ধুর
মশাই ! আর
এই প্রতিবছর এই নারীদিবসে আর হ্যাজাতে ভাল্লাগেনা
আমার। এই বিশেষ দিনগুলো আসলে
বড্ড দেখনদারির আর গ্লোবালাইজেশনের
চক্করে পড়ে ঐ উইমেনস হরলিকস,
কেলগস
স্পেশাল কে,
হীরের
গয়নায় ছাড়,
শড়িতে
ফ্ল্যাট ডিসকাউন্ট আজকের
জন্য অথবা বেকারী শপে শুধু মেয়েদের
জন্য আজ কেক কিনলে চকোলেট ফ্রির
শোয়িং অফ । এসবে আমার চিঁড়ে
ভেজার নয়। আমি রক্ষণশীল পরিবারে
বড় হয়েছি। রক্ষণশীল পরিবারে
বিয়ে হয়ে এসেছি। মেয়েদের
অধিকার টধিকার নিয়ে,
আদ্দেক
আকাশের ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে
দুই পরিবার বেশ সজাগ এবং সচেতন।
তবে এদের সেই "ভবি
ভোলার নয়"
ব্যাপারটাকে
আমি প্রায় ৮০ শতাংশ ভুলিয়েই
ছেড়েছি। তাই ঐ সব নারীদিবস
উদযাপন টুজ্জাপন আমার কাছে
নয়। অধিকারের প্রশ্নে যে জন্য
আজকের দিনটা পালন হয় আন্তর্জাতিক
ক্ষেত্রে সেটা বেশ স্পেশ্যাল
বটেই।
শৈশব
থেকে কৈশোর পদার্পণেই আমি
দেখেছি চরম লিঙ্গ বৈষম্য।
আত্মীয়স্বজন,
বন্ধুবান্ধবের
দ্বারা প্ররোচিত হয়ে সংসারে
মেয়ের কোলে কি করে ছেলে আনতে
হয় অথবা মেয়ে জন্মালে শাঁখ
বাজাতে নেই কিম্বা ছেলের
জন্মদিনে কেমন পরিপাটি করে
পায়েসের বাটি কিম্বা মাছের
মুড়োটি আগেভাগে তুলে রাখা
হয়। দেখে এসেছি । আমাদের বাড়িতেই
বলতে শুনেছি "ছেলের
মুতে কড়ি, মেয়ের
গলায় দড়ি"।
অথবা
মাধ্যমিকে স্টার পেলে "হীরের
টুকরো ছেলে"
বলতে
শুনেছি। হীরের টুকরো মেয়ে
বলতে শুনিনি আজ অবধি। তা যা
বলছিলাম, একটু
বড় হতেই মেয়েবেলার স্বাধীনতা
খর্ব হয়েছে একাধিকবার। হাঁটু
ঝাড়িয়ে ফ্রকের ঝুলেই হোক
কিম্বা বুকের কাছে ফ্রিল দেওয়া
ফ্রকেই হোক। ফ্যাশন নয় মোটেও।
শ্যাম্পু করা চুলে একখাবলা
তেল। সেটা নিজের অপছন্দ হলেও।
একটা পনি টেল নয়,
দুই বিনুনীই
মাস্ট কারণ "বড়
হওনি এখনো"
কিম্বা
এখুনি "ব্রা"
নয়। আরো
পরে। মামারবাড়িতে দেখেছি
পঙক্তিভোজে একপাল তুতো ভাইবোনদের
মাঝে নাতনীদের বরাদ্দ আধখানা
ডিম আর নাতিদের পুরো ডিম
পরিবেশিত হতে ।এমনকি নিজের
যখন সিজারিয়ান সেকশন করে ছেলে
সবেমাত্র বেবিকটে তখনো সম্পূর্ণ
জ্ঞান আসেনি। আধো ঘুমঘোরে
আমি। আর আমার মাথায় হাত রেখে
অভিভাবকরা নিজেদের মধ্যে
আলোচনা করছেন,
"ছেলের
সব কিছুই আলাদা"
আমার
নিজের জন্মের ন'বছর
পরে ভাই হওয়াতে ধুমধাম করে
অন্নপ্রাশন হতে দেখেছিলাম।
ভাই হতে স্কুলে ক্লাস শুদ্ধ
বন্ধুদের লজেন্স খাওয়াতে
দিয়েছিলেন বাবা মা। অথচ আমার
নাকি সেভাবে ঘটাই হয় নি মুখেভাতে।
কারণ আমাদের বাড়িতে নাকি মেয়েদের মুখে ভাত হয়না। আর যেহেতু আমার ভাই আমার থেকে
অনেকটাই "ধলা"
অর্থাত
সাহেবদের মত ফর্সা তাই আজন্মকাল
বাড়িতে শুনে এসেছি "মেয়েটা
ছেলেটার মত "রং"
পেল না"।
আমার
জন্য মাধ্যমিক,
উচ্চমাধ্যমিকে
একজন অংকের মাস্টারমশাই ছাড়া
আর কোনো প্রাইভেট টিউটার ছিল
না। তখন ভাবতাম বাবার সামর্থ্য
নেই। সামান্য চাকরী। একটা বড়
বাড়ি করেই তিনি ফতুর। আরেকটু
লাইফ সায়েন্সটা যদি কেউ দেখিয়ে
দিত! লেটার
মিস করেছিলম চার নম্বরের জন্য।
শুধু ভেবেই গেছি। মুখ ফুটে চাইতে
পারিনি কখনো। তারপর ভাইয়ের মাধ্যমিক এগিয়ে আসতে দেখেছি
প্রতি বিষয়ের ওপর তার জন্য নিযুক্ত প্রাইভেট টিউটর। মনে মনে খুব আঘাত পেয়েছি কিন্তু
ভাইয়ের প্রতি অকুন্ঠ স্নেহের
জন্য কিছুই বলতে পারিনি। আবার
তখন আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আগে
আমিই ওকে পড়তাম। অতএব শিক্ষক
তো লাগবেই।এমনি ভেবে শান্ত হয়েছি।
বিয়ের
ঠিক করেছেন বাবা। বিদেশ যাত্রা
হয়েছে তারপরেই। নিজের সংসার,
ছেলের
জন্ম, কেরিয়ারে
ইতি ঘোষণা। শ্বশুরবাড়িতে এসে
দেখেছি আরেকরকমের রক্ষণশীলতার
ঘেরাটোপ।
সেখানেও
একবাড়ির মধ্যে মন্ত্রণাদাতা
একপাল শাশুড়ির দল। কেউ সধবা,
কেউ বিধবা,
কেউ আজন্ম
আইবুড়ো, কেউ
হতবান্ধব। এবার আরো শুল্ক
আরোপ। আরো বৈষম্য। বাড়ির ছেলে
বৌয়ের কাপড় তুললে বা মেললে
সেখানে রীতিমতো রে রে করে তেড়ে
আসে কেউ। ছুটির দিনে বরের
সঙ্গে বারান্দায় দাঁড়ালে বা
দুপুরবেলায় দরজা বন্ধ করে
শুলে মহাপাপ হয়। নাইট শো'তে
সিনেমা গেলেও একই অবস্থা।
অবিশ্যি আমার বর একহাত নিতেও
ছাড়ে নি কখনো। আমার দিদা এদিকে
রক্ষণশীল হলেও বলতেন,
ওসব,
"সহে
রহে বাদ দাও,
বুকে বসে
দাড়ি ওপড়াতে হবে সেটাই নিজের
অধিকার রক্ষার একমাত্র উপায়, মেয়েদের"
তাই "আমারে
কেহ দাবায়ে রাখতে পারবা না"
সেই
আপ্তবাক্যি মাথায় নিয়েই চলেছি
এখনো অবধি। আমেরিকায় গিয়ে
সেই মাত্র ২৩ বছরে স্টুডেন্ট
পার্টির জন্য বর এবং তার
বন্ধুদের সঙ্গে হৈ হৈ করে
ওয়াইন শপে গিয়ে যখন ক্যান
ক্যান বিয়ার আর লিকারের ক্রেট
কিনে গাড়িতে উঠেছি তখন বন্ধুরা
হাসতে হাসতে বলেছে"
ছবি তুলে
রেখে দে, বঙ্গবধূর
এহেন পদস্খলন দেখলে আর দেখতে
হচ্ছে না"
অথবা
প্যারিসের নাইটশো'তে
ক্যাবারে,
সেখানেও
সেই এক কথা,
বুঝেছ?
বাড়ি গিয়ে
এসব গল্প করে বোলো"
তখন মনে
হয়েছে মুখে আগুণ নারীস্বাধীনতার!
মেয়েদের
তো ছেলেরাই এভাবে জায়গা করে
দেবে তা নয় আমাদের বাড়ির মেয়েরাই
তো আজন্মকাল মেয়েগুলোর স্বাধীনতা
খর্ব করে দিয়েছে। ডাক্তার
জামাইবাবুর সঙ্গে সিনেমা
দেখা নিয়ে অথবা গোপনে সব শালীদের
নিয়ে চকোলেট ফ্লেবার্ড সিগার
সেবন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
আর
প্রশ্ন কিন্তু তুলেছেন মেয়েরাই।
ছেলেরা বরং বলেছেন ছেড়ে দাও।
তবে আমি অনেক বদল এনেই ছেড়েছি। মায়ের কাছেও, শাশুড়ির কাছেও। রীতিমত কাউন্সেলিং করে চলেছি এখনো। শাশুড়িকে স্লিভলেস ব্লাউজ থেকে হাউসকোটে উত্তরণ করতে সমর্থ হয়েছি। তাঁর সাধের পুত্রটিকে দিয়ে জামাকাপড় তোলানো থেকে মেলা অথবা নিজের মা'কে এমন মোল্ড করেছি যে বাবা এখন রান্নাঘরের চায়ের ডিপার্টমেন্ট এর দায়িত্ত্বে।
আমার ছেলে আরো বদলে দিয়েছে। "ফুলকো লুচি আমি আর বাবা খাব না ঠাম্মা। ওগুলো মা আর তুমি খাবে। কিম্বা কাজের মাসী ছুটি চাইছে, সেটাই তো স্বাভাবিক মা, তুমি হলে পারতে রোজ রোজ কাজ করতে? অথবা আমাদের ঐ কুচকুচে কালীমায়ের ওপর তোমাদের এত দরদ অথচ বিয়েবাড়িতে গিয়ে নতুন বৌ "কালো" হয়েছে বলে গাড়িতে উঠেই তোমরা সমালোচনায় মত্ত হও! কি হিপোক্রিট তোমরা, আই মিন এই মেয়েরা!" এমনো বলেছে।
তবে আমি অনেক বদল এনেই ছেড়েছি। মায়ের কাছেও, শাশুড়ির কাছেও। রীতিমত কাউন্সেলিং করে চলেছি এখনো। শাশুড়িকে স্লিভলেস ব্লাউজ থেকে হাউসকোটে উত্তরণ করতে সমর্থ হয়েছি। তাঁর সাধের পুত্রটিকে দিয়ে জামাকাপড় তোলানো থেকে মেলা অথবা নিজের মা'কে এমন মোল্ড করেছি যে বাবা এখন রান্নাঘরের চায়ের ডিপার্টমেন্ট এর দায়িত্ত্বে।
আমার ছেলে আরো বদলে দিয়েছে। "ফুলকো লুচি আমি আর বাবা খাব না ঠাম্মা। ওগুলো মা আর তুমি খাবে। কিম্বা কাজের মাসী ছুটি চাইছে, সেটাই তো স্বাভাবিক মা, তুমি হলে পারতে রোজ রোজ কাজ করতে? অথবা আমাদের ঐ কুচকুচে কালীমায়ের ওপর তোমাদের এত দরদ অথচ বিয়েবাড়িতে গিয়ে নতুন বৌ "কালো" হয়েছে বলে গাড়িতে উঠেই তোমরা সমালোচনায় মত্ত হও! কি হিপোক্রিট তোমরা, আই মিন এই মেয়েরা!" এমনো বলেছে।
আমি
অবিশ্যি তার আগেই বদলে গেছি
নিজের মত করে। ছেলের বিয়ের
পর থেকেই প্রতি মা ষষ্ঠীর
পুজোয় ছেলে-বউ দুজনের নামেই পয়সা তুলে
রাখি ঠাকুরের কৌটোতে। সব পয়সা
জমিয়ে সারাবছর পর দুর্গাষষ্ঠীতে
পুজো দিই।
আমার
মা ও বদলেছেন। শুধু ছেলের জন্য
নয়। মেয়ে, জামাই,
বৌ সকলের
জন্য পুজো তুলে রেখে ষষ্ঠীদেবীর
কাছে মঙ্গল কামনা করেন সবার জন্য । তবে আমার শাশুড়ি মা কিন্তু
এখনো পারলেন না। এবারেই শীতল
ষষ্ঠীর দিন ছেলের কপালে কয়েন
ছোঁয়ালেন। আমি বললাম তক্ষুণি,
আমি বাদ?
বললেন,
আহা!
ও তো আমার
ছেলে বলো! বললাম
"তো"?
আমিও তো
আপনার ছেলের ছেলেকেই গর্ভে
ধারণ করেছি। বললেন ও আলাদা।
আমার বত্রিশ নাড়ী ছেঁড়া ছেলে।
তোমার মা তোমার জন্য তো করবেই ।
আমাকে আমার মত করতে দাও। তাই
এই কিস্সার শেষ হবেনা জীবনেও।
ভবিরা ভুলবেওনা কোনোদিনো।
মেয়েরাই আজন্মকাল মেয়েদের
দাবিয়ে রাখবে। আবার খবরের
কাগজে, টিভি
চ্যানেলে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের গুরুগম্ভীর সব বক্তিমে
শুনে হাততালি দেবে। পারলে
নিজেদের লেডিসক্লাবে গিয়ে
চুপুচুপি বন্ধুদের একটা করে
লবেঞ্চুস খাইয়ে বলবে "হ্যাপ্পি উইমেন্স ডে"
তবে ঐটুকুই।
ভাগবত বা গীতার সারমর্মটুকু
পাঠস্থানে রেখে এসেই খালাস
তাঁরা। বাড়ি বাড়ির মতোই।
সেখানে মেয়েদের নিজের টাঁইস্যে
রাখতে হয়। কথাতেই তো বলে "লঙ্কা
জব্দ শিলে,বউ
জব্দ কিলে" নয়ত বাড়ির নারী এগিয়ে যাবে তার স্বাধিকার লঙ্ঘনে।
আজন্মকাল
ধরে যদি আন্তর্জাতিক নারীদিবস
পালন করে এই নারীদের নাড়িতে
সামান্যতম বিদ্যুত খেলত!
তবেই হত
এইদিনের সার্থকতা!
আর পারলাম না নিজের বাবাকেও। একমাত্র ভাই দূরে থাকে। নিজের কাজের জন্য আসতেও পারেনা। দেখভালও করেনা। তাদের সব দায়িত্ত্ব আমার ওপরেই বর্তেছে । মাঝেমাঝেই তিনি বলে ওঠেন "তুই আমার বড় ছেলের কাজ করছিস" খুব দুঃখে বলে উঠি, কেন গো বাবা? মেয়ে বলতে এখনো তোমার এত কষ্ট হয়? আমার যে খুব ক্লিশে লাগে শুনতে।
( যুগশঙ্খ ডিজিটালে প্রকাশিত ২০১৯ নারীদিবসে )
আর পারলাম না নিজের বাবাকেও। একমাত্র ভাই দূরে থাকে। নিজের কাজের জন্য আসতেও পারেনা। দেখভালও করেনা। তাদের সব দায়িত্ত্ব আমার ওপরেই বর্তেছে । মাঝেমাঝেই তিনি বলে ওঠেন "তুই আমার বড় ছেলের কাজ করছিস" খুব দুঃখে বলে উঠি, কেন গো বাবা? মেয়ে বলতে এখনো তোমার এত কষ্ট হয়? আমার যে খুব ক্লিশে লাগে শুনতে।
( যুগশঙ্খ ডিজিটালে প্রকাশিত ২০১৯ নারীদিবসে )
1 টি মন্তব্য:
সুন্দর লেখা । রাগের সঙ্গে দুঃখের যুগলবন্দী । রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে ও বৌ আমিও । বাপের বাড়িতে যদিও এসব পোহাতে হয়নি। তবে দিন একেবারে পাল্টেছে । ব্যক্তিগত লড়াই লড়তে লড়তে মাঝেমাঝে অবশ্য অবহেলিত নিরন্ন নারীদের জন্য কষ্ট হয় ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন