১৫ মে, ২০২২

বাংলার লৌকিক দেবদেবী / গন্ধেশ্বরী

কলকাতায় গন্ধেশ্বরী পুজো / সূত্র ইন্টারনেট 

 বুদ্ধ পূর্ণিমা আসে যায়। কিন্তু এই দিনে গন্ধেশ্বরীর পুজো হয় তা জানতাম না। বাঁকুড়ায় 
গন্ধেশ্বরী নদী আছে জানতাম। সেখানে গন্ধবণিক সম্প্রদায়ের খুব রমরমা। তাঁরা গন্ধদ্রব্যের ব্যাবসা করেন। কিন্তু বাকীটুকু মানে পুরাণকথা অজানা ছিল। ব্রতপিডিয়া-২ তে বাংলার লৌকিক দেব দেবী নিয়ে লিখতে গিয়ে জানলাম এতসব। 

গন্ধবণিক সম্প্রদায় গন্ধেশ্বরী পুজোর দিন তাঁদের হিসেব খাতা এবং ওজন পরিমাপের যন্ত্র দেবীর সামনে সাজিয়ে রাখেন।সারা বছরের বিভিন্ন সুগন্ধি প্রসাধনী, ধূপ, দেশবিদেশের মশলাপাতির কারবারে যাতে সমৃদ্ধি হয় । ধনপতি, শ্রীমন্ত, চাঁদসওদাগরের সময় থেকেই বাংলায় বাণিজ্যে খ্যাতি অর্জন করেছে এই গন্ধবণিক সম্প্রদায়। বৌদ্ধ ধার্মালম্বীরাও এই পুজো পালন করে থাকেন। বাংলাদেশের পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে, অন্যান্য হিন্দু দেবদেবীর সঙ্গে গন্ধেশ্বরীরও একটি মূর্তি আছে। 


বেদব্যাস রচিত, মহানন্দীশ্বর পুরাণে গন্ধেশ্বরীর একটি আখ্যান আছে। 

গন্ধাসুর নামে এক দানব সমগ্র বণিককুলের ওপর যাকে বলে ক্ষেপে ব্যোম একেবারে। তার এমন বেনে-বিদ্বেষী হয়ে ওঠার মূলে তার বাবা সুভুতি। তাই সে প্রতিজ্ঞা করেছিল বেনে সম্প্রদায়ের শেষ রাখবেনা। প্রবল তপস্যায় শিবকে সন্তুষ্ট করে বর পেয়ে যারপরনাই বলবান হয়ে উঠল সে।

সুভুতি মোটেও সুবিধের ছিলনা। নিজের বউ থাকতেও সে বেনেবাড়ির মেয়ে সুরূপাকে হরণ করতে গেল কিন্তু ধরা পড়ে গিয়ে মারধর খেয়ে চূড়ান্ত বিড়ম্বনার স্বীকার হল। বাবার এই অপমানের প্রতিশোধ নিতেই গন্ধাসুর উগ্রচণ্ডা।  

একদিন গন্ধাসুরের নির্দেশে তার সঙ্গোপাঙ্গরা সুবর্ণবট নামে এক গোবেচারা বেনেবাড়িতে হানা দিয়ে সুবর্ণকে তো হত্যা করলই, সেইসঙ্গে তার বউ চন্দ্রাবতীকেও হত্যার জন্য উদ্যত হল। তখন চন্দ্রাবতী পূর্ণগর্ভা। বেনেবংশ ধ্বংস হবে সেই আশায়। 

বাড়িতে অসুরদের হানায় চন্দ্রাবতী তার গর্ভস্থ সন্তানটিকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হল। সে খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে ছুটতে ছুটতে এক গহীন অরণ্যে গিয়ে প্রবেশ করল। ছুটছিল সেই আসন্নপ্রসবা গর্ভের সন্তান নিয়ে। 

অতঃপর তলপেটের অসহ্য যন্ত্রণায় কাতর হয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বুনো ঘাসের ওপর শয্যা নিল। কিছুক্ষণ পর সেই অসহ্য যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে তার একটি ফুটফুটে কন্যা জন্মাল। কিন্তু প্রসবের পরিশ্রমে চন্দ্রাবতীর মৃত্যু হল। 


ঋষি কশ্যপের তপোবন ছিল অনতিদূরেই।   

ধ্যানযোগে দেবী মহামায়ার আদেশ পেয়েছেন কশ্যপ। জানলেন, দেবী বসুন্ধরা সেই অরণ্যে ভূমিষ্ঠ হয়েছে। জন্মলগ্নেই মাতৃহীনা পিতৃহীনা এই অভাগিনীকে আশ্রমে এনে কশ্যপ যেন নিজকন্যার মতো লালনপালন করেন, তেমনি আদেশ দেবীর। তপোবন ছেড়ে ঋষি জঙ্গলের মধ্যে গেলেন সেই সদ্যোজাতা কে আশ্রমে এনে প্রতিপালন করবেন বলে। 

তপোবন থেকে বেরোতেই আচমকা এক দিব্য সুগন্ধ ঋষিকে চরম আকৃষ্ট করল। সেই সুগন্ধ যেন সমগ্র অরণ্যকে আমোদিত করে রেখেছে। ঋষিকেও টেনে নিয়ে গেল সেই উৎসের দিকে। 


নাড়ী বন্ধন ছিন্ন অপূর্ব, নিষ্পাপ কন্যা তখন মৃত মায়ের পাশে খেলা করছে। মুগ্ধ কশ্যপ তাকে আদরে কোলে তুলে নিতেই কন্যার শরীর থেকেই যে সেই সুগন্ধ আসছিল, বুঝলেন!


আশ্রমিকরা চন্দ্রাবতীর সৎকার করল। কন্যাটি আশ্রমজীবন শুরু হল। সুগন্ধার দেহটি মন মাতানো গন্ধের আকর । তাই ঋষি তার নাম দিলেন গন্ধবতী। 

ঋষির বাৎসল্য ও শিক্ষাদীক্ষায় গন্ধবতী ধীরে ধীরে একদিন শৈশব পেরিয়ে যৌবনে পা দিল। রূপেগুণে, লাবণ্যে দশদিক আলো করল।

ঋষি তাকে জানালেন তার জন্মদাতা পিতা-মাতার মৃত্যুর নৃশংস কারণ। অসুরদের সেই নৃশংসতা জেনে গন্ধবতীর বুকেও ভয়ানক প্রতিশোধস্পৃহা জন্মালো। তপোবনের মধ্যে যজ্ঞাগ্নি জ্বেলে সে এক কঠোর তপস্যায় রত  হল।

ওদিকে গন্ধাসুরের অত্যাচারে বেনে সম্প্রদায় অতিষ্ঠ হয়ে প্রায় শেষ হতে বসেছে। তাদের ত্রাহি আর্তরবে দেবতাদের দোরে হত্যে দিয়ে নিত্যই চলছে উদ্ধারের উপায়। ঠিক তখনই গন্ধাসুরের কানে গেল অসামান্যা গন্ধবতীর অঙ্গসৌরভ ও অপরূপ সৌন্দর্যের কথা। 


সে তখন আকুল হয়ে গন্ধবতী কে খুঁজতে খুঁজতে ঋষি কশ্যপের আশ্রমে এসে দাঁড়ালো। 

ধ্যানমগ্ন গন্ধবতীকে নিজের চোখে দেখেই সে বাকরহিত। কিন্তু গন্ধবতীর ধ্যান ভাঙল না। 


অধৈর্য গন্ধাসুর বারবার ব্যর্থ হতেহতে তার ক্ষমতাপ্রদর্শনে ব্যস্ত হল। টেনে হিঁচড়ে তাকে নিয়ে যাবার জন্য তেড়ে গিয়ে গন্ধবতীর চুলের মুঠি ধরল বটে কিন্তু গন্ধবতীকে একচুল নড়াতে পারল না। গন্ধবতী তখনও অটল ধ্যানে। ধূমায়িত হয়ে উঠল তার যজ্ঞকুণ্ড। কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেল সমস্ত চরাচর।তা দেখে ভয় পেল অসুরকুল। গন্ধবতীর কেশ ছেড়ে গন্ধাসুর হতচকিত হয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়াল।

তখন যজ্ঞকুণ্ডের ধোঁয়া ভেদ করে সিংহের পিঠে চড়ে এক জ্যোতির্ময়ী চতুর্ভুজা দেবীর আবির্ভাব হল। 


গন্ধবতীর ধ্যানভঙ্গ হল। সম্মুখে আবির্ভুতা দেবীকে সে প্রণাম করে বন্দনা করতেই দেবী তাকে অভয় দিয়ে ক্রুদ্ধনয়নে  তাকালেন গন্ধাসুরের দিকে। বিশালাকায় গন্ধাসুর প্রচণ্ড হুঙ্কারে দেবীকে আক্রমণ করল। শুরু হল ঘোরতর যুদ্ধ। ত্রিভুবন কেঁপে উঠল। অসুরেরা ভয়ে লুকিয়ে পড়ল। সমগ্র বণিক সম্প্রদায় গন্ধাসুরের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে করজোড়ে দেবীর নিকট প্রার্থনা জানালেন। 


তুমুল যুদ্ধের শেষে অপরাজেয় দেবীর ত্রিশূলে বিদ্ধ হয়ে অচিরেই দুরাচারী গন্ধাসুরের মৃত্যু হল। দিনটা ছিল বৈশাখী পূর্ণিমা।  


গন্ধাসুরকে বধ করে জগতে শান্তি প্রতিষ্ঠার কারণে আদ্যাশক্তি দুর্গার নতুন অবতার 'গন্ধেশ্বরী' খ্যাত হলেন বণিক সম্প্রদায়ের কাছে। 

দেবীর ইচ্ছায় সমুদ্রে পতিত গন্ধাসুরের বিশাল মৃতদেহ পরিণত হল একটি বিশাল দ্বীপে। যেখানে উদ্ভূত হল মশলা ও সুগন্ধদায়ী বৃক্ষ-লতা-বিটপী । দেবী সেই দ্বীপের নাম দিলেন, গন্ধদ্বীপ। বেনে-সম্প্রদায়ের একটি গোষ্ঠীকে দেবী এই দ্বীপ থেকে গন্ধদ্রব্য আহরণ করে বাণিজ্যের অধিকার দিয়ে তাদের নাম দিলেন 'গন্ধবণিক'।


প্রাচীনকালে বণিকরা ময়ূরপঙ্খী ভাসিয়ে আড়ম্বরপূর্ণ বাণিজ্যযাত্রায় যেতেন। পথে ঝড়বৃষ্টি, দুর্যোগ ছাড়াও জলদস্যু ও বন্য জীবজন্তুর ভয় ছিল। এই সবের থেকে মা গন্ধেশ্বরী তাঁদের রক্ষা করবেন, এই বিশ্বাস থেকেই শুরু হয় গন্ধেশ্বরীর পুজো।

সিংহবাহিনী, অসুরদলনী, শঙ্খ, চক্র, ধনুর্বান ধারী গন্ধেশ্বরী অনেকটাই জগদ্ধাত্রীর মতই।