৫ নভে, ২০২১

সেই তো মল খসালি তবে কেন লোক হাসালি

 সেই তো মল খসালি তবে কেন লোক হাসালি

আগে কোন কাজ করতে অস্বীকৃত হয়ে পরে উপযাচক হয়ে এবং স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সেই কাজ করতে স্বীকৃত হলে এমন প্রবাদ আজও মুখে মুখে ফেরে। এমন অনর্থক ভণিতা করা আমাদের অনেকেরই অভ্যেস। তা সে রাজনৈতিক, সামাজিক বা পারিবারিক ক্ষেত্র হোক। এসব হল মানুষের চরিত্র। তবে এই প্রবাদটির শুরু বা জন্ম হয়েছিল অন্যভাবে। তখন বলা হত সেই তো নথ খসালি তবে কেন লো হাসালি? 

সে যুগে পতিতাবৃত্তি এবং বেশ্যারা মানুষের মনোরঞ্জনের অন্যতম ব্যবহৃত পণ্য ছিলেন। অনেক বাঈজি তার অবাঞ্ছিত কন্যা কে গায়িকা এবং নর্তকী রাখার চেষ্টা চালাতে ব্যস্ত থাকতেন কিন্তু ঘুণাক্ষরেও তা প্রকাশ করতেন না সর্বসমক্ষে। যেন বাঈজি কন্যা কিছুতেই বেশ্যাবৃত্তি করবেনা। তখন কুমারীত্বের লক্ষণ ছিল নথ আর নথ ভাঙার অর্থ হল কুমারীত্বের বিসর্জন দেওয়া। 

এবার অভাবের চাপে বাধ্য হয়ে মা বাইজীর মেয়ের সেই কুমারীত্ব বহু মূল্যে বিক্রীত হতে দেখলে অন্য রসিক সমালোচকরা ঈর্ষান্বিত হয়ে এই মন্তব্য করতেন। এ প্রায় অভ্যেসের পর্যায়ে চলে যেত সে যুগে। 

অভাবে সামিল হয়ে বাঈজী মা তার সেই কন্যার কুমারীত্ব ভাঙার জন্য চড়া ক্রয়মূল্য হেঁকে বসতেন যা সাধারণ রসিক জনের সাধ্যের বাইরে ছিল ।

যার ফলে পাতি রাজা বা জমিদার ধনীদের ভাগ্যে সেই কুমারী রত্ন জুটবেনা কারণ তাদের ভাগ্যে তা নেই বলে এমন ঈর্ষান্বিত মন্তব্য করে বসতেন। এখনও পরিস্থিতির চাপে কেউ নিজের অবস্থান পরিবর্তন করলে আজও এরূপ মন্তব্য করা হয়।

অনেকেই হয়ত গায়ে মাখেন না এমন প্রবাদ। ভাবেন, নিন্দুকে যা বলছে বলুক, তাতে আমার কী? আমার কাজ উদ্ধার হওয়া নিয়ে কথা।রাজনীতির আঙিনায় এমন ঘটনা আমরা আকচার দেখি।মনে মনে বলেও থাকি উদ্দিষ্ট ব্যক্তির সম্পর্কে। কিন্তু তাঁরা সেসব শুনতেই পান না।    

১৪ অক্টো, ২০২১

দুর্গার শক্তির মূলে কী রহস্য? / ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

টেরাকোটার দুর্গা - লেখকের নিজস্ব সংগ্রহ থেকে 


মহিষাসুর তখন অসুরগণের রাজা। দেবতাদের বলে অমরত্ব লাভ করে তার বিশাল প্রতিপত্তি। অত্যাচারী মহিষাসুর তখন দেবতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে ঠিক করেছে। স্বর্গ তার পাখির চোখ। যেনতেনপ্রকারেণ দেবতাদের পরাজিত করে স্বর্গরাজ্য তার দখলে আনতেই হবে। একশো বছর ধরে যুদ্ধ করে স্বর্গরাজ্য নিজের করায়ত্বে আনল সে। দেবসেনাবাহিনী পরাজিত হল আর মহিষাসুর হল স্বর্গের রাজা। দেবতাগণ একত্র হয়ে বিষ্ণু ও মহাদেবকে সঙ্গে নিয়ে প্রজাপিতা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হল। একজন অসুরের কাছে তাঁরা কি করে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন সব কাহিনী জানালেন ব্রহ্মাকে। দেবতাদের মুখে মহিষাসুরের দ্বারা এমন লাঞ্ছনার ঘটনা শুনে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহাদেব যারপরনাই ক্রুদ্ধ হলেন। তাঁদের মুখমন্ডল থেকে এক মহাতেজ নির্গত হল। হিমালয় অঞ্চলে ঋষি কাত্যায়ণের আশ্রমে সেই মহাতেজ থেকে জন্ম নিল এক দেবী। আশ্বিনমাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে তাঁর আবির্ভাব হল আর ঋষি কাত্যায়ণের আশ্রমে জন্ম বলে তাঁর নাম হল কাত্যায়ণি। 

অদ্রিজা মাদুর্গার আরেক নাম । অদ্রি অর্থাত পর্বত হিমালয়ের কন্যা বলে তাঁকে এই নামে ভূষিত করা হয় ।

পুরাণ আর শাস্ত্রের পাতায় আমরা আবির্ভূতা হতে দেখি সেই অসামান্যা নারী কে যিনি একহাতে বরাভয় অন্যহাতে তুলে নেন অস্ত্র। দশপ্রহরেণ সেই দেবীশক্তির হাতে পরাজিত হয়েছিলেন মহিষাসুর। এবার দেখা যাক এই দেবীশক্তির রহস্যের পেছনে কোন্‌ ঘটনা ছিল।

শিবের তেজে দেবীর মুখ, যমের তেজে কেশপাশ, বিষ্ণুর তেজে বাহুসমূহ, চন্দ্রের তেজে কুচযুগ, ইন্দ্রের তেজে শরীরের মধ্যভাগ, বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও উরুদ্বয়, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্রহ্মার তেজে পদযুগল, সূর্যের তেজে পায়ের অঙ্গুলিসমূহ, এবং কুবেরের তেজে তৈরী হল উন্নত নাসিকা। অষ্টাবসুর তেজে তার হাতের আঙুল তৈরী হল। দক্ষাদি প্রজাপতিগণের তেজে তাঁর দন্তসকল এবং বহ্নির তেজে দেবীর ত্রিনয়ন সৃষ্টি হল। সন্ধ্যাদেবীদ্বয়ের তেজে ভ্রূযুগল ও বায়ুর তেজে উত্পন্ন হল কর্ণদ্বয়। দেবী এরূপে তেজসম্ভূতা হলেন কিন্তু মহিষাসুরকে বধ করবার জন্য তো তেজই যথেষ্ট নয়। তাই সকল দেবতারা এই দেবীকে অসুর বধের জন্য নানাবিধ দিব্যাস্ত্র যোগাতে লাগলেন। 

গভীর গর্জণে আকাশবাতাস ধ্বনিত হল। দেবীর সিংহনাদে দশদিশি কম্পিত হল। পৃথিবী ও পর্বতসকল বিচলিত হল। দেবগণ সানন্দে সিংহবাহিনী দেবীর জয়ধ্বনি দিলেন। মুণিগণ দেবীর স্তব শুরু করলেন। অসুরগণ ত্রিলোকবাসী দেবতাদের উদ্দেশ্যে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ধেয়ে এল। যুদ্ধ শুরু হল প্রবল।

যেহেতু ব্রহ্মার বরে মহিষাসুর দেবাসুর-দানবের অবধ্য হলেও স্ত্রীবদ্ধ হবে তাই বুঝি ঋষি কাত্যায়ণ সকল দেবতার তেজ এবং ক্রোধানলের শক্তি ও দিগন্তব্যাপী সংহত তেজ দিয়ে তৈরী করলেন এই কাত্যায়ণীকে।

বিন্ধ্যপর্বতে এই তিলোত্তমা দেবী মহামায়া বা কাত্যায়ণি সসৈন্যে অগ্রসর হয়ে অচিরেই বধ করলেন মহিষাসুর নামক দোর্দ্দন্ডপ্রতাপ ঐ দৈত্যটিকে। আর এই মহিষাসুরকে বধ করে দেবীর অপর নাম হল মহিসাসুরমর্দ্দিণি ।


১৩ অক্টো, ২০২১

দুর্গাবাহিনীর বাহনকথা / ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

 

মহিষাসুর - লেখকের নিজস্ব। পুরুলিয়ার চড়িদার ছৌ মুখোশ 
পশুপাখির ছবি ইন্টারনেট 

স্বজন পরিবৃতা মাদুর্গার যে রূপটি দেখতে আমরা অভ্যস্ত তেমনি ভাবে দুর্গা পুজোর প্রচলন ঘটেছিল গুপ্তযুগে।সিংহবাহিনী দুর্গার সঙ্গে আমরা দেখি একগন্ডা পশুপাখীকে। দেবীর বাহনরূপে পশুরাজ সিংহ, মহিষের দেহ থেকে নির্গত অসুর, লক্ষ্মীর পায়ের কাছে পেঁচা, সরস্বতীর রাজহাঁস, গণেশের পায়ের কাছে ছোট্ট ইঁদুর আর কার্তিকের পাশে ময়ূরকে। আদতে ঐ একরত্তি পাখীগুলি বা ইঁদুরের ওপরে চড়ে বসলে দেবতার ভারে তাদের প্রাণ বেরিয়ে যাবার কথা। মাদুর্গা না হয় সিংহবাহিনী হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। অসুর না হয় স্ত্রী মহিষের পেটে জন্মেছিলেন আর পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে মায়ের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। তাই বলে অন্যদের সঙ্গে এত পশুপাখীর কি সম্পর্ক?    

  • মহিষাসুর =  মহিষ + অসুর

পুরাণে বর্ণিত আছে রম্ভাসুর ও গর্ভবতী এক মহিষীর মিলনে জন্ম হয়েছিল মহিষাসুরের । তার বৈশিষ্ট্য হল তার হাত-পা সব মানুষের মত কিন্তু মুখটি শিং সহ মহিষের মত । সে জন্মের পরেই স্বর্গরাজ্য লাভের আশায় তপস্যা শুরু করেছিল । বহুকাল কঠোর তপস্যার পর ভগবান ব্রহ্মা তুষ্ট হয়ে তাকে অমরত্ব ছাড়া যেকোনো  বরদান করতে সম্মত হলেন । এই বরে দেবতা, যক্ষ, রক্ষ, গন্ধর্বাদি কেউই তাকে হত্যা করতে পারবেনা  এবং কেবল কোনো অবলা নারীর হাতেই  সে ধ্বংস হবে এরূপটিই চাইলেন মহিষাসুর । তাই  তুমুল যুদ্ধের পর মা দুর্গাই একমাত্র পেরেছিলেন একে বধ করতে । মহিষ তমোগুণের প্রতীক । মহিষাসুর মহিষ থেকে জাত বলে সে ভয়ংকর এবং যুদ্ধে দুর্গার সত্ত্বগুণের দ্বারা সেই তমোগুণের বিনাশ হয়  ।

  • সিংহারূঢ়া দেবী

দেবীর বাহন সিংহ । তাঁর পায়ের নীচে সিংহের অবস্থান । দুর্গা হলেন সমস্ত শুভ শক্তির কান্ডারী । আর এমন গুণকে ধারণ করে দেবীর মন ।  সিংহ মানুষের জৈবপ্রবৃত্তি তথা পশুভাবকে লালন করে  । অরণ্যে ঘুরে শিকার সংহার করে । এহেন জৈব প্রবৃত্তির বিনাশ ঘটান মা দুর্গা । আর এরূপ পুরুষসিংহই  মা’কে শুভ কার্যে বহন করে নিয়ে চলে  । সে থাকে পায়ের নীচে অর্থাত দুর্গা হলেন জয়ী আর অশুভ সেই সংহার মনোবৃত্তি মায়ের পায়ের তলায় ধ্বংস হয় । সিংহরূপী মনকে বয়ে বেড়ান মা দুর্গা এবং অবশেষে তার পাশবিক স্বার্থপরতাকে গ্রাস করে তার শুভবুদ্ধির উদয় ঘটান ।

  • পেঁচা

লক্ষ্মীর বাহন নিশাচর পেঁচা । অন্ধকার যার আশ্রয় । লক্ষ্মী সৌভাগ্য-সমৃদ্ধির  আলোর দিশা দেখান  পেঁচাকে সাথে নিয়ে  অর্থাত অন্ধকার ও আলোর মধ্য থেকে জীবজগত আলোর দিশা খুঁজে নেবে । কারণ জীবনে ঘাত-প্রতিঘাতের লড়াইতে সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য উভয়ই থাকবে কিন্তু  সব পরিস্থিতিতেই অবিচল থেকে আলোর পথ যাত্রী হয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলতে হবে । জাগতিক সত্ত্ব ও তমগুণের মধ্য থেকে সত্ত্বটুকুকে বেছে নিতে হবে । তাই বলে তমকে বাদ দিলেও বাদ দেওয়া যাবে না তাই এই নিশাচর ।

  • রাজহাঁস

সরস্বতীর বাহন শ্বেত রাজহংস ।  সরস্বতী পুরাণে বর্ণিত গঙ্গার মত এক পুতঃসলিলা নদী । তাই সরস্বতীর সাথে রাজহংস অনুষঙ্গটি  মনে করিয়ে দেয় নদীর জলপ্রসঙ্গকে । এবার রাজহংস জল ও দুধের মিশ্রণ থেকে সারটুকু অর্থাত কেবলমাত্র দুধটুকু গ্রহণ করে । তাই বিবেকমান জীবজগত সংসারের অসার বা অনিত্যকে সারটুকু গ্রহণ করার বারতাই বোধহয় ছড়ায় রাজহাঁস । আর সবকিছু সাদা রং বহন করে অমলিনতা যে শ্বেত রাজহংসের গায়ে কখনো অবিদ্যারূপ মলিনতা স্পর্শ করতে পারেনা ।

  • ইঁদুর

বিশালাকার গণপতির বাহন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মুষিক । এখানে গণেশ নেতা বা গণশক্তির প্রতীক । আর তার অনুপাতে অতি ক্ষুদ্র ইঁদুর জীবের ছোট ছোট কর্মফলের কর্তনকারী । অর্থাত অতি বৃহত শুভ কর্মের দ্বারা কৃত সুফল বিনষ্ট হয়ে যায় ছোট্ট কোনো মন্দ কর্মের দ্বারা । তাই ষড়রিপু বা কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ ইত্যাদির মত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কর্মফল বিনাশ করে ইঁদুর যাতে কিনা বৃহত সিদ্ধিলাভে বাধা না ঘটে ।

  • ময়ূর

কার্তিকের বাহন আমাদের জাতীয় পাখী আলস্যহীন ময়ূর। ময়ূর অত্যন্ত সজাগ এবং কর্মচঞ্চল পাখী । সৈনিক কার্তিকের সবগুণ গুলি সে বহন করে। মেঘ দেখলেও সে  উত্ফুল্ল হয় এবং তার মত ধীর স্থির হয়ে  যুদ্ধক্ষেত্রে নিরলস লড়াই করে যাবেন সৈনিক কার্তিক এবং সেইসঙ্গে লোকশিক্ষাও যোগাবে তার কর্মোদ্দীপনা ।

১২ অক্টো, ২০২১

বোধন থেকে বিসর্জন / ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

 

দুর্গার ছবিঃ অনুকরণে শিল্পী নিলয় বিশ্বাস 

বোধন 

দাশরথি রায়ের আগমনী গানে পাই বোধনের কথা। বোধনেই হয় মায়ের পুজোর শুরু। 

"বিল্ব বৃক্ষ মূলে পাতিয়া বোধন, গণেশের কল্যাণে গৌরীর আগমন" 

কেন মহাষষ্ঠীর সূচনালগ্নে বোধন হয়? 

সীতাহরণের পর রামচন্দ্র বানরসেনাদের সাহায্যে সেতুবন্ধ করে লঙ্কায় হাজির হলেন। ব্রহ্মা তখন রামকে আদেশ করলেন অপরাজিতা দুর্গার পুজো করে জগতের উদ্ধারে নেমে পড়তে। সমগ্র রাক্ষসকুলকে ধ্বংস না করতে পারলে যে ধরিত্রীর নিস্তার নেই। তাই কৃষ্ণপক্ষেই নিদ্রিতা দেবীকে অকালে জাগ্রত করে অকালে অর্থাত শরতকালে  (পূর্বে বসন্তকালে শুক্লপক্ষে দেবলোক জাগ্রত অবস্থায় পুজো হত)  

কাজে নেমে পড়েছিলেন রামচন্দ্র স্বয়ং। তাই তো অকাল বোধন। ব্রহ্মার পরামর্শে দেবী দুর্গার দশভুজা মূর্তি মাটি দিয়ে গড়ে ব্রহ্মা স্বয়ং বিল্ব বৃক্ষমূলে সিংহবাহিনী সেই দেবীর বোধন করেছিলেন। সেই দিনটিই ছিল শুক্লপক্ষের মহাষষ্ঠী ।

রামচন্দ্র স্তব করলেন :

নমস্তে ত্রিজগদ্বন্দ্যে সংগ্রামে জয়দায়িনী

প্রসীদ বিজয়ং দেহি কাত্যায়নি নমোহস্তুতে ।।

পূজা শুরু হল । পিতামহ  ব্রহ্মা  রামচন্দ্রের সঙ্গে বললেন

“হে দেবী! যত দিন না পর্যন্ত রাবণ বধ হয়, রাক্ষসকুল ধ্বংস না হয় আমাদের পূজা গ্রহণ করে তুষ্ট হোন ”   

মিথিলার কবি বিদ্যাপতির দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী গ্রন্থে ষষ্ঠীতে মায়ের বোধনের উল্লেখ আছেঃ 

"ষষ্ঠ্যাং বিল্বতরৌ বোধঃ সায়ংসন্ধ্যাসুকারয়েত্‌" 

 বসন্তকালের দুর্গাপুজোয় বোধনের প্রয়োজন হয়না কারণ দেবতারা ঐ সময় জাগ্রত থাকেন। সমগ্র দেবকুলকে শরতকালে জাগানোর উদ্দেশ্যেই এই বোধন। বোধনের অর্থ হল জাগরণ। কালিকাপুরাণে পাওয়া যায় এই বোধন নিয়ে...

"বোধয়েদ্বিল্ব্শাখায়াং ষষ্ঠ্যাং দেবীফুলেষু চ"

এবার সব গাছ বাদ দিয়ে বিল্ব বা বেল গাছের নীচে বোধন কেন? কারণ মা দুর্গার প্রিয় ফল হল ওষধি গুণ সম্পন্ন বেল। নবপত্রিকার অন্যতম উদ্ভিদও বেল চারা আর মায়ের স্নানের সময় চার আঙুল পরিমাণ বেল কাঠিও তাঁর দন্ত মার্জনার জন্য ব্যবহৃত হয়। 

নবপত্রিকা স্নান 

"ওঁং উত্তিষ্ঠ পত্রিকে দেবী অস্মাকং হিতকারিণি" 
মহাসপ্তমীর ভোরের সূচনা হয় নবপত্রিকার স্নানপর্ব দিয়ে । নবপত্রিকা দেবীদুর্গার প্রতিনিধি । শ্বেত অপরাজিতা লতা এবং হরিদ্রাক্ত সূতা দিয়ে ন'টি উদ্ভিদ {কলা–ব্রহ্মাণী(শক্তিদাত্রী), কালো কচু– কালিকা (দীর্ঘায়ুদাত্রী),হলুদ– ঊমা( বিঘ্ননাশিনী),জয়ন্তী–জয়দাত্রি,  কার্তিকী(কীর্তিস্থাপয়িতা), বেল–শিবাণী(লোকপ্রিয়া), ডালিম–রক্তবীজনাশিনী( শক্তিদাত্রী), অশোক–দুর্গা(শোকরহিতা), মানকচু– ইন্দ্রাণী (সম্পদদায়ী), ধান–মহালক্ষ্মী( প্রাণদায়িনী)}চারাকে একত্রে বেঁধে নদীতে স্নান করানো হয়। নদীতে নবপত্রিকা স্নানের পূর্বে কল্পারম্ভের শুরুতে দেবীর মুখ ধোয়ার জন্য যে দাঁতন কাঠি ব্যাবহৃত হয় তাও আট আঙুল পরিমিত বিল্বকাঠেরই। মন্ত্রের মাধ্যমে সম্বোধন করে নবপত্রিকাকে দেবীজ্ঞান করা হয় । শস্যোত্পাদনকারিণি দেবী দুর্গা স্বয়ং কুলবৃক্ষদের প্রধান অধিষ্ঠাত্রীদেবতা ও যোগিনীরা দেবীর সহচরী । স্নানান্তে নতুন শাড়ি পরিয়ে তিনটি মঙ্গলঘটে আমপাতা, সিঁদুর স্বস্তিকা এঁকে জল ভরে  বাদ্য, শঙ্খ, ঘন্টা এবং উলুধ্বনি দিয়ে বরণ করে, মন্ডপে মায়ের মৃন্ময়ীমূর্তির সাথে স্থাপন করা হয় । এই তিনটি ঘটের  একটি মাদুর্গার ঘট, একটি গণেশের এবং তৃতীয়টি শান্তির ঘট। নবপত্রিকার পূজা একাধারে কৃষিপ্রধান ভারতবর্ষের বৃক্ষপূজা অন্যদিকে রোগব্যাধি বিনাশকারী বনৌষধির পূজা । মহাসপ্তমীর ভোরে বিল্ববৃক্ষের পূজা, নবপত্রিকা এবং জলপূর্ণ ঘটস্থাপন এর দ্বারাই দেবীপূজার সূচনালগ্ন ঘোষিত হয় । 

দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তির পাশেই নবপত্রিকা কে স্থাপন করে আহ্বান করা হয় এই বলে... 

"ওঁং চন্ডিকে চল চল চালয় চালয় শীঘ্রং ত্বমন্বিকে পূজালয়ং প্রবিশ" 

সন্ধিপুজো 


রামায়ণে আছেঃ 

শুক্লাসপ্তমী থেকে মহানবমী অবধি বিশেষ পুজো চলতে লাগল । সপ্তমীর দিন দেবী স্বয়ং রামের ধনুঃশ্বরে প্রবেশ করলেন । অষ্টমীতে রামের বাণে আশ্রয় নিলেন । অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে দশানন রাবণের মস্তক পুনঃ পুনঃ ছেদন করলেন রামচন্দ্র ।

দেবী দুর্গা নাকি এই দুইতিথির মিলনক্ষণেই আবির্ভূতা হন দেবী চামুন্ডারূপে । চন্ড এবং মুন্ড এই দুই উগ্রমূর্ত্তি ভয়ানক অসুরকে বধ করেছিলেন এই সন্ধিক্ষণে । আশ্বিনমাসে রামচন্দ্রের অকালবোধন এবং অপ্রতিরোধ্য রাক্ষসরাজ রাবণকে বধ করার জন্য যে দুর্গাপুজোর উল্লেখ পাওয়া যায় কৃত্তিবাসের রামায়ণে সেখানেও দেখি রামচন্দ্র সন্ধিপূজা সমাপন কালে দেবীর চরণে একশো আট পদ্ম নিবেদন করার আশায় হনুমানকে দেবীদহ থেকে একশো আটটি পদ্মফুল তুলে আনতে বলেন । হনুমান একশোসাতটি পদ্ম পেলেন । দেবীদহে আর পদ্ম ছিলনা । এবার প্রশ্ন কেন দেবীদহে একটি পদ্ম কম ছিল । তার কারণ স্বরূপ কথিত আছে , দীর্ঘদিন অসুর নিধন যজ্ঞে মাদুর্গার ক্ষত বিক্ষত দেহের অসহ্য জ্বালা দেখে মহাদেব কাতর হলেন । মায়ের সারা শরীরে একশো আটটি স্থানে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল । মহাদেব তাঁকে দেবীদহে স্নান করতে বললেন সেই জ্বালা জুড়ানোর জন্য । দেবীদহে মায়ের অবতরণে একশো সাতটি ক্ষত থেকে সৃষ্টি হয়েছিল একশো সাতটি পদ্মের । মহাদেব দুর্গার এই জ্বালা সহ্য করতে না পারায় তাঁর চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু নিক্ষিপ্ত হল মায়ের একশো আটতম ক্ষতের ওপর । দেবীদহে স্নানকালে সেই অশ্রুসিক্ত ক্ষতটির থেকে যে পদ্মটি জন্ম নিয়েছিল সেটি মা নিজে হরণ করেছিলেন । কারণ স্বামীর অশ্রুসিক্ত পদ্মফুলটি কেমন করে তিনি চরণে নেবেন । আবার কৃত্তিবাসের রামায়নে পাই রাবণ নিধন যজ্ঞের প্রাক্কালে রামচন্দ্র বলছেন

যুগল নয়ন মোর ফুল্ল নীলোত্পল

সংকল্প করিব পূর্ণ বুঝিয়ে সকল ।।

রাম ধনুর্বাণ নিয়ে যখন নিজের নীলোত্পল সদৃশ একটি চক্ষু উত্পাটন করতে উদ্যত তখন দেবী রামচন্দ্রের হাত ধরে তাঁকে নিবৃত্ত করে বলেন

“অকালবোধনে পূজা কৈলে তুমি, দশভুজা বিধিমতে করিলা বিন্যাস।

লোকে জানাবার জন্য আমারে করিতে ধন্য অবনীতে করিলে প্রকাশ ।।

রাবণে ছাড়িনু আমি, বিনাশ করহ তুমি এত বলি হৈলা অন্তর্ধান ”

দুর্গাপুজোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষণ হল এই সন্ধিপুজো। অষ্টমীতিথির শেষ ২৪ মিনিট ও নবমীতিথির শুরুর ২৪ মিনিট....এই মোট ৪৮ মিনিটের মধ্যেই  অনুষ্ঠিত হয়। মহিষাসুরের সাথে যুদ্ধের সময় দেবী দুর্গার পিছন দিক থেকে আক্রমণ করেছিল দুই ভয়ানক অসুর চন্ড ও মুন্ড। দেবী তখন এক অদ্ভূত রূপ ধারণ করেন। কেশরাজিকে মাথার ওপরে সু-উচ্চ কবরীতে বেঁধে নিয়ে, কপালে প্রজ্জ্বলিত অর্ধচন্দ্রাকৃতি টিপ ও তিলক এঁকে, গলায় বিশাল মালা ধারণ করে, কানে সোনার কুন্ডল ও হলুদরঙা শাড়িতে নিজেকে সজ্জিত করেন। তাঁর রক্তচক্ষু, লাল জিহ্বা, নীলাভ মুখমন্ডল  এবং ত্রিনয়ন থেকে অগ্নি বর্ষণ করতে থাকেন। ঢাল ও খড়্গ নিয়ে চন্ড ও মুন্ডকে বধ করেছিলেন দেবী এই সন্ধিপুজোর মাহেন্দ্রক্ষণে।   

সন্ধিপূজার এই মাহেন্দ্রক্ষণে কেউ বলি দেন । কেউ সিঁদুর সিক্ত একমুঠো মাসকলাই বলি দেন । সবকিছুই প্রতিকী । সর্বকালের সর্বক্ষণের দুষ্টের দমন হয় দেবীর দ্বারা । রক্তবীজ অসুর কুল বিনষ্ট হয় । ঢাকের বাদ্যি বেজে ওঠে যুদ্ধজয়ের ভেরীর মত । একশো আট প্রদীপের আলোকমালায় উদ্ভাসিত হয় ভারতবর্ষের আনাচকানাচ । উত্তিষ্ঠত ভারতবাসীর জাগ্রত মননে দুষ্কৃতের বিনাশিনী এবং সাধুদের পরিত্রাণ কারী মা দুর্গা কান্ডারী হয়ে প্রতিবছর অবতীর্ণ হন মর্ত্যলোকে ।

বিসর্জন 


বিজয়া কেন বলে? বিসর্জন হয়ে গেলেই তো বিজয়া হয়। এরপর অপরাজিতা দেবীর পুজো শেষে বিসর্জনের বাজনা বাজে। 

বিজয়ায় বিসর্জন মা দুর্গা কে ত্যাগ নয়, বরং বিশেষরূপে অর্জন। বিজয়া হলো আসুরিক শক্তির ওপর দৈব শক্তির বিশেষ প্রভাব বিস্তারে জয়লাভ। অসুর বধ করেছিলেন বলে মা দুর্গার আরেক নাম ও বিজয়া। 

ঢাকের তালে তালে প্রতিমা নিরঞ্জনের তোড়জোড়ের সঙ্গে "আসছে বছর আবার হবে" আর দেবী কে বলা হয়,  "ওং গচ্ছ গচ্ছ পরং স্থানং স্বস্থানং দেবি দুর্গে! পুনরাগমনায় চ" অর্থাৎ নিজের ঘরে ফিরে যাও মা। আবার এসো।

দশমীর বিকেলে পাড়ার ঠাকুর বিসজর্ন হয়ে গেলেই কলাপাতার পেছনে লালকালি দিয়ে "শ্রী শ্রী দুর্গা সহায়" লিখতাম আমরা। এ যেন আমাদের সংস্কার । বিজয়ার প্রথম চিঠি মা দুর্গার উদ্দেশ্যে লিখে গঙ্গায় ভাসানো। 





 



১১ অক্টো, ২০২১

দশপ্রহরণ দেবীর দিব্যায়ুধ / ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়


ছবিসূত্র - আমাজন 


দুর্গা পুজোর অঞ্জলির মন্ত্রে আমরা বলি "সায়ুধায়ৈ নমঃ" । সায়ুধা ( স+ আয়ুধ) অর্থ আয়ুধ বা অস্ত্রের সহিত। 

এবার দেখি কোন্‌ কোন্‌ দেবতারা মা দুর্গাকে কি কি অস্ত্র দিয়ে "সায়ুধা"করলেন?   

  • মহাদেব তাঁর স্বীয় শূল থেকে সৃষ্ট একটি ত্রিশূল দিলেন। ত্রিশূলের তিনটি ফলা মানুষের তিনটি গুণ যথা সত্ত্ব, রজ এবং তম কে ব্যাখ্যা করে। 
  • বিষ্ণু তাঁর সুদর্শণ চক্র থেকে সৃষ্ট চক্র দিলেন। এই সুদর্শন চক্রের ১০৮ ফলা। চক্রের আবর্তন এর অর্থ হল থেমে না থাকা। হাতে চক্র থাকার অর্থ হল সমস্ত সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছেন দুর্গা আর তাঁকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়ে চলেছে সমস্ত বিশ্ব।
  • বরুণ দিলেন শঙ্খ ও নিজের পাশ থেকে তৈরী করে আর একটি পাশ। জীব জগতের স্পন্দন স্বরূপ এই শঙ্খ সৃষ্টির প্রতীক।পুরাণ মতে শঙ্খ থেকে উৎপন্ন শব্দেই প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে জীব জগতে।শঙ্খের ধ্বনি মঙ্গলময়। আবার যুদ্ধের আহ্বান জানাতে দেবী ব্যবহার করেছিলেন শাঁখ। 
  • অগ্নিদেব দিলেন আগুণ রূপ শক্তি যা জ্ঞান এবং বিদ্যার প্রতীক।তিনি প্রাকৃতিক শক্তির প্রতিভূ। মানব সভ্যতার শুরুতেই রয়েছে আগুনের মহিমা। অগ্নি আজ পর্যন্ত পূজিত হন হোমশিখায়, দেবারতির প্রদীপে। দেবীর হাতে ধরা অগ্নি এক দিকে যেমন অস্ত্র, তেমনই আবার প্রজ্জ্বলিত অগ্নি দেবীর নিজস্ব শক্তিকেও বোঝায়। শাস্ত্র মতে অগ্নি যাবতীয় ক্লেদ থেকে জগৎকে উদ্ধার করে, শুদ্ধ করে। 
  • পবনদেবতা দিলেন একটি ধনুক ও দুটি বাণপূর্ণ তূণীর। তীর ও ধনুক উভয়ই ইতিবাচক শক্তির প্রতীক ৷ মানব শরীরের অন্তর্নিহিত শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটে ধনুর টঙ্কারে। ধনুকের সঙ্গে জুড়ে থাকে তীর যা ধনুর টঙ্কারে প্রকাশিত শক্তির ভারকে বহন করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানে। ধনুক এখানে সম্ভাব্য শক্তির প্রতীক আর তীর প্রকাশিত গতিশক্তিকে বোঝায়। 
  • দেবরাজ ইন্দ্র দিলেন বজ্র ও ঐরাবত নামক স্বর্গের হাতির গলদেশের ঘন্টা থেকে ঘন্টা তৈরী করে দিলেন ঘন্টান্তর। মা দুর্গার হাতের এই বজ্র দৃঢ়তার প্রতীক। এর মাধ্যমেই জীবনে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হন মানুষ। দেবীর বাম হস্তের তুমুল ঘণ্টা ধ্বনি অসুরদের তেজকে দুর্বল করেছিল। বজ্র অন্যতম প্রধান প্রাকৃতিক শক্তি। দুর্গার বর্তমান রূপটির পিছনে বৌদ্ধতান্ত্রিক প্রভাব যথেষ্ট। বৌদ্ধ ব্যাখ্যা অনুসারে, বজ্র জাগতিক বন্ধন থেকে চেতনাকে মুক্ত করে।
  • মৃত্যুরাজ যম দিলেন কালদন্ড বা গদা যা আনুগত্য, ভালবাসা এবং ভক্তির প্রতীক। আবার এই গদা মানুষের মোহকে চূর্ণ করে বলে ব্যক্ত করে বিভিন্ন শাস্ত্র।
  • প্রজাপতি ব্রহ্মা দিলেন একটি রুদ্রাক্ষের মালা ও কমন্ডলু। কমণ্ডলুর মধ্যে ধৃত জল সৃষ্টির প্রতীক। শান্তির প্রতীক। 
  • দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা দিলেন কুঠার ও নানাপ্রকার অস্ত্র ও অভেদ্য কবচ।পুরাণে বিশ্বকর্মাকে অসংখ্য দিব্যাস্ত্র নির্মাণ করতে দেখা যায়। যার মধ্যে কুঠার একাধারে নির্মাণ ও ধ্বংসের প্রতীক। কুঠার দিয়ে কাঠ কেটে তৈরি হয় বিবিধ আসবাব থেকে শুরু করে বাড়িঘরও। সে দিক থেকে দেখলে, এটি সৃজনের প্রতীক। আবার কুঠার একটি প্রাণঘাতী অস্ত্রও বটে।
  • সূর্যদেব দেবীর লোমকূপে তাঁর তেজরাশি সমর্পণ করলেন। 
  • কালের দেবতা দিলেন একটি উজ্জ্বল ধাতব ঢাল ও প্রদীপ্ত খড়্গ। তলোয়ার বা খড়গ হল মানুষের বুদ্ধির ধারের প্রতীক ৷ যার জোরে সমস্ত বৈষম্য এবং অন্ধকারকে ভেদ করতে পারে মানুষ৷
  • দেবীর ডান হস্তে খড়গ বা খাঁড়া উদ্দত হয়ে থাকে। খড়গ হল বলি প্রদানের অস্ত্র। বলি হল, বিবেক বুদ্ধির মধ্যে নিহিত অশুভের নিধন যজ্ঞ। হিংসা, গ্লানি, ক্রোধ, অহং সহ ষড় রিপু থেকে নিজের আত্ম শক্তিকে পরিশুদ্ধির প্রক্রিয়া। তাই দেবীর হস্তে সজ্জিত খড়গ হল, পরম মোক্ষের প্রতীক। এই খড়গ সর্বদা উদ্দত অভয় প্রদানকারী। 
  • ক্ষীরসমুদ্র দিলেন পদ্মের মালা ও হাতে দিলেন পদ্মফুল। পাঁকে জন্মায় সুন্দর পদ্ম। তেমনই মায়ের আশীর্বাদে যেন অন্ধকারের মধ্যেও আলোর আবির্ভাব হয় সেই বার্তাই দেয় পদ্ম ফুল যা পূর্ণ চৈতন্যকে ব্যক্ত করে। দেবীকে তন্ত্রশাস্ত্র প্রকাশিত জগৎশক্তি হিসেবেই জ্ঞান করে। সেই কারণে তাঁর হাতে ধরা পদ্ম সামূহিক চৈতন্যকেই বোঝায়। 

  • হিমালয় দিলেন দেবীর বাহন সিংহকে।  
  • কুবের দিলেন একটি সুরাপূর্ণ পানপাত্র। 
  • নাগরাজ বাসুকি দিলেন একটি মহামণিশোভিত নাগহার। চেতনার নিম্ন স্তর থেকে উচ্চ স্তরে প্রবেশ এবং বিশুদ্ধ চেতনার চিহ্ন এই সাপ। সাপ হিন্দু ধর্মে কুলকুণ্ডলিনী শক্তির প্রতীক। যা জাগরিত হলে সাধকের সাধনা পূর্ণ হওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। শাক্তধর্মে সর্পপ্রতীক বার বার ব্যবহৃত হয়। 
এছাড়াও নানাবিধ অলঙ্কার যেমন, মুক্তামালা, দিব্যচূড়ামণি, কর্ণকুন্ডল, হাতের বলয়, ললাটভূষণ, বাজু, নির্মল নূপুর, অত্যুত্তম কন্ঠহার ও সমস্ত অঙ্গুলিতে শ্রেষ্ঠ অঙ্গুরীয়। 

এইরূপে দিব্য আয়ুধে দশভুজা দেবীমূর্তি সজ্জিত হয়ে  প্রস্তুত হলেন সেই মহাসংগ্রামের জন্য। দশ হাতে ধৃত অস্ত্রগুলি বিভিন্ন ভাবে দশভুজা দুর্গার সাধনতত্ত্বকেই ব্যক্ত করে। হিন্দু অথবা বৌদ্ধ, যা-ই হোক না কেন, দেবীর এই দশপ্রহরণের আসল কাজ মানুষকে আসুরিক চেতনা থেকে মুক্ত করে ব্রহ্মাণ্ডস্বরূপ প্রদর্শন, পূর্ণজ্ঞান লাভের পথে নিয়ে যাওয়া।


৯ অক্টো, ২০২১

মেয়ে চলেছে মহাস্নানে / ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়



পুবের নরম আলো পড়ছিল তার গায়ে। গা আবার কোথায় তার ? সে তো রোদ লাগবে বলে ঢাকা।আর ' 'তার' বলতে কার? কার আবার, আমাদের আদরের কন্যে দুর্গার গায়। দুর্গা স্নানে যাবে বলে কথা! সব্বোমটি মাড়িয়ে, ঢাক ঢোল পিটিয়ে, শাঁখ বাজিয়ে, উলু দিয়ে, মেয়ে যাবে পাইক বরকন্দাজের কোলে চেপে। কেউ আবার পালকিতে নিয়ে যায়। কেউ আবার দোলায় । কেউ মাথার ওপর ছাতা ধরে তার। পাছে মেয়েটার কষ্ট হয়। পরিপাটি করে লাল পাড় কোরা শাড়িতে মেয়ের উথলে ওঠা রূপলাবণ্য ঢেকে দিয়েছে বাড়ির বড়োরা। লজ্জা মেয়ের ভূষণ কিনা । লাজে অবনত মেয়ে ঘোমটার আড়ালে মুচকি হাসে।


ভাবে, এইদিনটা পুরুষগুলোর খুব উত্সাহ। সারাটা বছর দানাপানি দেয়না কেউ। মহাসপ্তমীর ভোরে মেয়ের মহাস্নানের জন্য সব পুরুষের দরদ যেন উথলে ওঠে।

অবগুন্ঠনা মেয়ে মনে মনে বলে ওঠে,

প্রকৃতি সতীরে সাজিয়ে দাও। বলি, ঘরের মেয়েটাকে যত্ন করো তোমরা? আমায় নিয়ে বছরে একটা দিন এমনি আদিখ্যেতা না করলেও তো পারো। আর প্রকৃতি সতী? যে সারাটা বছর তোমাদের ভালোয় মন্দে মাথায় ছাতা ধরে রয়েছে? তোমাদের অসুখ থেকে মুক্তি দিচ্ছে সেই ওষধিরা? তাদেরো হেলাফেলা কোরোনি বাপু! ওরাও মানুষের জীবনদায়ী। আযুর্বেদের ঐতিহ্যবাহী ভারতবর্ষে মানুষের এত রোগভোগ । আমাদের এ দেশটায় আবার চাষাবাদ সর্বস্বতা! কৃষিকাজ তাদের রুজি রোজগার। তাই মহাসপ্তমীর ভোরে এই সবুজের অভিযান। সবুজের স্নান। আমি থাকি সবকিছুর অলখ্যে, সকলের আড়ালে। নেপথ্যের নায়িকা হয়ে।


ছোটবেলায় জ্ঞান হবার পর থেকে আমরা সকলেই দুর্গাপুজোর সপ্তমীর ভোরে মহা সমারোহে ঢাকের বাদ্যির সঙ্গে গঙ্গায় বা নদীতে “কলা-বৌ” স্নান করানোর আয়োজন দেখি । স্নান করিয়ে সেই কলাবৌটিকে নতুন লালপাড় শাড়ি পরিয়ে মাদুর্গার পাশে রাখা হয় এবং পুজোর পাঁচটাদিন পুজো করা হয় ঐ কলাবৌটিকে । মা দুর্গাকেই ঐ রূপে পুজো করা হয় ।


মায়ের সেই মহাস্নানের মাহেন্দ্রক্ষণ। আশ্বিনের নরম রোদ গরম হতে থাকে বেলা বাড়ার সঙ্গে। কন্যে তখন ঘেমে নেয়ে একসা। ততক্ষণে তার ত্বকের প্রতিটি রোমকূপ উন্মুক্ত। এবার তার সৌন্দর্য্য চর্চায় ব্রতী হবার পালা। ইদানীং রূপসজ্জার জন্য আমরা অনেকেই ভেষজ উপাদানে ভরসা রাখি।মা দুর্গা সেই আদিকাল থেকেই স্কিন ফ্রেন্ডলি এইসব প্রাকৃতিক উপাদানেই রূপচর্চা করতে অভ্যস্ত। তাঁর পুজোয় সবই ভেষজ। দুর্গাপুজোর বিধিতে আট আঙুল পরিমাণ সরু বেলকাঠ দিয়ে দেবীর  দন্তমার্জনা থেকে শুরু করে কুলকুচির জন্য কবোষ্ণ জল এমনকি স্নানের আগে গায়ে মাখার জন্য সরষের তেল ও কাঁচা হলুদ বাটা রাখতে হয়।

গঙ্গার জল ছাড়াও দেবী স্নান করেন শঙ্খ অর্থাৎ শামুকের দেহে যে জল থাকে সেই পরিশ্রুত জলে। এ ছাড়াও ঝর্না ও তীর্থের জলও লাগে দেবীর মহাস্নানে। পঞ্চগব্য বা দুধ, দই, ঘিয়ের সঙ্গে সনাতন বিশ্বাসে পবিত্র এবং রোগ বিনাশক গোময়, গোমূত্রও লাগে। আর লাগে পঞ্চ কষায় বা জাম, শিমূল, বেড়েলা, বকুল ও টোপাকুল গাছের ছাল ভেজানো জল। আর দেবীর মুখ পরিষ্কারের জন্য চাই হাতির দাঁতে করে উপড়ে তোলা মাটি। এ ছাড়াও বেশ্যাদ্বার, রাজদ্বার-সহ নানা স্থানের মাটিও দরকার হয়। নিয়ম অনুসারে লাগে উইয়ের ঢিবির মাটিও। মধু তো থাকেই সেই সঙ্গে দেবীর শরীরের ময়লা তুলতে লাগে চিনি। 

এ যেন আমাদের আধুনিকার সনা বাথ নিয়ে গায়ে বেশ করে সরষের তেল, কাঁচাহলুদ বাটা মাখা হল। তারপর সুবাসিত তিলতেল মেখে আরো কিছুক্ষণ রোদ লাগানো। পরের পর্যায়ে তাঁর ফেসপ্যাক এবং বডিপ্যাক । এখন বিউটিশিয়ানরা মুলতানি মাটি, গঙ্গামাটি মাখতে বলেন! মা সেই কবে থেকে মেখে আসছেন তা! গজদন্ত মৃত্তিকা বা হাতির গজদাঁত লেগেছে এমন মৃত্তিকা, বৃষশৃঙ্গ মৃত্তিকা বা ষাঁড়ের শিঙের স্পর্শে ধন্য মাটি, নদীর উভয়কুলের মৃত্তিকা, বেশ্যাদ্বারের মাটি, রাজদ্বারের মাটি, উইঢিপির মাটি, চতুষ্পথ মৃত্তিকা অর্থাত চৌরাস্তার মোড়ের মাটি আর সর্বতীর্থের মাটি মেখে মা বসে থাকবেন নদীপারে কিছুসময়। নদীতীরের দৃশ্য দেখতে দেখতে এবার তিনি দন্ত মার্জনা করবেন বেলকাঠের দাঁতন দিয়ে।

এবার আসল স্নানের পালা। পঞ্চগব্য বা গোমূত্র, গোময়, দধি, ঘৃত এবং দুধ, নারকেলের জল, আখের রস, মধু, পুষ্পোদক, ত্রিফলা বা হরিতকী, আমলকী ও বহেড়া ভেজানো জল, পঞ্চকষায় যুক্ত জল দিয়ে স্নানের পর নদীর জল, সাত সাগরের জল, শিশিরের জল, শুদ্ধজল, পাণিশঙ্খের জল, কবোষ্ণ জল, গঙ্গোদক, সহস্রধারার জল, কুশ ঘাসের দ্বারা ছেটানো জল, নির্ঝরিণীর জল এবং তীর্থবারি এমন কত কত জল ঢেলে মেয়ের অবাক জলস্নান হল!

 তারপর ফ্রুট ফেসিয়াল ফলোদক দিয়ে। পঞ্চরত্ন সমন্বিত জল দিয়ে গোল্ড ফেসিয়াল। তারপর অগরু চন্দন দিয়ে আ্যরোমা থেরাপি হল। সবশেষে আবার গাত্রমার্জণার পর ম্যাসাজ হল তিলতেল, বিষ্ণুতেল, সর্বোষধি আর মহৌষধির জল দিয়ে। সব শেষে অষ্টকলসের পূর্ত জল দিয়ে একে একে বিশেষ স্নান হল। পবিত্র হল সে। কিন্তু প্রশ্ন হল যুগে যুগে কি কন্যেরা এমন অপবিত্র থাকে? তাকে কি পুজো করার জন্য আগে শুদ্ধিকরণ করে নিতে হবে? মহাস্নান কি তবে বিশেষ শুদ্ধিকরণ?

আটটি ঘটিতে বন্দী আটরকমের জল। গঙ্গারজল, বৃষ্টির জল, সরস্বতীর জল, সাগরের জল, পদ্মরেণুমিশ্রিত জল, নির্ঝরোদক, সর্বতীর্থম্বু, ও শুদ্ধজল নিয়ে পদ্ম পাপড়ি ছড়িয়ে স্নান করে সিন্দুর পরে নতুন শাড়ি জড়িয়ে চললেন তিনি মন্ডপে।

আর এই অষ্টকলসের জল আক্ষরিক অর্থেই আটটি কলসের মন্ত্রপূত জল। দেবগণ, মরুত্গণ্, লোকপালগণ, নাগগণ, পর্বতসকল, সপ্তঋষিগণ, অষ্টবসুগণ সকলেই মহা উত্সাহে দেবীকে বাদ্য সমারোহে স্নান করানোয় ব্রতী হয়েছেন। তাই এই মহাস্নান রাজকীয় যজ্ঞ স্বরূপ।

আর এই অষ্টকলসের স্নানের সময় যে মন্ত্র পাঠ হয় তা সঙ্গীতশাস্ত্রসম্মত স্বরলিপি অনুসারে রচিত আটটি রাগ সঙ্গীত। প্রত্যেকটি একটি রাগরাগিণীর আশ্রয়ে রচিত। অষ্টকলসের মন্ত্রপূত জল দিয়ে দেবীর স্নানাভিষেকের সময় এই গানগুলি সেযুগেও ব্যাবহৃত হত এবং এখনো হয়। কালিকাপুরাণেই এর উল্লেখ রয়েছে।

প্রথমে "মালবরাগং বিজয়বাদ্যং কৃত্বা গঙ্গাজলপূরিতঘটেন " এই মন্ত্র বলে গঙ্গাজল পূর্ণ ঘট দ্বারা অভিষেক হয়। তখন বিজয়বাদ্য বা কাঁসা-পিতল দ্বারা নির্মিত বাদ্য যন্ত্র অর্থাত কাঁসরঘন্টা সহযোগে গাওয়া হয় মালব রাগে এবং চৌতালে ।|


এরপর "ললিতরাগং দুন্দুভিবাদ্যং কৃত্বা বৃষ্টিজলপূরিতঘটেন " এই মন্ত্র বলে বৃষ্টির জল পূর্ণ ঘট দিয়ে অভিষেক কালে দুন্দুভির সঙ্গে গাওয়া হয় ললিত রাগে এবং চৌতালে ।


এবার "বিভাসরাগং দুন্দুভিবাদ্যং কৃত্ব সরস্বতী-জলপূরিতঘটেন" এই মন্ত্র বলে সরস্বতী নদীর জলপূর্ণ ঘট দিয়ে স্নানাভিষেক হয় বিভাস রাগে এবং চৌতালে গীত হয় সংগীতের মধ্য দিয়ে আর দামামা জাতীয় রণ দুন্দুভি বাজে।


এরপর "ভৈরবরাগং ভীমবাদ্যং কৃত্বা সাগরোদকেন" এই মন্ত্র বলে ভীম বাদ্য বা ভেরী বা চামড়ার তৈরী ঢাকের আওয়াজের সাথে সাগরের জল দ্বারা স্নানের সময় ভৈরবী রাগে চৌতালে গান গাওয়া হয় ।


এবার "কেদাররাগং ইন্দ্রাভিষেকং বাদ্যং কৃত্বা পদ্মরজমিশ্রিতজলেন" এই মন্ত্র বলে পদ্মরজ বা পদ্মফুলের রেণু মিশ্রিত জল দিয়ে, বীণার সাহায্যে উৎপন্ন ধ্বনিতে কেদাররাগে চৌতালে স্নানাভিষেকের সঙ্গীত গাওয়া হয়।


তারপর "বরাড়ীরাগং শঙ্খবাদ্যং কৃত্বা নির্ঝরোদকপূরিতঘটেন" এই মন্ত্র বলে, শঙ্খধ্বনি, তূর্য, বাঁশী, সানাই ইত্যাদির সাথে ঝর্ণার জল দিয়ে স্নান এবং সঙ্গীত বৈরাটি রাগে ও চৌতালে ।


এবার "বসন্তরাগং পঞ্চশব্দবাদ্যং কৃত্বা সর্বতীর্থাম্বুপূর্ণেন ঘটেন" এই মন্ত্র বলে পাঁচ রকমের ধ্বনি, মানুষের সম্মিলিত ঐক্যতানের সঙ্গে সর্বতীর্থের জল দিয়ে স্নান হয় বসন্তরাগে ও চৌতালে ।


সবশেষে "ধানশ্রীরাগং বিজয়বাদ্যং কৃত্বা শুদ্ধ জলপূরিত ঘটেন" এই মন্ত্র বলে শীতল ও শুদ্ধ জল পূর্ণ ঘটের জল দিয়ে স্নানের সময় গান হয় ধানশ্রী রাগে ও চৌতালে আর বাজানো হয় বিজয়বাদ্য।

অর্থাৎ কাঁসরঘণ্টা দিয়ে শুরু ও শেষ হয় এই মহাস্নান।

কিন্তু কেন এত মাটি আর কেন‌ই বা এতস্থানের জল দিয়ে তাঁর স্নানের আয়োজন? এ যেমন তেমন স্নান নয়। এ হল মহাস্নান যার অর্থ হল মহত বা বিরাট স্নান। স্নানের নানাবিধ বিপুল আয়োজন, দ্রব্যাদির অনুষঙ্গ, ষোড়শ উপাচার স্মরণ করিয়ে দেয় তাঁর মহত্বকে। স্মরণ করায় সৃষ্টির আদিমতম রহস্যকে । যখন ধরিত্রীতে এসে মিশেছিল সর্বপ্রকার বারিধারা। সব স্থানের মৃত্তিকা। প্রথম আদি তব শক্তি। তোমার জন্যেই আমাদের পায়ের নীচে আজ শক্ত মাটি। তোমার জন্য‌ই আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় এই জল। তাই তোমার মহাস্নানেই সেই জল আর মাটি আমরা নিষ্ঠার সঙ্গে যোগাড় করে তোমাকেই নিবেদন করি। অতএব গঙ্গাজলেই গঙ্গাপুজো করে বলি "তদীয় বস্তু তুভ্যমেব সমর্পয়ে" !

প্রান্তিকে ইরিগেশন ক্যানেলে নবপত্রিকার স্নান





৮ অক্টো, ২০২১

দুর্গা ও তাঁর পরিবার / ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

দুর্গার পটচিত্র- শিল্পী আয়েশা পটিদার, নয়াগ্রাম, মেদিনীপুর 


দুর্গা পুজোর অঞ্জলির মন্ত্রে আমরা বলি "সপরিবারায়ৈ"। এবার দেখা যাক কে কে আছেন মায়ের পরিবারে? 

প্রথমে দুর্গা নিজে মধ্যমণি। দুর্গা শব্দটির অর্থে আসা যাক ।

দুর্গা =  দুর্গ + আ =  দ্+উ+র্+গ্ +আ

দ এর অর্থ দৈত্যনাশ

উ এর অর্থ বিঘ্ননাশ

র এর অর্থ রোগনাশ

গ এর অর্থ পাপনাশ এবং

আ এর অর্থ ভয় ও শত্রুবিনাশ । (মহিষাসুরমর্দিনী, স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ) 


দুর্গ শব্দের অর্থ দৈত্য, বাধাবিঘ্ন,  দুঃখশোক, নরকযন্ত্রণা, রোগব্যাধি… এহেন নানাবিধ অশুভকিছু আর “আ” অর্থটি বাংলাভাষায় নাশ করা বা বধ করা বোঝায় । সেই কারণে দুর্গা শব্দের অর্থ দাঁড়ায়  জীবের জীবন থেকে যা কিছু অশুভ শক্তির বিনাশ কারী দেবী শক্তি । নিজের নাম প্রসঙ্গে দেবী বলেছেন চন্ডীতে


“তত্রৈব চ বধিষ্যামি দুর্গমাখ্যং মহাসুরং

দুর্গা দেবীতি বিখ্যাতং তন্মে নাম ভবিষ্যতি” ।।


কিন্তু দুর্গা নাম এল কিভাবে? পুরাকালে দুর্গম নামক এক অত্যাচারী অসুর দেবতাদের পরাজিত করে বেদ শাস্ত্রকে হরণ করে । তার উদ্দেশ্য ছিল জীবজগতে ধর্মের বিনাশ ঘটানো । সমাজে এমন বিশৃঙ্খলা দেখে দেবতারা সমবেত ভাবে মহামায়ার শরণাপন্ন হন । কোনো অসুর যাতে ভবিষ্যতে এমন অনিষ্ট সাধন না করতে পারে তাই দেবী দেবতাদের আরাধনায় তুষ্ট হয়ে সমগ্র বেদ কে স্বীয় দেহে ধারণ করেন। বেদময়ী দেবীকে দেবগণ “দুর্গা” নামে ভূষিত করেন । দেবী পুরাণ মতে দুর্গা নাম স্মরণ করলেই ত্রিতাপ দুঃখ, জ্বালা যন্ত্রণা মুক্ত হয়  এবং এরূপে তিনি জীবের কল্যাণদায়িনী, রোগ-শোক বিনাশিনী রূপে জীবকে অশুভ শক্তির হাত থেকে উদ্ধার করেন । অথবা বলতে পারি মহাশক্তিকে লাভ করার দুর্গম পথকে যিনি সুগম করে দেন তিনিই দুর্গা ।


দুর্গা পুজোয় মহিষাসুরও দুর্গার সঙ্গে এক চালায় পূজিতা হন বৈকি। 


পুরাণে বর্ণিত আছে রম্ভাসুর ও গর্ভবতী এক মহিষীর মিলনে জন্ম হয়েছিল মহিষাসুরের। তার বৈশিষ্ট্য হল তার হাত-পা সব মানুষের মত কিন্তু মুখটি শিং সহ মহিষের মত । সে জন্মের পরেই স্বর্গরাজ্য লাভের আশায় তপস্যা শুরু করেছিল । বহুকাল কঠোর তপস্যার পর ভগবান ব্রহ্মা তুষ্ট হয়ে তাকে অমরত্ব ছাড়া যেকোনো  বরদান করতে সম্মত হলেন। এই বরে দেবতা, যক্ষ, রক্ষ, গন্ধর্বাদি কেউই তাকে হত্যা করতে পারবেনা  এবং কেবল কোনো অবলা নারীর হাতেই  সে ধ্বংস হবে এরূপটিই চাইলেন মহিষাসুর । তাই তুমুল যুদ্ধের পর মা দুর্গাই একমাত্র পেরেছিলেন একে বধ করতে। মহিষ তমোগুণের প্রতীক। মহিষাসুর মহিষ থেকে জাত বলে সে ভয়ংকর এবং যুদ্ধে দুর্গার সত্ত্বগুণের দ্বারা সেই তমোগুণের বিনাশ হয়।


লক্ষ্মী-সরস্বতী


কেউ বলেন এঁরা মায়ের দুই কন্যা । কেউ বলেন এঁরা মায়ের অন্য দুটি রূপ । মহাদেব নিজের দেহ থেকে সৃষ্টি করেছিলেন ঊমাকে এবং ঊমা পরে সৃষ্টি করেন লক্ষ্মী, সরস্বতী, দুর্গা এবং কালীকে। শ্রী শ্রী চন্ডীতে দুর্গাদেবীকেই মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতী রূপে আখ্যা দেওয়া হয় । এই মহামায়া মাতৃশক্তির দশভুজা দুর্গা রূপটিই অসুর নিধন করেছিলেন । মহিষাসুরমর্দিণী দুর্গাপূজার সূত্রপাত ঘটে গুপ্তযুগে । বাঙালী কল্পনাপ্রবণ জাতি। সপরিবারে মা দুর্গাকে না দেখলে তাদের যে মন ভরেনা । তাই তো দুই শক্তি লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে দুপাশে আমরা দেখি এবং মহানন্দে বরণ করি । লক্ষ্মী হলেন শ্রী বা বিষ্ণুপ্রিয়া বা নারায়ণী যিনি সৌভাগ্য, ঐশ্বর্য্য এবং সমৃদ্ধির প্রতীক আর সরস্বতী হলেন বাগদেবী, বিদ্যা-বুদ্ধির অধিষ্ঠাত্রী, জ্ঞানদায়িনী। অর্থাত এই দুই নারীশক্তি সকল শুভ, সৃজনশীল, গঠনমূলক ক্রিয়াকলাপের উত্স। তাই শুভ শক্তির প্রতীকও বটে ।

দুর্গাপুজো তো শুধুই দেবী দুর্গার পুজো নয়, এক গণ্ডা বাহন সমেত আরো চারজন দেবদেবী এমনকী মহিষাসুরও সমান গুরুত্ব সহকারে পুজো পেয়ে থাকে বাঙালির দুর্গাপুজোয়। 


পৌরাণিক আখ্যানে এমন অনেক কাহিনি রয়েছে, যা অনেকাংশে পরস্পরবিরোধীও বটে। যেমন, পুরাণ অনুসারে লক্ষ্মী দুর্গার মেয়ে নন, ভৃগুমুনির কন্যা। তাঁর মায়ের নাম খ্যাতি। স্বর্গলোকের অধিবাসিনী হলেও, দুর্বাসা মুনির অভিশাপে দেবী লক্ষ্মীর স্থান হয় ক্ষীরোদসাগরের তলদেশে। এরপর, অমৃতলাভের আশায় দেবাসুরের একত্রে সমুদ্রমন্থনে সাগর থেকে লক্ষ্মী আবির্ভূত হন এবং বিষ্ণুর স্ত্রী হিসেবে তিনি পরিচিত হন।

বাগদেবী সরস্বতী আবার, পুরাণ অনুসারে প্রজাপতি ব্রহ্মার কন্যা। এবং সেই কারণে সরস্বতীকে ব্রহ্মার শক্তি হিসেবেও দেখা হয়। আবার স্কন্দপুরাণ অনুযায়ী, দেবী সরস্বতী হলেন দেবাদিদেব মহাদেবের আপন বোন।

কিন্তু দুর্গার সঙ্গে এই দুই দেবী ঠিক কিভাবে জুড়ে গেলেন, তার অনেক ব্যাখা রয়েছে। শাক্তদের মতে, দুর্গা হলেন আদি পরাশক্তি, তিনি স্বয়ং শিবের-ও অগম্য। এই আদি পরাশক্তি দুর্গাই নিজেকে লক্ষ্মী ও সরস্বতীরূপে বিস্তৃত করেন, এবং এই তিন দেবী একত্রিত হয়ে ‘ত্রি-দেবী’ নামে পরিচিত হন। এই তিন দেবী আবার মানব চরিত্রের তিনটি গুণকে প্রকাশ করেন।সরস্বতী সত্ত্বগুণের, লক্ষ্মী রজোগুণের এবং দুর্গা স্বয়ং তমোগুণের প্রতীক। অর্থাৎ শাক্ত ঐতিহ্য অনুযায়ী, দেবী সরস্বতী ও লক্ষ্মী আসলে আদি পরাশক্তি দুর্গারই রূপভেদ। 

এ তো হল পুরাণের কথা। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে ঠিক কবে থেকে দেবী দুর্গার সঙ্গে জুড়ে গেলেন সরস্বতী ও লক্ষ্মী? আমাদের দেশে অনেক প্রাচীন দুর্গামন্দির রয়েছে যেখানে দেবী দুর্গারই প্রতিমা রয়েছে। বাকি দেবদেবীরা সেখানে অনুপস্থিত। মহীশূর থেকে সেন বংশীয় রাজারা যে দুর্গাপ্রতিমা এনে বাংলায় পুজো করা শুরু করেন, সেখানেও দেবী দুর্গার সঙ্গে লক্ষ্মী ও সরস্বতী অনুপস্থিত। কোনও কোনও ঐতিহাসিকের মতে, ত্রি-শক্তিকে একত্রিত করে পুজো করাটা বাংলায় প্রথম চালু করেন নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। বাংলায় তখন নবাবি আমলের শেষের দিক। ইংরেজদের সঙ্গে মিত্রতা বজায় রাখা হিন্দু রাজারা আর মুর্শিদাবাদের নবাবকে ভয় পাচ্ছেন না বিশেষ। এ রকমই একটা সময়ে, নতুন করে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র দুর্গাপুজো শুরু করেন। সঙ্গে যুক্ত করে দেন লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক ও গণেশকে। এই লোকাচার-ই এখন চলে আসছে, আমরা এই দেবদেবীদের দেবী দুর্গার সন্তান-সন্ততি বলে মান্যতা দিয়েছি মাত্র।

আবার কিছু কিছু সামাজিক গবেষকের মতে, প্রাচীন ভারতের হারিয়ে যাওয়া এক নদী হল সরস্বতী। তাঁদের মতে দেবী লক্ষ্মী হলেন শস্যের দেবী এবং তাঁর সঙ্গে দেবী সরস্বতীকে নদীরূপে একত্রে পুজো করার অর্থ হল নদীমাতৃক, কৃষিভিত্তিক দেশের অন্যতম সংস্কার। শস্যে ফসলে পরিপূর্ণ হওয়ার কামনায়।

তবে গুপ্তযুগ থেকেই অভ্যস্ত পরিবারকেন্দ্রিক বাঙালির দুধে-ভাতে কিম্বা মাছে-ভাতে থাকতে চাওয়ার   আকাঙ্ক্ষায় সপরিবারে মা দুর্গার বাৎসরিক এই পুজোর আবেদন সর্বজনীন। 


কার্তিক-গণেশ

মহাভারতে বলে গণেশ হলেন ত্রিকাল জ্ঞানী, সিদ্ধিদাতা, বিঘ্নেশ অর্থাত সকল বাধা বিঘ্ন নাশ কারী। আর পুরাণে তাঁর জন্মরহস্যেই আছে যে সকল দেবতার পূজার পূর্বে গণেশের পূজা অবশ্য কর্তব্য । তিনি পার্বতীর পুত্র । অভিশপ্ত তাই গজানন। মায়ের এরূপ দুর্বল পুত্রটি তো মায়ের সঙ্গেই পূজিত হবেন, এ আর এমন কী? গণেশের আগমনে পরিশ্রমে সিদ্ধিলাভ হবে মায়ের এবং সেখানে দুর্গাও পুত্রের গর্বে আনন্দিত হন। তাই তো আগমনী গানে আছে, "গিরি গণেশ আমার শুভকারী"।  


কার্তিকেয় হর-পার্বতীর আদরের দুলাল। কিন্তু শিবের ঔরসজাত এই পুত্রটি কে ছয় কৃত্তিকা প্রতিপালন কয়েছিলেন তাই সে কার্তিকেয়। সে দেব সেনাপতি। সে তরুণ সদৃশ, সুকুমার, শক্তিধর এবং সর্বসৈন্যের পুরোভাগে অবস্থান করে। তাই মাদুর্গার যুদ্ধযাত্রায় এমন শৌর্যবীর্য সম্পন্ন পুত্র সঙ্গী না হয়ে যায় কোথায় !

অতএব দেখা গেল লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, এরা কেউ মা দুর্গার গর্ভের সন্তান নয়। 



চালচিত্র কেন থাকে? / ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

চালচিত্রের ছবি- কুমারটুলি, কলকাতা 


মাদুর্গার চালচিত্র যেন দুর্গাপূজার অন্যতম অঙ্গ। বহু দেবতার সমাবেশ লক্ষ্য করা যায় এই চালচিত্রে। পটশিল্পীর রং তুলির টানে এই চালচিত্রের সুষমা যেন মায়ের মূর্তিকে আরো সম্পূর্ণ এবং উজ্জ্বল করে তোলে। আমরা কেবল দেবী দুর্গাকে সপরিবারে পূজা হতে দেখি কিন্তু আসলে হিন্দু সম্প্রদায়ের সকল দেবদেবীরাই কিন্তু উপস্থিত থাকেন ঐ চালচিত্রতে। সব দেবদেবীরাই যেন দুর্গা কে পিছন থেকে অহোরাত্র আশীর্বাদ বর্ষণ করে অভয় দেন। বলেন, তুমি লড়াই করে জয় লাভ কর। আমরা সঙ্গে আছি। আমাদের ত্রেত্রিশ কোটি দেবদেবীর অসংখ্য নাম কিন্তু আসলে এরা সবাই প্রতীকী। 

শিব

দুর্গাপূজা যেন কলিকালের অশ্বমেধ যজ্ঞ । শিব ছাড়া যেমন সকল যজ্ঞ অসম্পূর্ণ তাই মায়ের চালচিত্রের মধ্যমণি হলেন মহাদেব । তিনি যেন এলাহী বৈচিত্রের মাঝে নির্বিকার স্বামীরূপে বিরাজমান । মহামায়া মা দুর্গাকে যেন তিনি সৃষ্টি ও প্রলয়ের ভার দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে আছেন তাঁর মাথার ওপর । মা অসুর বিনাশ করলে শিবপ্রদত্ত আশীর্বাদে আর তাই আমরা শিবকে বন্দনা করি আর মা এর কারণে প্রসন্ন হন । শিব ও শক্তির সম্মিলিত সত্তায় প্রকৃতির সর্বক্ষণের ভাঙাগড়া অব্যাহত থাকে ।

রাইরাজা

চালচিত্রে শিবের ডানদিকে উপবিষ্টা শ্রীরাধা । শক্তিবাদী আরাধনার সাথে সেখানে বৈষ্ণববাদের মেলবন্ধন । বিষ্ণুর শক্তি লক্ষ্মী । শ্রীরামের অবতারে তিনি সীতা আর শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গীনী শ্রীরাধিকা। দেবী-ভাগবতে বলা আছে  যে জগতের উত্পত্তিকালে বিশুদ্ধ শক্তিরূপিণী রাধিকা এবং বুদ্ধির অধিষ্ঠাত্রী দেবী দুর্গা আবির্ভূতা হন তাই একত্রে এই দুই শক্তিযুগলের আরাধনা একান্ত কর্তব্য ।

নারসিংহী

রাইরাজার ডানদিকে নারসিংহী থাকেন ।  অষ্টশক্তির অন্যতম হলেন নারসিংহী । ভগবান শ্রীহরি দেবতাদের কার্যসিদ্ধির জন্য  নৃসিংহ রূপে অবতীর্ণ হয়ে হিরণ্যকশিপুকে বধ করেন । সেই কারণে অসুরগণের বিনাশ ও দেবতাদের কল্যাণার্থে দেবগণের মহাবল শক্তিসমূহ তাদের শরীর থেকে বহির্ভূতা হয়ে নারসিংহী নামক দেবীমূর্তিতে প্রবেশ করে ।  এই দেবীমূর্তি শ্রীচন্ডীর সমীপে উপস্থিত হন । এবং মাদুর্গার সঙ্গে অসুরের যুদ্ধের সময় এই নারসিংহী দুর্গার শরীরে লীন হয়ে যান ও মা’কে  অসুর নিধনের জন্য  আরো শক্তি দান করেন ।

রক্তবীজ

নারসিংহীর ডানদিকে আছেন রক্তবীজ । রম্ভাসুরের মৃত্য্র পর তার চিতার আগুণ থেকে এক বিশালাকায় দৈত্য নির্গত হয় যার নাম রক্তবীজ । চন্ডও মুন্ড বধের পর দানবরাজ শুম্ভ মহাসুর রক্তবীজকে বলে মাদুর্গাকে সংহার করতে । রথে আরোহণ করে রক্তবীজ শৈলশিখরে মাদুর্গার কাছাকাছি পৌঁছতেই দেবীদুর্গা শঙ্খধ্বনি করতে লাগলেন । সেই শঙ্খধ্বনিতে রক্তবীজ বিন্দুমাত্র ভীত না হয়ে দেবীর নিকট গিয়ে দেবীকে শুম্ভ অথবা নিশুম্ভকে বিবাহ করতে বলে । দেবী উগ্র থেকে উগ্রতর হয়ে ওঠেন । প্রচ্ন্ড যুদ্ধ হয় দুজনের মধ্যে । পাপমতি রক্তবীজ দেবীর বাণে বিদ্ধ হয়ে মূর্ছিত হয়ে পড়ে । মূর্ছা ভঙ্গ হলে তার শরীরের প্রতিটি ফোঁটা রক্ত থেকে সেই দানবের অনুরূপ বলশালী দৈত্য উত্পত্তি হয় । শত সহস্র অসুরে ধরিত্রী ছেয়ে যায় । দেবগণ তখন বিপদ দেখে চন্ডিকা রূপিণিদেবীকে বলেন রক্তবীজের দেহনিঃসৃত প্রতিটিরক্তের ফোঁটাকে পান করতে তাহলে দৈত্যের উত্পত্তি রোধ হবে । চামুন্ডারূপিণিদেবী তাই করতে লাগলেন এবং অতঃপর সেই রক্তহীন রক্তবীজকে অস্ত্রাঘাতে নিহত করলেন ।

চামুন্ডা

রক্তবীজের ডানদিকে আছেন দেবী চামুন্ডা ধূম্রলোচন বধের পর শুম্ভের আদেশে চন্ড ও মুন্ড পদাতিক, অশ্ব, হস্ত ও রথ এই চতুরঙ্গ সৈন্য সহ দেবীর উদ্দেশ্যে ধাবিত হয় । দেবী ক্রোধে অতিশয় কৃষ্ণবর্ণ হলে তাঁর ললাট থেকে করালবদনা, লোলজিহ্বা কালী নির্গত হন । দেবী কালী চন্ডের মস্তক ছিন্ন করেন এবং পরে মুন্ডকেও অসির আঘাতে বধ করেন । সেই দেখে চন্ডিকাদেবী কালীকে চামুন্ডা রূপে অভিহিত করেন ।  তাই দুর্গার চালচিত্রে চামুন্ডার অবস্থান যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত ।

মাহেশ্বরী

চামুন্ডার ডানদিকে আছেন দেবী মাহেশ্বরী ।  অষ্টশক্তির অন্যতমা এই দেবী চতুর্ভুজা, ত্রিনেত্রা, বৃষভারূঢ়া ।

ইন্দ্রাণী

মাহেশ্বরীর ডানদিকে আছেন ইন্দ্রাণী ।  তিনি দেবরাজ ইন্দ্রের পত্নী, ইন্দ্রের শক্তি । গজবাহনা, চতুর্ভুজা, বজ্রধারিণী  ।

রামচন্দ্র

চালচিত্রে মহাদেবের বাঁদিকে আছেন রামচন্দ্র ।

সীতাহরণের পর রামচন্দ্র বানরসেনাদের সাহায্যে সেতুবন্ধ্ন করে লঙ্কায় হাজির হলেন । ব্রহ্মা তখন রামকে আদেশ করলেন অপরাজিতা দুর্গার পুজো করে জগতের উদ্ধারে নেমে পড়তে । সমগ্র রাক্ষসকুলকে ধ্বংস না করতে পারলে যে ধরিত্রীর নিস্তার নেই । তাই কৃষ্ণপক্ষেই নিদ্রিতা দেবীকে অকালে জাগ্রত করে অকালে অর্থাত শরতকালে (পূর্বে বসন্তকালে শুক্লপক্ষে দেবলোক জাগ্রত অবস্থায় পুজো হত) কাজে নেমে পড়েছিলেন রামচন্দ্র স্বয়ং । তাই তো অকাল বোধন । ব্রহ্মার পরামর্শে দেবী দুর্গার দশভুজা মূর্তি মাটি দিয়ে গড়ে সিংহবাহিনী সেই দেবীর বোধন করেছিলেন ব্রহ্মা স্বয়ং বিল্ব বৃক্ষমূলে । সেই দিনটিই ছিল মহাষষ্ঠী । শুক্লাসপ্তমী থেকে মহানবমী অবধি বিশেষ পুজো চলতে লাগল । সপ্তমীর দিন দেবী স্বয়ং রামের ধনুঃশ্বরে প্রবেশ করলেন । অষ্টমীতে রামের বাণে আশ্রয় নিলেন । অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে দশানন রাবণের মস্তক পুনঃ পুনঃ ছেদন করলেন রামচন্দ্র । নবমীর দিন সীতা উদ্ধার করলেন রাম । আর দশমীর দিন প্রাতে যুদ্ধে জয়লাভের পর দেবীমূর্তি নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়ে বিসর্জন মন্ত্র পাঠ হল । সেদিন পালিত হল বিজয়া দশমীর বিজয়োত্সব ।

জগদ্ধাত্রী

শ্রীরামচন্দ্রের বঁদিকে আছেন দেবী জগদ্ধাত্রী । তিনি মাদুর্গার অন্যতম রূপ । দেবী চতুর্ভুজা এবং কবীন্দ্রাসুর নিসূদিনী । দেবীর সাথে যুদ্ধের সময় মহিষাসুরের ছদ্মরূপ হল কবীন্দ্রাসুর । মা দুর্গা অঘটন পটীয়সী মায়ার বলে মহিষাসুরের আবরণ উন্মোচন করে কবীন্দ্রাসুরের শিরশ্ছেদ করতে সক্ষম হয়েছিলেন ।

নিশুম্ভ-শুম্ভ

চালচিত্রে জগদ্ধাত্রীর বাঁদিকে থাকে নিশুম্ভ আর নিশুম্ভের বাঁদিকে থাকে শুম্ভ ।  রক্তবীজ নিহত হবার পর নিশুম্ভ সসৈন্যে দেবীর দিকে তেড়ে যায় ।দেবীর সঙ্গে শুম্ভ ও নিশুম্ভের ভয়ানক যুদ্ধ হয় । দেবী নিশুম্ভকে বাণ দিয়ে আঘাত করে মাটিতে ফেলে দেন । সেই দেখে শুম্ভ কুপিত হয় । তখন দেবী শুম্ভকে শূলের দ্বারা আঘাত করেন । ইতিমধ্যে নিশুম্ভ জ্ঞান ফিরলে বাণ দিয়ে দেবীকে ও বাহন সিংহকে আঘাত করে । তারপর চলে গদাযুদ্ধ । শেষে দেবী চন্ডিকা শূলের দ্বারা নিশুম্ভের হৃদয় বিদীর্ণ করেন ।

শুম্ভকে বধ করতে দেবীর সময় লেগেছিল ।  একসময় শুম্ভ দেবতীর্থ পুষ্করে তপস্যা করে । ব্রহ্মা সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বর দান করেন যে কোনো পুরুষের হাতে তোমার মরণ হবেনা । চন্ডিকার সঙ্গে যুদ্ধের সময় শুম্ভ দেবীকে বলেহে উদ্ধত দেবী দুর্গা, তুমি গর্ব কোরোনা । তুমি অন্যান্য দেবীর সাহায্যেই তো যুদ্ধ করছ । সেই শুনে দেবী বলেন,    সমস্ত দেবীর প্রকাশ তাঁর শরীরেই । এরপরেই তিনি যেইমাত্র শুম্ভকে শূল দিয়ে বক্ষে আঘাত করেন সাথে সাথেই শুম্ভর মৃত্যু হয় ।

বারাহী

দৈত্যরাজ শুম্ভের বাঁদিকে থাকেন বারাহী । ইনি বরাহ অবতারের শক্তি । বরাহবদনা, কৃষ্ণা, পীতাম্বরী, সালঙ্কারা, বরাভয়, হল ও মুষলধারিণী । ইনিও অষ্টশক্তির এক শক্তি যিনি দাঁত দিয়ে ধরণীকে ধরে রেখে উদ্ধার করেছিলেন ।

ব্রহ্মাণী

ইনি ব্রহ্মার সৃষ্টিশক্তি । কমন্ডলুর  মন্ত্রপূত জল কুশ দিয়ে ছিটিয়ে দৈত্যদের হীনবীর্য করেছিলেন । ইনি রক্তবর্ণা, বিশালনয়না, বর ও অভয় মুদ্রাধারিণী, হংসারূঢা ।

কাত্যায়নী

দেবী ব্রহ্মাণীর বাঁদিকে আছেন দেবী কাত্যায়নী । তিনি অপরূপা, শান্ত । কাত্যায়ন ঋষির আশ্রমে আশ্বিনমাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে আবির্ভূতা ও পালিতা এই কন্যা দেবতাদের তেজে প্রকাশিত হন ।  তাঁর ত্রিনয়ন থেকে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর সৃষ্টি হয়েছিল । তাই সকল প্রকার জাগতিক ও পারমার্থিক বিপদ থেকে রক্ষা পাবার জন্য দেবতারা কাত্যায়নীর সাহায্য নেন ।

এছাড়াও চালচিত্রে রয়েছেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, গণেশ, কার্তিক, সূর্য, চন্দ্র, পবন, ইন্দ্রাদি দেবতারা । নারীশক্তির মধ্যে অন্যতমা কালী, অন্নপূর্ণা, লক্ষ্মী সরস্বতীও আছেন সেই সাথে । সুতরাং চালচিত্রে আঁকা মূর্তিগুলি  যথেষ্ট ইঙ্গিত বহন করে এবং এই মূর্তিগুলির মধ্যে দিয়েই মায়ের সার্বিক শক্তির প্রকাশ ঘটে ।

মহিষাসুরবধ ও নারীশক্তির উত্থান / ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

 


পুরুলিয়ার চড়িদা গ্রামের ছৌ মুখোশে মহিষাসুর - লেখকের নিজস্ব সংগ্রহ 


মহিষাসুরমর্দ্দিণি দুর্গা বৃত্তান্তের খলনায়ক হলেন অপরাজেয় দোর্দ্দন্ডপ্রতাপ মহিষাসুর। তিনি কে? কিভাবেই বা তাঁর জন্ম? কেনই বা মা দুর্গা তাঁকে বধ করতে উদ্যত হলেন, মা দুর্গার এত শক্তির উৎসের কারণই বা কি আর বিপদে পড়লে দুর্গানাম জপতে বলাই বা কেন, সেই নিয়ে বলব এবার। 

বরাহপুরাণের মতে বিপ্রচিত্তি নামক এক দৈত্যের মাহিষ্মতী নামে একটি মেয়ে ছিল। ছোট মেয়ে খেলার ছলে সিন্ধুদীপ নামে তপস্যারত এক ঋষির সামনে গিয়ে মহিষীর বেশে তাকে প্রচণ্ড ভয় দেখাতে লাগল। ঋষির তপস্যা ভঙ্গ হল । ক্রুদ্ধ ঋষি ছোট মেয়েটিকে অভিশাপ দিয়ে বললেন “তাহলে তুমি বরং মহিষী‌ই হয়ে যাও”। সেই মহিষীরূপী মাহিষ্মতীর গর্ভে যে পুত্রসন্তান হয়েছিল তার নামই মহিষাসুর।

আবার কালিকাপুরাণে বলে মহিষাসুর হল রম্ভাসুরের পুত্র। প্রবল ক্ষমতাশালী রম্ভাসুর মহানন্দে এক সুন্দর মহিষীকে বিবাহ করেছিল। বিবাহ করে ফেরার পথে আর এক অসুরের দ্বারা রম্ভাসুর নিহত হয় আর তার নবপরিণীতা স্ত্রী কিছুদিন পর জন্ম দেয় মহিষাসুরের। যে কিনা মহাদেবের আরাধনা করে দেবীর আশীর্বাদী বর লাভ করে। কঠোর তপস্যার দ্বারা ব্রহ্মার কাছ থেকে অমরত্ব পায় । ব্রহ্মা যেমন মহিসাসুরকে অমরত্ব দিলেন তেমনি বললেন একমাত্র নারীশক্তির দ্বারাই এই মহিষাসুর বধ হবে।

বামনপুরাণে দেখা যায় পুল্যস্ত নারদ কে বলছেন, 

দেবতারা মহিষাসুরের কাছে পরাস্ত হয়ে গৃহ পরিত্যাগ করে ব্রহ্মার নেতৃত্বে বিষ্ণুর কাছে শরণাপন্ন হলেন। সেখানে মহাদেব‌ ও উপস্থিত ছিলেন।এবং তাঁরা তিনজনে মিলে দেবতাদের এই দুরবস্থার কথা শুনে প্রচন্ড ক্রোধানলে জ্বলে ওঠেন। তাঁদের চোখ এবং মুখমন্ডল থেকে যে রোষানল বহির্গত হয় সেই পর্বতসম অগ্নি থেকে জন্ম নেন অষ্টাদশভুজা, ত্রিনয়নী, কৃষ্ণকেশা এবং দীপ্তিময়ী কাত্যায়নী মহিষাসুরমর্দিনী।  

একের পর এক বর লাভের পর এই সর্বশক্তিমান মহিষাসুরের দাপট ক্রমশঃ বাড়তেই থাকে।

ওদিকে এক নারী শক্তির উত্থানও হতে লাগলো ঋষি কাত্যায়নের লালনে। কাত্যায়নের কন্যা কাত্যায়নীই পরবর্তী কালে দিব্যায়ুধে সুসজ্জিতা আমাদের দুর্গা। 

৭ অক্টো, ২০২১

৯ব রাত্রির ৯ব দুর্গার পুজোই ৯ব পত্রিকার পুজো / ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

  

নবদুর্গা - সংগ্রহ (লেখকের নিজস্ব) 


দুর্গাপুজোর সঙ্গে ৯ শব্দটির সম্পর্কটি বেশ আশ্চর্যের। যদিও বাঙালিরা ষষ্ঠী থেকে দশমী অবধি মা দুর্গার পুজোয় সামিল হ‌ই আমাদের অনেকের‌ই বোধহয় জানা নেই যে মহলায়ার অমাবস্যার পরদিন অর্থাত প্রতিপদ তিথি থেকেই কিন্তু দেবীপক্ষের সূচনালগ্ন ঘোষিত হয় এবং সেই তিথি থেকে পরপর ন'দিন কিন্তু দেবী দুর্গার জন্য পালিত হয় নবরাত্রি। তাই দুর্গা পুজো আর নবরাত্রি আলাদা নয় একে অপরের পরিপূরক। ভারতবর্ষের বহুস্থানেই নবরাত্রি বেশ সাড়ম্বরে পালিত হয়। বাঙালীদের স্মরণে মননে এই সময় দুর্গা থাকলেও নবরাত্রির সঙ্গে হয়ত তাদের বিশেষ পরিচিতি নেই। অথচ হিন্দু পুরাণশাস্ত্র অনুসারে দেবী দুর্গার নয়টি রূপ বা নবদুর্গার পুজোই হয় ন'দিন ব্যাপী নবরাত্রিতে।   

৯ রাত্রিতে ৯ ভিন্ন রূপে দেবী পূজিতা হন।

প্রতিপদ-এ তিনি গিরিরাজ হিমালয়-কন্যা দেবী শৈলপুত্রী, দ্বিতীয়া-য় তপশ্চারিনী দেবী ব্রহ্মচারিনী, তৃতীয়া-য় শান্তি ও কল্যাণের দেবী চন্দ্রঘন্টা, চতুর্থী-তে ব্রহ্মাণ্ডউৎপন্নকারিনী দেবী কুষ্মান্ড,পঞ্চমীতে কুমার কার্তিকেয়র মাতা দেবী স্কন্দমাতা, ষষ্ঠীতে মহর্ষি কাত্যায়নের কন্যা দেবী কাত্যায়নী, সপ্তমীতে দুষ্টের দমনকারী দেবী কালরাত্রি, অষ্টমীতে মহাদেব-পত্নী দেবী গৌরী এবং নবমীতে সর্বসিদ্ধি প্রদায়িনী দেবী সিদ্ধিদাত্রী। 

এই হল দুর্গার নয়টি ভিন্ন রূপ। 

আবার সপ্তমীর ভোরে আমরা যে নবপত্রিকা স্নান করাই তিনিই জ্যান্ত দুর্গার প্রতীক। মৃন্ময়ী দুর্গা মূর্তি কল্পনার আড়ালে নবপত্রিকার পুজো আমাদের কৃষি প্রধান দেশের ন'টি ভেষজ উদ্ভিদ স্বরূপিণী বলে দুর্গারই পুজো। 

। কৃষিভিত্তিক সমাজ গঠনের পর্বে শস্যদায়িনী পৃথিবীমাতার আরাধনাই প্রকৃতপক্ষে নবপত্রিকার পুজো। পুরাণ অনুসারে দেবীর ন'টি রূপের প্রতিনিধি স্বরূপ কলাগাছ, কালোকচু, মানকচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, অশোক ও ধানগাছ কে শ্বেত-অপরাজিতার লতা ও হলুদ রঙের সুতো দিয়ে বেঁধে তৈরি হয় ‘নবপত্রিকা’। 

কলাগাছ ব্রাহ্মণী-র, কালোকচু কালিকা-র, মানকচু চামুণ্ডা-র, হলুদ দুর্গা-র, জয়ন্তী কার্তিকী-র, বেল শিব/শিবানী-র, ডালিম রক্তদন্তিকা-র, অশোক শোকরহিতা-র, ধান লক্ষ্মী-র প্রতীক।

৯ সংখ্যাটির সঙ্গে একটি শুভ সংযোগ আছে নিউম্যারলজিতে। অতএব দুয়ে দুয়ে চার করে বলি নবরাত্রিতে নবপত্রিকা স্বরূপিণী নবদুর্গার পুজোও একটি শুভমুহূর্ত বাঙালি সহ সারা ভারতবর্ষের কাছে।

নবপত্রিকার ন'টি উদ্ভিদ ( ছবি-ইন্টারনেট ) 

বেদে আছে ভূমি হল মাতা, মৃত্শক্তি  যা ধারণ করে জীবনদায়িনী উদ্ভিদকে । আযুর্বেদের  ঐতিহ্যবাহী ভারতবর্ষে রোগভোগের প্রাদুর্ভাবও কিছু কম নয় । এবং মা দুর্গার চিন্ময়ীরূপটি এই কলা-বৌয়ের অবগুন্ঠনেই যে প্রতিস্থাপন করা হয় সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই । এই কলাবৌকে বলা হয় নবপত্রিকা । নয়টি প্রাকৃতিক সবুজ শক্তির সঙ্গে আধ্যাত্মিক চেতনশক্তির মিলন হয় দেবীবন্দনায় । সম্বচ্ছর যাতে দেশবাসীর রোগ ভোগ কম থাকে এবং  দেশ যেন সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা হয়ে ওঠে সেই বাসনায় এই নবপত্রিকাকে দুর্গারূপে পুজো করা হয় । ন’টি উদ্ভিদের প্রত্যেকটির গুরুত্ব আছে । প্রত্যেকটি উদ্ভিদই দুর্গার এক একটি রূপ এবং তার কারিকাশক্তির অর্থ বহন করে । এরা সমষ্টিগত ভাবে মাদুর্গা বা মহাশক্তির প্রতিনিধি ।  যদিও পত্রিকা শব্দটির অর্থ হল পাতা কিন্তু নবপত্রিকায় নয়টি চারাগাছ থাকে । আবক্ষ অবগুন্ঠনের আড়ালে নববধূর একটি প্রতিমূর্তি কল্পনা করা হয় । বসন্তকালে বাসন্তী এবং শরতকালে দুর্গার আরাধনায় নবপত্রিকা অর্চনার নিয়ম আছে । যে ক’টি চারাগাছের সমষ্টিকে একত্রিত করে অপরাজিতার রজ্জু দিয়ে বেঁধে নবপত্রিকা তৈরী করা হয় সেই নয়টি উদ্ভিদের নাম শ্লোকাকারে লেখা আছে  আর এই ন’টি গাছের প্রত্যেকের আবার অধিষ্ঠাত্রী দেবী আছেন। 


।। রম্ভা, কচ্বী, হরিদ্রা চ জয়ন্তী বিল্বদাড়িমৌ। অশোক মানকশ্চৈব ধান্যঞ্চ নবপত্রিকা ।।


এঁরাই আবার নবদুর্গা রূপে পূজিতা হ’ন । তাই দুর্গাপূজার মন্ত্রে পাই 

“ওঁ পত্রিকে নবদুর্গে ত্বং মহাদেব-মনোরমে”

৫ অক্টো, ২০২১

ভোরের বার্তা

  তপন বন্দ্যোপাধ্যায়
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় 
কবিতা
পদ্মবনে সদ্য কিছু পদ্য ফুটেছে
চোদ্দোটা মৌমাছি অদ্য ঠিকই জুটেছে
যেই না মধু শুষতে গেল ওষ্ঠপুটে সে
বোধ্য হল মদ্যপানা পঙক্তি জুটেছে।
আমি বাপু বোকার হদ্দ,পদ্ম দেখতে পাইনে
পদ্ম দেখে পদ্য লিখি কবি হতে চাইনে।
 সদ্য সদ্য গদ্যপুরে পাড়ি দিয়ে এনু
পদ্যরা সব পদ্ম বনে থমকে দাঁড়িয়ে ছিনু
মদ্দা কথা গদ্যপদ্য সব পুরেতেই শান্তি
চোদ্দোগন্ডা লিখতে গিয়েই গাইতে ভুলি গানটি।
প্রকৃতি
মাঝে মাঝে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে
অরণ্যজীবনে
চাপমুক্ত মনে
শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আছি
সভ্যতার অপরূপ নাগপাশ বন্ধনে।
অরণ্যের সবুজ ধরে পেরুবো মেঠো পথ
নদীর সাঁকোয় দেখবো উঠে সূর্যোদয়ের রথ।
মাটির বুকে কীতপতঙ্গ হাওয়ায় পাখির ডাক
মায়ের বুকে শিশুরা সব বেঁচেবর্তে থাক।
পরিবেশ
কংক্রিটবনে ধূম্রকন্টক 
দূষণক্লিষ্ট শহর
নিশ্বাস নিতে সবুজ খুঁজছি
সবুজই পরশপাথর।
গাছের পাতার ঘুম নেই আজ
ভারী হয়ে আছে দূষণে
পত্ররন্ধ্র বুজে গেছে তার
রং তেজ সব হরণে।
অতিমারী
ওষধিরা ফুল সেজে
ভরে থাকে বারান্দার কোণ
ক্লেশক্লান্ত মানুষকে
নিরন্তর করে উন্মন।
রক্তজলে ভাসছে দেহ
অসহায় বড় মানুষ
তবুও আমরা খাচ্চিদাচ্ছি
ওড়াচ্ছি আজো ফানুস।
ফুল
ফুলের গান কি শুনেছ কখনও
অতিশয় সুশ্রাব্য
রাতের স্বপ্নে মোহজাল বুনে
ভোরে ঘুম ভাঙে মিঠে সুর শুনে
উঠে বসে লিখি পরমানন্দে
ফুলসুন্দর কাব্য।
ফুলেরা কখন চোখ মেলে চায়     
দেখেছ কখনো ভেবে?
পাপড়িগুলো খুলে খুলে চায়
কেউ কেউ তারা ঝরে পড়ে যায়  
ঠিক কখন যে ঘটে যায় সব       
খেয়াল করিনা দেখে।
কোবিদ
কই কাশফুল, ফুটলি কি রে, 
তাহলে এবার তৈরি হব
কোবিদ কি এখন গেছে দেশ ফেলে
না এবারও পুজো ফাঁকা প্যান্ডেলে
ও কাশ, শিউলি,
ফিরতি পোস্টে সবটা জানিয়ে পাঠাস খবর।
যমরাজ আছে লুকিয়ে চুরিয়ে     
দিনকয়েকের ছুটিতে
সাগরে কিম্বা নদীতে                 
পাহাড়ে, পঞ্চবটীতে।
করোনা কী তাকে হটিয়ে দিল?   
ভাটা পড়ল কী দোস্তিতে?
মার্জার সংবাদ -১
পুষিবেড়ালটা কী কারণে যেন গোঁসাঘরে দিল খিল
খবরে প্রকাশ, গোপনে কিচেনে মাছটি খেয়েছে, গিন্নিমা জেনে ঘেটি ধরে তার দিয়েছে কষিয়ে গোটা কয় ঘুষি-কিল
পুষির আজকে মনখারাপ
খাবেনা কিছুই আজ
আগামীকাল চাপড়াষষ্ঠী,
 ডিটক্স, উপোস গুষ্টি তুষ্টি
কব্জি ডুবিয়ে খাবে বলে কাল
ভুলে যাবে সব লাজ।
মার্জার সংবাদ-২
মাছপাহারায় ব্যস্ত আছে
সে এক আজব বিল্লি
কর্তব্যে সে ঘোর অবিচল
দিবারাত্রি পল-অনুপল নড়নচড়ন নেইকো
যতই করো চেল্লাচিল্লি।
আজ যে ঘরে আন্নাপুজো
বিল্লির ভারি সুখ
কাঁটাপোঁটা, ল্যাজামুড়ো সব এসেছে বাড়ির ভেতর
বিল্লির সব হুঁশ আছে যে,  খেয়াল রাখে নিজের মতো
কাল ভোরের আগে পাবেনা সেসব সেটায় বড় দুখ।
ফুল
ফুল বলল, তাকাও ওহে,
হয়ো না নাক-উচ্চ
একবার তুমি দৃষ্টিং দেহি
হাম কিসিসে কমতি নেহি
তুচ্ছ ভাবছ যাকে--তুমি
তারও কাছে তুচ্ছ।
ফুলের কথায় বৃষ্টি বলে আমি তো নীচেই নামি।
তৃণের চেয়েও নীচে ঝরি, গাছের মাথায় থামি।
এক আকাশের বুকে আছি মোরা বাতাসেও একই শ্বাস।
তবু চেয়ে দেখ, মানুষের শুধু অহং সর্বনাশ।
বাগান বিলাস
বাগানবিলাসী গৃহিণীর খেতে ফুটে আছে দেখলাম
ছোট্ট তবুও কী যে তার জাঁক বাজারবিখ্যাত কচি লালশাক বর্ষাদুপুরে লাল লাল ভাত খেতে কী আশ্চর্য আরাম!
আমিও বড় বাগানবিলাসী, সবুজ ভালোবাসি
বৃষ্টি এলেই ছেঁটে কেটে সব রূপ দিয়ে চলে আসি।
কারোর শেকড়, কারোর পাতা, কারোকে সমূলে তুলে
নতুন নতুন টবে মাটি ঢেলে পুঁতে দিই প্রাণ খুলে।
বর্ষার জলে নেচে ওঠে ওরা, পরাণে কত যে সুখ!
ওদের খুশিতে আমি বড় সুখী ভুলে যাই সব দুখ।
কবুতর কিসসা
গম্ভীর মুখে চোয়াল ফুলিয়ে অপেক্ষায় পায়রানি
রোজ খুদকুড়ো জিবের অরুচি তেনাকে বলেছি
'এনো ভাজাভুজি'
না আনলে আজ কি যে অনর্থ ঘটবে কী তা জানি।
প্যাকেট প্যাকেট দেখি চারধারে,       মনে জাগে খুলে দেখি
ফাস্টফুড আর হোম ডেলিভারি       আমার ওপরই যত নজরদারি
নীরব দর্শক বসে থাকি শুধু লালা ঝরিয়েই দুখী।
জীবন
জীবনবাবু রসিক মানুষ রাখতে হবে রসেবশে
জীবন তো চায় ছন্দে চলন ব্যত্যয় হলে পদস্খলন ভাবো একবার ঝরনা যদি
চলতে চলতে ব্রেক কষে!
ঝর্ণা যদি ব্রেক কষে ভাই    নদীও যাবে থমকে।
পাহাড় যদি সচল হয়ে       সমুদ্র তবে শান্ত হয়ে
বৃষ্টি ঝরা থেমে গিয়ে ভাই   বরফই শুধু গলবে। 
শরত এলো
ফড়িং ঘুরছে ফুলবাগানে
ডানায় কত জাঁক
মধু কি খায় ফড়িংসোনা
করছি দেদার গবেষণা
ফড়িং যদি মধুই খাবে
কোথায় ফড়িংচাক!
আমরা দু'জন এই নৌকায় থাকি,   যে নৌকায় জায়গা অনেক বেশী
শিউলিগন্ধ এতোই আছে সেথায়   পারলে তুমি ভরো নিয়ে যেও শিশি
কাশের হাওয়া লাগে নৌকাপালে,   বন্ধু তুমি আছো ধরে তার হাল
সোনারতরী ভাসবে দুলে দুলে,       আজ যাই ভাই, আসব আবার কাল ।
সূর্য তামসী
সূর্য যেই-না উঠতে চাইল, ধমকায় মেঘ, 'এখন না' বর্ষাকালের মরসুমে
 সবাই এখন ভোরঘুমে আরেকটু পর উঠে তুমি
ছড়িও আলোর বন্যা।
সূর্য তার কাজ সেরে উঠে পড়ে তাড়াতাড়ি
মেঘের তখনো প্যাকিং সারা, যেতে হবে যে বাড়ি।
বৃষ্টি বলে আরেকটু থাকি, আবার তো কত পরে
চোখ রাঙিয়ে বর্ষা বলে আর না! দেব দু'ঘা করে।
ভরা বাদর
মিষ্টি নদী, নাচছ, বইছ, সারাক্ষণ কী সজাগ
ছোট্ট ঢেউয়ের পিঠে উঠে
ইচ্ছে করে বেড়াই ছুটে
অচিন দেশে হারিয়ে যাওয়ার একশো এক মজা।
নাচছে নদী, কাঁদছে আকাশ
জীবন ফুরায় হাঁফিয়ে
সাজছে শরত, পুজোর আমেজ
তবুও বাতাস ভিজিয়ে।
ভিজছে মাটি, জোলো হাওয়ায়
পুজোর গন্ধ ফুরোয় না
শারদীয়ার গন্ধ ভাসে
আগমনী কেউ গায়ই না।
মেঘ -বৃষ্টি
মেঘ বলল, ও মেঘবউ, আজ ওয়েদার ফাস্টো কেলাস সন্ধেবেলা যাওয়াই যায়
কুলকুল কোনও রেস্তোরাঁয় বেশি দূর নয়, একবেলা পথ, চল উড়ে যাই খাইবার পাস।
মেঘবতী শুধায়।" বলছিলাম কী, পুজো টা নাহয় থেকেই যাই,
এখনো বড় সাধ হয়, যদি দু'জনে ভেজাতে পারি।
দুদণ্ড প্যান্ডেলের মাথায় বসি। ওরা কেমন খায়দায়, মজাটজা করে সেজেগুজে বেড়ায় ঘুরে।
আমরা নাহয় নামব কারোর ছাদে কিম্বা কোনো সবুজ মাঠে।
আশ্বিনে তবু নামা যায়।
কার্তিক এলেই আবার ওরা লাঠিসোঁটা নিয়ে
করবে তাড়া । 
বাতাসে তখন হিমহিম গন্ধ
তোমার আমার নীলকালো সংসার।
সময় তখন আড়ালে লুকিয়ে থাকার।
আমরা বেড়াতে যাব না?
'কোথায় যাবেন, আপ না ডাউন, বলুন মশয়, কীসে যাওয়া?
আপ ট্রেন যায় সব ফাইভ স্টার
ডাউন ট্রেন পাইস রেস্তরাঁ'
'কোত্থাও নয়, দিন না টিকিট,
যেখানে ফ্রি থাকা-খাওয়া।
আমি যাব চলে জাহান্নামে কিম্বা বেহেস্ত,
পরীর দেশে অথবা যাব মায়ের কাছে
সুখ যেখানে উপচে আছে।
কিম্বা যাব বাবার কোলে
ছোট্ট আমি ঘুমের দেশে
হয়ত কখন যাব চলে।
প্রজাপতি
ফুলটার পাশে হাসল বসে সে এক প্রজাপতি
কালচে গাউন তার পরনে লাল স্কার্ট পরে অন্যজনে
মাপছে দুজন, আমি না ও,
কে কম রূপবতী!
পেরজাপতির পুজোয় এবার পালাজো, টপ চাই
গাউন, স্কার্ট ব্যাকডেটেড বরং, কেপরি হাইফাই।
ফুলের কাছে যেতে গিয়ে থমকে গেছে আজ।
ও কী! ও মা! ফুলের আবার দেখ কেমন সাজ!
শরত আলোয়, পুজোর ভীড়ে শিউলিবাড়ির দোর
রাত পোহালেই দেখব সবাই মহালয়ার ভোর।

১০ সেপ, ২০২১

আমাদের গোবর গণেশ

 

মজিলপুরের পুতুল "গণেশ জননী" 

স্কন্দপুরাণে একটি গল্প আছে গণেশের জন্ম নিয়ে।

মা দুর্গা একদিন কৈলাসে বসে স্নানের পূর্বে তেল হলুদ মেখে গাত্রমার্জণা করছিলেন। মায়ের দুই সহচরী জয়া-বিজয়া কাঁচা হলুদ বেটে তার মধ্যে সরষের তেল দিয়ে মায়ের সর্বাঙ্গে মাখিয়ে দিতে ব্যস্ত। মা সেই আরাম পাবেন কি, মনে তাঁর খুব দুঃখ। মহাদেব কত নারীকে পুত্র দিয়ে তাদের আকাঙ্খা পূর্ণ করেন আর দুর্গাই স্বপুত্র থেকে বঞ্চিত। কার্তিককে পেয়েছেন যদিও কিন্তু সে তো তাঁর গর্ভের নয়। সে শিবের ঔরসজাত, গঙ্গার কানীনপুত্র আর ছয় কৃত্তিকার দ্বারা পালিত।


আমাদের নিজেদের বংশের কেউ তো র‌ইলনা দেব। কে আমাদের পারলৌকিক ক্রিয়াদি সম্পন্ন করবে? অতএব একবার আমরা চেষ্টা করেই দেখি। আমার গর্ভে আপনার ঔরসে সন্তান আসুক একটা।


"অদৈব ময়ি সঙ্গম্য ঔরসং জনায়াত্মজম্‌"


বিবাগী শিব এমন কথা শুনে বিচলিত হয়ে বললেন, আমি তো গৃহস্থ ন‌ই, চালচুলো নেই আমার, তোমার সঙ্গে আমার বিয়েটাও তো দেবতাদের ইচ্ছায়। গৃহস্থ মানুষেরা বংশোলোপ পাবার ভয়ে পুত্র কামনা করে, আমি তো অমর। এই তো বেশ আছি আমরা বন্ধুর মতন। পার্বতীর মাতৃহৃদয় শান্ত হলনা।


গাত্রমার্জণা শেষের দিকে। মা জয়া-বিজয়াকে বললেন, তোরা যা দেখি একটু ওদিকে, বাবার সঙ্গে আমাকে একটু একা থাকতে দে। মা নিজের তেলহলুদ মাখা গায়ের ময়লাগুলি তুলতে তুলতে মহাদেবকে বলেই ফেললেন


" আজ আমার একটা ছেলে থাকলে..."


মহাদেব বললেন,


" তুমি ত্রিলোকের যত পুত্রসন্তান আছে তাদের সকলেরি মা"


মা বললেন,"তবুও, একটুতো দুঃখ হয়, বুঝলেনা"


মহাদেব বললেন" কত ঝামেলা করে চন্দ্রলোক থেকে কৃত্তিকাদের অমতেও কার্তিককে এনে দিলাম তাও তোমার দুঃখ ঘুচলোনা?"


মা বললেন " ঠিক আছে আর বলবনা" বলতে বলতে নিজের গায়ের ময়লাগুলি তুলে তুলে মাটিতে ফেলছিলেন মনের দুঃখে। হঠাত তাঁর কি মনে হল, সেই ময়লাগুলি দিয়ে একটি পুতুল গড়ে ফেললেন মাদুর্গা। নারায়ণ সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি ঐ পুতুলের মধ্যে সূক্ষ্ম শরীরে প্রবেশ করা মাত্র‌ই পুতুলটি প্রাণ পেল আর মাদুর্গাকে "মা, মা" বলে ডেকে উঠল। মায়ের বুকের ওপরে উঠে তাঁর দুধ খেতে শুরু করে দিল। দুর্গা আনন্দে আত্মহারা হয়ে সেই ছেলেকে কোলে নিলেন। মহাদেব আবার কার্তিককে এনে তাঁর আরেক কোলে দিলেন। । এবার কৈলাসে মহাভোজ। দুর্গার সুখ আর দ্যাখে কে! দুই পুত্র, দুই কন্যা নিয়ে সুখের সংসার শিব-দুর্গার। কৈলাসের সেই মহাভোজে সব দেবতারা নিমন্ত্রিত হলেন। সকলেই নির্ধারিত দিনে এলেন কেবল শনি মহারাজ ছাড়া। শিব ক্ষুণ্ণ হলেন শনি না আসায়। শনি সম্পর্কে দুর্গার ভাই। একবার দুর্গা শনিকে বর দিয়েছিলেন, সে যার দিকে চাইবে সঙ্গে সঙ্গে তার মাথাটা খসে পড়বে। মহাদেবের অসন্তোষের কারণে সেদিন শনি অবশেষে দুচোখ হাত দিয়ে ঢেকে প্রবেশ করলেন। এদিকে মহাদেব তো আর সেকথা জানেননা। তাঁদের ছেলেকে দেখছেন না শনি, সেও তো এক অপমানের বিষয়। শনি বাধ্য হয়ে চোখ খুলে সেই ছেলের দিকে চাইতেই ছেলের মুন্ডুটি খসে পড়ে গেল মাটিতে। মাদুর্গা কাঁদতে লাগলেন।


দুর্গা নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকল দেবতারা বিচলিত হয়ে পড়লেন। মহাদেব বললেন, ভয়ানক গ্রহদোষে দুষ্ট তোমার ছেলে পার্বতী। দৈববাণী হল, "শিশুটি মায়ের কোলে উত্তরমুখী শুয়ে আছে অতএব উত্তরদিকে শয়নরত কোনো পশুর মাথা এনে জুড়ে দেওয়া হোক শিশুর ধড়ে, তাহলে বেঁচে যাবে শিশুটি। " মহাদেব নন্দীকে বললেন ত্রিভুবন ঘুরে উত্তরদিকে শয়নরত যে কোনো পশুর মুন্ডটা কেটে আনতে। নন্দী বেরিয়ে পড়ল। স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল ঘুরে নন্দী স্বর্গের রাজধানী অমরাবতীতে গিয়ে উত্তরদিকে শয়নরত ইন্দ্রের হাতি ঐরাবতের মাথাটি‌ই কেটে নিয়ে এল । সেই হাতীর মাথাটা মহাদেব তখুনি মাথাটা ছেলের কাঁধে জোড়া দিলেন ছেলে আবার মা, মা করে ডাকতে শুরু করে দিল।যদিও ছেলেটি একটু বেঁটেখাটো ও মোটা তবুও ঐ গজমুখে তাকে দিব্যি মানিয়ে গেল।


"খর্বস্থূলতরদেবো গজেন্দ্রবদনাম্বুজঃ"


মা দুর্গার একাধারে মা ডাক শুনে আনন্দ হল আবার অন্যথায় ছেলের হাতীর মাথা দেখে দুঃখে প্রাণ কেঁদে উঠল। তাঁর দুঃখ দেখে দেবতারা বললেন, মা তুমি দুঃখ কোরোনা, তোমার এই ছেলের নাম দিলাম গণপতি। সকল দেবতার পুজোর আগে এঁর পুজো হবে সর্বাগ্রে। মা দুর্গা ছেলের এই সম্মানে গর্বিত হলেন।


ব্রহ্মা বিশাল এ ছেলের হাতির মাথা বলে নাম দিলেন গজানন আর বীজমন্ত্রে তার নাম দিলেন হেরম্ব।ভুঁড়ির জন্য লম্বোদর আর একটি দাঁতা ভাঙা (নন্দী মাথা আনতে গিয়ে একটি দাঁত ভেঙে ফেলেছিল) বলে নাম দিলেন একদন্ত।


অচিরেই সেই গণেশ সরস্বতীর হাত থেকে পেল তার প্রথম উপহারস্বরূপ একটি লেখনী। ব্রহ্মা দিলেন জপমালা। ইন্দ্র দিলেন গজদন্ত। লক্ষ্মী দিলেন সম্পদের প্রতীকি স্বরূপ একটি পদ্মফুল। শিব দিলেন ব্যাঘ্রচর্ম। বৃহস্পতি দিলেন যজ্ঞোপবীত। আর পৃথিবী দিলেন একটি মূষিক। মা ছেলের হাতে দিলেন প্রচুর মিষ্টি।


পৃথিবী প্রদত্ত ঐ মূষিকটিই কিন্তু ঐ মিষ্টান্নের ভাগ প্রথম পেয়েছিল।


দক্ষিণে আবার গণেশের জন্মের অন্য কাহিনী আছে। একবার শিব-পার্বতী হিমালয়ের পাদদেশে ভ্রমণ করতে করতে দুটি রমণে রত হস্তী-হস্তিনীকে দেখতে পেলেন। এই মিলন দৃশ্যে তাঁরাও যারপরনেই উত্তেজিত হলেন এবং ইচ্ছাপূরণ করলেন। এবং এর ফলে যে শিশুটি জন্ম নিল তার মাথাটি হাতির এবং ধড়টি মানুষের।


মা-বাপ অর্থাত দুর্গা-শিবের বুড়ো বয়সের "মেঘ না চাইতেই জল" এর মত এই গণেশ পুত্রটি। বাবা যদিও একটু উদাসীন এহেন পুত্রের ব্যাপারে। মায়ের আদিখ্যেতা যেন ধরেনা এই পেটমোটা, বেঁটেখাটো হাতিমুখো ছেলেটির জন্য। এদ্দিন বাদে একটা ছেলে এসে তার অপূর্ণ মাতৃত্বের হাহাকারকে কিছুটা হলেও ভরিয়ে তুলেছে। মাদুর্গার এই "গোবর গণেশ" ছেলেটিকে নিয়ে বড়োই গর্ব। দেবতারা সকলে মিলে একে সব দেবতাদের মাথায় রেখেছেন বলে কথা। তাই এক কথায় গণেশ হলেন প্যাম্পার্ড ব্র্যাট বলতে যা বোঝায় তাই। মায়ের গায়ের সঙ্গে লেপটে থাকে সে। মায়ের আঁচলধরা এই ছেলেকে মা কথায় কথায় একদিন বলেই ফেললেন "এবার একটা বিয়ে দিতে হবে তোর"


গণেশ বলল, তোমার মত মেয়ে চাই কিন্তু মা। মাদুর্গা তো হেসেই খুন! তিনি বললেন, তা আবার হয় না কি বাবা!


শিব মা-ছেলের বন্ধুত্ব দেখে একটু একটু ঈর্ষাও করেন মনে মনে। কারণ তাঁর বুঝি স্ত্রীর আদরে একটু হলেও ভাটা পড়ে। স্ত্রী বুঝি ছেলেকে নিয়ে বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়েন।


কেউ কেউ আবার কানাঘুষো বলতেও থাকেন


মা-ছেলের এই সম্পর্কটা ঠিক ভালো নয়, নিশ্চয়‌ই ওরা "খারাপ" ।


দুর্গা সেই শুনে মনে মনে হাসেন।


ফ্রয়েড বলেন "ইডিপাস" বিপরীত লিঙ্গের ওপর স্বাভাবিকভাবেই আকৃষ্ট হওয়াটা দোষের কিছুই নয়। বাংলার ছেলের মায়েরা জানে এ জিনিষের আসল তত্ত্ব। তাই বহুদিন বাদে ছেলে ঘরে এলে মা বলে ওঠেন "আমার গণেশ এল" !


এই ছেলে বেশ এঁচোড়ে পাকা, ডেঁপো বলতে যা বোঝায়। আর হবেনাই বা কেন? জন্মের পরেই মা-বাপের সামনেই সব দেবতারা তাকে গণাধিপত্য দিয়েছে। সে তাই মাথার ওপরেই চড়ে বসে সকলের। এহেন পরিস্থিতিতে একদিন পরশুরাম তাঁর প্রভু শিবের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। শিব-দুর্গা তখন ঘরের মধ্যে মৈথুনে রত। গণেশ পরশুরামের পথ আটকে দেয়। বলে " এখন বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করা যাবেনা" পরশুরাম রেগে আগুণ হয়ে নিজের হাতের কুঠারটি ছুঁড়েই মেরে দেয় গণেশের দিকে। গণেশ জানে ঐ কুঠারটি শিবপ্রদত্ত। একবার পরশুরাম কঠোর তপস্যায় শিবকে তুষ্ট করে শিবের কাছ থেকে লাভ করেছিলেন। গণেশের কাছে সেই কুঠারটি তাই বেশ গুরুত্ব বহন করছে। কুঠারটি সজোরে এসে লাগে গণেশের বাঁদিকের গজদন্তে। দাঁতটি ভেঙে যায় । তাই বুঝি সে হয় একদন্ত।


গবেষকরা বলেন, শূকর বা হস্তীর দাঁত ভেঙে দেওয়ার অর্থ হল তার পৌরুষ ভেঙে দেওয়া আর সে যাতে পুরুষত্ব হারায় তার ব্যবস্থা করা। মাদুর্গার প্রতি শিবের ঈর্ষার থেকেই নাকি জন্ম নিয়েছিল এরূপ আক্রোশ। তাই নিজ শিষ্য পরশুরামকে দিয়ে অমন কাজ করিয়েছিলেন শিব। কি জানি বাপু! গণপতির পৌরুষ তো আজন্ম অক্ষত থাকতেই দেখেছি। যিনি নিজেই লিঙ্গেশ্বর তিনি‌ই আবার নিজপুত্রের ক্যাস্ট্রেশানের ব্যবস্থা করলেন এভাবে? একটি দাঁত তো ভেঙে দিলেন পরশুরাম আর অন্যটি যে আমাদের সর্ব শক্তি দিয়ে সর্বদা রক্ষা করে চলেছে, সিদ্ধি-বুদ্ধি সব যুগিয়ে চলেছেন তার কি ব্যাখ্যা দেবেন গবেষকরা? বরং বলা যেতে পারে ইন্দ্রিয় সংযম করে আজীবন ব্রহ্মচর্য পালনের ব্রত পালনে মন দিলেন তিনি। কিন্তু তাও তো নয়। বিশ্বকর্মার দুই শুভকারিণী শক্তি কন্যা বুদ্ধি আর সিদ্ধির সঙ্গে তাঁর বিয়েও হয়েছিল আর দুটি সন্তানও জন্ম নিয়েছিল। সিদ্ধির গর্ভে গণেশের পুত্র লক্ষ্য আর বুদ্ধির গর্ভে লাভ এর জন্ম হয়।


গণেশের এই রূপকধর্মী বংশপরম্পরা থেকে বোঝা যায় ব্যবসায়ীদের দোকানে "শুভলাভ" লেখা থাকার কারণটি।   


তিনি হলেন গিয়ে "গণানাং পতি", গণশক্তির প্রতীক, গণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ (গণ+ঈশ) । বিনায়ক (বি+নী+অক) তাঁর অপর নাম। আর প্রমথগণ হলেন শিবের অনুচর এবং সঙ্গী। তাঁরা নাচগানে পারদর্শী । সন্ধ্যার অন্ধকার প্রমথগণের আশ্রয়। বিনায়ক হলেন সেই প্রমথগণের পতি। সন্ধ্যার অধিপতি দেবতা বলে সন্ধ্যারূপিণী লক্ষ্মীদেবীর পাশে গনেশের অবস্থান। ভূতপ্রেতদের দৌরাত্ম্যি ও সকলপ্রকার বাধাবিঘ্ন নাশ করার জন্য প্রমথগণ গণপতিকে সন্তুষ্ট রাখতেন তাই গণপতির অপর নাম বিঘ্নেশ। তাঁকে পুজো করলে সিদ্ধিলাভ হয় তাই তিনি সিদ্ধিদাতা গণেশ। গ্রীসে ও রোমে গণেশ "জুনো(Juno)" নামে পুজো পান। হিন্দুধর্ম ছাড়া বৌদ্ধধর্মেও গণপতিকে "ওঁ রাগ সিদ্ধি সিদ্ধি সর্বার্থং মে প্রসাদয় প্রসাদয় হুঁ জ জ স্বাহা" মন্ত্রে পুজো করা হয়। কিন্তু তফাত হল হিন্দুদের গণপতি সিদ্ধিদাতা আর বৌদ্ধদের সিদ্ধিনাশক যা সম্পূর্ণ বিপরীত। হিন্দুদের দেবী অপরাজিতা মা দুর্গার ডানদিকে থাকেন গণপতি। কিন্তু মহাযানী বৌদ্ধদের অপরাজিতা দেবীর সাধনায় লক্ষ্য করা যায় গণপতি চিরবিঘ্ন প্রদায়ক। সেখানে দেবীর বাঁ পা গণেশের উরুতে আর ডান পা ইন্দ্রের ওপরে ন্যস্ত। বিনায়ক দেবীর পদভারে আক্রান্ত। আবার পুরাণের মতে গণেশ কেবলমাত্র শিব-দুর্গার পুত্ররূপে পরিচিত। বহুযুগ আগে সমাজে দুধরণের সম্প্রদায় ছিল যাঁরা দুটি ভিন্ন মতবাদে গণেশের পূজা করত। একদল নাগ-উপাসক ছিল তাই গণেশের গলায় যে যজ্ঞ-উপবীত বা পৈতেটি রয়েছে সেটি নাগোপবীত তথা নাগের অলঙ্কারের পরিচায়ক। আর অন্য সম্প্রদায় আবার স্কন্দ বা কার্তিকের পূজারী। তারা নাগ-উপাসনার বিরোধী হয়ে কার্তিকের বাহন ময়ূরকেই বেশী প্রাধান্য দিত । ময়ূর হল নাগেদের শত্রু।


বর্তমান দুর্গাপুজোতে আমরা মা দুর্গার দুই পাশে কার্তিক ও গণেশ উভয়েরি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান লক্ষ্য করি। অর্থাত নাগ-উপবীতধারী গণেশও র‌ইলেন আবার ময়ূরবাহন কার্তিকও র‌ইলেন। আর সেই রূপটি‌ই সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে আজো সমাদৃত।



এবার গণেশ, গণাধিপতি, গণপতি সব নামগুলিতে "গণ" শব্দটি কেন? গণ'র আভিধানিক অর্থ হল অনেকের সমাহার। বেদের মধ্যে যে সব দেবতাদের নাম পাওয়া যায় অর্থাত রুদ্রগণ, বসুগণ, আদিত্যগণ, সকলের মাথার ওপরে দেবাশীর্বাদ প্রাপ্ত এই গণেশের ওপরে যে গণাধিপত্য বর্তালো তার জেরেই তিনি হলেন সকল দেবতাগণের পতি বা শ্রেষ্ঠ।


"ভবতোপি গণা যে তু তেষামপ্যাধিকো ভবেত্‌"



বিশালাকার গণপতির বাহন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মুষিক । আর তার অনুপাতে অতি ক্ষুদ্র ইঁদুর জীবের ছোট ছোট কর্মফলের কর্তনকারী । অর্থাত অতি বৃহত শুভ কর্মের দ্বারা কৃত সুফল বিনষ্ট হয়ে যায় ছোট্ট কোনো মন্দ কর্মের দ্বারা । তাই ষড়রিপু বা কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ ইত্যাদির মত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কর্মফল বিনাশ করে ইঁদুর যাতে কিনা বৃহত সিদ্ধিলাভে বাধা না ঘটে ।


আমরা ছোট থেকে গণেশের পাশে যে কলাবৌটি দেখে অভ্যস্ত সেটিকে মনেমনে গণেশের বৌ বলেই জানি। আচ্ছা এই কি সেই বৃক্ষবধূ? যে কিনা আমাদের কৃষিপ্রধান দেশের বর্ষবরেণ্যা এক দেবী যার নাম নবপত্রিকা। তাঁকেই তো জানি মাদুর্গা রূপে পাঁচদিন অর্চনা করা হয়। তাহলে গণেশের পাশে কেন তিনি? আবারো উঠে আসে মা-ছেলের সেই প্রগাঢ় সম্পর্কের কথা। এখানেও মায়ের আঁচলধরা সেই ছেলেটি। আসলে আমাদের ঘরের মেয়ে দুর্গার এই সপরিবারে আসাটা আমাদের মেনে নেওয়াটাই কাল হয়েছে। এক চালচিত্রের লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশ নিয়ে মা দুর্গা...এরা কেউ মায়ের পেটের সন্তানতো নন। সেটাই ভুলে যাই আমরা। বিভিন্ন শক্তির প্রতিমূর্তি এঁরা। এই যে কলাবৌ বা উদ্ভিদবধূটি, এতো শস্যশালিনী পৃথিবী-মাতৃকার প্রতীক। অতএব আদি অনন্তকাল থেকে আমাদের ঐ "মা"য়ের ওপরে অবসেশানটা থেকেই যায়।


সত্যি কি বৃহদাকার গণপতির বাহন ঐ মূষিক? তাহলে ঐ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মুষিকের ওপরে চড়ে বসলে তো সে মরেই যাবে। তাহলে বাহন কেন বলি আমরা? জন্মের পরেই গনেশ সব দেবতাদের কাছ থেকে একগুচ্ছ দৈবী উপহার পেয়েছিলেন আগেই বলেছি। তার মধ্যে পৃথিবীমায়ের দেওয়া এই ইঁদুরটি কেন? হস্তীমুখ গজাননের প্রচন্ড ক্ষুধা আর ইঁদুরের শস্যদানা ভক্ষণের প্রবল ইচ্ছা দুয়ে মিলেমিশে এক সেইখানে।

৬ সেপ, ২০২১

কৌশিকী অমাবস্যা

 পার্বতী তাঁর আগের জন্মে সতী রূপে দক্ষ যজ্ঞ স্থলেই আত্মাহুতি দেন। তাই পরের জন্মে ওঁর গায়ের রঙ কালো মেঘের মতো হয়ে যায়। মহাদেব তাই তাঁকে কালিকা নামে ডাকতেন। একদিন দৈত্য দ্বারা পীড়িত দেবতারা যখন কৈলাসে আশ্রয় নিলেন, মহাদেব সব দেবতাদের সামনেই পার্বতীকে বললেন, “কালিকা, এসো। তুমি ওদের উদ্ধার করো।”

আবার একদিন সবার সামনে বউকে আদর করে 'কালী' বলে ডাকায় পার্বতী অত্যন্ত ক্ষুব্ধ, অপমানিত ও ক্রোধিত হলেন।
এদিকে কৈলাসে পা দিয়ে দেবতারা নতুন বউয়ের গায়ের রঙ দেখে মুখ চাওয়াচাউয়ি করলেন।
মহাদেব জানতে পেরে বললেন, "তা বাপু, আমি দেখেশুনে ফর্সা না কালো বৌ আনবো তাতে তোমাদের এত মাথাব্যাথা কিসের?" দেবতারা মুচকি হাসলেন।
গায়ের রঙ নিয়ে বারেবারে এসব চাপানউতোর কালীর মোটেও পছন্দ হচ্ছিল না।
কৈলাসে পৌঁছে দেবতাদের বড় আনন্দ তখন। একে প্রাকৃতিক শোভা তায় নতুন বউয়ের সম্মানার্থে বেশ সাজো সাজো রব।
মহাদেবের মনোরঞ্জনের জন্য ইন্দ্র অপ্সরাকে এনেছেন নাচাগানার জন্য। মাঝখান থেকে এত সব অতিথি আপ্যায়নে কালিকার একেই নাভিশ্বাস ওঠে তায় আবার গায়ের রঙ নিয়ে সবার কানাঘুষো।
অপ্সরাদের সামনেই মহাদেব আবার আদরের সঙ্গে ডাক দেন বউকে,
-হে অঞ্জনসদৃশ শ্যামলী, আমার রূপসী কুচকুচে কালী, ওগো বধূ ব্ল্যাক-বিউটি ! ক‌ই ? এসো একটিবার সামনে, দ্যাখো কারা এসেচেন তোমার সঙ্গে আলাপ করতে, তোমাকে নাচগান শোনাতে!
ফর্সা অপ্সরাদের সামনে এরূপ কুরুচিকর সম্বোধনে কালিকা গেলেন ক্ষেপে। একে নতুন বৌ, তায় আবার রাসভারী, মেজাজী, দাপুটে এক মেয়ে। তাঁর মোটেও সহ্য হলনা।
তিনি মনে মনে বললেন, " কি এত বড় আস্পর্ধা! আবার আমাকে বাইরের নারীর সামনে কালো বলা! ধ্যুত্তোর গায়ের রঙ! আমিও দেখিয়ে দেব আমার প্রকৃত স্বরূপ। আমি ছাড়া তোরা সবাই অচল।"
মনের দুঃখে পাশের মানস সরোবরে গিয়ে তপস্যা শুরু করলেন। নিজের গায়ের কৃষ্ণকোষগুলি একে একে পরিত্যাগ করলেন। যেন খোলস ছাড়ছেন তিনি। দ্বিখণ্ডিত ব্যাক্তিত্ত্ব বা স্প্লিট পার্সোনালিটি হলেন বোধহয়। কালো রং অনায়াসে বদলে ফেলে কালিকা হলেন গৌরী ।
তপস্যান্তে শীতল মানস সরোবরের জলে স্নান করে দেখলেন নিজের দেহের রঙ হয়েছে পূর্ণিমার চাঁদের মতো। ইনিই দেবী কৌশিকী। পার্বতী বা কালিকার আরেক রূপ। তাইতো এই অমাবস্যার নাম কৌশিকী অমাবস্যা। আজ ভরা ভাদ্রের সেই তিথি, যে দিন এই দেবীর উৎপত্তি হয় এবং তিনিই পরে শুম্ভ ও নিশুম্ভকে বধ করেন। শুরুতেই বলেছি, যে কারণে দেবতাদের অত কাঠখড় পুড়িয়ে কৈলাসে আসা।

১০ আগ, ২০২১

ভাঙা আয়না / ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

  



ভাঙা আয়না  

ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় 

(১)

সল্টলেকের বহুতল অফিসবিল্ডিং টা অনেক কষ্ট করে মনে পড়েও পড়ে না তন্ময়ের। বিশাল লম্বা কাচের দেওয়ালের পাশেই ছিল তার ডেস্ক। পূর্ব শহরতলীর বেশ সুন্দর স্কাইভিউ পেত সেখান থেকে। কাজের ফাঁকে চোখের আরাম হত নীল-সবুজের মাখামাখি দেখে। 

তন্ময়ের জীবনটা ওলটপালট হয়ে আছে এখন। সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের এক কেবিনের মধ্যে সে । কখনও বিছানায় বসে থাকে হাঁটু মুড়ে অথবা শুয়ে। ঘর অন্ধকারই বেশী ভালো লাগে তার। উল্টোদিকের দেয়ালের ওপর কোথাও থেকে একটা  তির্যক আলোর রেখা উঁকি মারে। তন্ময়ের আলো ভালো লাগেনা। তার চোখ  আলোর দিকে নয়। নিজের হাতের আঙ্গুলগুলো বারবার এক দুই তিন করে গুনছে আর হিসেব ভুল হয়ে যাচ্ছে। একবার সামনের দিকে গোনে তো আরেকবার উল্টোদিক থেকে। তন্ময়ের বয়স তিরিশের কমই তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে আন্দাজ করা মুস্কিল। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে ঢাকা মুখ, উসকোখুসকো চুল। পরনে স্ট্রাইপড নীল শার্ট আর নীল পাজামা। হাসপাতালের  রুগীদের ড্রেসকোড যেমন হয় আর কি। 

দুহাতের দশটি আঙ্গুল বারবার এক দুই তিন করে গুণেই চলেছে তন্ময় আর হিসেবে কেবলই ভুল হয়ে যাচ্ছে। হাতের নখ বেড়েছে বেশ। দেখতে পায়না তন্ময় সেসব। 

মাঝেমাঝে নিজের মনেই বকে চলে অসংলগ্ন সংলাপ। গোনাতে খেই হারিয়ে গেলেই মনে পড়ে পুরনো কথা। আবছা স্মৃতি অফিসের। সেই নীল-সবুজ দৃশ্যপট। ল্যাপটপের কিবোর্ডে ঝড় তোলা সেই শব্দ। আবার হারিয়ে যায় সব। এর মধ্যেই সেই দেওয়ালের ওপর অস্বস্তিকর আলোর রেখা। তা বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই  ক্ষীণ হতে থাকে প্রতিদিন। একইভাবে। একইসময়ে। সে হুঁশ নেই তন্ময়ের। ঘড়ির সঙ্গে অনেকদিন কোনও সম্পর্ক নেই তার। 

কেউ যেন কেবিনের দরজা খোলে। সেই শব্দে চেয়ে দেখে তন্ময়। একজন মধ্যবয়স্কা নার্স এগিয়ে আসেন। তাঁর বুকে স্টিলের পাতে ইংরেজীতে নাম লেখা "অলকা"। পড়তে পারল তন্ময়। কিন্তু তাঁকে দেখেও না দেখার ভান করে। নিজের মনে আঙুল গোনায় ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। অলকার চোখে পড়ে তন্ময়ের হাতের নখগুলো। ভাবেন, কেটে দিতে হবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে। 

অলকার খুব পছন্দের কর্মস্থল এই সুপারস্পেশ্যালিটি হাসপাতালের মানসিক নিরাময় কেন্দ্রটি। 

তন্ময় কে মৃদু স্বরে ডাকলেন নাম ধরে। নাহ! কোনও ইচ্ছেই নেই সাড়া দেবার। এবার আরও কাছে গিয়ে তার মাথার চুলে হাত দিলেন অলকা। 


তন্ময় তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। 

অলকা বললেন, খেতে যাবে আমার সঙ্গে? অনেক বেলা হল তো। 

তন্ময় বুঝে উঠতে পারেনা, কোথায় যেতে হবে তাকে। কেনই বা খেতে হবে? খিদে তো পায়নি তার। 

অলকা বললেন, না কি এখানেই খাবার দিতে বলব? 

তন্ময় ভাবে, এখানে? খাটের ওপরে বসে রোজ খায় সে? মনে করতে পারেনা। 

অলকা বললেন, কি খেতে ইচ্ছে করছে বল আমাকে। 

তন্ময় বলে সেই বিস্কিট টা? যেটা অফিসে খেতাম রোজ। একটা কৌটোয় রাখা থাকত আমাদের ডেস্কের পাশে। 

অলকা বললেন, কি বিস্কিট? ক্রিম দেওয়া? চকোলেট না কি নোনতা ক্র্যাকার? 

তন্ময় বলল, না, না মোটা মোটা। 

অলকা বললেন, বুঝেছি। কুকিজ? 

তন্ময় বলল, তুমি কি করে জানলে? 

আমাকে সব জানতে হয়। বুঝেছ? আমারও ঘরে তোমার বয়সী একজন ছিল  কিনা। তারও পছন্দ ছিল এইসব। বলে হাসিমুখে তন্ময়ের অবাধ্য  চুলগুলো ঘেঁটে মাথার ওপর পাতিয়ে দিলেন। তন্ময়ের আবছা মনে পড়ল মায়ের কথা। এমন করেই দিত তার মা। 

অলকার ব্যাগে সবসময় একটা করে কালোজিরে দেওয়া বেকারী বিস্কিটের প্যাকেট রাখা থাকে। মনে পড়তেই সেটি এনে তন্ময়ের হাতে ধরিয়ে দিলেন তিনি। খাবে নাকি তন্ময়? 

খুব খুশিতে তন্ময় হাত বাড়িয়ে দিল। আপাতত আঙুল গোনার থেকে নিষ্কৃতি পেল ছেলেটা। মনে মনে ভাবেন অলকা। কি গুণে চলে সে অবিরাম? সেদিন দুপুরে তন্ময়ের মুখোমুখি সেই ঘরেই বসে লাঞ্চ সারলেন দুজনেই। তন্ময়ের চোখেমুখে বেশ পরিতৃপ্তির চিহ্ন দেখলেন অলকা। 

ভাবলেন, কোথা থেকে কি হয়ে যায়! এই ছেলের আজ কত আনন্দে থাকার কথা। কী  ই বা এমন বয়স তার। মেদিনীপুরের গ্রামের ছেলে। বাবা, মায়ের সঙ্গে বড় হয়ে পড়াশুনো করে মোটের ওপর কলকাতায় একটা ভালোই চাকরি জুটিয়েছিল।এই কদিনেই তাঁর বেশ মায়া পড়ে গেছে ছেলেটার ওপর। 

 

অলকা ভালোই বোঝেন যৌবনে পদার্পণ করা ছেলেপুলের মনস্তত্ত্ব। খুব সেন্সটিভ ইস্যু এসব পেশেন্ট কে ডিল করা। 

(২) 

এখানে ভর্তি হবার দিনেই তন্ময়ের বাবা দিয়ে গেছেন একটা ডায়েরি। সেটির ওপর অলকা কে নজর দিতে বলেছেন ডাক্তারবাবু। কাজের ফাঁকে সময় পেলেই অলকা চোখ রাখছেন ডায়েরির পাতায়। 


অলকার চোখের সামনে সেই ডায়েরী খানা খোলা । একের পর এক পাতা উলটে চলেন তিনি । স্তম্ভিত হয়ে যান আর ভাবেন জগতে এত সৃষ্টিশীল মানুষের মধ্যে এই ছেলেটিও তো নাম করতে পারত । কী অপূর্ব হাতের লেখা! কী অপূর্ব কবিতা লেখে । দু-এক লাইনের ফাঁকে ফাঁকে নীল পেন দিয়ে আবার ছোট্ট ছোট্ট ছবিও তার হাতের । অলকার ঘুম পালিয়ে গেল । 

কোথাও লেখা, 

আমি কেমন জানি ফুরিয়ে আসছি মা। কেন এমন হল আমার? 

এতো ডায়েরীর শেষের দিকের লেখা । এবার অলকা পাতা উল্টে সামনের দিকে আসেন।

 

একটা পাতায় লেখাঃ

উফ্‌ ! আর পারছিনা সহ্য করতে। মা, ওদের তুমি ঢুকতে দিওনা বাড়িতে । ওরা তুলসীগাছের কাছে দাঁড়িয়ে আছে এখনো । ওরা কী সংযুক্তা কে নিয়ে এল মা? 


আরেকটা পাতায় লেখাঃ

আমার মনে হচ্চে জ্বর এসেছে, এই দ্যাখো দ্যাখো আমার গায়ে হাত দিয়ে, হ্যাঁগো, আমি সত্যি বলছি । আলোটা নিভিয়ে দাও মা । সংযুক্তা এলে আমায় জানিও প্লিজ মা। আই বেগ অফ ইউ। 


অলকা আবারো পাতা উলটে চলেন । একটা পাতায় গিয়ে চোখ আটকে গেল তাঁর । 

বিশ্বাস করো তুমি, আমি মিথ্যে বলছিনা । তোমাকে সত্যি সত্যিই খুব ভালোবেসেছিলাম সংযুক্তা । আমাকে ভুল বুঝোনা। প্লিজ, সংযুক্তা প্লিজ। 


এতসব অসংলগ্ন টুকরো চিঠির ভীড়ে অলকার মাথায় একটাই কথা বারবার ঘুরছে তখন । ভাবতে লাগলেন তন্ময়ের এখানে আসার কারণ ।


আরও আগের কথা... 

পড়ে ফেলে নিজের মত করে ভাবতে বসলেন অলকা। 

তখন তার শেষের দিকের স্কুলবেলা । উচ্চমাধ্যমিকের বিজ্ঞান শাখা । যারপরনেই পড়ার চাপ । মধ্যবিত্ত পরিবারের একরত্তি শিবরাত্তিরের সলতে । তার ওপরেই যত আশা তার মা বাপের । ছেলেটাও খুব উজ্জ্বল । চোখে মুখে বুদ্ধিদীপ্ততার ছাপ । ক্লাসে ফার্স্ট সেকেন্ড না হোক ওপরের দিকেই আছে সে । কিন্তু আজকের বাজারে অমন ওপরের দিকে থেকেও কত স্বপ্ন হারিয়ে যায় । হতে চাইলেই হওয়া যায়না অনেক কিছু । তন্ময় মোটামুটি ঠিক করেই ফেলেছিল জেনারেল স্ট্রিমে কিছু একটা অনার্স নিয়ে ভর্তি হবে ভালো একটা । এখনো তো কোলকাতার কলেজের ছেলেরাও কলার তুলে ঘুরে বেড়ানোর ক্ষমতা রাখেরে বাবা ! বাবা তাকে টিউটরও দিয়েছিলেন প্রতিটি বিষয়ে । এজন্য বাবার কাছে খুব লজ্জিত । খেতে বসে এক একদিন বাবা পড়াশুনোর কথা জানতে চাইলে সে কেমন আড়ষ্ট হয়ে ওঠে । সে ভাবে, বাবা উদয় অস্ত পরিশ্রম করছেন । সারাটাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম সেরে বাবার মুখে একটু হাসি ফোটাতে পারলেই সে কৃতার্থ । কোন্‌দিন আবার বাবা ছেলের জন্য ধর্মতলার মোড় থেকে একটা ছাতা নিয়ে আসেন । কোনোদিন তাঁর হাতে থাকে ঘিয়ের পান্তুয়া । কোনোদিন আবার চারটে বড় বড় ইম্পোর্টেড আপেল নিয়ে ছেলের মা'কে বলেন টিফিন দিতে। বিজ্ঞান নিয়ে পড়ছে তন্ময়, প্র্যাকটিকাল করতে হয় দাঁড়িয়ে দাঁডিয়ে । এইভাবে চলতে থাকে তন্ময়ের  যুদ্ধ তার লক্ষ্য নিয়ে আর তার বাবার চাকরী সামাল দিতে দিতে ।

আজ ডাঃ সেনের ফোন এসেছিল অলকার কাছে। পেশেন্ট তন্ময়ের আপডেটস  জানতে। অলকা ডায়েরীর পাতার তন্ময়ের সঙ্গে সেদিনের তন্ময় কে মেলাতে চান । তন্ময়ের চোখে অদ্ভুত এক শূন্যতা। ঘোলাটে চাহনি। যেন পৃথিবী থেকে তার সব পাওয়া ফুরিয়ে গিয়েছে, আর কিছুই নেই বাকি। আজ অবধি তন্ময় একটি কথাও বলেনি। অলকা ডায়েরীর পাতা উল্টে আবার ফিরে যান  তার স্কুলের সেই দিনগুলিতে।

ডায়েরীর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে চোখে পড়ে... 

" যদি আমি কোনো কিছুতেই না পাই তবে আমার কি হবে? বাবা, মা আমার জন্যে এত চেষ্টা করে চলেছে ।

বন্ধুরা তো বলেই দিয়েছে একবার না পাই আবার বসব জয়েন্টে। 

সেবন্তী তো বলেই দিয়েছে কিছু না পেলে বাংলায় অনার্স পড়বে ।

কিন্তু আমি যদি সায়েন্স সাবজেক্টে ভালো ফল না করি তাহলে তো অনার্সও পড়তে পারব না "

পরের পাতাতে আবার বিষাদের লেশমাত্র নেই। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার টুকটাক। পকেটমানি বাঁচিয়ে আধখানা এগরোলের হিসেব দেখে হাসি পায় অলকার। 

যার অর্থ হল, বন্ধুদের আওতায় যখন থাকে তখন নিজেকে বেশ কম্পোজড লাগে তন্ময়ের। স্কুল টিউশান সেরে বাড়ি এলেই আবার কেমন যেন ছন্নছাড়া ভাবটা পেয়ে বসে । মাঝে মাঝে মনে হয় ছাদে বসে কবিতা লিখতে । ছুটির দিনে মনে হয় একটা ভালো ছবি আঁকতে । কিন্তু এই সিলেবাস আর দমবন্ধ করা চাপটা তাকে গ্রাস করে ক্রমশঃ । 

তন্ময় নিজেও জানেনা এর থেকে মুক্তি পাবে কি করে । উচ্চমাধ্যমিকের আর ঠিক দশ মাস বাকী । মাথার বাঁদিকটা দপদপ করে ওঠে।

এই টানাপোড়েনের মাঝে এক পশলা সুবাতাস দেয় নীপা। তার সমবয়সী । এবার কেঁপে ওঠেন অলকা। 

তার মেয়ের নামও নীপা। কোচিং ক্লাসে বন্ধুত্ব হয়েছিল তবে এই ছেলেটির সঙ্গেই । দুজনে একসঙ্গে বাসস্টপে হেঁটে যেত রোজ । একসঙ্গে এইটুকুনি হাঁটাতেই  কিছুক্ষণের ভালোলাগা জন্মাত তাদের পড়াশুনোর চাপের মাঝে । দমবন্ধ হওয়া থেকে নিস্তার। মিষ্টি মেয়েটাও খুব পছন্দ করে ফেলেছিল তন্ময় কে ।

এখন ভাবেন তিনি। ভালোলাগার মতোই ছেলে তন্ময়।  

একজায়গায় সে লিখেছে... 

" নীপা, তোর চেহারায় কি যে যেন একটা আছে, মনে হয় অনেকটা পথ হেঁটে যেতে পারি তোর সঙ্গে। তুই বুঝেও বুঝলি না।    

তুই না আমার না মেলা সব অংক মিলিয়ে দিতি? কোচিং ক্লাসের ফাঁকে, পথ হাঁটতে হাঁটতে। তুই তো খুব প্র্যাক্টিকাল ছিলি। তোর যেমন গভীরতা পড়াশুনোয় তেমনই চাহনিতে।

আচ্ছা, নীপা তুই আমাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসিস তো? ঠিক যেমন আমি বাসি তোকে?” 


শেষ লাইনে গিয়ে আটকে যান অলকা। তন্ময়ের লেখায় অনিশ্চয়তার সুর। 


শেষমেশ অলকা মিলিয়েছেন অংকটা । একমাত্র মেয়ের জীবনের সমীকরণ উল্টোপথে মেলাতে গেছেন। তিনি। আজ তিনি তন্ময়ের কাছে অপরাধী। কী করে আর দাঁড়াবেন এই ছেলেটার সামনে? নীপা কে তন্ময়ের কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়ার মূলে তো তিনিই । হাসপাতালের সেবিকা সিঙ্গল মাদার অলকার লড়াই আর কেই বা বুঝবে? 

তিনিই তো মেয়েকে বোঝাতে গিয়েছিলেন এসব। এখন কী তার ভালোবাসাবাসির সময়? আগে পড়াশুনো তারপর প্রেম। ঠিক যেমন অতি স্মার্ট সংযুক্তার বেলাতেও তন্ময়ের মা বলেছিল, "আগে গুছিয়ে নাও জীবনের চলার নুড়িপাথরগুলোকে। সবে তো চাকরীর শুরু। একবার সময় নষ্ট হয়ে গেলে আর ফিরে আসবেনা ।"  


কিন্তু এসব তো বুঝে হজম করে ফেলেছে তন্ময় ।  তবুও বুঝলনা তার মন।  এত এত মোটা মোটা ব‌ই, কঠিন পরীক্ষা পেরিয়ে সংযুক্তা বা নীপা কারোর সঙ্গেই  দুটো ভালোলাগার  মূহুর্ত্ত পাওয়া হলনা তার জীবনে। তন্ময় তো হারবার পাত্র নয় কোনোদিনো । একটা ছবি শুরু করলে শেষ না করে ও ভাত খেতনা ছুটির দিনে । একটা কবিতা শুরু করলে ঘুমোতে যেত না রাতে । তাই বুঝি পাকাপাকি একটা চাকরীও শুরু করেছিল কেরিয়ার গড়তে। 


অলকা হঠাৎ পড়তে পড়তে থেমে গেলেন । অনেকটা লেখা কলম দিয়ে খুব যত্ন করে কেটে দেওয়া হয়েছে। ঠিক কি লিখেছিল তন্ময়? বারেবারে প্রেম ভেঙে যাওয়ার জন্য হয়ত দায়ী করেছে কাউকে। কিম্বা লিখেছে, আমাকে আমার মত থাকতে দাও... 

অলকা সেরাতের মত তন্ময়ের ডায়েরীখানা মাথার শিয়রে রেখে ঘুমোতে চেষ্টা করলেন । ভোরে উঠে আবার তার মাথায় পাক খেতে লাগল সেই কথা । কি এমন লিখেছিল ছেলেটা যে কেটে দিতে হল! প্রশ্ন করলে সে আরো অস্বস্তিতে পড়তে পারে । এসব নিয়ে বেশী সন্দেহ, কৌতুহল প্রকাশ পেলে তার ভালোর চেয়ে মন্দ হবেনা । চিন্তার জটগুলো গ্রাস করে অলকা কে । কোথায় গেল স্মার্ট সংযুক্তা? আর কোথায়ই বা হারিয়ে গেল তাঁর ব্রাইট নীপা? মেয়েটাও চলে গেছে তার মায়ের কাছ থেকে। বহু দূরে। কোথায় পাবেন তিনি এখন সে নীপার ঠিকানা? তার সঙ্গে অলকার একটিবার কথা বলতে পারলে ভালো হত । কিন্তু কোথায় খুঁজবেন তিনি নীপা কে? নীপা তো নিজের জীবনকে নিজেই মুক্তি দিয়েছিল সেদিন। নিজের অদৃষ্ট কে ধিক্কার দিতে দিতে তন্ময়ের বিছানার দিকে এগিয়ে গেলেন অলকা । 

যুগশঙ্খ ( রবিবারের বৈঠক, ১ লা আগস্ট, ২০২১)