আবার দেখতে দেখতে আমরা নতুন বছরের দোরগোড়ায়। নতুন বাড়ির হাউস ওয়ার্মিং পার্টির তোড়জোড় শুরু। সারা বছরের পুরনো খাতাপত্তর ঝেড়েঝুড়ে তাকে গুছিয়ে, সকলের বাড়িতেই এখন বসন্ত বিদায়ের তোড়জোড়। আবার গরমের বিকেলে গা ধুয়ে পরে নেব মলমল শাড়িখানা, বরষার সান্ড্যাক চটিজোড়া যত্ন করে রেখে দেব, ভাদ্রের রোদে পুরনো বালুচরি রোদ খাওয়াব, শীতের পশমিনা-বালাপোশ মথ বলের গন্ধে ভরপুর করবে। ফাগুনের আগুন নিভে যাবে দোলের সঙ্গে সঙ্গে আর তার সঙ্গেই চৈত্রসেলের চিত্কার! চৈত্রমাস পড়তে না পড়তেই পুরনো বছরটার পাততাড়ি গোটানোর ধান্ধা। নতুন বছর আসবে বলে ঘর ঝাড়াপোঁছা, সেই অছিলায় নতুন জামা, আনন্দে হইহই করে হ্যাং আউটের প্ল্যান, নবপঞ্জিকা, হালখাতা আর নতুন ক্যালেন্ডার। সেইসঙ্গে বাঙালির ঝালিয়ে নেওয়ার পালা সেই বং-কানেকশন। কী করে ভুলি আমরা? যতই ইংরেজি ছবি দেখি, ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে অনর্গল কথা বলি আর গোগ্রাসে কন্টিনেন্টাল খাবারদাবার গিলি না কেন, আদতে আমরা ঝোল-ঝাল-অম্বলের ভক্ত।
চৈত্রশেষে অকালবোশেখি পাওয়ার মতো বাঙালির আরও একটা বড় প্রাপ্তি হল পয়লা বৈশাখের অপ্রত্যাশিত নতুন জামাকাপড়, নিদেন একটা গানের সিডি অথবা একখানা বই। ঠিক তক্ষুণি মনে হয় ছোটবেলার কথা। মনে মনে আমাদের বয়স কিন্তু বাড়ে না। সেই পয়লা বৈশাখের দিন বাবার সঙ্গে দোকানের হালখাতার চিঠি নিয়ে, বরফকুচি দেওয়া কাচের গ্লাস ওপচোনো অরেঞ্জ স্কোয়াশ আর সঙ্গে বগলদাবা করে মিষ্টির বাক্স। ঠাকুমার জন্য বাড়ি নিয়ে যেতে হবে সোনার গয়নার দোকানে নতুন বাংলা ক্যালেন্ডার। দিদিমার জন্য বুকস্টল থেকে নতুন পঞ্জিকা, তা-ও নিতে হবে মনে করে। কমপক্ষে চারটি দোকানের মিষ্টির বাক্স একত্র জড়ো করে বাড়ি ফিরে বসবে আমাদের সান্ধ্য বৈঠকি। সঙ্গে গান তো হাতের পাঁচ। সবচেয়ে মজা লাগত মাছের বাজারেও হালখাতার মৌরসী পাট্টা দেখে। সে দিন মাছবাজার ধুয়েমুছে সাফ এক্কেবারে। মাছের আঁশটে গন্ধ কাটানোর জন্য ফিনাইল, ধূপ-ধুনো কত্ত সব কায়দা। আর মাছওয়ালাও ধবধবে পাজামা-পাঞ্জাবি চড়িয়ে বসেছেন জম্পেশ করে। আমি আছি বাবার হাত ধরে লেসের ফ্রিল দেওয়া, নতুন ছিটের নরম ফ্রকে। প্রথম বার গিয়ে ভেবেছিলাম সে বুঝি মাছ দেবে ফ্রি-তে। সে গুড়ে বালি! পয়লা নম্বর মিষ্টির বাক্স নিয়ে থরে থরে বসে আছে সে-ও!
পয়লা বোশেখের কথা মনে হলেই বেশি করে মনে পড়ছে হাতিবাগান বাজারের কথা। আমার কলেজবেলার পাঁচ-পাঁচটা বছরে এই হাতিবাগানের শাড়ির দোকানগুলো থেকে হইহই করে ভিড় মাথায় নিয়ে বন্ধুরা মিলে শাড়ি কিনতে যাওয়া, সে-ও এক দারুণ অভিজ্ঞতা। আর সেই সঙ্গে রূপবাণী-তে উত্তম-সুচিত্রার ছবি দেখে সিলভার ভ্যালির মুচমুচে কবিরাজি কাটলেট? ফড়িয়াপুকুরের টকি শো হাউসে তখন ভাল ভাল ইংরেজি ছবিগুলো আসত। বাবা নিয়ে যেতেন দেখাতে। টাওয়ারিং ইনফার্নো, টোয়েন্টি থাউসেন্ডস লিগস আন্ডার দ্য সি, টেন কমান্ডমেন্টস, বেনহার— কত ছবি না দেখা হয়েছে ওই হলে। আর ফেরার পথে ফড়েপুকুরের সেই অমৃতর পয়োধি?
আর মনে পড়ে স্টার থিয়েটারের কথা। সে বার কলেজ থেকে ফেরার পথে সুপ্রিয়াদেবীর "বালুচরী" নাটকের টিকিট কেটে নিয়ে এলাম বাড়ির সকলের জন্য। পর দিন পয়লা বৈশাখে সকলে মিলে নাটক দেখে বাড়ি আসা হল। কি দারুণ নাটক! যেমন কাহিনি তেমনই অভিনয়। ফিনিক্স পাখীর মতো আগুনে ভস্মীভূত হয়ে আবার সেই ছাই থেকে উঠে এসেছে স্টার। স্টার থিয়েটারের সিনেমায় উত্তরণ হয়েছে। ভাবলেও নস্ট্যালজিয়ায় সেই নাটক শুরু হওয়ার মিউজিকাল সোনাটা কানে বাজে।
হেদুয়ায় কলেজ গেটের পাশে রোজ সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা অবধি দাঁড়িয়ে থাকত মতিদা। এ পাড়ার বিখ্যাত ফুচকাওয়ালা। তার ফুচকা যেমন বড় বড়, গোল্লা গোল্লা ও মুচমুচে আর তেমনই সুস্বাদু তার যাবতীয় অনুপান। একদম ঠিকঠাক টক, ঝাল ও নুনের কম্বিনেশন। আমাদের অনেক গবেষণা হত সেই তেঁতুল জলের রসায়ন নিয়ে। বাড়িতে অনেক বকুনিও খেতাম রোজ রোজ ফুচকা খাওয়া নিয়ে। কিন্তু মতিদা মানুষটা আর তার ফুচকার টানকে কিছুতেই এড়াতে পারতাম না। মতিদার ছিল একটাই স্লোগান, "ইয়ে ফুচকা খাইয়ো তো মতিদাকা গুণ গাইও", "আমার ফুচকায় অসুখ করবে না। কলেজের ফিল্টারের জলে তৈরি এই তেঁতুলজল।"
আমার দিদি তখন পড়ত অন্য কলেজে। দিদিকে বলতাম "এক দিন তোকে মতিদার ফুচকা খাওয়াব।" তা সে আর হয়ে উঠত না। সে বার পয়লা বোশেখের ঠিক আগে মা নতুন জামাকাপড় কেনার টাকা দিলেন। আমরা দু'বোনে হাতিবাগান থেকে জামাকাপড় কিনে একটা চায়ের দোকানে এসে চা-জলখাবারের অর্ডার দিয়ে দেখি, পার্সের সব টাকা শেষ। মাত্র একটা কয়েন পড়ে আছে। এই হল পয়লা বৈশাখের হাতিবাগান! যেখানে অজস্র জিনিস আর তার হাতছনিকে উপেক্ষা করা যায় না। এ দিকে প্রচন্ড খিদে পেয়েছে আর বাড়িও ফিরতে হবে। হাঁটা লাগালাম কলেজের দিকে। বাসে উঠব যে সে পয়সাও নেই। হাঁটতে হাঁটতে দুজনে পৌঁছলাম কলেজ অবধি। সেখানে মতিদা তখনও দাঁড়িয়ে। দিদিকে দেখামাত্রই মতিদা যথারীতি তার স্লোগান আওড়াল, "ইয়ে ফুচকা খাইয়ো তো..."
দিদিকে কথা দিয়েছিলাম এক দিন ফুচকা খাওয়াব। মতিদা শালপাতা ভাঁজ করে এগিয়ে দিল আমাদের সামনে। আমি বললাম, "না, মানে একটা কথা ছিল মতিদা।" মতিদা বলল, "খাও খাও, কিচ্ছু হবে না।" বললাম, "না না, সে কথা নয়।" মতিদা বলল, "মা বকবে?” বললাম, "না না, পয়সা ফুরিয়ে গেছে যে।" মতিদা বলল, "কাল দিও, আগে তো খাও।" আমি বললাম, "বাড়ি ফেরার পয়সাও নেই।" মতিদা বলল, "আমি দিচ্ছি, কাল দিও।" আমরা পেট পুরে ফুচকা খেলাম। এত ভাল বোধ হয় আগেও লাগেনি কখনও। আরও যেন বড়বড়, গোল্লা গোল্লা, মুচমুচে ফুচকা! আরও পার্ফেক্ট টক-ঝাল-নুনের কম্বিনেশন!
এই পয়লা বোশেখ এলেই আমার মতিদার কথাও ভীষণ মনে পড়ে!
আনন্দবাজার পত্রিকা, ইন্টারনেট এডিশান ১৫ই এপ্রিল, ২০১৪
চৈত্রশেষে অকালবোশেখি পাওয়ার মতো বাঙালির আরও একটা বড় প্রাপ্তি হল পয়লা বৈশাখের অপ্রত্যাশিত নতুন জামাকাপড়, নিদেন একটা গানের সিডি অথবা একখানা বই। ঠিক তক্ষুণি মনে হয় ছোটবেলার কথা। মনে মনে আমাদের বয়স কিন্তু বাড়ে না। সেই পয়লা বৈশাখের দিন বাবার সঙ্গে দোকানের হালখাতার চিঠি নিয়ে, বরফকুচি দেওয়া কাচের গ্লাস ওপচোনো অরেঞ্জ স্কোয়াশ আর সঙ্গে বগলদাবা করে মিষ্টির বাক্স। ঠাকুমার জন্য বাড়ি নিয়ে যেতে হবে সোনার গয়নার দোকানে নতুন বাংলা ক্যালেন্ডার। দিদিমার জন্য বুকস্টল থেকে নতুন পঞ্জিকা, তা-ও নিতে হবে মনে করে। কমপক্ষে চারটি দোকানের মিষ্টির বাক্স একত্র জড়ো করে বাড়ি ফিরে বসবে আমাদের সান্ধ্য বৈঠকি। সঙ্গে গান তো হাতের পাঁচ। সবচেয়ে মজা লাগত মাছের বাজারেও হালখাতার মৌরসী পাট্টা দেখে। সে দিন মাছবাজার ধুয়েমুছে সাফ এক্কেবারে। মাছের আঁশটে গন্ধ কাটানোর জন্য ফিনাইল, ধূপ-ধুনো কত্ত সব কায়দা। আর মাছওয়ালাও ধবধবে পাজামা-পাঞ্জাবি চড়িয়ে বসেছেন জম্পেশ করে। আমি আছি বাবার হাত ধরে লেসের ফ্রিল দেওয়া, নতুন ছিটের নরম ফ্রকে। প্রথম বার গিয়ে ভেবেছিলাম সে বুঝি মাছ দেবে ফ্রি-তে। সে গুড়ে বালি! পয়লা নম্বর মিষ্টির বাক্স নিয়ে থরে থরে বসে আছে সে-ও!
পয়লা বোশেখের কথা মনে হলেই বেশি করে মনে পড়ছে হাতিবাগান বাজারের কথা। আমার কলেজবেলার পাঁচ-পাঁচটা বছরে এই হাতিবাগানের শাড়ির দোকানগুলো থেকে হইহই করে ভিড় মাথায় নিয়ে বন্ধুরা মিলে শাড়ি কিনতে যাওয়া, সে-ও এক দারুণ অভিজ্ঞতা। আর সেই সঙ্গে রূপবাণী-তে উত্তম-সুচিত্রার ছবি দেখে সিলভার ভ্যালির মুচমুচে কবিরাজি কাটলেট? ফড়িয়াপুকুরের টকি শো হাউসে তখন ভাল ভাল ইংরেজি ছবিগুলো আসত। বাবা নিয়ে যেতেন দেখাতে। টাওয়ারিং ইনফার্নো, টোয়েন্টি থাউসেন্ডস লিগস আন্ডার দ্য সি, টেন কমান্ডমেন্টস, বেনহার— কত ছবি না দেখা হয়েছে ওই হলে। আর ফেরার পথে ফড়েপুকুরের সেই অমৃতর পয়োধি?
আর মনে পড়ে স্টার থিয়েটারের কথা। সে বার কলেজ থেকে ফেরার পথে সুপ্রিয়াদেবীর "বালুচরী" নাটকের টিকিট কেটে নিয়ে এলাম বাড়ির সকলের জন্য। পর দিন পয়লা বৈশাখে সকলে মিলে নাটক দেখে বাড়ি আসা হল। কি দারুণ নাটক! যেমন কাহিনি তেমনই অভিনয়। ফিনিক্স পাখীর মতো আগুনে ভস্মীভূত হয়ে আবার সেই ছাই থেকে উঠে এসেছে স্টার। স্টার থিয়েটারের সিনেমায় উত্তরণ হয়েছে। ভাবলেও নস্ট্যালজিয়ায় সেই নাটক শুরু হওয়ার মিউজিকাল সোনাটা কানে বাজে।
হেদুয়ায় কলেজ গেটের পাশে রোজ সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা অবধি দাঁড়িয়ে থাকত মতিদা। এ পাড়ার বিখ্যাত ফুচকাওয়ালা। তার ফুচকা যেমন বড় বড়, গোল্লা গোল্লা ও মুচমুচে আর তেমনই সুস্বাদু তার যাবতীয় অনুপান। একদম ঠিকঠাক টক, ঝাল ও নুনের কম্বিনেশন। আমাদের অনেক গবেষণা হত সেই তেঁতুল জলের রসায়ন নিয়ে। বাড়িতে অনেক বকুনিও খেতাম রোজ রোজ ফুচকা খাওয়া নিয়ে। কিন্তু মতিদা মানুষটা আর তার ফুচকার টানকে কিছুতেই এড়াতে পারতাম না। মতিদার ছিল একটাই স্লোগান, "ইয়ে ফুচকা খাইয়ো তো মতিদাকা গুণ গাইও", "আমার ফুচকায় অসুখ করবে না। কলেজের ফিল্টারের জলে তৈরি এই তেঁতুলজল।"
আমার দিদি তখন পড়ত অন্য কলেজে। দিদিকে বলতাম "এক দিন তোকে মতিদার ফুচকা খাওয়াব।" তা সে আর হয়ে উঠত না। সে বার পয়লা বোশেখের ঠিক আগে মা নতুন জামাকাপড় কেনার টাকা দিলেন। আমরা দু'বোনে হাতিবাগান থেকে জামাকাপড় কিনে একটা চায়ের দোকানে এসে চা-জলখাবারের অর্ডার দিয়ে দেখি, পার্সের সব টাকা শেষ। মাত্র একটা কয়েন পড়ে আছে। এই হল পয়লা বৈশাখের হাতিবাগান! যেখানে অজস্র জিনিস আর তার হাতছনিকে উপেক্ষা করা যায় না। এ দিকে প্রচন্ড খিদে পেয়েছে আর বাড়িও ফিরতে হবে। হাঁটা লাগালাম কলেজের দিকে। বাসে উঠব যে সে পয়সাও নেই। হাঁটতে হাঁটতে দুজনে পৌঁছলাম কলেজ অবধি। সেখানে মতিদা তখনও দাঁড়িয়ে। দিদিকে দেখামাত্রই মতিদা যথারীতি তার স্লোগান আওড়াল, "ইয়ে ফুচকা খাইয়ো তো..."
দিদিকে কথা দিয়েছিলাম এক দিন ফুচকা খাওয়াব। মতিদা শালপাতা ভাঁজ করে এগিয়ে দিল আমাদের সামনে। আমি বললাম, "না, মানে একটা কথা ছিল মতিদা।" মতিদা বলল, "খাও খাও, কিচ্ছু হবে না।" বললাম, "না না, সে কথা নয়।" মতিদা বলল, "মা বকবে?” বললাম, "না না, পয়সা ফুরিয়ে গেছে যে।" মতিদা বলল, "কাল দিও, আগে তো খাও।" আমি বললাম, "বাড়ি ফেরার পয়সাও নেই।" মতিদা বলল, "আমি দিচ্ছি, কাল দিও।" আমরা পেট পুরে ফুচকা খেলাম। এত ভাল বোধ হয় আগেও লাগেনি কখনও। আরও যেন বড়বড়, গোল্লা গোল্লা, মুচমুচে ফুচকা! আরও পার্ফেক্ট টক-ঝাল-নুনের কম্বিনেশন!
এই পয়লা বোশেখ এলেই আমার মতিদার কথাও ভীষণ মনে পড়ে!
আনন্দবাজার পত্রিকা, ইন্টারনেট এডিশান ১৫ই এপ্রিল, ২০১৪