বসন্ত মানেই কৃষ্ণচূড়া , পলাশ, শিমূল ও অশোকের রেঙে ওঠা প্রকৃতি। বসন্ত মানেই সেই আগুণে মেতে ওঠা, দখিনা বাতাসের উড়নী গায়ে জড়িয়ে আবীরে মাখামাখি, বসন্ত মানেই মনের দোলা, ফাগুনের সকালে দোল খেলার পালা। আজ আমাদের দোল একটু ভিন্ন স্বাদের । একালের দোল আর সেকালের দোলে আকাশ্-পাতাল তফাত। আজ আমাদের দোলে পাড়ার কচি-কাঁচারা দোল খেলেনা,বরংএকটু ছুটির আমেজে দেরি কোরে ঘুম থেকে উঠে হোমওয়ার্ক করার প্রস্তুতি নে য়। কারন এখনকার দোলে সব স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা চলতে থাকে। তাই তাদের কোন উপায় থাকে না। ছোট বেলায় বাড়ীতে সত্যনারায়্ণ পূজো হতে দেখেছি। ভোর থেকেই পূজোর গোছগাছ, স্নান সেরে ফাঁকে ফাঁকে একেওকে আবীর দেয়া, গুরুজনদের পায়ে আবীর দেয়া ও গৃহদেবতার ছবিতে আবীর দিয়ে প্রণাম করা ..
কিন্ত কোথায় আজ আমাদের দোল? আমদের দোলে আজ ফুট্-কড়াই-মুড়কি-মঠ এর স্থান নেই; ছেলেরা বাজারে গিয়ে রঙীন মঠ কেনার বায়না করে না। বরং এগরোল, বার্গার বা পিত্জা চায়।
আজ আমাদের দোলে সান্ধ্য অধিবেশনে ফাগফাগুয়ার খেলা চলার পর সাদা পাথরের গ্লাসে সিদ্ধির সরবতের বদলে স্থান করে নিয়েছে সুদৃশ্য কাট্-গ্লাসের সুরাপাত্রের রেড্-ওয়াইন। আমাদের প্রজন্ম দোলের মাহাত্ম্য বোঝে কিনা জানিনা তবে বিশ্বায়নের আবীর গায়ে মেখে কেবল্ টিভি , মোবাইল ফোন্, আইপড্, এফ্-এম রেডিও এবং যন্ত্রজালে প্রচুর গবেষণা চালিয়ে যচ্ছে।
এখন আবীরের রং এর বিভিন্নতা ও প্লাস্টিক পিচকারির বৈচিত্র্য দেখে ছোটোবেলার জন্য মন কেমন করে কিন্ত আমাদের রং এ ছিল আরো উজ্জ্বলতা ও গন্ধে ছিল আরো মাদকতা।
আমরা ছোট ছোট নিউক্লিয়ার পরিবারের সদস্য, দোল উপভোগ করবই বা কার সংগে ? র্ংই বা দেব কার গায়ে? আমার গায়ে রং দেবে এমন সময়ই বা আছে কার্? র্ং খেলে সময় নষ্ট না করে কিশোররা এখন নেট সার্ফিং করে, "সোশাল নেটওয়ার্কিং" সাইটে ঢুকে র্ং খেলে, বন্ধুকে ই-গ্রিটিংস পাঠায় দোলের জন্য ; বা এস্-এম্-এস্-এ হোলির শুভেচ্ছা জানায়। আরো পাকা-পোক্তো হলে মাল্টিপ্লেকসে ঘুরে বেড়িয়ে চাড্ডি ফাস্ট ফুড খেয়ে দেয়ে দিব্যি করে বাড়ী ফেরে। দোল কেবলই ছুটির দিন একটা।
যেসব বাড়ীতে দোলের বৈঠকী বসে তারা অবশ্যই এর ব্যতিক্রম। সেখানে গানের আড্ডা বসে সকাল থেকে, যেখানে ব্রজগোপীদের র্ং খেলা থেকে শুরু করে গৌর আবির্ভাব্, পুরাতনী, রবীন্দ্র্নাথ্, নজরুল সকলকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়ে। আজ আমাদের দোলের আগের রাতে ন্যাড়া-পোড়া হাতে গোনা যায়। পর্যাপ্ত প্লাসটিক পূর্ণ পরিবেশে ন্যাড়া-পোড়া নিষিদ্ধ। বিদায়ী বসন্তের সাথে সাথে পুরানো আবর্জ্জনার দহন পরিবেশকে কিছুটা মুক্ত করে "মুছে যাক্ গ্লানি" , ঘুচে যাক্ মলিনতার সংগে নতুন বছরকে "এসো হে বৈশাখের" বার্তা শোনাতে পারত, কিন্ত আজকের দিনে ন্যাড়া-পোড়া আযোজন করবে কে? কোথায় বা আছে খোলা মাঠ?
এখনকার ট্রেন্ডি-টিনরা এসব নিয়ে মোটেই মাথা ঘামায়না। আমরা কত উন্নত ও যান্ত্রিক হয়েছি আজ। Motion-এর চাপে সব Emotion উবে গেছে কর্পূরের মত ।দোল প্রতি বছর পরিযায়ী পাখীর মত আসবে আবার চলেও যাবে। কিন্ত দোল খেলায় থাকবেনা মাতামাতি, রং খেলায় হবে না কোন চ চাঞ্চল্য । বরং পরিশীলিত এবং মার্জিত রূচিবোধের অভাবে রং খেলা হলে , হবে খুনোখুনি কিংবা রংএর বদলে রক্ত গঙ্গা বইবে। মোটর সাইকেলে ট্রিপল ক্যারি করে বন্ধুকে নিয়ে কানে আই-পড লাগিয়ে বিকট চিত্কার করে দোল খেলা চলবে বহুত রাত অবধি, কো-এড কলেজে আবীরের বদলে সিঁদুর চলবে, অথবা দোলখেলাকে কেন্দ্র করে বন্ধু-বন্ধুতে ঝগ্ড়া এমন পর্য্যায় চলে যাবে যা থেকে অয্থা প্রাণ হারাবে একটি বন্ধু অপর বন্ধুর গুলিতে। কত স্বামী-স্ত্রী তাদের বিবাহ-বিচ্ছেদের পরে স্মরণ করবে তাদের একটুকরো দোলের "একটুকু ছোঁয়া লাগে"র সুখস্মৃতি;
আজকের কালের আবর্তণে ঘুরন্ত পৃথিবীর ছুটন্ত মানুষের উত্তেজনা, উদ্দীপনা-বহুল দোল মানে হাতে বিয়ারের ক্যান কিংবা শপিংমলে কিছুক্ষণ !!!