২৪ ডিসে, ২০১৭

আনন্দনাড়ু পর্ব



কেমন যেন স্বপ্নের মত একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম কয়েকটা সপ্তাহ। এখনো মনে হচ্ছে ঘোর কাটেনি। ওরা এল, দেখল, জয় করল আবার ফিরে চলেও গেল। শাশুড়ি নামক এহেন ভিনগ্রহের জীবটির কি বিশেষত্ব থাকে, তার পদোন্নতিতে কি পরিবর্তন হয় এসব নিয়ে মাথা ঘামাইনি কখনো। এখন খুব সন্তর্পণে ভাবতে বসেছি এতসব। আয়নার সামনে নিজেকে দেখছি আর ভাবছি হস্ত-পদ-স্কন্দ-মাথা যথাস্থানে আছে কিনা। আমার কি ইস্পেশ্যাল গ্রুমিং দরকার? অথবা লেসেন নিতে হবে ভেটারান কোনো শ্বশ্রূমাতার কাছ থেকে? তা যাইহোক আমার মতন এহেন শ্বশ্রূমাতার শারীরিক ধকলটি ছিল বেশ ঘটনাবহুল এবং উত্তেজনাপূর্ণ। শুরুরদিনেই ছাদে প্যান্ডেল বাঁধতে এসে  ডেকরেটারের লোকজন দিল খানকয়েক ফুলের টব ভেঙ্গে। তারপর আদ্যোপান্ত ছাদটাকে মুড়ে ফেলে রং মিলিয়ে কাপড় সেলাই করে চলে যাচ্ছে। আমার ঘরমোছার মেয়ে চেঁচিয়ে বলল, আমার ন্যাতা-বালতি?
ডেকরেটরের লোকটা বললে "কাপড়টা একটু তুলুন, ওখানেই আছে'
ব্যাস! বিয়েবাড়িতে হাসির রোল। বাড়ি ভর্তি লোক জন  সকলে হেসে খুন।

তারপর রোজ সকালে দুধ চা না লাল চা? এই কটা দিন দুধ-চিনির ফতোয়া জারি ছিল না। অতএব চালাও পানসি দুধ চা।  শাশুড়ি হবার আগে একটু শক্তি সঞ্চয় প্রয়োজন কিনা। তারপর একটু ফাটা গোড়ালি, ফ্রুট ফেসিয়াল, এক্সট্রা সাইন হেয়ার ট্রিটমেন্ট। সবটাই ঘরোয়া যদিও। বিউটি স্যালোঁ আমার পোষাতা নেহি হ্যায়।   শীতের সকাল। ছোট দিন। পরাণ আঁটুপাটু।



হঠাত আমার মায়ের চীত্কার। ওরে কাল আনন্দনাড়ুর বাজার ? বললাম, সব রেডি আছে। ঘটিবাড়ির আরেক রীতি। শুভকাজে আনন্দনাড়ু বানানো। সে এক যজ্ঞ। আত্মীয় স্বজন মুখিয়ে থাকেন সেই নাড়ুর জন্য। সত্যনারায়ণের শিরণির মত মাপ তার। যত প্রিসিশন তত সুস্বাদু হবে সেই নাড়ু। আমার মায়ের মাপ মুখস্থ। সেইমত বাজার করেছি। সে এক যজ্ঞ আমাদের। বিয়ের আগের দিন বিশাল পরাতে নারকোল কোরা হল। চারটে বড় বড় নারকোলের জন্য  এক কিলো আটশো আতপচালের মিহি গুঁড়ো, আটশো গ্রাম সাদা তিল আর দেড়কিলো শুকনো আখের গুড় এর জোগাড় হল। আর ভাজার জন্য সরিষার তেল। এবার আয় তবে সহচরী হাতে হাতে ধরি ধরি, মাখিব নাড়ু সবে ভাজিব তায়। প্রথমে নারকোলের ওপর চালের গুঁড়ো আর গুড় দিয়ে ঠাসা। ভাগে ভাগে পেতলের গামলায় এক একটি অংশ নিয়ে ঠাসল বাড়ির মেয়েরা, বৌয়েরা। তারপর তিল ছড়িয়ে আবার ঠাসো। মোলায়েম করে, মসৃণ করে। এবার পাকানোর পালা। ঘন্টা তিনেক কাবার এই ঠাসাঠাসিতে। বিশাল গ্যাস আভেনে বিশাল পিতলের কড়াই। সরষের তেলে ধোঁয়া উঠতেই প্রথম খোলায় একুশটা নাড়ু আমাকে মানে পাত্রের মা'কে ভেজে তুলে রাখতে হবে মাটির হাঁড়িতে। এর নাম শ্যামের হাঁড়ি। বিয়ে মিটলে নারায়ণের পুজোয় এই নাড়ু নিবেদন করতে হবে। এই একুশটি নাড়ুর অদ্ভূত সব আকার প্রকার। আমাকেই গড়তে হল। জ্যামিতিক আকৃতি। কোনটা গোলক, কোনটা চৌকো, কোনটা ত্রিকোণ,কোনটা তারা, কোনটা আবার চোঙাকৃতি। গনগনে আঁচে গরম তেলে নাড়ু ভাজা শুরু হল। শাঁখ বাজল।  সেইসঙ্গে ছিল অঘ্রাণের কালো মেঘ করা আকাশের অন্তহীন বৃষ্টি। মা বললেন এ হল আশীর্বাদ। নাড়ুভাজার সময় বৃষ্টি নাকি আনন্দের বার্তা বহন করে।।

১৭ নভে, ২০১৭

ঘুম গেছিলাম গত দীপাবলিতে। প্রত্যন্ত চা বাগান তামসাং  টি-রিট্রিটের বাঙালি ম্যানেজার এই ধানী লঙ্কার দানা দিয়েছিলেন। এদ্দিনে সেই লঙ্কা আমার যত্নে। প্রথমে গাছের তেজ দেখে মালুম হয়নি।  এখন বুঝছি ভরা পোয়াতির কি তেজ! বিয়োতে না বিয়োতেই দাপট! দিদা বলত, " যেমন তেমন মেয়ে বিয়োব, বয়েস কালে তেজ দেখাব"

 প্রচন্ড ঝাল আর ঝাঁজ এই লঙ্কায়।তবে একে ধানী বলেনা পরে জেনেছি।  ঠিক বাঙালী মেয়ের মত। রূপে না গুণে ভোলায়, মিছরির ছুরিতে নয় শুধুই গন্ধে, ঝালের মাত্রা ছাড়িয়ে কাজ সারে।
বেশী ফলে না। জৈব সারের মাহাত্ম্য। গোবর,  খোল ভেজানো জল, মাছ ধোয়া জল আর বাকীটা অমিতাভ বচ্চনের অমৃত বচন যারর নাম বিজ্ঞাপন।  অল্প খাব, প্রতি রান্নাপিছু একটি লঙ্কাতেই মাত। অরগ্যানিক লঙ্কা বলে কথা। দুষ্প্রাপ্য।

১৪ নভে, ২০১৭

নবান্নে হেমন্ত লক্ষ্মী আর কুলুই চণ্ডী কি এক?


এইসময় ১৩ই নভেম্বর ২০১৭
বর্ধমান কে বলে Granary of Bengal অর্থাত বংলার শস্যভান্ডার। অঘ্রাণে ধানকাটা আর মাড়াই শেষ।চাষীর উঠোন ভরে গেছে সোনার ফসলে। নতুন ধানের গন্ধে ম ম করা গ্রাম। মৌসুমীর আনুকুল্যে বাম্পার ফলন। কৃষক পরিবারে আনন্দের বন্যা। আর তাই আমন ধান ওঠার সময় এখানে নবান্ন উত্সব বা হেমন্ত লক্ষ্মীর আরাধনায় মহাধূম। 
গ্রামবাসীরা খেতের সদ্য ওঠা নতুন আতপ চাল, এক টুকুরো সোনা, একটুকুরো রুপো, একটি ধাতব রেকাবির মধ্যে রেখে লক্ষ্মীকে নিবেদন করেন আর বলেন

“নতুন বাঁধি, পুরনো খাই, তাই খেতে খেতে যেন জন্ম যাই
নতুন বস্ত্র পুরনো অন্ন, তাই খাই যেন জন্ম জন্ম”

উৎসবমুখর বাঙালীর প্রিয় পার্বণ এই নবান্ন। নতুন অন্নের এই উৎসবে মেতে ওঠার আরেক অর্থ হল মা লক্ষ্মীর প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন।
বর্ধমানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সর্বমঙ্গলার মন্দিরে সর্বকালের ঐতিহ্য পরম্পরা মেনে অনুষ্ঠিত হয় নবান্ন উৎসব। দেবী দুর্গার আর এক রূপ অন্নপূর্ণা।তাই এখানে মা  অন্নপূর্ণাকে নতুন অন্নের রাজকীয় ভোগ নিবেদন করে তবেই ভক্তরা নতুন অন্ন গ্রহন করেন। কেউ আবার তাদের আরাধ্য দেবদেবী, পিতৃ পুরুষ কে নিবেদন করে তবেই নতুন অন্ন গ্রহণ করেন।
আরেকটি লৌকিক প্রথা হল কাক কে নতুন চালের খদ্যদ্রব্য নিবেদন করা। যাতে কাকের মাধ্যমে সে অন্ন পূর্বপুরুষের নিকট পৌঁছে যায়।এর নাম "কাকবলী' । 
অঘ্রাণের নতুন চাল, মটরশুঁটি, মূলো, কমলালেবু আর খেজুরের গুড়ের পাটালী দিয়ে মা ঠাকুরঘরে "নতুন" দিতেন। দুধের মধ্যে সব নতুন জিনিস দিয়ে পাথরের বাটিতে ঠাকুরকে নিবেদন করা আর কি! আর পুজোর পর সেই প্রসাদের কি অপূর্ব স্বাদ! তখন মনে হত, 
আহা শীতকাল, থাক্‌না আমার ঘরে। বারেবারে ফিরে আসুক নবান্ন, ঠিক এমনি করে । 

অঘ্রাণের শুক্লপক্ষে "বড়িহাত' থাকে বাংলার ঘরে ঘরে ।  নতুন বিউলির ডাল ভিজিয়ে রেখে শীলে বেটে নিয়ে তার মধ্যে চালকুমড়ো কুরে দিয়ে, হিং, মৌরী সব মিশিয়ে  স্না সেরে অঘ্রাণের রোদে পিঠ দিয়ে মেয়েরা বড়ি দেয় । একটি বড় কুলোর ওপরে পাতলা পরিষ্কার কাপড় বিছিয়ে সুচারু হস্তে এই বড়ি হাত অর্থাত বড়ি দেওয়ার রীতি অনেকেরি আছে। ঝোলে খাবার বড় বড়ি, ছোট্ট ছোট্ট ভাজাবড়ি এসব আজকাল স্মৃতি। আমরা দোকান থেকে কিনে খাই। আর ডালের সাথে পরিবেশিত হওয়া এই ভাজাবড়ির অন্যতম অঙ্গ ছিল কালোজিরে আর পোস্ত। কেনা বড়িতে পাইনা তেমন আর। এই বড়িহাতের দিন দুটি বড় বড়ি গড়ে তাদের বুড়ো বুড়ি করা হত। বুড়ি-বড়িটির মাথায় সিঁদুর আর দুজনের মাথাতেই ধানদুব্বো দিয়ে, পাঁচ এয়োস্ত্রীর হাতে পান, কপালে সিঁদুর ছুঁইয়ে, শাঁখ বাজিয়ে তাদের রোদে দেওয়া হত। একে বলে বড়ির বুড়োবুড়ির  বিয়ে দেওয়া।
এছাড়াও অঘ্রাণ মাসের শুক্লপক্ষের মঙ্গলবারে মেয়েরা কুলুই চন্ডীর ব্রত করে । বহুযুগ আগে এক ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্মণী এই ব্রত করত।তাদের মেয়ে পুজোর যোগাড়  দিত ।এই পুজোয় ঘটে জোড়া কলা রাখার নিয়ম। মেয়ে একবার জোড়াকলাটি লোভ করে খেয়ে নিল । কিছুদিনের মধ্যে তার গর্ভে এল যমজ সন্তান । কুমারী মেয়ের গর্ভধারণে কুলের সম্মান রক্ষার্থে ও লোকলজ্জার ভয়ে তার বাবা মা তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল । মেয়েটি বনের মধ্যে কাঠকুটো দিয়ে পাতার ঘর বানিয়ে বাস করতে লাগল । নির্ধারিত সময়ে তার দুই যমজ পুত্র হল । নাম রাখল আকুলি ও সুকুলি । বড় হয়ে তারা নদীর ধারে খেলা করছে মস্ত এক সওদাগর ধনরত্ন বোঝাই নৌকা নিয়ে তাদের সামনে আসতেই আকুলি ও সুকুলি বলল "তোমার নৌকায় কি আছে? আমাদের একটু দেবে? '
সওদাগর বলল "কেবল গাছপালা আছে বাবা, আর কিচ্ছু নেই'
ছেলে দুটি বলল "বেশ, তবে তাই হোক'
সাথে সাথে সওদাগর গিয়ে দেখে নৌকায় সত্যি সত্যি গাছপালা রয়েছে ।
সওদাগর ছেলেদুটির মাথায় হাত রেখে বললে "তোমরা কে বাবা? আমার ঘাট হয়েছে, আমার নৌকার জিনিষ যেমনটি ছিল তেমনটি ঠিক করে দাও বাবা"

আকুলি-সুকুলি বলল "আমরা তো কিছু জানিনা" এই বলে সওদাগরকে তাদের মায়ের কাছে নিয়ে গেল । তার মা  সব শুনে মা মঙ্গলচন্ডীকে সবকথা জানাল ।
মা মঙ্গলচন্ডী  সওদাগরকে  দৈববাণী করে বললেন  "কেন সে তাঁর ব্রতদাসের অপমান করেছে, কেন সে কিছু ভিক্ষা দেয়নি ছেলে দুটিকে' 

সওদাগর তার ভুল বুঝতে পেরে বাড়ি ফিরে মঙ্গলচন্ডীর পুজোর আয়োজন করল ও হারাণো জিনিষ সব ফিরে পেল।

এবার মঙ্গলচন্ডী স্বপ্নাদেশ দিলেন সেই রাজ্যের রাজাকে । বললেন তার দুই মেয়েকে আকুলি আর সুকুলির সাথে বিয়ে দিয়ে তাদের ঘরজামাই করতে । আকুলি-সুকুলি আর তাদের মায়ের বরাত ফিরে গেল ।

ব্রতকথা যদি লোকশিক্ষার অস্ত্র হয় তবে আমি বলব কন্যার অবাঞ্ছিত মাতৃত্বের জন্য পাশে থাকুক তার বাবা-মা। যে কারণেই গর্ভাধান হোক না কেন মেয়েসন্তানকে তাড়িয়ে না দিয়ে তার প্রতিকার করুক ।
সওদাগরের ধনসমুদ্র থেকে এক আঁচলা ভিক্ষান্ন পাক আকুলি-সুকুলির মত অবাঞ্ছিত শিশুরা ।
রাজকন্যার সাথে হোকনা ঐ যমজ ছেলেদুটির বিয়ে । বেঁচে যাবে সংসারটি ও সাথে তাদের মা টিও যাকে একদিন লোকলজ্জার ভয়ে ত্যজ্যা কন্যা হতে হয়েছিল । 
প্রতিবছর অঘ্রাণের ভোরে যখন শীত দরজায় কড়া নাড়ে তখন মনে পড়ে এইসব। পাল্টায়না ব্রতকথার গল্পগুলো। শুধু পাল্টে যায় সমাজের চিত্রকল্পটা। বদলে যায় চরিত্রগুলো। ব্রতের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদে চলে এ যুগেও  । সমাজে মেয়েগুলো আজো ব্রাত্য ।

২০ অক্টো, ২০১৭

"ভাইবোনফোঁটা"

ছবি সূত্রঃ গুগল

* সূর্যের ঔরসে সংজ্ঞার গর্ভে যম এবং যমী নামে একজোড়া পুত্র কন্যা হয়। মাতৃজঠরে একত্রে প্রতিপালিত ভ্রাতা যমের জন্য দেহের বাইরে এসে ভগিনী যমীর খুব কষ্ট হত। সে যত বড় হতে লাগল তত তার কষ্ট বাড়তে লাগল। অন্যথায় বিমাতা ছায়া দুজনকে পৃথক করে রাখতে চাইলেন। ছায়ার কুমন্ত্রণায় সূর্য নিজ পুত্র যমকে নরকে এবং কন্যা যমীকে মর্ত্যে পাঠিয়ে দেন। বহুদিন অতিবাহিত হলে যম এবং যমী উভয়ে একে অপরের বিচ্ছেদে কাতর হলেন। যম দেখা করতে গেলেন যমীর সঙ্গে। আর সেদিনটি ছিল কালীপুজোর দু-দিন পর কার্তিক অমাবস্যার শুক্লাদ্বিতীয়া তিথি যা আজো ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা যমদ্বিতীয়া নামে খ্যাত। ভাইয়ের জন্য যমী ঘর সাজিয়ে, নানাবিধ খাদ্যদ্রব্যের আয়োজন করে উপহার সাজিয়ে নাকি বসেছিলেন তাই ঐদিনে বোনেরা ভাইদের জন্য এভাবেই পালন করে থাকে। কারণ একটাই। ভাইয়ের মঙ্গলকামনায়, ভাইয়ের পরমায়ু কামনায়। এটি বলে পুরাণ।
* ঋগ্বেদ বলে যম আর যমী মায়ের শরীরের বাইরে এসেও নাকি মাতৃজঠরের একত্র অবস্থানকে ভুলতে পারেনা। তাই যমী যমকে কামনা করে বসেন। বলেন, আমাকে তোমার সন্তান দাও। যম কিন্তু নিরুত্তর। প্রত্যাখ্যান করেন আপন সহোদরা যমীকে।
* অথর্ববেদে বলে যমুনা নাকি যমকে বলেছিলেন মায়ের পেটে তো তাঁরা একসাথেই দশমাস পাশে শুয়ে ছিলেন অতএব এখনো তিনি সেভাবেই যমকে শয্যাসঙ্গিনী রূপে কামনা করেন কিন্তু যম বোনের মুখে এমনটি শুনে যেন তড়িতাহত হলেন। বলেন, জন্মসূত্রে এক পরিবারের হলে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করা গর্হিত কর্ম।
* যদিও প্রাকবৈদিক যুগে ভাই-বোন বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছে তাই যমীর এরূপ ধারণা অমূলক নয়। কিন্তু যম সেই ধারণাকে এক্কেবারে আমল না দিয়ে চলে যান।
আজ আমাদের শরীরবিজ্ঞান বলছে ভাই-বোনে বিবাহ হওয়াটা সত্যি সত্যি যুক্তিযুক্ত নয় ।
জিনগত সমস্যা এই বিবাহকে নিরাপদ করেনা অনেকাংশেই। সুস্থ মাতৃত্ব আসেনা। এলেও জিনগত ত্রুটি নিয়ে সন্তান আসে তাদের যা পরবর্তী জীবনে দুর্বিষহ। ভয়ানক সব রোগের স্বীকার হয় ভাইবোনের মিলনের ফলস্বরূপ সন্তানটি। সে যুগে এত বিজ্ঞান ছিলনা। ছিলনা হেমাটোলজির পরীক্ষানিরিক্ষা। মানুষ বুঝতনা জিনতত্ত্ব ও জৈবরহস্য। সেই বিয়ের ফলশ্রুতি মোটেই সুখকর হয়নি তাই বুঝি ধীরে ধীরে বিদায় নিয়েছে সহোদর-সহোদরার বিবাহ। আর তাই বুঝি যমীর ভাইকে বিবাহের আবেদন ও বোনকে বিবাহে যমের এই প্রত্যাখানের লোকায়ত কাহিনীটি প্রচার করে ধীরে ধীরে মর্যাদার আসনে বসানো হয়েছে ভাইফোঁটাকে আর সমাদর করা হয়েছে ভাইবোনের মধুর সম্পর্কটিকে।

যা হয়েছে তা সমাজের ভালোর জন্যেই। যম-যমীর সুস্থতার জন্যেই। আর ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়েছে ভাইবোনের বিয়ে। তাই বুঝি যমী মনকে বুঝিয়ে বলে, যমের অখন্ড পরমায়ু আশা করে। বোনেরা এখনো ভাইয়ের কপালে চুয়া-চন্দনের ফোঁটা দিতে দিতে বলে ওঠে

ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁট৷ ।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা।
ঢাক বাজে, ঢোল বাজে আর বাজে কাঁড়া।
আজ অবধি ভাই তুমি যেওনা কো যমের দক্ষিণ পাড়া।

সেই সময় কেউ বোধহয় যমীকে বুঝিয়েছিল যে এই বিয়েতে ঠিক হবেনা। তুমি যদি সত্যি সত্যি ভাইকে ভালোবাসো তবে তার সুস্থ পরমায়ু কামনা করো। তাকে পেট পুরে তার মনের মত পদ রেঁধেবেড়ে খাওয়াও, তাকে উপহার দাও..শুধু এই বিয়ে থেকে শতহস্ত দূরে থাকো।
কালের স্রোতে ধুয়েমুছে সাফ হল ভাইবোনের যৌনতার গন্ধ মাখা সম্পর্ক। আর ঠাঁই পেল স্বর্গীয় সুন্দর এক অমলিন, পবিত্র সম্পর্ক। যম যমীর ফোঁটা নিয়ে পরম তৃপ্তি পেলেন। আর সমাজ স্বীকৃতি দিল ভাই-ফোঁটা, ভাই-দুজ, ভাই-বীজ, ভাই-টীকা বা ভাই-তিলকের মত পবিত্র উত্সবকে।

*তাই আবহমান কাল ধরে বোনেরা ভাইদের মঙ্গল কামনা করে ফোঁটা দেয় ভাইয়ের শত পরমায়ু, উন্নতি কামনা করে।
কিন্তু কখনো কি শুনেছি আমরা এর উল্টোটা? অর্থাৎ ভাই তার বোনকে ফোঁটা দিয়ে বোনের সুস্থতা, সুরক্ষা এবং সার্বিক উন্নতি চাইছে? সকালে ধোপদুরস্ত হয়ে মাঞ্জা দিয়ে, ধুতির কোঁচা দুলিয়ে ভাইরা যুগে যুগে বলে এল, "ভাইফোঁটা নিতে যাচ্ছি"। কিন্তু "বোনফোঁটা দিতে যাচ্ছি" ও তো বলতে পারত তারা।
তাই এস আমরা চালু করি সামগ্রিক "ভাইবোনফোঁটা"। দু-তরফের পক্ষ থেকেই ফোঁটা চালু হোক!

১৯ অক্টো, ২০১৭

দীপাণ্বিতার স্মৃতিকণা



মার স্মৃতিতে ছোটবেলায় কালীপুজোর প্রদোষে দীপাণ্বিতা লক্ষ্মীপুজোর স্মৃতি অমলিন। সব ঘটিবাড়িতেই এই পুজো হবার কথা। আমাদের কোজাগরী পুজো নেই তাই এই পুজোয় মহা ধুম হত। সকাল থেকেই সাজো সাজো রব পড়ে যেত বাড়িতে। মা, ঠাম্মা উপোস থাকতেন। আর সারাদিন ধরে বিকেলের পুজোর জোগাড় যন্ত্র চলত। আগেরদিন বাজার হয়ে যেত। নারকোল নাড়ু মা আগের দিন করে রাখতেন। ঠাম্মা বসে নাড় পাকাতেন। আখের গুড়ের গন্ধে বাড়ি ঘর ম ম করত। স্কুল ছুটি থাকায় পড়াশুনো শিকেয় তখন। বারান্দার গ্রিলে মোমবাতি, ছাদের প্যারাপেটে মোমবাতি জ্বালানো নিয়ে কত এক্সপেরিমেন্ট চলত আমার আর ভাইয়ের। পুজোর দিন সকালে বাগানের ফুল তোলা ছিল আমার কাজ। একটাও কুঁড়ি না ছিঁড়ে শিউলি, জবা অপরাজিতা ফুল, স্থলপদ্ম তুলে সাজি ভরে আনতাম। ভাই ব্যস্ত তার বাজী নিয়ে। বাজি রোদে শুকনো, কড়মড়ে করে তবে তার শান্তি। আর ক্যাপ ফাটানো নিয়ে তার কত উত্তেজনা। একবার বম্বে থেকে বাবা তার জন্য নিয়ে এলেন স্পেশ্যাল এক ক্যাপ ফাটানোর স্টীলের বন্দুক। তার সঙ্গে আবার কিছু ক্যাপ ফ্রি ছিল। সেই দেখে আমিও উত্তেজিত। যদিও হাতে খেলনা বন্দুক দেওয়া মায়ের নাপসন্দ তবুও ভাইয়ের ইচ্ছে কে বেশ ভালোই প্রশ্রয় দেওয়া হত বাড়িতে।আমাদের বাড়ীতে পুত্র সন্তান ছোট থেকেই বেশ অগ্রাধিকার পায়, দেখেছি এমনটি। কিন্তু আমি
আমার ন'বছরের ভাকে এতটাই স্নেহ করতাম যে তার আনন্দে আমার আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে যেত। ভাবতাম এটাই যেন হওয়া উচিত। ও তো কত ছোট আমার থেকে। সেই ফুল দিয়ে মা দীপাণ্বিতা লক্ষ্মীর জন্য মালা গাঁথতেন দেখবার মত। এবার পুজোর ভোগ রাঁধার প্রস্তুতি। বড় হয়ে মা আমাকে বঁটিতে ভোগের ভাজাগুলি কাটতে বলতেন। পাঁচভাজার মধ্যে আলু, পটল, ফুলকপি, বেগুণ, আর রাঙা আলু ভাজা। মা ভাগ করে দিয়ে ভোগের খিচুড়ি বসাতেন। আমি মন দিয়ে ভাজা কাটতাম। ভাই ঠিক সময়ে এসে আমাকে বলত দিদি, বেশী করে গোল গোল চাকা চাকা আলুভাজা কেটে দে প্লিজ। মা যা আলু দিয়েছে তার প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ আলু কাটিয়ে নিত, যাতে না কম পড়ে। এবার মায়ের সেই আলুভাজতে প্রাণান্ত হত। নিয়মিত বাড়িতে এমন আলুভাজা হত না। তাই বুঝি ওর এমন আসক্তি ছিল ঐ স্পেশ্যাল আলুভাজায়। মা ভোগের জন্য সোনামুগ ডাল আর গোবিন্দভোগ চালের অপূর্ব খিচুড়ি, ঘিভাত, ফুলকপির ডালনা, রাঁধতেন। এরপর সুজির পায়েস বসত পেতলের কড়ায়। তাতে কাজু, কিশমিশ দিয়ে গার্ণিশ করার দায়িত্ব পড়ত আমার ওপরে। আর হত একটা স্পেশ্যাল চাটনী। এটা সারাবছরে আর হত না বাড়িতে। পালংশাক ভাজা হয়ে যেত আগেভাগে। সদ্য ওঠা মূলো, রাঙা আলু, বেগুণ আর মটর ডালের ছোট্ট ছোট্ট বড়ি দিয়ে সেই চাটনী।সরষে, ফোড়ন আর নামানোর ঠিক আগে একাটু ময়দা গোলা আরা কাঁচা তেঁতুলের ক্বাথ। সে যে কি অপূর্ব রসায়ন!
সব শেষে চাপত ছোট্ট ছোট্ট গোল গোল ঘিয়ের লুচির খোলা। সে গন্ধ আর পেতুম না সারা বছর।বছরের একটি দিনেই লুচির ময়দা কি করে শক্তপোক্ত করে, কম জল দিয়ে মাখতে হয় শিখে গেছিলাম সারা জীবনের মত। ভাই পাশ থেকে এসে বলত দিদি, বেশী করে ময়দা টা মেখেছিস তো? তারপর পাহাড় প্রমাণ সেই লুচি ভাজতে উপোসী মা হিমশিম খেতেন।
ভোগ রান্নার সময় মা একটিও কথা বলতেন না। পাছে ভোগের মধ্যে থুতু পড়ে যায়।
এবার মা লক্ষ্মী পাততেন। ধানের মধ্যে লক্ষ্মী আর তাঁর পেঁচার আসন গ্রহণ সুচারু আলপনা দেওয়া জল চৌকি তে। ঠাকুমার লক্ষ্মীর হাঁড়ি পেয়েছিলেন মা। সেই ধান প্রতিবছরে বদলানো হত পৌষ মাসে নতুন ধান উঠলে। এবার লক্ষ্মীর পা, ধানের শীষ এঁকে মা পিটুলি গোলা দিয়ে সারা বাড়ি আলপনা দিতেনা। লক্ষ্মীর কুনকে ভর্তি ধান আর ধান, পাশে সিঁদুর কৌটোখানি। মা লক্ষ্মীর ছবিতে পুজোই আমাদের রীতি।
লক্ষী, নারায়ণ আর ধনপতি কুবেরের পুজো হয় । পিটুলি বাটা দিয়ে মা তাঁর নিপুণ হাতে তৈরী করেন তিন পুতুল.... সিঁদুর দিয়ে পিটুলির তৈরী লালরঙের লক্ষ্মী পুতুল, নীলের গুঁড়ো দিয়ে নীল নারায়ণ পুতুল, আর অপরাজিতা পাতা বাটা দিয়ে সবুজ কুবের পুতুল । কলার পেটোতে সেই পুতুল তিনটিরই আসলে পূজো হয় ঐদিন । আর একটি কলার পেটোতে মাথা থেকে আঁচড়ানো চুলের নুড়ি, একটু গোবর আর একটা ভাঙা মোমবাতি রেখে তৈরী হয় অলক্ষী । চাটাই পিটিয়ে, মোমবাতি জ্বেলে অলক্ষীকে বাড়ির বাইরে বের করে পূজো করে, লক্ষী, নারায়ণ আর ধনপতি কুবেরকে শাঁখ বাজিয়ে বরণ করে প্রতিষ্ঠা করা হয় ।
চাটাই বাজাতে বাজাতে বলা হয়,
"অলক্ষ্মী বিদেয় হোক, ঘরের লক্ষ্মী ঘরেই থাক্'
আসলে কুললক্ষ্মী তথা ভাগ্যলক্ষ্মীর পুজো এই দীপাণ্বিতা লক্ষ্মীপুজো। সূর্যাস্তের আগেভাগে প্রদোষকালে হয় অলক্ষ্মীর পুজো। তারপর শুরু হয় দীপাণ্বিতা লক্ষ্মীর পুজো। ব্রতকথা অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানলাম ঈশ্বর, মানুষ, পুজোআর্চা এসবকিছুই তো মানুষের মনগড়া। এই অনুষঙ্গগুলি জীবনযাপনের উপলক্ষ্যমাত্র। উপযুক্ত চেষ্টা এবং ভাগ্যের জোরে মানুষের সংসারে শ্রীবৃদ্ধি হয়। যাকে আমরা বলি লক্ষ্মীর আগমন। তাই ভাগ্যলক্ষ্মীকে বরণ করা হয় দীপাণ্বিতার দিনে।

১৬ অক্টো, ২০১৭

কার্তিক লক্ষ্মী দীপান্বিতা এবং ধনতেরস



এইসময় বর্ধমান সমাচার ১৬ই অক্টোবর ২০১৭
বর্ধমান হল পশ্চিমবাংলার অন্যতম বিজনেস সেন্টার। মাড়োয়ারি, গুজরাটি সহ বহু রাজ্যের মানুষের বাস এখানে। সেই সঙ্গে যে বাঙালীরা এখানকার প্রাচীন বাসিন্দা তাদের সকলের সংস্কৃতি মিলেমিশে এক হয়ে গেছে এই জেলায় কার্তিকমাসের অমাবস্যা তিথিতে কালীপুজোর দিনে ঘটিদের হয় দীপাণ্বিতা লক্ষ্মী পুজো। অবাঙালী ব্যবসায়ীরা বলে দীপাণ্বিতা কালীপুজো।

দীপাবলী বা দেওয়ালির সঙ্গে আমরা পরিচিত। তবে দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজোর কথা অনেকেই জানিনা। রামায়ণ অনুসারে দীপাবলী হল রামের রাবণ বধ করে চৌদ্দ বছরের বনবাস শেষে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করা উপলক্ষে আলোক উৎসব। দীপাবলীর আলোকসজ্জা এবং শব্দবাজি সেই অধ্যায়কে সামনে রেখেই আজও সমাদৃত ।কোজাগরীর ঘোর কাটতে না কাটতেই কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর পরদিনেই ভূতচতুর্দশী। শুক্লপক্ষে আকাশ আলো করা রূপোর থালার মত চাঁদ, হিম ঝরানো জ্যোত্স্না আর শারদীয়ার মনখারাপ। দিন পনেরো কাটতে না কাটতেই কৃষ্ণপক্ষের সূচনা। ভূত চতুর্দশীর প্রস্তুতি। পূর্ণিমার চাঁদ এখন ঘুমোতে গেছে। ঝুপসি অন্ধকার আকাশের গায়ে।আসন্ন দীপাবলীর আলোর রোশনাই আর আকাশছোঁয়া ঘরবাড়ির আলোয়, বাজির গন্ধকী গন্ধে ভরপুর বাতাস। হিমের পরশ, ঝিমধরা নেশাগ্রস্ত ... ঋতু বৈচিত্র্যময়তায়

কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর দিন ধনতেরস অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দীপাবলি উৎসবের সূচনা হয়। কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে ভাইফোঁটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই উৎসব শেষ হয়। নবরাত্রি উৎসব শেষ হওয়ার ১৮ দিন পর দীপাবলি শুরু হয়।
দীপাবলীর আগের দিন চতুর্দশীকে বলা হয়নরকা চতুর্দশী।দেবী কালী নাকি কার্তিকমাসের এই চতুর্দশীর রাতে ভয়ানক অত্যাচারী নরকাসুরকে বধ করেন।

চতুর্দশী পরের অমাবস্যা তিথি দীপাবলী উৎসবের দ্বিতীয় দিন শাক্ত ধর্মের অনুসারীগণ শক্তি দেবী কালীর পূজা করেন।
আলোকসজ্জার মাধ্যমে অন্ধকারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার দিন। সকল অজ্ঞতা তমোভাবকে দীপের আলোয় প্রজ্বলিত করার দিন। কেউ বলেন মহালয়ায় যমলোক ছেড়ে যে পিতৃপুরুষগণ মর্ত্যে এসেছিলেন, তাঁদের পথ প্রদর্শনার্থে দিন আলোকসজ্জা বাজি পোড়ানো হয়, দরজা-জানালায় মোম বাতি দেওয়া হয় কেউ বা জ্বালায় আকাশপ্রদীপ।

ধনাগমের জন্য মানুষ করে ধনতেরস লক্ষ্মী-গণেশের পুজো। মূল উদ্দেশ্য একটাই। শ্রীবৃদ্ধি আর উন্নতি।

পশ্চিমবাংলায় অনেকের রীতি কালীপুজোর বিকেলে দীপাণ্বিতা লক্ষ্মীপূজো করে অলক্ষ্মী বিদেয় করা সংসারের শ্রীবৃদ্ধির আশায় লক্ষী, নারায়ণ আর ধনপতি কুবেরের পুজো পিটুলি বাটা দিয়ে নিপুণ হাতে তৈরী হয় তিন পুতুল.... সিঁদুর দিয়ে পিটুলির তৈরী লালরঙের লক্ষ্মী, নীলের গুঁড়ো দিয়ে নীল নারায়ণ, আর অপরাজিতা পাতা বাটা দিয়ে সবুজ কুবের কলার পেটোতে সেই পুতুল তিনটিরই আসলে পূজো হয় ঐদিন আর একটি কলার পেটোতে মাথা থেকে আঁচড়ানো চুলের নুড়ি, একটু গোবর আর একটা ভাঙা মোমবাতি রেখে তৈরী হয় অলক্ষী চাটাই পিটিয়ে, মোমবাতি জ্বেলে অলক্ষীকে বাড়ির বাইরে বের করে পূজো করে, লক্ষী, নারায়ণ আর ধনপতি কুবেরকে শাঁখ বাজিয়ে বরণ করে প্রতিষ্ঠা করা হয়

চাটাই বাজাতে বাজাতে বলা হয়,

"অলক্ষ্মী বিদেয় হোক, ঘরের লক্ষ্মী ঘরেই থাক্" আসলে কুললক্ষ্মীর পুজো এই দীপাণ্বিতা

প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী কার্তিকমাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশীতেই সমুদ্র থেকে উঠে এসেছিলেন ধ্বন্বন্তরী। তাই এই তিথির নাম হল ধনতেরস। তাই এই দিনটিতে ধনের উপাসনা করতে হয়। আর তার ঠিক পরেপরেই লক্ষ্মীর পুজো করতে হয়। সমুদ্রের ক্ষীরসাগর থেকে উঠে এসেছিলেন মহালক্ষ্মী। সেদিন নাকি ছিল কার্তিক অমাবস্যা। তাই লক্ষ্মীকে বরণ করে স্বর্গে ফিরিয়ে নেওয়ার অনুষ্ঠানটিতে আলোকমালায় সুসজ্জিত করা হয়েছিল স্বর্গকে। এই দিনে ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মী বরদাত্রী রূপে ভক্তের মনোস্কামনা পূর্ণ করেন।
দীপাণ্বিতা লক্ষ্মীপুজোর ব্রতকথায় আবারো উঠে আসে লক্ষ্মীর মাহাত্ম্য
এক রাজার পাঁচ মেয়ে। একদিন তিনি সকলকে ডেকে জিগেস করলেন, তারা কে কার ভাগ্যে খায়? কনিষ্ঠা কন্যাটি ছাড়া প্রত্যেকেই সমস্বরে জানাল, রাজার ভাগ্যে তারা খায়। কিন্তু কনিষ্ঠা বলল সে নিজের ভাগ্যে খায়। আর মা লক্ষ্মী তার সহায়। সেই কথা শুনে রাজা অগ্নিশর্মা। ঠিক করলেন পরদিন ভোরে উঠে যার মুখ দেখবেন তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেন। পরদিন রাজবাড়ির সামনে দিয়ে এক বামুন তার পুত্রকে নিয়ে যাচ্ছিল। তাকে ডেকে তিনি ছোটমেয়ের বিয়ে দিলেন। পুত্র রাজার জামাই হল বলে বামুন একাধারে খুশি আবার মহাচিন্তিত। রাজকন্যা তো মহানন্দে শ্বশুরবাড়ি চলল। অভাবের সংসার। মেয়েটি শ্বশুরকে বলল, রাস্তায় যা দেখবেন সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন। বামুন একদিন একটি মরা কেউটে দেখতে পেল। বৌমার কথামত সেটি ঘরে নিয়ে এনে মাচায় তুলে রাখল। এবার সে দেশের আরেক রাজার ছেলের অসুখ করেছে। রাজবৈদ্য বলেছে মরা কেউটের মাথা আনলে ওষুধ তৈরী করতে পারে। সেইমত রাজা ঢেঁড়া পেটালেন। যে মরা কেউটের মাথা এনে দিতে পারবে সে যা চাইবে তাই দেবেন
সেই শুনে রাজকন্যা তখুনি সেই মরা কেউটের মাথাটা রাজার কাছে পাঠিয়ে দিল। আর সেই সঙ্গে তার শ্বশুরকেও বলে দিল, রাজা কিছু দিতে চাইলে যেন তিনি না নেন শুধু রাজার কাছে তার অর্জি হল একটাই। কার্তিক অমাবস্যায় রাজার রাজত্বের কোনো গ্রামে কেউ যেন ঘরে আলো না জ্বালায়। রাজকন্যার শ্বশুর তা জানিয়ে ফিরে এলেন খালি হাতে। অবশেষে কার্তিক অমাবস্যার রাতে রাজকন্যা নিজের ঘরে খুব জাঁকজমকের সঙ্গে লক্ষ্মী পুজো করল।নিজের বাড়ির চৌহদ্দিতে আলো জ্বেলে রাখল। মা লক্ষ্মী দেখলেন ঘুটঘুটে অন্ধকারে কেবল তাঁর ব্রতীর ঘরেই আলো জ্বলছে। তাঁর কৃপায় বামুনের ঘরে আর কোনো অর্থাভাব ইল না। অবস্থা ভাল হতে বামুন পুকুর কাটালেন। পুকুর প্রতিষ্ঠার দিন নিমন্ত্রিতদের মধ্যে রাজকন্যার বাবা ভূতপূর্ব রাজাও উপস্থিত। তিনি জানালেন তাঁর দুরবস্থার কথা। নিজের অহমিকায় তাঁর সর্ব নাশ হয়েছে। তিনি আজ ভিখারী। মেয়ে জানাল, "বাবা তুমি লক্ষ্মীপুজো কর। তুমি সেদিন রেগে গিয়েছিলে আমার ওপর। আজ দেখলে তো মা লক্ষ্মীর কৃপাতেই আমার সব হয়েছে"