৮ মার্চ, ২০১৬

নারীনক্ষত্র

 
ছবি- ইন্টারনেট 


দলে যাচ্ছে কি সমাজের পরিস্থিতিটা? আজ কি তবে আকাশের বাকী অর্দ্ধেকটা থেকে উড়ে যাচ্ছে সামিয়ানাটা? চাঁদের আলো কি পড়ছে আজ অন্ধকার বাকী অর্ধেক আকাশের গায়ে? দেখতে পাচ্ছি কি আমরা নারীর এগিয়ে চলা? নাকি পিছিয়ে পড়ছি আরো? এগিয়ে তো চলেইছি প্রতিনিয়তঃ। নয়ত কি মেরি কম, সুনীতা উলিয়ামস, কল্পনা চাওলার গল্প উঠে আসছে বারেবারে? রবিঠাকুরের কথায় বলতে ইচ্ছে করে


সে কি রহিল লুপ্ত আজি সব জন পশ্চাতে? ল‌উক বিশ্ব কর্মভার মিলি সবার সাথে।

নূতন যুগ সূর্য উঠিল, ছুটিল তিমির রাত্রি তব মন্দির অঙ্গন ভরি মিলিল সকল যাত্রী





আজ আমার নারী আমার সম্পূর্ণ আকাশ।

আন্তর্জাতিক নারীদিবস পালন তো একটা ছুতো। আসলে আমরা মেয়েরা মনেপ্রাণে রোজ‌ই চাই এমন দিন। আমাদের কেউ মাথায় তুলে রাখুক। আমাদের জন্যে ভাবুক, তাই তো আজ জমায়েত হয়েছি এই অঙ্গনে, শরতচন্দ্রের বাসভবনে। যে কথাসাহিত্যিক মেয়েদের নিয়ে লিখেছিলেন কত কত গল্প, উপন্যাস, শুধু তাদের স্থান দিয়েছেন তাঁর লেখনিতে। তাদের পারিপার্শ্বিক টানাপোড়েন এখনো আমাদের বারেবারে মনে করায় । লিঙ্গগত এই বৈষম্যের জন্য আমাদের গ্রামেগঞ্জের অন্দরমহলে কি দেখতে পাইনা সুষ্পষ্ট একটা বিভাজন? এখনো কি ঘটা করে পুত্রসন্তানের জন্য পায়েসের বাটি, মাছের মুড়োটি তুলে রাখা হয়না? ছেলের পড়াশোনায় বেশী খরচাপাতি করা হয়না? তারপর সেই কথা? আহা, ও ছেলে, ও কি আর রান্নাঘরে যেতে পারে অথবা ওর কি এসব করার কথা? এর পরেও রয়েছে কণ্যাভ্রূণ হত্যা, মেয়ে পাচারের মত ঘটনা। যে কোনো বয়সের মেয়েকে স্থান কাল পাত্র ভেদে শারীরিক উত্পীড়ন, ডাইনি সন্দেহে হত্যা করা কিম্বা বৃদ্ধ মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার মত মর্মান্তিক ঘটনা।


আর আমার বাংলার নিতান্ত সাদামাটা দশভুজা, আটপৌরে মেয়েরা? কন্যাশ্রী, কন্যা সমৃদ্ধি, বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও কত কত প্রকল্প! কত কত গালভরা নাম! কিন্তু তার প্রাপ্য সম্মানটুকুনি? তাকে পুরুষের সমকক্ষ হবার জন্য এগিয়ে দেওয়া? তাকে সুরক্ষা দেওয়া আরো কত কিছু আছে ভাববার! কিন্তু আজো যেন মা হওয়াতেই তার চূড়ান্ত সার্থকতা। আবার ভাবি মাসমাইনে নিয়ে বাড়ি ফিরে সম্মানের সঙ্গে ঘরে ফেরাটাই কি তার মুক্তির পথ, অর্ধেক আকাশ পাওয়া? নিজের পায়ে দাঁড়ানো নারীও কিন্তু যথাযোগ্য সম্মান পায়না সর্বদা। নারীর লড়াই তার নিজের সঙ্গে। সর্বদা অর্ধেক আকাশ জিতে নেবার জন্য।




তোমার জন্যে সিঁথেয় সিঁদুর, মঙ্গলসূত্র গলায়

ঝমঝমিয়ে চুড়ির সাথে, নোয়া, শাঁখাপলায়।

তোমার জন্য ঘোমটা দেওয়া, আলতাপাটি রাঙা

হাতের তেলোয় মেহেন্দিতে খয়েরডুমো ভাঙা।

তোমার জন্যে ভোরে ওঠা, অগোছালো আঁচল

সব সামলে, নাভিঃশ্বাসে ধেবড়ে চোখের কাজল।

তুলসীতলায় প্রদীপজ্বালা, নিতসিঁদুর ব্রত

বিশ্বাসে মিলায় বস্তু এঁয়োস্ত্রীদের মত।





হঠাত মনে পড়ে গেল সুকান্ত ভট্টাচার্যের রানার কবিতার অমোঘ সেই লাইনটি! রানার গ্রামের ডাকহরকরা, রাতের পর রাত ক্লান্তিহীন, মানুষের সুখদুঃখের খবর সে পৌঁছে দেয় দোরে দোরে, কিন্তু তার খবর কে রাখে?

আমি বলি? রূপনগরের কন্যা, পছন্দপুরের গৃহবধূ কিম্বা নিশ্চিহ্নপুরের মা'টি? সেই কোন ভোর থেকে উঠে রাত অবধি সামাল দেয় সংসারে। ক্লান্তিহীন শরীরকে বুঝতেও দেয়না তারা। তারা জানে তাদের থকে যেতে নেই। এটাই জীবন। জোয়াল কাঁধে নেবার জন্য‌ইতো জন্মেছে তারা। পুরুষরা সারাদিন রুটিরোজগারের পর বাড়ি এসে তাদের চোখ রাঙাবে, ভুলভ্রান্তি হলে ক্ষমা করবেনা, সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু সেই মা, গৃহবধূ অথবা কন্যাটি সেই স্বামী বা সংসারের মঙ্গলের জন্য‌ই সন্ধ্যেবেলায় তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালবে, আবার রাতেরবেলায় শরীরে ঘামের গন্ধ দূর করতে ঠান্ডা জল ঢেলে এসে ডিওস্প্রে ছড়িয়ে নেবে স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্য। স্বামী হয়তবা বলবে ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্সের খবর, এই তো তোমার আসল সিকিউরিটি। সব একাউন্টেই তার বৌয়ের সংগে জয়েন্ট নাম, আইদার অর সার্ভাইভার ! কিন্তু রূপনগরের কন্যা, পছন্দপুরের গৃহবধূ কিম্বা নিশ্চিহ্নপুরের মা'টির মনের খবর কে রাখে? সে মন তো খুব ঠুনকো। সুদৃশ্য কাঁচের জিনিস বন্দী বাক্সের অন্তঃপুরে, তার বাইরে লেখা আছে, Glass inside, handle with care! সেটা ক'জন খেয়াল রাখে?



আমার নারী গ্রীষ্মঋতুতে জ্বর এলে জলপটি

আমার নারী বর্ষা-শরতে শাড়ি তার ধুলোমুঠি । 

আমার নারীটি মায়ের মতন আধফোটা ভেজা শিউলি

ল্যাজাতে-মুড়োতে ঢেকেছে লজ্জা, কনে দেখা মেঘ গোধূলি  ।

আমার নারী হেমন্তে ধান নবান্নে  পোষ-লক্ষ্মী

পিঠেপার্বণে কয়লার আঁচে ওম্‌ নেওয়া যেন পক্ষী  ।

আমার নারী নিরাভরণা সে শাঁখায় সিঁদুরে লাবণী 

খড়কে ডুরেতে আটপৌরে সে বৈশাখী বা শ্রাবণী  ।

নিজের জন্যে বাঁচতে শেখেনি আমার শ্রীমতী নারী

ভাললাগাটুকু ঝেড়ে ফেলে বলে "ভালো আছি আমি  তোমারি"  !

আমার নারী বৃষ্টিশাড়িতে, উঠোনে ইলশেগুঁড়িতে

শীতরোদ্দুরে নকশীকাঁথায়, উলের গোলায় কাঁটাতে  ।

আমিও যে সেই নারীর কন্যা  খোলা বসন্ত উঠোনে

লজ্জা চাউনি আমার অঙ্গে  ভালোবাসার সে ফাগুণে । 




আজকেও কি মেয়েদের হয়ে কথা বললে আমাদের "নারীবাদী" আখ্যা দেওয়া হবে? সেই কবে পুরাণের গল্পেও তো দেখে আসছি অপ্সরাদের মুণিঋষিদের হাতে লাঞ্ছিত হবার ঘটনা। রামায়ণে দেখেছি সীতার অপমান, পাতাল প্রবেশের মত ঘটনা। মহাভারতে দেখেছি দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, কেশাকর্ষণের মত নারকীয় ঘটনা। এখনো কেন এইযুগে বসে যে দেখতে হবে এসব সেটার উত্তর কেউ দেয়না আমাকে।



আবারো আজকের দিনে স্মরণ করি কবিগুরুকে...


দেশ দেশ নন্দিত করি মন্দ্রিত তব ভেরি, আসিল যত বীরবৃন্দ আসন তব ঘেরি

দিন আগত ঐ ভারত তবু ক‌ই ?

স্থান দাও, স্থান দাও, দাও দাও স্থান হে জাগ্রত ভগবান হে, জাগ্রত ভগবান

প্রাণ দাও, প্রাণ দাও, দাও দাও প্রাণ হে জাগ্রত ভগবান হে, জাগ্রত ভগবান ।