৩১ মার্চ, ২০২০

করোনা কথা

খুব ক্লান্তি রয়েছে। অ-সুখ এমন অবস্থাকেও বলে বুঝি। আক্ষরিক অর্থে ব্যাধি নেই তবে আধি আছে যা ব্যাধির চেয়েও মারাত্মক। সংবাদের স্রোত নজরে আসতেই দুপুরের সোহাগী বিশ্রাম আপাত নিদ্রা কেড়ে নিচ্ছে। রাতে তাড়াতাড়ি বিছানায় গেলেও তন্দ্রা ও নিদ্রার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে হাত-পা আপাত জিরেন নিচ্ছে বটে কিন্তু স্বপ্নের ভেলায় ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে দোদুল্যমান জীবনের অজানা ঘূর্ণিপাকে। 
কাল বহুক্ষণ ছিলাম এমনি এক স্বপ্নের ঘোরে। মামারবাড়ির পুরনো রান্নার মাসী অরুণা দিকে দেখলাম স্বপ্নে। বাল্যবিধবা তিন ছেলে নিয়ে ইঞ্চিপাড় সাদা থান পরে থাকতেন। কথায় পূর্ববাংলার টান। কপালে চন্দনের ফোঁটা। ছোট্টখাট্টো লক্ষ্মীমন্ত মানুষটি সবার আবদার, ওজর আপত্তি মানিয়ে নিত দিনের পর দিন। বাংলার তথা সারা দেশের গিন্নীদের‌ও বলিহারি যাই বাপু! নিজেরা নড়ে বসতে পারেনা। কাজের লোকেদের কি ফরমায়েশের ঘটা। অরুণা দি সব হুকুম মুখ বুঁজে তামিল করবে। সেই অরুণাদি যখন দেশে যাবে তখন দিদিমার মেজাজ সপ্তমে। ওড়িয়া ঠাকুর এনে রান্না শিখিয়ে চারবেলার রান্না হবে।  কারণ অরুণা দি একবার দেশে গেলে কমপক্ষে মাসখানেক। দিদিমার এমন দুরবস্থা দেখে আমার মায়ের ধনুকভাঙ্গা পণ।  জীবনেও রান্নার লোক রাখেনি তাই । খুব মনের জোর আর রাঁধবার অভ্যেসের কারণে বুক বাঁধতে দেখেছি মা'কে। সেই মা কে বরং আমি বলে বলে মা ৬৫ পেরুতেই রাঁধুনি রাখতে বাধ্য করেছি মায়ের শারীরিক কারণে। 
তা যা বলছিলাম । গতকাল রাতে অরুণা দি ছাড়াও দেখা হল মালকোঁচা দিয়ে ধুতি পরা মামার বাড়ির ঠাকুর গোলক কে। আমার শ্বশুরবাড়ির রান্নার মাসী পারুল কে। আমার বিয়েতে গায়েহলুদের তত্ত্ব নিয়ে গেছিল সে। পারুলের ব্রেস্ট অপারেশন, চোখের ছানি কাটানো সব করিয়ে সে বুড়ো হতে তাকে বাড়ি চলে যেতে বলা হল। টুকটাক ভুল করত বুড়িটা। বেদম বকুনিও জুটত কপালে। তারপর এসেছে জ্যোত্স্না, জবার মা, পুতুল, উত্তরা, চন্দনা এমন কত কত মেয়ে। 
এখন রোজ নিজে কেটে, বেটে রান্না করছি বলেই এদের সবার মুখগুলো খুব মনে পড়ছিল খুব। একে একে আসছিল স্মৃতির সরণী বেয়ে, পরত খুলে খুলে। মনোবিদ্যায় একে বলে "ল অফ এসোসিয়েশন"। এর কারণেই স্বপ্নে  দেখলাম সবকটা পরিচিত মুখকে অনেকদিন পর। করোনা না এলে এ জীবনে আর বুঝি তাদের কথা মনেও পড়ত না আমার। রান্নাঘরের জাহাজভাঙা হাতল ছাড়া তয়ীতে একটু ময়লা থাকলে দুই মা কি চীত্কার করতেন! গ্যাস বাড়িয়ে ভাজা বসালেই গিয়ে টুক করে গ্যাসটা সিম করে দিতেন। তরকারী কাটাকুটি করার সময় ভুল এদের হতেই পারে। তায় আবার অপুষ্টির কারণে স্মৃতির ঘাটতি আশ্চর্যের কিছুই নয়। একেক বাড়িতে একেক রকমের রান্না। সেই নিয়ে সব একহাত নিতেন। রোজ রোজ সকালবেলায় এই কাটা আর বাটা নিয়ে নিত্যি কথা কাটাকাটি দেখেছি। কতবার বলেছি ঝোলের আলু আর চচ্চড়ির আলু এক নয়। বেগুণভাজা ফালাফালা আর তরকারিতে ডুমোডুমো। সর্ষেটা একবাটা কোরো কিন্তু নয়ত ঝালের সোয়াদ হবেনা। কিম্বা ভাতটা আজো গলিয়ে ফেলেছ? এত দামী জুঁইফুলের মত চাল! আজ খাওয়াটাই মাটি! কিম্বা আজ আবার দুধ উথলে গেল? খেয়াল রাখতে পারোনা? জানো কত দাম এই দুধের? রুটিগুলো কাল বড্ড মোটা মোটা হয়েছিল। হ্যাঁগো! কাল রাত্তিরের তারকারিটার কি তলা লেগে গেছিল? পোড়া গন্ধ পেলুম যে। মনে রাখতে পারোনা? নাহ! সত্যি পারেনা এরা।  
মা, শাশুড়িদের প্রথম দিকে বোঝাতে চেষ্টা করেছি বহুবার কিন্তু ভবি ভোলার নয়। তবে সংসারের হাল ধরতে গিয়ে আমি কিন্তু নিজের অগোচরে নিজেও তাঁদের মত এমন ভয়ানক গিন্নী হয়ে উঠেছি যে সেই লেগাসি বহন না করলে যেন বাড়ির যোগ্য গৃহিণী হওয়া যায় না। গত কয়েকদিন নিজে একাহাতে রান্না করতে করতে, তয়ী ধুতে ধুতে এসব মনে হচ্ছিল কেবলই। তাই বুঝি স্বপ্ন দেখেছি। 

২৮ মার্চ, ২০২০

করোনা পেয়িং ডিভিডেন্ড

(১) 
আলমবাজারে আমার বাবা মা দুদিন ধরে দুধ পাচ্ছিলেন না দেখে ফেসবুকে পোস্ট করতেই বান্ধবী অদিতি সেন চট্টোপাধ্যায় ফোন করে ব্যাবস্থা করতে গেলেন। ওদিকে আমার মা ততক্ষণে রিষড়ায় মাসীর ছেলেকে বলে রেখেছিল ওদিকে এলে দুধ ব্রেড নিয়ে আসতে কারণ রিষঢ়া পুরসভার কাউন্সিলর মাসীর পুত্রবধূ। এবার গতকাল প্রচুর দুধ এধার ওধার থেকে এসে পড়ায় আমার মা নিজেই এখন মাদার ডেয়ারী। অদিতি কে বারণ করলাম এত দূর থেকে লোক পাঠাতে। এবার যেটা হল তা আরো আনন্দের এবং প্রশংসার ও বটে। অদিতিকে মায়ের বাড়ির ঠিকানা ও মোবাইল দিয়েছিলাম। গতকাল থেকে বরানগর মিউনিসিপালিটির কাউন্সিলর নিজে ফোন করছেন। মাসীমা কিছু লাগবে এই বলে। আজ নিজে এসেছিলেন বাড়িতে। বলে গেলেন প্রয়োজন হলে জানাতে। চীন, ইউরোপ, আমেরিকা এমনকি ভারতেও এমন পরিষেবা কে কে পেলেন বা পাচ্ছেন জানান। করোনার যুগে আবিষ্কার করছি এই দেশে জন্মানোর মাহাত্ম্য।
(২) 
প্রচুর পরিশ্রমের ফলে দেহের অবাঞ্ছিত, অনাকাঙ্ক্ষিত মধ্যপ্রদেশের স্ফীতি বুঝি একটু ন্যায়দম খাচ্ছে।মেপে খাওয়াদাওয়া আর সেই সঙ্গে পরিশ্রম দুয়ে মিলে বেশ চাপে রেখেছে তাকে।
(৩) 
অনেকদিন বাদে বেশ ঝালিয়ে নেওয়া হচ্ছে মা, দিদা, ঠাম্মার কেজো সব রান্না। কাজের লোকেদের হাতে সেসব রান্না বলে করিয়ে নেওয়া যায় না কারণ (১) তখন ফ্রিজে এত আমিষ মজুদ থাকে আর (২) নিজের মাথাতেও আসেনা সেসব
(৪) 
ঈশ্বরকে শুধাই মনে মনে, এভাবেই তবে ঘরবন্দী করে তুমি শেষমেশ দুনিয়ার সব উগ্রপন্থী, নরখাদক, ধর্ষক, জঙ্গি, খুনী, চোরডাকাত, ছিনতাইবাজ সব দুষ্টুদের শান্ত করার উপায় বের করলে? ইন্ডিয়ার ক্রাইম রিসার্চ ব্যুরো অনুযায়ী অপরাধের মাত্রা এখন মাত্র ৭%। রেপ ভিক্টিম রিপোর্ট নেই !তাই বুঝি উপলব্ধি হয় ঈশ্বরই শাশ্বত এবং চরম সত্য।মানুষ যখন অপারগ তখন উত্তরোত্তর বেড়ে যাওয়া এই ক্রাইম রেটের লেখচিত্র কে তিনিই নিজের হাতে নিম্নমুখী করলেন। এর নাম ধর্মের কল বাতাসে নড়ে ওঠা। নাকি এভাবেই সমাজকে বাঁচানোর জন্য তিনি নিজেই গোকুলে বাড়াচ্ছিলেন এই মারণ ভাইরাসটিকে?
(৫) 
নাস্তিকেরা বিপদে পড়লে আমার মত আস্তিককে বলে তোমার ঠাকুরকে বোলো আমার কথা।
(৬)  
আমাদের বাড়িতে একটা কথা আছে "ঢেউচালানি" বলে মানে যারা আরকি সবসময়ই উঠল বাই তো কটক যাই টাইপ, ঘরে মন বসেনা মোটেও। সেই দলে মাঝেমাঝে আমিও পড়ি আর এখন শুধু ঠাম্মার কথা ভাবছি, মেয়েরা ঘরমুখো হলে সংসারের অনেক কাজ হয়, একথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে কিন্তু। ঘরের কোণে কোথায় ঝুল, বাগানে শুকনো গাছের ডালপালা, ফ্রিজটা অফ করে পরিষ্কার, রান্নাঘরের আনাচকানাচ, বাসনের র‍্যাক, মশলাপাতির শিশি ধোয়ামোছা, একটা করে বইয়ের তাক গোছানো, অবিন্যস্ত আলমারি গুলোর দিকে নজর দেওয়া, বাড়ির সব আয়নাগুলো একদিনে খবরের কাগজ ভিজিয়ে মুছে নেওয়া আর সেই সঙ্গে এখন সদর দরজা আর কলিংবেলে কলিন দিয়ে পরিষ্কার করা..... মানে বাড়িটাকে এই ফাঁকে একটু গুছিয়ে নেওয়া। সবকিছুর একটা ভালো দিক আছে কিন্তু।
(৭) 
এদ্দিন স্বার্থপর মানুষ শুধু দারা-পুত্র-পরিবারের অসুখে প্রার্থনা করত।এখন অপারগ হয়ে সারা বিশ্ববাসীর জন্য ভাবছে।মশাই এর নাম learning process!


(৮) 
প্রকৃতির দূষণ নিম্নমুখী। মানুষ হল পরিবেশের সবচেয়ে বড় শত্রু। তাই অবলা, সর্বংসহা পৃথিবী আজ মানুষ নামক জীব কে গৃহপালিত করে ঘর বন্দী করেই ফেলেছে। গাড়িঘোড়া না চলায় পরিবেশের দূষণ, ধুলো, ধোঁয়া থেকে মুক্তি। প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছাচারে বিরতি। জঙ্গলের অরণ্যমেধ যজ্ঞ থেকে যত্রতত্র প্ল্যাস্টিক পতন ইত্যাদির মত বিষয় গুলো বেশ ভালো দিক।
(৯) 
সব অনলাইন খাবার সরবরাহকারীরা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঘরে বানানো খাবারেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে সারা বিশ্ববাসীকে। শরীরের আপাত ধৌতিকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত। সবাই স্বাস্থ্য সম্মত খাবার খাচ্ছে।পরিমাণে কম খাচ্ছে কাজেই জাঙ্ক ফুডের, ট্রান্স ফ্যাটের রমরমা আপাতত শিকেয় তোলা।
(১০) 
ঘরে বসে, গৃহবন্দী হয়ে মধ্যবয়সী হোমমেকারদের শারীরিক ব্যাথা বেদনা, আর্থ্রাইটিস, গাউট, গেঁটে বাত, কোমরে ব্যাথা, গোড়ালি ব্যাথা, সাইনাস, মাইগ্রেন অনেকটাই কম এ যাবত। তবে ইনসমনিয়া গ্রাস করছে যেটা আমাকেও বেশ কষ্ট দিচ্ছে। ঘুমের ওষুধ খাচ্ছি। রাতে কোকো / ড্রিংকিং চকোলেট দিয়ে দিয়ে এক গ্লাস গরম দুধ আর বিকেলের দিকে চা কফি আর না খেলে ইনসম্নিয়ার উপশম হয় কিন্তু। তবে মনে পড়ছে আমাদের এক দুঁধে অভিজ্ঞ হাউজ ফিজিশিয়ানের কথা। মা, দিদিমারা বাড়িতে দেখতে এলে হাজার একটা রোগের কথা বলে ওষুধ দিতে বলতেন।ওপরে উল্লিখিত কোনো না কোনো ছোটোখাটো উপসর্গের কথা বলতেন তাঁরা। সেইসঙ্গে ছিল গায়ে হাতে পায়ে জ্বালা অথবা সামান্য চুলকুনি। সেই প্রাজ্ঞ ডাক্তারবাবু মুচকি হেসে বলতেন, এগুলি "হাউজওয়াইফস কমন সিনড্রোম" বলে গড়গড় করে একটা মাল্টিভিটামিন লিখে দিতেন। হোমিওপ্যাথির ডাক্তার দিতেন বিনা ওষুধের চিনির গুলি। এখনকার ডাক্তারবাবুরা বলেন প্রাণায়াম করতে। কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে, সেলাইফোঁড়াই করতে, রান্না করতে, ব‌ই পড়তে, গান করতে, বাগান করতে, কবিতা লিখতে। তবেই নাকি মধ্য থেকে প্রৌঢ় হাউজ ওয়াইফরা এই প্রবলেম গুলি থেকে অনায়াসে মুক্তি পাবেন। এসবের কোনো দাওয়াই নেই। প্ল্যাসিবো এফেক্টের কারণে সাদা চিনির গুলিতেও এমন হত আগেকার দিনে। সবটাই ছিল মনের ব্যাপার। আমার একমাস ধরে খুব কষ্ট হচ্ছিল সাইনাসের। সেই সঙ্গে কোমরে ছিল বেদম ফিক ব্যাথা। বলতে নেই, এখন সব গায়েব!!! করোনা পেয়িং ডিভিডেন্ড!  

২৭ মার্চ, ২০২০

করোনা ডায়েরী

 
দুপুরে একটু তন্দ্রা আসছে আজকাল। কায়িক পরিশ্রম বোধহয় এর কারণ। অথচ রাতে ঘুম আসছেনা। খুব ভোরে অ্যালারম ছাড়াই ঘুম ভেঙে যেতেই মনে হচ্ছে একটা বিস্তারিত স্বপ্নের ঘোরে ছিলাম। সন্ধের অন্ধকার ঘনিয়ে এলেই মনে হচ্ছে আবার কি দুঃসংবাদ আসবে।  ছাদে বা বারান্দায় একটু চৈতি হাওয়া গায়ে মাখলেই মনে হচ্ছে ঠান্ডা অনুভূতি। জ্বর এল নাকি? কিম্বা কপালের রগদুটো কনকন করে উঠল কি? ভাবতে না ভাবতেই বাড়ির কেউ হয়ত হেঁচে ফেললেন। ৮৩ বছরের শাশুড়িমা দুবার কেশে উঠলেই শিরদাঁড়ায় কিসের যেন চোরাস্রোত ওঠানামা করে উঠছে। ভোরে উঠে এখনো দেখছি চরাচর জুড়ে গোলাপী কুয়াশা মাখা হিমেল আবহাওয়া। এমন হয় কি প্রতিবারের চৈত্রশেষে? তার মধ্যেও ছাদের আলসের ধারে বসন্তের অন্তিম নিঃশ্বাস মেখে ভুঁইচাঁপা তার উদ্ধত স্টক ফুঁড়ে মাটি ঠেলে বেরিয়ে এসে বলে ওঠে, আমায় দেখো একটু। কত রঙীন তার দেহ মন। ঠিক আসমুদ্রহিমাচল জুড়ে আমাদেরো সবার যেমন ছিল। ফুলেল রক্তকরবী কে দেখে মনে হল তার সেই আত্মপ্রত্যয়েও যেন এবার কিছুটা হলেও ঘাটতি এবারের চৈত্রে। বসন্তের ফুল তুলে মালা গাঁথব বলেই না আমারা অনেকেই কোথাও না কোথাও পৌঁছে গেছিলাম হাজিরা দিতে। কেউ মিটিং এ, কেউ মিছিলে, কেউ সামাজিক দায়বদ্ধতায়। সেই সব তারিখগুলো মাথার ওপর এখন খাঁড়া হয়ে ঝুলছে। কেউ জানিনা। এতদিনে বুঝলাম মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা কি জিনিষ! সেদিন চৈত্রমাস! করোনার চোখে দেখব হয়ত আবারো আমাদের সর্বোনাশ! এবার চৈত্রে চড়কের ঢাকে কাঠি পড়ল না। বাবা তারকনাথের চরণে সেবা লাগে বলে চীৎকার করে সেই মাধুকরীর সিধে নিতে ওরা কেউ এল না এবার কেউ বাড়ি বয়ে। এবার আমাদের চৈত্র সেল নেই। ফুটপাথে হকারদের রমরমা নেই। আমাদের এখন উইকেন্ডের জন্য মনকেমন নেই। শুক্রবারের বিকেল থেকেই রবিবারের বায়নাক্কা নেই। কোনও প্ল্যান নেই আমাদের কারোর। ভোরে উঠলেই কাজের সহকারীর আমার বাড়িতে আসার কোনও অনিশ্চয়তা নেই। তার জন্য অপেক্ষাও নেই আমাদের। কি রান্না হবে তা নিয়ে বাজারের তাড়া নেই। অফিসের জন্য টিফিন নেই। তারমধ্যেও ছাদ বাগানের ফুল গাছেদের জল দিয়ে, ঘরের পোষ্যদের খাবারের ভাবনা আছে। নিজেদের সংসারের মাসকাবারির ফর্দ নেই। গল্প লেখার রসদ নেই। পঞ্চব্যঞ্জন ছেড়ে শুধু দিনগতে করোনা পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে করতে কোনোরকমে গ্রাসাচ্ছদনের উপায় বের করা আছে। কোথায় সবজীর খোসা ফ্রিজে জমিয়ে ডালের সঙ্গে ভাজা খাওয়ার বিলাসিতা আছে। ভাতের ফ্যানের স্যুপ কে নতুন মোড়কে আবিষ্কার করার নতুন ভাবনা আছে। আলুভাতের চমকদার রেসিপি ইনোভেশনের কৃতিত্ব আছে। গেরস্থ আলু পেঁয়াজ হিসেব করে খরচ করেনি এতদিন। এখন যেন মঙ্গলগ্রহের কল্পবিজ্ঞানের গল্পের মত খাবারের হিসেব নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। কটা আলু, কটা পিঁয়াজ রোজ রান্না হলে কতদিন যাবে । নতুন করে ঐকিক নিয়ম মাথা খাটিয়ে বের করছে সুগৃহিণী। যেন অর্ধভক্ষ ধনুর্গুণঃ। কিছু না পেলে আটা গুলে গোলা রুটিই খাব আমরা অথবা মাড়ভাতের স্যুপ । একটু সরষের তেল, কাঁচা লঙ্কা আর নুন ছড়িয়ে। খিদের মুখে তাই অমৃত হবে।
চৈতালী হাওয়া গায়ে মেখে ছাদে দাঁড়িয়ে দেখি ছাদ বাগান থৈ থৈ বাসন্তী ফুলে। আমার মনের অগোচরে। আজ বসন্তে আমার ফুল গাঁথার সময় নেই। তবুও ওরা সব ছাদ আলো করে দোল খাচ্ছে। কত আনন্দে, রঙীন হয়ে ফুটে রয়েছে। একে একে জড়াজড়ি করে, হাত ধরাধরি করে। আমার মনের খবর নেই ওদের কাছে।আমাদের এখন বেঁধে বেঁধে থাকার উপায়ও নেই। আমরা সবাই দূরে দূরে তবুও আমার কাছাকাছি ফুলেরা কাছে যেতেই বলে ওঠে
" কি গো দেখলে না আমায়?"
আমি বলে উঠলাম, দেখছিই তো কিন্তু পারবি তোরা সবাই মিলে সারাদেশের মানুষের মন ভালো করে দিতে? আচমকা দেখি রক্তকরবী খুব হাওয়ায় মাথা ঝুঁকিয়ে বলে উঠল, আছিই তো। চিন্তা কিসের?
অদৃশ্য সেই শক্তির কাছে বারেবারে নতজানু হই আমি। কে তিনি? শীতলা? রক্তকরবী? নাকি করোনার প্রতিষেধক?

২৩ মার্চ, ২০২০

করোনার কড়চা

ঠাত যেন আলোর ঝলাকানি তারই মাঝে। অভিভূত হয়ে পড়ছি সবাই। এদ্দিন স্বার্থপর মানুষ শুধু দারা-পুত্র-পরিবারের অসুখে প্রার্থনা করত। এখন অপারগ হয়ে সারা বিশ্ববাসীর জন্য ভাবছে। শিখছে সভ্য, শিক্ষিত মানুষ। পরিবার আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব একে অপরের খবর নিচ্ছে, সেটাও আমাদের পরম পাওয়া। সব মানুষের পাখীর চোখ এখন করোনা দমন। রাজনীতির রঙ, জাতপাত সব ভুলে সবার লক্ষ্য এক । সেটাই বা কম কিসের? ভাবছিলেন তো মিলন হবে কত দিনে? এইতো এগিয়ে এল সেই বহু আশার মিলনক্ষণ। আমরা সবাই এখন এককাট্টা হয়েছি। মোরা মিলেছি আজ মায়ের সাথে।
ওদিকে রাস্তায় গাড়ি চলছেনা। সব বন্ধ। কেউ বাইরে বেরুচ্ছেনা। যেন বন্ধ উদযাপন চলছে দিনের পর দিন। অর্থাত প্রচুর এনার্জি কনজারভেশন হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। প্রকৃতি খুব খুশি । এজন্য‌ই বুঝি বলে রিসোর্সেস লিমিটেড, বুঝে চল।
আরেকদল শিক্ষিত মানুষ জেনেবুঝেও অন্ধ। এই একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাসের দাপটে রাজার ঘরেও যে অসুখ টুনির ঘরেও তাই। বিলেত ফেরত গায়ক গায়িকা এদ্দিন নিজেকে যত‌ই সেলেব ভাবুন না কেন উনি আসলে কিস্যু নন। গণ্ডমূর্খ। মোটেও সমাজ সচেতন নন। শিল্পী হবার কোনো যোগ্যতাই আসলে নেই তাঁদের, শুধু গান গাইলেই শিল্পী হওয়া যায় না। তাঁরা ছড়ালেন রোগ। ছড়াচ্ছেন‌ও প্রতিমূহুর্তে। মরছি আমরা, যারা সরকারি বিধি মেনে চলছি। দামী চিকিত্সক থেকে নামী আমলা, খেলোয়াড় থেকে অভিনেতা আজ আমি-আপনি কিন্তু সমান রিস্কে, সেটা অন্ততঃ বুঝুন। রাজার রোগ, টুনির রোগ এখন সমান।

আমাদের তো দিব্য চলছিল কবিতার আড্ডা, সাহিত্য‌আড্ডা, জনসমাবেশ, মাল্টিপ্লেক্সে হৈ হৈ হ্যাঙ‌আউট, শপিংমলের ফুডকোর্টে মস্তির দিনলিপি। ক্রমে চীন, জাপান, কোরিয়া আর তারপর দস্তুর মত ইউরোপ। ইতালি কে শেষ করে ইরান। আমেরিকাতেও অনুরূপ অবস্থা।  দাপিয়ে বেড়াতে বেড়াতে অবশেষে ভারতে ঢুকে এল করোনা ।  তখনও হুঁশিয়ার নয় আম বাঙালী। ওয়ার্ক ফর্ম হোম, অনলাইনে পড়ানো এসব করতে করতে ঘরে বোরড হয়ে ক্লাবে কিম্বা রেস্তোরাঁয় গিয়েছে তারা। নাহ! তারপর অ্যাটলাস্ট সেই অশৌচ পর্ব পালন আবশ্যিক হয়েই পড়ল। তবুও ভবি ভোলার নয়। কলকাতায় কাজের লোকেরা সবেমাত্র বলতে শুরু করেছে, কি একটা রোগ এইয়েচে গো?
এর মধ্যে ফুলেল শহরে বসন্তের কোকিলের কুহুতান । তার শুধু চিন্তা আহার-মৈথুনের আর বাঙালীর ভ্রমণের। তায় আবার পুরোদস্তুর ছুটির আমেজ। বাঙালীর ভ্রমণ পিপাসা পায়। ভাবতে অবাক লাগে। হোয়াটস্যাপে দী-পু-দার প্ল্যান হয়। ফূর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ যেন। এরা আবার গাড়ির মধ্যে ঢুকে সেলফি তুলে এই ডামাডোলের বাজারে ফেসবুকে পোস্ট‌ দেবার লোভ সামলাতে পারেনা। বলে ওঠে, হ্যালো ফ্র্যান্দস...চললুম পলাশের দেশে। কারণ বসন্ত ফুরায়। বাঙালীর বেড়ানোর নেশা পৃথিবীর সব জাতের চেয়ে বেশী কিনা।
ততক্ষণে লন্ডন ফেরত শিক্ষার্থী, আমলা ও ডাক্তারের পুত্র ছড়িয়েই দিল সেই মারণ রোগ কলকাতায় । ঠিক তারপরেই দক্ষিণ কলকাতার ওয়েসিস আবাসনের ব্যাবসায়ী পুত্র। এরা সবাই লন্ডন ফেরত। কিন্তু কারোর কোনও হেলদোল নেই। নেই স্বাস্থ্য সচেতনতা। বাড়ির লোকেও ভাবল না নিজেদের কথা, পড়শির কথা। মশাই এরা মানুষ? মানুষের তো আক্ষরিক অর্থে মান এবং হুঁশ দুই থাকতে হয় জানি। আবার নির্লজ্জের মত কলকাতার বাপ মায়েরা তাদের বিদেশে পড়া ছেলেপুলেকে ডেকে ডেকে নিয়ে এলেন দেশে। আহা! বলুন তো! মায়ের প্রাণ! আয় তোরা আয় ফিরে অথবা বেটা তুরন্ত  বাপাস আ যা । সঙ্গে নিয়ে আয় দু' চারটে করোনা।
তাদের উদ্দেশ্যে বলি, আমাদেরও আছে মশাই বত্রিশ নাড়ী ছেঁড়া ধন সেদেশে পড়ে। তবু বলেছি বেরুবি না একদম। প্রয়োজন না হলে। ঘরে বসে পড়াশুনো। কনফারেন্স, মিটিং সব চলছে গবেষকদের। দুগগা নাম জপছি অহোরাত্র ঘরে বসে।

এখন অনলাইন ম্যানেজমেন্টের ছাত্রের পরীক্ষার ইন্টার্ভিউতেও করোনা ইস্যু। ম্যানেজমেন্ট গুরু শিষ্যকে শুধান " আচ্ছা বল দেখি স্যনাইটাইজারের খুব চাহিদা এখন। বাজারে পাওয়াই যাচ্ছেনা। তোমায় যদি একটা মডেল সেট আপ করতে বলা হয় কি হবে তার স্ট্র্যাটেজি?” তারপর তার সাপ্লাই আর ডিমান্ড নিয়েও ভাবনাচিন্তা । ভাব ম্যানেজমেন্ট ট্রেনী ভাব। গ্রুম কর নিজেকে। করোনার যুগে তোমাদের এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতেই হবে ম্যানেজমেন্ট পড়লে।

পরীক্ষাগারে সহজে রাসায়নিক স্যানিটাইজার তৈরী কিম্বা গ্রামে গঞ্জে ভেষজ পদ্ধতিতে। এমন সব ইনোভেশন দৌড়চ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তেই কলকাতার করোনা কথার জন্ম হল। শয়নে স্বপ্নে জাগরণে এভাবেই করোনা ঢুকে পড়েছে বাঙালীর জীবনযাত্রায়। ধীর গতিতে আমরা পেরিয়ে চলেছি একের পর এক স্টেজ গুলি। এক, দুই, তিন। কে জানে ততদিনে আমিই বা কেমন থাকি।

কলকাতা করোনা কথা - ৫ 
২৩ শে মার্চ, ২০২০
অবশেষে করোনার এপিসেন্টার দক্ষিণ কলকাতার পন্ডিতিয়ার আবাসন ওয়েসিসে গতকাল মধ্যরাতে চারজন আমেরিকার অভিবাসী ফিরলেন দীর্ঘ দিনের ছুটি কাটিয়ে উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। এর মধ্যে দুজন আমাদের ব্লকে, দুজন পাশের ব্লকে। ফেসবুকেও তাঁরা আমার খুব ভালো বন্ধু দিদি। তারা সবাই বেশ বয়স্ক। সিনিয়ার সিটিজেন। বিদেশ থেকে ফিরে কিছুদিন এখানে থেকে তারপর ভারত পরিক্রমায় বেরিয়েছিলেন।প্রতিবারেই যান এমন। শুনলাম তাদের আইসোলেশনে থাকতে বলা হয়েছে। সরকারি নোটিশ। আমার প্রশ্ন হল রোগের সিম্পটম না দেখা দিলে টেস্ট করা হবেনা? না কি অপর্যাপ্ত টেস্ট কিট বেলেঘাটা আইডি তে এবং পিজি তে। আরো দুজনের পড়ুয়া কন্যা বিদেশ থেকে এসে ঘাপটি মেরে ঘরে বসে রয়েছে। ওয়েসিস টাওয়ারে করোনা আক্রান্ত চারজনের কথা তো সবার জানা। তাঁরা এখনও সবাই আইডিতে ভর্তি আছেন। তারপরেই শুনলাম এইমাত্র আমার নীচের তলায় একজন প্রৌঢ় ফিরেছেন কাতার থেকে একমাস আগে। তার নাকি জ্বর জ্বর ভাব আজ থেকে। তবে একমাস বোধহয় পেরিয়ে গেলে ভয়ের কিছু নেই। করোনার ইনকিউবেশন পিরিয়ড দু-সপ্তাহ ভাগ্যিস!
ধরিত্রী দেবী দ্বিধা হ‌ও। রিয়েল এস্টেট নিপাত যাক। ফ্ল্যাট কালচার আর নয়। পুনর্মুষিকো ভব। বাড়িই ভালো। বুঝবেন তো রিয়েল এস্টেটের মালিকরা? সম্বিত ফিরবে আপনাদের? বাড়ি ভেঙে, পুকুর বুজিয়ে বড় বড় আবাসন বানাবেন তো? এই শিক্ষাই করোনার কাছ থেকে নিতে হবে কিন্তু। 
বাকী চার পর্ব  আরও পড়ুন এখানে  CORONA EPICENTRE KOLKATA 

১০ মার্চ, ২০২০

ব্রহ্মা জানেন এসব তত্ত্ব


স্বয়ং ব্রহ্মা জানতেন না। এবার জানুন দয়া করে। 

হ্যাঁ, প্রজাপিতা ব্রহ্মাও জানেন মেয়েদের চেপে রাখা, চেপে দেওয়ার গোপন তত্বটি । আবহমানকাল ধরে সেটাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের লেগাসি মশাই। পান থেকে চুন খসে যাবে তবুও ব্রহ্মা অনড়।

আমাদের আড়িয়াদহের বাড়ি ছিল রক্ষণশীল। দাদুর গঙ্গাস্নানে গিয়ে বারেবারে পায়ে ঠেকতে থাকা শিবলিঙ্গ মাথায় করে এনে নিত্য ফুল-বেলপাতা-জল আর বাতাসা দিয়ে পুজো এখনো হয় দুবেলা। ঐ সার্ধশতবছরের ধাতব শিব এখন আমার বাবা-মায়ের কাছে। সেই সূত্র ধরেই ছোটোবেলা থেকেই আমাদের বাড়ির মেয়েরা শিবপুজো ও অন্যান্য পুজোয় সামিল হয়েছি সেই ছোট্টবেলা থেকেই।  এ আমার সংস্কার। এ আমার অহংকার। একে আমার লালন করতেও মন্দ লাগেনা। দক্ষিণ কলকতার শ্বশুরবাড়িতে পুজোআচ্চা বড় একটা দেখিনি। ষষ্ঠী, বারব্রত তে গায়ে উপোস আর পয়সা তুলে রাখা ছাড়া। "ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মোটি" দেখতে দেখতে এসব খুব মনে পড়ছে কাল থেকে। পৈতে কেন পরব না, আমারো মনে হত বৈকি । পরে জেনেছি নবদুর্গার ব্রাহ্মণী রূপে আর সরস্বতী পুজোয় দেবীরাও উপবীত পরেন বৈকি। বাড়িতে মা অনেক ট্যাবু ভেঙেছিলেন । রোজ আমি বা মা কেবল সন্ধ্যে জ্বেলে শাঁখ বাজাব কেন? তাই ভাই আর বাবাও প্রক্সি দিত। বাড়ির প্রথম মেয়ে আমার জাঠতুতো দিদির প্রথম অসবর্ণ বিয়ে হল। বিয়ের পরে অষ্টমঙ্গলায় এসে দিদি বলেছিল আমি তো শিবঠাকুর ছোঁবনা, আমার তো ব্রাহ্মণত্ব ঘুচেছে। মা বলেছিল, আলবাত জল দিয়ে ছুঁয়ে পুজো করবি তুই। বাড়িতে সরস্বতী পুজো বা শিবরাত্রির পুজো বাবার সঙ্গে সমান তালে মাকে করতে দেখেছি। মন্ত্র বলে আমাদেরো পুজো করাতে শিখিয়েছে মা। শাঁখা-পলা আমাদের ঘটিবাড়িতে ঠাকুমাও পরতেন না। সিঁদুরও অতি সামান্য। তবে কেউ পরলে বাধা দেয়নি। এই যেমন আমার ভালো লাগে লোহা পরে থাকতে, একটু সিঁদুর ছোঁয়াতে সেটা আমার বিশ্বাস। সেটাও আমার সংস্কারের মধ্যেই পড়ে। তাই বলে কেউ না পরলে আমিও জোর করে চাপাতে রাজী ন‌ই। আমার আশেপাশের মানুষকে খুশি করাই নয়, আমারো ভালো লাগে। তবে আমি অত আড়ম্বরে পুজোআচ্চা করিনি কোনোদিনো। যতটুকুনি না হলে নয়। আর ঐ পাঁজির পুরুত? তাদের মৌলবাদ বা ফতোয়া জারি করা, এটা হবে না, ওটা করতে নেই, এসবকে আমিও এক তুড়ি মেরে উড়িয়ে দি চিরকাল। সেইসঙ্গে বিজ্ঞান আমাকে অনেক যুক্তি দেয় এবং দিয়ে চলে। এই যেমন বাসিকাপড় ছেড়ে রান্না ঘরে ঢোকা। সেটার একটা হাইজিনের অন্যতম কারণ বলে আমি মনে করি। তাই বলে ভোরবেলায় স্নান করেই ঠাকুরঘরে বা রান্নাঘরে ঢুকতে হবে, তাই আবার একজন মেয়েকে সেটা আমার নাপসন্দ। গায়ত্রী মন্ত্র বা ওম্‌ কেন মেয়েরা উচ্চারণ করবেনা? সেটা নিয়েও আমার সঙ্গে তুমুল হয়েছে বাবার সঙ্গে এক আধবার। সত্যি‌ই তো পিতৃতান্ত্রিক সমাজ এসব ক্ষমতা নিজেদের মধ্যে কুক্ষিগত করে রেখে দেবে আজন্মকাল? মেয়েরাই আজন্মকাল পুজো গোছাবে, ভোগ রাঁধবে, বাড়বে  অথচ প্রধান পুজোটা করবে একজন পুরুষ পুরোহিত? সেই সঙ্গে বিয়ের সময় পিঁড়ি করে মেয়ে কে ঘোরানো বা কন্যা সম্প্রদান কে বড়োই অহেতুক বলে মনে হয়েছে আমারো।
গতবছর আমর ঋতুমতী পুত্রবধূকে কালীমন্দিরে প্রবেশ করিয়েছি আমি ও আমার কর্তা দুজনে মিলে। সে নিজে অবাক হয়েছে। সে নিজে মানেনা কিন্তু সোজা একেবারে মন্দিরের গর্ভগৃহে  ঢুকতে আপত্তি করছিল, ভাবছিল হয়ত তার নতুন শ্বশুর শাশুড়ি কি ভাববে। কিন্তু আমরাই বলেছি, আয় তুই। তখন তার চোখ চিকচিক করে উঠেছে। এত লিবারাল তার আধুনিক শ্বশুর শাশুড়ি?
আমিও বলেছি সেদিন তাকে, এই পুরুত গুলোই তো অম্বুবাচীতে কামাখ্যায় যজ্ঞ করে আসে না? যত্ত জ্বালা তাদের রক্তমাংসের মেয়েদের নিয়ে? তাই বলে শবরীমালা প্রসঙ্গ কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য। খ্রিষ্টানদের হাত থেকে একটা হিন্দু মন্দির কে বাঁচিয়ে রাখার প্রচেষ্টায় এত সরব তারা। এমনিতেই দক্ষিণে পুজোটুজোয়, আচার বিচারে আমাদের এক কাঠি ওপরে সেখানে আর এক শ্রেণীর মানুষরা সেই পিরিয়ডস নিয়েই এত সোচ্চার ।সেখানে আবার রাজনৈতিক কারণও আছে অতএব সিনেমায় এই প্রসঙ্গটি না এলেও পারত। আরেকটা ছোট্ট ভুল। ঊমা কে হোয়াটস্যাপ পাঠিয়েছিল শবরী। কিন্তু ঊমা এসে বলল, এসেমেস পেয়েছে। এছাড়া সুপার ফ্ল পেলুম না। সত্যি বলছি ভালো লেগেছে ছবিটি। আমাদের সবার প্রিয় কবি সম্রাজ্ঞীর সংলাপ, ঋতাভরীর চমৎকার অভিনয় এর জন্যই ১০০ তে ৮০ দিলাম। অতিকথনে দুষ্ট নয়, প্যানপ্যানে প্রেম নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা হল মেয়েদের উত্তরণের গল্পটি। বাঙালিদের জীবনে মেয়েদের তুলে আনার জন্য যিনি এই কাজটির পুরোধায় সেই গৌরী ধর্মপাল কে আবারো শ্রদ্ধা। খুঁটিনাটি সব বলে দিয়েছে ছবির চিত্রনাট্য। সবাইকে দেখে আসার অনুরোধ জানাই। মেয়েদের পৌরোহিত্য এর জয়জয়াকার হোক। কন্যা সম্প্রদান, লগ্নভ্রষ্টা, পুজোর তিথি এসবের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে এগিয়ে চলুক তাদের ধ্বজা উড়িয়ে।
সব শত্রুমুখে ছাই দিয়ে ব্রহ্মাদের আবহমানকালের লেগাসি কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিন মেয়েরা, মায়েরা, ঘরের ঝি বৌরা। ধর্ম ভীরু হবেন না দোহাই। ধর্ম প্রাণ হয়ে উঠুন। মানবিকতাই হোক আসল ধর্ম। সবার ওপরে মানুষ সত্য। অতএব লিঙ্গ বৈষম্য আর নয়!
স্বয়ং ব্রহ্মা জানতেন না। এবার জানুন দয়া করে।  দিন আগত ঐ! 

৬ মার্চ, ২০২০

ফালতু দিনের ঝরাপাতা / ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়




ধুর মশাই ! আর এই প্রতিবছর এই নারীদিবসে আর হ্যাজাতে ভাল্লাগেনা আমার। এই বিশেষ দিনগুলো আসলে বড্ড দেখনদারির আর গ্লোবালাইজেশনের চক্করে পড়ে ঐ উইমেনস হরলিকস, কেলগস স্পেশাল কে, হীরের গয়নায় ছাড়, শড়িতে ফ্ল্যাট ডিসকাউন্ট আজকের জন্য অথবা বেকারী শপে শুধু মেয়েদের জন্য আজ কেক কিনলে চকোলেট ফ্রির শোয়িং অফ । এসবে আমার চিঁড়ে ভেজার নয়। আমি রক্ষণশীল পরিবারে বড় হয়েছি। রক্ষণশীল পরিবারে বিয়ে হয়ে এসেছি। মেয়েদের অধিকার টধিকার নিয়ে, আদ্দেক আকাশের ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে দুই পরিবার বেশ সজাগ এবং সচেতন। তবে এদের সেই "ভবি ভোলার নয়" ব্যাপারটাকে আমি প্রায় ৮০ শতাংশ ভুলিয়েই ছেড়েছি। তাই ঐ সব নারীদিবস উদযাপন টুজ্জাপন আমার কাছে নয়। অধিকারের প্রশ্নে যে জন্য আজকের দিনটা পালন হয় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সেটা বেশ স্পেশ্যাল বটেই।
শৈশব থেকে কৈশোর পদার্পণেই আমি দেখেছি চরম লিঙ্গ বৈষম্য। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে সংসারে মেয়ের কোলে কি করে ছেলে আনতে হয় অথবা মেয়ে জন্মালে শাঁখ বাজাতে নেই কিম্বা ছেলের জন্মদিনে কেমন পরিপাটি করে পায়েসের বাটি কিম্বা মাছের মুড়োটি আগেভাগে তুলে রাখা হয়। দেখে এসেছি । আমাদের বাড়িতেই বলতে শুনেছি "ছেলের মুতে কড়ি, মেয়ের গলায় দড়ি"

অথবা মাধ্যমিকে স্টার পেলে "হীরের টুকরো ছেলে" বলতে শুনেছি। হীরের টুকরো মেয়ে বলতে শুনিনি আজ অবধি। তা যা বলছিলাম, একটু বড় হতেই মেয়েবেলার স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে একাধিকবার। হাঁটু ঝাড়িয়ে ফ্রকের ঝুলেই হোক কিম্বা বুকের কাছে ফ্রিল দেওয়া ফ্রকেই হোক। ফ্যাশন নয় মোটেও। শ্যাম্পু করা চুলে একখাবলা তেল। সেটা নিজের অপছন্দ হলেও। একটা পনি টেল নয়, দুই বিনুনী‌ই মাস্ট কারণ "বড় হ‌ওনি এখনো" কিম্বা এখুনি "ব্রা" নয়। আরো পরে। মামারবাড়িতে দেখেছি পঙক্তিভোজে একপাল তুতো ভাইবোনদের মাঝে নাতনীদের বরাদ্দ আধখানা ডিম আর নাতিদের পুরো ডিম পরিবেশিত হতে ।এমনকি নিজের যখন সিজারিয়ান সেকশন করে ছেলে সবেমাত্র বেবিকটে তখনো সম্পূর্ণ জ্ঞান আসেনি। আধো ঘুমঘোরে আমি। আর আমার মাথায় হাত রেখে অভিভাবকরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন, "ছেলের সব কিছুই আলাদা"
আমার নিজের জন্মের ন'বছর পরে ভাই হওয়াতে ধুমধাম করে অন্নপ্রাশন হতে দেখেছিলাম। ভাই হতে স্কুলে ক্লাস শুদ্ধ বন্ধুদের লজেন্স খাওয়াতে দিয়েছিলেন বাবা মা। অথচ আমার নাকি সেভাবে ঘটাই হয় নি মুখেভাতে। কারণ আমাদের বাড়িতে নাকি মেয়েদের মুখে ভাত হয়না। আর যেহেতু আমার ভাই আমার থেকে অনেকটাই "ধলা" অর্থাত সাহেবদের মত ফর্সা তাই আজন্মকাল বাড়িতে শুনে এসেছি "মেয়েটা ছেলেটার মত "রং" পেল না"
আমার জন্য মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে একজন অংকের মাস্টারমশাই ছাড়া আর কোনো প্রাইভেট টিউটার ছিল না। তখন ভাবতাম বাবার সামর্থ্য নেই। সামান্য চাকরী। একটা বড় বাড়ি করেই তিনি ফতুর। আরেকটু লাইফ সায়েন্সটা যদি কেউ দেখিয়ে দিত! লেটার মিস করেছিলম চার নম্বরের জন্য। শুধু ভেবেই গেছি। মুখ ফুটে চাইতে পারিনি কখনো। তারপর ভাইয়ের মাধ্যমিক এগিয়ে আসতে দেখেছি  প্রতি বিষয়ের ওপর তার জন্য নিযুক্ত প্রাইভেট টিউটর। মনে মনে খুব আঘাত পেয়েছি কিন্তু ভাইয়ের প্রতি অকুন্ঠ স্নেহের জন্য কিছুই বলতে পারিনি। আবার তখন আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আগে আমি‌ই ওকে পড়তাম। অতএব শিক্ষক তো লাগবেই।এমনি ভেবে শান্ত হয়েছি। 
বিয়ের ঠিক করেছেন বাবা। বিদেশ যাত্রা হয়েছে তারপরেই। নিজের সংসার, ছেলের জন্ম, কেরিয়ারে ইতি ঘোষণা। শ্বশুরবাড়িতে এসে দেখেছি আরেকরকমের রক্ষণশীলতার ঘেরাটোপ।

সেখানেও একবাড়ির মধ্যে মন্ত্রণাদাতা একপাল শাশুড়ির দল। কেউ সধবা, কেউ বিধবা, কেউ আজন্ম আইবুড়ো, কেউ হতবান্ধব। এবার আরো শুল্ক আরোপ। আরো বৈষম্য। বাড়ির ছেলে বৌয়ের কাপড় তুললে বা মেললে সেখানে রীতিমতো রে রে করে তেড়ে আসে কেউ। ছুটির দিনে বরের সঙ্গে বারান্দায় দাঁড়ালে বা দুপুরবেলায় দরজা বন্ধ করে শুলে মহাপাপ হয়। নাইট শো'তে সিনেমা গেলেও এক‌ই অবস্থা। অবিশ্যি আমার বর একহাত নিতেও ছাড়ে নি কখনো। আমার দিদা এদিকে রক্ষণশীল হলেও বলতেন, ওসব, "সহে রহে বাদ দাও, বুকে বসে দাড়ি ওপড়াতে হবে সেটাই নিজের অধিকার রক্ষার একমাত্র উপায়, মেয়েদের" তাই "আমারে কেহ দাবায়ে রাখতে পারবা না" সেই আপ্তবাক্যি মাথায় নিয়েই চলেছি এখনো অবধি। আমেরিকায় গিয়ে সেই মাত্র ২৩ বছরে স্টুডেন্ট পার্টির জন্য বর এবং তার বন্ধুদের সঙ্গে হৈ হৈ করে ওয়াইন শপে গিয়ে যখন ক্যান ক্যান বিয়ার আর লিকারের ক্রেট কিনে গাড়িতে উঠেছি তখন বন্ধুরা হাসতে হাসতে বলেছে" ছবি তুলে রেখে দে, বঙ্গবধূর এহেন পদস্খলন দেখলে আর দেখতে হচ্ছে না" অথবা প্যারিসের নাইটশো'তে ক্যাবারে, সেখানেও সেই এক কথা, বুঝেছ? বাড়ি গিয়ে এসব গল্প করে বোলো" তখন মনে হয়েছে মুখে আগুণ নারীস্বাধীনতার! মেয়েদের তো ছেলেরাই এভাবে জায়গা করে দেবে তা নয় আমাদের বাড়ির মেয়েরাই তো আজন্মকাল মেয়েগুলোর স্বাধীনতা খর্ব করে দিয়েছে। ডাক্তার জামাইবাবুর সঙ্গে সিনেমা দেখা নিয়ে অথবা গোপনে সব শালীদের নিয়ে চকোলেট ফ্লেবার্ড সিগার সেবন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
আর প্রশ্ন কিন্তু তুলেছেন মেয়েরাই। ছেলেরা বরং বলেছেন ছেড়ে দাও। 
তবে আমি অনেক বদল এনেই ছেড়েছি। মায়ের কাছেও, শাশুড়ির কাছেও। রীতিমত কাউন্সেলিং করে চলেছি এখনো। শাশুড়িকে স্লিভলেস ব্লাউজ থেকে হাউসকোটে উত্তরণ করতে সমর্থ হয়েছি। তাঁর সাধের পুত্রটিকে দিয়ে জামাকাপড় তোলানো থেকে মেলা অথবা নিজের মা'কে এমন মোল্ড করেছি যে বাবা এখন রান্নাঘরের চায়ের ডিপার্টমেন্ট এর দায়িত্ত্বে। 
আমার ছেলে আরো বদলে দিয়েছে। "ফুলকো লুচি আমি আর বাবা খাব না ঠাম্মা। ওগুলো মা আর তুমি খাবে। কিম্বা কাজের মাসী ছুটি চাইছে, সেটাই তো স্বাভাবিক মা, তুমি হলে পারতে রোজ রোজ কাজ করতে? অথবা আমাদের ঐ কুচকুচে কালীমায়ের ওপর তোমাদের এত দরদ অথচ বিয়েবাড়িতে গিয়ে নতুন বৌ "কালো" হয়েছে ব‌লে গাড়িতে উঠেই তোমরা সমালোচনায় মত্ত হ‌ও! কি হিপোক্রিট তোমরা, আই মিন এই মেয়েরা!" এমনো বলেছে।
আমি অবিশ্যি তার আগেই বদলে গেছি নিজের মত করে। ছেলের বিয়ের পর থেকেই প্রতি মা ষষ্ঠীর পুজোয় ছেলে-বউ দুজনের নামেই পয়সা তুলে রাখি ঠাকুরের কৌটোতে। সব পয়সা জমিয়ে সারাবছর পর দুর্গাষষ্ঠীতে পুজো দি‌ই।

আমার মা ও বদলেছেন। শুধু ছেলের জন্য নয়। মেয়ে, জামাই, বৌ সকলের জন্য পুজো তুলে রেখে ষষ্ঠীদেবীর কাছে মঙ্গল কামনা করেন সবার জন্য । তবে আমার শাশুড়ি মা কিন্তু এখনো পারলেন না। এবারেই শীতল ষষ্ঠীর দিন ছেলের কপালে কয়েন ছোঁয়ালেন। আমি বললাম তক্ষুণি, আমি বাদ? বললেন, আহা! ও তো আমার ছেলে বলো! বললাম "তো"? আমিও তো আপনার ছেলের ছেলেকেই গর্ভে ধারণ করেছি। বললেন ও আলাদা। আমার বত্রিশ নাড়ী ছেঁড়া ছেলে। তোমার মা তোমার জন্য তো করবেই । আমাকে আমার মত করতে দাও। তাই এই কিস্‌সার শেষ হবেনা জীবনেও। ভবিরা ভুলবেওনা কোনোদিনো। মেয়েরাই আজন্মকাল মেয়েদের দাবিয়ে রাখবে। আবার খবরের কাগজে, টিভি চ্যানেলে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের গুরুগম্ভীর সব বক্তিমে শুনে হাততালি দেবে। পারলে নিজেদের লেডিসক্লাবে গিয়ে চুপুচুপি বন্ধুদের একটা করে লবেঞ্চুস খাইয়ে বলবে "হ্যাপ্পি উইমেন্স ডে" তবে ঐটুকুই। ভাগবত বা গীতার সারমর্মটুকু পাঠস্থানে রেখে এসেই খালাস তাঁরা। বাড়ি বাড়ির মতোই। সেখানে মেয়েদের নিজের টাঁইস্যে রাখতে হয়। কথাতেই তো বলে "লঙ্কা জব্দ শিলে,ব‌উ জব্দ কিলে" নয়ত বাড়ির নারী এগিয়ে যাবে তার স্বাধিকার লঙ্ঘনে।   
আজন্মকাল ধরে যদি আন্তর্জাতিক নারীদিবস পালন করে এই নারীদের নাড়িতে সামান্যতম বিদ্যুত খেলত! তবেই হত এইদিনের সার্থকতা!  
আর পারলাম না নিজের বাবাকেও। একমাত্র ভাই দূরে থাকে। নিজের কাজের জন্য আসতেও পারেনা। দেখভালও করেনা। তাদের সব দায়িত্ত্ব আমার ওপরেই বর্তেছে । মাঝেমাঝেই তিনি বলে ওঠেন "তুই আমার বড় ছেলের কাজ করছিস" খুব দুঃখে বলে উঠি, কেন গো বাবা? মেয়ে বলতে এখনো তোমার এত কষ্ট হয়? আমার যে খুব ক্লিশে লাগে শুনতে।

( যুগশঙ্খ ডিজিটালে প্রকাশিত ২০১৯ নারীদিবসে )