৩১ অক্টো, ২০১৪

জগত্+ধাত্রী == জগদ্ধ্বাত্রী

মেয়ে যুদ্ধ করে জিতে এয়েচে, মানে দশহাতে অসুর বধ করেচে, দেশ জুড়ে সবাই মেয়েটাকে বাহবা দিতেছে.... মাদুগ্গা কৈলাসে ফিরে গেচেন মাস খানেক হল। দেবতারা বসে সেখানে গোঁফে তা দিতেছেন।
একা মেয়েছেলের কত ক্ষেমতা বাপু, কেষ্টদা অকপটে মেনে নিল।
কেউ বলছে, ধুস্‌ তবুও যদি বুঝতুম একা সামলেছে সব।
ধার করা সব অস্ত্র শস্ত্র পেলে আমারাও অমন দশটা অসুর মারতে পারতি, ইন্দর দাদাবাবুতো কোনো রাখঢাক নেই, বলেই ফেল্ল।  
তবে যাই বলো বাপু দুগ্গাটা দেকিয়ে দিল! শিবুদা বৌয়ের প্রশংসায় আরো কয়েক ছিলিম বেশী গাঁজা নিয়েছে ।
এখন কৈলাসে মহিষাসুর বধের দ্বিতীয় ইনিংসের তোড়জোড়। বড়াখানার আয়োজন হচ্ছে। দুর্গার অনারে। তবে অহংকারে পা পড়তেচেনা কারো। যেন তেনারাই যুদ্ধ করে এয়েচেন। তাই দেখে শুনে শিবুদা বললেন তা তোমাদের বৌয়েরা তো সব পাটরাণী। বলি আমার বৌ অসুর মেরেচে তো তোমাদের এত গর্বের কি! এমন ভাবখানা কচ্চো যেন তোমরাই মেরেচো!
ব্রহ্মা সেই শুনে একটা ফন্দী আঁটলেন। ব্রাহ্মণের রূপ ধরে রাজসভায় এসে সকলের সামনে একটা তৃণ মানে কচি দুব্বোঘাসের টুকরো রেখে বললেন, দেখি কত্ত ক্ষেমতা বাপু তোমাদের্? এই তৃনটাকে উড়িয়ে দাওতো যেমন করেই হোক!
পবনদেব এলেন। বললেন্, এ আর এমন কি! কিন্তু শত চেষ্টা করেও পারলেন না ঐ ঘাসের টুকরোকে হটাতে। এরপর অগ্নিদেব এলেন তৃণকে পুড়িয়ে দেবার জন্যে। সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও বিফল হলেন।
তখন ব্রহ্মা স্বয়ং নিজের রূপ ধরে বল্লেন, কি করে পারবে তোমরা? সারাটা জগতকে যিনি ধারণ করে রয়েছেন তিনিই তো মায়া-মমতা-স্নেহ দিয়ে আগলে রেখেছেন ঐ তৃণটুকুনিকে। অতএব স্বীকার করলে তো ঐ জগদ্ধ্বাত্রীর কত্ত ক্ষেমতা? আর তোমরা কিনা দুর্গার অসুরবধ নিয়ে বুক ফোলাচ্ছ্, গোঁফে তা দিছ, পার্টির আয়োজন কচ্চো যেন তোমরাই অসুরটাকে মেরেচো!!!

অতএব এখন দুর্গা=জগদ্ধ্বাত্রীর অনারে আরো একবার পার্টি হৌক্! কেষ্টদা বলে উঠলেন!!!  

২২ অক্টো, ২০১৪

প্রাক্‌-কালীপুজো কথন


কোজাগরীর ঘোর কাটতে না কাটতেই কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর পরদিনেই ভূতচতুর্দশী। শুক্লপক্ষে আকাশ আলো করা রূপোর থালার মত চাঁদ, হিম ঝরানো জ্যোত্স্না আর শারদীয়ার মনখারাপ। দিন পনেরো কাটতে না কাটতেই কৃষ্ণপক্ষের সূচনা। ভূত চতুর্দশীর প্রস্তুতি। আমেরিকার হ্যালোউইন আর ভারতবর্ষের আকাশ প্রদীপ জ্বলা ভূত চতুর্দশীর ঘোর অন্ধকার। সেই পূর্ণিমার চাঁদ এখন ঘুমোতে গেছে। ঝুপসি অন্ধকার আকাশের গায়ে। শহরে অবিশ্যি আসন্ন দীপাবলীর আলোর রোশনাই আর আকাশছোঁয়া ঘরবাড়ির আলোয়, বাজির গন্ধকী গন্ধে ভরপুর বাতাস। হিমের পরশ, ঝিমধরা নেশাগ্রস্ত ... ঋতু বৈচিত্র্যময়তায় । কার্তিক মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী। আকাশের ফুটফুটে তারা সেই অন্ধকারে দৃষ্টিগোচর হয়। হ্যালোউইন পালিত হয় সেদেশে মৃত আত্মার শান্তি কামনায়। ঠিক যেমন আমরা আমাদের মহলায়ায় প্রিয়জনের মৃত আত্মার প্রতি স্মৃতিতর্পণ জানিয়ে পিতৃপক্ষের অবসান ঘটিয়ে দেবীপক্ষের শুরু করি। 
 মহালয়ার দিনে আমরা যে পিতৃপুরুষকে স্মরণ করে  তাঁদের মর্ত্যে অবতরণ ঘটিয়েছিলাম । ঠিক একমাস পরের অমাবস্যায় তাঁদের আবার স্বর্গে ফিরে যাবার কথা। তাঁদের যাত্রাপথকে আলো দেখানোর জন্য এই একমাস আকাশপ্রদীপ জ্বলেছে প্রতিবাড়ির ছাদে। এবার তাঁদের যাত্রাপথকে আলোকিত করার জন্য দীপাবলী উত্সব। তাঁরা আবারো শান্তিতে  আলোয় আলোয় ফিরে যাবেন স্বর্গলোকে।   

ভূত চতুর্দশীর অন্ধকারে মৃত আত্মারা নাকি ঘুরে বেড়ায়। তাদের আত্মার শান্তি কামনায় চৌদ্দ রকম শাক (ওল, কেঁউ, বেতো, সরিষা, কালকাসুন্দে, নিম, জয়ন্তী, শাঞ্চে, হিলঞ্চ, পলতা, শৌলফ, গুলঞ্চ, ভাটঁপাতা, সুষণী ) ভেজে খাওয়ার রীতি। আর সন্ধ্যেবেলায় বাড়ির আনাচে কানাচে চৌদ্দ প্রদীপ জ্বালার নিয়ম। কোথাও যেন কোনো অন্ধকার না থাকে। বৈদিক মতে এর ঠিক একমাস আগে মহালয়ার দিন পরিবারের আত্মীয় বন্ধুদের মৃত আত্মার শান্তি কামনা করে তর্পণ করা হয় তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। আবার তন্ত্র মতে ঠিক এক মাস পরে এই কার্তিক অমাবস্যার আগের দিন মৃত আত্মাদের আলো জ্বালিয়ে স্মরণ করা হয়। মূল কথা একটাই ,তোমরা সুখে থাকো, ভালো থাকো। কারো কোনো অনিষ্ট কোরোনা। 

ছবিঃ শিল্পী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় 

 

পুরাণকথায় পাই দেবী কালী নাকি কার্তিকমাসের এই চতুর্দশীর রাতে ভয়ানক অত্যাচারী নরকাসুরকে বধ করেন। তাই তামিলনাডুতে এই চতুর্দশীর রাতেই দীপাবলি পালিত হয়। কিন্তু অন্য সব রাজ্যে পরের দিন অর্থাত অমাবস্যার রাতেই কালীপুজো হয়। গোয়ায় নরকাসুরের কুশপুত্তলি পোড়ানো হয় মহা সমারোহে। কাগজের তৈরী এই কুশপুতুলে নানারকম বাজি বেঁধে তাতে অগ্নিসংযোগ করে জ্বালানি হয়। কারণ কিংবদন্তীর কড়চা বলে গোমন্তেশ্বর বা গোয়াতেই নাকি নরকাসুরের দাপট অতিবৃদ্ধির জন্য স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ তা রুখতে সেখানে হাজির হন সুদর্শন চক্র সমেত। তবে নরকাসুর বলি হন মা কালীর হাতে।
গুজরাট, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র উত্তরপ্রদেশ সহ সর্বত্র দেওয়ালী পালন করা হয় আলোর উত্সব, ধনতেরস ইত্যাদির সাথে । আত্মীয় বন্ধুদের সাথে উপহার আদানপ্রদান হয়, মোমবাতি, প্রদীপের আলো দিয়ে ঘরবাড়ি সাজানো হয়।
দক্ষিণ ভারতে যেমন নরকাসুর বধের আনন্দোত্সব হল দীপাবলী উত্তর ভারতে রামচন্দ্রের রাবণ বধ করে অযোধ্যায় ফিরে আসার বিজয়োত্সব।আলো দিয়ে অযোধ্যা নগরীর কোণা কোণা সাজানো হয়েছিল। তাই আলোর উত্সব দীপাণ্বিতা বা দীপাবলী বা দেওয়ালি। মূল কথা আলো আর তাকে কেন্দ্র করেই নতুন পোষাক, সুখাদ্য আর উপহার আদানপ্রদান। সেই কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীকা, কামরূপ থেকে কাথিয়াবাড় সর্বত্রই অশুভ শক্তির বিনাশ আর শুভ শক্তির বরণোত্সব হল দীপাবলীর মদ্যা কথা।
ধনাগমের জন্য মানুষ করে ধনতেরস ও লক্ষ্মী-গণেশের পুজো। মূল উদ্দেশ্য একটাই। শ্রীবৃদ্ধি আর উন্নতি। আলোয় আলোয় সব ঘুচে যাক্‌, মুছিয়ে দে মা মনের কালি।
পশ্চিমবাংলায় অনেকের রীতি কালীপুজোর বিকেলে দীপাণ্বিতা লক্ষ্মীপূজো করে অলক্ষ্মী বিদেয় করা হয় । সংসারে সারাবছর যাতে শ্রীবৃদ্ধি হয়, ধনাগম হয় সেই আশায় । লক্ষী, নারায়ণ আর ধনপতি কুবেরের পুজো হয় । পিটুলি বাটা দিয়ে মা তাঁর নিপুণ হাতে তৈরী করেন তিন পুতুল.... সিঁদুর দিয়ে পিটুলির তৈরী লালরঙের লক্ষ্মী পুতুল, নীলের গুঁড়ো দিয়ে নীল নারায়ণ পুতুল, আর অপরাজিতা পাতা বাটা দিয়ে সবুজ কুবের পুতুল । কলার পেটোতে সেই পুতুল তিনটিরই আসলে পূজো হয় ঐদিন । আর একটি কলার পেটোতে মাথা থেকে আঁচড়ানো চুলের নুড়ি, একটু গোবর আর একটা ভাঙা মোমবাতি রেখে তৈরী হয় অলক্ষী । চাটাই পিটিয়ে, মোমবাতি জ্বেলে অলক্ষীকে বাড়ির বাইরে বের করে পূজো করে, লক্ষী, নারায়ণ আর ধনপতি কুবেরকে শাঁখ বাজিয়ে বরণ করে প্রতিষ্ঠা করা হয় ।

চাটাই বাজাতে বাজাতে বলা হয়,

 " অলক্ষ্মী বিদেয় হোক, ঘরের লক্ষ্মী ঘরেই থাক্" আসলে কুললক্ষ্মীর পুজো এই দীপাণ্বিতা লক্ষ্মীপুজো। ........

সারা ভারতবর্ষ জুড়ে চতুর্দশীর আগের দিন অর্থাত ত্রয়োদশীর দিন ধনতেরস নামে উত্সব পালন হয় । পুরাণের গল্পে আছে সমুদ্রমন্থনের সময়কালীন এক গল্প। ঐশ্বর্যের ভারে অহংকারী দেবরাজ ইন্দ্র সকলকে খুব হেয় করছিলেন। একদিন দুর্বাশা মুনি তাঁর গলার পারিজাতের মালাটি অত্যন্ত স্নেহের সাথে হাতির পিঠে চড়া ইন্দ্রকে গলায় পরিয়ে দিতে যান। মালাটি ইন্দ্রের গলায় না পড়ে হাতির দাঁতের ওপর গিয়ে পড়ে ও হাতি ততক্ষণাত সেই মালাটিকে শুঁড়ে করে মাটিতে ফেলে দেয়। তা দেখে দুর্বাসা অতীব ক্রুদ্ধ হন ও দেবরাজকে "লক্ষ্মী চ্যুত হও" এই বলে অভিশম্পাত করেন। মুনির এই অভিশাপে দেবরাজ ইন্দ্র অসুরদের পরাজয় লাভ করেন ও রাজ্য, সিংহাসন, লোকবল সব হারান। অসুররা তখন স্বর্গের মালিকানা পান ও লক্ষ্মীদেবী সহ সমগ্র দেবতাকুল পালিয়ে গিয়ে সমুদ্রের অতলে আশ্রয় নিলেন। দেবকুলের এহেন সমূহ বিপদে দেবরাজ ইন্দ্র প্রজাপিতা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। তিনি সব শুনে বললেন একমাত্র বিষ্ণুই পারেন দেবতাদের বিপন্মুক্ত করতে। আর তখনি শুরু হল সেই মহাকার্য যার নাম সমুদ্রমন্থন। সমুদ্রের গভীরে নাকি "অমৃত" নামে এক অমোঘ সঞ্জিবনী সুধা আছে যা পান করলে দেবতারা অমরত্ব লাভ করবেন। বিষ্ণুর আদেশে মন্দার পর্বত হল সমুদ্রমন্থনের দন্ড। আর নাগরাজ বাসুকী হল মন্থনের রজ্জু। মন্দার পর্বতকে বাসুকী তার সমগ্র শরীর দিয়ে বেষ্টন করে র‌ইল আর দেবতারা দুইদিক থেকে তার মুখ ও লেজ ধরে টানতে লাগলেন। শুরু হল ভয়ানক সমুদ্রমন্থন প্রক্রিয়া। ইন্দ্রের বাহন ঐরাবত নামে হস্তী, চন্দ্র, উচ্চৈঃশ্রবা নামক অশ্ব, বৈচিত্রময় মণিমাণিক্য, পারিজাত নামক স্বর্গের নান্দনিক পুষ্পবৃক্ষ সব উঠে আসতে লাগল একে একে । এরপর অমৃতের ভান্ড হাতে উঠলেন দেবতাদের চিকিত্সক ধ্বন্বন্তরী। আর সবশেষে বাসুকীরাজের সহস্র ফণারূপ ছত্র মাথায় উঠে এলেন মা লক্ষ্মী।
প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী কার্তিকমাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশীতেই সমুদ্র থেকে উঠে এসেছিলেন ধ্বন্বন্তরী। তাই এই তিথির নাম হল ধনতেরস। তাই এই দিনটিতে ধনের উপাসনা করতে হয়। আর তার ঠিক পরেপরেই লক্ষ্মীর পুজো করতে হয়। সমুদ্রের ক্ষীরসাগর থেকে উঠে এসেছিলেন মহালক্ষ্মী। সেদিন নাকি ছিল কার্তিক অমাবস্যা। তাই লক্ষ্মীকে বরণ করে স্বর্গে ফিরিয়ে নেওয়ার অনুষ্ঠানটিতে আলোকমালায় সুসজ্জিত করা হয়েছিল স্বর্গকে।