাটা খসে পড়বে। মহাদেবের অসন্তোষের কারণে সেদিন শনি অবশেষে দুচোখ হাত দিয়ে ঢেকে প্রবেশ করলেন। এদিকে মহাদেব তো আর সেকথা জানেননা। তাঁদের ছেলেকে দেখছেন না শনি, সেও তো এক অপমানের বিষয়। শনি বাধ্য হয়ে চোখ খুলে সেই ছেলের দিকে চাইতেই ছেলের মুন্ডুটি খসে পড়ে গেল মাটিতে। মাদুর্গা কাঁদতে লাগলেন।
দুর্গা নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকল দেবতারা বিচলিত হয়ে পড়লেন। মহাদেব বললেন, ভয়ানক গ্রহদোষে দুষ্ট তোমার ছেলে পার্বতী। দৈববাণী হল, "শিশুটি মায়ের কোলে উত্তরমুখী শুয়ে আছে অতএব উত্তরদিকে শয়নরত কোনো পশুর মাথা এনে জুড়ে দেওয়া হোক শিশুর ধড়ে, তাহলে বেঁচে যাবে শিশুটি। " মহাদেব নন্দীকে বললেন ত্রিভুবন ঘুরে উত্তরদিকে শয়নরত যে কোনো পশুর মুন্ডটা কেটে আনতে। নন্দী বেরিয়ে পড়ল। স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল ঘুরে নন্দী স্বর্গের রাজধানী অমরাবতীতে গিয়ে উত্তরদিকে শয়নরত ইন্দ্রের হাতি ঐরাবতের মাথাটিই কেটে নিয়ে এল । সেই হাতীর মাথাটা মহাদেব তখুনি মাথাটা ছেলের কাঁধে জোড়া দিলেন ছেলে আবার মা, মা করে ডাকতে শুরু করে দিল।যদিও ছেলেটি একটু বেঁটেখাটো ও মোটা তবুও ঐ গজমুখে তাকে দিব্যি মানিয়ে গেল।
"খর্বস্থূলতরদেবো গজেন্দ্রবদনাম্বুজঃ"
মা দুর্গার একাধারে মা ডাক শুনে আনন্দ হল আবার অন্যথায় ছেলের হাতীর মাথা দেখে দুঃখে প্রাণ কেঁদে উঠল। তাঁর দুঃখ দেখে দেবতারা বললেন, মা তুমি দুঃখ কোরোনা, তোমার এই ছেলের নাম দিলাম গণপতি। সকল দেবতার পুজোর আগে এঁর পুজো হবে সর্বাগ্রে। মা দুর্গা ছেলের এই সম্মানে গর্বিত হলেন।
ব্রহ্মা বিশাল এ ছেলের হাতির মাথা বলে নাম দিলেন গজানন আর বীজমন্ত্রে তার নাম দিলেন হেরম্ব।ভুঁড়ির জন্য লম্বোদর আর একটি দাঁতা ভাঙা (নন্দী মাথা আনতে গিয়ে একটি দাঁত ভেঙে ফেলেছিল) বলে নাম দিলেন একদন্ত।
অচিরেই সেই গণেশ সরস্বতীর হাত থেকে পেল তার প্রথম উপহারস্বরূপ একটি লেখনী। ব্রহ্মা দিলেন জপমালা। ইন্দ্র দিলেন গজদন্ত। লক্ষ্মী দিলেন সম্পদের প্রতীকি স্বরূপ একটি পদ্মফুল। শিব দিলেন ব্যাঘ্রচর্ম। বৃহস্পতি দিলেন যজ্ঞোপবীত। আর পৃথিবী দিলেন একটি মূষিক। মা ছেলের হাতে দিলেন প্রচুর মিষ্টি।
পৃথিবী প্রদত্ত ঐ মূষিকটিই কিন্তু ঐ মিষ্টান্নের ভাগ প্রথম পেয়েছিল।
দক্ষিণে আবার গণেশের জন্মের অন্য কাহিনী আছে। একবার শিব-পার্বতী হিমালয়ের পাদদেশে ভ্রমণ করতে করতে দুটি রমণে রত হস্তী-হস্তিনীকে দেখতে পেলেন। এই মিলন দৃশ্যে তাঁরাও যারপরনেই উত্তেজিত হলেন এবং ইচ্ছাপূরণ করলেন। এবং এর ফলে যে শিশুটি জন্ম নিল তার মাথাটি হাতির এবং ধড়টি মানুষের।
মা-বাপ অর্থাত দুর্গা-শিবের বুড়ো বয়সের "মেঘ না চাইতেই জল" এর মত এই গণেশ পুত্রটি। বাবা যদিও একটু উদাসীন এহেন পুত্রের ব্যাপারে। মায়ের আদিখ্যেতা যেন ধরেনা এই পেটমোটা, বেঁটেখাটো হাতিমুখো ছেলেটির জন্য। এদ্দিন বাদে একটা ছেলে এসে তার অপূর্ণ মাতৃত্বের হাহাকারকে কিছুটা হলেও ভরিয়ে তুলেছে। মাদুর্গার এই "গোবর গণেশ" ছেলেটিকে নিয়ে বড়োই গর্ব। দেবতারা সকলে মিলে একে সব দেবতাদের মাথায় রেখেছেন বলে কথা। তাই এক কথায় গণেশ হলেন প্যাম্পার্ড ব্র্যাট বলতে যা বোঝায় তাই। মায়ের গায়ের সঙ্গে লেপটে থাকে সে। মায়ের আঁচলধরা এই ছেলেকে মা কথায় কথায় একদিন বলেই ফেললেন "এবার একটা বিয়ে দিতে হবে তোর"
গণেশ বলল, তোমার মত মেয়ে চাই কিন্তু মা। মাদুর্গা তো হেসেই খুন! তিনি বললেন, তা আবার হয় না কি বাবা!
শিব মা-ছেলের বন্ধুত্ব দেখে একটু একটু ঈর্ষাও করেন মনে মনে। কারণ তাঁর বুঝি স্ত্রীর আদরে একটু হলেও ভাটা পড়ে। স্ত্রী বুঝি ছেলেকে নিয়ে বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
কেউ কেউ আবার কানাঘুষো বলতেও থাকেন
মা-ছেলের এই সম্পর্কটা ঠিক ভালো নয়, নিশ্চয়ই ওরা "খারাপ" ।
দুর্গা সেই শুনে মনে মনে হাসেন।
ফ্রয়েড বলেন "ইডিপাস" বিপরীত লিঙ্গের ওপর স্বাভাবিকভাবেই আকৃষ্ট হওয়াটা দোষের কিছুই নয়। বাংলার ছেলের মায়েরা জানে এ জিনিষের আসল তত্ত্ব। তাই বহুদিন বাদে ছেলে ঘরে এলে মা বলে ওঠেন "আমার গণেশ এল" !
এই ছেলে বেশ এঁচোড়ে পাকা, ডেঁপো বলতে যা বোঝায়। আর হবেনাই বা কেন? জন্মের পরেই মা-বাপের সামনেই সব দেবতারা তাকে গণাধিপত্য দিয়েছে। সে তাই মাথার ওপরেই চড়ে বসে সকলের। এহেন পরিস্থিতিতে একদিন পরশুরাম তাঁর প্রভু শিবের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। শিব-দুর্গা তখন ঘরের মধ্যে মৈথুনে রত। গণেশ পরশুরামের পথ আটকে দেয়। বলে " এখন বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করা যাবেনা" পরশুরাম রেগে আগুণ হয়ে নিজের হাতের কুঠারটি ছুঁড়েই মেরে দেয় গণেশের দিকে। গণেশ জানে ঐ কুঠারটি শিবপ্রদত্ত। একবার পরশুরাম কঠোর তপস্যায় শিবকে তুষ্ট করে শিবের কাছ থেকে লাভ করেছিলেন। গণেশের কাছে সেই কুঠারটি তাই বেশ গুরুত্ব বহন করছে। কুঠারটি সজোরে এসে লাগে গণেশের বাঁদিকের গজদন্তে। দাঁতটি ভেঙে যায় । তাই বুঝি সে হয় একদন্ত।
গবেষকরা বলেন, শূকর বা হস্তীর দাঁত ভেঙে দেওয়ার অর্থ হল তার পৌরুষ ভেঙে দেওয়া আর সে যাতে পুরুষত্ব হারায় তার ব্যবস্থা করা। মাদুর্গার প্রতি শিবের ঈর্ষার থেকেই নাকি জন্ম নিয়েছিল এরূপ আক্রোশ। তাই নিজ শিষ্য পরশুরামকে দিয়ে অমন কাজ করিয়েছিলেন শিব। কি জানি বাপু! গণপতির পৌরুষ তো আজন্ম অক্ষত থাকতেই দেখেছি। যিনি নিজেই লিঙ্গেশ্বর তিনিই আবার নিজপুত্রের ক্যাস্ট্রেশানের ব্যবস্থা করলেন এভাবে? একটি দাঁত তো ভেঙে দিলেন পরশুরাম আর অন্যটি যে আমাদের সর্ব শক্তি দিয়ে সর্বদা রক্ষা করে চলেছে, সিদ্ধি-বুদ্ধি সব যুগিয়ে চলেছেন তার কি ব্যাখ্যা দেবেন গবেষকরা? বরং বলা যেতে পারে ইন্দ্রিয় সংযম করে আজীবন ব্রহ্মচর্য পালনের ব্রত পালনে মন দিলেন তিনি। কিন্তু তাও তো নয়। বিশ্বকর্মার দুই শুভকারিণী শক্তি কন্যা বুদ্ধি আর সিদ্ধির সঙ্গে তাঁর বিয়েও হয়েছিল আর দুটি সন্তানও জন্ম নিয়েছিল। সিদ্ধির গর্ভে গণেশের পুত্র লক্ষ্য আর বুদ্ধির গর্ভে লাভ এর জন্ম হয়।
গণেশের এই রূপকধর্মী বংশপরম্পরা থেকে বোঝা যায় ব্যবসায়ীদের দোকানে "শুভলাভ" লেখা থাকার কারণটি।
তিনি হলেন গিয়ে "গণানাং পতি", গণশক্তির প্রতীক, গণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ (গণ+ঈশ) । বিনায়ক (বি+নী+অক) তাঁর অপর নাম। আর প্রমথগণ হলেন শিবের অনুচর এবং সঙ্গী। তাঁরা নাচগানে পারদর্শী । সন্ধ্যার অন্ধকার প্রমথগণের আশ্রয়। বিনায়ক হলেন সেই প্রমথগণের পতি। সন্ধ্যার অধিপতি দেবতা বলে সন্ধ্যারূপিণী লক্ষ্মীদেবীর পাশে গনেশের অবস্থান। ভূতপ্রেতদের দৌরাত্ম্যি ও সকলপ্রকার বাধাবিঘ্ন নাশ করার জন্য প্রমথগণ গণপতিকে সন্তুষ্ট রাখতেন তাই গণপতির অপর নাম বিঘ্নেশ। তাঁকে পুজো করলে সিদ্ধিলাভ হয় তাই তিনি সিদ্ধিদাতা গণেশ। গ্রীসে ও রোমে গণেশ "জুনো(Juno)" নামে পুজো পান। হিন্দুধর্ম ছাড়া বৌদ্ধধর্মেও গণপতিকে "ওঁ রাগ সিদ্ধি সিদ্ধি সর্বার্থং মে প্রসাদয় প্রসাদয় হুঁ জ জ স্বাহা" মন্ত্রে পুজো করা হয়। কিন্তু তফাত হল হিন্দুদের গণপতি সিদ্ধিদাতা আর বৌদ্ধদের সিদ্ধিনাশক যা সম্পূর্ণ বিপরীত। হিন্দুদের দেবী অপরাজিতা মা দুর্গার ডানদিকে থাকেন গণপতি। কিন্তু মহাযানী বৌদ্ধদের অপরাজিতা দেবীর সাধনায় লক্ষ্য করা যায় গণপতি চিরবিঘ্ন প্রদায়ক। সেখানে দেবীর বাঁ পা গণেশের উরুতে আর ডান পা ইন্দ্রের ওপরে ন্যস্ত। বিনায়ক দেবীর পদভারে আক্রান্ত। আবার পুরাণের মতে গণেশ কেবলমাত্র শিব-দুর্গার পুত্ররূপে পরিচিত। বহুযুগ আগে সমাজে দুধরণের সম্প্রদায় ছিল যাঁরা দুটি ভিন্ন মতবাদে গণেশের পূজা করত। একদল নাগ-উপাসক ছিল তাই গণেশের গলায় যে যজ্ঞ-উপবীত বা পৈতেটি রয়েছে সেটি নাগোপবীত তথা নাগের অলঙ্কারের পরিচায়ক। আর অন্য সম্প্রদায় আবার স্কন্দ বা কার্তিকের পূজারী। তারা নাগ-উপাসনার বিরোধী হয়ে কার্তিকের বাহন ময়ূরকেই বেশী প্রাধান্য দিত । ময়ূর হল নাগেদের শত্রু।
বর্তমান দুর্গাপুজোতে আমরা মা দুর্গার দুই পাশে কার্তিক ও গণেশ উভয়েরি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান লক্ষ্য করি। অর্থাত নাগ-উপবীতধারী গণেশও রইলেন আবার ময়ূরবাহন কার্তিকও রইলেন। আর সেই রূপটিই সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে আজো সমাদৃত।
এবার গণেশ, গণাধিপতি, গণপতি সব নামগুলিতে "গণ" শব্দটি কেন? গণ'র আভিধানিক অর্থ হল অনেকের সমাহার। বেদের মধ্যে যে সব দেবতাদের নাম পাওয়া যায় অর্থাত রুদ্রগণ, বসুগণ, আদিত্যগণ, সকলের মাথার ওপরে দেবাশীর্বাদ প্রাপ্ত এই গণেশের ওপরে যে গণাধিপত্য বর্তালো তার জেরেই তিনি হলেন সকল দেবতাগণের পতি বা শ্রেষ্ঠ।
"ভবতোপি গণা যে তু তেষামপ্যাধিকো ভবেত্"
বিশালাকার গণপতির বাহন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মুষিক । আর তার অনুপাতে অতি ক্ষুদ্র ইঁদুর জীবের ছোট ছোট কর্মফলের কর্তনকারী । অর্থাত অতি বৃহত শুভ কর্মের দ্বারা কৃত সুফল বিনষ্ট হয়ে যায় ছোট্ট কোনো মন্দ কর্মের দ্বারা । তাই ষড়রিপু বা কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ ইত্যাদির মত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কর্মফল বিনাশ করে ইঁদুর যাতে কিনা বৃহত সিদ্ধিলাভে বাধা না ঘটে ।
আমরা ছোট থেকে গণেশের পাশে যে কলাবৌটি দেখে অভ্যস্ত সেটিকে মনেমনে গণেশের বৌ বলেই জানি। আচ্ছা এই কি সেই বৃক্ষবধূ? যে কিনা আমাদের কৃষিপ্রধান দেশের বর্ষবরেণ্যা এক দেবী যার নাম নবপত্রিকা। তাঁকেই তো জানি মাদুর্গা রূপে পাঁচদিন অর্চনা করা হয়। তাহলে গণেশের পাশে কেন তিনি? আবারো উঠে আসে মা-ছেলের সেই প্রগাঢ় সম্পর্কের কথা। এখানেও মায়ের আঁচলধরা সেই ছেলেটি। আসলে আমাদের ঘরের মেয়ে দুর্গার এই সপরিবারে আসাটা আমাদের মেনে নেওয়াটাই কাল হয়েছে। এক চালচিত্রের লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশ নিয়ে মা দুর্গা...এরা কেউ মায়ের পেটের সন্তানতো নন। সেটাই ভুলে যাই আমরা। বিভিন্ন শক্তির প্রতিমূর্তি এঁরা। এই যে কলাবৌ বা উদ্ভিদবধূটি, এতো শস্যশালিনী পৃথিবী-মাতৃকার প্রতীক। অতএব আদি অনন্তকাল থেকে আমাদের ঐ "মা"য়ের ওপরে অবসেশানটা থেকেই যায়।
সত্যি কি বৃহদাকার গণপতির বাহন ঐ মূষিক? তাহলে ঐ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মুষিকের ওপরে চড়ে বসলে তো সে মরেই যাবে। তাহলে বাহন কেন বলি আমরা? জন্মের পরেই গনেশ সব দেবতাদের কাছ থেকে একগুচ্ছ দৈবী উপহার পেয়েছিলেন আগেই বলেছি। তার মধ্যে পৃথিবীমায়ের দেওয়া এই ইঁদুরটি কেন? হস্তীমুখ গজাননের প্রচন্ড ক্ষুধা আর ইঁদুরের শস্যদানা ভক্ষণের প্রবল ইচ্ছা দুয়ে মিলেমিশে এক সেইখানে।