১৫ নভে, ২০২০

ভাইফোঁটার পুরাণকথা এবং বিজ্ঞান / ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

যম, সংযম, যমুনা, যমজ... আগে কখনো ভাবিনি এই শব্দগুলোর সঙ্গে ভাইফোঁটার কত গভীর সংযোগ। সূর্যপত্নী সংজ্ঞা সূর্যের সঙ্গে সহবাসকালে তাঁর পতির তেজোদৃপ্ত শরীরের ছটা, উত্তাপ, তেজময় বিকিরণ সহ্য করতে না পারায় চোখ বুঁজে র‌ইলেন। ক্রুদ্ধ সূর্যের সংজ্ঞার এহেন সংযম অপছন্দ হল। গালিগালাজ করলেন পত্নীকে! "কোথায় আমার মত পুরুষের সঙ্গে রতিলিপ্ত হয়ে শীত্কারে, আনন্দে চূড়ান্ত সম্ভোগময়ী হবে তা নয় চোখ বুঁজে রয়েছো! সংযম পালন হচ্ছে? ঠিক আছে, আমার ঔরসে তোমার গর্ভের সন্তান হবে আলোকবিহীন অর্থাত ঘোর আঁধারের মত কালো।' 

সাহিত্যের ধারাপাতে সংযোজিত হল নতুন শব্দ যার নাম সংযম। আর সূর্যের অভিশাপে সংজ্ঞার একজোড়া কালো পুত্রকন্যা জন্ম নিল যাদের নাম হল যম এবং যমী। ।  

সূর্যপত্নী সংজ্ঞা সূর্যের দাপট সহ্য করতে না পেরে পৃথিবীতে ফিরলেন । সেইসঙ্গে তার বিকল্প হিসেবে তার ছায়াকে রেখে এলেন সূর্যের কাছে, দেবলোকে।ব্যাস! সূর্য ছায়ার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হলেন। ছায়ার গর্ভে যখন সূর্যের সন্তান এল তখন সংজ্ঞার পুত্রকন্যা যম-যমীর সঙ্গে ছায়া বৈমাত্রেয় সুলভ ব্যবহার করতে থাকলেন । ছায়ার কুমন্ত্রণায় সূর্য নিজপুত্র যমকে নরকে এবং কন্যা যমীকে মর্ত্যে পাঠিয়ে দিলেন । 

সাহিত্যের অভিধানে একজোড়া সহজাত সন্তানের নাম একত্রে যমজ। সূর্যতনয়া, রবিনন্দিনী, সূর্যজা যমুনার অপর নাম কালিন্দী বা যমুনাও প্রবাহিত হল কালীয় নামক সর্পের বিষোদগারে কালো বর্ণের নদীরূপে । যম হলেন কালদন্ড হাতে নরকে মৃত্যুর দেবতা রূপে।  

বহুদিন অতিবাহিত হলে যম এবং যমী উভয়ে একে অপরের বিচ্ছেদে কাতর হলেন। যম দেখা করতে গেলেন যমীর সঙ্গে । আর সেদিনটি ছিল কালীপুজোর দু-দিন পর কার্তিক অমাবস্যার শুক্লাদ্বিতীয়া তিথি যা আজো ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা যমদ্বিতীয়া নামে খ্যাত। ভাইয়ের জন্য যমী নানাবিধ খাদ্যদ্রব্যের আয়োজন করে, উপহার সাজিয়ে নাকি বসেছিলেন তাই ঐদিনে বোনেরা ভাইদের জন্য এভাবেই পালন করে থাকে। কারণ একটাই। ভাইয়ের মঙ্গলকামনায়, ভাইয়ের পরমায়ু কামনায়।  

ঋগ্বেদ বলে যম আর যমী মায়ের শরীরের বাইরে এসেও নাকি মাতৃজঠরের একত্র অবস্থানকে ভুলতে পারেনা। তাই যমী যমকে কামনা করে বসেন। বলেন, আমাকে তোমার সন্তান দাও।  যম কিন্তু নিরুত্তর। প্রত্যাখ্যান করেন আপন সহোদরা যমীকে। 

অথর্ববেদে বলে যমুনা নাকি যমকে বলেছিলেন মায়ের পেটে তো তাঁরা একত্রে দশমাস পাশে শুয়ে ছিলেন অতএব এখনো তিনি সেভাবেই যমকে শয্যাসঙ্গিনী রূপে কামনা করেন কিন্তু যম বোনের মুখে এমনটি শুনে যেন তড়িতাহত হলেন। বলেন, জন্মসূত্রে এক পরিবারের হলে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করা গর্হিত কর্ম।   

যদিও প্রাকবৈদিক যুগে ভাই-বোন বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছে তাই যমীর এরূপ ধারণা অমূলক নয়।  কিন্তু যম সেই ধারণাকে এক্কেবারে আমল না দিয়ে চলে যান।  আজ আমাদের শরীরবিজ্ঞান বলছে ভাই-বোনে বিবাহ হওয়াটা সত্যি সত্যি যুক্তিযুক্ত নয় । ভারত সহ পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে এই বিবাহ চালু ছিল কিন্তু জিনগত সমস্যা এই বিবাহকে নিরাপদ করেনা অনেকাংশেই। সুস্থ মাতৃত্ব আসেনা। এলেও জিনগত ত্রুটি নিয়ে সন্তান আসে তাদের যা পরবর্তী জীবনে দুর্বিষহ। ভয়ানক সব রোগের স্বীকার হয় ভাইবোনের মিলনের ফলস্বরূপ সন্তানটি। সে যুগে এত বিজ্ঞান ছিলনা। ছিলনা হেমাটোলজির পরীক্ষানিরিক্ষা। মানুষ বুঝতনা জিনতত্ত্ব ও জৈবরহস্য। সেই বিয়ের ফলশ্রুতি মোটেই সুখকর হয়নি তাই বুঝি ধীরে ধীরে বিদায় নিয়েছে সহোদর-সহোদরার বিবাহ।  সেই প্রাচীন যুগে এক পরিবারের, একই পিতামাতার দুই পুত্রকন্যার বিবাহ হলে হয়ত নিজেদের রক্তের শুদ্ধতা বাঁচিয়ে রাখাটা হত একটি‌ই কারণে। পিতার সম্পত্তি যাতে নিজের পরিবারের মধ্যেই সযত্নে রক্ষিত হয়। কারণ বিবাহ নামক সামাজিক বন্ধন হল সম্পত্তি রক্ষার্থে উত্তরসুরীর উৎপাদন। 

কিন্তু রক্তের রসায়ন দেবা ন জানন্তি কুতো মনুষ্যাঃ । এ জটিল তত্ত্ব গবেষণায় উঠে এসেছে। রক্তের শুদ্ধতার পরিবর্তে রক্ত দূষণ কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তা জানিয়েছে বিজ্ঞান। কিন্তু এ তত্ত্ব জানতেন না যমরাজ। ডার‌উইনের থিয়োরি অফ ইভোলিউশানে  সারভাইভ্যাল অফ দ্যা ফিটেষ্ট বা যে সমর্থ সেই বাঁচবে সেই অনুসারে কালক্রমে ভাই-বোনের এই বিবাহে ভাটা পড়ে গেছে। পরে এসেছে আরো থিয়োরি। রক্তসূত্র ধরে যেমন এসেছে আমাদের বংশগোত্র। এখনো আধুনিক সমাজেও আমরা স্বগোত্রে তাই বিবাহ দিতে কেউ কেউ নারাজ হ‌ই।  আর তাই বুঝি যমীর ভাইকে বিবাহের আবেদন ও বোনকে বিবাহে যমের এই প্রত্যাখানের লোকায়ত কাহিনীটি প্রচার করে ধীরে ধীরে মর্যাদার আসনে বসানো হয়েছে ভাইফোঁটাকে আর সমাদর করা হয়েছে ভাইবোনের মধুর সম্পর্কটিকে।  

যা হয়েছে তা সমাজের ভালোর জন্যেই। যম-যমীর সুস্থতার জন্যেই। আর ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়েছে ভাইবোনের বিয়ে। তাই বুঝি যমী মনকে বুঝিয়ে বলে,  যমের অখন্ড পরমায়ু আশা করে। তাকে পেট পুরে তার মনের মত পদ রেঁধেবেড়ে খাওয়াও, তাকে উপহার দাও..শুধু এই বিয়ে থেকে শতহস্ত দূরে থাকো।  

কালের স্রোতে ধুয়েমুছে সাফ হল ভাইবোনের যৌনতার গন্ধ মাখা সম্পর্ক। আর ঠাঁই পেল স্বর্গীয় সুন্দর এক অমলিন, পবিত্র সম্পর্ক।  যম যমীর ফোঁটা নিয়ে পরম তৃপ্তি পেলেন। আর সমাজ স্বীকৃতি দিল  ভাই-ফোঁটা, ভাই-দুজ, ভাই-বীজ, ভাই-টীকা বা ভাই-তিলকের মত পবিত্র উত্সবকে।  

পুরাণ এই উত্সবের অন্য ব্যাখ্যা দেয়। কার্তিকমাসের শুক্লা দ্বিতীয়ার দিনে শ্রীকৃষ্ণ দোর্দ্দন্ডপ্রতাপ নরকাসুর বধ করে ফিরে এসেছিলেন। তাঁর বিজয়-সম্বর্ধনায় ভগিনী সুভদ্রা যে উত্সবের আয়োজন করেন তার নাম‌ই ভাইফোঁটা।  

*তাই আবহমান কাল ধরে বোনেরা ভাইদের মঙ্গল কামনা করে ফোঁটা দেয় ভাইয়ের শত পরমায়ু, উন্নতি কামনা করে।

কিন্তু কখনো কি শুনেছি আমরা এর উল্টোটা? অর্থাৎ ভাই তার বোনকে ফোঁটা দিয়ে বোনের সুস্থতা, সুরক্ষা এবং সার্বিক উন্নতি চাইছে? সকালে ধোপদুরস্ত হয়ে মাঞ্জা দিয়ে, ধুতির কোঁচা দুলিয়ে ভাইরা যুগে যুগে বলে এল, "ভাইফোঁটা নিতে যাচ্ছি"। কিন্তু "বোনফোঁটা দিতে যাচ্ছি" ও তো বলতে পারত তারা।

তাই এস আমরা চালু করি সামগ্রিক "ভাইবোনফোঁটা"। দু-তরফের পক্ষ থেকেই ফোঁটা চালু হোক!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর ভাইফোঁটা...

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেও ভাইফোঁটার অনুষ্ঠান হত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'ভাইফোঁটা' অনুষ্ঠানের উষ্ণতা ও আন্তরিকতা খুবই পছন্দ করতেন। তিনি তাঁর ভগিনীদের কাছ থেকে ভাইফোঁটা নেবার সুযোগ থেকে কখনও বঞ্চিত হতে চাইতেন না। সৌদামিনী, শরৎকুমারী, সুকুমারী, স্বর্ণকুমারীর ও বর্ণকুমারী দেবীরা নানা সময়েই দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, সৌমেন্দ্রনাথ প্রমুখ দাদা-দের ভাইফোঁটার দিন ফোঁটা দিতেন এবং সেই পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন রবীন্দ্রনাথও।

স্বর্ণকুমারী দেবী রবীন্দ্রনাথ-কে খুবই স্নেহ করতেন এবং ভালোবাসতেন ও তাঁর আদরের ভাই-কে ফোঁটা দিয়েছেন। স্বর্ণকুমারী দেবী তাঁর কাব্যগ্রন্থ 'গাথা' তাঁর আদরের ভাই 'রবি'কে উৎসর্গ করে লিখেছিলেন -

"ছোট ভাই'টি আমার

যতনের গাঁথা হার কাহারে পড়াব আর?

স্নেহের রবিটি, তোরে আয়রে পড়াই,

যেন রে খেলার ভুলে ছিঁড়িয়া ফেল না খুলে,

দুরন্ত ভাইটি তুই, তাইতে ডরাই।"

কবি'র জীবনের শেষ ভাইফোঁটার আবেগঘন অনুষ্ঠানের অসাধারণ বর্ননা আছে রাণী চন্দ'র "গুরুদেব" বইটিতে।

"ভ্রাতৃদ্বিতীয়া এল। গুরুদেবের এক দিদিই জীবিত তখন - বর্ণকুমারী দেবী। তিনি এলেন আশি বছরের ভাইকে ফোঁটা দিতে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। আজও ভাসে ছবি চোখের সামনে - গৌরবরন একখানি শীর্ণহাতের শীর্ণতর আঙুলে চন্দন নিয়ে গুরুদেবের কপালে কাঁপতে কাঁপতে ফোঁটা কেটে দিলেন। দুজন দুপাশ হতে ধরে রেখেছি বর্ণকুমারী দেবীকে। ফোঁটা কেটে তিনি বসলেন বিছানার পাশে চেয়ারে। ভাইয়ের বুকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। খুব রাগ হয়েছে দিদির ভাইয়ের উপরে। কালিম্পঙে গিয়েই তো ভাই অসুস্থ হয়ে এলেন, নয়তো হতেন না - এই ভাব দিদির। ভাইকে বকলেন, বললেন, দেখো রবি, তোমার এখন বয়স হয়েছে, এক জায়গায় বসে থাকবে, অমন ছুটে ছুটে আর পাহাড়ে যাবে না কখনো। বুঝলে?

গুরুদেব আমাদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন, বললেন, না, কক্ষনো আর ছুটে ছুটে যাব না; বসে বসে যাব এবার থেকে।

সকলের খিলখিল হাসিতে ঘর ভরে উঠল।"


মেয়েদের উপলক্ষ্য করে কোনো অনুষ্ঠানই নেই। একটি মাত্র অনুষ্ঠান সাধভক্ষণ তাও সে কোনো গৌরবের নয় সবাই জানি ।বেশ কয়েক বছর আগে তসলিমা নাসরিন তাঁর কোলকাতার বাড়িতে বোনফোঁটার অনুষ্ঠান শুরু করেন।গতবছর দেখলাম এই ফেসবুক পাতায় বেশ কয়েক জোড়া বোনের বোনাফোঁটার ছবি।বেশ লাগলো কিন্তু। মেয়েরা যদি এইভাবেই আরো কাছাকাছি এসে যায় পরস্পরের প্রতি আরো সহানুভূতিশীল হয়ে উঠবে।

যাইহোক আমাদের সিস্টারহুড জারি থাকুক।সব বোনেদের পক্ষ থেকে আমার পরম বন্ধু কবি তৃষ্ণা বসাক এর বোনফোঁটা মন্ত্রটি পড়ছি 

বোনফোঁটার মন্ত্র 

তৃষ্ণা বসাক 


(অমৃত আর গরল মথিয়া 

এসে গেছে আজ ভগিনীদ্বিতীয়া)


নতুন যুগের নতুন সুর।

বোন না যেও দূর।।

বোনের কপালে দিলাম ফোঁটা ।

ভায়েরা প্লিজ দিও না খোঁটা।।

যমুনাকেও দিলাম ফোঁটা ।

যম দেখে ভয়ে কাঁটা! 

তুমি আমার  বোন হয়ো।

বছর বছর ফোঁটা নিও।।

২৪ আগ, ২০২০

রসনাপুরাণ

 

রসনাপুরাণ / ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় ( লেখাটি প্রকাশিত গুরুচণ্ডালী ই-ম্যাগাজিনে) 

আমার মায়ের বাবা এবং বাবার মা দুজনেরি জন্ম বাংলাদেশের খুলনা জেলার সাতক্ষীরায় তবে কর্ম কোলকাতায় । তাই এহেন "আমি"র  সেই অর্থে শিরা উপশিরায় বাঙাল ও ঘটি উভয় শোণিত স্রোত বহমান । অন্তত: আমার শ্বশুরালায়ের মন্তব্য তাই ।


উপাদেয় পোস্তর বড়ার স্বাদ পেতে আমাকে ছুটতে হয় বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার বন্ধুর বাড়িতে । আর নারকোল-বড়ি দেওয়া মিষ্টি মোচার ঘন্ট খাবার জন্যে আমাকেই ছুটতে হয় রান্নাঘরে । আমাদের ঘটি বাড়ির হেঁশেলের বেশির ভাগ রান্নাবান্নাই শর্করায় পুষ্ট । কুটিঘাটের মেয়ে আমার দিদিমা ছিলেন খাস ঘটিবাড়ির মেয়ে । বিয়ের পরদিন বাঙাল শ্বশুরবাড়ির রান্নায় চিনি ছড়িয়ে খেয়েছিলেন । 


সেইকারণেই  বুঝি আমার ঠাকুরদাদার মুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনেছি । সব ক্রিয়াপদে এলুম, গেলুম, খেলুম শুনে বন্ধুরা হেসে বলত এই এল হালুম হুলুম করতে । কি আর করি ! জন্ম-দোষ যে! তাই বুঝি আমি মিসডি কথাও বলতি পারি আবার আট ডেসিবেল ক্রস ক‌ইরা ঝগড়া করতিও পারি । আমাদের সব রান্নায় যেমন মিষ্টি, তেমনি ঝাল। অভিনব এক কেমিস্ট্রি হয়েছে জানেন?  ইলিশ আর চিংড়ি দুইয়ের সঙ্গতে  আমার রসনা পুরাণ জমে গেছে । আমি যেমন রাঁধতি পারি ঝরঝরে ভাত তেমন ভাজতি পারি ফুলকো ফুলকো নুচি। তবে ঘটির ওপর আমি পক্ষপাতদুষ্ট । কারণ ঐ শোণিত স্রোতের সংকরায়ন ।  


ছোট্টবেলা থেকে শুনে আসছি খুলনা হল পশ্চিম আর পূর্ববাংলার সীমানার কাছে অতএব আমরা বাঙাল ন‌ই। আরে বাবা তাতে আমারই বা কি আপনারই বা কি! আমি বাঙালী ঘরে জন্মেছি সেটাই আমার কাছে বড় কথা। রবিঠাকুর, নজরুল, মাছের ঝোলভাত, কড়াইয়ের ডাল-আলুপোস্ত আমার শয়নে-স্বপনে-জাগরণে।  আমি বাঙালী বলেইতো বাংলাভাষা আমার সহজাত  আর বাংলার শিল্প-কলা-কৃষ্টি আমার রোমকূপের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সিঁধিয়ে আছে। কি ঠিক বলছি তো না কি? 


আমার একরত্তি একাদশী দিদিমা, ঘটিবাড়ির মেয়ের বাঙাল ঘরে বিয়ে হয়ে আসাটা যেন তার জীবনের ভোল পাল্টে দিয়েছিল রাতারাতি। ঐটুকুনি মেয়ে বিয়ের কি বোঝে! সে আবিষ্কার করতে শুরু করেছিল গ্রাম্য পরিবেশের মাধুর্য্য। গাছের ফলপাকড়, টাটকা শাকসব্জী, নদী-পুকুর থেকে মাছ ধরে আনা সেই বিবাহিতা কিশোরীর কাছে যেন বিস্ময় তখন। শহর বরানগর তখন অনেকটাই আটপৌরে গেঁয়োপনা ছেড়ে সবেমাত্র শহুরে হতে শিখেছে। কাজেই প্রকৃতি, সবুজের মাঝে অবাধ বিচরণ সেই কিশোরীর জীবনে অধরা ছিল । শ্বশুরবাড়িতে সকাল হতেই ঘি অথবা কাঁচা সরষের তেল ছড়িয়ে আতপ চালের ফেনাভাত খাওয়া তার কাছে অপার আনন্দ বয়ে আনত। বরানগরে তিনি শিখেছিলেন সকালের প্রাতরাশ হিসেবে পাঁউরুটি-মাখন খাওয়া অথবা লুচি-পরোটা কিম্বা রুটি তরকারী । বাংলাদেশে এসে সেই ফেনাভাত তার কাছে অবাক করা এক ব্রেকফাস্ট সেই মুহূর্তে। দুপুর হলেই পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরা ছিল তার কাছে এক আশ্চর্য্যের বিষয়। 


ননদীনিরা গরম গরম জ্যান্ত ট্যাংরা মাছভাজা আর তেল দিয়ে একথালা ভাত  নতুন বৌকে বসিয়ে আদর করে খেতে দিয়েছিলেন জলখাবারে। দিদার মুখে কতবার শুনেছি এ কথা। নদীর টাটকা মাছ আর অমন যত্ন দিদার মাও বুঝি করেনি তাকে..তিনি বলতেন।


এইভাবে পূর্ব ও পশ্চিমবাংলার সারটুকুনি আর উভয় পরিবারের আত্মীয়তায় গড়ে ওঠে আমাদের পরিবার। আমরা এর মধ্যে দিয়েই বড় হলাম, শিখলাম আর এখনো ভাবতে থাকলাম....পূর্ববাংলায় সেই আমাদের মরাই ভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, পুকুরভরা মাছের কথা। দুইবাংলার সংস্কৃতি তখন মিলেমিশে একাকার । জমে গেল ঘটি-বাঙালের রসনা, হেঁশেল বেত্তান্ত ।  আর এহেন ক্ষুদ্র আমি মেলবন্ধন ঘটালাম এপার বাংলা ও ওপার বাংলার সেরা রসনার ।  


বিকেলে ইস্কুল থেকে ফিরে বন্ধুরা সকলে ভাত খেত আর আমরা খেতাম লুচি-পরোটা বা রুটি কিন্তু দুবেলা ভাত নৈব নৈব চ ! কি আর করে বন্ধুরা! ওদের মা ময়দার কাজে মোটেও পটু নন, ভাতের রকমারিতে পটু তাই ঘটির বৈকালিক জলযোগের ময়দা বুঝি ওদের কাছে অধরা । 


ওদের সেই চিতলামাছের মুইঠ্যা একবগ্গা মাছের এক্সোটিক ডিশ ফর গ্যাস্ট্রোনমিক তৃপ্তি । আর কালোজিরে-কাঁচালঙ্কা দিয়া সেই বাদলা দিনের কাদলা মাছের পাদলা ঝোল না খেলে হয় না। আমাদের তার চেয়ে কাতলার কালিয়া, ক্রোকে, দৈ-মাছ, কোর্মা, মাছের পোলাও, মাছের কচুরী, চপ আরো কত বলব ! ঘটি হেঁশেলে শুঁটকি ফুটকির নো এন্ট্রি ! একবার বাঙাল-ঘটির কাজিয়ায় আমার ঠাকুর্দা তার এক বাঙাল বন্ধুকে বলেছিলেন "কচুরী আর রাধাবল্লভীতে যে বিস্তর ফারাক সেটাই জানোনা? আর কি করেই বা জানবে "ময়দার" ব্যাপারে  তোমাদের তো হাঁটুতে খঞ্জনী বাজে। চাড্ডি ভাত চাপিয়েই খালাস তোমরা । জমিয়ে মিষ্টি মিষ্টি নাউ-চিংড়ি খাও । দেখবে মনের কাদা সাদা হয়ে গেছে । এট্টু চিনি ছড়িয়ে কড়াইয়ের ডাল আর ঝিঙেপোস্ত খাও । দিল খুশ হয়ে যাবে । মিষ্টি কথা কি এমনি কৈতে পারি? মিষ্টি মিষ্টি ব্যবহার কি এমনি পারি! সবের মূলে ঐ ঘেটো মিষ্টি" 


বাজার গেছি একবার জ্যাঠামশাইয়ের হাত ধরে । সদ্য কৈশোরে পা দিয়েছি তখন । পুলিশে কর্মরত জ্যাঠামশাই তাঁর চাঁচাছোলা ভাষায় গঙ্গার ঘাটে তাঁর এক পুরোণো সহপাঠীকে বলছেন :

"তোমরা হলে গিয়ে, ইশে "অরিজিনাল দেশি" তাই বলে আমরা অ্যাবরিজিনাল দেশি ন‌ই গো দাদা ! এট্টু ঘুসোচিংড়ির বড়া খেয়ে দ্যাখেন মশাই ! অথবা কষে চিনি দিয়ে ছোলারডাল আর ঐ আপনাগো "ময়দা" মানে আমাগো "নুচি" । চিল্লোতে পারিনা আমরা, আট ডেসিবেল কি সাধে ক্রস করিনা? ভেতরটা সত্যিসত্যি মিষ্টি হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে"


এভাবেই আমি এলুম, দেখলুম, ছিলুম বলে । আমের সময় মিষ্টি আঁব খেলুম, হ্যান্ডলুম পরলুম ! নাউচিংড়ি রাঁধলুম নঙ্কা দিয়ে। সাদা ময়দার ফুলকো নুচি ভাজলুম ছোট্ট ছোট্ট। ডালের সঙ্গে নেবু ডললুম। এতে নজ্জার কিছু নেই । ঘটি রান্নার সোশ্যাইটি জুড়ে, হেঁশেলের ঝুলকালিতে শুধু একটাই কথা । রান্নায় মিষ্টি। জলখাবারে ময়দা আর রাতে রুটি। 


আমাদের ঘটিবাড়িতে জন্মেস্তক দেখছি চিংড়ির অবাধ ও অনায়াস গতায়ত। বারোমেসে বাজারের ফর্দে মহার্ঘ গলদা নয় তবে লবস্টারের বাবালোগ অর্থাত ঘুসো/কাদা/ফুল চিংড়ি থেকে কুচো কিম্বা ধানক্ষেতের জ্যান্ত চাবড়া চিংড়ি থাকবেই।  


চিংড়ি আর কাঁকড়া মাছ নয় বলে আর সম্পূর্ণ অন্যজাতের সজীব বলে বুঝি ওদের এত স্বাদ। আঁশটে ব্যাপরটা নেই। আছে এক অন্য রসায়ন। 


বাড়িতে কাউকে নেমন্তন্ন করে খাওয়ানো মানেই চিংড়ি মালাইকারি যেন অন্যতম প্রধান পদ ঘটিবাড়িতে। 


আজকাল হোটেলে ডাবচিংড়ি নামে একটি মাগ্যির ডিশ সার্ভ করা হয়। এমনকিছু আহামরি নয়, শুধু দামে গালভারী। দেখনদারির পণ্য। অথচ আজ থেকে একশো বর্ষ আগে আমার মামারবাড়িতে এই রান্না হত ডাব দিয়ে নয়। নারকোলের শাঁসসুদ্ধ দুটি মালার মধ্যে বাগদাচিংড়ি সর্ষে-পোস্ত-কাঁচালঙ্কা বাটা দিয়ে মেখে, কাঁচা সর্ষের তেল, হলুদ, লঙ্কা, নুন দিয়ে নারকোলের মালায় রেখে এবার নারকোলটিকে বন্ধ করে সেই ফাটা অংশে ময়দার পুলটিশ লাগিয়ে মরা উনুনের আঁচে ঐ নারকোলটি রেখে দেওয়া হত ছাইয়ের ভেতরে । ঘন্টা দুই পরে তাক লাগানো স্বাদ ও গন্ধে ভরপুর ভাপা চিংড়ি নাকি খুঁড়লেই বেরিয়ে আসত নারকোলের শাঁসের সঙ্গে। চিংড়ির মালাইকারীও এভাবে রাঁধা হয়েছে বহুবার। সেখানে সর্ষের বদলে পিঁয়াজ, আদা-রসুন গরমমশলা বাটা আর তেলের বদলে ঘি দেওয়া হত। 


চিংড়ি মাছের কথা উঠলেই মনে পড়ে যায় আমার এক রগুড়ে মামার কথা। ওনাদের সময় কত্ত বড় চিংড়ি খেয়েছিলেন তা বোঝানোর জন্য উনি একবার বলেছিলেন "জানিস? এ আর কি চিংড়ি? আমাদের সময়ে যে চিংড়ি খেয়েছি তার খোলাগুলো ডাস্টবিনে পড়ে থাকলে তার মধ্যে দিয়ে কুকুরের বাচ্ছা ঢুকতো আর বেরুত।"     


পুঁইশাক বাদ দিলে আমাদের মোচা, লাউ, ওলকপি, ওল, ফুলকপি, ডুমুর, প্যাঁজকলি সবের অন্যতম অনুপান হল চিংড়ি। চিংড়ি ছাড়া এসব সবজী রাধুমই  না। আবার পটল-আলু পোস্ত চচ্চড়ি তে আমার ঠাম্মা চিংড়ি দেবেন ই।  দিদিমার সিগনেচার ডিশ ছিল চিংড়ির বাটি চচ্চড়ি। দাদু তো শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো প্রায় বলেই ফেলেছিলেন  "এই বাটি চচ্চড়ি পেলে সব লণ্ডভণ্ড করে চলে যাব" । না এটা আমি বললাম। উনি বলতেন, "থাক, এটা আর খাব না। মাথার বালিশের পাশে নিয়ে শোব। খেলেই ফুরিয়ে যাবে।" 


তবে চিংড়ির পাশাপাশি ইলিশ‌ও তাই বলে ঘটিবাড়িতে ব্রাত্য এমন নয়। বাবার মুখে শুনেছি আড়িয়াদহের গঙ্গায় নামতেন তেল মেখে। কোমরের গামছায় চার আনা পয়সা বেঁধে। সাঁতরে ওপার থেকে ফেরার পথে মাঝিদের ধরা  ইলিশ কিনে নৌকোয় চড়ে বাড়ি ফিরেই মা'কে ভাত বসাতে বলতেন। তবে ঘটিবাড়িতে ইলিশ মানে বাঙালদের কালোজিরে, কাঁচালঙ্কা বা বেগুণ দিয়ে পাতলা ঝাল নয় । ভাতের মধ্যে কৌটোবন্দী ভাপা অথবা সর্ষে ইলিশ। কৌটোর মধ্যেই নুন মাখানো ইলিশের গাদা-পেটি সর্ষে, কাঁচালঙ্কা বাটা, কাঁচা সর্ষের তেল আর বেশ কয়েকটি চেরা কাঁচালঙ্কার সাথে জারিয়ে ভাত ফোটবার সময় হাঁড়ির মুখে মিনিট দুয়েক রেখে দিলেই এই অমূল্য পদ তৈরী।  আমার রন্ধন পটিয়সী দিদিমা তার বিশাল সংসারে বিরাট এক হাঁড়ির মুখে বিশাল এক কচুপাতার মধ্যে মাছগুলিকে ম্যারিনেট করে পাতাটি সুতো দিয়ে বেঁধে ভাত ফোটবার সময় হাঁড়ির মুখে রাখতেন। মা বলত, সে ভাপা ইলিশের নাকি অন্য স্বাদ। আমি একটু ইম্প্রোভাইজ করে এই কায়দাটি করি লাউপাতায় মুড়ে এবং ননস্টিক প্যানে অর্থাত পাতুড়ির স্টাইলে। যাই করো এ কানুর তুলনা নেই। কাঁচা তেলঝাল, ভেজে ফোড়ন দিয়ে ঝাল, গায়ে মাখামাখা হলুদ সর্ষেবাটার ঝাল, বেগুন দিয়ে বাঙালদেশের পাতলা ঝোল...সব‌ই যেন বর্ষায় দৌড়তে থাকে গরম ভাতের সঙ্গে।


আবার ইলিশের মুড়ো দিয়ে পুঁইশাক, কুমড়ো, মূলো, আলু দিয়ে অমৃতসম ছ্যাঁচড়া। এই ছ্যাঁচড়াতে পাঁচফোড়ন, কাঁচালঙ্কা আর নামানোর সময় সর্ষেবাটা। কড়াইয়ের গায়ে লাগা লাগা হয়ে রান্নাঘরময় পোড়া পোড়া গন্ধ বেরুবে তবেই সার্থক সে ছ্যাঁচড়া। দাদু মায়েদের নিয়ে পিওরসিল্ক কিনতে গিয়ে বলতেন শাড়ির কোল আঁচল থেকে একটি সুতো বের করে দেশলাই কাঠিতে ধরে যদি ছ্যাঁচড়াপোড়া গন্ধ বেরোয় তবেই সেটা আসল রেশম। এখন বুঝি তার অর্থ।  মেছো গন্ধে ভরপুর ছ্যাঁচড়া কাঁটা-অপ্রেমীদের কাছে যত‌ই কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর মত বস্তু হোক মাছের মাথা মিশে তা প্রোটিনে ভরপুর এক রসায়ন। তাই বুঝি পিওরসিল্কে সেই প্রোটিন পোড়া গন্ধটাই প্রকট। 


তবে দুই বাংলার পুণ্য তিথিতে শাক-সুক্তোয় শুরুয়াত হলে মন্দ হয় না মধ্যাহ্নভোজন। শুভদিনে ডালের সঙ্গে পাঁচ ভাজাও আবশ্যিক। দুই বাংলার ফোড়ন বিনে রান্না অচল। দুই বাংলাতেই  মূলো বিনে কিম্বা ঘি ছাড়া শুক্তো নৈব নৈব চ। 


আর দুই বাংলাতেই 


" বৃষ্টি মানেই পিটারপ্যাটার বৃষ্টি মানে টুপটাপ

বৃষ্টি মানেই মায়ের হাতে ভুনি খিচুড়ির উত্তাপ।" 


 


গোবিন্দভোগ চাল আর শুকনোখোলায় ভেজে রাখা সোনামুখ ডাল মেপে ধুয়ে ভিজিয়ে ডুমো ডুমো ফুলকপি, কুচোনো গাজর, বিনস আর ফ্রোজেন মটরশুঁটি দিয়ে আদা, ট্যোম্যাটো কুচি কষিয়ে খিচুড়ির রেসিপি কিন্তু এক মোটামুটি। জিরে আর ধনের গুঁড়োর সঙ্গে সামান্য লাল লঙ্কার গুঁড়ো। সামান্য ঘিয়ে তেজপাতা, জিরে আর গোটা গরমমশলার ফোড়ন। চড়বড়িয়ে উঠলেই আদা-মশলার পেষ্ট। সবশেষে চালডাল দিয়ে নাড়াচাড়া, ওলটপালট। এবার সব্জী দিয়ে মেপে জল। ঢাকা খুলে নেড়েচেড়ে নুন্, মিষ্টি, হলুদ ছেটানো। পরিবেশনের আগে ঘি ছড়িয়ে গরমমশলা গুঁড়ো।তবে বাঙ্গালদের এই খিচুড়িকে জব্দ করেই লাবড়ার তুমুল যোগাড়।আমরাও শিখে গেছি । ঘটিদের পাঁচমেশালি চচ্চড়ির মত। ঘটির ছ্যাঁচড়া আর বাঙালের লাবড়া কে কার অপভ্রংশ তা জানা নেই। খিচুড়ির সঙ্গে লাবড়া অথবা ছ্যাঁচড়া কে কার অলংকার!  


ঘটি বাঙাল উভয় হেঁশেলের গ্রীষ্ম-বর্ষার অগতির গতি ছেঁচকি রান্নার চল খুব। চাইনিজদের স্টার ফ্রাই আমাদের অল্প তেলে ফোড়ন দিয়ে ঢাকাচাপা দিয়ে ঝিরিঝিরি করে কাটা সবজী কে ন্যায়দম খাওয়ানোর নাম ছেঁচকি। আলু, পটল, ফুলকপিই হোক কিম্বা কুঁদরী অথবা ঢেঁড়শ। হাতের কায়দায়, গ্যাসের ঢিমে আঁচে সব সবজীর আস্ফালন নিমেষেই ফুরোয়। তাপের চাপে সব্বাই জব্দ হয়ে কেঁচোর মত গুটিয়ে যায়। আর যত গুটোবে তত স্বাদ হবে সেই ছেঁচকির। বাঙালীর আদি অকৃত্রিম কালোজিরে মেথি, শুকনোলংকা বা কাঁচালঙ্কা অথবা পাঁচফোড়ন, রান্নাঘরের সব্বোঘটে কাঁঠালিকলা। 


ছেঁচকির কথায় মনে পড়ে আমার যশুরে জেঠিমা শাশুড়ির লাউয়ের খোসার ছেঁচকির কথা। আগেকার গিন্নীদের সব রান্নার শেষে উনুনের ঢিমে আঁচে বসানো হত এই ছেঁচকি। আমরা এখন গ্যাস সিম করে বানাই। তবে উনুনের নিবু নিবু মরা আঁচে সেই ছেঁচকি বসিয়ে জ্যেঠিমার নাইতে যাওয়া আর ফিরে এসে বারেবারে নেড়েচেড়ে তাকে ন্যায়দম খাওয়ানো...আর তাতেই বুঝি ছেঁচকির স্বাদ বেড়ে যাওয়া। সরু সরু করে কাটা লাউয়ের খোসা ধুয়ে নিয়ে হালকা ভাপিয়ে রাখতে হবে। প্রেসারে নয় কিন্তু। তারপর কড়ায় সামান্য সর্ষের তেলে কালোজিরে, শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে সেই খোসা সেদ্ধ দিয়ে নুন দিয়ে চাপা দিতে হবে। তারপর নাড়া আর চাড়া। যতক্ষণ না লাউয়ের খোসা স্প্রিং এর মত গুটিয়ে যায়। তখন সামান্য চিনি, পোস্তদানা। লঙ্কা গুঁড়ো, অল্প আটা আর বেসন আলগোছে ছড়িয়ে আরো কিছুক্ষণ স্টারফ্রাই। দরকারে একটু তেল ছড়ানো যেতে পারে। শুকনো ভাতে গরম গরম এই খোসার ছেঁচকির বিকল্প নেই। আমাদের সব শাকভাজাই এমন। জল পড়বেনা মোটেও। তেলের মধ্যে ফোড়ন আর শাক দিয়ে জব্দ করা হবে। নেতিয়ে পড়বে লকলকে টাটকা সবুজ শাক। শুকনো ভাতে অমৃত। একেক রকমের স্বাদ একেক শাকের। 


ছেঁচকি ছাড়া বাঙালীর আরেক অগতির গতি মাগো তুমি পোস্তবাটা। এই কাঁচা পোস্তবাটার যেমন গুণ তেমনি তা দিয়ে একথালা ভাত উড়িয়ে দেওয়া যায়। সঙ্গে যদি থাকে কাঁচা সর্ষের তেল, পিঁয়াজ কুচি আর কাঁচালঙ্কার ছোঁয়া। আর রেঁধে নিয়ে আলুপোস্ত, ঝিঙেপোস্ত কিম্বা পটল পোস্ত, আর পোস্তর বড়া বানিয়ে খেতে পারলে কথাই নেই। গরমের দিনে নরম মেনু। পোস্ত বাটার সঙ্গে লাউশাকের ডগা সেদ্ধ অথবা গোটা পটল সেদ্ধ দিব্য যায়। তবে সঙ্গত হিসেবে কাঁচা সরষের তেল, নুন আর লংকা মাস্ট।


এমনি আরেক গ্রাম্য খাবার হল শীতের রাঙা মূলো, ওল বা কচু ভাতে। এই দুইয়ের সঙ্গে কাঁচা লংকা দিয়ে সরষে বাট, সরষের তেল আর নারকোল কোরার কেমিস্ট্রি অনবদ্য জমে। তবে বাঙাল বাড়ির কচুবাটা দারুণ খেতে। 


আমি ছোটবেলায় খুব রোগা ছিলাম আর আমিষের বড় একটা ভক্ত ছিলাম না মোটেও। তাই বাবা প্রায়ই বলতেন  


মাংসে বাড়ে মাস

ঘৃতে বাড়ে বল,

দুধে শুক্র বাড়ে

শাকে বৃদ্ধি মল। 


আবার বাড়িতে কারোর সর্দিকাশি হলেই বাবা ব্যাগ দুলিয়ে চলতেন মাংসের দোকানে। তখন মাংস বলতে আমরা খাসির মাংস‌ই বুঝতাম। মুরগী ঢুকত না ঠাম্মার জন্য। বলতেন একটু মাংসের ঝোল ভাত খা। সব সর্দ্দি সেরে যাবে। আমার ঠাকুরদা নাকি বাবাদের ছোটবেলায় বলতেন  


"নস্য মাংস উপবাস তিনটিতে করে শ্লেষ্মা নাশ" 


আর পরে যখন মাংস খেতে ইচ্ছে করত, বাবা দোহাই দিতেন রেডমিটের ওপর জারি নিষেধাজ্ঞা, কোলেস্টেরলের কচকচানি এইসব আর মা আমার পক্ষ নিয়ে বলতেন, 


"জমিদারের দাঁত পড়ল, পাঁঠা বলি বন্ধ হল"  


আর জামাইষষ্ঠীতে সেই প্রবাদটি "জামাইয়ের জন্য মারি হাঁস গুষ্টি শুদ্ধ খায় মাস” ?


কোথায় লাগে মশাই হাঁস, মুরগী, কচ্ছপ, কোয়েল ?


খাসি‌ই বলুন আর পাঁঠাই বলুন এ কানুর তুলনা নাই। অবিশ্যি ভাগাড় কাণ্ডের পর সে খাসিও নেই আর নেই সেই পাঁঠাও। রেডমিট হারিয়েছে তার কৌলীন্য। তবুও খুঁজে পেতে বাজারে গিয়ে কাটিয়ে এনে খেলেই বুঝি সার্থক মাংস মঙ্গল।   


জানেন তো ? কালীঘাটের বলিপ্রদত্ত পাঁঠার মাংসে পিঁয়াজ রসুন পড়েনা। জিরেবাটা, হিং, আদা আর গরমমশলা দিয়েই তৈরী হয় সুপক্ক উৎকৃষ্ট মাংস। তবে আমরা বাড়িতে সেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একধরণেরই মাংসের ঝোলে অভ্যস্ত। হয় মায়ের হাতের গরগরে লাল মাংস কিম্বা নিজের ব্যস্ততায় সাদামাটা স্ট্যু। আবার রবিবারের রাতের মাংসে সকাল থেকে টক দৈ, পেঁপে কুরোনো আর সব মশলা মাখিয়ে দমে বসানো রেওয়াজি খাসির কষা মাংসের আরেক স্বাদ। আর এখন কেটারারের দেখাদেখি মাটন রেজালা বাঙালী বাড়িতে ঢুকে পড়েছে।অথবা খুব খাটতে পারলে হরা মাটন মনোহরা। মানে সবুজ মাংস। কষে ধনেপাতা, পালংশাক বাটা দিয়ে মাটন।


তবে মাটন রান্নার মদ্যা কথাটা হল ঠান্ডা জল নৈব নৈব চ। এটা জেনেছিলাম অবিশ্যি আদর্শ হিন্দু হোটেলে। আর আমার মায়ের একটা ভাল টিপ্‌স হল


"মাছ ধুলে মিঠে, মাংস ধুলে রিঠে"


তাই বাজার থেকে কিনে এনে মাত্র একবার ধুলেই যথেষ্ট। মা অবিশ্যি প্রচুর সরষের তেল দেয়। মাঝেমাঝেই সেই তেল ওপর থেকে ডিক্যান্ট করে আমি রেখে দিই পরদিনের ডিমের কারি বা ঘুগনির জন্য। সে ঘুগনি বা এগ কারির  স্বাদ অনবদ্য।

২০ আগ, ২০২০

কি চেয়েছি আর কিপাইনি

 আমি চেয়েছিলাম স্বাধীনতা। পাইনি। আমি চেয়েছিলাম খোলা চুলে বিয়েবাড়ি যেতে। পারিনি। আমি চেয়েছিলাম বুকের কাছে ফ্রিল ছাড়া ফ্রক পরতে। পরতে দেওয়া হয় নি। এ ছিল টিন-বেলার দুঃখের কিস্‌স্যা । সবে তে বসানো হত টেকশো। মা বলত আমার ভালোর জন্য। বাবা বলত কথা শুনলে লক্ষ্মী মেয়ে বলবে সবাই। 

আমি চেয়েছিলাম জৈব রসায়ন বিজ্ঞানী হতে। আত্মীয়স্বজনের প্ররোচনায় বাড়ির সবচেয়ে "কালো মেয়ের" বিয়ে দিয়ে দিলেন বাবা। বিশ্ববিদ্যালয়ে র‍্যাঙ্ক করেও আমি বঞ্চিত হয়েছিলাম গবেষণা থেকে। আবারো করের বোঝা। 

বিয়ের পরেও স্বাধীনতা পাইনি। এক রক্ষণশীল পরিবার থেকে আরেক রক্ষণশীল পরিবারে এলাম। ভেবেছিলাম  নদীর ওপারে অনেক সুখ। তেমনি বিশ্বাস ছিল আমার। সেই বিশ্বাসে জল ঢেলে দিল শ্বশুরবাড়ির মাথারা। আগুণকে সাক্ষী করে নেওয়া ব‌উ তার স্বামীর পাশাপাশি বারান্দায় দাঁড়ালে, শোবার ঘরে দরজা আঁটলে নাকি অশালীন। 

তবে আমি যা চাইনি তা সত্যি পেলাম একদিন। তাই হিসেব মিলোতে চাইনা আর। এসব কি চেয়েছি আর কি পাইনির টানাপোড়েনে বিদ্ধ্বস্ত না হয়ে সোজা হাজির হয়েছিলাম সব পেয়েছির দেশে, আমার লেখালেখির জগতে। 

৭ আগ, ২০২০

বাইশের সবুজায়ন



ঠাকুরের মৃত্যু হয়না। তিনি চির সবুজ উদ্ভিদের মত। বেঁচে থাকেন আমাদের মধ্যে, আমাদের জীবনে, যাপনে, জন্মে, মরণে। বেঁচে ওঠেন তাঁর লেখায়, গানে, কবিতায় বারেবারে।  

আজ অরণ্যমেধ যজ্ঞের সামিল হয়ে মানুষ যখন পরিবেশ সচেতনতার বাণী আওড়ায় তখন মনে পড়ে বাইশে শ্রাবণের কথা। মরণশীল রবিঠাকুরের মৃত্যুদিন বাইশে শ্রাবণকে তার আশ্রমের বৃক্ষরোপণের দিন হিসেবে ধার্য করেছে বিশ্বভারতী। যেন তিনি ঐ উত্সবের মধ্যে দিয়ে নবজীবন লাভ করেন প্রতিবছর। ১৯৪২ সাল থেকে এমনটি হয়ে আসছে অথচ বিষয়টির ওপর বিশেষ আলোকপাত দেখিনা।  

শ্রাবণের ধারায় সিক্ত মাটিতে উদ্ভিদ তার সঞ্জিবনী শক্তি পায় ও ধীরে ধীরে  মহীরুহে রূপান্তরিত হয়। তাই তার নবীন জীবন বরণের এই উত্সবে কবির গতজীবন স্মরণ-মননের এবং বৃক্ষের নবজীবন বরণের। শান্তিনিকেতনে বিগত এই এতগুলি বছর ধরে কত নামী মানুষের হাতে পোঁতা বৃক্ষের তালিকাসূচি পাওয়া যায় । শ্রাবণ যেন দিনের শেষে যেতে গিয়েও যেতে পারেনা। বাইশেও তাকে নতুন করে ফিরে পাওয়া আমাদের। প্রকৃতিপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে ছিলেন। তাঁর ছিন্নপত্রে তার উল্লেখ পাই আমরা। 


কবির  কথায় "এই পৃথিবীটি আমার অনেক দিনকার এবং অনেক জন্মকার ভালোবাসার লোকের মত আমার কাছে চিরকাল নতুন। আমি বেশ মনে করতে পারি, বহুযুগ পূর্বে তরুণী পৃথিবী সমুদ্রস্নান থেকে সবে যখন মাথাতুলে উঠে তখনকার নবীন সূর্যকে বন্দনা করছেন তখন আমি এই পৃথিবীর  নূতন মাটিতে কোথা থেকে এক প্রথম জীবনোচ্ছ্বাস গাছ হয়ে পল্লবিত হয়ে উঠেছিলেম।"

বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানের সূচনা কবি প্রথম করেছিলেন তাঁর জন্মদিনে। আর কেন এই উত্সব সেই কারণ হিসেবে কবি বলেন" পৃথিবীর দান গ্রহণ করবার সময় মানুষের লোভ বেড়ে উঠল। অরণ্যের হাত থেকে কৃষিক্ষেত্রকে সে জয় করে নিলে, অবশেষে কৃষিক্ষেত্রের একাধিপত্য অরণ্যকে হটিয়ে দিতে লাগল। নানা প্রয়োজনে গাছ কেটে কেটে পৃথিবীর ছায়াবস্ত্র হরণ করে তাকে নগ্ন করে দিতে লাগল। তার বাতাস হল উত্তপ্ত, মাটির ঊর্বরতার ভান্ডার নিঃস্ব হল।"


এই কথা মাথায় রেখেই বৃক্ষরোপণ বা বনমহোত্সব্ বা তাঁর ভাষায় "অপব্যায়ী সন্তান কতৃক মাতৃভান্ডার পূরণের কল্যাণ উত্সব"।   

তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। কবির পরিবেশ বান্ধব মনের কোণে জেগে থাকা কত ইচ্ছে পূরণ হয়নি। তাঁর ইচ্ছেগুলোর সুবিচার হয়েও হয় নি। বিচারের বাণীগুলি নীরবে, নিভৃতে কেঁদেছে। সোনাঝুরির খালপাড়ে কত চাঁদ-সূয্যি উঠে অস্ত গেছে। আশ্রমের আম্রকুঞ্জ থেকে ছাতিমতলা অবধি কত গৃহবাসী দ্বার খুলেছে। কত বসন্ত, কত পৌষ দেখেছে। গোয়ালপাড়া থেকে তালতোড়, ফুলডাঙা থেকে শ্যামবাটিতে কত জনসমাগম হয়েছে। খোয়াইহাটে কত কত কাঁথা বাটিকের পসরা সেজেছে। ভুবনডাঙায় কত টেরাকোটার ঢোলক, নোলক নাড়াচাড়া হয়েছে । কত আউল বাউল উজাড় করে গেয়ে উঠেছেন মন প্রাণ ঢেলে। হৃদমাঝারে তবুও ধরে রাখতে পারলনা তাদের কবিগুরুকে । একরত্তি কোপাইয়ে যে জল সেই জলই রয়ে গেল যেন। আজ তিনিও পণ্য। বসন্ত উৎসবে, পৌষ মেলায় তাঁকে বেশী করে স্মরণ, মনন, তাও নিজেদের স্বার্থে। বৃক্ষরোপণ আজও হয় বাইশে শ্রাবণে তবু আরও সবুজায়ন হয়েছে কি? শান্তিনিকেতনের চারিপাশে আবর্জনার দূষণ কমেছে কি? গুরুকুলে শিক্ষার মান বেড়েছে কি? বিশ্বভারতী তেমন করে কবির ঠাটঠমক আর ধরে রাখতে পারল কই? 



তথ্যসূত্রঃ রবীন্দ্রনাথ ও মানুষ ছিলেন, আবদুস শাকুর ( দীপ প্রকাশন্ )

২৪ জুল, ২০২০

"বৃষ্টি"

শেষমেশ শ্রাবণের শেষ শুক্রবারে রিলিজ করতে চলেছে এবছরের সেরা ছায়াছবি "বৃষ্টি"। করোনাকালের আগেই শ্যুটিং এর কাজ শেষ হয়েছিল তাই রক্ষে। ছবিতে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন নায়ক মেঘ আর নবাগতা বর্ষা। ঠিক আগেকার সাদাকালো যুগের রোমান্টিক জুটি যেন! দারুণ পিকচারাইজেশন ! সবুজ ধানক্ষেতে হাঁটুজলে ঢলঢলে চাষীবৌ ধানচারা হাতে ...বেশ বোল্ড ড্রেসে অতিথিশিল্পীর ভূমিকায়। এই সিনটির জন্য একটু দেরী হল সেন্সর বোর্ডএর ক্লিয়ারেন্স পেতে। বর্ষা আর মেঘের প্রেমের দৃশ্য গুলো জাস্ট ফাটাফাটি, মানে মীরের ভাষায় অসাম শালা । চলবেই এই ছবিটা । মাস দুই কেন জনপ্রিয়তার শিখরে সাদরে শততম দিনও পার করে সগৌরবে শত সপ্তাহও পাড়ি দেবে মনে হচ্ছে । তাহলেই তো প্রোডিউসার শ্রাবণকুমার রাজা ! এই ছবির পরিচালক মৌসুমি কে দিয়ে তাঁর পরের ছবি নিয়েও ভাবছেন। নীল আকাশের থ্রিডি পর্দা মাত হলে তবেই নতুন ছবির মহরত এ হাত দেবেন ! ভাবনাচিন্তা শেষ।বলাই বাহুল্য পরের ছবিতেও মুখয় কুশীলবের ভূমিকায় মেঘ আর বর্ষাই থাকছেন।

করোনার সব ঝামেলা মিটলে আর পুজোর আগেই হাইওয়ে ধুয়ে সাফ্‌ হলে তবেই হবে এক্সিকিউশান। তদ্দিনে পেজ থ্রি কাঁপিয়ে বেড়াক মেঘ আর বর্ষা। তার আগে দেখে আসুন সবাই "বৃষ্টি"। কমার্শিয়াল, স্ল্যাপষ্টিক বা ইন্টেলেক্চুয়াল মুভি নয় । পাতি রোম্যান্টিক মুভি আর অনবদ্য পিকচারাইজেশন।এ ছবির সংগীত পরিচালনায় আছেন মেঘের দুইভাই বজ্র-বিদ্যুৎ। 

৩ জুন, ২০২০

অভিশপ্ত বুধবার


একডজন লকডাউনের বুধবার পেরুবো আজ। গত দুটো বুধবারের সেই অভিশপ্ত ঝড়ের রাতের দগদগে ঘা এখনো শুকোয় নি আমার। আজ আবারো বুধবার এসে পড়লেই বুক চিন্‌ চিন্‌ করছে। আড়ষ্ট হয়ে আছি। তার মধ্যে মৌসুমী বায়ুর কেরালায় প্রবেশ। মনসুন এসে গেলেই অন্যবার মনে হয় একটা ফিলগুড ফ্যাক্টর কাজ করছে আমাদের সবার। ভালো চাষবাস হবে, দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। জিডিপি বাড়বে সেই আশায়। এবার সে গুড়ে বালি। একে একে বিয়ের মরশুম বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য, আষাঢ়, শ্রাবণ পেরিয়ে আবারো ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক মাসে কোনো শুভকাজ হবেনা বাঙালীর। এই বিয়ের মরশুমে প্রচুর বিক্রিবাট্টা হত। গয়না থেকে শাড়ি, উপহার থেকে খাবারদাবার, মুদিখানা মায় দশকর্ম, প্রসাধনী দ্রব্য থেকে তত্ত্ব সাজানোর ট্রে, ফুল থেকে মালা এমন কি ডেকরেটার থেকে কেটারার... সব ছোটো, বড়, মাঝারি ব্যাবসায়ীদের অর্থনৈতিক মাস এই মরশুম। আবারো অপেক্ষা অঘ্রাণের জন্য। এবছর পুজো, দেওয়ালি তেমন জমবে না। কিছুই কেনাকাটি হয়ত হবেনা। পৌষ আবার মলোমাস।  মাঘ-ফাগুনের পর আবারো চৈত্র মাসে কোনো শুভ কাজ নেই। এসব ভাবছিলাম আমার ভাঙা কাচের আদিগন্ত বিস্তৃত সেই দেওয়ালের দিকে চেয়ে।  হঠাত দেখি উল্টোদিকের একটি বাড়িতে বাঁশ বাঁধা হচ্ছে বেশ সমারোহে। আহা! হোক, হোক। বেশ কিছু লোকজন কাজ করছে। বিয়ে হবে হয়ত ঘটা করে। সব‌ই হয়ত পূর্ব নির্ধারিত। রান্নার ঠাকুর, ডেকরেটার, ফুল, মালা, মাছ, মাংস, শাড়ি গয়না সব কিনবে এই বাড়ির লোকজন। আহা! কিনুক, খরচা করুক। কেন‌ই বা তারা বিয়ে দেবেনা? কিন্তু বর্ষা যেন আর না আসে দাপিয়ে। ঝড় যেন আর না আসে অভিসারে। কিন্তু আজ যে আবার বুধবার। সে কি শুনবে?
গতকালই তো বর্ষার প্রিওয়েডিং ফোটোশ্যুট ছিল। ঘন মেঘনীল শিফনশাড়ি, জলের ফোঁটার মত স্পার্কলিং মুক্তোর গয়নায় কাল দারুণ সেজেছিল মেয়েটা। সবচেয়ে সুন্দর ছিল চোখের মেকআপ। ঘনকালো চোখের পাতা ছুঁয়ে আকাশী রং লাইনার।বিয়ের আগের দিন সব মেয়েদের চোখ থাকে এমনই নরম। তারপর সব কেমন বদলে যাবে টুক করে। নরমে গরমে সেই চাউনিই হবে কাল। ভাবী বর মেঘও কাল ছিল অন্যপুরুষ। পরণে ছিল নেভিব্ল্যু রেশমি  শেরওয়ানি।সে ও বুঝি কঠিন হবে আগের থেকে। এই যেমন হঠাত এল করোনা, তার পেছন পেছন আমাপান। আবার আসছে নিসর্গ। কিন্তু আমার মোটেও ভালো লাগেনি বর্ষা আর মেঘের এবারের এই বিয়ের ভাবনা।

আমাদের জীবন কেমন বদলে বেরঙীন হয়ে গেল! সবটুকুনি কবে বর্ষার প্রিওয়েডিং ফোটোশ্যুটের মত আবারো রঙীন হয়ে উঠবে? 

১৪ মে, ২০২০

অতঃপর

সেদিন টিভিতে দুই অর্থনীতি বিশেষজ্ঞের আলোচনা শুনে বেশ ভালো লাগল। তাঁদের একজনের মতে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তদের সঞ্চিত কিছু পয়সাকড়ি রয়েছে। গত দুমাস তারাও খুব সীমিতভাবে নিজস্ব চাহিদা সীমাবদ্ধ রেখে খরচাপাতি করেছে।ব্যুটিকে যায়নি, গয়নার দোকানে, শপিংমলে যায়নি, মাল্টিপ্লেক্সে যায় নি, রেস্তোরাঁয় গিয়ে খায়নি, দেদার স্যুইগি জ্যোম্যাটোতে হোম ডেলিভারি নেয় নি। ক্লাবে গিয়ে মদ্যপান করেনি এমন কি গাড়িতে তেল ভরে কোথাও যায়নি।বিদেশে বা স্বদেশে বেড়ানোর জন্য প্লেন বা ট্রেনের টিকিট কাটেনি।খরচের মধ্যে ওষুধপালা, রোজকার গ্রসারি, ফলমূল, সব্জি, মাছ মাংস, ডিম আর সরকারি অনুদানে কিম্বা কাজের লোকেদের নেট ট্রান্সফারে পয়সাকড়ি পাঠিয়েছে। এবার সেই অর্থনীতিবিদ তাঁদের উদ্দেশ্যে বললেন, তাঁরা এবার জিনিষপত্র কেনা শুরু করুন। কারণ সেই চেইন টা অর্থাৎ তাঁদের টাকাকড়ি বাজারে আসুক। সংসারের জিনিষপত্র কিনেই হোক, কাউকে সাবানের প্যাকেট বা টয়লেট সোপ দান করেই হোক কিম্বা কেক কিনে হোক নিদেনপক্ষে স্যানিটাইজার অর্ডার দিয়েই হোক। তাহলে সেই টাকা বাজারে আসতে থাকলে একটা ভালো দিক তৈরী হবে, আমরা জিনিষ কিনলে সরকারের কিছু ট্যাক্স ঘরে আসবে, বিক্রেতার রেভিনিউ আসবে। ধীরে ধীরে এভাবেই চাঙ্গা হতে পারে কিন্তু অর্থনীতি। সেদিন এক নামকরা মিষ্টির দোকানে ফোন করে বলেছি, দোকান খুললে দোহাই আপনাদের দরবেশ, সন্দেশ করবেন না। রসগোল্লা, পান্তুয়া আর পনীর ভাজা, ছানাভাজা বানান। কাটতি হবে। আমরা কিনে ফুটিয়ে নেব। তিনি বললেন, "ভালো আইডিয়া দিলেন দিদি। দোকান খুল্লেই ফোন করব। দুধ তো নিতেই পারছি না কারিগরের অভাবে"
আমার একটি এসি খারাপ, ওয়াশিংমেশিনের একটি পার্টস লাগবে। কিচেন চিমনি, গ্যাস, ওয়াটার ফিলটারের সার্ভিসিং এর ছেলেটি পয়লা বৈশাখের আগে আসতে পারেনি। বছরে দুবার আসে ওরা। পুজো আর পয়লা বৈশাখের আগে। এসির মেকানিক আসতে চাইছে রিপেয়ারের জন্য । টাকার দরকার তার। কিন্তু আমি আসতে বলতে পারছি না তাকে। কারণ আবাসনে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। চোখে জল এসে গেল আমার। আমার চাই সার্ভিস। তার চাই কাজ কিন্তু আমি অপারগ। যোগব্যায়ামের ছেলেটি বেতন পেয়েই বলল, কেন দিলেন ম্যাম? আমি তো যেতেই পারছি না। বললাম এ দুমাস তো দেব। তারপর পারব কিনা জানিনা। তোমার চলছে কি করে? বলল যেটুকু জমি আছে বারুইপুরে সেটুকুন চাষাবাদ করছি আপাতত। হতদরিদ্র মালি আসতে চাইছে হেঁটে হেঁটে। বললাম টাকা পাঠিয়ে দেব। এসো না এই গরমে আর ঢুকতেও দেবেনা তোমায়। চিন্তা নেই কাজ থাকবে তোমার। মালী, যোগ শিক্ষক কেউ জরুরী পরিষেবা নয়। কিন্তু এই টেকনিক্যাল মানুষ গুলো? অনেক ভেবেচিন্তে তাই ঠিক করেছি ১৭ তারিখের পরে এসি মেকানিক কে আর চিমনি, ওয়াটার ফিলটার, গ্যাস মেকানিককে (একজনই করে এসে তাই রক্ষে) মাস্ক পরে ঘরে ঢোকাবো আর নিজেরাও মাস্ক পরে থাকব অন্য ঘরে বসে।আর তাদের প্রাপ্যটুকুনির সঙ্গে দুতিনশো বেশী দেব এবার।কতদিন বেড়াতে যেতে পারব না, রেস্তোরাঁয় খেতে পারব না। তারা তো আমার দেওয়া সেই সামান্য টাকায় বাঁচুক আগে। সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং মেনে, হাত, মুখ, কাপড়চোপড় সাবানে ধুয়ে, নিজে পরিচ্ছন্ন থাকব। এত ভয় পেলে চলবে না আমাদের। দেশের ও দশের ইকনমির কথা ভেবে।

৬ মে, ২০২০

রবিঠাকুর তোমাকে নিয়ে

ন্মের একশোটা বছর পেরিয়ে সালটা ১৯৬১। অভিজাত মহলে তখন রবীন্দ্রচর্চা হয়। গান, কবিতায় শিক্ষা নেয় তাদের ছেলেপুলেরা। পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়ের জমানা তখন। ঠিক হল রবীন্দ্রজন্মোত্সব পালন হবে। শতবর্ষে সরকারী আনুকুল্যে রাজ্যজুড়ে রবীন্দ্রভবন, রবীন্দ্রসদন, রবীন্দ্র নামাঙ্কিত অডিটোরিয়াম হল।সুলভ মূল্যে সম্পূর্ণ রবীন্দ্র রচনাবলী প্রকাশিত হল মাত্র ৭৫টাকায়।  এই শতবর্ষ উদ্‌যাপনের হিড়িক হল সর্বত্র। কোচবিহার থেকে কলকাতা সহ প্রতিটি জেলাতেই রবীন্দ্র শতবর্ষ পালনে বেশ উত্সবের মেজাজ তখন। জারি হল সরকারী আদেশনামা। সরকারী আদেশনামা পাবার পর প্রতিটি জেলার বিডিওদের মত কোচবিহারের বিডিও এলাহী অয়োজন করলেন। ঢাক ঢোল পিটিয়ে সর্বত্র প্রচারিত হল যে,  আগামী ২৫শে বৈশাখ রবিঠাকুরের জন্মশতবর্ষ পালনের জন্য নির্দ্দিষ্ট সময়ে, নির্ধারিত স্থানে সব মানুষকে আমন্ত্রণ জানানো হল। ঐ দিন সকালে সেই উত্সবে উপস্থিত হয়ে বিডিও সাহেব দেখলেন, মানুষজনের ঢল নেমেছে। অতএব তাঁর প্রচার সার্থক। সমবেত জনতার সিংহভাগ মহিলা। মনে মনে তিনি খুশি হলেন আত্মতুষ্টিতে। কিন্তু অচিরেই তাঁর স্বপ্নভঙ্গ হল। বিডিওসাহেবকে দেখেই মহিলারা জনায় জনায় প্রশ্ন করতে লাগলেনঃ 
" কোথায় তোমার ঠাকুর? কোথায় হবে পূজা? আমরা সেই কখন থেকে দুধভর্তি ঘটি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এসব ঢালব কোথায়?" 
ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল বিডিও সাহেব তাদের বোঝালেন, এ ঠাকুর তোমাদের পুজো করার ঠাকুর নন।   
এনার পুজোর রকমসকম প্রথাগত পুজোর থেকে ভিন্ন। সেই শুনে উপস্থিত মহিলার দল নিরাশ হয়ে একে একে প্রস্থান করেছিলেন।    কারণ এমন ঠাকুরের  পুজোয় তাঁরা অংশ নিতে চান না। দুদিন পর আনন্দবাজার পত্রিকায় ছবিসহ খবরটি প্রকাশিত হয়। কোচবিহারের এই ঘটনার পর থেকেই নাকি রবি নামক ঠাকুরটিকে অভিজাত সরণী থেকে জনতার দরবারে নিয়ে আসার চেষ্টা শুরু হল সেদিন থেকে। মানুষের মনে তাঁকে স্থায়ীভাবে ঠাঁই দেবার প্রক্রিয়াকরণ আজো অব্যাহত। 
তিনি মিশে গেলেন আমজনতার মাঝে। আকাশেবাতাসে আজ শুনি রবীন্দ্রগানের অণুরণন। রবীন্দ্রকবিতায় আজ সাধারণ মানুষ বিভোর। আমাদের ড্র‌ইংরুম থেকে বেডরুম, গাড়ির সাউন্ড সিষ্টেম থেকে ট্রাফিক সিগনাল, কলেজ ফেষ্ট থেকে নবীনবরণ, চলচিত্র থেকে চালচিত্র সর্বত্র তাঁর অবাধ বিচরণ। কারণ তিনি রবীন্দ্রনাথ।    

তথ্যসূত্রঃ রবীন্দ্রনাথ ও মানুষ ছিলেন 
আবদুস শাকুর 
(দীপ প্রকাশন)    

রবিঠাকুর তোমাকে.......

তোমার ভাবনাগুলো আজ আমার সুরে গাইছে । আমার ব্যাথা যখন হানে আমায় তোমার দ্বারে/ তখন তুমিই এসে পথ দেখাও, দ্বার খুলে দাও, ডাকো তারে। ঠিক তখনই ঠাকুর আবারো তোমায় মনে পড়ে।  যখন সেই ছোট্টটি ছিলেম তখন থেকে শুনেছি তোমার নাম । আমাদের পুরোণো বাড়ির সেই তাকের ওপর তোলা ঢাউস রেডিও থেকে, মায়ের কাছে আর স্কুলের রচনার  খাতায় । সেই থেকে হাতে খড়ি ।  তারপর হোঁচট খেয়েছি ব‌ইয়ের পাতায় তোমার সঙ্গে । সাহিত্যের ধারাপাত অধরা তখনো । তারপর বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে  মেঘের কোলে রোদ আর রোদের  উঠোনে কথা-কাহিনীর বৃষ্টি মেখেছি। তখন আমি মাধ্যমিক । জীবনস্মৃতি আমার ভালোলাগায়, মন্দলাগায়  আমার হয়ে উঠেছে । নতুন বছর আর বোশেখ মানেই তোমার পথ চাওয়া ।  কালবোশেখির বিকেল গড়িয়ে আমার গীতবিতানের পাতায় গানভাসি সাঁঝ  । আমারো সদ্য টিন-পেরোনো জীবনসিঁড়ি । ওঠানামা , স্কুলের নবীনবরণ, নতুন বর্ষার সবুজ উত্‌সব, আবার তোমার সঙ্গে  যেন মরুবিজয়ের আনন্দ বুকে, তোমার কবিতার বৃষ্টির ফোঁটা নতুন করে গায়ে মেখে। 

অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য্যের সম্পাদনায় “দশজন নারীকে লেখা রবীন্দ্রনাথঠাকুরের শ্রেষ্ঠ পত্রগুচ্ছ এর এক চিঠিতে  পেলাম তাঁর নিজের জন্মদিনেরই  কথা। 

চিঠিটি লেখা কবি অনুরাগী হেমন্তবালা দেবীকে এবং তারিখ হল ২৩শে বৈশাখ :
জন্মদিনের প্রভাতে ঘুম থেকে উঠতেই নানা লোকের কাছ থেকে নানা উপহার এসে পৌঁছ্ত । তখন জীবনের প্রভাতের আকাশ ছিল উজ্জ্বল, স্নিগ্ধ, স্বচ্ছ; মন ছিল সুকুমার সরস , স্নেহের ছোঁয়া লাগলেই বেজে উঠত মনোযন্ত্রের তার ; তখন জন্মদিনগুলির সমস্ত দিনই গুঞ্জরিত হয়ে থাকত তার রেশ থামতে চাইত না। কারণ তখন পৃথিবী প্রায় ছিল আমার সমবয়সী, পরস্পর এক সমতলে ব‌ইত হৃদয়ের আদানপ্রদানের প্রবাহ; এখনকার জন্মদিন তো আর কাঁচা নয়, কচি নয় ,মন তার সকল প্রত্যাশার শেষসীমায় এসে পৌঁচেছে । সেই আমার অল্প বয়সের ২৫শে বৈশাখের স্নিগ্ধ ভোরবেলাটা মনে পড়ছে ….
শোবার ঘরে নিঃশব্দচরণে ফুল রেখে গিয়েছিল কারা প্রত্যুষের শেষ ঘুম ভরেগিয়েছিল তারি গন্ধে, তার পরে হেসেছি ভালবাসার এই সমস্ত সুমধুর কৌশলে, তারাও হেসেছে আমার মুখের দিকে চেয়ে,
সার্থক হয়েছে এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ । 
শোকাতাপা সেই মানুষটির জন্ম হয় বারেবারে আমাদের অন্তরে। তাঁর লেখায়, গানে। 

৩ মে, ২০২০

দিনগোনা কফি






না না সোশ্যালমিডিয়ায় নেট নাগরিকদের তুফান না তোলা অবধি জানতাম না ডালগোনা শব্দটা কোরিয়ার এক জনপ্রিয় টফির নাম থেকে এসেছে। মৌচাকের মত দেখতে এই টফির নাম ডালগোনা। কফির ইতিহাস জানাচ্ছে ভারতেই এই কফির প্রচলন বেশি। একে সবাই "ফেঁতি হুই" বলত।কারণ তুমুল ফেটিয়ে ফেনার মত করে তা বানানো হয়। কিন্তু এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় লকডাউনে ইচ্ছে কফি, হঠাত কফি কিম্বা আবারও কফির জন্য মন উচাটন হয়েই রাতারাতি সেলিব্রিটি হয়ে গেছে এই ডালগোনা কফি।অতএব ডালগোনা শব্দ কোরিয়া থেকে আমদানি হলেও ঐ সিঙ্গারার মতই কপি পেস্ট ইন্ডিয়ান কফি ছাড়া আর কিস্যু নয়। আমরা ছোটো থেকেই দেখে এসেছি ইনস্ট্যান্ট কফি এভাবে বানানো। মানে কাপের মধ্যে চিনি, কফি আর একটু গরম জল দিয়ে ফেটিয়ে ফেটিয়ে ক্রিমের মত হলেই ফুটন্ত দুধ বা গরমকালে ঠাণ্ডা দুধ ওপর থেকে ঢেলে কিম্বা কাপের মধ্যে দুধ নিয়ে সেই ফেটানো কফি ফেনার মত ওপরে ঢেলে দিলেই এমন ফ্রদি, টেস্টি কফি তৈরী হতে। 
তা বাপু সে ডালগোনাই হোক, চালগোনাই হোক কিম্বা সর্ষে গোনাই হোক আপাতত এর নাম আমি দিয়েছি দিনগোনা কফি। কারণ এখন আমরা সেই দিনটার দিকে সবাই তাকিয়ে রয়েছি যেদিন সত্যিই আমাদের দেশের তথা রাজ্যের কভিড-১৯ গ্রাফটি ফ্ল্যাট হবে, এবং হতেই থাকবে আর সেই আশায় বুক বেঁধে ততক্ষণ লকডাউনের দমবন্ধ করা বিকেলগুলোতে বানাতেই থাকি এই ডালগোনা কফি। আমি যেমন করে বানাই এই দিনগোনা কফি তার রেসিপি দিলাম।

এর জন্য নেসক্যাফের ১০০ গ্রামের একটা খালি শিশি লাগবে। তিনজনের কফি বানাতে আমি যা যা দিয়ে থাকি...
ইনস্ট্যান্ট কফি পাউডার ২ চামচ
চিনি ২ চামচ
ফুটন্ত গরমজল দুচামচ
ফিলটার কফি ২ চামচ ( যেটি দিয়ে কফিমেকারে দুকাপ জলে ব্ল্যাক কফি বানিয়ে নি)
ফুটন্ত দুধ ২ কাপ
ওপর থেকে কোকো পাউডার (ছড়ানোর জন্য)

এবার চিনি, ইনস্ট্যান্ট কফি আর দুচামচ গরম জল ঐ শিশির মধ্যে ভরে, ছিপি এঁটে ডুগডুগি বাজানোর মত নেড়েই চলতে হবে... হবে... এবং হয়...গুলে যেতে যেতে দিন বয়ে যায়...মানে ডালের দানা গুনতে যেমন ধৈর্য লাগবে আর কি...এবার শিশির ভেতরে তৈরী হল ফেনা বা ক্রিম বা ফেটানো মিশ্রণ যাই বল।
এবার লম্বা কফির কাপে প্রথমে ব্ল্যাক কফি, তারপর ফুটন্ত দুধ । তারমধ্যে এবার ওপর থেকে শিশির মধ্যে থেকে উজাড় করে টপ আপ কর সেই ক্রিম দিয়ে আর স্প্রিংকল কর উদার হস্তে কোকো পাউডার। এভাবে বানানো দিনগোনা কফিতে আমি খুব মিষ্টি দিই না বলে একটু তিতকুটে হয় কিন্তু টেস্ট হয় ফাটাফাটি।    

৩০ এপ্রি, ২০২০

লকডাউন নামচা


হুরে পটের বিবিরা আজ বেশ পটু হয়ে গেছে ঘরকন্নায়। সংসার বেঁধে ফেলেছে তাদের আষ্টেপিষ্টে। সকাল সন্ধে খাটুনি তো কম হচ্ছেনা তাদের। সেইসঙ্গে মনোরঞ্জনের খামতি তো আছেই। এই কথায় কথায় সেজেগুজে বেরিয়ে যাওয়া। ছুতোয়নাতায় নিদেনপক্ষে গড়িয়াহাট কিম্বা শপিংমল। মানে দিদিমা ঠাকুমারা যাদের বলতেন সংসারে মন বসেনা তারাও বুক বেঁধে, মন দিয়ে নিত্যনতুন রান্নাবাড়া করে সংসারের সবার মন ভোলাচ্ছেন। 
বুড়ো বাবা মায়েরা দিন পনেরো হয়ে গেলেই অস্থির হতেন, কবে আসবি, কখন  আসবি করে মাথা খেতেন কিম্বা এটা দিয়ে যা, সেটা এনে দে করে। তারাও এখন মাথা খাচ্ছেন না। কপচাচ্ছেন না। 
সিরিয়াল প্রেমীরা? কোথায় গেল তাদের নেশা? আগে জিগাইলে ক‌ইতেন, ও বাবা! ঐ টাইমে আমি কারোর ন‌ই। ঐ এপিসোড মিস হলেই যেন জীবন শেষ তার। তাঁরা এখন বই পড়ছেন, খবর শুনছেন। 
কথায় কথায় চিকেন মাটন প্রেমীরা? বেশ তো পারছেন বাপু দিনের পর দিন ননভেজাসক্তি পরিত্যাগ করে।শুধু ডিম নিয়ে জীবন কাটাতে। 
গেলাসপ্রেমীরা? কথায় কথায় বোতল খুলে বসেন যারা? তাঁরাও তো বেশ আছেন ঘুমিয়ে, ভুঁড়ির ওপর হাত বুলিয়ে? 
আর ছোটোরা? তাদের নিয়ে তো মায়েদের জ্বালার শেষ ছিলনা এদ্দিন। তারাও তো দিব্য সোনা হেন মুখে ডাল ভাত তরকারি যা দিচ্ছেন গিলে নিচ্ছে। 
এদ্দিন যাদের বলতাম হাতে ক্যাশ মাইনে দেবনা। তারা বলত মরে যাব।মাইনের টাকা নাকি হাতে করে নিতেই হয়। তারা দূর থেকে এখন দিব্যি ফোনের মধ্যেই টাকা পাঠিয়ে দিতে বলছে। 
আর এই যে "জুম" অ্যাপে ভিডিও কোরোনা বলে বলে থকে যাওয়া পাবলিকরা? তাদের কথাও সেই ধর্মের কল বাতাসে নড়ার মত সত্যি হয়ে ফিরে এসেছে টিভির পর্দায়। এখন দিব্যি জীবন "জুম-বিহীন"হয়ে গেছে তাদের। অভ্যেস আর শিক্ষেয় কি না হয়। এই যে অশিক্ষে আর কুশিক্ষেয় দীক্ষিতরা আজ একবার পুলিশকে পেটায় তো একবার ডাক্তারবাবুদের পেটায় তারা তো জীবনেও মানুষ হবেই না।যারা ঘুরে ঘুরে বাজার করতে ভালোবাসে তারাও ঠিক এমনি। 
কিন্তু আমরা? মানে যারা পোড় খেতে খেতে, ঘষটে ঘষটে এদ্দূর জীবনটাকে কচলালাম মানে যারা কাছেপিঠে বেড়াতে গেলেও ওডোমস কিম্বা মশার ধূপ সঙ্গে রাখি? কলেরা, জন্ডিস বা আন্ত্রিকের ভয়ে মিনারেল ওয়াটার ছাড়া ফুচকা খাইনা কক্ষনো, অথবা আজন্মকাল ম্যালেরিয়ার ভয়ে আটতলার ওপরেও মশারী টাঙিয়ে শুই? 
সত্যিসত্যি করোনার অশৌচকালে অনেক কিছু লেসেন নিলাম যেগুলি মনে রাখবার মত। তবে যারা শুনবেনা তারা অন্য ধাঁচের, ভবি ভোলার নয়।

২৪ এপ্রি, ২০২০

পত্রলেখা



মুক্তি

তোমায় অনেকদিন দেখিনি। এই ভিডিও কলে যেমন দেখছি তেমন নয়। তোমার ছোঁয়া পেতে চাইছে মন। আজকাল বড়ো মন কেমন করে তোমার জন্য। সেই কবে যেন ছুঁয়েছিলে আমায়।দুজনে পাশাপাশি বসে একে অপরের শ্বাসে-প্রশ্বাসে, হাসি-কান্নায়, সুখের প্রলাপে দুঃখের ঘায়ে একসঙ্গে মলম লাগিয়ে ঠান্ডা হতাম মনে পড়ে তোমার? সেই কাঠি আইসক্রিম নিয়ে নন্দনে গাছের নীচে? কিম্বা মাল্টিপ্লেক্সে মুভি দেখে হতাশ হয়ে কফিশপে ঢুকে? আমার হাত থেকে সিগারেটের বাট টা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তোমার রাগ দেখানো? অথবা আমার গল্পলেখার সময় তোমার খুনসুটি?কতবার গল্পটা টাইপ করে শোনাতেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলে? মনে পড়ে? কপট রাগ দেখিয়ে কথা বন্ধ করে দিনের পর দিন থেকেছি আমরা। তবুও পাশাপাশি তো থাকতাম। এক বিছানা, এক মাদুর, এক সোফা শেয়ার করে রাগে অনুরাগে আড়িআড়ি ভাবভাব খেলেছি আমরা দিনের পর দিন। হোয়াটস্যাপে তোমার বাড়ি ফেরার দেরীতে রাগের ইমোজি দেখিয়েই মনে করিয়েছি রাতে ডিনারের পরে সেই আইরিশ ক্রিম খোলার কথা?ব্যালকনিতে বৃষ্টির ছাঁট এলেই তুমি কেমন গান ধরতে মুক্তি! কতদিন তোমার সামনে বসে গান শুনিনি।কতদিন তোমার সঙ্গে লেকে হাঁটতে যাইনি।তোমার পেটে এক পেগ ভদকা পড়লেই তুমি বলতে এমনি বেঁধে বেঁধে থাকবে আমার সঙ্গে কিন্তু আজ কতদিন হয়ে গেল মুক্তি, আমরা দুজন দুজনকে ছেড়ে ছেড়ে রয়েছি। আমি ভালো নেই মুক্তি। কবে আবার সেই বিদ্যাপতির ভরা বাদর শোনাবে আমায়? কবে আবার তোমার হাতে খাব আমার প্রিয় সেই বালিনিজ কফি? ওপরে ফেনার পরে ফেনা আর নীচে দুধ। আর সেই আলতো হাতে তুমি তার ওপর স্প্রিংকল করে দেবে কোকো পাউডার? আমি লোভ সামলাতে না পেরে একটা ছবি তুলেই ফেসবুকে পোস্ট করে দেব আর উন্মাদের মত গরম সেই কফিতে চুমুক দিয়েই আমার জিভ পুড়িয়ে ফেলব। তুমি তখন সেই জিভ কে আরাম দেবে নিজের মুখের ভেতর পুরে। কিন্তু এখন তা আর হবেনা মুক্তি। এভাবে অনেক দিন তোমায় ছেড়ে আমাকে থাকতে হবে। সেই হ্যারি বেলাফন্টের গানের সেলরের মত। আমার লিটল প্রিন্সেস আমার কাছে আবার কবে আসবে জানিনা কিন্তু আমি তাকে খুব মিস করছি।

" বাট অ্যাম স্যাড টু সে... অন মাই ওয়ে... আই উইল বি ব্যাক ফর মেনি অ্যা ডে...”
আবার আমাদের পাহাড় চুড়োয় সোনাগলা রোদ উঠবে রোজ আর আমি আবারো সেই পালতোলা জাহাজটা নিয়ে তোমার কাছে ফিরবই মুক্তি। বৃষ্টির পর শহরের গোধূলি আকাশে আবারো বিশাল রামধনু দেখব দুজনে একসাথে, শুধু তুমি যদি আমার পাশে থাকো। অনেক দিনের জন্য আমরা একে অন্যের কাছে ফিরব না ঠিকই তবুও তোমায় তেমন করেই ভালোবেসে যাব।
আবার আমরা একসঙ্গে ভীড় বাজারে যাব। মাছ মাংস কিনব। ফিরে এসে রান্না করব দুজনে। হাওয়াতে তখন ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়বে ঠিক আগের মতন, দেখো মুক্তি।সবাই আবার হাসবে, নাচবে, গাইবে। নন্দনে আবারো আমি গল্প কবিতা পড়তে যাব। তুমি ছবি তুলে দেবে। গড়িয়াহাটের ফুটপাথে হকারদের সঙ্গে তুমি বচসা করে বারগেইন করে জিতবে। আমি আওয়াজ দেব তোমায়। দেখো আবার সব পারব আমরা এক সঙ্গে মিলে।
ভালো থেকো মুক্তি। এই চিঠি কোন ঠিকানায় উড়িয়ে দিলাম জানিনা। তবে আপাততঃ প্রযত্নে ফেসবুকে র‌ইল। তোমার উত্তরের অপেক্ষায়।

ইতি
তোমার


২০ এপ্রি, ২০২০

লকডাউন মনোলোগ


কটা জিনিষ খুঁজতে গিয়ে আজ আলমারি খুলেছিলাম অনেকদিন বাদে। কেমন সুগন্ধী আবেশে যেন আবিষ্ট হয়ে গেলাম মূহুর্তের মধ্যে। প্রিয় শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে কিসের যেন মাদকতা! পরতে পরতে চেনা চেনা সব গন্ধ। সাহিত্য আড্ডা থেকে শপিংমল, বিয়েবাড়ি থেকে মাল্টিপ্লেক্স, পিকনিক থেকে আউটিং...সর্বত্র মাড়িয়ে আসা, আমাকে আদরে লেপটে জড়িয়ে রাখা শাড়িগন্ধ আমায় কেমন যেন এক মূহুর্তের জন্য আনমনা করে দিল। আমার জীবন্মৃত আত্মার ভেতর থেকে কেউ যেন বলে উঠল, এমনটা কি ভেবেছিলে কোনোদিনো? জীবনে অনেকবার নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছি কিন্তু দিন দশেকের মধ্যে বাড়ি ফিরে আলমারি খুলে মনে হত আমি বেঁচে আছি। আজ হঠাত মনে হল, কি হবে এমন বেঁচে থেকে? শাড়িগুলো, ম্যাচিং ব্লাউজগুলো আর হরেক কিসিমের হ্যান্ডব্যাগ, পার্স, ক্লাচ সব যেন গিলে খাচ্ছে মনে হল। ওরা কেন এমন কটমট করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে?  সত্যি‌ই তো নশ্বর আমাদের এই তুচ্ছ জীবনটা। শেষসময়ে শুধুই পড়ে থাকবে একমুঠো ছাই। তার জন্য এত্ত আয়োজন আমাদের্? বেশ তো চলছে একমাস ধরে । আমাদের চাহিদার লেখচিত্র হঠাত করেই নিম্নমুখী তাই নয় কি? আমরা শাড়ি-জামা-কাপড়-বেডশিট-পর্দা আরো আরো কতকিছু থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখেছি। এখন শুধুই চোখ যাচ্ছে চালের কৌটো, ডালের ডাব্বার দিকে। ফ্রিজে ক'টা ডিম বা দুধের প্যাকেট পড়ে আছে, আলু-পিঁয়াজের ঝুড়িতে ক'টা আরো আনতে হবে কিম্বা আদা-কাঁচালংকা? নাহ্! এতেই চালিয়ে নেব এই সপ্তাহটা। অথবা হঠাত করে ফ্রিজের কোণায় কুঁকড়ে, অবহেলায় পড়ে থাকা  এক প্যাকেট খেঁজুর কিম্বা একটা স্যুপের প্যাকেট মনটা কে খুশিতে ভরিয়ে দিচ্ছে। এখনো, মানে এই যুদ্ধের ঠিক একমাস আগেও যেমনটি দিচ্ছিল। এই একমাসে কোনোকিছুর পট পরিবর্তন হয়নি আমাদের। শুধু কয়েকটা মৃত্যু ছাড়া। নতুন সংক্রমণ? না কি গোষ্ঠীতে ছড়ালো ফাইনালি? চোখ এখন সেইদিকে শুধু সীমাবদ্ধ।কি হয়, কি হয়! 
পশুপাখিদের জীবনটাই বেশ|আহার, নিদ্রা, মৈথুন ছাড়া অন্য কোনও চিন্তা নেই তাদের। তাদের অতীত স্মৃতি নেই। ভবিষ্যতের চিন্তা নেই | আছে শুধুই বর্তমান। কিন্তু মানুষ তো আমি। তাই বুঝি আলমারি আজ বন্ধ না করে পাখা চালিয়ে হাওয়া খাওয়ালাম বেশ করে। আমার তো ভবিষ্যৎ আছে না কি!    

১৮ এপ্রি, ২০২০

Lockdown Story - 1 / এভাবেও ফিরে আসা যায় ( ছোটোগল্প )

photo: https://unsplash.com/s/photos/lockdown

শুধু কালো দীঘির মত টলটলে চোখের মণি দুটো বের করা পেমলার । মাথা থেকে মুখ অবধি মুখটা দোপাট্টায় আষ্টেপিষ্টে মুড়ে নিয়েছে সে। নিজেদের কুঁড়ে সংলগ্ন একফালি জমি থেকে সেদিনের মত কি আনাজপাতি পাওয়া যায় খুঁজতে বেরিয়েছে। । আগের দিন রাতেই তার মা বলে রেখেছে, পরের দিনের রসদ বলতে ঘরে শুধু এক কুনকে চাল আর দুটো আলু পড়ে আছে। সরকার থেকে নাকি প্যাকেট বেঁধে সবেমাত্র চাল, ডাল, নুন, তেল আর আলু দেওয়া শুরু হচ্ছে। তারাও পাবে দু একদিনের মধ্যেই। তাই আশায় বুক বেঁধে বসে আছে বাড়ির চারজন। ফ্রি তে রেশন দেবে বলেছে। কবে দেবে তা জানেনা তারা। 
পেমলার খুব গোছ তাই রক্ষে। তার মা দুঃখ করে করোনার বাজারেও বলে উঠছে তা দেখে "অতি বড় ঘরুণী, না পেল ঘর"। টিভির খবরে ঘরবন্দীর কথা শুনেই রোজ বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে রাঁধাবাড়া করছে মেয়েটা। ধানজমিও আছে একটু। তবে সেটা তাদের ঘর থেকে বেশ অনেকটা দূরে। এখন পেমলা তার বাবা কে যেতে দিতে চায়না । 
নিদাঘ তাতে সব বোরো ধান জ্বলে হেজে গেল রে। ভালো ধান রুইয়ে ছিলুম এবার। দামী বীজ ছিল। পেকে ওঠার সময় হয়ে গেল তো। 
ধানচারার যা হয় হোকগে। তুমি যাবে না। একেই তোমার বয়েস হয়েছে তায় টিভিতে বলেছে হাঁপানি থাকলে এই রোগ নাকি চট করে ধরে যায়। পেমলার ছোট্ট মেয়ে আদুরী শ্লেট পেন্সিল নিয়ে দাদুর কোলের কাছে গিয়ে বসে বলে, মা একটুও মুড়ি নেই আর? না রে মা, বলে ওঠে পেমলার বাবা। পেমলা অমনি এক সানকি মুড়ি এনে বাবার কাছে দিয়ে বলে বাবা এই যে, কিছুটা তুলে রেখেছিলাম, তুমি আর আদুরী খাও দিকিনি। এই বলে শাকপাতার খোঁজ করতে বেরুচ্ছিল পেমলা।  

বাপ মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে হেসে বলে হ্যাঁ রে মা, আমাদের লালীটা আজ ঠিকমত দুধ দিল তো
 হ্যাঁ বাবা, আমাদের জন্যে রেখে বাকীটা পাশের ঘরে দিয়ে এসেছি। ওদের ঘরে চারটে বাচ্ছা। অনেকদিন হল তো লালীটার। বাছুরটাও বড় হয়ে গেল। দুধ কমে এসেছে। আর খোল, চুনি, ভুষি সব শেষ যে। খাবার বলতে বাড়ির মাড়, নুন দিয়ে। আনাজের খোসাও নেই যে দেব একটু।   

সেদিন নিজেদের জমি থেকে লকলকে কুমড়োশাক, দুটো পোকালাগা বেগুণ আর ক'টা কাঁচালংকা নিয়ে আসে পেমলা। গাছগুলোয় জল দিয়েও এল। বৃষ্টি এখন হবেনা। আরও দু চারটে ডগা বেরোলে কদিন বাদে আবার খেতে পারবে তাঁরা। ঝুড়িতে দুটো মোটে আলু পড়ে আছে। একটা চচ্চড়ি হয়ে যাবে সেদিনের মত।

চারটে মুরগী রয়েছে ওদের । তাদের ডেরায় উঁকিঝুঁকি মেরে লাভ হলনা। ডিম নেই সেদিন ওদের ভাগ্যে। 
পুকুরটাও একটু দূরে। নয়ত গামছা ফেললেই চুনোচানা মাছ পাওয়া যেত। অনেক লোক ঘাটে জড়ো হওয়া বারণ এখন।আগেরমত জটলা করা যাবেনা। খবর পেল পাশের বাড়ির জানলা দিয়ে। পুলিশ এসে মাঝেমাঝেই টহল দিচ্ছে পুকুড়পাড়ে। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে শাকপাতাগুলো নিয়ে ঘরের দিকে আসতেই আদুরী চেঁচিয়ে উঠে মায়ের দিকে এসে বলল, দাদু দেখ, মা আজকেও কত্ত বাজার এনেছে। পেমলা বলল, খুব মজা না? ইশকুল নেই, মিড ডে মিলের গরম ডিম ভাত নেই, অঙ্ককষা নেই, নামতা পড়া নেই। আজ আমি বানান ধরব কিন্তু । টিভি তে দেখ শহরের বাচ্চারা ঘরে বন্দী হয়েও কেলাস করছে কেমন! 
মা আজ রাতে কি খাব আমরা? আদুরী বলে ওঠে। 
সস্নেহে মেয়ের মাথায় হাত রেখে পেমলা বলল, কেন? কাল যে বললি পেয়াজকুচি দিয়ে গোলা রুটি ভালো লেগেছে তোর। 

ঘরের ভেতর থেকে পেমলার মায়ের সন্ধে দেবার শাঁখের ক্ষীণ শব্দ ভেসে আসতেই পেমলার বাবা দুহাত জোড় করে মাথায় ঠেকালো। জয় মা শেতলা ! কবে এই রোগের থেকে মুক্তি হবে মানুষের! মা বলে ওঠে, আমি মানত করেছি গো। সব মিটলে দশটাকার বাতাসা দেব বসন্ত বুড়ীর থানে। নদীর জল তুলে এনে দণ্ডী কাটব মা। হরির লুঠ দেব হরিসভায়। সবাই কে সুস্থ রাখো। 

পেমলার বাবা চোখে একটু কম দেখে আজকাল। ছানি পড়ছে বোধহয়। সন্ধের আলো আঁধারিতে তবুও দূর থেকে একটা সাইকেল দুবার ক্রিং ক্রিং করে এসে ওদের বেড়ার ওপারে থামল দেখে বলে উঠল, কে ওখানে? কে রে? এখন লোকজনের আসা যাওয়া বারণ জানো না? সাইকেলারোহী নেমে সেখানে দাঁড়িয়েই বলল, আজ্ঞে আমি রতন। 
অনেকদিন পর গলাটা চেনা লাগল পেমলার। আদুরী হবার পর রতন তাকে ছেড়ে চলে গিয়ে আরেকটা বিয়ে করেছিল। বেদম নেশা করে মারধোর করত খুব। দিনের পর দিন অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে একদিন সে মেয়ে কোলে করে চলে এসেছিল বাপ-মায়ের কাছে। মাধ্যমিক পাশ পেমলা টিউশান পড়ানো ধরেছিল গ্রামের বাচ্চাদের। 

এইবার পেমলা মুখ খুলল। ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, কি মনে করে এদ্দিন বাদে আমাদের এখানে? 
রতন বলল, আদুরীটার জন্যে বড় চিন্তা হচ্ছিল। আর সত্যি বলতে কি তোমার জন্যেও। তাই সাইকেল চড়েই এতটা পথ এসে গেলুম। ঢুকতে দেবেনা? পেমলা বলল, টিভিতে দেখোনি? পাশের গ্রামে দূর থেকে এমন কত লোক এসে গাছের ওপর দু'হপ্তা ধরে রয়েছে? 
রতন বলল, আমার হাঁচি, কাশি, জ্বর কিছুই হয়নি। সত্যি বলছি, মা কালী। মা শেতলার দিব্যি। 
কেন তোমার বৌ? 
রতন ঘাবড়ে গিয়ে বলল, বউটা বোধহয় বাঁচবে না আর। যে কাজের বাড়িতে ঠিকের কাজ করে সেখান থেকে রোগ এনেছে। তেনারা  নাকি  বিদেশ থেকে এসেছিল কবে একটা। সরকারী গাড়ী এসে পরশু তুলে নে গেছে হাসপাতালে। দোহাই, তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দাও। 
ও তাই বলে এখানে দিতে রোগ এসেছো বুঝি? 
পেমলা তার বাবা আর মেয়েকে নিয়ে মুখের ওপর দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল।  

১৩ এপ্রি, ২০২০

লকডাউন নামচা

ই লকডাউনের দুঃসময়ে গতকাল সংবাদপত্রের খবরে আমাদের পন্ডিতিয়া আবার সেই ত্রাসের খপ্পরে যেন। আমাদের ডে ওয়ান থেকেই  ধর ধর ঠেকা ঠেকা অবস্থা। সেই  ছোটো বাচ্ছা প্রথম হাঁটতে শিখলে যেমন হয় আর কি।  এই পড়ে গেল।  মাথায় চোট লাগল। কোকিয়ে উঠল কেঁদে।  হটস্পট হয়ে গেল তবে? কে জানে বাপু? কি হবে তবে? নীলের পুজো? বেল যে চাই-ই। পাঁচটা অথবা তিনটে ফল যে দিতেই হয়। আর আকন্দফুল মাস্ট যে! মিস্টি? নিদেন বাতাসা?   
আরে ধুর মশাই উচিত তর্পণে গাঙ শুকোচ্ছে আর আপনি কিনা পাঁচ ফল, তিনফল আর আকন্দফুলে পড়ে রয়েছেন। যত্তসব! নিকুচি করেছে নীলষষ্ঠীর পুজো। সবটাই তো মনে। এই হটস্পট না হলেই তো আপনারা ভোরবেলায় ছুটতেন বাজারে। কোথায় বেল, কোথায় ফুটি, কোথায় ক্যাঁটালি কলা...সব্বো উপাচার চাই আপনাদের। বলি যখন যেমন তখন তেমন, জানেন না? মিষ্টির দোকান? আমি বাপু টোটালি বয়কট করেছি তাদের। আর ফুল? হ্যাঁ তাকেও। মানবো তো ভালো করে মানবো নয়ত বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ব এই বলে দিলুম সাফ।  জানেন? আজ সকালে বাসি ঘর ঝাঁটপোঁছ করে, নেয়েথুয়ে দুধের প্যাকেট কেটে দুধ (মানে যেটায় আমার সকালের চা হবে সেটার থেকেই)নিয়ে, তার মধ্যেই ঘরে পাতা টক দৈ (মানে যেটা আমরা খাব সেটার থেকেই), মধু( মানে যেটা আমার কাশি হলে খাই, সেটাই), ঘি (মানে যেটা আমরা খাই বা রান্নায় দি‌ই) আমার নীলের পুজো করেছি। বাগানে যা ফুল ছিল তাই দিয়ে। বেলপাতা নেই, তো কি করব! একে মা, ভাত দেয়না তায় আবার তপ্তা আর পান্তা!  নীলকন্ঠ কে বলেছি, তুমি যেমন করেছ, তেমনি আয়োজন। নো এঁটোকাঁটার বাছবিচার বস!। মুয়ে খেঁদির বে হয়না, তার চার পায়ে আলতা! হ্যাঁ, ছিল শুধু আসল জিনিষ।  বোতল থেকে ঢেলে নিয়েছি। না, না ইথাইল নেই এই বাজারে। কৈলাস-মানস সরোবরের জল, গঙ্গোত্রী থেকে গঙ্গাসাগর সব গঙ্গার জল ঢেলে বলেছি পরেরবার বৃষোতসর্গ করব করোনার, যদি বেঁচে থাকি। কাল হটস্পট ঘোষণার আগেই ভোরবেলায় সেফ ডিসট্যান্স মেনে যা হোক করে বেল, কলার জোগাড় করেছি। লেবু দিতে গিয়ে বারেবারে সেই থুতুর ভিডিও মনে পড়েছে। বলেছি, সাবান জলে ধোয়া, আবার সাদা জলে ধোয়া, তারপর রোদে ফেলে রাখা, এবার তোমার যদি করোনা হয় তখন বুঝবো আপদ বিদেয় হল। জানো? কাল দুধ-ডিম-আলু-পিঁয়াজ পাঁউরুটি, নুডলস, চিঁড়ে সব পাড়ার দোকান থেকে নিয়ে স্যানিটাইজ করে, রোদ খাইয়ে ঘরে তুলে পরাণ আঁটুপাটু। রান্না করব না ঘর পরিষ্কার, ওয়াশিং মেশিনের কাপড় মেলবো না দৈ পাতব? রাতের তরকারি, ডালের সঙ্গে ভাজা...এসব করতে না করতেই পুলিশী লালবাত্তির হুংকার। বাজারে যাবেন না। পন্ডিতিয়া সিলড হচ্ছে। টিভিতে হাওড়ার ভিডিও। ব্যারিকেড পড়ছে। নীচ থেকে লোকাল মুদীর ফোন, ভাবি, আউর কুছ লে লিজিয়ে, কাল নেহি আনে দেঙ্গে ও লোগ। মানে? কি চাই কি চাই? আবার ভাবনা। এই করে বাদাবন হারভেস্টিং, কেভেন্টর...আছে মশাই? দেবেন আজ বিকেলের মধ্যে? সবাই আপনারা খুব ভালো। কি প্রচন্ড সহযোগিতা করলেন পন্ডিতিয়াবাসীর সঙ্গে তা বলার কথা নয়। আমি কেঁদে ফেলেছি গতকাল বড়, ছোট, মেজো, সব ব্যাবসায়ীদের কথা ভেবে। বলতে না বলতেই আবার বাদাবনের মেসেজ। দিদি, বারুইপুরের ফল আছে। জিরো পেস্টিসাইড, জিরো কার্বাইড। 
বলেন তো আবারো যেতে পারি। কি ভালো আপনারা ভাই! কে বলে বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী চলে গেচে বাংলা থেকে? বাঙালী জাগো। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের আদর্শে মন দাও দিকিনি। ভাবতে ভাবতে আবারো পুলিশের গাড়ীর টহল আমাদের রাস্তায়... ঘরে বসে বাচ্চাদের নিয়ে ইনডোর গেম খেলুন। বাড়ির সবার সঙ্গে চা খেতে খেতে আড্ডা দিন। বই পড়ুন... ছেলের হোয়াটস্যাপ... মা এখানে অনলাইন গ্রসারি অর্ডার নিচ্ছেনা...কি করব তবে? এভাবেই বাঁচব আমরা জানেন? ঠিক পারব... 
ছোট্ট বৌটা  আমার পাশ থেকে বলে উঠল... নিয়েছে অর্ডার কাছের একটা স্টোর... বড় ই-কমারস সাপ্লাই দিয়ে উঠতে পারছেনা তাই নিচ্ছেনা... তুমি কেন সব কথা মামামাম কে জানিয়ে আগেভাগে টেনশন বাড়িয়ে দাও, বুঝিনা... ম্যাচিওরড মেয়েটা আমার... ভালো থকিস তোরা দুটিতে... ঘর বন্দী হয়ে।

৬ এপ্রি, ২০২০

করোনার গান

https://www.facebook.com/359880721279005/posts/586797121920696/

সুর - গৌতম চট্টোপাধ্যায় 
কথা- ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় 

এতটুকু এক চীনা ভাইরাস দুনিয়া কাঁপিয়ে মানুষকে আজ ঘরের মধ্যে করে ফেলে দিল বন্দী আহা হা হা, আহা, আহা হা 
সারাবিশ্বের মানুষ কে আজ করোনা বীজাণু গ্রাস করে দিয়ে মানুষ কে কাবু করে ফেলার এক ফন্দী আহা হা হা হা হা
ভেবে দেখেছো কি? শারীরিকভাবে আমরা কত যে দূরে, অনেক দূরে পাশাপাশি মোরা এক মিটার আজ ছেড়ে?
দেশকাল আজ ভালো নেই আর বিদেশের বুকে আত্মীয়েরা সত্যি সবাই বড় অসহায় আজকে আহা হা আ হা আহা হা 
ঘরে বসে বসে নিজের হবি কে কাজে লাগিয়েছি তবু একা একা দিন যাপনের নামতা গুলোকে পড়ছি আহা হা আ হা আহা হা
ভেবে দেখেছো কি? সামাজিকভাবে সবাই কত যে কাছে, বড়োই কাছে শারীরিকভাবে তবু দূরে দূরে আছে ...
দুঃসময়ের দুর্দিনে আজ, বন্ধু সবাই পাশে থেকো আজ, মনে মনে সব পাশেপাশে আছি আমরা, আহা হা হা হা হা ...
ভেবে দেখেছো কি? একদিন ঝড় আবার থেমেই যাবে, ঠিকই  যাবে, আগের মতোই ভালো হয়ে সব উঠবে...
দুনিয়া শুদ্ধু লকডাউন আজ, এটাই সবার ভালো থাকবার, পাসওয়ার্ড শিখে রাখাবার খুব দরকার আহা হা হা হা হা…
ভেবে দেখেছো কি? একদিন ঝড় আবার থেমেই যাবে, ঠিকই  যাবে, আগের মতোই ভালো হয়ে সব উঠবে... 

করোনার যুগে ভরসার রান্না

সবার সুবিধের জন্য এক ডজন সহজ রেসিপি রইল করোনার এই দুর্দিনে 

৩ এপ্রি, ২০২০

লকডাউন মোনোলোগ

ভিশপ্ত বসন্ত পেরিয়ে চৈত্রের প্রখর রৌদ্রে আমাদের নিভৃতবাস গালভরা ইংরেজী নাম কোয়ারেন্টিন। সীতার বন্দীদশা বা যক্ষের রামগিরি পর্বতের অভিশপ্ত নির্বাসনের মতোই এ এক ভয়ংকর জীবন দুনিয়া জুড়ে। তফাত শুধু একটাই সীতা বা যক্ষের ছিল একাকী নিভৃতযাপন আর আমাদের পারিবারিক গৃহবন্দী দশা। তাঁদের ছিলনা সোশ্যালমিডিয়া আর আমাদের বন্দীদশায় সেই খুপরিটুকুনি এক পশলা সুবাতাস। শারীরিক দূরত্বে আমরা  একটু বেশীই সামাজিক হয়ে পড়ছি বরং। পৃথিবী তথা দেশ তথা রাজ্য জুড়ে করোনার জন্য আমাদের সমবেত অশৌচপালন এই লকডাউন। এবছর চৈত্রে চড়কে ঢাকে কাঠি পড়লনা আর। হাম-বসন্তের জন্য শীতলার জন্য মানতের পুজো তুলে রাখতে হল কারোর। যারা চলে গেলেন তাদের শ্মশানযাত্রায় কেউ সামিল হলেন না। এমন কি ফুলের একটি পাপড়িও জুটলনা তাঁদের। একটা সর্বগ্রাসী চিন্তা সারাক্ষণ কুরেকুরে খেল মানুষকে। তার মধ্যেও শিক্ষিত মানুষদের আচরণ অবাক করে দিল আমাদের। ততক্ষণে মহামারী অতিমারীতে পরিণত হল। সীমিত শস্য, সীমিত খাদ্যদ্রব্য তবুও আমাদের ঘরভর্তি করার এক অদম্য তাড়না তৈরী হল। আর যারা পেলনা? তাদের কথা ভুলে গেলাম না তো আমরা? স্বার্থপর মানুষ এর এই বাজারেও পঞ্চব্যঞ্জন চাই‌ই চাই। ভাতের পরে রুটি, রুটির পরে দুধ, দুধের পরে আবার ভাত, এভাবেই চলবে তবে? আসুন যে যার সাধ্যমত ত্রাণ নিয়ে জমা করি তাদের জন্য।
শরীরে, মনে খুব ক্লান্তি রয়েছে। অ-সুখ এমন অবস্থাকেও বলে বুঝি। আক্ষরিক অর্থে ব্যাধি নেই তবে আধি আছে যা ব্যাধির চেয়েও মারাত্মক। সংবাদের স্রোত নজরে আসতেই দুপুরের সোহাগী বিশ্রাম আপাত নিদ্রা কেড়ে নিচ্ছে। রাতে তাড়াতাড়ি বিছানায় গেলেও তন্দ্রা ও নিদ্রার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে হাত-পা আপাত জিরেন নিচ্ছে বটে কিন্তু স্বপ্নের ভেলায় ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে দোদুল্যমান জীবনের অজানা ঘূর্ণিপাকে। 
আমরা স্বার্থসর্বস্ব মানুষ যাদের সরকারী নির্দেশিকা মেনে বিধিসম্মতভাবে হোম আইসোলেশনে থাকার কথা তারাও কি ঠিকঠাক পালন করলাম? যাদের বিদেশ থেকে ফিরে ঘরবন্দী থাকার কথা ছিল তারা? যারা এর মধ্যেই বিয়েবাড়ি গিয়ে সংক্রমিত হয়ে আবারো দূর থেকে দূরে, ছড়িয়ে দিলেন সংক্রমণ, ধর্মীয় সম্মেলনে একে অপরকে দূর থেকে দূরান্তের মানুষকে আক্রান্ত করলেন। কেউ কেউ প্রাণ‌ও দিলেন এই মারণ ভাইরাসের প্রকোপে তাঁদের দেখেও সচেতন হবনা? রোগ চেপে রাখব? আড়াল করব নিজেকে? তারপর এক্সপোজড হলে সেই মুখ দেখাতে পারবো তো সমাজে? কেউ দেখলাম খুব নোংরা রাজনীতি করছেন। এটা কি সেই সময়?  একেই তো এখন আমরা সবাই আমাদের গৃহ পরিচারিকাদের অনির্দ্দিষ্টকালের জন্য ছুটি দিয়েছি। নিজেদের কাজ নিজের হাতে করার অভ্যেস শহরের মানুষদের নেই তার মধ্যেও অনেকে কাজের লোক ছাড়া বাঁচতে পারছেন না। এবার ভাবুন সেই কাজের লোকটি রোজ তার ঘরে ফিরে যাচ্ছে। সে কার স্অঙ্গে মিশছে কোথায় যাচ্ছে আমাদের তা অজানা। এবার সেই এসে আমাদের দিতেই পারে সেই রোগ। আমরা হয়ত বুঝলাম না। সে ছিল নীরব এক বাহক। যাকে দেখে বোঝা যাবেনা। নিজের চাহিদা, ইচ্ছেগুলো সীমিত রাখা এই মূহুর্তে খুব জরুরী। সে খাবারদাবারেই হোক আর কাজের লোকের ব্যাপারেই হোক। আরো কত ঘটনা দেখছি। এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে সারাক্ষণের কাজের লোকের শরীরখারাপ হলে তাকে বাড়ির বাইরে বের করে দেবার মত অমানবিক ঘটনা। সে কোথায়  যাবে? পরিবহন নেই। তাকে ডাক্তার দেখিয়ে ব্যাবস্থা করুন তবে। করোনা অনেক কিছু শেখাচ্ছে প্রতিমূহুর্তে। আমরা একদিকে অমানবিক আচরণ করে ফেলছি আবার চূড়ান্তভাবে মানবিক হয়ে গৃহ পরিচারিকার খোঁজ নিচ্ছি। সে ত্রাণ পাচ্ছে কিনা। সে ঠিক আছে কিনা। নিজেদের একাহাতে সব  কাজকর্ম করতে হচ্ছে বলে হাড়েহাড়ে বুঝছি তাদের কদর। কথায় বলে দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝা যায় না। ঠিক তেমনি ব্যাপার । আমরা সামান্য ডাল ভাত, সেদ্ধ ভাত, খিচুড়ি, ডিম ভাতে দিনের পর দিন অভ্যস্ত হচ্ছি। ঘরের বাচ্ছারাও সোনা হেন মুখ করে খেয়ে নিচ্ছে তা। মা ঠাকুমার পুরনো, অত সাদামাটা কেজো রান্নাবান্না কে মান্যতা দিয়ে ঝালিয়ে নেবার সুযোগ দিল এই লকডাউন। এই ফাস্টফুডের্, ট্রান্সফ্যাটের রমরমায় সেটাও কম কথা নয়। হঠাত করেই প্রকৃতি দেখছি। ঘর থেকে দু' পা না ফেলেই চোখ রাখছি নীল আকাশে,পাখীর ডাকে, সবুজে, ফুলের রঙে। পরিবেশের দূষণমাত্রা ঝাঁ করে একধাক্কায় নেমে গেছে অনেকটাই। সারা বিশ্বজুড়েই। আমরা শিখলাম যে ধর্মের কল‌ও বাতাসে নড়ে। আমরা শিখলাম when resources are limited unlimited creativity দিয়ে সংসার করতে হয়। পরিবারের সবার জন্য খাদ্যবন্টন করতে হয়।  

৩১ মার্চ, ২০২০

করোনা কথা

খুব ক্লান্তি রয়েছে। অ-সুখ এমন অবস্থাকেও বলে বুঝি। আক্ষরিক অর্থে ব্যাধি নেই তবে আধি আছে যা ব্যাধির চেয়েও মারাত্মক। সংবাদের স্রোত নজরে আসতেই দুপুরের সোহাগী বিশ্রাম আপাত নিদ্রা কেড়ে নিচ্ছে। রাতে তাড়াতাড়ি বিছানায় গেলেও তন্দ্রা ও নিদ্রার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে হাত-পা আপাত জিরেন নিচ্ছে বটে কিন্তু স্বপ্নের ভেলায় ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে দোদুল্যমান জীবনের অজানা ঘূর্ণিপাকে। 
কাল বহুক্ষণ ছিলাম এমনি এক স্বপ্নের ঘোরে। মামারবাড়ির পুরনো রান্নার মাসী অরুণা দিকে দেখলাম স্বপ্নে। বাল্যবিধবা তিন ছেলে নিয়ে ইঞ্চিপাড় সাদা থান পরে থাকতেন। কথায় পূর্ববাংলার টান। কপালে চন্দনের ফোঁটা। ছোট্টখাট্টো লক্ষ্মীমন্ত মানুষটি সবার আবদার, ওজর আপত্তি মানিয়ে নিত দিনের পর দিন। বাংলার তথা সারা দেশের গিন্নীদের‌ও বলিহারি যাই বাপু! নিজেরা নড়ে বসতে পারেনা। কাজের লোকেদের কি ফরমায়েশের ঘটা। অরুণা দি সব হুকুম মুখ বুঁজে তামিল করবে। সেই অরুণাদি যখন দেশে যাবে তখন দিদিমার মেজাজ সপ্তমে। ওড়িয়া ঠাকুর এনে রান্না শিখিয়ে চারবেলার রান্না হবে।  কারণ অরুণা দি একবার দেশে গেলে কমপক্ষে মাসখানেক। দিদিমার এমন দুরবস্থা দেখে আমার মায়ের ধনুকভাঙ্গা পণ।  জীবনেও রান্নার লোক রাখেনি তাই । খুব মনের জোর আর রাঁধবার অভ্যেসের কারণে বুক বাঁধতে দেখেছি মা'কে। সেই মা কে বরং আমি বলে বলে মা ৬৫ পেরুতেই রাঁধুনি রাখতে বাধ্য করেছি মায়ের শারীরিক কারণে। 
তা যা বলছিলাম । গতকাল রাতে অরুণা দি ছাড়াও দেখা হল মালকোঁচা দিয়ে ধুতি পরা মামার বাড়ির ঠাকুর গোলক কে। আমার শ্বশুরবাড়ির রান্নার মাসী পারুল কে। আমার বিয়েতে গায়েহলুদের তত্ত্ব নিয়ে গেছিল সে। পারুলের ব্রেস্ট অপারেশন, চোখের ছানি কাটানো সব করিয়ে সে বুড়ো হতে তাকে বাড়ি চলে যেতে বলা হল। টুকটাক ভুল করত বুড়িটা। বেদম বকুনিও জুটত কপালে। তারপর এসেছে জ্যোত্স্না, জবার মা, পুতুল, উত্তরা, চন্দনা এমন কত কত মেয়ে। 
এখন রোজ নিজে কেটে, বেটে রান্না করছি বলেই এদের সবার মুখগুলো খুব মনে পড়ছিল খুব। একে একে আসছিল স্মৃতির সরণী বেয়ে, পরত খুলে খুলে। মনোবিদ্যায় একে বলে "ল অফ এসোসিয়েশন"। এর কারণেই স্বপ্নে  দেখলাম সবকটা পরিচিত মুখকে অনেকদিন পর। করোনা না এলে এ জীবনে আর বুঝি তাদের কথা মনেও পড়ত না আমার। রান্নাঘরের জাহাজভাঙা হাতল ছাড়া তয়ীতে একটু ময়লা থাকলে দুই মা কি চীত্কার করতেন! গ্যাস বাড়িয়ে ভাজা বসালেই গিয়ে টুক করে গ্যাসটা সিম করে দিতেন। তরকারী কাটাকুটি করার সময় ভুল এদের হতেই পারে। তায় আবার অপুষ্টির কারণে স্মৃতির ঘাটতি আশ্চর্যের কিছুই নয়। একেক বাড়িতে একেক রকমের রান্না। সেই নিয়ে সব একহাত নিতেন। রোজ রোজ সকালবেলায় এই কাটা আর বাটা নিয়ে নিত্যি কথা কাটাকাটি দেখেছি। কতবার বলেছি ঝোলের আলু আর চচ্চড়ির আলু এক নয়। বেগুণভাজা ফালাফালা আর তরকারিতে ডুমোডুমো। সর্ষেটা একবাটা কোরো কিন্তু নয়ত ঝালের সোয়াদ হবেনা। কিম্বা ভাতটা আজো গলিয়ে ফেলেছ? এত দামী জুঁইফুলের মত চাল! আজ খাওয়াটাই মাটি! কিম্বা আজ আবার দুধ উথলে গেল? খেয়াল রাখতে পারোনা? জানো কত দাম এই দুধের? রুটিগুলো কাল বড্ড মোটা মোটা হয়েছিল। হ্যাঁগো! কাল রাত্তিরের তারকারিটার কি তলা লেগে গেছিল? পোড়া গন্ধ পেলুম যে। মনে রাখতে পারোনা? নাহ! সত্যি পারেনা এরা।  
মা, শাশুড়িদের প্রথম দিকে বোঝাতে চেষ্টা করেছি বহুবার কিন্তু ভবি ভোলার নয়। তবে সংসারের হাল ধরতে গিয়ে আমি কিন্তু নিজের অগোচরে নিজেও তাঁদের মত এমন ভয়ানক গিন্নী হয়ে উঠেছি যে সেই লেগাসি বহন না করলে যেন বাড়ির যোগ্য গৃহিণী হওয়া যায় না। গত কয়েকদিন নিজে একাহাতে রান্না করতে করতে, তয়ী ধুতে ধুতে এসব মনে হচ্ছিল কেবলই। তাই বুঝি স্বপ্ন দেখেছি। 

২৮ মার্চ, ২০২০

করোনা পেয়িং ডিভিডেন্ড

(১) 
আলমবাজারে আমার বাবা মা দুদিন ধরে দুধ পাচ্ছিলেন না দেখে ফেসবুকে পোস্ট করতেই বান্ধবী অদিতি সেন চট্টোপাধ্যায় ফোন করে ব্যাবস্থা করতে গেলেন। ওদিকে আমার মা ততক্ষণে রিষড়ায় মাসীর ছেলেকে বলে রেখেছিল ওদিকে এলে দুধ ব্রেড নিয়ে আসতে কারণ রিষঢ়া পুরসভার কাউন্সিলর মাসীর পুত্রবধূ। এবার গতকাল প্রচুর দুধ এধার ওধার থেকে এসে পড়ায় আমার মা নিজেই এখন মাদার ডেয়ারী। অদিতি কে বারণ করলাম এত দূর থেকে লোক পাঠাতে। এবার যেটা হল তা আরো আনন্দের এবং প্রশংসার ও বটে। অদিতিকে মায়ের বাড়ির ঠিকানা ও মোবাইল দিয়েছিলাম। গতকাল থেকে বরানগর মিউনিসিপালিটির কাউন্সিলর নিজে ফোন করছেন। মাসীমা কিছু লাগবে এই বলে। আজ নিজে এসেছিলেন বাড়িতে। বলে গেলেন প্রয়োজন হলে জানাতে। চীন, ইউরোপ, আমেরিকা এমনকি ভারতেও এমন পরিষেবা কে কে পেলেন বা পাচ্ছেন জানান। করোনার যুগে আবিষ্কার করছি এই দেশে জন্মানোর মাহাত্ম্য।
(২) 
প্রচুর পরিশ্রমের ফলে দেহের অবাঞ্ছিত, অনাকাঙ্ক্ষিত মধ্যপ্রদেশের স্ফীতি বুঝি একটু ন্যায়দম খাচ্ছে।মেপে খাওয়াদাওয়া আর সেই সঙ্গে পরিশ্রম দুয়ে মিলে বেশ চাপে রেখেছে তাকে।
(৩) 
অনেকদিন বাদে বেশ ঝালিয়ে নেওয়া হচ্ছে মা, দিদা, ঠাম্মার কেজো সব রান্না। কাজের লোকেদের হাতে সেসব রান্না বলে করিয়ে নেওয়া যায় না কারণ (১) তখন ফ্রিজে এত আমিষ মজুদ থাকে আর (২) নিজের মাথাতেও আসেনা সেসব
(৪) 
ঈশ্বরকে শুধাই মনে মনে, এভাবেই তবে ঘরবন্দী করে তুমি শেষমেশ দুনিয়ার সব উগ্রপন্থী, নরখাদক, ধর্ষক, জঙ্গি, খুনী, চোরডাকাত, ছিনতাইবাজ সব দুষ্টুদের শান্ত করার উপায় বের করলে? ইন্ডিয়ার ক্রাইম রিসার্চ ব্যুরো অনুযায়ী অপরাধের মাত্রা এখন মাত্র ৭%। রেপ ভিক্টিম রিপোর্ট নেই !তাই বুঝি উপলব্ধি হয় ঈশ্বরই শাশ্বত এবং চরম সত্য।মানুষ যখন অপারগ তখন উত্তরোত্তর বেড়ে যাওয়া এই ক্রাইম রেটের লেখচিত্র কে তিনিই নিজের হাতে নিম্নমুখী করলেন। এর নাম ধর্মের কল বাতাসে নড়ে ওঠা। নাকি এভাবেই সমাজকে বাঁচানোর জন্য তিনি নিজেই গোকুলে বাড়াচ্ছিলেন এই মারণ ভাইরাসটিকে?
(৫) 
নাস্তিকেরা বিপদে পড়লে আমার মত আস্তিককে বলে তোমার ঠাকুরকে বোলো আমার কথা।
(৬)  
আমাদের বাড়িতে একটা কথা আছে "ঢেউচালানি" বলে মানে যারা আরকি সবসময়ই উঠল বাই তো কটক যাই টাইপ, ঘরে মন বসেনা মোটেও। সেই দলে মাঝেমাঝে আমিও পড়ি আর এখন শুধু ঠাম্মার কথা ভাবছি, মেয়েরা ঘরমুখো হলে সংসারের অনেক কাজ হয়, একথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে কিন্তু। ঘরের কোণে কোথায় ঝুল, বাগানে শুকনো গাছের ডালপালা, ফ্রিজটা অফ করে পরিষ্কার, রান্নাঘরের আনাচকানাচ, বাসনের র‍্যাক, মশলাপাতির শিশি ধোয়ামোছা, একটা করে বইয়ের তাক গোছানো, অবিন্যস্ত আলমারি গুলোর দিকে নজর দেওয়া, বাড়ির সব আয়নাগুলো একদিনে খবরের কাগজ ভিজিয়ে মুছে নেওয়া আর সেই সঙ্গে এখন সদর দরজা আর কলিংবেলে কলিন দিয়ে পরিষ্কার করা..... মানে বাড়িটাকে এই ফাঁকে একটু গুছিয়ে নেওয়া। সবকিছুর একটা ভালো দিক আছে কিন্তু।
(৭) 
এদ্দিন স্বার্থপর মানুষ শুধু দারা-পুত্র-পরিবারের অসুখে প্রার্থনা করত।এখন অপারগ হয়ে সারা বিশ্ববাসীর জন্য ভাবছে।মশাই এর নাম learning process!


(৮) 
প্রকৃতির দূষণ নিম্নমুখী। মানুষ হল পরিবেশের সবচেয়ে বড় শত্রু। তাই অবলা, সর্বংসহা পৃথিবী আজ মানুষ নামক জীব কে গৃহপালিত করে ঘর বন্দী করেই ফেলেছে। গাড়িঘোড়া না চলায় পরিবেশের দূষণ, ধুলো, ধোঁয়া থেকে মুক্তি। প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছাচারে বিরতি। জঙ্গলের অরণ্যমেধ যজ্ঞ থেকে যত্রতত্র প্ল্যাস্টিক পতন ইত্যাদির মত বিষয় গুলো বেশ ভালো দিক।
(৯) 
সব অনলাইন খাবার সরবরাহকারীরা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঘরে বানানো খাবারেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে সারা বিশ্ববাসীকে। শরীরের আপাত ধৌতিকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত। সবাই স্বাস্থ্য সম্মত খাবার খাচ্ছে।পরিমাণে কম খাচ্ছে কাজেই জাঙ্ক ফুডের, ট্রান্স ফ্যাটের রমরমা আপাতত শিকেয় তোলা।
(১০) 
ঘরে বসে, গৃহবন্দী হয়ে মধ্যবয়সী হোমমেকারদের শারীরিক ব্যাথা বেদনা, আর্থ্রাইটিস, গাউট, গেঁটে বাত, কোমরে ব্যাথা, গোড়ালি ব্যাথা, সাইনাস, মাইগ্রেন অনেকটাই কম এ যাবত। তবে ইনসমনিয়া গ্রাস করছে যেটা আমাকেও বেশ কষ্ট দিচ্ছে। ঘুমের ওষুধ খাচ্ছি। রাতে কোকো / ড্রিংকিং চকোলেট দিয়ে দিয়ে এক গ্লাস গরম দুধ আর বিকেলের দিকে চা কফি আর না খেলে ইনসম্নিয়ার উপশম হয় কিন্তু। তবে মনে পড়ছে আমাদের এক দুঁধে অভিজ্ঞ হাউজ ফিজিশিয়ানের কথা। মা, দিদিমারা বাড়িতে দেখতে এলে হাজার একটা রোগের কথা বলে ওষুধ দিতে বলতেন।ওপরে উল্লিখিত কোনো না কোনো ছোটোখাটো উপসর্গের কথা বলতেন তাঁরা। সেইসঙ্গে ছিল গায়ে হাতে পায়ে জ্বালা অথবা সামান্য চুলকুনি। সেই প্রাজ্ঞ ডাক্তারবাবু মুচকি হেসে বলতেন, এগুলি "হাউজওয়াইফস কমন সিনড্রোম" বলে গড়গড় করে একটা মাল্টিভিটামিন লিখে দিতেন। হোমিওপ্যাথির ডাক্তার দিতেন বিনা ওষুধের চিনির গুলি। এখনকার ডাক্তারবাবুরা বলেন প্রাণায়াম করতে। কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে, সেলাইফোঁড়াই করতে, রান্না করতে, ব‌ই পড়তে, গান করতে, বাগান করতে, কবিতা লিখতে। তবেই নাকি মধ্য থেকে প্রৌঢ় হাউজ ওয়াইফরা এই প্রবলেম গুলি থেকে অনায়াসে মুক্তি পাবেন। এসবের কোনো দাওয়াই নেই। প্ল্যাসিবো এফেক্টের কারণে সাদা চিনির গুলিতেও এমন হত আগেকার দিনে। সবটাই ছিল মনের ব্যাপার। আমার একমাস ধরে খুব কষ্ট হচ্ছিল সাইনাসের। সেই সঙ্গে কোমরে ছিল বেদম ফিক ব্যাথা। বলতে নেই, এখন সব গায়েব!!! করোনা পেয়িং ডিভিডেন্ড!  

২৭ মার্চ, ২০২০

করোনা ডায়েরী

 
দুপুরে একটু তন্দ্রা আসছে আজকাল। কায়িক পরিশ্রম বোধহয় এর কারণ। অথচ রাতে ঘুম আসছেনা। খুব ভোরে অ্যালারম ছাড়াই ঘুম ভেঙে যেতেই মনে হচ্ছে একটা বিস্তারিত স্বপ্নের ঘোরে ছিলাম। সন্ধের অন্ধকার ঘনিয়ে এলেই মনে হচ্ছে আবার কি দুঃসংবাদ আসবে।  ছাদে বা বারান্দায় একটু চৈতি হাওয়া গায়ে মাখলেই মনে হচ্ছে ঠান্ডা অনুভূতি। জ্বর এল নাকি? কিম্বা কপালের রগদুটো কনকন করে উঠল কি? ভাবতে না ভাবতেই বাড়ির কেউ হয়ত হেঁচে ফেললেন। ৮৩ বছরের শাশুড়িমা দুবার কেশে উঠলেই শিরদাঁড়ায় কিসের যেন চোরাস্রোত ওঠানামা করে উঠছে। ভোরে উঠে এখনো দেখছি চরাচর জুড়ে গোলাপী কুয়াশা মাখা হিমেল আবহাওয়া। এমন হয় কি প্রতিবারের চৈত্রশেষে? তার মধ্যেও ছাদের আলসের ধারে বসন্তের অন্তিম নিঃশ্বাস মেখে ভুঁইচাঁপা তার উদ্ধত স্টক ফুঁড়ে মাটি ঠেলে বেরিয়ে এসে বলে ওঠে, আমায় দেখো একটু। কত রঙীন তার দেহ মন। ঠিক আসমুদ্রহিমাচল জুড়ে আমাদেরো সবার যেমন ছিল। ফুলেল রক্তকরবী কে দেখে মনে হল তার সেই আত্মপ্রত্যয়েও যেন এবার কিছুটা হলেও ঘাটতি এবারের চৈত্রে। বসন্তের ফুল তুলে মালা গাঁথব বলেই না আমারা অনেকেই কোথাও না কোথাও পৌঁছে গেছিলাম হাজিরা দিতে। কেউ মিটিং এ, কেউ মিছিলে, কেউ সামাজিক দায়বদ্ধতায়। সেই সব তারিখগুলো মাথার ওপর এখন খাঁড়া হয়ে ঝুলছে। কেউ জানিনা। এতদিনে বুঝলাম মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা কি জিনিষ! সেদিন চৈত্রমাস! করোনার চোখে দেখব হয়ত আবারো আমাদের সর্বোনাশ! এবার চৈত্রে চড়কের ঢাকে কাঠি পড়ল না। বাবা তারকনাথের চরণে সেবা লাগে বলে চীৎকার করে সেই মাধুকরীর সিধে নিতে ওরা কেউ এল না এবার কেউ বাড়ি বয়ে। এবার আমাদের চৈত্র সেল নেই। ফুটপাথে হকারদের রমরমা নেই। আমাদের এখন উইকেন্ডের জন্য মনকেমন নেই। শুক্রবারের বিকেল থেকেই রবিবারের বায়নাক্কা নেই। কোনও প্ল্যান নেই আমাদের কারোর। ভোরে উঠলেই কাজের সহকারীর আমার বাড়িতে আসার কোনও অনিশ্চয়তা নেই। তার জন্য অপেক্ষাও নেই আমাদের। কি রান্না হবে তা নিয়ে বাজারের তাড়া নেই। অফিসের জন্য টিফিন নেই। তারমধ্যেও ছাদ বাগানের ফুল গাছেদের জল দিয়ে, ঘরের পোষ্যদের খাবারের ভাবনা আছে। নিজেদের সংসারের মাসকাবারির ফর্দ নেই। গল্প লেখার রসদ নেই। পঞ্চব্যঞ্জন ছেড়ে শুধু দিনগতে করোনা পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে করতে কোনোরকমে গ্রাসাচ্ছদনের উপায় বের করা আছে। কোথায় সবজীর খোসা ফ্রিজে জমিয়ে ডালের সঙ্গে ভাজা খাওয়ার বিলাসিতা আছে। ভাতের ফ্যানের স্যুপ কে নতুন মোড়কে আবিষ্কার করার নতুন ভাবনা আছে। আলুভাতের চমকদার রেসিপি ইনোভেশনের কৃতিত্ব আছে। গেরস্থ আলু পেঁয়াজ হিসেব করে খরচ করেনি এতদিন। এখন যেন মঙ্গলগ্রহের কল্পবিজ্ঞানের গল্পের মত খাবারের হিসেব নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। কটা আলু, কটা পিঁয়াজ রোজ রান্না হলে কতদিন যাবে । নতুন করে ঐকিক নিয়ম মাথা খাটিয়ে বের করছে সুগৃহিণী। যেন অর্ধভক্ষ ধনুর্গুণঃ। কিছু না পেলে আটা গুলে গোলা রুটিই খাব আমরা অথবা মাড়ভাতের স্যুপ । একটু সরষের তেল, কাঁচা লঙ্কা আর নুন ছড়িয়ে। খিদের মুখে তাই অমৃত হবে।
চৈতালী হাওয়া গায়ে মেখে ছাদে দাঁড়িয়ে দেখি ছাদ বাগান থৈ থৈ বাসন্তী ফুলে। আমার মনের অগোচরে। আজ বসন্তে আমার ফুল গাঁথার সময় নেই। তবুও ওরা সব ছাদ আলো করে দোল খাচ্ছে। কত আনন্দে, রঙীন হয়ে ফুটে রয়েছে। একে একে জড়াজড়ি করে, হাত ধরাধরি করে। আমার মনের খবর নেই ওদের কাছে।আমাদের এখন বেঁধে বেঁধে থাকার উপায়ও নেই। আমরা সবাই দূরে দূরে তবুও আমার কাছাকাছি ফুলেরা কাছে যেতেই বলে ওঠে
" কি গো দেখলে না আমায়?"
আমি বলে উঠলাম, দেখছিই তো কিন্তু পারবি তোরা সবাই মিলে সারাদেশের মানুষের মন ভালো করে দিতে? আচমকা দেখি রক্তকরবী খুব হাওয়ায় মাথা ঝুঁকিয়ে বলে উঠল, আছিই তো। চিন্তা কিসের?
অদৃশ্য সেই শক্তির কাছে বারেবারে নতজানু হই আমি। কে তিনি? শীতলা? রক্তকরবী? নাকি করোনার প্রতিষেধক?

২৩ মার্চ, ২০২০

করোনার কড়চা

ঠাত যেন আলোর ঝলাকানি তারই মাঝে। অভিভূত হয়ে পড়ছি সবাই। এদ্দিন স্বার্থপর মানুষ শুধু দারা-পুত্র-পরিবারের অসুখে প্রার্থনা করত। এখন অপারগ হয়ে সারা বিশ্ববাসীর জন্য ভাবছে। শিখছে সভ্য, শিক্ষিত মানুষ। পরিবার আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব একে অপরের খবর নিচ্ছে, সেটাও আমাদের পরম পাওয়া। সব মানুষের পাখীর চোখ এখন করোনা দমন। রাজনীতির রঙ, জাতপাত সব ভুলে সবার লক্ষ্য এক । সেটাই বা কম কিসের? ভাবছিলেন তো মিলন হবে কত দিনে? এইতো এগিয়ে এল সেই বহু আশার মিলনক্ষণ। আমরা সবাই এখন এককাট্টা হয়েছি। মোরা মিলেছি আজ মায়ের সাথে।
ওদিকে রাস্তায় গাড়ি চলছেনা। সব বন্ধ। কেউ বাইরে বেরুচ্ছেনা। যেন বন্ধ উদযাপন চলছে দিনের পর দিন। অর্থাত প্রচুর এনার্জি কনজারভেশন হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। প্রকৃতি খুব খুশি । এজন্য‌ই বুঝি বলে রিসোর্সেস লিমিটেড, বুঝে চল।
আরেকদল শিক্ষিত মানুষ জেনেবুঝেও অন্ধ। এই একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাসের দাপটে রাজার ঘরেও যে অসুখ টুনির ঘরেও তাই। বিলেত ফেরত গায়ক গায়িকা এদ্দিন নিজেকে যত‌ই সেলেব ভাবুন না কেন উনি আসলে কিস্যু নন। গণ্ডমূর্খ। মোটেও সমাজ সচেতন নন। শিল্পী হবার কোনো যোগ্যতাই আসলে নেই তাঁদের, শুধু গান গাইলেই শিল্পী হওয়া যায় না। তাঁরা ছড়ালেন রোগ। ছড়াচ্ছেন‌ও প্রতিমূহুর্তে। মরছি আমরা, যারা সরকারি বিধি মেনে চলছি। দামী চিকিত্সক থেকে নামী আমলা, খেলোয়াড় থেকে অভিনেতা আজ আমি-আপনি কিন্তু সমান রিস্কে, সেটা অন্ততঃ বুঝুন। রাজার রোগ, টুনির রোগ এখন সমান।

আমাদের তো দিব্য চলছিল কবিতার আড্ডা, সাহিত্য‌আড্ডা, জনসমাবেশ, মাল্টিপ্লেক্সে হৈ হৈ হ্যাঙ‌আউট, শপিংমলের ফুডকোর্টে মস্তির দিনলিপি। ক্রমে চীন, জাপান, কোরিয়া আর তারপর দস্তুর মত ইউরোপ। ইতালি কে শেষ করে ইরান। আমেরিকাতেও অনুরূপ অবস্থা।  দাপিয়ে বেড়াতে বেড়াতে অবশেষে ভারতে ঢুকে এল করোনা ।  তখনও হুঁশিয়ার নয় আম বাঙালী। ওয়ার্ক ফর্ম হোম, অনলাইনে পড়ানো এসব করতে করতে ঘরে বোরড হয়ে ক্লাবে কিম্বা রেস্তোরাঁয় গিয়েছে তারা। নাহ! তারপর অ্যাটলাস্ট সেই অশৌচ পর্ব পালন আবশ্যিক হয়েই পড়ল। তবুও ভবি ভোলার নয়। কলকাতায় কাজের লোকেরা সবেমাত্র বলতে শুরু করেছে, কি একটা রোগ এইয়েচে গো?
এর মধ্যে ফুলেল শহরে বসন্তের কোকিলের কুহুতান । তার শুধু চিন্তা আহার-মৈথুনের আর বাঙালীর ভ্রমণের। তায় আবার পুরোদস্তুর ছুটির আমেজ। বাঙালীর ভ্রমণ পিপাসা পায়। ভাবতে অবাক লাগে। হোয়াটস্যাপে দী-পু-দার প্ল্যান হয়। ফূর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ যেন। এরা আবার গাড়ির মধ্যে ঢুকে সেলফি তুলে এই ডামাডোলের বাজারে ফেসবুকে পোস্ট‌ দেবার লোভ সামলাতে পারেনা। বলে ওঠে, হ্যালো ফ্র্যান্দস...চললুম পলাশের দেশে। কারণ বসন্ত ফুরায়। বাঙালীর বেড়ানোর নেশা পৃথিবীর সব জাতের চেয়ে বেশী কিনা।
ততক্ষণে লন্ডন ফেরত শিক্ষার্থী, আমলা ও ডাক্তারের পুত্র ছড়িয়েই দিল সেই মারণ রোগ কলকাতায় । ঠিক তারপরেই দক্ষিণ কলকাতার ওয়েসিস আবাসনের ব্যাবসায়ী পুত্র। এরা সবাই লন্ডন ফেরত। কিন্তু কারোর কোনও হেলদোল নেই। নেই স্বাস্থ্য সচেতনতা। বাড়ির লোকেও ভাবল না নিজেদের কথা, পড়শির কথা। মশাই এরা মানুষ? মানুষের তো আক্ষরিক অর্থে মান এবং হুঁশ দুই থাকতে হয় জানি। আবার নির্লজ্জের মত কলকাতার বাপ মায়েরা তাদের বিদেশে পড়া ছেলেপুলেকে ডেকে ডেকে নিয়ে এলেন দেশে। আহা! বলুন তো! মায়ের প্রাণ! আয় তোরা আয় ফিরে অথবা বেটা তুরন্ত  বাপাস আ যা । সঙ্গে নিয়ে আয় দু' চারটে করোনা।
তাদের উদ্দেশ্যে বলি, আমাদেরও আছে মশাই বত্রিশ নাড়ী ছেঁড়া ধন সেদেশে পড়ে। তবু বলেছি বেরুবি না একদম। প্রয়োজন না হলে। ঘরে বসে পড়াশুনো। কনফারেন্স, মিটিং সব চলছে গবেষকদের। দুগগা নাম জপছি অহোরাত্র ঘরে বসে।

এখন অনলাইন ম্যানেজমেন্টের ছাত্রের পরীক্ষার ইন্টার্ভিউতেও করোনা ইস্যু। ম্যানেজমেন্ট গুরু শিষ্যকে শুধান " আচ্ছা বল দেখি স্যনাইটাইজারের খুব চাহিদা এখন। বাজারে পাওয়াই যাচ্ছেনা। তোমায় যদি একটা মডেল সেট আপ করতে বলা হয় কি হবে তার স্ট্র্যাটেজি?” তারপর তার সাপ্লাই আর ডিমান্ড নিয়েও ভাবনাচিন্তা । ভাব ম্যানেজমেন্ট ট্রেনী ভাব। গ্রুম কর নিজেকে। করোনার যুগে তোমাদের এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতেই হবে ম্যানেজমেন্ট পড়লে।

পরীক্ষাগারে সহজে রাসায়নিক স্যানিটাইজার তৈরী কিম্বা গ্রামে গঞ্জে ভেষজ পদ্ধতিতে। এমন সব ইনোভেশন দৌড়চ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তেই কলকাতার করোনা কথার জন্ম হল। শয়নে স্বপ্নে জাগরণে এভাবেই করোনা ঢুকে পড়েছে বাঙালীর জীবনযাত্রায়। ধীর গতিতে আমরা পেরিয়ে চলেছি একের পর এক স্টেজ গুলি। এক, দুই, তিন। কে জানে ততদিনে আমিই বা কেমন থাকি।

কলকাতা করোনা কথা - ৫ 
২৩ শে মার্চ, ২০২০
অবশেষে করোনার এপিসেন্টার দক্ষিণ কলকাতার পন্ডিতিয়ার আবাসন ওয়েসিসে গতকাল মধ্যরাতে চারজন আমেরিকার অভিবাসী ফিরলেন দীর্ঘ দিনের ছুটি কাটিয়ে উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। এর মধ্যে দুজন আমাদের ব্লকে, দুজন পাশের ব্লকে। ফেসবুকেও তাঁরা আমার খুব ভালো বন্ধু দিদি। তারা সবাই বেশ বয়স্ক। সিনিয়ার সিটিজেন। বিদেশ থেকে ফিরে কিছুদিন এখানে থেকে তারপর ভারত পরিক্রমায় বেরিয়েছিলেন।প্রতিবারেই যান এমন। শুনলাম তাদের আইসোলেশনে থাকতে বলা হয়েছে। সরকারি নোটিশ। আমার প্রশ্ন হল রোগের সিম্পটম না দেখা দিলে টেস্ট করা হবেনা? না কি অপর্যাপ্ত টেস্ট কিট বেলেঘাটা আইডি তে এবং পিজি তে। আরো দুজনের পড়ুয়া কন্যা বিদেশ থেকে এসে ঘাপটি মেরে ঘরে বসে রয়েছে। ওয়েসিস টাওয়ারে করোনা আক্রান্ত চারজনের কথা তো সবার জানা। তাঁরা এখনও সবাই আইডিতে ভর্তি আছেন। তারপরেই শুনলাম এইমাত্র আমার নীচের তলায় একজন প্রৌঢ় ফিরেছেন কাতার থেকে একমাস আগে। তার নাকি জ্বর জ্বর ভাব আজ থেকে। তবে একমাস বোধহয় পেরিয়ে গেলে ভয়ের কিছু নেই। করোনার ইনকিউবেশন পিরিয়ড দু-সপ্তাহ ভাগ্যিস!
ধরিত্রী দেবী দ্বিধা হ‌ও। রিয়েল এস্টেট নিপাত যাক। ফ্ল্যাট কালচার আর নয়। পুনর্মুষিকো ভব। বাড়িই ভালো। বুঝবেন তো রিয়েল এস্টেটের মালিকরা? সম্বিত ফিরবে আপনাদের? বাড়ি ভেঙে, পুকুর বুজিয়ে বড় বড় আবাসন বানাবেন তো? এই শিক্ষাই করোনার কাছ থেকে নিতে হবে কিন্তু। 
বাকী চার পর্ব  আরও পড়ুন এখানে  CORONA EPICENTRE KOLKATA