২৭ ফেব, ২০১১

"খড়গপুর" নাম কেন হ'ল ?


খড়গপুর আইআইটি ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে উত্তর দিকে ৫ কিলোমিটার গেলে পড়বে ইন্দা বাজারের মোড় । সেখান থেকে পূবদিকে আরো খানিকটা গেলে পড়বে ইন্দা দুর্গা মন্দির আর তারপরই বাঁদিকে খড়গেশ্বরের শিব মন্দির । এই মন্দিরের নামেই এই জায়গার নাম খড়্গপুর । কারো মতে,   রাজা খড়্গসিংহ তৈরী করেছিলেন এই মন্দির । আবার কারো মতে বিষ্ণুপুরের রাজা খড়্গমল্ল ২০০ বছর আগে এই মন্দির তৈরী করেছিলেন ।


মন্দিরের অভ্যন্তরে  গর্ভগৃহে প্রোথিত  খড়্গেশ্বর শিবলিঙ্গ  । শিবরাত্রি, আর গাজনের সময উতসব হয় এখানে ।


মন্দির চত্বরে বহু প্রাচীন একটি অশ্বত্থ গাছের বেদীমূলে রয়েছে আদিবাসীদের আরাধ্যা কোনো দেবতার প্রস্তর মূর্ত্তি । দক্ষিণবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার এই অঞ্চলগুলি প্রধানত:আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা ছিল । তবে  এখন সূর্য দেব রূপে ইনি পূজিত হন ।
মন্দিরের নাট মন্দিরে এখন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়েছে । স্থানীয় মানুষ জন আর মন্দিরের পুরোহিত বিদ্যালয়টি চালনা করেন । মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণও তাঁরাই করেন আর মন্দিরের মধ্যে অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে এই স্কুলটি করেছেন তাঁরা ।


জটাজুটো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই বহু পুরোণো অশ্বত্থ বৃক্ষ আর বহন করছে সময়ের সাক্ষ্য ।


 পুরো মন্দিরটী তৈরী পাথর দিয়ে । কোনো ইঁট নেই এর গায়ে । এখন সাদা রঙ করা হয়েছে ।

১৮ ফেব, ২০১১

ঘুরে এলাম পাথরা ও কর্ণগড়


১৬ই ফেব্রুয়ারি ২০১১ । একটা ছুটির দিন ছিল । তার আগের দিন রাতে আমাদের আরো এক বন্ধুর সাথে হঠাতই প্ল্যান হ’ল বেরোনোর । ” একে তো ফাগুন মাস , দারুন এ সময় ” ! আর খড়গপুরে এসে অবধি আমরা  নেট সার্ফ করে চলেছি এর আশপাশ নিয়ে । সময় পেলেই বন্ধুরা মিলে আর এন্ড ডি করছি …ছুটির দিনের অপেক্ষা করছি । হঠাতই মিলে গেল আরো একটি ট্যুরিস্টস্পটের  । বাতাসে সজনে ফুলের গন্ধ আর পলাশের রঙ সঙ্গে করে বেরিয়ে পড়লাম আমরা চারজন মিলে..
মেদিনীপুর থেকে মাত্র দশ কিলোমিটার দূরে মন্দিরময়ে পাথরা গ্রামের ।


কংসাবতী (কাঁসাই) নদীর ধারে, মন্দিরের পর মন্দির রয়েছে পাথরায় । মন্দির, নাট মন্দির , কাছারিবাড়ি, রাসমঞ্চ, ঠাকুরদালান । পাশেই পাথরা গ্রাম । গ্রামের বাড়ি, পুকুর, ধানক্ষেত,  আলুর ক্ষেত,  সবজীর ক্ষেত, বাঁশঝাড় সবকিছুর মধ্যেই মন্দিরময় এই পাথরা ।  সবমিলিয়ে চৌত্রিশটি অসাধারণ সব মন্দির আছে ।  এগুলি প্রায় ২০০ বছরের পুরোণো ।


১৭৩২ সালে বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁ ঐ পাথরা গ্রামের  রত্নাচক পরগণার রাজস্ব আদায়ের জন্য বিদ্যাসুন্দর ঘোষাল নামে একজনকে নিযুক্ত করেন । ঐ বিদ্যাসুন্দর বাবু তাঁর নিজের শখে একের পর এক এইখানে মন্দির বানান । মন্দির গুলির ধ্বংসাবশেষ দেখলে মন খারাপ হয়ে যায় । সব শিবলিঙ্গের ভাঙা করুন অবস্থা ..




একটি এনজিও সংস্থা "পাথরা আর্কিওলজিকাল প্রিজার্ভেশন কমিটি",  আইআইটি খড়গপুরের সাথে সম্মিলিত ভাবে এই সুন্দর মন্দিরগুলির তত্ত্বাবধানে ব্রতী হয়েছে । মন্দিরের কারুকার্য পোড়ামাটির ইটের ; স্টাইলটা বিষ্ণুপুরের বাংলার  চালাঘরের মত আর অভিনব শিল্পশৈলি তার গায়ে ।



সেখান থেকে আরো কিছুটা গিয়ে হাতিওলকা গ্রাম পেরিয়ে গেলাম কর্ণগড় । 


পুরোণো গড় আজ আর নেই । নতুন মন্দির হয়েছে অনেকগুলি ।

সেইখানে মন্দিরের প্রসাদ খেয়ে দুপুরের মধ্যেই আবার ফিরে এলাম খড়গপুরে |

১৩ ফেব, ২০১১

খুশির প্রেমদিবস






ভ্যালেন্টাইনস ডে ছিল না আমাদের সময়ে । কিন্তু তখনো প্রেমে পড়ত ছেলেমেয়েরা । আর বসন্ত এলেই প্রেমের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিত তারা । পালন করত নিত্য নতুন ভ্যালেন্টাইনস ডে । কখনো হোলিতে কখনো সরস্বতী পুজোতে । আর প্রণয়ের পারাবারে সাঁতার কাটতে কাটতে বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীরা  ? দৈনন্দীন জীবনের একঘেয়েমিতে কেমন পাগল পাগল ভাব নিয়ে  তারাও মাঝে মাঝে পালন করত ভ্যালেন্টাইন্স ডে । স্বামী তার বিশেষ দিনটিতে স্ত্রীয়ের জন্য ছোট খাট গয়না 
কিনে উপহার দিতেন । অফিস থেকে ফেরার পথে, জলযোগের কেক-প্যাটিস নিয়ে বাড়ি ফিরে বলতেন " কি গো চা বসাও ? দেখ আজ কি এনেছি, তোমার জন্যে " কিম্বা  চলো দু'দিন পুরী বেড়িয়ে আসি" এ সব দেখেছি আমাদের বাবা 
মায়েদের আমলে । আমাদের বিয়ের ঠিক আশপাশের সময় থেকে শুরু হ'ল ভ্যালেন্টাইন্স ডে । লেট আশির দশকে । ব্যাস! সেই থেকে শুরু "ভ্যালেন্টাইন প্যাকেজ"  ফুলের দোকান থেকে শুরু করে গ্রিটিংস কার্ড , গয়না থেকে কেক, মকটেল, 
কফি , আইস ক্রিম সর্বত্র সেই তীর বিদ্ধ হৃদয়ের ছবি !  শপিং মলে ঝুলছে বিশাল বিশাল রক্তাক্ত হৃদয় , টিভির পরদায় প্রেমের গান, প্রেমের ছবি, প্রেমের কবিতা আবৃত্তি  । আর এসেমেসের চোটে আগের দিন মধ্য রাত থেকে সেলফোনের 
নেট ওয়ার্ক হ'ল বেজায় স্লো।   সামনেই সব ছেলেপুলেদের বড় বড় পরীক্ষা ! তো কি ? পরীক্ষার আগে একটু ডাইভারশান চাই না ? তাই তো সাধু ভ্যালেন্টাইন এই উপায় বাতলেছেন ।
গতবছর ভ্যালেন্টাইন্স ডে'র দিন সকালে মর্নিং ওয়াকে গেছি; এক ভদ্রলোক তার সহধর্মিনীকে বলছেন " এই রোজ রোজ তোমার পাল্লায় পড়ে সকালে হাঁটতে বেরোনো আমার জীবন বিষময় করে তুলছে" 
নীরব স্ত্রীটি হাঁটতে লাগলেন আরো জোরে জোরে । 
ভদ্রলোক বললেন " খাবার ওপর ট্যাক্স ও বসালে , আর হাঁটাও ধরালে ...তাহলে যেকোনো একটাই করো হয় খেতে দিও না, নয় হাঁটতে  বোলোনা"আমার মা বেঁচে থাকলে দেখিয়ে দিত তোমার মজা  সব কিছুতেই  কাঁটছাঁট ! চায়ে চিনি বন্ধ , সকালে একগাদা ফল খাও , দুপুরে ভাত নৈব নৈব চ ! রাতে মোটে একটা রুটি ! কি কুক্ষণে একটা সেমি-ডায়েটিশিয়ান বৌ এনেছিলাম" 
বেচারী বৌটি তখনো চুপ !  
স্বামীটি আবারো বললে " দাঁড়াও দেখাব মজা , অফিসের বেয়ারাকে দিয়ে ভাল ভাল খাবার আনিয়ে খাব, তুমি জানতেও পারবে না" 
তখন বৌটি আর থাকতে না পেরে মুখ খুলল "আজকের দিনে ঝগড়া করতে  নেই গো , আজ প্রেমের দিন, আজ আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা প্রেমের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে আর তুমি কি না শুধুমুদু আমাকে সক্কালবেলা গালাগালি দিচ্ছ ? আমি যে 
তোমার ওয়ান এন্ড ওনলি ভ্যালেন্টাইন !" 
তাদের এই মৃদু প্রেম মিশ্রিত ঝগড়ার সুর উঠল আমার প্রাণে । অঞ্জন দত্তের গান মনে পড়ে গেল " তুমি না থাকলে সকালটা এত মিষ্টি হত না .. " 
আর  আমি তাদের কথাগুলো নিয়ে একটা গান লিখেছিলাম অঞ্জন দত্তের গানের সুরে .. যারা জানেন গানটি তারা বুঝতে পারবেন আশাকরি ;


 বৌটি বলছে 
"আমি না থাকলে তোমার জীবন আরো মধুময় হত, রাগঝাঁঝ আর ঝগড়াঝাটির অবসান আজ হোত । 
আমি না  থাকলে থোড়-বড়ি-খাড়া রান্নাঘরের মেনু, চামচ হাতে, প্লেট বাজিয়ে বাজাতে বসে বেণু  
আমি না থাকলে প্রতিসন্ধ্যায় কাঁচের গেলাস হাতে, শুধু ঘন ঘন চুরুট আর চাট দিতে তুমি শুধু দাঁতে । 
আমি না থাকলে ল্যাপটপ খোলা শুধু তুমি আর তুমি, চ্যাট, ইমেল খেয়েছে তোমায় (যা) আমার চেয়েও দামী । 
আমি না থাকলে ব্যাঙ্কের টাকা দ্বিগুণ হয়ে যেত, সকালে চিংড়ি, বিকেলে মাটন বন্ধুরা এসে খেত । 
রোজ সকালে হাঁটার জন্য উঠিয়ে দিত না কেউ, হত না এমন মন কষাকষি ঝগড়াঝাটির ঢেউ ! 
খাবার ওপর ট্যাক্স বসিয়ে জিমে পাঠালাম আমি, এখন ভুঁড়ি কমল তোমার, 
সুফল পেলে তুমি"

১২ ফেব, ২০১১

"তখন ২৩"..আমার চোখে




দৈনিক স্ট্যেটসম্যান ১২ই ফেব্রুয়ারি ২০১১ তে প্রকাশিত এই আলোচনা  



"তখন ২৩" একটি সময়োপযোগী বাংলাছবি । বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে যা ঘটে চলেছে  তাকে সঙ্গে নিয়ে অত্যন্ত নিপুণ ভাবে ছবির কাহিনীকার এবং পরিচালক অতনু ঘোষ চরিত্রগুলিকে এঁকেছেন  । 
বয়সন্ধির সমস্যা প্রকটভাবে না হলেও প্রচ্ছন্নভাবে স্থান পেয়েছে । স্থান পেয়েছে একটি একমাত্র সদ্য টিন পেরোনো ছেলের মায়ের অতি অধিকারবোধ । মূল চরিত্র তমোদীপ । যে কি না বাবা-মায়ের আকাশছোঁয়া প্রত্যাশা পূরণ করেছে, ডাক্তার হয়ে  । যে তমোদীপের জীবনে তার মা ছিল সবচেয়ে বড় বন্ধু তিনি ধীরে ধীরে সরে গেছেন তার কাছ থেকে যখন তার জীবন ঘিরে তার বায়োলজি টিচার মেঘনার  প্রতি   ইনফ্যাটুয়েশান । মেঘনার সাথে ঘনিষ্ঠতায় মা হয়েছেন বিরক্ত ।  মেঘনাকে তমোদীপের মা অনুরোধ করলেন তার ছেলের জীবন থেকে দূরে চলে যেতে । আবার পরক্ষণেই তিনি ভাবেন যে মেঘনাকে দূরে সরিয়ে দিয়েই বুঝি তার ছেলের সাথে  দূরত্ব তৈরী হল । তাই আবার মেঘনাকে অনুরোধ করেণ ফিরে যেতে যাতে তাঁর ছেলের সাথে সম্পর্ক সহজ হয় ।   
সোশ্যালনেটওয়ার্কে  তমোদীপের আলাপ হয়েছে শ্রীপর্ণার সাথে যে আবার চিনে ফেলে মেঘনাকে যিনিও উপস্থিত ফেসবুক নামক সোশ্যালনেট ওয়ার্কিং সাইটে ।  এমন সময় তমোদীপ আসক্ত হয়েছে পর্ণোগ্রাফিক ছবিতে । যেখানে পর্ণস্টার মোহিনী ওরফে শম্পা দাশগুপ্তার  লাস্যময়তার রঙীন ফ্যান্টাসিতে ডুবে গেছে তমোদীপ । এই তিন বাইরের জগতের নারীর আকর্ষণে দূরে সরে গেছে একসময়ের সবচেয়ে কাছের বন্ধু অন্দরমহলের "মা" নারীটি । তিনি বুঝতে পারেন না নিজের সেই ছোট্টটিকে । তমোদীপ  বুঝতে পারছে যে তার মায়ের কাছ থেকে সে দূরে সরে গেছে । তার বায়োলজি টিচার মেঘনার সঙ্গ তার ভালো লাগে কারণ তার মনের বয়স সেই ভালোলাগাকে  প্রাধান্য দিয়েছে । তার মা তাতে ভয় পেয়েছেন আর পাঁচটা মায়ের মত । কিন্তু মেঘনা নিজে একজন ডিভোর্সি এবং জীবনকে তমোদীপের থেকে বেশিদিন দেখেছে তাই মেঘনা কিন্তু আদ্যোপ্রান্ত শিক্ষিকার ভূমিকা পালন করেছে এবং সেই চরিত্রটির জন্য ইন্দ্রাণী হালদারকে নির্বাচন যথাযথ বলে আমার মনে হয়েছে ।  তমোদীপের জীবনে এসেছে চ্যাট ফ্রেন্ড শ্রীপর্ণা যার জীবনে সোশ্যালনেট ওয়ার্কিং শেষ কথা এবং নিজের জীবনকে ভালো করে উপলব্ধি করার জন্য সে সব চ্যাট ফ্রেন্ডকে মিট করে । ডিজিটাল সম্পর্ককে রিয়েলিটির মুখোশ পরিয়ে দেখবে বলে হয়ত । কিন্তু যখন সে চ্যাট-বন্ধু রজতাভ দত্তের সংস্পর্শে আসে তখন রজতাভ নিপুণ হস্তে তাকে বুঝিয়ে দেন যে এই বয়সে যখন তখন চ্যাট ফ্রেন্ডকে চর্মচক্ষে আলাপ করে তার সঙ্গে সময় কাটানোটা কতটা ক্ষতিকারক হতে পারে ।   আবার মন ছুঁয়ে যায় রজতাভর চরিত্রটির অপূর্ব চিত্রায়ণ । এই দুটো দিক বিচার করে আমার মনে হয়েছে ছবিটি শিক্ষামূলক । আজকের যুগের সোশ্যালনেটওয়ার্কে চিটে গুড়ের মত আটকে থাকা স্কুল-কলেজ পড়ুয়াগুলির দেখা দরকার ছবিটি আবার দেখা দরকার তাদের মায়েদেরও যারা বুঝতে পারছেন না বয়ঃসন্ধির সমস্যাটি কোথায়  ?  ঠিক এমন সময় তমোদীপের ফ্যান্টাসির জগতের নায়িকা পর্ণস্টার মোহিনীর আবির্ভাব হয়  বাইপাসে রোড এক্সিডেন্ট হয়ে সরাসরি তমোদীপের পেশেন্ট রূপে ; মোহিনী হয়ে নয় " শম্পা দাশগুপ্তা " যার আসল পরিচয় ; হসপিটালে কয়েকটাদিন কাছের থেকে মোহিনীকে দেখার সুযোগ করে দেন তমোদীপের ভাগ্যলক্ষী ।   উঠে আসে শম্পার মোহিনী হবার গল্প । এবার শুরু হয় তমোদীপের টানাপোড়েন । পরিচালক অতনু ঘোষ ঠিক সেই সময় মেঘনা চরিত্রটিকে সঠিক ভাবে রূপায়িত করেন একজন " মনের কথা মন খুলে " বলার মত কাউন্সিলারকে যিনি অল্পবয়সীদের মনের ছবি দেখেন  তার এফএম চ্যানেলের লাইভ টক-শো তে । ধীরে ধীরে কাউন্সেলিং করেন তমোদীপকে আর সেই সাথে তমোদীপের মা'টিকে  । তমোদীপের মনের টানাপোড়েনের পরত গুলি একটি একটি করে খুলে যায় । সে শক্ত করে ধরে থাকে জীবনের সম্পর্ক-যুদ্ধের স্টিয়ারিংটি । ধীরে ধীরে এগুতে থাকে পজিটিভিটির দিকে । দেখতে পায় আলো । ঝকঝকে রাস্তায় তার নিজের  কেনা  প্রথম লাল রঙের গাড়ির চাবি মায়ের হাতে দিয়ে প্রমাণ করে যে সে বদলায় নি একটুও । এখানে গাড়িটিও সিম্বলিক কারণ জীবনের গতিময়তার প্রতীক রূপে, নতুন রাস্তায় জীবন মোড় নেবে বলে  । আর পাওলি দামের অভিনয়ে মোহিনী চরিত্রটি আমার চোখ দিয়ে দেখে মনে হল শম্পার আর পাঁচটা পতিতার মত  অতীত ছিল ; শম্পার  শিল্পীসুলভ গায়নশৈলী ছিল আর ছিল কবিতাকে উপলব্ধি করার মন । কিন্তু  তমোদীপ, মেঘনা আর শ্রীপর্ণার বন্ধুত্বের স্পর্শে সে ফিরে এল আলোর জগতে । ভালোবাসার ছোঁয়ায় উন্মোচিত হ'ল তার হৃদয়ের কোমল মনোবৃত্তি । তাই সে  হলুদফুল রাখল তমোদীপের গাড়ির ওপর   । এখানে হলুদ ফুল আবারো " গোল্ডেন হার্টে"র প্রতীক গল্পের শুরুতে আমরা দেখি আমাদের দেশের তথাকথিত হিপোক্রেসীর শিক্ষা ব্যাবস্থায় গালভরা "সেক্স এডুকেশন"  কেমন সুন্দর ভাবে  তুলে ধরেছেন পরিচালক । আর যেহেতু তমোদীপ, মেঘনা, শ্রীপর্ণা এরা ফেসবুক ও অর্কুটের মাধ্যমে সোশ্যালাইট করে তাই প্রতিনিয়ত অতনু বুঝিয়ে দিয়েছেন রিয়েল আর ভারচুয়াল চরিত্র সব সময় এক হতেও পারে আবার না হতেও পারে । তাই এসেছে ডাঃ রূপক সেনের জীবন সঙ্গিনী পিঙ্কি প্রসঙ্গ । আবার ফেসবুকে রজতাভর ছবি দেখে শ্রীপর্ণার বিস্ময় ! আর মোহিনী চরিত্রটি ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে না ঘুরলেও রিয়েল লাইফে তার দুটো আইডেন্টিটি । একটি মোহিনী অন্যটি শম্পা ।    সেখানে রিয়েল লাইফের সাথে ভার্চুয়াল লাইফ মিলে মিশে এক ! সব শেষে বলি " তখন ২৩" একটি মনের সমুদ্রে সাতাঁর কেটে চলা " ইনফ্যাটুয়েশানের্" ছবি যেখানে যৌবনে পদার্পণ হওয়া তমোদীপের ফ্যান্টাসিগুলো একসময় ফিরিয়ে দেয় তাকে নিজের একান্ত আপন জীবনে ।  জীবন চতুষ্কোণে চার নারীর  সম্পর্কের টানাপোড়েনে বিদ্ধস্ত তমোদীপ নিজের চোখ দিয়ে মনের ভেতরকে দেখে  উপলব্ধি করে মনের কোণে থিতিয়ে পড়ে থাকা জীবনদর্শন |
সব মিলিয়ে বলা যায় এই জেনারেশানের ছবি, পরিচ্ছন্ন ছবি যেখানে অহেতুক নাচ-গান নেই । আর সব শেষে বলি তমোদীপের ভূমিকায় যীশু সেনগুপ্ত, মোহিনীর ভূমিকায় পাওলি দাম, শ্রীপর্নার ভূমিকায় অপরাজিতা ঘোষদাস,    মেঘনার ভূমিকায় ইন্দ্রাণী হালদার এবং তমোদীপের মায়ের ভূমিকায় তনুশ্রী শঙ্কর এক্কেবারে সঠিক নির্বাচন । কেবল লকেট   চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্রটির তাতপর্য আমার কাছে একটু প্রশ্ন জাগিয়েছে । আর অতুলপ্রসাদের গান " তুমি গাও" এ জয়তী চক্রবর্ত্তির গায়কী আরো একবার মন ছুঁয়ে গেল । এ যাবত কাল পরিচালক অতনু ঘোষের কাছ থেকে ঊনিশটি টেলিছবি আমরা দেখেছি তারা মিউজিকের পর্দায় । বড়পর্দায়  অতনু ঘোষের ২য় ছবি " তখন ২৩" এ ও তিনি সার্থক তা আবার প্রমাণ করে দিয়েছে ।   তারা ফিল্মস বড়পর্দায় প্রথমেই সফলতা প্রমাণ করেছে 

 

৯ ফেব, ২০১১

কুরুম্ভেরা দুর্গে কিছুক্ষণ !



এখন যে আই-আই-টি খড়গপুরকে আমরা দেখি প্রাক স্বাধীনতার যুগে সেখানে ছিল হিজলী জেল ।
আই-আই-টি ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে দক্ষিণদিকে যাত্রা করলে হিজলি ফরেস্ট শুরু হয় ।

শীতের রোববারের সকালে এই অরণ্যের হাত ধরে, কেশিয়াড়ি হয়ে ঘুরে আসা যায় ভসরাঘাট| সুবর্ণরেখা নদীর ধবধবে সাদা, মসৃণ ও রোদের আলোয় চিকচিকে বালির চরে হেঁটে নদীকে ছুঁয়ে দেখে আসা যেতেই পারে ।

নদী দেখে ফেরার পথে বেলদার রাস্তায় ২ কিলোমিটার গেলে পড়বে কুকাই গ্রাম । সেখান থেকে আরো ২ কিলোমিটার গেলে পড়বে গগনেশ্বর গ্রামে কুরুম্ভেরা দুর্গ । পুরাতাত্মিক মনুমেন্ট হিসেবে স্বীকৃত এই ফোর্টটি সত্যি সত্যি এখনো স্বমহিমায় তার রাজকীয়তা বজায় রেখেছে ।

পশ্চিম মেদিনীপুরে যে এত অভিনব একটি স্থাপত্য আছে তা হয়ত অনেকেরই জানা নেই ।

কোলকাতার অনতিদূরে এমন একটি জায়গা আছে । কোলকাতায় আছে অনেক সৃষ্টিশীল মানুষ । কিন্তু কোনারক আর খাজুরাহে হয় ডান্স ফেষ্টিভাল কিন্তু কুরুম্ভেরাতেও তো হতে পারে ! আমার এখানে গিয়ে কেবলই মনে হতে লাগল সে কথা । আমার মনের ক্যামেরায় ধরা র‌ইল সেই রাজকীয় দুর্গের ছবি !
 

৪ ফেব, ২০১১

"থট-শপ"


সে এক ছিল মজার দোকান । দোকানের নাম "থট-শপ" ;সেই দোকান সাধারণ মানুষ খুঁজে পেত না, যার যাবার ইচ্ছে হত সে ঠিক পৌঁছে যেত সেই দোকানে । মালিক এক থুড়থুড়ে, দাড়ি ওলা বুড়ো যার নাম চিন্তামণি, অনেক বয়স তাঁর ।  এক সময় ছিলেন রসায়নবিদ । ক্রিস্টালের ওপরে রিসার্চ করেছিলেন বহু বছর ।  সে দোকানে কত রকমের  সব জিনিষ বিক্রি হত । থরে থরে সব সাজানো থাকতো কাঁচের বয়ামের মধ্যে  । ঠিক যেন লজেন্স ! লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, কমলা.... কত রঙের বাহার।  কত ধরণের গড়ন সেই সব রঙীন লজেন্স-ক্রিস্টালের; কোনোটা ছুঁচের মত, কোনোটা রম্বসের মত, কোনোটা আবার চোঙাকৃতির, কোনটে বা আয়তঘনাকার ।প্রত্যেক বয়ামের গায়ে স্ফটিকের নাম, দাম আর গুণাবলী লেখা থাকত।  বুড়ো চিন্তামণি দোকানের মধ্যে  টেষ্টটিউব, বানসেন বার্নার, বিকার, ফিল্টারপেপার, ফানেল  আর আইসবক্স নিয়ে বসে থাকত ঘন্টার পর ঘন্টা নাওয়া-খাওয়া ভুলে । ছোট ছোট বাক্সের মধ্যে রাখা রঙবেরঙয়ের নুন-চিনির মত দানা  বের করে তাদের জলে দ্রবীভূত করে , ফুটিয়ে ধীরে ধীরে ঠান্ডা করে বরফে কিম্বা ঠান্ডা জলের মধ্যে রেখে রাতে  বাড়ি চলে যেত; পরদিন এসে দেখত কেমন সব রঙ বেরঙয়ের স্ফটিকের উত্পত্তি ।বুড়োর ছিল এক গ্লাসরড যা প্রত্যেক ক্রিস্টালে ছোঁয়ালেই একটা করে চিন্তা বা "থট" ঢুকে যেত তার মধ্যে । আর যে সেই ক্রিস্টাল বুড়োর কাছ থেকে কিনে নিয়ে বাড়ি গিয়ে বয়ামে লেখা নিয়ম মাফিক গ্লাসে জল নিয়ে এক এক করে যেই ফেলত অমনি চিন্তার বুদবুদেরা গ্লাসের জলের মধ্যে থেকে সেই মানুষটির মাথায় যেত চলে । আর ঠিক তক্ষুণি সেই মানুষটি পাড়ি দিত চিন্তার কল্পলোকে ।     "কিউবিক"
ছোট্ট অপু একদিন সেই দোকানের খোঁজ পেল । তার অনেক দিনের সাধ পাখি হয়ে উড়ে মেঘেদের কাছে যাবার; নীলচে সবুজ "স্ফটিক"নামের    লজেন্স-ক্রিস্টালের পাউচ কিনে নাচতে নাচতে বাড়ি এল । বুড়োর কথামত এক গ্লাস জল নিয়ে যেই একদানা ক্রিস্টাল জলে ফেলা অমনি অপু পাড়ি দিল পাখির বেশ ধরে  স্বপ্নের কল্পনায় । মাছরাঙার নীলটুকু ,কাঠঠোকরার হলদে টুকু, টিয়ার ঠোঁটের লালটুকু নিয়ে অপু হল ছোট্ট পাখি  টুনিয়া । শিস দিয়ে গান গাইতে গাইতে টুনিয়া উড়ে গেল মেঘের বাড়ি। অনেক দিন ধরেই অপুর মা বলছিল বৃষ্টিহীনতা আর খরার কথা । মেঘের কাছে গিয়ে টুনিয়া গান শুনিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে মেঘকে নিয়ে এল নিজের বাড়ির ছাদের মাথায় আর শুরু হল ঝমাঝম বৃষ্টি ।

ছোট্ট মেয়ে তাথৈ সমুদ্রের নীচে  দ্বীপে পাড়ি দিতে চায় ।  তাথৈ সেই দোকানে গিয়ে  কমলা রঙয়ের "রম্বিক"নামের ক্রিস্টাল কিনে নিয়ে এল আর জলে ফেলতেই চিন্তার বুদবুদেরা তাথৈকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল সমুদ্রের নীচে । ছোট ছোট সি এনিমন, কোরাল, হাইড্রা আর এলগিদের সাথে তার বন্ধুত্ব হল। মায়ের কাছে গল্প শুনেছিল ঝিনুকের পেটে মুক্তোর কথা । কিন্তু কোনোদিন তা চোখে দেখেনি সে। খুব ইচ্ছে হত হাতে করে দেখার । নীচে গিয়ে দেখে কত কত ঝিনুক । ঢাকনা খুলে পেটে করে পেল্লায় মুক্তো নিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে আছে । দুচোখ ভরে তা দেখতে দেখতে হঠাত্‌ তাথৈ ভাবল "আমি যদি এমন একটা মুক্তো হতে পারতাম"  । যেমনি ভাবা অমনি একটা বিরাট গোলাপী ঝিনুক তার দিকে ছুটে এসে বলল "আজ থেকে তুমি হলে এই জলমন্ডলের রাণী । তোমার নাম আমি দিলাম মুক্তা, এস আমার কোলে"  আহ্লাদে আটখানা হয়ে মুক্তারাণী ঝিনুকের কোলে বসে পড়ল । আর তখুনি আর সব জলদেশের বন্ধুরা তাকে ঘিরে হৈচৈ করতে লাগল, নাচতে লাগল, গাইতে লাগল । মুক্তা তাদের বলল যাবে তোমরা আমার বাড়ির বাগানে? একটা ছোট্ট লিলিপুলে থাকবে । আমার সাথে রোজ খেলবে এই ভাবে । রাণীর কথা কি আর অমান্য করা যায় সব ছোট বড় ঝিনুকেরা, মস-ফার্ণ, শাঁখেরা  অমনি রাজী হয়ে গেল । তাথৈ তাদের সঙ্গে নিয়ে বাড়ির বাগানের লিলিপুলে ছেড়ে দিল । অনেকদিনের শখ তার পূর্ণ হল ।
অপু, তাথৈ স্কুলে গিয়ে সব বন্ধুদের তাদের নতুন অভিজ্ঞতার কথা বলল ।  স্কুলের টিচারদেরও বলল সব । একজন টিচার দোকানের নাম জিগেস করল । তার অনেকদিনের সাধ চাঁদে যাবার ।  তা তিনি রাস্তা চিনে সেই "থট-শপে" গেলেন । সেখানে গিয়ে চিন্তামণির কাছ থেকে বেগণি রঙের "কিউবিক"  নামের   ক্রিস্টালটি পছন্দ করে কিনে ফেললেন । বুড়োকে টিচার এবার প্রশ্ন শুরু করলেন । আচ্ছা আমি তাহলে সত্যি সত্যিই আমার শখ পূরণ করতে পারবতো এই লজেন্স-ক্রিস্টালের সাহায্যে? যদি না হয় আমার কিন্তু পয়সা ফেরত চাইই-চাই । আমার কোনো বিপদ হবে নাতো?"আরো বললেন " আচ্ছা জলে দিলেই হবে ? এতো মনে হচ্চে গ্যাঁজাখুরির গল্পের মত ।  আমি আবার ফিরতে পারবো তো এই পৃথিবীতে ? ইত্যাদি ইত্যাদি ..."বুড়ো চিন্তামণি বিরক্ত হয়ে বললেন " আচ্ছা বাপু, তোমার যখন এতই চিন্তা তখন কেন আমার দোকানে আসা ? আমি কি আর তোমার মত খদ্দেরের জন্যে সে কোন সূদুর থেকে এই সব লজেন্স নিয়ে এসে বিক্রি করি ?  অপু, তাথৈ এদের মত শিশুরা যাদের আমার কথার ওপর অগাধ আস্থা আর যারা শুধু বিশ্বাস করে আমাকে তাদের জন্যই আমি বেচি । তাই তারা ফলও পায়  । তুমি চাইলে তাই বিক্রি করলাম ঐ বেগণি লজেন্স-ক্রিস্টাল গুলো । এই নাও তোমার পয়সা ফেরত, আমার জিনিস দিয়ে দাও আমাকে"

এমনি করে চিন্তামণির রঙিন দিন গুলো কাটতে থাকে একে একে । হঠাত সে ভাবল আচ্ছা আমিও তো এমন করে পৌঁছে যেতে পারি আমার ড্রিমল্যান্ড স্বর্গপুরের দরজায় । আমার তো কেউ কোত্থাও নেই; আমার জন্যে তো ভাববার ও কেউ নেই; আমি মরে গেলে কাঁদবার ও কেউ নেই; তাহলে দেখি না আমি যদি যেতে পারি চিরকালের মত সেখানে । আর শুনেছি সেখানে গেলে আর জন্ম হয় না । আর যুগযুগ ধরে মানুষের বিশ্বাস এই যে যারা ভাল কাজ করে তারা নাকি স্বর্গে যায় । আর চিন্তামণি জ্ঞানত: কোনো খারাপ কাজ করেনি কোনোদিন । মিথ্যে বলেনি, লোক ঠকায়নি, মানুষকে হিংসে করেনি । তাহলে সেও তো পৌঁছে যেতে পারে সেই স্বর্গদ্বারে ।  ব্যাস, যেই ভাবা অমনি খুলে গেল একটা বয়ামের ঢাকনা । বয়ামের লেবেলে লেখা "কসমিক",  রঙ টুকটুকে লাল  । বয়ামের মুখ থেকে উঠে আসছে একটা স্টিক আর তার থেকে ছোট ছোট লাল ফুল স্বচ্ছ পাপড়ি মেলে চিন্তামণির দিকে চাইছে, ঘরের  মধ্যে জোছনার  আলো চুঁইয়ে পড়েছে সেই পাপড়িতে আর ফুল গুলো ঝলমল করে উঠছে, যেন বলছে "এস, চল আমার সাথে, তোমার এবার যাবার সময়" চিন্তামণি উঠে ফুলের কাছে গেল| হাতে করে একটা ফুল নিল আর এক গ্লাস জলে ফেলল সেই লজেন্স-ক্রিস্টালের লাল ফুলটিকে ; সঙ্গে সঙ্গে চিন্তার বুদবুদেরা চিন্তামণিকে নিয়ে চলল স্বর্গের দিকে ।  যেতে যেতে সে ছুঁয়ে দেখল আকাশের নীল রঙ, পাহাড়ের গাছেদের সবুজ রঙ , সূর্যের হলুদ-কমলা রঙ মেখে নিল বেশ করে । একটা বিশাল গুহার মধ্যে পৌঁছাল সে । যেখানে একধারে ঝরণার জল ওপরে সাদা কিন্তু ঝরে পড়ার মুখে নীল । কোথাও বা ফোয়ারা উঠছে মাটি থেকে লাল রঙের, লাল নীল ফুলেরা ফুটছে সবেমাত্র তাদের কুঁড়ি থেকে । ফুলের পাপড়ি যে এই ভাবে চোখের সামনে খোলে তা দেখে চিন্তামণির আনন্দ আর ধরে না ।  এইবার সে দেখতে পেল বিশালাকার ঝুলন্ত স্ট্যালাকটাইটের পাহাড়। মনে পড়ে গেল কেমিস্ট্রি ব‌ইতে ছবি দেখেছিল । কিছুদূর গিয়েই চোখে পড়ল স্ট্যালাগমাইটের প্রোথিত স্তম্ভ । ক্রিস্টাল নিয়ে গবেষণা করতে করতে , পড়াশুনো করতে করতে অনেক দিনের ইচ্ছে  ক্যালসিয়াম কার্বনেটের ক্রিস্টালাইজেশনের কারসাজিতে প্রাকৃতিক ভাবে তৈরী স্ট্যালাকটাইট আর স্ট্যালাগমাইটের দেশে যাবার । এই বুঝি তার স্বর্গের ঠিকানা । সে সত্যি আজ পৌঁছে গেল স্বর্গের আঙিনায় ।

ছোটদের ম্যাগাজিন "ইচ্ছামতী" তে প্রকাশিত

"টাইটানিক বৃষ্টি"


সেদিন তিন্নি পার্কে বসেছিল দাদুর সাথে। উঠল ভীষণ ঝড়, পড়ল বাজ, চমকাল বিদ্যুতমালা আকাশের গায় । এল বৃষ্টি । আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টি। গাছপালা নতুন বর্ষার জল পেয়ে নেচে উঠল। দাদুর সাথে গল্প হচ্ছিল চাঁদের বৃষ্টির। চন্দ্রযান খবর পাঠিয়েছে জলের, বৃষ্টি ঝরেছে কয়েক ফোঁটা সেখানে । পৃথিবীর সাতসমুদ্রের কত জল তিন্নি তা জানে; মহাসিন্ধুর কত জল বাষ্পীভূত হয়ে বৃষ্টি রূপে তাই ঝরে পড়ে মাটীর বুকে। পার্কের ঘেরা বারান্দার ওপরে উঠে বৃষ্টি দেখল প্রাণ ভরে, ঘুম এল তার চোখ জুড়ে। দাদুর কোলে মাথা রেখে ছোট্ট তিন্নি বৃষ্টির নূপুর শুনতে শুনতে স্বপ্নের দেশে পাড়ি দিল । আকাশের গায়ে ভূগোল ব‌ইয়ের সৌরমন্ডলের ছবি । পৃথিবীর কোল আলো করে দাঁড়িয়ে আছে তিন্নি । একে একে কাছে তার এল বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, আর সবশেষে নেপচুন ।

"বল তোমরা কে কে বৃষ্টি দেখেছ?" তিন্নি প্রশ্ন করে তাদের ।

শান্ত সৌম্য চেহারায় ঠান্ডা মাথায় জবাব দিল বুধ | বললে, "বড্ড গরম, সূয্যিমামার কাছে থাকি, মোটে আরাম নেই, কি যে বল, বৃষ্টি কি তাই জানিনা ।"

ধবধবে ফর্সা রঙের শুক্র বললে, "শুনেছি মেঘ থেকে নাকি বৃষ্টি হয়, কিন্তু আমার কাছে মেঘের অনেক বাড়ি, তাতে বাষ্প নেই, আছে সালফারডাই-অক্সাইড গ্যাস । বৃষ্টি হবে কোত্থেকে? আমি কি ছাই বৃষ্টি দেখেছি!"

এল মঙ্গল। গম্ভীর মুখ করে রেগেমেগে বলল, "জানিনা, জানতে চাইও না ; বৃষ্টি! দূর দূর ! পাথরে, পাহাড়ে, লোহার শরীরে কঠিনে আমি লাল হয়ে গেছি দেখছ, আর তুমি বলছ বৃষ্টি?"

বিশালাকার বৃহষ্পতি মাথা চুলকে উত্তর দিল "জল নেই তো বৃষ্টি কোথা? হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম সেথা ।" জানো? আমার এখানে তো শুধু হিলিয়ামের সাইক্লোন দেখি, বৃষ্টি তো দেখি না

সবশেষে এল শনি । "বল তিন্নি কি বলবে। অনেক কিছু বলার আছে তোমায় । তুমি যে দেশে থাকো তার নাম পৃথিবী। তুমি অনেক ভাগ্যবতী যে ওখানে আছ । আমার চারপাশ ভীষণ ঠান্ডা, জানো? বরফের কুচি আমার চারধারে বলয়ের মত আমাকে বেষ্টন করে রেখেছে । আর আমার চাঁদের নাম টাইটান । তা তো তুমি জানো তিন্নি । সেখানে দেখেছি বৃষ্টি আমি ; সেদিন বর্ষা নেমেছিল শনির ঘরে, শনির দেশে, শনিগ্রহে। অতি ঠান্ডায় সব মিথেন গ্যাস তরলায়িত হয়ে ঝরঝর করে ঝরে পড়ে বাদলরূপে,ঠায় পড়তেই থাকে | যাকে তোমরা পৃথিবীর বুকে বৃষ্টি বল আমি তাকে শনির বুকে সৃষ্টি বলি । আহা কি সুখ কি সুখ! তোমায় যদি দেখাতে পারতাম তিন্নি। তুমি কি যে খুশি হতে!"

শনিদাদার কথা শুনে ভয় পেয়ে ইউরেনাস আর নেপচুন পিছু হাঁটল। মুখে তারা তিন্নির সামনে রা'টি কাটল না । যেতে যেতে বলল ফিস ফিস করে

"বৃষ্টি কিরে? কেমন তর?
বৃষ্টি কোথা? কেমন বড়?
বৃষ্টি নামে জলের ফোঁটা,
বৃষ্টি মানেই বাদল ফোটা"

"দাদাই, দাদাই," ঘুম থেকে ধড়মড়িয়ে উঠে তিন্নি বলল দাদুকে আমাকে টাইটানের গল্প বলবে ? আমি মিথেনের বৃষ্টির গল্প শুনব । তখন পার্কের মধ্যে বৃষ্টি-বাদল গেছে টুটে । আকাশে রামধনু উঠেছে । বৃষ্টির জলের ফোঁটায় আলোর প্রতিসরণে কি করে রামধনু সৃষ্টি হয় সেই গল্প শুনতে শুনতে দাদুর সাথে তিন্নি বাড়ি ফিরল সে বিকেলে। কিন্তু দাদাই যত তাকে রামধনুর গল্প বলে তিন্নি তত‌ই টাইটানের মিথেন বৃষ্টির গল্প শুনতে চাইল।
ছোটদের ম্যাগাজিন "দিয়ালা"য় প্রকাশিত