বনভোজন-২০১৬
ডিজিটাল ক্লিকে মুখর নৌকাবিহার |
সদলবলে নৌকায় গঙ্গাবক্ষে |
আমি তরী নিয়ে বসে আছি নদী কিনারে... |
থ্রি মাস্কেটিয়ার্স |
এবার দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার রায়পুর। গঙ্গার ধার, মাঘের শীত বাঙালীর তসরে, পুলওভারে, টুপিতে, পশমিনা চাদরে। কনকনে হাওয়া, মিঠে রোদে ভেসে যাওয়া সকালে বনভোজন। আমাদের Praxis Buisness School এর annual picnic ! সারাবছর আমরা এইদিনটার জন্য মুখিয়ে থাকি। অনিতা আর জয়দীপদা লেট করতে করতে অবশেষে আমাদের তুলল ঠিক গাড়িতে। তারপর চারটে গাড়ির কনভয় অবশেষে নদীর ধারে গিয়ে পৌঁছল। ফুলকো ফুলকো লুচি আর কড়াইশুঁটি দেওয়া সাদা আলুচচ্চড়ি। তারপরেই ডাবের জল আর ভদকা কিম্বা পাতি বিয়ার।সঙ্গে শীতসব্জীর পকোড়া, চিকেন পকোড়া আর রুইমাছ ভাজা। নদীর ধার দিয়ে ডিঙিনৌকায় চলে মাছওয়ালা....
কি মাছ আছে? উত্তর এল খোকা ইলিশ।
খেলবনা।
কেন ম্যাডাম?
ধরেছো কেন?
কি খাব? আপনারা কিনলে একটু রোজগার হয়, ভালো দাম পাব, এই দেখুন, একদম লড়ছে, ডিম হয়নি। আজ যেকটা ধরেছি সব আপনাদের দিই তবে?
বললাম, কথা দিতে হবে, আর ধরবেনা।
এই শীতকালেই তো পিকনিক পার্টির রমরমা, তারপরেই হাতখালি। কিছুই নেই বাংলায়।ছেলেপুলেদের পড়াশুনো করিয়েও লাভ নেই । অগত্যা মাছ ধরেই বেচি। তারপর অসুখবিসুখ, নৌকো মেরামতি, ঘরের খড়, জমির ধান, মেয়ের বিয়ে...কোথায় যাই? মাগঙ্গার সাথেই ওঠবোস, গঙ্গার কাছেই সারাদিন মিনতি জানাই, শরীল থাকতি নিয়ে নাও মা।
মাছ ছিল সর্বসাকুল্যে এককেজি দুশো গ্রাম। তাই সই। কেটেকুটে খাবি খাওয়া মাছভাজা সকলেই খেল চেটেপুটে। মন মানলোনা। কামড় দিয়েই মনে হল হায়রে দারিদ্র্য! কোথায় মাগঙ্গা! কোথায় সেই ছোটবেলা? এককিলোর কম ইলিশ আমরা চোখেই দেখিনি। জেলেটির কথাগুলোও তো ফেলতে পারিনা। খোকা ইলিশ ধরা বন্ধ করা হল কিন্তু এই জেলেটির সেদিনের ভাত কে জোটাবে? তবুও তো পেল পাঁচশোটা টাকা। এরপরেই সবশুদ্ধু নৌকাবিহার। ম্যাডামদের হাতে ডাবেরজল মিশ্রিত ভদকার গ্লাস, পেপার ন্যাপকিনে মোড়া পকোড়া আর মাছভাজা.....কত গান, কত ফূর্তি আমাদের্! ভেসে গেলাম গঙ্গাবক্ষে টানা একটা ঘন্টা । কনকনে উত্তুরে হাওয়ায় আমাদের শাল-দোশালা, জ্যাকেট, সোয়েটার টুপি, মাফলার আরো কতকিছু শীত অনুষঙ্গে মাঘীশীত জমে দৈ! গরম ভাত আর মাটনকারিতে ভরাপেটে আবার ভরা মানে তেলা মাথায় তেল বা Carrying Coal to New Castle । তারপরেই জয়মা বলে গঙ্গার ধারে ভাসাও থার্মোকলের থালার তরী! পরপর গঙ্গার ধারে পিকনিক স্পট। পিকনিক স্পটের মালিক পয়সা নিয়েছে। রসিদ দিয়েছে। কিন্তু কোনো ট্র্যাশ ফেলার জায়গা নেই। মাননীয় সরকারী অফিসাররা, আপনারা কি নৌকাবিহারে যান? তবে দেখে আসুন গঙ্গার ধারের আবর্জনাগুলো। এখনো কত জাহাজ চলে এই গঙ্গায়। এখনো কত জল, কত সুন্দর তার রূপলালিত্য!
চড়ুইভাতি-২০১৬
এবার দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ফলতা
আমরা এমনি এসে ভেসে যাই...।গানে, কবিতায়, নাচে, কুইজে... |
জগদীশ চন্দ্র বসুর বড়ি... দূর থেকে... |
এখনো সে বৃন্দাবনে বাঁশী বাজেরে... |
"আপ্কো কিতনা বার বোলা থা, জলদি আনেকে কে লিয়ে? হমলোগ ব্রেকফাস্ট খায়েঙ্গে ন'বাজে। যাইহোক অব স্টার্ট তো কি জিয়ে।" সাড়ে আটটায় ছাড়ল টাটা উইঙ্গার। সদলবলে আমি দক্ষিণ কলকাতা পাঠচক্রের সদস্যাদের নিয়ে।
সাদার্ণ এভিনিউ আসতেই গাড়ি বাঁদিকে ঘুরছে। কেন? কেন আবার? ডানদিকে ফলতা যদিও কিন্তু ডায়মন্ডহারবার দিয়ে গেলে "গঙ্গাসাগর মে হমারা গাড়ি পাকড় লেগা" মতলব? বারুইপুর, আমতলা ঘুমকে জানা হ্যায়। তার মানে? কড়াইশুঁটির কচুরী-কালোজিরে, কাঁচালঙ্কা দিয়ে আলুর তরকারী, চা, নলেনগুড়ের সন্দেশ ভোগে? পেছনের সিট থেকে প্রবাসী শুভশ্রীদির হুঙ্কার শিট্! আমার বাঁদিক থেকে মনীষামাসীর অনুযোগ...আপনার তো বোলনা চাহিয়ে থা! ডান দিক থেকে বন্দনাদি তখন তারস্বরে গেয়ে চলেছে..." আমার পরাণো যাহা চায়....তুমি তাই...." অমিতামাসী বলে উঠল, তুই চুপ্ করবি বন্দনা? আমার মাইগ্রেন শুরু হয়ে গেল। বাড়ি থেকে শুধু এককাপ চা খেয়ে বেরিয়েছি আমি" আবার শুভশ্রীদি রোদচশমাটা মাথার ওপরে তুলে বলে উঠল, ডিসগাস্টিং! দিস ইস কলকাতা! আমি তখন ড্রাইভারের সাথে বলে চলেছি, এডভান্স লেনে কা টাইম মে ইয়ে মালুম নেহি থা? বলতে না বলতেই হুশ্ করে গাড়ি এসে পড়ল। ড্রাইভার বলে কিনা উতর যাইয়ে! হমারা গাড়ি নেহি হ্যায়! মালিকনে বাতা দিয়া....ব্লা, ব্লা, ব্লা....তখন উনি মানে আমার হিরোটি বলে উঠলেন
" অগর হমলোগ উতর জায়েঙ্গে তো আপ জিন্দা নেহি ঘর পৌঁছেঙ্গে....." উরিব্বাস! একদম অক্ষয়কুমার মার্কা ডায়লগ! পেছন থেকে মিসেস বালসারা তো ভয়ে, কুঁকড়ে অস্থির। আমাদের আরেকটি প্রাইভেট কার তখন ফোন করে বলছে, এই শোনো আমরা না ডায়মন্ডহারবারের পথ দিয়েই চললাম...
এক মাসীমা বলে উঠলেন, তো?
ফলতা আসতেই একজন বলে উঠলেন, "ইতনা সংকীর্ণ গলি মে কিঁউ ঘুসা?" আর আমরা হেসে কুটি আর পাটি।
এই করতে করতে অবশেষে ফলতা পৌঁছে যেন মনে হল বিশ্বজয় করেছি। কে যেন গাড়িতে বলছিলেন তাঁর অম্বল হয়েছে। কার যেন গ্যাসের ব্যাথাটা বাড়ছিল। কেউ একজন মাইগ্রেনে কষ্ট পাচ্ছিলেন। আর আমার টেনশনযুক্ত এহেন মনের অবস্থা, পেটের ভিতর ছুঁচোবাবুর ডন-বৈঠক দেওয়া....সবকিছুর আগুণে জল পড়ল। গঙ্গার ধারে টেবিল পাতা লোকনাথ রেসর্টে কি ভালোই আয়োজন করেছিলেন আমাদের কলকাতার ঠাকুর(ওরফে কেটারার)..টোপা টোপা, পুর ঠাসা, বটলগ্রীন রংয়ের কড়াইশুঁটির কচুরী পেয়ে মুখে সব কুলুপ এঁটে বসে গেল চুপচাপ। ঝগড়া তখন মাথায়। গাড়ির কাজিয়া রণে ভঙ্গ দিয়েছে ততক্ষণে। তাপ্পর ছোট ছোট জগদীশবাবুর বাড়ি দেখতে। আঃ মলো যাঃ! বোস ইন্সটিট্যুটের সরকারমশাইরা আমাদের ঢুকতে পর্যন্ত দিলনি! আমরা এতোই অছ্যুত! তা বাপু আমরা আমাদের মত সব গেম খেলিচি অনেক। সিনিয়র সিটিজেন মাসীমাদের স্মৃতিতে শান দিইয়েচি বাপু...মেমারি গেম খেলিয়েচি, ক্যুইজ হল, ডাম্ব-শারড, ছোট্ট ক্লু থেকে অণুগল্প ( ৫ মিনিটে পাঁচ লাইনে) সব করিচি।খেলতে খেলতে সেকেন্ডরাউন্ড চা আর পকোড়া এল। মাসীমাদের কি খুশি! তাপ্পর হেব্বি লাঞ্চ করিচি...মেইন কোর্সে দইমাছে আখাম্বা কাতলা ছিল আর চিকেন চাঁপ। ও হ্যাঁ, মধুরেণ সমাপয়েত আমসত্ত্ব-আলুবখরার চাটনী আর নলেন গুড়ের রসোগোল্লা! জেরিয়াট্রিক এই মহানগরে এই মানুষগুলি আমার বড্ড ওয়েল উইশার। এরা বছরের এই একটি দিন বসে থাকেন আমার মুখ চেয়ে। কবে আমি একটু নিয়ে যাব এদের পিকনিকে!