২৩ মার্চ, ২০২০

করোনার কড়চা

ঠাত যেন আলোর ঝলাকানি তারই মাঝে। অভিভূত হয়ে পড়ছি সবাই। এদ্দিন স্বার্থপর মানুষ শুধু দারা-পুত্র-পরিবারের অসুখে প্রার্থনা করত। এখন অপারগ হয়ে সারা বিশ্ববাসীর জন্য ভাবছে। শিখছে সভ্য, শিক্ষিত মানুষ। পরিবার আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব একে অপরের খবর নিচ্ছে, সেটাও আমাদের পরম পাওয়া। সব মানুষের পাখীর চোখ এখন করোনা দমন। রাজনীতির রঙ, জাতপাত সব ভুলে সবার লক্ষ্য এক । সেটাই বা কম কিসের? ভাবছিলেন তো মিলন হবে কত দিনে? এইতো এগিয়ে এল সেই বহু আশার মিলনক্ষণ। আমরা সবাই এখন এককাট্টা হয়েছি। মোরা মিলেছি আজ মায়ের সাথে।
ওদিকে রাস্তায় গাড়ি চলছেনা। সব বন্ধ। কেউ বাইরে বেরুচ্ছেনা। যেন বন্ধ উদযাপন চলছে দিনের পর দিন। অর্থাত প্রচুর এনার্জি কনজারভেশন হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। প্রকৃতি খুব খুশি । এজন্য‌ই বুঝি বলে রিসোর্সেস লিমিটেড, বুঝে চল।
আরেকদল শিক্ষিত মানুষ জেনেবুঝেও অন্ধ। এই একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাসের দাপটে রাজার ঘরেও যে অসুখ টুনির ঘরেও তাই। বিলেত ফেরত গায়ক গায়িকা এদ্দিন নিজেকে যত‌ই সেলেব ভাবুন না কেন উনি আসলে কিস্যু নন। গণ্ডমূর্খ। মোটেও সমাজ সচেতন নন। শিল্পী হবার কোনো যোগ্যতাই আসলে নেই তাঁদের, শুধু গান গাইলেই শিল্পী হওয়া যায় না। তাঁরা ছড়ালেন রোগ। ছড়াচ্ছেন‌ও প্রতিমূহুর্তে। মরছি আমরা, যারা সরকারি বিধি মেনে চলছি। দামী চিকিত্সক থেকে নামী আমলা, খেলোয়াড় থেকে অভিনেতা আজ আমি-আপনি কিন্তু সমান রিস্কে, সেটা অন্ততঃ বুঝুন। রাজার রোগ, টুনির রোগ এখন সমান।

আমাদের তো দিব্য চলছিল কবিতার আড্ডা, সাহিত্য‌আড্ডা, জনসমাবেশ, মাল্টিপ্লেক্সে হৈ হৈ হ্যাঙ‌আউট, শপিংমলের ফুডকোর্টে মস্তির দিনলিপি। ক্রমে চীন, জাপান, কোরিয়া আর তারপর দস্তুর মত ইউরোপ। ইতালি কে শেষ করে ইরান। আমেরিকাতেও অনুরূপ অবস্থা।  দাপিয়ে বেড়াতে বেড়াতে অবশেষে ভারতে ঢুকে এল করোনা ।  তখনও হুঁশিয়ার নয় আম বাঙালী। ওয়ার্ক ফর্ম হোম, অনলাইনে পড়ানো এসব করতে করতে ঘরে বোরড হয়ে ক্লাবে কিম্বা রেস্তোরাঁয় গিয়েছে তারা। নাহ! তারপর অ্যাটলাস্ট সেই অশৌচ পর্ব পালন আবশ্যিক হয়েই পড়ল। তবুও ভবি ভোলার নয়। কলকাতায় কাজের লোকেরা সবেমাত্র বলতে শুরু করেছে, কি একটা রোগ এইয়েচে গো?
এর মধ্যে ফুলেল শহরে বসন্তের কোকিলের কুহুতান । তার শুধু চিন্তা আহার-মৈথুনের আর বাঙালীর ভ্রমণের। তায় আবার পুরোদস্তুর ছুটির আমেজ। বাঙালীর ভ্রমণ পিপাসা পায়। ভাবতে অবাক লাগে। হোয়াটস্যাপে দী-পু-দার প্ল্যান হয়। ফূর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ যেন। এরা আবার গাড়ির মধ্যে ঢুকে সেলফি তুলে এই ডামাডোলের বাজারে ফেসবুকে পোস্ট‌ দেবার লোভ সামলাতে পারেনা। বলে ওঠে, হ্যালো ফ্র্যান্দস...চললুম পলাশের দেশে। কারণ বসন্ত ফুরায়। বাঙালীর বেড়ানোর নেশা পৃথিবীর সব জাতের চেয়ে বেশী কিনা।
ততক্ষণে লন্ডন ফেরত শিক্ষার্থী, আমলা ও ডাক্তারের পুত্র ছড়িয়েই দিল সেই মারণ রোগ কলকাতায় । ঠিক তারপরেই দক্ষিণ কলকাতার ওয়েসিস আবাসনের ব্যাবসায়ী পুত্র। এরা সবাই লন্ডন ফেরত। কিন্তু কারোর কোনও হেলদোল নেই। নেই স্বাস্থ্য সচেতনতা। বাড়ির লোকেও ভাবল না নিজেদের কথা, পড়শির কথা। মশাই এরা মানুষ? মানুষের তো আক্ষরিক অর্থে মান এবং হুঁশ দুই থাকতে হয় জানি। আবার নির্লজ্জের মত কলকাতার বাপ মায়েরা তাদের বিদেশে পড়া ছেলেপুলেকে ডেকে ডেকে নিয়ে এলেন দেশে। আহা! বলুন তো! মায়ের প্রাণ! আয় তোরা আয় ফিরে অথবা বেটা তুরন্ত  বাপাস আ যা । সঙ্গে নিয়ে আয় দু' চারটে করোনা।
তাদের উদ্দেশ্যে বলি, আমাদেরও আছে মশাই বত্রিশ নাড়ী ছেঁড়া ধন সেদেশে পড়ে। তবু বলেছি বেরুবি না একদম। প্রয়োজন না হলে। ঘরে বসে পড়াশুনো। কনফারেন্স, মিটিং সব চলছে গবেষকদের। দুগগা নাম জপছি অহোরাত্র ঘরে বসে।

এখন অনলাইন ম্যানেজমেন্টের ছাত্রের পরীক্ষার ইন্টার্ভিউতেও করোনা ইস্যু। ম্যানেজমেন্ট গুরু শিষ্যকে শুধান " আচ্ছা বল দেখি স্যনাইটাইজারের খুব চাহিদা এখন। বাজারে পাওয়াই যাচ্ছেনা। তোমায় যদি একটা মডেল সেট আপ করতে বলা হয় কি হবে তার স্ট্র্যাটেজি?” তারপর তার সাপ্লাই আর ডিমান্ড নিয়েও ভাবনাচিন্তা । ভাব ম্যানেজমেন্ট ট্রেনী ভাব। গ্রুম কর নিজেকে। করোনার যুগে তোমাদের এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতেই হবে ম্যানেজমেন্ট পড়লে।

পরীক্ষাগারে সহজে রাসায়নিক স্যানিটাইজার তৈরী কিম্বা গ্রামে গঞ্জে ভেষজ পদ্ধতিতে। এমন সব ইনোভেশন দৌড়চ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তেই কলকাতার করোনা কথার জন্ম হল। শয়নে স্বপ্নে জাগরণে এভাবেই করোনা ঢুকে পড়েছে বাঙালীর জীবনযাত্রায়। ধীর গতিতে আমরা পেরিয়ে চলেছি একের পর এক স্টেজ গুলি। এক, দুই, তিন। কে জানে ততদিনে আমিই বা কেমন থাকি।

কলকাতা করোনা কথা - ৫ 
২৩ শে মার্চ, ২০২০
অবশেষে করোনার এপিসেন্টার দক্ষিণ কলকাতার পন্ডিতিয়ার আবাসন ওয়েসিসে গতকাল মধ্যরাতে চারজন আমেরিকার অভিবাসী ফিরলেন দীর্ঘ দিনের ছুটি কাটিয়ে উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। এর মধ্যে দুজন আমাদের ব্লকে, দুজন পাশের ব্লকে। ফেসবুকেও তাঁরা আমার খুব ভালো বন্ধু দিদি। তারা সবাই বেশ বয়স্ক। সিনিয়ার সিটিজেন। বিদেশ থেকে ফিরে কিছুদিন এখানে থেকে তারপর ভারত পরিক্রমায় বেরিয়েছিলেন।প্রতিবারেই যান এমন। শুনলাম তাদের আইসোলেশনে থাকতে বলা হয়েছে। সরকারি নোটিশ। আমার প্রশ্ন হল রোগের সিম্পটম না দেখা দিলে টেস্ট করা হবেনা? না কি অপর্যাপ্ত টেস্ট কিট বেলেঘাটা আইডি তে এবং পিজি তে। আরো দুজনের পড়ুয়া কন্যা বিদেশ থেকে এসে ঘাপটি মেরে ঘরে বসে রয়েছে। ওয়েসিস টাওয়ারে করোনা আক্রান্ত চারজনের কথা তো সবার জানা। তাঁরা এখনও সবাই আইডিতে ভর্তি আছেন। তারপরেই শুনলাম এইমাত্র আমার নীচের তলায় একজন প্রৌঢ় ফিরেছেন কাতার থেকে একমাস আগে। তার নাকি জ্বর জ্বর ভাব আজ থেকে। তবে একমাস বোধহয় পেরিয়ে গেলে ভয়ের কিছু নেই। করোনার ইনকিউবেশন পিরিয়ড দু-সপ্তাহ ভাগ্যিস!
ধরিত্রী দেবী দ্বিধা হ‌ও। রিয়েল এস্টেট নিপাত যাক। ফ্ল্যাট কালচার আর নয়। পুনর্মুষিকো ভব। বাড়িই ভালো। বুঝবেন তো রিয়েল এস্টেটের মালিকরা? সম্বিত ফিরবে আপনাদের? বাড়ি ভেঙে, পুকুর বুজিয়ে বড় বড় আবাসন বানাবেন তো? এই শিক্ষাই করোনার কাছ থেকে নিতে হবে কিন্তু। 
বাকী চার পর্ব  আরও পড়ুন এখানে  CORONA EPICENTRE KOLKATA 

কোন মন্তব্য নেই: