২৯ এপ্রি, ২০১১

যদিদং হৃদয়ং


টেমস নদীর বাতাস আজ বড়ই সুখকর  । নদীতীরের শহর লন্ডনে  আজ রাজবাড়ির "শাহী-বিবাহ" অনুষ্ঠিত হ‌ইতেছে ।  রাণীমা এলিজাবেথের বড়নাতির বিবাহ । মাতৃহারা নাতি রাজকুমার উইলিয়ামের সহিত তার ইউনিভারসিটির আটপৌরে  সহপাঠিনী কেট মিডলটনের শুভ পরিণয়ে বাকিংহাম রাজপ্রাসাদের আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হ‌ইতেছে সানাইয়ের অণুরণন । সর্বত্র উড়িতেছে ইউনিয়ান জ্যাকের নীলে লালে শুভেচ্ছা বার্তা । দশ বছরের ঘনীভূত প্রেম আজ পূর্ণতা পাইতে চলিয়াছে । চারিদিকে সাজোসাজো রব । পৃথিবীর  বিভিন্নপ্রান্ত হ‌ইতে নিমন্ত্রিত রাজদূতেরা আসিয়াছেন  । উপস্থিত পাঁচশত সংবাদগ্রাহকেরা । যাঁরা রাজকীয়তাকে অতি রাজকীয় করিবার জন্য আসিয়াছেন । রাজবাড়ির পারিবারিক সমারোহে মোট দুই বিলিয়ন দর্শক উপস্থিত হ‌ইয়াছেন । নবজীবনে প্রবেশের ঠিক পূর্ব মূহুর্ত্তে রাজকণ্যা সকলকে হাত নাড়িয়া অভিবাদন জানাইয়াছেন গতকাল যখন সে আইবুড়ো ভাত  খাইতে ছিল সেই ফাঁকে  পাত্র উইলিয়াম তার বন্ধুদের সহিত দক্ষিণ লন্ডনের ব্যাটার্সি পার্ক-প্রাঙ্গণে ফুটবল খেলিয়াছে ।
 বিমাতা ক্যামেলিয়া তা জানিয়া প্রমাদ গনিলেন " বিবাহের প্রাক্কালে কি প্রয়োজন খেলিবার্? " 
উপর হ‌ইতে গর্ভধারিনী  স্বর্গতঃ ডায়না  হুঙ্কার  ছাড়িয়া কহিলেন " উহুঁ উ উ!  না বিয়াইয়া কানাইয়ের মা আইলেন !"  আশীর্বাদ করিলেন " আহা ! উহারে একটু খেলিতে দাও! বিবাহের পর যে কিরূপ রাজকীয় মুষিক-দৌড় শুরু হ‌ইবে !  না জানি আমার ভাবী পুত্রবধূ উইলিয়ামের নাসিকায় দড়ি লাগাইয়া কতকিছু করাইবে!"    
"জানা আছে ! পনের বত্সরের  পুত্রটিকে তো ত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলে , এতদিন তো এই আমিই ছিলাম তাহার সাথে; সেন্ট এন্ড্রুজ ইউনিভার্সিটি যাইবার সময় তাহার সেলফোন, রুমাল, টাই , ওযালেট আগাইয়া দিলাম । তাহার শুভ পরিণয়ের সংবাদ পাইবামাত্র চার্চে গিয়া বাতি দিলাম । এত বিশাল ঝক্কি সব একাহাতে সামলাইলাম আর উনি এখন উপর হ‌ইতে ফাঁকা মাঠে গোল দিতেছেন " উইলিয়াম-বিমাতা কহিলেন  
ডায়না বলিলেন " এ আর এমন কি ! "" রাজমাতা যদি সমর্থ হ‌ইতেন একা হাতে এই যজ্ঞ্যি সামালাইবার ক্ষমতা রাখিতেন" ক্যামিলিয়া বলিলেন " হ্যাঁ,  তাঁর তো বাতজবেদনা আর ক্ষণেক্ষণে স্মৃতিভ্রম বর্তমানে,  আর আজকাল রাজবাড়ির দাসদাসীরাও পূর্বের মত নাই । অতএব ফ্যাশন ডিজাইনার হ‌ইতে ভূষণ-পালিশ, সসেজের মশলার অনুপান হ‌ইতে কেকের ব্যাটার সবকিছুই আমাকে দেখিতে হ‌ইতেছে ।  তোমার কনিষ্ঠ পুত্র হ্যারি তো বধূমাতা কেটের ভগিনী পিপার পিছনে ছোঁক ছোঁক করিতেছে । কোনো কাজেই সে লাগিল না । আর তোমার আমার সাধারণ পতিদেব চার্লস মহাশয় তো বার্ধক্যের কারণে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ! তিনি শুধু  একটি কাজ‌ই করিতে পারেন । পানশালায় অতিথিদের ঠিকমত পানসামগ্রীর  দ্বারা আপ্যায়ন হ‌ইতেছে কিনা আর এক আধ সুরাপাত্র চুক চুক করিয়া চুমুক দিয়া আমাকে আসিয়া ঘ্ন্টায় ঘন্টায় চুম্বন করিয়া চলিয়া যাইতেছেন । " 
ডায়না বলিলেন " এ আর নতুন কথা কি ? আমি থাকিলে এতটা না বাড়িলেও তাঁর ছোটপুত্রের মত তোমার পিছনে ছোঁক ছোঁক করিতেন ইহা তো সর্বজনবিদিত ।আমি কি সাধে পলায়ন করিয়াছিলাম ! ডোডির সাথে না পালাইলে আমার জীবন দুর্বিসহ হ‌ইয়া উঠিত এতদিনে " যাক আজ আমার গর্ভের প্রথম সন্তানের বিবাহ ;  এসব অলুক্ষুণে কথা বলিব না " 
এতক্ষণে রাজবাটির দাসদাসীগণ বাকিংহাম প্যালেস হ‌ইতে গায়ে হলুদের তত্ত্ব ল‌ইয়া ওয়েষ্টমিনস্টার এবে অভিমুখে যাত্রা করিয়াছে । বধূমাতার গোলাপী গাউনের সহিত জরির ফিতা বাঁধিয়া, শ্যানেল এইট শিক্ত করিয়া ; রৌপ্য রেকাবে হীরক খচিত ব্রোচ, বিবিধ মণিমুক্তার অঙ্গুরীয় , রতনচূড়, মানতাশা, ইত্যাদি অলঙ্কার ল‌ইয়াছে । কেহ বহন করিতেছে তাহার  কেশ সামগ্রী । কেহ তাহার প্রিয় খাদ্য । বাকিংহাম প্রাসাদের প্রহরীগণ উচ্ছ্বসিত । নতুন লাল পোশাক পাইয়াছে সাথে নতুন কালো লোমের টুপিও ।  রাণীর সভাকবি ক্যারল এন ড্যাফি "রিং" নামক    বিবাহের কবিতা লিখেয়াছেন । দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রীটের ল্যারি নামক বিড়াল ক্যাবিনেটের টেবিলে বসিয়া বিবাহ দেখিতেছে ।  সেও রাজবাড়ি হ‌ইতে গলায় বাঁধিবার  ইউনিয়ান জ্যাক ভূষিত ডিজাইনার বো উপহার স্বরূপ পাইয়াছে । বিবাহ সহ দীর্ঘায়িত অবকাশের সপ্তাহ শেষে লন্ডনের নরনারীগণের ফূর্ত্তি লক্ষ্য করা যায় পথিপার্শ্বের পানশালাগুলিতে । ফোয়ারা ছুটিতেছে সিঙ্গলমল্ট হুইশকির ; স্রোতের মত শ্যাম্পেন বহিতেছে । বিয়ারের ঝর্ণায়  সিক্ত হ‌ইতেছে হোটেলগুলির কার্পেট ।  বিয়েবাড়ির ভোজনশালায় নানা রকমের কেকবেকিং হ‌ইতেছে । রাজকীয় "হগ-রোস্টের" ম্যারিনেশন পর্ব চলিতেছে । একদিকে রাজকীয় বার্বিকিউয়ের ব্যবস্থা হ‌ইয়াছে ।   
জনা পঞ্চাশ রাষ্ট্রপ্রধান এবং দুইহাজার নিমন্ত্রিত অতিথির পদার্পণ হ‌ইয়াছে ।  মহিলা অতিথিদের  টুপির বৈচিত্র্যে বিবাহালয় বৈচিত্রময় হ‌ইল । কাহারো মস্তকে একগুচ্ছ গোলাপের চূড়া । কাহারো পাখির বাসার মত লিলিফুলের বেড়া, কাহারো আবার জরির প্রজাপতি । কেউ আবার রংবেরংয়ের পালক সাজাইয়াছেন মস্তকে । এদিকে লন্ডনের বাসন্তী মেঘলা আকাশ; ড্যাফোডিল ও ফুটিয়াছে । দু এক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়িয়াছে উহার পাপড়িতে । আম জনতা পথ-উতসবে সামিল হ‌ইয়াছে । কেহ শিবিরে আশ্রয় ল‌ইয়াছে ,   নবদম্পতির মঙ্গল কামনা করিতেছে ।  অবশেষে রোলসরয়েসে চাপিয়া রাজপুত্র লাল পোশাকে  অবতরণ করিল । সাথে বরকর্তা  কনিষ্ঠভ্রাতা হ্যারি । রাণীমা আসিলেন  ডিউক অফ এডিনবরা , ফিলিপের সাথে  । ভ্রূযুগল ঈষত্‌ কুঞ্চিত । তাঁর পুত্র চার্লস সস্ত্রীক উপস্থিত হ‌ইলেন । কিন্তু বিবাহের বধূর দেখা নাই । ভোর ছয় ঘটিকায় শুরু হ‌ইয়াছে তাহার কেশ পরিচর্যা । পাঁচজন  বিশেষ কেশ বিশারদ আসিয়াছেন । 
রাণী এলিজাবেথ বলিয়া উঠিলেন " ঐ কেশ‌ই তাহার কাল হ‌ইল;   আমার বা উহার শাশুড়ি ডায়নার এরূপ তো দেখি নাই । আমাদের সময় এরূপ হ‌ইত না । ঐ জন্যই বলিয়াছিলাম  উইলিয়ামকে " যেমন-তেমন ঘর হ‌ইতে রাজবাটীতে মেয়ে ঢুকিলে সমস্যা হয় ! অমন প্রেম ঘনিষ্ঠতায় পূর্ণতা না পাইলেই নয়? তা পৌত্র আমার শুনিল না " 
চার্লস বলিল " আহ্‌, থাম না মা! যা হ‌ইয়াছে ভালোই তো " রাণী ক্রুদ্ধ হ‌ইয়া বলিলেন " মনে আছে ? আজি হতে তিরিশ বত্সর পূর্বে তোমারেও বলিয়াছি এতসব,  তুমি শুনিলে না , দেখিলে তাহার পরিণতি"   চার্লস হালকা হেসে বলিল  " থাক না মা আজ ওসব কথা "  
এরূপ বচসা হ‌ইতে হ‌ইতে যীশুর মন্দিরে পিতার হাত ধরিয়া প্রবেশ করিলেন রূপবতী কেট-কুমারী । সর্বশুভ্রা । মস্তকে হীরের টায়রা  পরিয়া এলোচুলে  । কানে হীরের দুল, গলায় হীরের ফুলফুল হার ।শুভ্র ফুল্ল কুসুমিত অর্কিড  হস্তে  ;  মুখ শুভ্র লেসের কারুকার্য করা উড়নিতে আচ্ছাদিত । ছিদ্র দিয়া সব দেখিতে পাইতেছেন কিন্তু তাহাকে কেহ স্পষ্ট দেখিতেছে না ।  সাদা ঘাগরার পিছনে যত্সমান্য রেশমী রেল । দেখিয়াই রাণি জ্বলিয়া উঠিলেন ।  
রুমালে চশমা মুছিয়া ভালো করিয়া দেখিলেন আর ফিলিপকে বলিলেন " আমি এত ঘটা করিয়া দ্বিপ্রাহরিক আহারের বিশেষ ব্যবস্থা করিলাম ।  আর আমার নাত-বৌ এর দাম দিল না ! বেনা ঘাসের অরণ্যে মুক্তা ছড়াইলাম ! হায় যীশু, তুমি কোথায়?"
 ফিলিপ বলিলেন " আহা, অত অধৈর্য্য হ‌ইলে চলিবে রাণী? অধুনাকালের পাত্রী, দিন বদলাইয়াছে । উহারা এখন বৈদ্যুতিন যুগ দেখিয়াছে ।  ফেসবুক করিতেছে । কত কত ডিজাইনারের পোশাক দেখিয়া শুনিয়া বানাইয়াছে ।  নতুন প্রজন্মের নরনারী এরা । তোমার সহিত তুলনা করিলে সংঘাত  হ‌ইবে। চক্ষু মুদিয়া যীশুর  প্রার্থণা কর । রাণি ভুলিবার নয় । বলিলেন " এমন জানিলে! অত মূল্যবান খাঁটি সোনার  হীরের অঙ্গুরীয় উহাকে না দিলেই হ‌ইত ! বানাইয়া দিলাম আমি "   
বিবাহ শুরু হ‌ইল । চার্চের আকাশ বাতাস ঘন্টাধ্বনিতে অণুরণিত হ‌ইল মেপলগাছের পাতাও শুনছে সেই শব্দ । বিউগ্‌ল বাজিতে শুরু হ‌ইল ।  সুরের মুর্ছনায় চার্চ মুখর । ক্যান্টারবেরী চার্চের ডিনের মধ্যস্থতায়  কেটের পিতা সম্প্রদান করিলেন । দুই হস্ত এক হ‌ইল । উইলিয়াম কেটের পাণিগ্রহণ করিলেন । কেটের চোয়াল দৃঢ় হ‌ইল । শপথ নিলেন বর-কনে । সম্মিলিত  প্রার্থনা সঙ্গীত হ‌ইল । ফিলিপ পৌত্রবধূর গর্বে গর্বিত পিতামহ । 
রাণিকে বলিলেন " দেখিলে রাণি? তুমি নাত-বৌয়ের নিন্দা করিতেছিলে , তোমার পুত্রবধূ  স্বর্গীয় ডায়ন র জন্য যে শপথ বাক্য " তোমার সকল আদেশ মানিয়া চলিব " পরিবর্তন করিতে হ‌ইয়াছিল , আমাদের নাত-বৌ  কিন্তু লক্ষীমেয়ের মত অবলীলাক্রমে তাহা উচ্চারণ করিয়া ফেলিল । দেখ এ আমাদের দেখিবে । সেবা করিবে । বড় বাধ্য মেয়ে । আমি উহার পিতামাতাকে জানাই"
রাণী বলিলেন " সাধে কি বলে  পুরুষের বুদ্ধি ! কদাপি মেয়ের প্রশংসা করিবে না, নতুন কুটুম মাথায় চড়িয়া বসিবে"  রাজবাড়ি প্রবেশ করুক তাহার পর যা বন্ধন দিবার আমি দিব । ভবিষ্যতের রাণী হ‌ইবার যোগ্যতা অর্জন করিতে হ‌ইবে না ? আমার যা শরীরের অবস্থা ! আমার উত্তরসুরীকে আমি স্বহস্তে লালন করিব "
চার্লস বলিলেন " মা, দেখ ডায়নাকে কেমন ধরিয়াছিলাম ! কেমন দীর্ঘকায় হ‌ইয়াছে আমার উইলিয়াম , বেশ মানাইয়াছে তাকে দীর্ঘাঙ্গী কেটের পার্শ্বে" 
এলিজাবেথ বলিলেন "  বাহ্‌, তুই না হয় নাতিদীর্ঘকায় ,  ভুলিয়া গেলি তুই কাহার পুত্র? তোর পিতার  উচ্চতার  জিনটি পাইয়াছে আমার নাতি " 
কলহের অবসান হ‌ইল । রাজরক্ষী আসিয়া রাণিকে গাড়িতে উঠিতে বলিলেন ।  দুধে আলতা পায়ে নতুন বধূ  লাল কার্পেটের উপর দিয়া চলিয়া চার্চের বাহিরে আসিল এবং ১৯০২ সালের প্রাচীন ঘোড়ার গাড়ি করিয়া বাকিংহাম রাজপ্রাসাদ অভিমুখে যাত্রা করিলেন ।  
রাজবাড়ির বারান্দায় , পোর্টিকোয়, অলিন্দে  চিলেকোঠার ছাদে এয়োস্ত্রীরা গল্পে, আলাপে আলোচনায় কত রঙ্গতামাশা করিতেছে । 
একজন বলিল " মডেলিং করা মেয়ে , দেখ আবার এ কেমন তর হয় ! "
 কেউ বলিল " " উইলিয়ামের কপালটা তার বাবার মত না হ‌ইলেই হয় , বিয়ের তারিখ দুজনের্‌ই ঊনতিরিশ " 
একজন স্মিত হাসিয়া বলিল " ইহারা নতুন প্রজন্মের বরকনে । দশ বছর ধরিয়া বাজাইয়া ল‌ইয়াছে " 
অন্য একজন খলখল করিয়া বলিয়া উঠিল " থামো থামো , মাঝে তো একবার ছাড়াছাড়িও তো হ‌ইয়া গেছিল"  
আরেকজন তো বলিয়া বসিল " কেনিয়ার গহন অরণ্যে তো সব হ‌ইয়া গেছে আজকের অনুষ্ঠান তো  প্রহসন মাত্র ।
এক রাজদাসী আসিয়া সংবাদ দিল " আসুন আপনারা বরকনে আসিয়া গেল্, উলু দিন, শঙ্খ বাজান"  
শ্যাম্পেন্-বৃষ্টি-ফোয়ারায়, হৃদয় বেলুন আকাশে উড্ডীয়মান । লন্ডনের  বসন্তে ড্য্যাফোডিল ফুটুক না ফুটুক শুভ পরিণয় সমাপ্ত হ‌ইল নিরাপদে । রাজ বারান্দা তখন চুম্বনময় !  
গুরুচন্ডা৯   ই-ম্যাগাজিনের  কূটকাচালি বিভাগ( ৩রামে, ২০১১) তে প্রকাশিত  

২৭ এপ্রি, ২০১১

অথ বিবাহ- উবাচ !

শুন শুন সর্বজন শুন দিয়া মন
রাণীর নাতির শাদীকথা করিব বর্ণন 
সেথায় পাত্র হল রাজপুত্র উইলিয়াম নাম
চার্লস-ডায়নার  জ্যেষ্ঠপুত্র , লন্ডন তার ধাম । 
অশীতিপর এলিজাবেথ রাণী সেথায় কর্ত্রী 
কেট নামে রাজকন্যা  নাতির পাণিপ্রার্থী
নাতবৌয়ের গাউন বানায় ডিজাইনার বুটিক 
সিকুয়েন্স, ফ্রিল, লেসের ঘটায় ঢাকিল রয়াল সিল্ক 
কেশবতী কেট কুমারী  ভাবিছেন বসিয়া
কেতার  কবরী বাঁধিব? না রাখিব কেশ খুলিয়া ? 
টায়রা শিরে রাখিব  নাকি পুষ্পে গাঁথিব মুকুট ? 
সোনার রিস্টলেট পরিব নাকি  শুধুই হীরের অঙ্গুঠ ? 
তালিম নিতেছে এখন সেথায় রাজবাটির গার্ডগণ
অসুস্থ হৈলেও কায়দা করিবে,  শিখিছে  সর্বখন ।
কোথায় হৈবে মধুচন্দ্রিমা কেনিয়া-সেশেলস-সিসিলি ?
প্যাপারত্জি পিছু নিবে তাই সত্য নাই বা বলি  !      
চতুর্দশ হীরকমন্ডিত বিশালাকার নীলা
এহেন  বিবাহ অঙ্গুরীয় পরিবে বধূবালা 
এটি পিতা চার্লসও যে ডায়নারে পরায়েছিল  
পরিয়া হতভাগীর বেঘোরে প্রাণ গেল  !
আমার দেশে নীলা যে বড় শুভ নয়
এ'কথাটি  রাণির কানে রাখিও নিশ্চয় ! 
এখনো সময় আছে ইমেল পাঠাও
ভনয়ে সোনারতরী রাণিরে জাগাও !

২৪ এপ্রি, ২০১১

তরাই তুমি


করিমগঞ্জ থেকে প্রকাশিত দৈনিক জনকন্ঠ, ২৪শে এপ্রিল ২০১১ 

২২ এপ্রি, ২০১১

জন্মদিনের চিঠি-মা'কে

স্বাধীনতার বছরতিনেক আগে, দিনটা ছিল ৯ইবৈশাখ ।
তুমি দেখেছিলে প্রথম ভোরের আলো,
কোলকাতার হাসপাতালে, তখন শ্বেতাঙ্গিনী নার্স ।
তোমার ধবধবে ফর্সা তুলতুলে হাত-পা, মাথাভর্তি কালো চুল
কপালে বাদামী তিল, চিবুকে কালো তিল, পিঠে লাল জড়ুল
কেউ নাম দিল তিলোত্তমা, কেউ ডাকল কৃষ্ণা কেউ গৌরী বলে ।
তুমি তখন ঘুম, ঘুম আর ঘুম !
সেই একরত্তিটি বাড়ি এলে, বাড়তে থাকলে কলে কলে আর বড় হলে 
তারপর স্কুল, গান খেলাধূলোর ফাঁকে ফাঁকে আর পাঁচটার মত ।
ভালোবাসার রূপকথা তৈরী হল তোমার  ।
তুমি তখন বেথুনসাহেবের কলেজে, আর সে চাকরীতে ।
লুকিয়ে দেখা চিলেকোঠার বিকেলগুলোয়, ছায়াছবির অন্ধকারে..  
তুমি তখন আটপৌরে ফুলিয়ার তাঁতে বছর ঊণিশ কি কুড়ি ।
পরিপাটী দুটো বেণী, হাতে সোনার চুড়ি 
তারপর একে একে সানাই, সিঁথিময়ূর, শাঁখ, উলুধ্বনি,
লক্ষীমেয়ে গুটিগুটি, চললে তুমি তার হাত ধরে 
তোমাদের সেই হুটোপাটি, ছাদের ওপর হাসিঠাট্টায়,
ঝুল বারান্দায় হাত ধরাধরি, কোলে এল ফুটফুটে দুটি ।
আজো সেই হাত ধরা তোমাদের; কত ঝড়ঝাপটার রেলিংএ
মনখারাপের কার্ণিশে আর সেই পুরোণো ছাদের প্যারাপেটে

১৪ এপ্রি, ২০১১

পয়লা-সাহিত্য-পার্বণ


 বেশ চড়চড়ে গরম । সোনালী বিকেলে মেঘ এল । আরো গুমট গরম । নৌকোখানা নিয়ে মাঝি যাবে কেমন করে একা একা ?   দমকা ঠান্ডা হাওয়া দিল । এই বুঝি ঝড়  ওঠে নদীতে । মাঝির মনখারাপ । মাছ ধরে আনবে কথা দিয়েছিল বৌকে । বৌ তার বন্ধুদের ভাজামাছ খাওয়াবে কথা দিয়েছে । নতুন বছর বলে কথা ! যে বাবুদের বাড়ি মাছ দিতে যায় তাদের সব কত চেয়ার, কত টেবিল ! কত বড় বড় কাঁচের রেকাব ।
"আমাদের তো কিছুই নেই , এতসব" কোথায় বসতে দিবি আর কোথায় খাওয়াবি বৌ?
বৌয়ের সাধ "আমাদের নৌকোখানাতেই বসবে ওরা । একটা মোটে দিন তো । আমি নৌকোয় বসেই ভাজব মাছ । আর তুমি কলাপাতায় করে ওদের খেতে দেবেখন"
"আচ্ছা তবে তাই হবে"  
"শুভ দিন , নতুন বছর। বাবুরা যেমন মাছের অর্ডার দিয়েছে, আমরাও মাছ আনব, আর কি যেন বলে ? পার্টি দেব বাবুদের মতন"
নৌকো তখন মাঝ দরিয়ায় । প্রচুর মাছ উঠেছে আজ । মেঘ সরে গেছে । চাঁদ উঠেছে । মাঝি বৌয়ের  তুলসীতলায় পিদিম, শাঁখ, ঘটে সিঁদুরের স্বস্তিকা এঁকে আমের পল্লব হ'ল। 
রঙচঙে হয়েছে নৌকোখানা । ছ‌ই এর দোরে দুটো কলাগাছ হাওয়ায় দুলছে আপনমনে ।   খোলা হাওয়া লেগেছে তার পালে । বৌ পরেছে নতুন কড়কড়ে শাড়িখানা । পায়ে রূপোর বিছুয়া । নৌকোর পাটাতনে পা ছড়িয়ে মাছ ভাজছে বসে । এসে গেছে একে একে সকলে । পুরোণো নদী , পুরোণো চাঁদ , পুরোণো নৌকোখানি। বদলায়নি কিছুই । শুধু এক নতুন ভালোলাগা । নতুন করে ভালোথাকা । নিজের লোকেদের নিয়ে নিজের মত করে থাকতে চাওয়া !  
নদীর জলে কলকল করে জল কাটছে নৌকোর দাঁড় । আপনমনে নদী চলেছে নৌকোকে নিয়ে । আর খলখল করে হাসির রোল উঠেছে..
 ১ ব‌ই-শাখে, দেখা হল ২ জনায়..

 এসো Hey ব‌ই-শাখ ! s o, s o
ছবি: শুভেন্দু দাস 
কমিউনিকেশন স্পেশালিস্ট, 
আইবিএম  করপোরেট কমিউনিকশন 


আমাকে আমার মতো থাকতে দাও  
রেখা মিত্র
মহাদেবের আর্জি 
মধুমিতা ভট্টাচার্য
ভোঁকাট্টা 
সুতপা ভট্টাচার্য বারুই
আপনমনে আমায় থাকতে দে 
রমা চৌধুরী
মন 
অদিতি ভট্টাচার্য
আমাকে আমার মতন থাকতে দাও 
অনির্বাণ রায়
বাতিঘর এক সবুজ  
মেঘ
নববর্ষ ১৪১৮  
মহাশ্বেতা রায়
সোনালী আহ্বান 
নীল নক্ষত্র
২২ নভেম্বর, গোপন রহস্য উদ্ধার 
হামিদা রহমান
এক বৃদ্ধ ও এক যুবক 
আমিনুল ইসলাম মামুন
লিখিনু যে লিপিখানি 
ইন্দিরা মুখার্জি
ছবিতা 
সোমা মুখার্জি 
আমার পয়লা বৈশাখ   
আইভি চট্টোপাধ্যায়
আমাকে আমার মতো  
কল্যাণবন্ধু মিত্র
একটি কুকুরের বদলে যাবার গল্প  
মুরাদুল ইসলাম
আমার‌ই মত এই আমি 
সংঘমিত্রা নাথ  


পয়লায় ৯ ১লা 

আনলিমিটেড  ব্লগবাজি, ই-পাড়ায় টোটো-টোকলা, সোশ্যালনেটে টুইটুই,  ডিজিটাল সেলিবদের সঙ্গে চ্যাট-বিলাস, লিটলম্যাগের রিয়েলিটি শো       



  • হেল্থ-e-ফুড  
  • মান্থলি-e-ম্যাগাজিন  
  • চৈত্রসেলে-e-শপিং
  • এন্ড্রয়েড vs আইফোন তর্ক 
  • গুগ্‌লক্রোম, এক্সপ্লোরার, ফায়ারফক্সের রেস
  • ডিজিটাল বন্ধুত্ব 
  • রিয়েল vs  ভার্চুয়াল প্রোফাইল 
  • জি-টকে ঝগড়া 
  • সারারাতব্যাপী ইউটিউব-জলসা    
  • নতুন সোশ্যাল-মিডিয়া 
  • নতুন  ওয়েবম্যাগ 
  • নতুন ব্লগ-বিজ্ঞাপন    



মধুরেণ তুষ্টি তাম্বুলে
কাঁচামাল :

টাটকা পালংপাতা  
তেঁতুল আর গুড়ের মিষ্টি চাটনি
শুকনো খোলায় ভাজা চীনে বাদাম কুচি
কাঁচা আমের ঝুরি
পেঁয়াজ কুচি
কাঁচালঙ্কা কুচি
সেওভাজা
ধনেপাতা কুচোনো
চাট-মশলা 

কেমন করে ?

যেমন করে পান সাজে ঠিক তেমন করে | পালংপাতা ভালো করে ধুয়ে নিয়ে চুনের বদলে চাটনী মাখিয়ে আর সুপুরী, মৌরী, মশলার বদলে বাকী সব দিয়ে মুড়ে ফেলুন আর টপ করে মুখে পুরুন এই "দিল-জ্বলা" পানটি!   


লিখিনু যে লিপিখানি : ইন্দিরা মুখার্জি



বছর 
আবার বিনা নিমন্ত্রণে পা বাড়ালাম তোমার কাছে । তোমার চেহারাটাই কেমন জানিনা । তোমাকে দেখতে কেমনতুমি কতটা ভালকতটা খারাপ তা বুঝতে না বুঝতেই তোমার চলে যাওয়ার সময় হয়ে যায় আর আমার তোমার কাছে যাবার সময় হয়ে যায় । প্রতিটি আলোকবর্ষ পেরিয়ে যায়, তোমার নোটিশ এসে যায় বাড়ি ছাড়ার । আর আমার নতুন বাড়ির হাউস ওয়ার্মিং পার্টির তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় । সময়ের সাক্ষী হয়ে থেকে যায় প্রতিটি মূহুর্ত্ত। সময়ের দলিলে 
স্বাক্ষর রেখে চলে যাও তুমি । প্রতিটি মাসপ্র্তিটি দিনপ্রতিটি রাত তৈরী করে যায় নিজের নিজের নজির । ফুলের পাপড়ির মত একটা একটা করে খসে যায় প্রত্যেকটা দিন । জন্ম হয় নতুন দিনের । কেমন যেন চেনা আশপাশে অচেনা একটা দিন । কালের ছায়াপথ ধরে হেঁটে চলে যায় দিনেরা । একটা মাত্র চাঁদের ৩৬৫ দিন ধরে পর্যায়ক্রম হ্রাসবৃদ্ধি প্রতিদিনের জোয়ার-ভাটা 
 দিনরাতের খেয়ালখুশিরাহাসিকান্নারা চলে যায় তোমার হাত ধরে । তোমার ৩৬৫টা দিনের যেন রামধনু রঙ । ঝোড়ো হাওয়ায় রঙগুলোকে ফাগের মত উড়িয়ে নিয়ে যাও তুমি । কখনো দিয়ে যাও এক রাশ ঠান্ডা হাওয়াকখনো দুপশলা বৃষ্টির গন্ধ কখনো বা মুঠো মুঠো রোদের উষ্ণতা । তুমি কেড়ে নিয়ে যাও কত জীবন খালি করে দাও কত মায়ের কোলভেঙে দাও কত নদীর পাড়; আবার দুহাত ভরে দিয়ে যাও কত কিছু । ছুঁয়ে যাও মন; ভিজিয়ে দাও দুচোখের পাতাকে আনন্দের কান্না দিয়ে । তুমি তো চললে বছর একবারো কি ভাবলে তোমার পুরোণো বন্ধুর কথা 
বছর আমিও চললাম তোমার সাথে কারণ তোমার খেয়ায় পা দিয়ে তো বসেই আছি ।
তুমি আসবে বলে ঘর ঝাড়াপোঁছা । তুমি আসবে বলে সেই অছিলায় নতুন জামা । তোমার আসার আনন্দে হৈ হৈ করে হ্যাঙ আউটের প্ল্যান । তোমার জন্যে নবপঞ্জিকাহালখাতা আর নতুন ক্যালেন্ডার । 
ভালো থেকো বছরটা । ভালোটি হয়ে থাকব আমিও যদি তোমার ভালোটুকুনির মধ্যে থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি । একরত্তি এই জীবনটাকে ভালোবাসায়মন্দবাসায় ভরিয়ে রেখো । তোমার তো ৩৬৫রকম জীবন থাকবে কিন্তু আমার তো একটাই । কথা দিলাম ভালবাসব । কথা দিলাম তোমায় ভালো রাখব ।  আবার গরমের বিকেলে গা ধুয়ে পরে নেব মলমল শাড়িখানা বরষার সান্ড্যাক চটিজোড়া যত্ন করে রেখে দেবভাদ্রের রোদে পুরোণো বালুচরি রোদ খাওয়াবশীতের পশমিনা-বালাপোশ মথ বলের গন্ধে ভরপুর করবে । ফাগুনের আগুন নিভে যাবে দোলের সাথে সাথে আবার শুরু হয়ে যাবে তোমার যাওয়ার তোড়জোড় আর আমার বাড়ি বদলের পার্টি !
তোমার সাথে যাব বলে আমিও সেজেগুজেনতুন জামা কাপড় পরে বসে আছি আমার মত । শুধু তোমার অপেক্ষায় । তুমি যেমন খামখেয়ালি ইচ্ছেডানায় উড়ে চল রোজতেমনি করেই আমিও যাব কথা দিলাম । শুধু আমাকে আমার মত থাকতে দিওএই টুকুনি চাইলাম তোমার কাছে । তোমার যেমন বয়সটা এক এক করে বেড়ে যায় প্রতিবারের পয়লা বোশেখে আমারও তো বাড়ে । তাই যত না পাওয়ার গল্পটানষ্ট জীবনছারখার জাহাজ মাস্তুল সরিয়ে রেখে নিজেকে নিজের মত গুছিয়ে নাও । আর আমাকে আমার মত থাকতে দাও !
ইতি
তোমার নতুন নৌকোর পুরোণো যাত্রী   

ইন্দিরা মুখার্জি  
ব্লগার




















[ ১ম পাতায় ফেরত ]

আমাকে আমার মতো : কল্যাণবন্ধু মিত্র


আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ। আমি কারোর সাতে-পাঁচে থাকি না। আশেপাশে কার ঘরে কি ঘটছে না ঘটছে সে নিয়ে মাথা ঘামাই না।বাজারদোকান,অফিস,ছেলে, মেয়ে, কুকুর, বউ, সিরিয়াল...ব্যস্‌ ,এর বাইরে আর কিছু জানিনা। কারণ আমি আমার মতো থাকতে চাই’। এই হলো আজকের গড়পড়তা মানুষের মনের ভেতরকার ছবি।
আধুনিক কাল আমাদের ‘স্বার্থের জমিটাকে’ এইভাবে ক্রমশঃ ‘ঊর্বর’ করে তুলছে।সেই ঊর্বর জমিতে ‘সবুজ ফসল ফলানো’র ধান্দাবাজি চাপা দেওয়ার ধামা হিসেবে এমন ধাপ্পাবাক্যের কোন জবাব নেই।“আমাকে আমার মতো থাকতে দাও”!
আমার বাবা প্রতিদিনই বাজার যাবার সময় একগোছা পোস্টকার্ড নিয়ে বেরোতেন ডাকবাক্সে ফেলবেন বলে। সে-সব পত্রপ্রাপকদের মধ্যে হাতে গোনা ক’জনের  উত্তর আসতো।যারা  চিঠির প্রাপ্তিস্বীকারটুকুও করে না,পয়সা খরচ করে বারবার কুশলবার্তা জানতে চেয়ে তাদের চিঠি লিখে কি হবে ? কী আশ্চর্য,অতোদিন আগে এই কথার জবাবে বাবা বলেছিলেন , ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’।
মাঝেমাঝে ভাবি, এই মানুষটা সত্যিই যদি  নিজের মতো থাকতেন,তাহলে কী বিপুল সম্পদ-ই না তিনি অর্জন করতে পারতেন!মধ্যবয়সে তার সামনে এসেছিলো এক সুবর্ণ সুযোগ।যে সুযোগ জীবনে একবারই আসে।কিন্তু সুযোগকে “হ্যাঁ” বলার বদলে তিনি সরাসরি “না” বললেন ।কারণ ঠাকুমা তখন পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গেছেন। বাড়িতে যদিও ঠাকুমা দৃষ্টিহীন চোখেই স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেন সর্বত্র,নিকটজনেরা আসেন তাঁর সাথে গল্প করতে, কিন্তু অচেনা পরিবেশে নির্বান্ধব অবস্থায় তিনি সারাটা দিন কাটাবেন কি করে ?শুধু এই কারণেই সুযোগপ্রাপ্তদের মধ্যে একমাত্র বাবা-ই রয়ে গেলেন কলকাতায়।বাকি জীবনটা কাটালেন পুরানো পদে-ই,অনেক কম বেতন ও সুযোগসুবিধাকে হাসিমুখে শিরোধার্য করে।
নিজের অপরিনামদর্শী ঋণজর্জর ভাইকে পাওনাদারের হাত থেকে রক্ষা করতে কী পরম মমতায় সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন তিনি ,সে তো বারবার-ই দেখেছি।একবার এইরকম পরিস্থিতিতে বাবার নিজেরই টাকার ভাঁড়ার শূন্য,তা-ও তিনি ভাইকে বিমুখ করেন নি,কিভাবে যেন সব সামাল দিলেন।নিজের কষ্টার্জিত অর্থের বিরাট অঙ্ক জলাঞ্জলি দিয়ে ভাইকে সম্মানহানি থেকে বাঁচালেন।তখন এমনটাই হতো।শুধু ভাই কেন,প্রতিবেশীর বিপদেও মানুষ নিজেকে আড়ালে রাখার অভিনব সব কায়দায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে নি।তখনকার যুগের মুখে “আমাকে আমার মতো থাকতে দাও” ধরণের নির্লজ্জ আত্মকেন্দ্রিক-বার্তাময় সঙ্গীত সত্যিই অকল্পনীয় ছিল।স্বার্থপর মানুষ কি তখন ছিল না ? সংখ্যায় কম হলেও তারা সেযুগেও জন্মগ্রহণ করতো।কিন্তু আপন-আপন স্বভাবের জন্য তারা প্রকাশ্যেই নিন্দিত হতো।অমানবিক কাজ অর্থকৌলীন্য দিয়ে ঢাকা যেতো না।   
আমার পারিবারিক গণ্ডিতে দীর্ঘদিন আমিই ছিলাম সবার স্নেহের একচ্ছত্র অধিরাজ। কিন্তু সেই সময় আমাকে আমার মতো করে থাকার শিক্ষা দেওয়া হয় নি। যে কোনো সুখাদ্য অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে খেতে শেখানো হয়েছিলো আমাকে।আজ প্রায় সব ছেলেমেয়ের কানে তার-তার নিজের মতো করে জীবনযাপনের মন্তর দেয়া হচ্ছে ঘরে বাইরে । সেই মন্তর প্রথমে ঘর ভরিয়ে দেয়,ধাঁধা লাগায় প্রাপ্তির চমকে-ঠমকে।তারপর  আসে এক মর্মান্তিক আবিষ্কারের লগ্ন।এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপে চলচ্ছক্তিহীন একা নিজেকে দেখার পালা। অন্যরা সবাই,এমনকী আপনজনেরাও তখন যে যার নিজের মতো করে থাকছে ! তাদের আর অন্যদিকে তাকাবার সময় কোথায় ?

কল্যাণবন্ধু মিত্র
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের  বিধি নির্দেশক দফতরের বিশেষ দায়িত্ত্বপ্রাপ্ত অফিসার











[ ১ম পাতায় ফেরত ]

আমার‌ই মত এই আমি : সংঘমিত্রা নাথ



মনের ভিতরে যখন খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ি, তখন মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ছায়া ঘেরা বনের মধ্যে সবুজ ঘাসের উপর হাত-পা ছড়িয়ে চোখ বুজে শুয়ে থাকি, মাথার উপর গাছের উপর শুধু থাকুক ছোট ছোট রঙিন পাখির কিচিমিচি। গভীর কান্না বুকে নিয়ে নিঃশব্দ জ্যোৎস্না ভরা ছাদে বসে থেকে দু’চোখের জলে মনের ব্যাথা ধুয়ে পেয়েছি শান্তি। ইয়ুমথাং-এ যাবার আগে যে লাচুং গ্রামে রাত কাটিয়ে ছিলাম, সেখানে মাথা উঁচু ক’রে দাঁড়িয়ে থাকা স্তব্ধ পর্বতের নীচে লাচুং নদীর তীরে বসে ভোর বেলার আলোয় হাত জোড় ক’রে গাইতে ইচ্ছে করেছিল এমন গান যা আমি কখনও গাইনি – মনের মধ্যে খুঁজে পাইনি তাকে, তাই নদীর কলতান শুনেছিলাম পাথরের উপর বসে বসে। আমাকে আমার মতো থাকতে দিও না – আমাকে থাকতে দাও তোমাদেরই মাঝে, তোমাদেরই একজন হয়ে – আমার ভালবাসা, অভিমান, হাসি, বেদনা, চাওয়া-পাওয়া, আশা-হতাশা সব তোমাদের নিয়ে, সব তোমাদেরই ঘিরে। 

ছেলেবেলায় খুব মনে হ'ত জানো ? আমাকে কেন এত নিয়মের শৃঙ্খলে থাকতে হবে ? কেন আমি আমার নিজের মত থাকতে পারব না , নিজের ইচ্ছেমত চলতে পারব না । ক্রমশ: এই নিয়মের শৃঙ্খলটাই অভ্যেস হয়ে গেল । ঠিক তোমাদের জীবনেও যেমন হয়েছে । তারপর এই অভ্যেসগুলোকেই কখনো ভালবেসে কখনো না ভালবেসে কখনো বিরক্তিতে অনুসরণ করে চলেছি । রিক, আমার ছেলে বলেছিল -" অভ্যাস মেনোনা মা, নিয়ম মেনোনা -নিয়ম থেকে বেরিয়ে নিজের মত সময় কাটাও, তবেই আনন্দ পাবে" ভাবছিলাম, তাই কি ? তাহলে সেবার ক'দিন  বাইরে কাটিয়ে বাড়ি ফিরে রাতে সোশ্যাল-নেটওয়ার্কিং সাইটে নিজের অর্কুট, ফেসবুক আর কমিউনিটিতে গিয়ে যখন দেখলাম আমার জন্য অজস্র মানুষের বার্থডে উইশ এসে জমা হয়েছে তখন দারুণ আনন্দ পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল সবার মধ্যে থেকে যে আনন্দ পাওয়া যায় সেটা অনেক । জীবনে চলার পথে অন্যকে খুশি করে চলার মধ্যেও এক পরিতৃপ্তি আছে । আমি আমার মত করে চলতে পারি যদি আমার সেই চলা অন্যদের ভাল লাগে ; আমার মনের গান যদি অন্য কারোর ভালো লাগে তবেই না আমার গান গাওয়ার সার্থকতা; আমার লেখা কবিতা হয়ে ওঠে যখন  অন্য কেউ তা কবিতা বলে পড়ে ।   



সংঘমিত্রা নাথ
ইংরেজি শিক্ষিকা , গড়িয়া হরিমতি দেবী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় 
নেশা  : গান করা 









[ ১ম পাতায় ফেরত ]

ভোঁকাট্টা : সুতপা ভট্টাচার্য বারুই


কোনোদিন আমার করে আমার থাকা হয়নি
 তোমার কসরতে আকাশ ছুঁয়ে
একটা হলদে ঘুড়ির  মত উড়তে উড়তে
আটকে গেছি ‘ইলেক্‌ট্রিক পোল’এ ।
পথচারীর দল কখনো অবাক হয়
কখনো মজা খোঁজে...
শুধু  দক্ষিণের জানালায় বৌটা
 আয়নার বদলে এদিকে নির্নিমেষ চেয়ে থাকে।


সুতপা ভট্টাচার্য বারুই
নেশা -- লেখালেখি
পেশা -- ব্যবসা [বুটিক]

আমাকে আমার মতন থাকতে দাও : অনির্বাণ রায়



পাঞ্চলাইন হরণের স্বর্ণযুগে এই লাইনটা ধার না করে থাকতে পারলাম না। নিজের ইচ্ছেতে যতবার শুনেছি, তার চেয়ে ঢের বেশিবার অন্যের ঠেলায় শুনতে হয়েছে – সৌজন্যে কলার টিউন। কিন্তু এই লাইনটা রচনার প্রশংসা না করে পারছি না। এত নম্র ভদ্র আর্তির মোড়কে বেশ কড়া একটা মুখঝামটা লুকিয়ে আছে – ‘নিজের চরকায় তেল দাও’।

রোজকার জীবনে এই লাইনটার প্রাসঙ্গিকতা অপরিসীম। অফিসের কোনো বড় কর্তা যখনই দলগত সংহতি জাতীয় বক্তব্য রাখেন, কেন জানি না মনের ব্যাকগ্রাউন্ডে এই লাইনটা গমগমিয়ে বাজতে থাকে। নববর্ষ বা বিজয়ার পরে কিছু অপ্রয়োজনীয় আত্মীয়ের সাথে খেজুরে আলাপচারিতাতেও এই লাইনটা বেশ জ্বলজ্বলে। যখন অফিসফেরৎ ট্রেনে জানলার ধারের আলতো তন্দ্রাটা কোনো হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়া বকবকে পরিচিতর অত্যাচারে বিপন্ন হত, এই লাইনটাই যেন অসহায় ভাবে হাতড়ে বেড়াতাম। সেই সময় না থাকুক, আজ তো আছে। সেই সমস্ত মানুষ যারা তাদের না-চাওয়া মতামতের ঝুড়ি নিয়ে সময়ে-অসময়ে বিব্রত করে বেরায়, তাদের মতুয়া নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে আমার আজকের হাতিয়ার – ‘আমাকে আমার মতন থাকতে দাও’।

নিজেদের অলস সময়কে অন্যের জীবনের বিরক্তিতে রূপান্তরিত করা কিছু মানুষের জন্মগত প্রতিভা। এই প্রতিভারা পাটিল হলে হয়ত রাষ্ট্রপতি হতে পারত, কিন্তু বাতিল হওয়ায় এরা আজ মূর্তিমান ত্রাস। বিশেষত আমার মতন ‘হ্যাপিলি সিঙ্গল’ শ্রেণীর গোবেচারাদের জীবন আজ এদের দয়ায় বিপন্ন। অবিবাহিত জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের বিন্দুমাত্র ত্রুটি আবিষ্কার করতে না পারলেও, তাদের অস্তিত্ত্বে এদের ঘোর অস্বস্তি। ভাগ্যদেবীর বিরূপতায় এদের সম্মুখীন হওয়ার চেয়ে বাঘের গলায় মালা পড়ানো বোধহয় অপেক্ষাকৃত সহজ কাজ। ঈশ্বরের দয়ায় আজ এদের ভাইরাল আক্রমণের বিরুদ্ধে আমার প্রতিষেধক – ‘আমাকে আমার মতন থাকতে দাও’, সঙ্গে মহীনের ঘোড়াগুলি থেকে ছোট্ট নোট, ‘কখনও কি দেখেছ নিজেদের দিকে তাকিয়ে?’



অনির্বাণ রায়
পেশা সফটওয়ার
নেশা খেলাধূলো, গানবাজনা ও লেখালেখি   

[ ১ম পাতায় ফেরত ] 

বাতিঘর এক সবুজ : মেঘ



সবুজ আলোর ফুটকি।
অপার্থিব সেই আলোই ছিল মাধ্যম।
পরস্পরকে চিনেছি আমরা এভাবেই। ধীরে ধীরে ভাবতে শিখেছি, এই আলোকবিন্দুর মধ্য দিয়েই একে অপরের সুখ-দুঃখকে ভাগাভাগি করে নিচ্ছি। দু'জনের কাছে দু'টো আলোকবিন্দু, যাকে আমরা ডাকতাম সবুজ ফুটকি। আমাদের একটা নদীও ছিল। নদীর কাছাকাছি থাকতে ভীষণ ভালো লাগত আমার, মন খারাপ করা সন্ধ্যেগুলো সেই নদীটার কাছেই কাটিয়ে দিয়েছি। কে না জানে মন ভালো করে দিতে নদীর মত বড় বন্ধু আর কে আছে! নদীর কাছে গেলেও সবুজ ফুটকিগুলো কিন্তু আমাদের পাশে পাশেই চলত। তবুও হঠাৎ একদিন একটা সবুজ ফুটকি নিভে গেলো। ওর কি হয়েছে জানা গেল না। আর তারপর থেকে তুমিও নিরুদ্দেশ। কোথাও তোমাকে আর পাই না। পাই না সেই সবুজ বিন্দুটিও। ওকে আর তোমাকে কোথায় কোথায় না খুঁজেছি আমি। খানাখন্দে পড়তে পড়তেও রাস্তাটা ধরে সোজা একা হেঁটে গেছি। কোথাও যখন পেলাম না তোমাদের কাউকে তখনই আমি একটা ছায়া খুঁজেছি।

পেলাম ঠিক কিন্তু সেখানে আবার হরেক রকমের ছায়া পাওয়া যায়। কালো ছায়া, ধুলো ছায়া, বেটে-লম্বা, লাল-নীল, সাদা-কালো, আনন্দ-বিষাদ সব ধরনের ছায়া সেখানে। প্রথমে বুঝে উঠতেই পারিনি কোনটা নেব। পরে ভেবে দেখলাম প্রত্যেককেই আমি দেখতে চাই। যদি দেখি ওদের কারো মধ্যে সবুজের বদলে সামান্য হলুদ আভাও আছে তাহলেই সেই ছায়াকে সঙ্গী করে নেব। নাহ্, কোন ছায়াই আমার পছন্দ হলো না। কারও মধ্যেই সবুজ বা হলুদ রঙা আলোর ফুটকি পেলাম না। আবার আমি ছায়া সন্ধানে বেরোলাম। এপথ-ওপথ ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে যখন বুঝে গেলাম কোনো ছায়াই তোমার পরিপূরক নয়, ঠিক তখনই আমি ফিরে এলাম নিজের কাছে।

হ্যাঁ, বলছিলাম আমার সেই সবুজ আলোর ফুটকির কথা, আমি সযত্নে রেখেছি রাধাকৃষ্ণের মূর্তিটার পাশে। রোজ জল দিই, রোজ রোদ খাওয়াই । তারপর সন্ধ্যেবেলা আবার ঘরে তুলে রাখি। এই আলোকবিন্দুটি যাকে আমি সবুজ ফুটকি বলছি সে একসময় সত্যিই নাজুক ছিল ভারি। ওকে যত্ন না করলে কবেই মরে যেত। আমি জানতাম এই বিন্দুটিকে সাথে সাথে রাখতে হবে। জানি, ওকে সাথে করে আমি পৌঁছে যেতে পারি আমাদের ছায়াপথে। আমি জেনে গেছি এইসব বিন্দুগুলোকে আগলে রাখতে জানলে কেউ যেমন হারে না তেমন হারায়ও না। নিজের অবস্থানটি চিনে নিয়ে সে নিজের মত করে বেঁচে থাকতে শিখে যায়!

আমি জানি তুমি কেমন আছ! তুমি এখন চেনা গন্ডির সীমানা ছুঁয়ে, আটপৌরে হয়ে, চাঁদ দেখে দেখে বাঁচো। এও জানি সূর্যপীড়িত তুমি সবার দৃষ্টি আড়াল করে রুমালে মুছে নাও মুখ। তোমার মুখে ঘামের বদলে লেগে থাকা তোমার যাবতীয় আবেগ ও মুখে লেগে থাকা ঝুরোকুচি প্রেম তুমি মুছে ফেলতে চাও । আবার সেইসব পূর্ণিমা রাত এলেই তুমি অসহায় হয়ে মাটি খামচে পড়ে থাকো। স্মৃতি নামক যে অংশটি তোমার মাঝে বসবাস করে সে এসে আঁচড়ে দেয়, কামড়ে দেয়, ক্ষতবিক্ষত করে তোমাকে।

আমার দিকে তাকাও।
দেখ,
কীরকম সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আমি!
আমাকে কোনো আড়াল খুঁজতে হয় না।
ধূসর হয়ে, অদৃশ্য হয়ে লুকিয়ে পড়তে হয় না!
আমার গড়ে তোলা পৃথিবীতে বেশ আছি। আমি আমার মত করে আছি, জানি তুমিও ফিরবে একদিন সেই সবুজ ফুটকি হাতে আমার সত্যের কাছে, সুন্দরের কাছে।

তোমাকে ফিরতেই হবে হে সবুজ আলোর ফুটকি!

 মেঘ
পেশা- গ্রাফিক ডিজাইনার
নেশা- ব্লগিং, বই পড়া, ভ্রমণ










[ ১ম পাতায় ফেরত ] ..

নববর্ষ ১৪১৮ : মহাশ্বেতা রায়


'আমাকে আমার মত থাকতে দাও...' - হ্যাঁ, এই কথাটা বেশ গম্ভীর গম্ভীর গলায় বলতেই পারে নতুন বঙ্গাব্দ - নেই নেই করে বাংলা চতুর্দশ শতক এইবার আঠেরোয় পা দিয়েই ফেলল যে ! আর কে না জানে, আঠেরো বছর বয়স মানেই বড় হয়ে যাওয়া, কাগজে কলমে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যাওয়া, হয়ত বা অনেক কিছু করার ছাড়পত্রও পাওয়া !

আঠেরো বছর আগে যখন বঙ্গাব্দ ১৪০০য় পা দিল, মনে আছে তখন নানান উতসব উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে তাকে স্বাগত জানানো হয়েছিল। হিসেব করে দেখতে গেলে, সেই আঠেরো বছর আগে আমি নিজেও আঠেরোর আশেপাশেই ছিলাম। মানসিক ভাবে কতটা প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছিলাম তা আজ আর সত্যিই মনে নেই, কিন্তু কাগজে কলমে "বড়" হয়ে কোন একটা পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রথম বার ভোট দিয়ে এসে , বাঁ হাতের মধ্যমায় বেগুনী রঙের দাগটাকে দেখে দেখে বেশ কয়েকদিন যে খুব উত্তেজিত বোধ করেছিলাম তা বলতে পারি।

যদি ভাবতে বসি চতুর্দশ শতক আঠেরোয় পা দিয়ে কি করবে, তাহলে কেমন হয়? সত্যিই কি সে হয়ে উঠবে প্রাপ্তবয়স্ক? তার কাছ থেকে আমাদের কি কি আশা করার আছে? হয়ত নেহাতই কাকতালীয়, কিন্তু এটা ঘটনা যে আঠেরোয় পা দিয়েই চতুর্দশ শতক সম্মুখীন হতে চলেছে এক জমজমাট নির্বাচনের। কাকে জেতাবে সে, কে তার পছন্দ, এই নিয়ে নাহয় আর কথা নাই বা বাড়ালাম; হাজার হোক, সে এখন প্রাপ্তবয়স্ক, তার ভাবনা চিন্তা পছন্দ তারই; সেখানে অন্য কেউ কথা না বলাই ভাল।

কিন্তু এছাড়া? আঠেরোয় পা দিলেই তো হল না, বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে এসে পড়ে কিছু দায়িত্ব, কিছু আশা পূরণের অংগীকার। বড় হয়ে গেছি, তাই 'আমাকে আমার মত থাকতে দাও...' বললেই কিন্তু সেই দায়িত্ব এড়ানো যায়না। সবাই যে যার নিজের মত থাকতে চায়, একে অন্যকে পরোয়া করে না, রাস্তায় একে অপরকে ধাক্কা মেরে চলে, যেখানে সেখানে থুতু আর পানের পিক ফেলে, যেমন ইচ্ছা তেমন করে গাড়ি চালায়, সিগনালের তোয়াক্কা না করে রাস্তা পার হতে গিয়ে আরো বেশি জ্যাম তৈরি করে,  বেলাইনে গিয়ে  কাজ সারতে চায়, নির্দ্বিধায় ঘুষ দেয় আর ঘুষ খায়, বেদম আলসেমি করে, কাজের জায়গায় অকাজ করে বেশি,  তোমার দরজার সামনে নিজের  বাড়ির নোংরা ফেলে যায়, অকারণে ঝগড়া করে, বিনাকারণে মন কষাকষি করে...১৪১৮'র কাছে যদি এই আশা রাখি যে সে এই সব কিছুকে বদলে দেবে, অন্তত চেষ্টা করবে - সে কি পারবে আমার এই আশাপূরণ করতে? 

আমি জানি, যে কাজের ফিরিস্তি দিলাম, তা কারোর পক্ষেই একদিনে বা একলার পক্ষে করে ওঠা সম্ভব নয়। আঠেরো বছরে পড়া চতুর্দশ শতক হয়ত তার এলোমেলো চুল ঝাঁকিয়ে, ব্র্যান্ডেড জিন্‌স্‌ আর টি-শার্ট গায়ে চাপিয়ে, গুজরাতি কাজ করা স্লিং ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে, কানে আইপড লাগিয়ে, তন্দুরি চিকেন ফ্লেভার্ড্‌ পিত্‌জায় কামড় দিয়ে, মোবাইল থেকে ফেসবুক আর অর্কুটে আপডেট পাঠাতে পাঠাতে আমার নাকের সামনে দিয়ে বলে চলে যাবে - "এইসব টু-ডু লিস্ট আমাকে ধরিও না, আমাকে আমার মত থাকতে দাও..." 

কিন্তু আমি যে জানি,  'আঠেরো বছর বয়স জানেনা বাধা...' , তাই, আশা করতে তো আপত্তি নেই ! সেই আশায় বুক বেঁধেই নাহয় আরো একবার বাংলা সনের জন্মদিন পালন করব আমরা -  প্রভাতফেরি হবে, বাংলা - বাংলা ভাষা- বাঙালি সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে নানাধরনের উতসব-অনুষ্ঠান- আলোচনা হবে, পেটপুরে বাড়িতে- রেস্তোঁরায় খেতে-ভুলে-যাওয়া-কচুর শাক বা রাঁধতে-কঠিন-চিতল মাছের মুইঠ্যা খাওয়া হবে, নতুন কাপড়ের পাট ভাঙা হবে, হালখাতা হবে... স-অ-অ-ব হবে, প্রতি বছর যেমন হয়। কিন্তু তারপরে?

ইংরেজি নববর্ষের মত হইচই করে বাংলা নতুন বছরে 'রেসোলিউশন' নেওয়ার অভ্যাস হয়ত আমাদের নেই, কিন্তু চেষ্টা করতে ক্ষতি কি -এই বছরে আমাদের সবার মনে আসুক আরেকটু দায়িত্ববোধ,  আসুন নতুন বছরের হাত ধরে শিখে নিই আর শিখিয়ে দিই কেমন করে আরেকটু ভালভাবে বাঁচতে হয়।

সূর্যের প্রখর দাবদাহে তপ্ত গ্রীষ্মের দুপুরে কখন হটাত করে ধেয়ে আসবে সব ওলটপালট করা প্রাণজোড়ানো কালবৈশাখী - আগে থেকে কেউ কি বলতে পারে? 

মহাশ্বেতা রায়
পেশাঃ ওয়েব ডিজাইনিং ও লেখালিখি
ভালবাসাঃ ইচ্ছামতী, ছোটদের জন্য বাংলা ত্রৈমাসিক ই-পত্রিকা









[ ১ম পাতায় ফেরত ] ...

সোনালী আহ্বান : নীল নক্ষত্র


বরষ পরে আবার এসেছ বৈশাখ
সোনার তরী বেয়ে
স্বাগতমস্বাগতম হে নতুন
তোমায় বরণ করি ভালবেসে।

প্রভাতী তারার মালা গলায় পরে
সুখের পায়রা হয়ে চঞ্চল পায়ে
এনেছ আবার দূরন্ত মৌসুমী ঝড়
কাঠ ফাটা তৃষা
চাতকীর চেয়ে থাকা আকাশে।

মেঘে মেঘে ঢালো বারিধারা
সাজাতে সুখের ধরনী
হৃদয়ে সঞ্চারো আশা
দ্বীপ জ্বালো সোনার বরনী।

শূন্যতার অভিশাপ করে উন্মোচন
এসো আবার নতুন করে
ফুলে ফুলে ভরে দাও তৃষিত ভালবাসা
মুছে দাও বেদনা কান্না
তোমার মধুর আহ্বানে।


নামঃ ওই তোছবিতেই লিখে রেখেছি।
পেশাঃ পাগলা হাওয়ার যাযাবর
নেশাঃ নীল সাগরের বুকে স্বপ্নের পাল তুলে ভেসে বেড়ানো













[ ১ম পাতায় ফেরত ]

২২ নভেম্বর, গোপন রহস্য উদ্ধার : হামিদা রহমান


ধারেকাছে নয় সুদূর থেকে তারে ভেসে আসে অভিপ্রায়ের সুখ। সুখটা যদি গায়ে মাখা যেত... যদি বন্দি করা যেত সিন্দুকে। আমার বসবাস অন্যগোলার্ধে, প্রতিক্ষীত দিনটি আসতে আরো তেরো ঘন্টা বাকি। এই তেরো ঘন্টায় অনেক কিছু হতে পারে...। উদযাপনের মূল্যবান সময়ের ধাক্কায় পিছনে ছুটি জিইসির মোড়, লালখান বাজার, জিলাপি পাহাড়সহ সাঁতার কাটি পতেঙ্গার উত্তাল সাগরে। ভাবি এবেলায় হোক ভাগাভাগি, মুক্তির হিসেব-নিকেশ; একটু সান্ধ্যসঙ্গমে চোখ বুজি মনে মনে

ঠাণ্ডা হানা দিয়েছে শহরে। বাইরে মিষ্টি রোদেও হাত-পা গুটিয়ে আসে। এই শহরের কত রূপ, কত জাতি, কত সংস্কৃতির লোক বাস করে, সবাই কি সুখী? সে ভাবনা মনের দ্বৈত বসবাস। মনে মনে হাঁটি আমার প্রিয় শহরে আর পা ফেলি অন্যশহরে। আবেগ জমানো সুখ ঢাকি, মুখ লুকিয়ে অনিচ্ছায় আবারও ঠাণ্ডা হাওয়ায় মিশে যাই

অনেক পর্যবেক্ষণের পর দিগন্তে জমে থাকা ধোঁয়ায় উপহারের অধিক গুরুত্বে স্নাত হই আরেকবার। সে এক অসাধারণ মহৌষধ; মোক্ষম সময়ের ফিতা টেনে টেনে এর দৈর্ঘ্যে কাগজের লেপ, টুপিতে নিজেকে আবরণ করে একটি উদগত রাতযাপনের প্রতীক্ষায় থাকি। প্রতিটি মোহ কেমন আনন্দ তা আরেকবার টানি, বারবার মনে হয় উপলব্ধিতে বোবা দৃষ্টি...

ভুলে নয়, মাঝে-সাঝে ভাবি দিন শেষে লেটারবক্সে জমে থাকা বিল আর বাণিজ্যিক পোষ্টার তুলে আনবো। আজও সান্ধ্যসঙ্গমে এগারো ধাপ সিঁড়ি পার হয়ে লেটারবক্সে হাত পড়তে কড়কড় শব্দে বেরিয়ে এলো একখানা শক্ত বাক্স। প্রেরকের ঠিকানা অতিখুদ্রাক্ষরে কারুকাজে লেখা। প্যাকেটটি হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নাম উদ্ধারের ব্যর্থতায় খামটা খুলতে বেশ তালগোল পাকিয়ে আর সময় ক্ষেপণ না করে যত্নে করে পাশ কেটে টেনে বের করি গোপনরহস্য... ভিতরে বিশেষ তরিকায় আরো কয়েকটা ধাপ পেরিয়ে রঙিন শক্তকাগজ টেনে নিজেকে উদ্ধার করি...

হামিদা রহমান
নেশা: পড়া ও লেখা 










[ ১ম পাতায় ফেরত ]

এক বৃদ্ধ ও এক যুবক : আমিনুল ইসলাম মামুন


এক গাঁয়ে ছিল এক মোটা বৃদ্ধ। সে সব সময় লোকজনের নিকট একটি যুবকের দোষ বর্ণনা করতো, অথচ যুবকটি ছিল নির্দোষ ও পরোপকারী। কোথাও কেউ বিপদে পড়লে সে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতো। একদিন একটি মেয়ে স্কুল থেকে বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরছিলো। যুবক তার ছাতা দিয়ে মেয়েটিকে বাড়িতে পৌঁছে দিলো। মোটা বৃদ্ধটি গাঁয়ের অনেককে বিষয়টি জানালো এবং এ-থেকেও যুবকের দোষ আবিষ্কার করলো। তারপর লোকগুলো যুবককে ডেকে জিজ্ঞেস করলে যুবকটি বললো, তার কাছ থেকে শুনেছেন? লোকগুলো মোটা বৃদ্ধ লোকটির কথা বললে যুবক সত্যতা স্বীকার করলো এবং বৃদ্ধ লোকটির অনেক গুণ বর্ণনা করলো।

  আবার একদিন এক ক্ষুধার্ত অমুসলিম ক্ষুধা নিবারণের জন্য অনেকের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা না পেয়ে এ যুবকের কাছে এলো। যুবকটি ওই অমুসলিমকে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করলো। বৃদ্ধ দূর থেকে তা দেখলো। এতে সে রেগে গিয়ে এলাকার অনেককে বললো, এসব অমুসলিমকে সাহায্য দিলে কোনো সওয়াবতো হবেই না, বরং আজাব হবে। যাদের কাছে বলা হলো, তারা এসে যুবককে জিজ্ঞেস করলে যুবকটি যুবকটি বললো, সে বিধর্মী হলেও আল্লাহরই সৃষ্টি। আল্লাহর সৃষ্টি যে কোনো প্রাণীকে যদি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা না হয়, তাহলে আল্লাহর সৃষ্টিকে অবহেলা করা হয়। এরপরও  বৃদ্ধ লোকটি বিভিন্ন সময় বিভিন্নজনের কাছে যুবকের দোষ গাইতে থাকলো। যুবকটি দেখা হলে বৃদ্ধকে সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময়ের চেষ্টা করতো এবং অন্যদের কাছে বৃদ্ধকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করতো। এতেও বৃদ্ধ যুবকটিকে ভেংচি কাটতো। একদিন একটি লম্বা বাঁশের সাঁকো পার হবার সময় বৃদ্ধ লোকটি সাঁকো ভেঙ্গে খালে পড়ে গেলো। বৃদ্ধ বলে তার গায়ে তেমন শক্তি ছিল না। তাছাড়া মোটা দেহ। তাই সে উঠতে পারছিল না। সাঁকোর দুই ধারের লোকজন পার হতে না-পেরে বৃদ্ধকে গালাগাল করতে লাগলো। এমন সময় যুবকটি এসে বৃদ্ধকে ওপরে তুললো এবং সাঁকোটি ঠিক করে দিল। বৃদ্ধ যুবককে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, আমি তোমার দোষ গাইতাম আর তুমি সব সময় আমার গুণগুলো বর্ণনা করতে এবং আজ আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচালে। তুমি মানুষ নয়, মানুষরূপী এক ফেরাস্তা।

আমিনুল ইসলাম মামুন
সেক্রেটরি-জেনারেল, ইয়ং রাইটার্স ফোরাম, বাংলাদেশ









[ ১ম পাতায় ফেরত ]

ছবিতা : সোমা মুখার্জি

ঐ যে খোলা আকাশ ! আমার একখানা মোটে ঘুড়ি । "মা, আমি তো তোমার সব কথা শুনি,  শুধু আমাকে একটু ঘুড়ি ওড়াতে দাও না । আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা করো ; আমাকে আমার মত থাকতে দাও"
নতুন বছর আবার এল ঘুরে । "মা, এবার যেন  আমি ফুরিয়ে  না যাই ডালভাতে, আমাকে যেন ওরা একটু বোঝে ; শুধু আমি যেন আমার মত থাকতে পারি মা"
আমি সহজিয়া হতে চেয়েও হতে পারিনি । তবু চেষ্টা করে চলেছি । ঘর ছেড়েছি, সব ছেড়েছি শুধু বাউল হব বলে । জীবনদর্শন, দেহতত্ত্ব ... সে সব তো অনেক তাত্ত্বিক কথা । আমার আমিকে নিয়ে থাকব বলে.. 

সোমা মুখার্জি
চিত্রশিল্পী
শখ : ব‌ইপড়া, গানশোনা  







[ ১ম পাতায় ফেরত ]

আমার পয়লা বৈশাখ : আইভি চট্টোপাধ্যায়


পর্ব -এক
শুভ নববর্ষ । পয়লা বৈশাখ । বাঙালির নিজস্ব দিন ।
আমার ছোটবেলার পয়লা বৈশাখ মানে প্রভাতফেরি, বিকেলে গানের জলসা । বাংলা ক্যালেন্ডার, নতুন পজ্ঞিকা, হালখাতা, মিষ্টির বাক্স । চড়কের মেলা, গাজন । সকাল সকাল নতুন জামা । মা-ঠাকুমার সঙ্গে মন্দিরে যাওয়া । দুপুরে পঞ্চব্যঞ্জন । সব বাঙালি রান্না । সুক্তো, ঝিঙেপোস্ত, ধোকার ডালনা, রুইমাছের কালিয়া, গলদা চিংড়ির মালাইকারি, মাংস । আমের চাটনি, কিশমিশ দেওয়া পায়েস । সন্দেশ, রসগোল্লা ।
সকালে উঠে মা বলবেন, ‘আজ সারাদিন ভালো মেয়ে হয়ে থাকবে । কোন দুষ্টুমি করবে না .. কারো কাছে যেন বকুনি খেতে না হয় । হাসিমুখে খুশিমনে থাকবে সারাদিন, তবে সারা বছর এইরকম ভালো কাটবে ।‘
আমরা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতাম । ঝগড়া দূরে থাক, সেদিন কেউ কাউকে একবার জোরে কথাও বলব না ।
এইরকম দৃশ্য পাড়ার সব বাড়িতেই ।
আমাদের পয়লা বৈশাখের আগের দিন হরবিন্দর-গুরপ্রীতদের নববর্ষ ‘বৈশাখী’ হয়ে গেছে .. বিশাল মিছিল বেরিয়েছিল ওদের .. সেইসঙ্গে গুরুদোয়ারায় খাওয়া দাওয়া । মিনি ভার্গিস শুকনো মুখে আছে, কারণ এবছর কেরালার নতুন বছর ‘ভিশু’ পড়েছে আরো দুদিন পরে । মৃদুলা-প্রাচীদের মারাঠী নববর্ষ ‘গুডি পারোয়া’ আমাদের সঙ্গেই পড়েছে, কিন্তু ওদের এত হৈ হৈ ব্যাপার নেই .. বাড়ির দরজায় রঙ্গোলি আঁকবে আর গণেশপুজো করবে । গত সপ্তাহে শৈলজা রেড্ডিদের নতুন বছরের অনুষ্ঠান ‘উগাডি’ হয়ে গেছে .. ওদেরও মারাঠীদের মতই আল্পনা আর পুজো .. সাদা রঙের আল্পনা .. ভারি সুন্দর । হৈ হল্লা নেই । অসমীয়াদের আজকের দিনে ‘বিহু ফেস্টিভাল’ হবে .. শ্রুতি বড়ুয়া আমাকেও বিহু নাচে শামিল করবে বলেছিল .. আমি যাব কি করে ? সন্ধেবেলা আমাদের জলসা আছে না ? নেপালীদের নববর্ষ পালন হল মোটামুটি ‘উগাডি’র সময়, কান্তা আর ক্রেনো আমাদের ‘মায়ার খেলা’য় নাচ করবে এবার । বাবার বন্ধু আনন্দআঙ্কল কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ .. ওঁদের বর্ষবরণ ‘নবরে’ অনুষ্ঠানের লাল সেমাইয়ের পায়েসের স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে । আনন্দআঙ্কলের ছেলে মহেন্দ্র এবার আমাদের গানের দলে গান গাইবে । কেটি বাথেনাদের পার্সী নিউ ইয়ার হয়ে গেছে একত্রিশে মার্চ, বাথেনারা ইরানীরা আমাদের পয়লা বৈশাখে আসবেনই ।

বিশুদ্ধ পঞ্জিকা কেনা হয়েছে .. পঞ্জিকা পড়াটা খুব মজার । আমি বিজ্ঞাপনগুলোও পড়ে ফেলি .. অনেক অচেনা শব্দ .. ছোটনদি আর দোলাদি চোখে চোখে হেসে বিজ্ঞাপনের সব বুঝে ফেলে । গোপন ইশারাটা কিছুতেই বুঝি না আমি । হেসে হেসে আমার মোটা কলাবিনুনী ধরে নেড়ে দেয়, ‘তুই এখন দুধভাত ।‘ এইটা শুনলেই খুব রাগ হয় আমার । ‘আর কোনদিন তোমাদের সঙ্গে খেলব না’ বলে এসে বিছানায় মুখ গুঁজি ।
ঠাকুমা এসে আদর করে চোখের জল মুছিয়ে দেন, ‘আমার সোনা মেয়ে বচ্ছরকার দিন কাঁদে কেন ? আয়, তোকে পঞ্জিকা দেখতে শেখাই ।‘ মঘা, অশ্লেষা । শিহরণ জাগানো শব্দ সব । তিথি নক্ষত্র । উপোস ব্রত । পরিবার পরিজনের কল্যাণকামনার বার্তা ।
মা একটু রাগ করেন । অল্পবয়স থেকে এসব ব্রত তিথি নক্ষত্রের হিসেব শেখানো মায়ের পছন্দ নয় । অবশ্য ঠাকুমার মুখের ওপর সে কথা বলার সাহস নেই মায়ের । আমাকে কোলের কাছে বসিয়ে বাংলা ক্যালেন্ডারের গল্প করবেন । হিজরি ক্যালেন্ডার থেকে কিভাবে বাংলা ক্যালেন্ডার আলাদা রূপ নিল, মা সেই হিসেব শেখাবেন । হিজরি ক্যালেন্ডারে পৃথিবীকে চন্দ্র-পরিক্রমার হিসেব হয় । বাংলা ক্যালেন্ডারের হিসেব পৃথিবীর রবি-পরিক্রমা দিয়ে । মা বুঝিয়ে দেবেন, সেইজন্যেই হিজরি ক্যালেন্ডারে বছরে এগারো-বারো দিন কম ।
বাবা দিনের মধ্যে কতবার যে বাজারে যাবেন । আমি বাবার হাত ধরে ঘুরব । বাবা হালখাতার মানে বুঝিয়ে দেবেন । পয়লা বৈশাখের দিন থেকে দোকানীদের ফিনান্সিয়াল ইয়ার শুরু হয় ।
আমাদের ছোট্ট পপা ‘পয়লা’ বলতে পারে না । বাবার হাত ধরে ঝুলে পড়বে, ‘আমিও পেয়ালা বোশেখের বাজারে যাব’। বাবা পপাকে নিয়ে সুরুচি মিষ্টান্ন ভান্ডারে যাবেন, মিষ্টি দৈ আর রকমারি মিষ্টি কিনবেন । সুরুচির দোকানের সামনে বসে আড্ডা দেওয়া পাড়ার ছেলেরা ডাক দেবে, ‘এই পপা, আজ কি দিন রে ?’
পপা অমনি সুর করে বলে উঠবে, ‘পেয়ালা বৈ ই ই ই শাখ ।‘ সবাই হৈ হৈ করে হাসবে । পাড়ার দাদাদের দেওয়া লজেন্স বিস্কুট দু’হাত ভরে নিয়ে ছোট্ট পপা বাড়ি ফিরবে । 

সন্ধেবেলা জলসা । বাবারা সবাই সাদা ধুতি, সাদা পাঞ্জাবী । মায়েরা তাঁতের শাড়ি, সোনার গয়না । আমরা লালপাড় সাদা শাড়ি, মাথায় ফুল । আমরা গান গাইতে শুরু করলেই পর্দা সরবে ।
হারমোনিয়াম বাজাবে শমিতাদি । আমায় খুব ভালোবাসে, ইশারায় পাশে ডেকে নেয় । তবলা বাজাতে বাজাতে মাণিকদা ইশারা করেন .. ছন্দা আর মল্লিকার গম্ভীর মুখ .. ওরা মাইকের সামনে দাঁড়াতে পারে নি । আমি ছন্দার হাত ধরে শমিতাদির পাশে টেনে নিই, মল্লিকার হাত ধরে বুনিদির পাশে । ছন্দা আর মল্লিকা হেসে ফেলে । শমিতাদি মিষ্টি হেসে ঘাড় নেড়ে দেয় ।একটুখানি ছেড়ে দিলেই যে অনেকখানি পাওয়া হয়ে যায় তা বুঝে ফেলে আমিও হাসি ।
কুচোকাচাদের আবৃত্তি । তারপর আবার গান । গানের মাঝে উদাত্ত গলায় আবৃত্তি করবেন শিবাজিদাদা ।
ছোটদের নাটক । এক বছর ‘অবাক জলপান’, আরেক বছর ‘ডাকঘর’ । দেবকাকু বলেছেন এবার ‘সামান্য ক্ষতি’ গীতিনাট্যরূপ হবে, আমি পরিচালনা করব । আমার চেয়েও বেশি খুশি ছন্দা আর মল্লিকা । সবশেষে শিশুতীর্থের ‘মায়ার খেলা’ .. গান আবৃত্তি নাটক নৃত্যনাট্য .. জমজমাট ব্যাপার ।
কোনো এক বছর সত্যেনজ্যেঠু আমাকে নববর্ষ অনুষ্ঠানের গ্রন্থনা লিখতে বললেন । সত্যেনজ্যেঠু আমাদের পাড়ায় একজন গণ্যমান্য মানুষ । সেই জ্যেঠু আমায় লিখতে বলেছেন .. আহা আর কি চাই জীবনে ! আমার লেখা লাইনগুলো পড়বে শৌভিক আর বুবুন । আনন্দে চোখ জ্বালা করে আমার ।
সারা বছর অপেক্ষায় থাকি, কবে আসবে পয়লা বৈশাখ ।


পর্ব -দুই
মিলুবৌদি মাঝে মাঝেই ফোন করেন, ‘মোহর আর তিতলি যখন গল্প করে, শুনেছ ? হয় হিন্দি, নয় ইংরেজি । হ্যাঁগো, দুজন বাঙালি মেয়ে গল্প করবে আর একটাও বাংলা শব্দ বলবে না?’
সে ভাবনা তো আমারও । মোহর আর তিতলি দুজন কেই বেশ বাবা বাছা করে বোঝাই । আজকাল আর বকাঝকা করার চল নেই । দুই বন্ধু হেসে গড়ায়, ‘মা/কাকিমা তোমরা বড্ড পুরানা জমানা । আরে, কমিউনিকেট করাটাই আসল । বাংলা বললাম কি হিন্দি কি ইংরেজি .. কি যায় আসে?’
প্রিয়াঙ্কার মা করুণ গল্প করেন, ‘জানো, দুই ছেলে মেয়ের একজনও বাংলা বলে না । যতই বকি, ওদের কোনো হেলদোল নেই ।‘
অভিষেকের মা রাগ করেন, ‘কি সব অদ্ভুত অদ্ভুত বাংলা শব্দ শিখেছে অভিষেক । আমি তো মানেই বুঝি না । ল্যাদ, একঘর, ঢপ .. এমন সুন্দর বাংলা ভাষার কি অবস্থা । আমার কান্না পায় ।‘
অভিষেককে দোষ দিই বা কি করে ? কলকাতা থেকে আসে বাংলা কাগজ । তাতে এমন সব শব্দের ব্যবহার দেখি, আমাদের বাঙালি সত্তাটা ধাক্কা খায় । প্রবাসী মায়েদের বড় সমস্যা ।
বিনু ভার্গিস আমাকে বোঝায়, ‘তোমার তিতলি তো তবু বাংলা বোঝে । একটু হলেও পড়তে পারে । আমার মিনি তো মালয়ালাম বলতেই পারে না । দেশের বাড়ি গেলে যে কি লজ্জায় পড়ি !’
বলে নির্মলা রাগম, সতবিন্দর কাউর, মৃদুলা আপ্তেও ।
ললিতা পান্ডে, শীলা মিশ্রারাও বলে, ‘জানো ভোজপুরী মগহি বলতে ছেলেমেয়ের লজ্জা করে ।‘ ওরা একরকম মেনেই নিয়েছে । আমাদের বাঙালি মায়েদের এইটা মেনে নেওয়া হয় না বলেই সমস্যা ।
আমরা ঠিক করি, নববর্ষ পালন করব ।  বকুলদি, মীরাদি, সংযুক্তা, সুপ্তি, মুনমুন আমরা সবাই ।
এমনিতে আমাদের ক্যাম্পাসে সারাবছরই হৈ হৈ । নীলম-সরিতাদের ব্যবস্থায় ‘হোলি মিলন’ হয় । অনুপা-সতবিন্দরদের ‘লোড়ি’, মহাপাত্ররা জন্মাষ্টমীর দিন ঝুলন করে । কৃষ্ণনদের ‘দিওয়ালি মিলন’, আমাদের ‘বিজয়া সম্মেলন’, কোশি-থমাসদের ‘ক্রিসমাস পার্টি’ ।
গেট-টুগেদার । বেশ খাওয়াদাওয়া .. কাঁথা-আড়ি-বমকাই-ঢাকাই .. জরদৌসি-শিফন-পৈঠানি .. জ়ৈনদের ছেলের সঙ্গে মিশ্রাদের মেয়ের মাখামাখি .. এগজিকিউটিভ স্বামীদের অফিসের গল্প থেকে শাশুড়ির নিন্দে .. কিছুই বাদ যায় না ।
‘বঙ্গালি নয়া সাল সেলিব্রেশন’ .. সেটা আবার কি ? এমনিও বাঙালিরা তেমন পুজোআচ্ছা করে না, শ্রাবণমাসেও মাছ-মাংস খায়, বাঙালি বৌরা খুব স্বাধীন .. এসব নিয়ে নানা নালিশ আছেই । আবার এ কি? পুজো টুজোর ব্যাপার নেই, শুধু নাচগান । এই ‘পহেলা বৈশাখ’ জিনিসটা কাউকে বোঝানো যায় না ।
তাতে আমাদের বয়েই গেল ।

রায়বৌদি কোমরে কাপড় জড়িয়ে মেয়েদের দলকে ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে’ শেখান, একমুখ উজ্জ্বল হেসে ঘাম মুছতে মুছতে বলেন, ‘বড্ড মোটা হয়ে গেছি যে, নইলে কলেজে সব নৃত্যনাট্যে আমিই তো নায়িকা হতাম ।‘
তিতলি মোহর কিঙ্কি প্রিয়া সোনাইকে নিয়ে আমি খরগোশ আর কচ্ছপের গল্পটা নাটক করাই ।
বিনু ভার্গিসের মেয়ে ‘হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে’ গ্রুপ-নাচে অংশ নেয় । গুরপ্রীতের ছেলে গুড্ডু ‘হবুরাজার গবুমন্ত্রী’ হয়ে দারুণ অভিনয় করে । কুচোরা জোরগলায় ‘তাঁতীর ঘরে ব্যাঙের বাসা’ আবৃত্তি করে ।
গৌতমদা বাড়ি বাড়ি ঘুরে গানের দল তৈরী করে ফেলেন .. ‘সব ঠিক হয়ে গেছে বৌদি, শুধু হারমোনিয়ামটা যদি আপনি ম্যানেজ করে নেন’ .. খুশি হয়ে উঠে আমি মাণিকদাকে খবর পাঠাই .. তবলাটাই বা বাকি থাকবে কেন ?
রোজ রিহার্সাল । কিন্তু কিন্তু মুখ করে একদিন ডঃ গুপ্ত এসে পড়লেন । নামী শিশু-বিশেষঞ্জ সবাই জানি, এমন মন–ভরানো কান-জুড়োনো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারেন, কে জানত !
সন্ধেবেলায় জলসা । ধুতি পাজ্ঞাবির দলে ‘ওরা জীবনের গান গাইতে দেয় না’ । আমরা ঢাকাই শাড়িতে ‘এসো হে বৈশাখ’ । ধাক্কাপাড়ের ধুতি কাঁথাকাজের পাজ্ঞাবি প্রশান্ত সিনথেসাইজার বাজাবেন, সারাবছর দেখা পাওয়াই যায় না .. ব্লাস্ট ফারনেসের দায়িত্ব কম কথা ? আজ কাজ থেকে ছুটি । কনভেন্টে পড়াশোনা করা সুস্মিতা স্বামীর সিনথেসাইজারের সঙ্গে গাইবেন ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ ।
সাদা ধুতি সাদা পাজ্ঞাবি বাসুদা মাউথ-অর্গ্যান । কসমোপোলিটান শহরে বাস । আলাদা করে বাঙালি বলে চিনে নেবার উপায় নেই । এ শহরে এই একদিন আমরা বাঙালি হয়ে উঠি ।
তিতলি মোহর উজ্জ্বল মুখে ঘোরে, এবছর পয়লা বৈশাখে গান গাইবার পর ছাব্বিশে জানুয়ারি-পনেরো আগস্টের অনুষ্ঠানে গান গাইবার ডাক পেয়েছে । সারাবছর ক্যাম্পাসের বাচ্চারা ‘পয়লা বৈশাখ’-এর অপেক্ষায় থাকে ।

সকালে উঠে মেয়েকে বলি, ‘আজ সারাদিন ভালো মেয়ে হয়ে থাকবে । কোন দুষ্টুমি করবে না, কারো কাছে যেন বকুনি খেতে না হয় । হাসিমুখে খুশিমনে থাকবে সারাদিন, তবে সারা বছর এইরকম ভালো কাটবে ।‘
মা-বাবাকে প্রণাম করতে যাই । মা একমুখ হেসে বলেন, ‘এই দ্যাখ, পেয়ে গেছি । আয় তিতলি, তোকে দেখা শেখাই ।‘
আমি হাসি, ‘মা, তুমিও !’
মা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলেন, ‘সেই ছোটবেলায় বৌ হয়ে এসেছি, যা কিছু শেখা সব তো তোমার ঠাকুমার কাছেই । আচার বিচার সংস্কারে কেন আনন্দ পেতেন উনি, আমিও এখন জেনেছি । তবে তুমি যদি না চাও, তোমার মেয়েকে না হয় পাঁজি দেখা শেখাব না ।‘
‘তুমি’ করে বলা মানেই মায়ের রাগ হয়েছে । বাবার মুখে চাপা হাসি । আমি মানে মানে সরে আসি । মা বিজয় উল্লাসে নাতনিকে তিথি নক্ষত্র, ব্রত উপবাস শেখান । শিখুক । ক্ষতি নেই । এ আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি ।
ইউনাইটেড ক্লাবে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হয় ঘটা করে । সব বাঙালির সেখানে যাওয়া চাই । পাশের বাড়ির সুজাতা, নতুন বিয়ে হয়ে এ শিল্পশহরে এসেছে, এখনো শহরটার সঙ্গে চেনাজানা হয় নি । বলি, ‘আমাদের সঙ্গে ক্লাবে চলো, কেমন নববর্ষ পালন করি আমরা দেখবে । এখন থেকে তোমাকেও চাই যে ।‘
সন্ধেবেলার সুজাতা, পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর । দেখে চোখ ফেরাতে পারি না । বাঙালি সাজের মত এমন সুন্দর সাজ আছে নাকি ? লাল লাল মুখে সুজাতা নালিশ করে, ‘তোমার ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া হয়ে গেল বৌদি । বলছে ধুতি- পাজ্ঞাবি পরে কেউ ক্লাবে যায় না ।‘
তাপস আমাকেই সালিশ মানে, ‘বোঝাও বৌদি । এখানে ওসব হয় না । এ কি কলকাতা নাকি ?’
আমি মজা পেয়ে হাসি । সন্ধেবেলা যে এখানেও সব অন্যরকম দেখবে তাপস । মস্ত কর্পোরেট লিডার মুখার্জিসাহেব সেনসাহেব চ্যাটার্জিসাহেব কেমন ধুতি-পাজ্ঞাবি বাঙালি সেজে আস বেন । ডঃ অমিত চ্যাটার্জি বাংলা কবিতা আবৃত্তি করবেন । রকমারি বাঙালি খাবার, বাংলা গান । এবছর মহাশ্বেতা দেবী প্রধান অতিথি । ‘ক্যাকটাস’-এর গান .. সন্ধেবেলা আবার তাপসের মনে হবে, ‘এ কি কলকাতা নাকি ?’

মিলুবৌদির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল খাবার জায়গায় । গলা নামিয়ে হেসে বললেন, ‘দেখছ, তিতলি মোহর কেমন বাংলায় কথা বলছে ?’
পাশ থেকে শ্রাবণীও হেসে অঠে, ‘আমিও লক্ষ্য করেছি বৌদি, সারা সন্ধে ধরে তিতলি মোহর ঋভু গোগোল বাংলা বলছে ।‘
আমিও দেখেছি । তিতলিরাও খুব খুশি । আমাদের পয়লা বৈশাখ আছে । আমাদের ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’ নেই । বাংলা নিয়ে আমাদের আবেগ, বাঙালি হওয়া নিয়ে আমাদের অহঙ্কার । আমাদের যাপন, আমাদের মূল্যবোধ, পুরোনো যা কিছু তা নতুন করে চিনে নেবার তাগিদ আমাদের আছে ।
সারাবছর অপেক্ষায় থাকি, কবে আসবে ‘পয়লা বৈশাখ’ ।  


আইভি চট্টোপাধ্যায়
পেশা :স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ায় কর্মরতা
নেশা জমিয়ে গল্প লেখা এবং ব‌ইপড়া ( "নিরবলম্ব" ও "রাতপাখি ও অন্যান্য" এই দুটি গল্পের ব‌ই প্রকাশিত )










[ ১ম পাতায় ফেরত ]