- তিলোত্তমার মেয়ের বিয়ে (পুজো২০১৩)
আমাদের দুর্গোত্সব কিন্তু খুঁটিপুজো ছাড়াই ঝাক্কাস ছিল— প্রথা অনুযায়ী রথের দিন বাঁধা হয় মা দুগ্গার কাঠামো। সেই অনুষঙ্গ নিয়েই বুঝি এখন হয় খুঁটিপুজো— শ্রাবণ-ভাদ্রের জলভাসি শহরের প্রাক্ পুজো টেম্পো— পাড়ায় পাড়ায় যেন মায়ের আগমন বার্তা জানানোর আগাম হুল্লোড়। নাগরিক মহাকাশ ছয়লাপ খুঁটিপুজোর হোর্ডিংয়ে। ছাপা কাগজে তাবড় ‘সেলেব’দের ছবি খুঁটিপুজোর উদ্বোধনীতে। পাল্লা দিয়ে নক্ষত্র আনা হবে প্রতি পাড়ায়। যার যত ‘খুঁটি’র জোর তার তত রথী-মহারথী। বাবুদের দুগ্গাপুজো বলে কথা! তাও আবার খাস কলকাতার। যেন মায়ের নাম ভাঁড়িয়ে নতুন পণ্যের ‘প্রোমোশন’ বা ক্লাবের ‘ব্র্যান্ড’ বাজানো। তার চেয়ে ক্লাবগুলো যদি পাড়ার মোড়ের পার্কটাকে পরিচ্ছন্ন করে আবর্জনা মুক্ত রাখত, তা হলে শহরটার ভাল হতো।
মা আসেন প্রতি বছর। তিনি জানতেও পারেন না দেশের কী অবস্থা, দশের কী হাল! তবুও দেশ ও দশ প্রতি অণু-পল শুনতে থাকে মায়ের আগমনের প্রতিধ্বনি। এ বার মা দ্বিতীয় বার আসছেন ‘বদলের বঙ্গে’! সেটাই বড় কথা। মায়েরও হাওয়াবদল হবে আশা করা যায়। কিন্তু প্রতি বছরের মতোই বাজারের দাম বদলায় না। রাস্তাঘাট সারাই হয় না। রাজনীতির অশুভ আঁতাত, খরা-অতিবৃষ্টির টানাপোড়েনে রোগের হ্রাস-বৃদ্ধি, প্লাস্টিক না পেপার, পরীক্ষার পাশ-ফেল, পেঁয়াজের বাজারদর, রিসেশান-ইনফ্লেশান চাপানউতোর— সব কিছু চাপা পড়ে যায় ‘কৈলাস অ্যান্ড কোম্পানি’র আগমনে। ধর্ষণে, বিস্ফোরণে, দুঃখের যজ্ঞে আহুতি দেয় শহরবাসী। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক... সব জটিল প্রশ্নের টেস্ট পেপারের মুখোমুখি হতে হয় কৈলাস পরিবারকে। পুণ্যতোয়া গঙ্গার জল বয়ে চলে প্রতি দিনের নিয়মে...
থিম থিম করে পাগলু হয়ে পুজোয় চমক হয়। দেবদেবীদের চক্ষু চড়কগাছ। হিংসায় উন্মত্ত ধরায় শান্তির বাণী বরষাতে এসে সব ‘প্ল্যান’ ভণ্ডুল। পিচঢালা ঝকঝকে রাস্তায় গর্ত খুঁড়ে খুঁটি পোঁতা হয়। মা চলে যাওয়ার পর সেই গর্তগুলোর কী হবে তা নিয়ে কেউ ভাবেন না। একই পাড়ায় চারটে দলের আলাদা আলাদা পুজো— দলবাজির মা, রকবাজির মা, রংবাজির মা, দাদাগিরির মা— ‘ভাগের মা’ বলে কথা। গঙ্গা পাবেন অবশ্য। কিন্তু গঙ্গার কী হবে? একেই তো বুজে আছে পর্যাপ্ত প্লাস্টিকে। ক্লিন কলকাতা, গ্রিন কলকাতা থিম তত ক্ষণে বিসর্জন। মহানগরের নর্দমাগুলি আবার ভর্তি হয়। ঠাকুর দেখে প্রচুর দর্শনার্থী। জলের বোতল, কোল্ড ড্রিঙ্কস-এর বোতল, কফির কাপ, আইসক্রিমের কাপ, আরও কত কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে তারা চলে যায় এই মহানগরের রাস্তাঘাটে। তেরঙ্গা, গুটখা, শিখরময় হয় এই মহানগর। চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙে মাইক্রোফোনের স্পিকারে গান বাজতেই থাকে উচ্চৈঃস্বরে। আলোর রোশনাই কোজাগরীর জোছনাকে আড়ালে রাখে। বিদ্যুত্— কত চাই এ সময়! জয়েন্ট পরীক্ষার আগের দিন না হয় অন্ধকারে ডুববে বঙ্গ, তাই বলে পুজোতে আঁধার ভাল লাগবে কি?
রমরমিয়ে ব্যবসা চলবে ট্রান্সফ্যাটের। আবার ওজন বাড়বে বাঙালির। তাই বলে কি রসনা অতৃপ্ত থাকবে? পুজো তো আর রোজ রোজ হবে না! চক্ষুশুদ্ধি হবে প্যান্ডেল হপিং করে। জিনস-কুর্তা, কুর্তি-কেপরি, স্কার্ট-লাচ্ছায় লাস্যময়ী, হাস্যময়ীরা মাতাবেন ম্যাডক্স স্কোয়্যার, ত্রিকোণ, দেশপ্রিয়, বাদামতলা, মুদিয়ালি। মানুষ ভিড় করবে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে। তত ক্ষণে মা উধাও সেই প্যান্ডেল থেকে, পড়ে থাকবে মৃন্ময়ী মূর্তি। চিন্ময়ী মায়ের বিরহী আত্মাটুকু ভিড়ভাট্টা থেকে রক্ষা পাবে বলে পাড়ি দেবে ভোলেবাবার কাছে। কলকাতার ভূষণ হবে দূষিত। মাননীয় নেতারা বিজয়া-টিজয়া সেরে সিদ্ধান্ত নেবেন মহানগরকে দূষণমুক্ত করার। অনেক মিটিং হবে। তত ক্ষণে শারদ সম্মান ‘সেরিমনি’ও শেষ।
আপামর কলবাতাবাসীর পুজোর এই উদ্যম হিড়িক দেখেশুনে মনে হয়, ফি বছরের এনার্জি বাঙালি কেন উন্নয়নে কাজে লাগায় না? কোনও ‘কংক্রিট’ কাজে যদি কলকাতার বাঙালির এই উদ্যম দেখতাম তা হলে শহরটার বুঝি একটু একটু করে উন্নতি হতে পারত। প্রতি পাড়ায় দু’কিলোমিটার ব্যবধানে দু’টো করে পুজো না করে চারটে পাড়া এক সঙ্গে পুজো করুক না! ইকোসিস্টেমের সঙ্গে ভিড়ভাট্টাও কমবে আর সেই সঙ্গে বন্ধ হবে অপচয়। পুজোর সংখ্যা না বাড়িয়ে কী ভাবে শহরটার একটু উন্নতি হয় সে দিকে দাদারা মাথা ঘামালে বড় ভাল হতো। পাড়ায় পাড়ায় কম্পিউটার সেন্টার তৈরি হোক, যেগুলি আছে সেগুলির তদারকি হোক। বস্তির ছেলেমেয়েগুলো আরও সুযোগ পাক এই প্রযুক্তির। ব্যায়ামাগার তৈরি করুক কলকাতার স্বনামধন্য সব ক্লাব, যাদের টিকি কেবল দুর্গাপুজোতেই দেখা যায়। কিশোর স্বাস্থ্য তৈরি করুক তারা। নতুন কিছু হোক— পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরি, পুরনো লেখকদের বইয়ের আর্কাইভ। নতুন প্রজন্ম কম্পিউটারের পাশাপাশি বই পড়তে শিখুক।
মহানাগরিক ভিড় শুরু হয়ে যাবে পুজোর কয়েক মাস আগে থেকেই। ফুটপাথে হকাররাজ চলছে, চলবে। কারণ ভোটের রাজনীতির সমীক্ষা বলে সবার উপরে মানুষ সত্য, তার উপরে নাকি কিছুই নেই! চাকরি-বাকরি নেই শহরে। অতএব বেকারগুলো যাবে কোথায়? মাগো, তাদের পুজোর কথা ভেবে বসতে দিও ফুটপাথে। ভোটের সময় ওরা অনেক খাটে। অটোওয়ালাদের বাড়বাড়ন্ত শহরে। মাগো, যেতে দিও ওদেরও। ট্রাম উঠে যায় যাক, অটো যেন চলে পর্যাপ্ত সংখ্যায়, কারণ ওরাই ভোটের ভবিষ্যত্। এই ভাবেই চলে কলকাতা। এ ভাবেই চলে কলকাতার মেয়ের বিয়ে— পাঁচ দিনের দুর্গোত্সব। বাঙালির গর্বের একটা কিছু তো বটেই। দুর্গাপুজোকে ঘিরে কত জলসার আয়োজন। কত গায়ক গান গেয়ে পয়সা পাবে। কিছু শিল্পী, কারিগর, স্টলওয়ালা, দোকানির অল্প হলেও তো ব্যবসা হবে এ সময়। তাই এসো দেবী এসো এ আলোকে, এক বার তোরে হেরি চোখে!
চার দিন কাটল। নাড়ু মুখে, পান হাতে, সিঁদুর খেলে মা মুচকি হেসে বলবেন, ‘আবার আসিব ফিরে...’
সিংহমশাইয়ের পিঠে চেপে মা, মায়ের দু’জোড়া ছেলেপুলে, একাই একশো উগ্রপন্থী মহিষাসুর আর এক গণ্ডা নির্বিবাদী পশুপাখি বাক্স প্যাঁটরা প্যাক করে রেডি হয়ে জুলজুল করে দেখছে তখন। কোথায় পাব বলরাম-যুগল? কোথায় পাব বাঞ্ছারামের পান্তুয়া? সেনমশাইয়ের মিষ্টি দই? যাদবের দিলখুশ আর কেসি দাসের রসোমালাই? মা বলবেন—
‘চলো চলো চলো সবে,
কৈলাসে গিয়ে হবে,
চমরীর দুধে মিষ্টিমালাই,
বানাবো সকলে খাবে’
আমার ছোটবেলা কেটেছে বরাহনগরের আলমবাজারে। পুজোর মাস দুয়েক আগে কোনও একটা সপ্তাহান্তে বাবা আমাদের কলকাতায় নিয়ে যেতেন পুজোর বাজার করতে। সে ছিল আমাদের সব চাইতে বড় উত্তেজনার দিন— সারাদিনের ‘প্রোগ্রাম’। সকালবেলা ভারী জলখাবার খেয়ে বেরোনো হত আর ফেরা হত সেই রাতে। বাড়ির সামনে থেকে সরকারি স্পেশাল বাস ‘এস ১৭’য় চেপে বসতাম আমরা চার জন। তার পর গিয়ে নামা হত লিন্ডসে স্ট্রিট। প্রথমেই ঠান্ডা পানীয়— ক্যাম্পাকোলা। তার পর সোজা হেঁটে বেন্টিঙ্কট স্ট্রিটে গিয়ে চিনে বাজারের জুতো কেনা হত। চিনেপাড়ার উস্তাদদের হাতে বানানো জুতোতে নাকি পা ভাল থাকে, তাই এত কষ্ট করা! সেই জুতোর বাক্স বয়ে যাওয়া হত নিউমার্কেটে। আমার ফ্রক কেনা হত স্টাইল টেক্স থেকে। মা প্রতিটি ফ্রকের ঝুল আর ডিজাইন খুঁটিয়ে দেখতেন যাতে পোশাকে শালীনতার মাত্রা বজায় থাকে। ভাইয়েরটা কেনা হত রহমান স্টোর্স থেকে। গঙ্গাদীন গুপ্তার অর্গ্যান্ডি আর কোটা শাড়ি, জয়সওয়াল স্টোর্স থেকে মায়ের তাঁতের শাড়ি, ঠাম্মার দুধ সাদা ফাইন থান, দিদিমার ইঞ্চিপাড়ের সাদা শাড়ি, মা দুর্গার লালপেড়ে শাড়ি, জ্যাঠামশাইদের জন্য ফাইন ধুতি— সব কিনে যাওয়া হত নাহুম’স-এ। নিউমার্কেটের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ নাহুম’স-এর চিজ প্যাটি আর ডি গামার কেক। কেক, প্যাটি খাওয়ার পর বাড়ির জন্যও কিছু নিয়ে নেওয়া হত। তার পর যাওয়া হত লিন্ডসে স্ট্রিটের হ্যান্ডলুম হাউসে। এখানে তখন তো আর আনাচে কানাচে এত বুটিক ছিল না! তাই এক্সক্লুসিভ পিওর সিল্ক শাড়ি কিনতে মা ওখানেই যেতেন। আর সেখানে এক ঢিলে দুই পাখি! পর্দার কাপড়, বেডশিট সব কিছুই মিলত ন্যায্য দামে। বাবার জন্য প্রায় জোর করে মহাদেবী এন্ড মেহতা থেকে শার্ট প্যান্টের পিস কিনতেন মা।
তখন শহর কলকাতায় হাতে গোনা খাবারের দোকান ছিল। কিন্তু এ পাড়ায় সঠিক দামের ছোট বড় রেস্তোরাঁ ছিল বেশ কিছু। ছোলা বাটুরে আর স্পেশাল কুলফি মালাই খেতাম ইন্দ্রমহলে। র্যালি’স-এর সিরাপ আর সিমাইয়ের পায়েস সহযোগে এমন সুন্দর কুলফি মালাই বোধহয় আর কোথাও তখন পাওয়া যেত না। এর পর সিম্ফনিতে আমাদের অভিযান। নতুন পুজোর গানের এলপি রেকর্ড। আর তখন এইচএমভি থেকে শিল্পীদের গানের রেকর্ড কিনলে একটা গানের লিরিকসের বই দিত। মায়ের নজর থাকত ওই বইয়ের দিকেই। তত ক্ষণে ফুটপাতের দোকান থেকে ভাই মায়ের আঁচলে গেরো দিয়ে একটা গাড়ি বা মোটরসাইকেল বা একটা ক্যাডবেরি বাগিয়ে বসে আছে। আমার একটা হেয়ারব্যান্ড, জামার সঙ্গে ম্যাচ করে দু’টো ক্লিপ আর রিবনও কেনা হয়ে গিয়েছে। বাবা রেগেমেগে বলছেন ‘‘এ বছরই শেষ। তোমাদের নিয়ে আর আসা যাবে না এখানে। এত বায়না!” কথাগুলো বাবা যে এমনিই বলতেন সেটা আমি বুঝতাম। কিন্তু ভাই বেচারা খুব ভয় পেয়ে যেত।
বিকেলের চায়ের জন্য ঢোকা হত অনাদি কেবিনে। সঙ্গে অবশ্যই অনাদির স্পেশাল মোগলাই পরোটা। এই একটা দিন বাবা বাইরের খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে আমাদের লাগাম ছেড়ে দিতেন। আর তখন কলকাতা এত পরিচ্ছন্ন ছিল যে বাইরের খাবার খেয়ে অসুস্থ হওয়ার ভয় কম ছিল। এখন বাইরে খেতে গেলেই ভাবি ভাল জায়গায় যেতে হবে, এসি থাকতে হবে, ভাজাভুজি মোটেই না— হেলথ রুল মেনে খেতে হবে। খোলা জিনিস খাওয়া চলবে না ইত্যাদি।
এক বার বাবা আমাদের চাইনিজ রেস্তোরাঁ কারকো-য় নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন কলকাতায় চিনে খাবারের চল সবে হচ্ছে। চাংওয়া, জিমিস কিচেন, পিপিং আর কারকো— এই ক’টি রেস্তোরাঁতেই সাবেকি চিনে খাবার মিলত। আর চাইনিজ খাবারে ইন্ডিয়ানত্বের ছোঁয়াও ছিল অল্প, তাই আমাদের বরং অসুবিধেই হত। কেবল গোল্ডেন ফ্রায়েড প্রন ছাড়া আর কোনও পদই ভাল লাগত না। বাবা বলতেন, চাইনিজ খাবারের অভ্যেস করতে— সহজ পাচ্য, তেল মশলাও কম। আর সস্ ভিত্তিক রান্না, তাই মুখ বদলানোর পক্ষে আদর্শ। কিন্তু আমরা তিন জন সে কথা মানতাম না। শুধুই গোল্ডেন ফ্রায়েড প্রনের দিকে হাত বাড়াতাম।
আমাদের স্কুল ছুটি পড়ে যেত পঞ্চমীর দিন। আর খুলত ভাইফোঁটার পর। পুজোর ক’দিন বইপত্র শিকেয় তোলা থাকত।
পুজোর প্রতি দিন সকালে বাবা নিয়ম করে চালাতেন গ্রামাফোন চেঞ্জার। আর একে একে সানাই, শরদ, সেতার, নতুন গানের এলপি রেকর্ড— কলের গান বাজত। বছরের এই সময়টা নিয়ম করে বাবা সেই শব্দ যন্ত্রটির পরিচর্যা করতেন পুজোর কয়েক দিন আগে থেকেই। আজও সেই পুরনো আধুনিক গানগুলো রেডিওতে শুনলে মনটা যেন কেঁদে ওঠে। শিউলির গন্ধ, পুজোর ঢাকের আওয়াজ, শিশির ভেজা শরত্কাল ছুট্টে এসে মনের দরজায় কড়া নাড়ে। এক বার কেনা হয়েছিল হেমন্ত, মান্না, আরতি, প্রতিমা, শ্যামল, সন্ধ্যা, অনুপ ঘোষালের সাতটা ছোট ৪৫ আরপিএম-এর রেকর্ড, এইচএমভি থেকে বেরিয়েছিল। আর সবচেয়ে মজা হল দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর সাতটা ছোট রেকর্ড এক সঙ্গে ওই চেঞ্জারে বসিয়ে সেট করে ঘুমিয়ে পড়লে নিজের থেকেই একটা একটা করে বাজতে থাকবে। খুব মজা হত— নতুন গান যা প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে বাজছে তা আবার আমাদের বাড়িতেও বাজছে। অনুপ ঘোষালের ‘বিয়ে করবই না’, আরতি মুখোপাধ্যায়ের ‘বন্য বন্য এ অরণ্য ভাল’, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ‘আমিও পথের মতো হারিয়ে যাব’, মান্না দের “ক’ ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ”, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘গহন রাতি ঘনায়’— এই গানগুলো আমাকে তখন ছুঁয়ে গিয়েছিল, তাই বোধ হয় আজও মনের কোটরে পড়ে রয়েছে। সে বার এই গানগুলোই কিন্তু বেরিয়েছিল পুজোর গান হিসেবে, সালটা বোধ হয় ১৯৭৩ কি ১৯৭৪ হবে, ঠিক মনে নেই। এখনকার ছোটরা দেখি পুজোর সময়েও কম্পিউটার গেম খেলছে নয়তো টিভি খুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কার্টুন দেখছে। তাদের ঠেলেঠুলে প্যান্ডেলে পাঠাতে হয় আরতি দেখতে আর অঞ্জলি দিয়ে প্রসাদ খেয়ে আসার জন্য।
সপ্তমীর দিন সকাল থেকেই সব প্যান্ডেলে পড়ে যেত নবপত্রিকার স্নান করানোর ধুম। আলমবাজার গঙ্গার ঘাট খুব কাছে বলে সকাল থেকেই শোনা যেত ঢাকের আওয়াজ। প্রত্যেক বার মা বলতেন নবপত্রিকার পুজো মানে আসলে মা দুর্গার পুজোই। অত বড় মৃন্ময়ী মূর্তি তো আর গঙ্গায় নিয়ে গিয়ে স্নান করানো যায় না, তাই নব পত্রিকা বা কলাবউকে নিয়ে যাওয়া হয়। আর ভাই কেবল বলত, ওটা তো গণেশের পাশে থাকে তাই গণেশের বৌ। মা দুর্গা কেমন করে গাছ হবে? মা তখন আবার ব্যাখ্যা করে দিতেন যে ন’রকমের উদ্ভিদ, যেমন, বেল, ডালিম, কচু, মান কচু, হরিদ্রা, অশোক, ধান, কদলী, আর জয়ন্তী গাছের চারাকে শ্বেত অপরাজিতা গাছ দিয়ে বেঁধে নবপত্রিকা বানানো হয়। শস্যপূর্ণ বসুন্ধরার প্রতীক রূপে চার দিন ধরে মা পূজিত হন।
সপ্তমীর দিন বিশেষ আমিষ পদ রান্না হত— মাছের মাথা দিয়ে ডাল, ফুলকপি দিয়ে ভেটকি মাছ, চিংড়ির মালাইকারি, আরও কত কি! সে দিন বিকেলে আড়িয়াদহে আর দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর দেখতে যেতাম রিকশা ভাড়া করে। বিরাট বিরাট পুজো হয় ওই দু’টি অঞ্চলে। মাঝে মাঝে ‘হল্ট’ দেওয়া হত মামারবাড়িতে আর জ্যাঠামশায়ের বাড়িতে। জল যোগ এবং বিয়োগ করে ঠাকুর দেখার পর্ব চলত।
অষ্টমীর দিন ভোর থেকেই চলত অঞ্জলির প্রস্তুতি। একে একে স্নান সেরে সবচেয়ে ভাল আর দামি জামাটি পরে অঞ্জলি দিতে যেতাম। বিয়ের আগে পর্যন্ত এ ভাবেই কাটত ষষ্ঠী, সপ্তমী আর অষ্টমী।
বিয়ের পর প্রথম বছর কেটেছিল দক্ষিণ কলকাতার পুজো দেখে। ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্যুরিজমের বাসে চেপে দেখতে গিয়েছিলাম কলকাতার বনেদি বাড়ির পুজো। আধুনিক থিমের দুর্গাপুজোর চেয়ে অনেক মন কাড়ে এই পুজোগুলি। সে বার সপ্তমীর দিন ধর্মতলা থেকে বাসে চড়ে দেখেছিলাম বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের পুজো, জানবাজারে রানি রাসমণির বাড়ির পুজো, শোভা বাজারের রাজবাড়ির পুজো, উত্তর কলকাতার বিখ্যাত লাটুবাবু-ছাতুবাবুদের পুজো। ডাকের সাজের প্রতিমা, চণ্ডীমণ্ডপে সুদৃশ্য চালচিত্রে বিশাল আয়োজন, বাড়ির মহিলাদের সাবেকি গয়না ও বেনারসি শাড়ি পরে মায়ের পুজো গোছানো— সব কিছুতেই ঐতিহ্যের ছাপ।
আর এক বার আমরা একটা গাড়ি নিয়ে বেলুড় মঠে কুমারী পুজো দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানেও খুব নিষ্ঠার সঙ্গে পুজো হয়। তবে আজকাল ধর্মের নামে যে হুজুগের স্রোতে আপামর বাঙালি মেতে উঠেছে তা বেলুড় মঠের ভিড় দেখলেও বোঝা যায়।
পুজো এখন ফ্যাশানেবল হয়ে উঠেছে। প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে আলোর রোশনাইয়ের সঙ্গে অনুরণিত হয় এক দিকে মহিষাসুরমর্দিনীর স্তোত্র আর ডিজিট্যাল এলসিডি স্ক্রিনে রংচঙে বিজ্ঞাপন। আর সেই সঙ্গে থরে থরে সাজানো ফাস্টফুডের গরমাগরম হাতছানি। এক একটি বারোয়ারি পুজো এখন ‘স্পনসর্ড’ পুজো— কোনও এক কোম্পানির সম্পত্তি, কোনও একটি টেলিভিশন চ্যানেল তাদের কিনে নিয়েছে ওই পাঁচটি দিনের জন্য। প্রতিযোগিতার মাপকাঠিতে মা আসেন একটা প্যাকেজে! সেরা প্যান্ডেল, সেরা প্রতিমা, সেরা দর্শক শ্রীমতি, সেরা আরও কত কিছুর ভিড়ে কিন্তু আসল পুজো একটু একটু করে সরে যাচ্ছে। সরে যাচ্ছে পুজোর মূল, অনাদি আবেদন।
আমাদের দোল ছিল কিছুটা অন্যরকম— শহুরে দোল যেমন হয়।
আগের দিন স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখতাম ফাঁকা মাঠে শুকনো গাছপালা কেটে ন্যাড়াপোড়ার আয়োজন। সূর্য ডোবার আগেই প্রস্তুত পাড়ার কচিকাঁচারা। তারপর ঝুপ করে সন্ধে নামলেই সবাই লাইন করে বারান্দায়। আর চারপাশ থেকে ঐক্য সুরে দোলযাত্রার ট্যাগলাইন—
আজ আমাদের ন্যাড়াপোড়া, কাল আমাদের দোল,
পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠবে বল হরিবোল!
এ যেন ন্যাড়াপোড়ার রিয়্যালিটি শো!
পরদিন সত্যনারায়ণের পায়ে ঢিপ করে পেন্নাম করে আবির, পিচকারি, বালতি ভরে রঙের গোলা আর বারান্দা দিয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে রং ভর্তি বেলুন মারা— কাউকে না পাও তো ধোপ দুরস্ত ফতুয়া পরা বাজার অভিমুখী বাবা-দাদাকেই রং দাও কিম্বা বেচারা কাজের মাসিকে একেবারে চুবিয়ে দাও রঙে। এর সঙ্গে অবিরত মুখ চালানো— ঠাকুর ঘর থেকে ঠাম্মার পুজো করা ফুট কড়াই, মুড়কির চুড়ো ক্রমশ নিম্নগামী হতে থাকে, হাতে রঙিন মঠ। তখন কেউ ফতোয়া জারিও করেনি মঠের রঙের ওপর। লাল মঠে এলিজারিন, হলুদে মেটানিল... এটা খেও না, সেটা করো না!
ক্রমে যখন স্কুল পেরিয়ে কলেজ-গেট তখন দোল বেশ সিরিয়াস, অনার্সের চাপে। তবে দোল ছিল প্রকৃত দোলের মতো— অন্য রকমের মাদকতা আর একটা বিশেষ ছুটির দিন পাওয়া। তখন না ছিল ইন্টারনেট, না মোবাইল ফোন, বা হাজারো কেবল চ্যানেল। অগত্যা দূরদর্শনের দোলের বৈঠকি! তবে মায়ের হাতে স্পেশাল রান্না ছিল সেদিনের মুখ্য আকর্ষণ। দুপুরে পোলাও-মাংস কিম্বা রাতে লুচি-আলুর দম ছিল দোলের ‘স্পেশালিটি কুইজিন’।
কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটির এক লাফে ট্রানজিশান, কো-এড বাতাবরণ। রঙিন চশমা চোখে আর সদ্য ফুটিফুটি যৌবনে পা রাখার আনন্দ। হেদোর মোড়ের ফুচকা ততদিনে পার্শিবাগানে পাড়ি দিয়েছে। বিধান সরণির চাচার রোল তখন রাজাবাজারে উত্তীর্ণ। সেবার প্রচুর ফাগ খেলা হল এক পাল ছেলেমেয়ে মিলে। সেই প্রথম ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে দোল খেলে লজ্জায় লাল টুকটুকে হয়ে মিনিবাসে বাড়ি ফেরা। তবুও আনন্দ আকাশে বাতাসে। মা যেন খুশিই হলেন। একরত্তি মেয়েটা কেমন বড়ো হয়ে গেল! এই তো জগতের নিয়ম। প্রকৃতির গাছে পাতা ঝরে নতুন পাতা আসবে। আম গাছে মুকুল আসবে। বাদাম গাছের পাতা ঝরে গিয়ে লাল ফুল সর্বস্ব গাছ হবে এই তো বসন্তের নিয়ম!
তখন প্রাপ্তবয়স্ক হবার পাসপোর্ট যেন পাওয়া হয়েই যেত সরস্বতী পুজোতে। তার পরেই দোল। অত এব সেই পাসপোর্ট হাতে পেয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসা পেয়ে যাওয়া। তাই সব কিছুতেই মায়ের সায়। লালগোলাপ দিয়ে ভালোবাসার কোর্টশিপ চালু হতে না হতেই বিরহিনী যক্ষের মত দোল রঙিন হত নীল খামে পারফিউম মাখানো চিঠির ভাঁজে লিপস্টিকের চুমু পাঠিয়ে সাগরপারে। তখনও হিমেল বসন্তে ই-মেল নেই। দোলের দিনে এক টুকরো চিরকুটের নীরব প্রতীক্ষা। অপ্রত্যাশিত ভালোবাসার সেই নীল খাম পেলাম দোলে। তারপর একে একে গায়েহলুদ, সপ্তপদী আর দোলের গালের লাল রং উঠল সিঁথিতে।
এখন ফাগুনের ফুল ঝরতে না ঝরতেই চকোলেট-ডে, প্রোপোজ ডে, হাগ-ডে, কিসিং-ডে, ভ্যালেন্টাইনস-ডে পেরিয়ে দোল ডে। দোলের আবিরগুঁড়ো অহোরাত্র উড়তেই থাকে ফেসবুক জানলায়, দেওয়ালে, বারান্দায়। দোলের রং গড়িয়ে পড়তে লাগল অরকুট অলিন্দ দিয়ে। সেই রং গিয়ে পড়ল ফেসবুক উঠোনে।
এখন দোলের রঙের ওপরেও ‘টেকশো’! রূপ সচেতন বঙ্গ তনয়ারা ‘স্কিন-ফ্রেন্ডলি’ রং চায়— ইকো-ফ্রেন্ডলি আবির, ভেষজ গুলাল! দোলের উপহারের তালিকায় আইপড কিম্বা পেনড্রাইভের কাটতি বেশি। দোলের কবিতার খাতা লুকিয়ে থাকত বালিশের নীচে। আর এখন সেই কবিতা ঝরে ঝরে পড়ছে ফেসবুকের বারান্দায়, কার্নিশ থেকে সর্বত্র। তবে দোল আছে দোলেতেই। একটু অন্য আঙ্গিকে। তখন ছিল তরতাজা সত্যি গোলাপ, এখন তা ডিজিটাল। ছিল বসন্ত কেবিনে দুজনে মুখোমুখি দুটো ডিমের ডেভিল বা ফাউল কাটলেট। প্রেম এখন বার্গার-মকটেলে আছড়ে পড়ছে অবিরত। দোলের দিনেও সেই ‘হ্যাং আউট’— শুধু বসন্ত কেবিন এখন নীল ফেসবুকের কফিহাউস কিম্বা ডিজিটাল ঠান্ডাই শরবতি মেসেজ আদানপ্রদানে।
আমরা দোলবাজি করি অন্য ভাবে। কিছুটা ফেসবুকি দলবাজিতে অথবা ব্লগবাজির ঠেকে। তবে দোলের সেই আনন্দ আর খুঁজে পাই না। ফুটকড়াই মুড়কি-মঠ হারিয়ে গেছে। হারিয়েছে দোলের আটপৌরে আভিজাত্য। দোলবাজি এখন স্মার্ট হয়েছে। দোলা লাগছে ফেসবুক-বনে কিন্তু দোলের রং লাগে না মনে। দোলের ব্র্যান্ড ডাইলুশান হল!
মকটেল থেকে চকোলেট, কফি থেকে কেক, সোনা থেকে জাঙ্ক— সর্বত্র হিয়ার মাঝে লুকোনো ‘হ্যাপি হোলি’— হোলি ধামাকা, হোলি বাম্পার, হোলি হ্যায়। শপিং মল, মেট্রোরেল, সুইমিং পুল, তন্ত্রে-মন্ত্রে হোলি হ্যায়।
সেই কবে কবি বলেছিলেন ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’। তারা পলাশ চিনুক না চিনুক, দোলের দিন আগতপ্রায়। দোলের রং লাগতে না লাগতেই ফেসবুকে স্টেটাস আপডেট করতে হবে...
ওহ্ ক্যালকাটা! প্রথমে ছিল বেহুলার ভেলা, চাঁদ সদাগরের সপ্তডিঙা, সপ্তদ্বীপের রাজকুমারের ময়ূরপঙ্খী নৌকা, গৌরমাঝির চৌদিকে পালতোলা নৌকা। তার পর দেবী চৌধুরানির বজরা, পর্তুগিজ জলদস্যুদের ছিপ নৌকা, সেই সঙ্গে স্টিমার। আরও পরে রবার্ট ক্লাইভের মাল বোঝাই বড় জাহাজ— এ হল জলযানের ফিরিস্তি।
তার সঙ্গে ছিল কুলীনদের পালকি করে বৌ আনা। ভোরবেলায় হাটের দিকে যাত্রা করা কুমোরপাড়ার মাটির জিনিস ভর্তি গরুরগাড়ি, বিকেল হলেই টুং-টাং শব্দ করে শোভাবাজার কিংবা জানবাজার রাজবাড়ির গজগামিনী ঘোড়ার গাড়ি বা সাহেব-বিবিদের ফিটন গাড়ি। তার পর এল ঘোড়ায় টানা রাজকীয় ট্রাম বা স্ট্রিট-কার— হেনরি ফোর্ডের মডেলটি। ক্রমে ইলেকট্রিক ট্রাম, দেহাতিদের টানা রিকশা। অনেক পরে সাইকেল-রিকশা, বাস, মিনিবাস, মেট্রোরেল, দম আটকানো অটো। এর পরে আয়েস করে অস্টিন অথবা হিন্দুস্তান ফোর্টিন, কখনও সাপের আওয়াজ বের করে স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড কিংবা বেসুরো হর্নের স্টুডিবেকার— যা আজকের যুগে ‘ভিন্টেজ কার’-এর মর্যাদা নিয়ে কোথাও না কোথাও এখনও এই শহরের বুকে বেঁচে আছে। এদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাঁই পাঁই করে ফিয়াট আর আরাম করে অ্যাম্বাসাডর চলত। আর এখন? ম্যারাথনে মারুতির সঙ্গে মার্সিডিজ, হৈ হৈ করে হুন্ডাই, হা হা করে হন্ডা, শোঁ শোঁ করে শেভরোলে আর টগবগ করে টয়োটা ধুলোমাটির শহরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এ হল স্থলযানের বিবর্তনের গল্প!
কত ছোটাছুটি হল। পায়ে হেঁটে পানিহাটি থেকে সুতানুটি, পালকি চেপে ব্যারাকপুর থেকে গোবিন্দপুর, বজরায় চাঁদপালঘাট থেকে কুঠিঘাট, বাসে করে খড়দহ থেকে শিয়ালদহ, ট্রামে চেপে শ্যামবাজার থেকে বড়বাজার, ট্রেনে করে সোনারপুর থেকে বারুইপুর,আবার খানিক হেঁটে তালতলা থেকে তারাতলা। ঠিক এমন করেই পায়ের তলায় সরষে নিয়ে কলকাতার মানুষজন নিয়ে বেঁচেবর্তে আজও কলকাতা আছে কলকাতাতেই। ‘কলিকাতা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে’—এ যুক্তির যথার্থতা কলকাতার সব বাঙালি না বুঝলেও অন্য প্রদেশের বাঙালি-অবাঙালি সকলেই বোঝে। ১৬৯০ সালে জোব চার্নক কলকাতা মহানগরীর গোড়াপত্তন করেছিলেন। যদিও মহামান্য আদালতের নির্দেশে কলকাতার এখন আর কোনও জন্মদিন নেই, শহরের প্রতিষ্ঠাতার গৌরব থেকেও জোব চার্নক বাদ পড়েছেন। তখন শিয়ালদহে সত্যি সত্যি শেয়াল প্রতি সন্ধ্যায় সুর সাধনা করত, বাগবাজারে বেরোত বাঘ, হাতিবাগানে হস্তিকূল না থাক হায়না হা হা করে হাসত, আর গোবিন্দপুরের জঙ্গলে ছিল সাপেদের আধিপত্য। জোব চার্নক অনুধাবন করেছিলেন এ শহরের মাহাত্ম্য। এ শহরের মৃত্তিকার কণায় কণায় কনক-দানা, যার প্রমাণ স্বরূপ কলকাতার নাড়ি নক্ষত্র এখন প্রোমোটারের কব্জায়। শ্রীরামকৃষ্ণ সেই কবে বলেছিলেন না ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা’! মহাপুরুষের বাণী কি বিফলে যাবে? আহা! ঠাকুর দেখে যেতে পারলেন না!
কলকাতা এই মুহূর্তে সেতু-নগরী। আগে ছিল হাওড়া ব্রিজ মানে রবীন্দ্র সেতু, একাই। এখন তো ব্রিজ-ফ্লাইওভারের দায়ে আকাশ দেখাই যায় না! ব্র্যাবোর্ন রোড ফ্লাই ওভার, শিয়ালদার উড়ালপুল, হেমন্ত সেতু, বিজন সেতু, অরবিন্দ সেতু, আরও পরে শম্বুকগতিতে তৈরি হওয়া বিদ্যাসাগর সেতু... তার পর আর ফিরে দেখতে হয়নি। প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় সেতুতে-সেতুতে ছয়লাপ। বেচারা রামচন্দ্র! কী কষ্ট করে সেতু বেঁধেছিলেন! তিনি বেঁচে থাকলে অবশ্যই রামেশ্বর স্টাইলের আরও দু-চারটে সেতু গঙ্গাবক্ষে এত দিনে নির্মাণ হয়ে যেত!
যোগাযোগ ব্যবস্থায় কলকাতার জন্মলগ্নেই বৃহস্পতি তুঙ্গে। ভৌগলিক সীমারেখা আদি অনন্তকাল থেকেই একে বর্গি, জলদস্যুর হাত থেকে যেমন রেহাই দেয়নি, ঠিক তেমনি ইউরোপীয় বণিকদের আশ্রয় দিয়ে তাদের ব্যবসা বাণিজ্যের পথও সুগম করে দিয়েছিল। সেই জন্যই সাহেব-সুবো বুঝতে পেরেছিল তাদের এই প্রাণের জায়গাটি অর্থাত্ ‘ক্যালকাটা’ সারা ভারতবর্ষের রাজধানী হওয়ার যোগ্য। এর অন্যতম ও প্রধান কারণ এ নগরীর যোগাযোগ ব্যবস্থা আর সহজলভ্য শ্রমিক, যারা অন্যের হাতে মার খেয়ে কাজ করতে প্রস্তুত, আর তার সঙ্গে বিদেশি বণিকের মোসায়েবি করতে পিছপা নয় এ রূপ বাঙালিবাবু।
প্রায় অর্ধশত বছর পূর্বে দেশবরেণ্য চিকিত্সক বিধান রায় তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন তাঁর সুপরিকল্পিত স্বপ্ননগরী সল্টলেক। কলকাতার লবণহ্রদ আজকের বাংলার সিলিকন ভ্যালি। আহা! বিধানচন্দ্র দেখে যেতে পারলেন না। তিনি আরও কিছু দেখে গেলেন না, নিজের হাতে গড়া তাঁর এ শহরের চিকিত্সা ব্যবস্থা এখন ঢেলে সাজানো হয়েছে। আধুনিক কলকাতার হাসপাতালের কি ‘দশা’ আজ! রাজারহাটে যে চাঁদের হাট বসেছে তাও দেখে যেতে পারলেন না বিধানচন্দ্র। এ দিকে কেষ্টপুর ক্যানেলে গন্ডোলা চলল বলে!
এ শহরের লোকের মজ্জায় মজ্জায় মাছের সুবাস, হাড়ে হাড়ে হাওয়াবদলের জন্য সদা-ব্যাকুলিত প্রাণ, রক্তের প্রতিটি কণায় কণায় নৃত্য-গীত-বাদ্যানুরাগ। বাঙালি দিনের বেলায় মাছ, ভাত খেয়ে ভুঁড়ি উঁচিয়ে যতটা না ঘুম দিতে পারে, সন্ধেবেলায় মুড়ি-তেলেভাজা সহযোগে ততধিক আড্ডার আরাধনা করে। এ শহরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অন্ধ ভালবাসা, যার গন্ধে গন্ধে বিজাতীয় মানুষ এখানে ভিড় করে, চৌম্বকীয় আবেশে বশ করে কাছে টানে। সস্তার এ শহরে এক বার কেউ এসে ব্যবসা ফাঁদলে ধনী হয়,পস্তায় না। এ শহর পারে শুধু পরকে আপন করতে, নিজেকে পেছনে ফেলে পরকে এগিয়ে দিতে। নিজের ব্যবসায় ইতি টেনে ভিন্ দেশিদের স্বাগত জানাতে।
শত-সহস্র তারকাখচিত এ শহরের আকাশ। যার রূপে সুচিত্রা, রসে ভানু, বর্ণে সৌমিত্র, কণ্ঠে শানু। মানুষের শয়নে উত্তমকুমার, স্বপনে হেমন্তকুমার আর জাগরণে কিশোরকুমার। কলকাতাবাসীর ছন্দে আনন্দ-তনুশ্রী, সুরে শচীনকর্তা-কৃষ্ণচন্দ্র, সঙ্গীতে নজরুল-রবীন্দ্র, সাহিত্যে বঙ্কিম-শরত্চন্দ্র, স্পর্শে সিনিয়র-জুনিয়র সরকার, শিল্পকলায় যামিনী-গগনেন্দ্র, স্বর্ণে পিসিচন্দ্র আর সর্বোপরি মিষ্টান্নে যাদবচন্দ্র— এদের নিয়েই বাঙালি বহাল তবিয়তে কাল যাপন করছে। যুগ যুগ ধরে এ শহর তৈরি করেছে ব্রান্ডেড-ব্যাক্তিত্ব— অফুরান হাসিতে ঘনাদা, রহস্যে ফেলুদা, রোমাঞ্চে টেনিদা।
আধুনিক কলকাতার জলে এখন আর্সেনিক, নবনির্মিত নর্দমার মুখে প্ল্যাস্টিক যা কিনা পরিবেশবিদের উদ্বেগের কারণ। মিষ্টান্নে মেটানিল-ইয়েলো এবং সরবতে এলিজারিন-রেড রসায়নবিদের গবেষণার বিষয়। আজকের বহুতলে বর্ণময় কলকাতার বুকেপিঠে শপিংমল, মাল্টিপ্লেক্স।
যে শহরের আকাশে-বাতাসে মাছের আঁশটে গন্ধ, কেন তার কাছে অবাঙালির ভিড়? চিংড়িহাটায় জ্যাম নিয়ে, ট্যাংরার চাইনিজ নিয়ে আমরা আজও আছি ও থাকব। ভেতো বাঙালির বাজারের থলি থেকে সজনেডাঁটা আর পুঁইশাক উঁকি দেবেই। বাঙালির পোস্ত চচ্চড়ি ছাড়া ডাল রুচবে না। বাঙালি যুত করে মাছের কাঁটা চচ্চড়ি চিবোবে, বাঙালি মজা করে মৌরলার টক খাবে আর সরষের তেল ছাড়া ইলিশ রাঁধবে না। এই নিয়ে তারা শান্তিতে থাক না, ক্ষতি তো নেই! তাতে যদি অন্যের ক্ষতি না হয়! রোজ সন্ধ্যায় তুলসীতলায় আলো দিয়ে রেডিও খুলে অনুরোধের আসরে প্রতিমা-আরতি শুনুক। অথবা বিকেলে ভোরের শুকনো ফুল ফেলে শাঁখ বাজিয়ে বাড়ির মঙ্গল কামনা করুক।
নৈশাহারের পরে দিলখুশের জন্যে মন উসখুস করবে, নতুন প্রজন্ম লোডশেডিং-এ অঙ্ক কষে বিদেশ যাবে, বাংলা ব্যান্ডের ‘ফাজলামি’ আর নেতাদের ‘পাগলামি’ নিয়েই পড়ে থাকবে— ক্ষতি কি? শুধু দফতরের ডেস্কে বসে ঘুমোব না আর নিজের পায়ে কুড়ুল মারব না। তা হলেই আমাদের মোক্ষলাভ হবে। সৃজনশীল বঙ্গসন্তান বুদ্ধি বেচে বড় হবে, অদূর ভবিষ্যতে কলকাতা হবে ‘বিশ্বের বিনোদন হাব’— যেথায় আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সৃষ্টি সুখের উল্লাসে উদ্দাম নৃত্য-গীত-বাদ্যের সমন্বয়ে জগতের মনোরঞ্জন করে ‘কলিযুগ কি কলিউড’-এর আখ্যা পাবে। এখানেই তার সার্থকতা। কলকাতার মানুষ দোল-দুর্গোত্সবের দক্ষযজ্ঞ নিয়ে, বামে-ডানে দলাদলি করে, নন্দনে সত্যজিতের বন্দনা, রবীন্দ্রসদনে রবির আরাধনা আর রবীন্দ্র সরোবরে প্রেমের উপাসনা নিয়ে যদি কোনও এক দিন জগতের আনন্দযজ্ঞে নিমন্ত্রণ পায়! আমাদের কল্লোলিনী কলকাতা যেন ভারতবর্ষের রাজধানী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। উপর থেকে নেতাজি-নেহরু-গাঁধীরা দিল্লির মসনদের ঘাড় ধরে কলকাতায় নিয়ে আসার আদেশ দেন!
এই জনমেই ঘটাতে চাই জন্ম-জন্মান্তর... সুন্দর, হে সুন্দর!
আবার দেখতে দেখতে আমরা নতুন বছরের দোরগোড়ায়। নতুন বাড়ির হাউস ওয়ার্মিং পার্টির তোড়জোড় শুরু। সারা বছরের পুরনো খাতাপত্তর ঝেড়েঝুড়ে তাকে গুছিয়ে, সকলের বাড়িতেই এখন বসন্ত বিদায়ের তোড়জোড়। আবার গরমের বিকেলে গা ধুয়ে পরে নেব মলমল শাড়িখানা, বরষার সান্ড্যাক চটিজোড়া যত্ন করে রেখে দেব, ভাদ্রের রোদে পুরনো বালুচরি রোদ খাওয়াব, শীতের পশমিনা-বালাপোশ মথ বলের গন্ধে ভরপুর করবে। ফাগুনের আগুন নিভে যাবে দোলের সঙ্গে সঙ্গে আর তার সঙ্গেই চৈত্রসেলের চিত্কার! চৈত্রমাস পড়তে না পড়তেই পুরনো বছরটার পাততাড়ি গোটানোর ধান্ধা। নতুন বছর আসবে বলে ঘর ঝাড়াপোঁছা, সেই অছিলায় নতুন জামা, আনন্দে হইহই করে হ্যাং আউটের প্ল্যান, নবপঞ্জিকা, হালখাতা আর নতুন ক্যালেন্ডার। সেইসঙ্গে বাঙালির ঝালিয়ে নেওয়ার পালা সেই বং-কানেকশন। কী করে ভুলি আমরা? যতই ইংরেজি ছবি দেখি, ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে অনর্গল কথা বলি আর গোগ্রাসে কন্টিনেন্টাল খাবারদাবার গিলি না কেন, আদতে আমরা ঝোল-ঝাল-অম্বলের ভক্ত।
চৈত্রশেষে অকালবোশেখি পাওয়ার মতো বাঙালির আরও একটা বড় প্রাপ্তি হল পয়লা বৈশাখের অপ্রত্যাশিত নতুন জামাকাপড়, নিদেন একটা গানের সিডি অথবা একখানা বই। ঠিক তক্ষুণি মনে হয় ছোটবেলার কথা। মনে মনে আমাদের বয়স কিন্তু বাড়ে না। সেই পয়লা বৈশাখের দিন বাবার সঙ্গে দোকানের হালখাতার চিঠি নিয়ে, বরফকুচি দেওয়া কাচের গ্লাস ওপচোনো অরেঞ্জ স্কোয়াশ আর সঙ্গে বগলদাবা করে মিষ্টির বাক্স। ঠাকুমার জন্য বাড়ি নিয়ে যেতে হবে সোনার গয়নার দোকানে নতুন বাংলা ক্যালেন্ডার। দিদিমার জন্য বুকস্টল থেকে নতুন পঞ্জিকা, তা-ও নিতে হবে মনে করে। কমপক্ষে চারটি দোকানের মিষ্টির বাক্স একত্র জড়ো করে বাড়ি ফিরে বসবে আমাদের সান্ধ্য বৈঠকি। সঙ্গে গান তো হাতের পাঁচ। সবচেয়ে মজা লাগত মাছের বাজারেও হালখাতার মৌরসী পাট্টা দেখে। সে দিন মাছবাজার ধুয়েমুছে সাফ এক্কেবারে। মাছের আঁশটে গন্ধ কাটানোর জন্য ফিনাইল, ধূপ-ধুনো কত্ত সব কায়দা। আর মাছওয়ালাও ধবধবে পাজামা-পাঞ্জাবি চড়িয়ে বসেছেন জম্পেশ করে। আমি আছি বাবার হাত ধরে লেসের ফ্রিল দেওয়া, নতুন ছিটের নরম ফ্রকে। প্রথম বার গিয়ে ভেবেছিলাম সে বুঝি মাছ দেবে ফ্রি-তে। সে গুড়ে বালি! পয়লা নম্বর মিষ্টির বাক্স নিয়ে থরে থরে বসে আছে সে-ও!
পয়লা বোশেখের কথা মনে হলেই বেশি করে মনে পড়ছে হাতিবাগান বাজারের কথা। আমার কলেজবেলার পাঁচ-পাঁচটা বছরে এই হাতিবাগানের শাড়ির দোকানগুলো থেকে হইহই করে ভিড় মাথায় নিয়ে বন্ধুরা মিলে শাড়ি কিনতে যাওয়া, সে-ও এক দারুণ অভিজ্ঞতা। আর সেই সঙ্গে রূপবাণী-তে উত্তম-সুচিত্রার ছবি দেখে সিলভার ভ্যালির মুচমুচে কবিরাজি কাটলেট? ফড়িয়াপুকুরের টকি শো হাউসে তখন ভাল ভাল ইংরেজি ছবিগুলো আসত। বাবা নিয়ে যেতেন দেখাতে। টাওয়ারিং ইনফার্নো, টোয়েন্টি থাউসেন্ডস লিগস আন্ডার দ্য সি, টেন কমান্ডমেন্টস, বেনহার— কত ছবি না দেখা হয়েছে ওই হলে। আর ফেরার পথে ফড়েপুকুরের সেই অমৃতর পয়োধি?
আর মনে পড়ে স্টার থিয়েটারের কথা। সে বার কলেজ থেকে ফেরার পথে সুপ্রিয়াদেবীর "বালুচরী" নাটকের টিকিট কেটে নিয়ে এলাম বাড়ির সকলের জন্য। পর দিন পয়লা বৈশাখে সকলে মিলে নাটক দেখে বাড়ি আসা হল। কি দারুণ নাটক! যেমন কাহিনি তেমনই অভিনয়। ফিনিক্স পাখীর মতো আগুনে ভস্মীভূত হয়ে আবার সেই ছাই থেকে উঠে এসেছে স্টার। স্টার থিয়েটারের সিনেমায় উত্তরণ হয়েছে। ভাবলেও নস্ট্যালজিয়ায় সেই নাটক শুরু হওয়ার মিউজিকাল সোনাটা কানে বাজে।
হেদুয়ায় কলেজ গেটের পাশে রোজ সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা অবধি দাঁড়িয়ে থাকত মতিদা। এ পাড়ার বিখ্যাত ফুচকাওয়ালা। তার ফুচকা যেমন বড় বড়, গোল্লা গোল্লা ও মুচমুচে আর তেমনই সুস্বাদু তার যাবতীয় অনুপান। একদম ঠিকঠাক টক, ঝাল ও নুনের কম্বিনেশন। আমাদের অনেক গবেষণা হত সেই তেঁতুল জলের রসায়ন নিয়ে। বাড়িতে অনেক বকুনিও খেতাম রোজ রোজ ফুচকা খাওয়া নিয়ে। কিন্তু মতিদা মানুষটা আর তার ফুচকার টানকে কিছুতেই এড়াতে পারতাম না। মতিদার ছিল একটাই স্লোগান, "ইয়ে ফুচকা খাইয়ো তো মতিদাকা গুণ গাইও", "আমার ফুচকায় অসুখ করবে না। কলেজের ফিল্টারের জলে তৈরি এই তেঁতুলজল।"
আমার দিদি তখন পড়ত অন্য কলেজে। দিদিকে বলতাম "এক দিন তোকে মতিদার ফুচকা খাওয়াব।" তা সে আর হয়ে উঠত না। সে বার পয়লা বোশেখের ঠিক আগে মা নতুন জামাকাপড় কেনার টাকা দিলেন। আমরা দু'বোনে হাতিবাগান থেকে জামাকাপড় কিনে একটা চায়ের দোকানে এসে চা-জলখাবারের অর্ডার দিয়ে দেখি, পার্সের সব টাকা শেষ। মাত্র একটা কয়েন পড়ে আছে। এই হল পয়লা বৈশাখের হাতিবাগান! যেখানে অজস্র জিনিস আর তার হাতছনিকে উপেক্ষা করা যায় না। এ দিকে প্রচন্ড খিদে পেয়েছে আর বাড়িও ফিরতে হবে। হাঁটা লাগালাম কলেজের দিকে। বাসে উঠব যে সে পয়সাও নেই। হাঁটতে হাঁটতে দুজনে পৌঁছলাম কলেজ অবধি। সেখানে মতিদা তখনও দাঁড়িয়ে। দিদিকে দেখামাত্রই মতিদা যথারীতি তার স্লোগান আওড়াল, "ইয়ে ফুচকা খাইয়ো তো..."
দিদিকে কথা দিয়েছিলাম এক দিন ফুচকা খাওয়াব। মতিদা শালপাতা ভাঁজ করে এগিয়ে দিল আমাদের সামনে। আমি বললাম, "না, মানে একটা কথা ছিল মতিদা।" মতিদা বলল, "খাও খাও, কিচ্ছু হবে না।" বললাম, "না না, সে কথা নয়।" মতিদা বলল, "মা বকবে?” বললাম, "না না, পয়সা ফুরিয়ে গেছে যে।" মতিদা বলল, "কাল দিও, আগে তো খাও।" আমি বললাম, "বাড়ি ফেরার পয়সাও নেই।" মতিদা বলল, "আমি দিচ্ছি, কাল দিও।" আমরা পেট পুরে ফুচকা খেলাম। এত ভাল বোধ হয় আগেও লাগেনি কখনও। আরও যেন বড়বড়, গোল্লা গোল্লা, মুচমুচে ফুচকা! আরও পার্ফেক্ট টক-ঝাল-নুনের কম্বিনেশন!
এই পয়লা বোশেখ এলেই আমার মতিদার কথাও ভীষণ মনে পড়ে!
(পুজো ২০১৪)
‘পুজোটা এ বার বড্ড তাড়াতাড়ি, ধুস ভাল্লাগে না, জলে-কাদায় এ বার যে কি হবে! জলে ডুবে কলকাতার প্যাচপ্যাচে পথঘাটে পা মচকে সে বার আমার কি করুণ অবস্থা হল। আগের বছরের খুঁটিপোঁতার গর্ত এখনও বোজায়নি আর সেখানেই না পড়ে...। তার পর সেখানে প্রোমোটার রাজের কৃপায় রাস্তায় চলায়ই দায়। স্টোনচিপস, বালি, ইট-কাঠ বোঝাই রাস্তার দু’পাশ, ফুটপাথে হকার, খালপাড়ে ঝুপড়ি। তবে সেখানকার মানুষজন তোমাকে বড় ভক্তিছেদ্দা করে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে একটা বট কিংবা অশ্বত্থ গাছ হলেই তোমাকে পিতিষ্ঠা করে ওরা। আমি তো সেখানে পাত্তাই পাই না। এই বছরে এক বার যা পুজোর সময় আমাকে ওরা ফুলবেলপাতা ছোড়ে।’ মা দুর্গা বললেন মহাদেবকে।
মহাদেব বললেন, ‘গিন্নি, তোমার যাবার যে কী দরকার, তাই বুঝি না... বাপের বাড়ি, বাপের বাড়ি। প্রতি বছর এই আদিখ্যেতা আমারও পোষায় না।’
‘সারাটা বছর তো এই ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে আছি আমরা। ন যজৌ, ন তস্থৌ অবস্থা। বলি তোমার অসুবিধেটা কোথায় বাপু? তোমার আফগারি বিলাসের তো ব্যবস্থা থাকছেই। আর ওই ষাঁড় দুটো তো রইলই পাহারায়। থরে থরে সিদ্ধি-গাজা-আফিম-ভাঙ সব কিনেকেটে রেখে দিয়ে যাই তো।’ দুর্গা বললেন।
এ বছর সুদূর ইতালি থেকে মহাদেবের এক ভক্ত ইলারিও এলাতজি কৈলাস মানস সরোবর বেড়াতে গিয়ে মহাদেবকে একটি গন্ডোলা উপহার দিয়ে এসেছেন। এতক্ষণ ধরে মা-বাবার কথোপকথন শুনতে পেয়ে প্রত্যুৎপন্নমতি সরো বললে, ‘আইডিয়া! এ বার তা হলে গন্ডোলাটা আমরা কলকাতায় নিয়ে যাব।’
লক্ষ্মী বললে, ‘বেঁড়ে বললি বোন আমার।’
গণশা ভুঁড়ি চুলকোতে চুলকোতে শুঁড়টা দুলিয়ে সম্মতি দিল। আর কেতো সেই কথা শুনে ঘরের বাইরে পার্ক করে রাখা গন্ডোলাটিকে ঘষেমেজে সাফ করতে উঠেপড়ে লেগে গেল। বলল, ‘ইয়েস! এ বার আমরা আমাদের মতো থিমসর্বস্ব গমন শুরু করব কৈলাস থেকে। গন্ডোলায় আগমন ও প্রত্যাবর্তন। দাঁড়াও সে গন্ডোলা এখন বরফের আস্তরণে বন্দি হয়ে আছে। তকে চেঁচে নিয়ে, রং চং করে তবে আমাদের যাওয়া।’
গণশা শুঁড় নাচিয়ে বিজ্ঞের মতো বললে, ‘নীল-সাদা রং লাগাস ভাই, নয়তো কলকাতায় আমাদের ল্যান্ডিংটা সুখের হবে না। আর সরো তুই সারা রাস্তায় আর যাই গান গাস না কেন পশ্চিমবাংলায় ঢুকে রোবিন্দসংগীত ধরিস বাপু। কলা-কৃষ্টি-সঙ্গীত-বাদ্যের সর্বজনীন পীঠস্থান পশ্চিমবাংলা।’
দুর্গা সহাস্যে বললেন, ‘দেখ, কেমন ছেলে বিইয়েছি! লোকে সাধে আমায় বলে রত্নগর্ভা! কিন্তু কৈলাস থেকে কলকাতা এই গন্ডোলা বয়ে নিয়ে যাবে কে?’
সরো বললে, ‘গুগল ম্যাপস খুলে দেখে নিচ্ছি রুটটা। পালোয়ান সিংহ অসুর সামনে বসে দাঁড় বাইবে গন্ডোলার। আর মা তোমার সিংহকে বোলো তার সামনের হাত দু’টো গন্ডোলার বাইরে রেখে জল কাটতে কাটতে যাবে সে। উল্টো দিকে কেতোর ময়ূরটা মুখ বের করে থাকবে। বাংলায় এমন নৌকো তো ছিল আবহমান কাল ধরে।’
লক্ষ্মী বলল, ‘ময়ূরপঙ্খী যাকে বলে। শুধু রুটটা দেখে নে ভাল করে। কৈলাস টু কলকাতা।’
সরো বললে, ‘আমাদের গন্ডোলার নাম দেব সিংহ-ময়ূরপঙ্খী। আর বাকিরা কোথায় বসবে?’
মাদুর্গা উল্লসিত হয়ে বললেন, ‘কেন অসুরের পেছনে আমি। আমার দু’পাশে তোরা দুই বোন যেমন থাকিস।’
কেতো বললে, ‘ভাল বলেছ। আমরা দুই ভাই উল্টো দিকে মুখ করে ময়ূরের দিকে বসবখন। গণশা একাই ব্যালেন্স করে দেবে তোমাদের।’
সরো বললে, ‘হোয়াট অ্যাবাউট ইঁদুর?’
লক্ষ্মী বললে, ‘আমার রাজহাঁসের আর তোর প্যাঁচার বাবা কোনও জ্বালা নেই। সুন্দর ডানা মেলে গন্ডোলার উপর দিয়ে উড়তে উড়তে যাবে প্যাঁচা। আর রাজহাঁস জল কেটে কেটে ঠিক সাঁতরে ম্যানেজ করে দেবে। মুশকিল হল ইঁদুরটাকে নিয়ে। তেনার আবার সারা দিন দাঁত বেড়ে চলেছে। কিছু কাটতে না পারলে আমাদের জামাকাপড় সব যাবে ওর পেটে।’
গণশা বললে, ‘বেশ, আমার ইঁদুরকে নিয়ে তোমাদের যখন এত জ্বালা...।’
লক্ষ্মী বললে, ‘আহা, রাগ করছিস কেন? আমার ধানের ঝাঁপি থেকে ধান ছড়িয়ে দেব গন্ডোলার মধ্যে, ও সারাটা রাস্তা খুঁটে খেতে খেতে পৌঁছে যাবে।’
সরো বললে, ‘গন্ডোলায় উঠে মাঝিকে গান গাইতে হয় কিন্তু। অসুর কি ওই সব সূক্ষ্ম, রুচির অধিকারী?’
দুর্গা বললেন, ‘সরো, তুই বাবা ওটুকুনি ম্যানেজ করে দিস।’
‘আমার রুদ্রবীণা অবসোলিট। আমাকে বেস গিটার কিনে দাও তবে।’
মা দুর্গা বললেন, ‘ও সরো, খালি গলাতেই গলা ছেড়ে গান গেয়ে দে মা এ বারটার মতো। কলকাতা পৌঁছে তোর বেস গিটারের অর্ডার দেব।’
‘রবীন্দ্রসঙ্গীতকে অপেরার মতো গাইতে দেবে ওরা? গন্ডোলায় অপেরা সঙ্গীত কিন্তু অবশ্য কর্তব্য। ইলারিও বলে দিয়েছে বাবাকে। নয়তো গন্ডোলার ভরাডুবি। গলা ছেড়ে চিৎকার করে গাইতে হবে গান। আমাদের মাঝিমল্লার প্যানপ্যানে ভাটিয়ালি গাইলে হবে না। ইতালির লোকগীতি কি যেন নামটা তার, ভুলে গেছি।’ সরো বলে।
কেতো ঝাঁ করে সার্চ করে বলল, ‘বার্কারোল।’
‘হ্যাঁ, আমাদের লোকগীতির সঙ্গে আকাশপাতাল তফাত। আমায় ডুবাইলিরে, ভাসাইলিরে মার্কা গান ওরা গায় না। ওরা থাকুক ওদের বার্কারোল নিয়ে। আমরা আমাদের মতো করে গাইব, ব্যস।’ সরো বলল।
কেতো বলল, ‘এ সব তো ঠিক আছে। কলকাতায় পৌঁছে বানভাসি পথঘাটে গন্ডোলা চড়ে আমাদের হোল ব্যাটেলিয়ান যখন নামবে তখন ভিড়টা আন্দাজ করতে পারছ? প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে তখন থিম পুজোর মাতলামি, আমাদের নিয়ে হইচই... সব মিলিয়ে আমরা ঘেঁটে ঘ।’
‘যা বলেছিস। এ দিকে বৃষ্টি রিমঝিম, ও দিকে পুজোর থিম। এ পাড়ায় জল থই থই, ও পাড়ায় শুধু হইচই...। তার পরে তারস্বরে মাইক, ভিড়ে ছয়লাপ মোটরবাইক। কলকাতার হকারময়তা, আর হকারদের কলকাতাময়তা। তার চেয়ে বরং এই বেশ ভাল আছি আমরা। ওই ক’টা দিন জমিয়ে খাই, চমরীর দুধের মালাই। ব্রাহ্মণী হাঁসের রোস্ট। এ বারে পুজোয় যাওয়াটা পোস্টপন্ড কর! লেট আস প্ল্যান ফর এ প্লেজার অটাম ট্রিপ!’ লক্ষ্মী বললে চিন্তিত হয়ে।
তা হলে আমাদের গন্ডোলা প্ল্যান? মা দুর্গা কেঁদেই ফেললেন।
‘মা তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যাব বলেছি যখন যাবই আমরা। আর গন্ডোলা চড়েই যাব। তবে কলকাতায় নয়। এ বার অন্য কোথাও।’
কেতো বললে, ‘সেখানে শিল্পীদের খুব সম্মান বুঝলি সরো। আমাদের মতো আম আদমি পাত্তাই পাবে না। তার উপর এ বার শুরু হয়েছে বেঙ্গল পুজো লিগ (বি পি এল)-এর হুজ্জুতি।’
‘সেটা আবার কী রে?’ লক্ষ্মী বলল।
‘শোন, ইংল্যান্ডের ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ। তার নকলে আমাদের ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ। যার ধাক্কায় ক্রিকেট প্লেয়াররা ক্রিকেট ভুলে গিয়ে ফ্যাশন মডেল ও টেলিভিশন স্টার হয়ে গেল। এখন ক্রিকেটের কভার ড্রাইভের বদলে সেক্সি মন্দিরা বেদীর হল্টার বেশি পাত্তা পেল।’ কেতো বললে।
‘তার সঙ্গে আমাদের কী সম্পর্ক?’ সরো বললে।
‘শোন, তবে বলছি। প্রিমিয়ার লিগে ক্রিকেটারদের খাতির দেখে হকিওয়ালারা করল হকি লিগ, ব্যাডমিন্টনে করল ব্যাডমিন্টন লিগ। এর পরে পেশাদারি ফুটবল লিগ ও কবাডি লিগও হচ্ছে।’
‘কিন্তু তার সঙ্গে শারদীয়া উৎসবের কী সম্পর্ক?’
‘ওটাও বোঝো না? কাগজ পড়ো না? এখন আর পুজোর প্যান্ডেলে গিয়ে হাত পা গুটিয়ে ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে পাঁচ দিন অহোরাত্র বসে থাকলে চলবে না। কমার্শিয়াল ব্রেকের ফাঁকে ফাঁকে হাত-পা ছুড়ে কিছু একটা তামাশা দেখাতে হবে। তবেই না দর্শকরা থুড়ি ভক্তরা আনন্দ পাবে আর পুজো এনজয় করবে। আর তবেই না প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ফুটফল হবে। তবেই না চ্যানেলের টিআরপি বাড়বে। আর তবেই না স্পনসররা পয়সা ঢালবে আর তবেই না উদ্যোক্তারা সেই টাকায় মোচ্ছব করবে।’
‘তার মানে আমরা নিছক এন্টারটেইনার?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ মশাই। ঠিক যেমন খোলায়াড়দের খেলায় পারদর্শিতার চেয়ে চিত্তবিনোদেন করা বেশি জরুরি, তেমনই আমাদের জ্ঞান, বিবেক, বৈরাগ্য, ভক্তির আর কোনও প্রয়োজন নেই। ও সব এখন অবসোলিট। আম আদমিকে খুশ করো, তা হলেই জুটে যাবে সারদশ্রী মার্কা একটা অ্যাওয়ার্ড।’
‘তা হলে আমাদের এখন কী করণীয় সেটা বল।’
‘আমাদের তিন মহিলাকে বোল্ড অ্যান্ড বিউটিফুল ড্রেস পরতে হবে। ওই সব আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ির বেনারসী শাড়ি আর ব্লাউজ পরা চলবে না। পারলে আইপিএলের চিয়ার লিডারদের মতো উদ্ভিন্ন যৌবনা হয়ে নাচতে হবে, নাচাতে হবে পাবলিককে। কেতো আর অসুরকে চুলবুল পান্ডে মার্কা ভায়োলেন্ট নাচ নাচতে হবে। পারলে মহিলা কনস্টেবলকে পাঁজাকোলা করে।’ লক্ষ্মী বলল।
গণশা বললে, ‘আমি বাপু নাচাকোঁদায় নেই।’
কেতো বললে, ‘ঠিক আছে, তোমাকে বীরাক্কেল কিংবা হাস্যকবি সম্মেলনের মতো কাতুকুতু দিয়ে হাসাতে হবে। এই এ বারের বি পি এল।’
সো উই আর গোয়িং। দিস পুজো গন্না বিপিএল! থ্রি চিয়ার্স ফর বিপিএল। হিপ হিপ হুররে। মা দুর্গার চার ছেলেপুলে মহা আনন্দে চিৎকার করে উঠল।
আদরের শীতে ভাসমান শহর ( শীত- ২০১৫ )
শীতের জন্য সারাটা বছর ঠিক যেন হাপিত্যেশ করে বসে থাকা!
ভোরে উঠে চোখ রগড়িয়ে কুয়াশার ফাঁক দিয়ে সূর্যকে চোখ মারব বা লেপ-বালাপোশ নরম করে গায়ে টেনে নিয়ে আরও একটু বিছানার ওম নিচ্ছি। কর্তা জিজ্ঞাসা করলেন, “আজও বাজার যেতে হবে?” গিন্নির গলায় আদুরে মেজাজ, “আজ একটু ওলকপি এনো প্লিজ! ফ্রিজে অনেকটা চিংড়ি আছে, কড়াইশুঁটি দিয়ে রাঁধব।” অথবা “খেজুরের গুড় ওঠেনি গো? দু’টো নারকেল এনো তা হলে। বাবার জন্য একটু পাটিসাপটা বানিয়ে নিয়ে যাব।” এই হল শীতের কলকাতায় আম বাঙালিবাড়ির ভোর।
কুয়াশার পরত ছিঁড়ে ঘুম ভাঙে কলকাতার। হ্যালোজেন নিভে যায়। আমি কান পেতে রই। উশখুশ প্রাণ। খবরের কাগজ ছিনিয়ে নিয়ে দেখা শীতের কলকাতার কোথায় কী আছে! আজ নন্দনে সিনেমা তো কাল আইসিসিআর-এ চিত্র প্রদর্শনী। অ্যাকাডেমিতে নাটক কিংবা মিলনমেলায় টেরাকোটা-ডোকরার আমন্ত্রণ। আর কয়েক দিন পরেই তো শীতের কলকাতার বড় পার্বণ ‘বইমেলা’। রবিবার ভোরে ঘুম ভাঙে কড়াইশুঁটির কচুরি আর আলুরদমের গন্ধে অথবা সরু-চাকলির সঙ্গে স্রেফ পয়রা গুড়ের মাখামাখিতে। খবরের কাগজ হাতে তুলতেই কয়েকশো পিকনিক স্পট। এখন আর যেমন কেউ চড়ুইভাতি বলে না, তেমনই বাড়ির মেয়েদেরও মাঠে-ঘাটে-জঙ্গলে গিয়ে রান্নাবান্নাও করতে হয় না। কেটারিং-এর ঘাড়েই সব দায়িত্ব। চাই শুধু একফালি সোনালি রোদের সকাল, নীল আকাশ আর একচিলতে সবুজ খোলা মাঠ। ঠান্ডায় লং ড্রাইভ পুরো জমে ক্ষীর। অমৃত কমলালেবুর সকাল। বেগুনি-মুড়ি অথবা জয়নগরের মোয়া। শীতকাল হল বাঙালির কফি অ্যান্ড কেক মাস। তাই ওই কম্বোতে শীত-বাঙালির ফ্যাশন ইন। শীতের কলকাতায় বাঙালি চা কম খায়। ঊর্দ্ধমুখী হয় কফির চাহিদা। তবে ব্ল্যাক কফি নয়। অপর্যাপ্ত দুধ-চিনির কফি ছাড়া রোচে না তাদের। সন্ধেয় চাই স্যুপ। এটা নাকি শীতকালীন পানীয়! পাড়ায় পাড়ায় চলে ব্যাডমিন্টন। কখনও বা রাস্তা আটকে বারোয়ারি ক্রিকেট।
ছোটবেলায় মা দক্ষিণের বারান্দায় পিঠে ভেজা চুল রোদের দিকে মেলে উল বুনতেন। এক কাঁটা সোজা, পরের কাঁটা উল্টো। ঘর বন্ধ করা শিখেছিলাম উলকাঁটায়। এখন সেই ঘর খুলতেই ভুলে যাই। শীতের মিঠে রোদ পিঠে নিয়ে কমলালেবুর দুপুরগুলো খুব মনে পড়ে। আর মনে পড়ে স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার কথা। ক্লাসে ওঠার ক্ষণও পড়ত ঠিক বড়দিনের প্রাক্কালে। শীতের ভাল-মন্দ, সার্কাস, মেলা, চিড়িয়াখানা কিংবা চড়ুইভাতি— সবই নির্ভর করত সেই মাহেন্দ্রক্ষণের উপর।
দুটো মাস বই তো নয়, যেন সম্বত্সরের পরম প্রাপ্তির আবহাওয়া। প্রবাসের বন্ধুদের বলে ফেলি, “শীতকালে আসছিস তো তোরা?” আমার গর্বের মহানগরের রাজমুকুট যেন বড্ড বেশি ঝলমলে হয়ে ওঠে এই শীতে। মাঘের শীত, পৌষের পিঠে, লেপের ওম— সব আমাদের। তোরা দেখে যা একটি বার, কী সুখেই আছি আমরা! বিদেশে ঝোলাগুড় পাবি? টাকির পাটালি পাবি? রুপোর মতো চকচকে দেশি পার্শে পাবি? বাজারের থলি ভর্তি করে মৌরলা আর তোপসে আনব তোদের জন্য। কলকাতার মাছের মতো স্বাদ আর কোথায় পাবি! ভায়ের মায়ের স্নেহের চেয়েও বেশি শীতের টাটকা মাছ। নলেন গুড়ের সন্দেশ পাবি। আছে তোদের দেশে? কলকাতায় আছে। ফ্লুরিসে বসে কেক দিয়ে কফি খাওয়াব। ভিন্টেজ কার দেখাব। গঙ্গাবক্ষে স্টিমার চড়াব। কল্পতরু উত্সব দেখাব। হর্টিকালচারের ফুলের মেলায় নিয়ে যাব। চামড়াজাত জিনিসের মেলা লেক্সপোতেও নিয়ে যেতে পারি। ওয়েলিংটনে গোলগাল ভুটিয়া মাসির শীতপোশাকের অস্থায়ী দোকানে যাবি? খুব সস্তা। সস্তার ফুটপাথও আছে আমাদের। আন্ডার এস্টিমেট করিস না মোটেই। আমরা নিপাট আতিথেয়তার ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছি সারা বছর তোদের জন্য। অতিথি দেব ভব!
একটি বার দেখে যা তোরা! বিশ্বায়নের ঢেউতে হাবুডুবু খাচ্ছি আমরা। আমাদেরও শপিং মল আছে। প্রচুর ফ্লাইওভার আছে। মাল্টিপ্লেক্সের রমরমা দেখে যা। বড়দিনের কলকাতার আলোর রোশনাই? পার্ক স্ট্রিটের ট্রিঙ্কাস-এর ঊষা উত্থুপরা এখন আরও গ্লিটসি হয়েছে রে। কলকাতার টিন-রা এখন তন্ত্র-মন্ত্রে দীক্ষিত। শীতে আরও রঙিন হয় পার্ক স্ট্রিট। রেস্তোরাঁতে ক্রিসমাস ডিনারে জায়গা মেলে না জানিস! এত ভিড় সেখানে। প্রিন্সেপ ঘাটে শীতের ওম নিয়ে, গঙ্গায় ভাসমান বয়াগুলোর মতো জেরিয়াট্রিক সব নাগরিক নিয়ে, জানু-ভানু-কৃশানু পথশিশুদের নিয়ে আমরা বেশ ভাল আছি। কফিহাউসের বাড়বাড়ন্ত দেখলে তোরা অবাক হবি। হরেক কিসিমের কফির ঠেক এখন শহরে।
আমাদের বাপ-ঠাকুর্দা অনেক ঠাটঠমক শিখেছিলেন সাহেবদের কাছ থেকে। সওদাগরি অফিসে কাজ করেছেন। এক আধ পেগ হুইস্কি বা ভ্যাট সিক্সটি নাইন তাঁরাও খেতে শিখেছিলেন সাহেবদের হাত ধরেই। স্যুট-বুট পরেছেন শীতকালে। সেই স্যুট বানানোর ট্র্যাডিশন টিকিয়ে রেখেছিল তাঁদের সন্তানসন্ততিরাও। শীত পড়লে দূরে কোথাও, বহু দূরে তাঁরা যান হাওয়াবদলে। ব্যাগ গুছিয়ে পৌষমেলা বা বকখালি।
আর এই শীতে যে জিততে পারল না, তার জন্য পড়ে রইল রোয়াকের আড্ডা। গিন্নিদের দুপুর গড়াল পুরনো পুজোবার্ষিকী ঘেঁটে আর বালাপোষে রোদ খাইয়ে। রান্নাঘরে গন্ধ ওঠে তলা লেগে যাওয়া নলেন গুড়ের পায়েসের। কলকাতার আম আদমি এখন ই-মেল বোঝে। সোশ্যাল নেটে নাম লেখায়। গৃহবধূরা ফেসবুকে মাতে অলস দুপুরে। তবুও তো তোরা ফিরলি না! আসলে শহরের মনটাকেই বুঝলি না যে!
মনে পড়ে কবীরসুমনের সেই বিখ্যাত গান "সব আমাদেরি জন্যে, আমাদেরি জন্যে..." । ভিনরাজ্যে গিয়ে থেকে তো দেখেছি মশাই। এই চৈত্তসেলের জন্যে ফাগুণ পড়তেই মন কেমন উশখুশ করে! এমন সেলের পসরা কোথাও পাবে না কো তুমি। সেবার সেই বাম জমানায় সুভাষবাবুর তাড়ায় অপারেশন সানশাইনের কবলে পড়ে রাতারাতি গড়িয়াহাট খালি । ফাগুণে সে বিরহব্যথা যে কি জিনিষ তা আমি বুঝি। । কোথায় আমার পায়জামার দড়ি! কোথায় গেল জামাকাপড় শুকোনোর ক্লিপ্! কোথায় পাই আমার সাধের জাঙ্ক জুয়েলারি, টিপ-ক্লিপ আর কুশন কভার? আর পয়লাবৈশাখে বাড়ির দোরে নতুন ডোরম্যাট? কিনবই তো ! মাই চয়েস!
কি ভালো ছিল আমার সেই হকার ভাইটা! মাঝবয়সী আমাকে এখনো বৌদি বলে ডাকে। একবাক্যে জিনিষের দাম আর্ধেক করে হাসিমুখে বলে, নিয়ে যান, পরে দাম দেবেন। এত আন্তরিকতা কোথায় পাব বলতে পারো? তাই ওকেই আমার এত পছন্দ। মাই চয়েস!
মায়ের মলমল ছাপাশাড়ি আর শ্বশুরমশাইয়ের হাফপাঞ্জাবি না হয় কিনলাম দোকান থেকে। তাই বলে নিজের হাউসকোট কিম্বা কাজের মেয়ের ম্যাক্সি? কক্ষণো নয়। বেঁচে থাক ফুটপাথ! আর ওখানে কেনার চার্মটাই আলাদা! কত্ত চয়েস! কত্ত আন্তরিকতা হকার ভাইদের!চাকরী জোটেনি তাই টিউশানির পয়সায় আমার গুড টাইমপাস। আমি বড়বড় দোকানের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত উইন্ডোয় চোখ রাখি আর উইন্ডো শপিং করি। কিন্তু কিনি ফুটপাথ থেকে। আমার হকার ভাইটিও বিএ পাস করে হকার হয়েচে। গর্বের সাথে বলে সে। হকারকেই আমার দরকার এই চৈত্তসেলে, কুর্তির ঝুলে। এইজন্যেই তো পড়ে রইলাম কলকাতায়। তাও মাই চয়েস!
এই শহরটার জন্মলগ্নে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৃহস্পতি তুঙ্গে জানেন তো? তাই কর্তা নামেন বালিগঞ্জ স্টেশনে, গিন্নী নামেন গড়িয়াহাটে। তারপর ছুঁচোর ডন বৈঠক দেওয়া পেটে ঐ ফুটপাথের এগরোল কিম্বা চাউমিন, মোমো কিম্বা ফিশফ্রাই সাবাড় করে চৈত্তসেলে পথ পেরোন তাঁরা। আহা কি আনন্দ তখন সেই পথচলায়! যিনি মেট্রো করে নামেন রাসবিহারী তাঁর জন্য আছে রাসবিহারীর বিস্তীর্ণ দুপারের প্লাসটিক বালতি, মেলামিনের বাসন থেকে কাটগ্লাসের সুরাপাত্র, বাথরুম সেট, পুরণো ম্যাগাজিন থেকে পাইরেটেড সিডি, রেডিমেড ব্লাউজ, সায়া থেকে শার্ট-প্যান্টের পিসে ঢালাও সেল। কি চাই! রাসবিহারীর মোড় থেকে রসা রোডের দিকে কালীঘাট পেরিয়ে হাজরা আর এপাশে দেশপ্রিয় পার্ক পর্যন্ত সেলে ডুবে আছে মহানগরী। ভেতরের জামা, বাইরের জামা, পর্দার কাপড় সবেতেই সেল। গয়নার মজুরি ফ্রি। আবার সোনা কিনলে সম ওজনের রূপো ফ্রি! ভাবা যায় এই পয়লা বৈশাখের কি মহিমা?
ওদিকে বঙ্গললনার এখন টেলিভিশনে মাস্টারশেফ দেখে দেখে বড় সাধ জাগে একবার কন্টিনেন্টাল কিম্বা ইটালিয়ান বানানোর। বিশ্বায়নের ঢেউ লাগা সাফসুতরা রাস্তায় এখন বাটন মাশরুম থেকে বেবিকর্ণ, সুইট কর্ণ থেকে ব্রকোলি, তেরঙ্গা সিমলা মির্চ কি না পাওয়া যায়!
কেউ নামেন শ্যামবাজার মেট্রো স্টেশনে। তাঁর গার্ল ফ্রেন্ড হয়ত কলেজ ফেরত আসেন সেথায়। তারপর শুরু হয় সেল পরিক্রমা। আদিগন্ত হাতীবাগান জুড়ে সেল, সেল, সেল। আর সে যুগে যারা স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের অমোঘ বাণীকে পাথেয় করে ব্যবসায় নেমেছিলেন তাদের দোকানে হাহুতাশ! নিউমার্কেটে তারা নাকি অবস্থান করছেন হকারদের বিরুদ্ধে। আরে বাবা ! বোঝেনা সে বোঝেনা। তার বাপ-ঠাকুরদার এদ্দিনের ব্যাবসাপাতি নাকি হকারদের কল্যাণে লাটে ওঠার উপক্রম! ক্রেতা বলেন যেখানে সস্তা পাব, সেখানে যাব। বিক্রেতা বলেন এসি দেব, ভ্যাট নেব, রসিদ দেব। আর নেতা বলেন হকার আমার মাটি। হকার আমার ভোট। হকার আমার ভাগ্যনিয়ন্তা। "সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই".... সেই কোন্ যুগে চন্ডীদাস বলে গেছেন। সুভাষবাবুর অপারেশন সানশাইনের পর হকার পুনর্বাসন হয়েছিল। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি জানেন? কেউ যায়নি নতুন বাড়িতে। ক্রেতা খোঁজে সস্তার জিনিষ। বিক্রেতা চায় বিকোতে। কারণ এ শহরে শিল্প আসেনি তেমন করে। তাই ইকনমিক গ্রোথ হয়নি বুঝি। তাই ক্রয় ক্ষমতা বাড়লনা বোধহয়। তাই ফুটপাথেই উঁকিঝুঁকি আর হাতড়ে মরা সাধের জিনিষগুলোর জন্যে।
ওদিকে উঁচু উঁচু শপিং মলের বাতানুকুল বায়ুমন্ডলে ম্যানেকুইন ডুকরে কাঁদে। পথিক আসে দর্শক হয়ে। চোখ বুলায়, হাত বুলায়। পিছন পানে চায়। সেখানেও সেই এক অছিলা। মাই চয়েস!
এতো গেল পথেঘাটে প্রাক্বৈশাখী প্রস্তুতি। চাদ্দিকের চৈত্তসেলের হাতছনি। এবার আসি ডিজিটাল সেল প্রসঙ্গে। সেখানেও নানান অফার। সবকিছুই বর্ষবিদায়ের আনন্দে। গড়িয়াহাটার মোড়ে, হাতিবাগানের ধারে কিম্বা নিউমার্কেটের আশেপাশে নয় কিন্তু। শ্যামবাজারে বা কসবাতেও নয়। এ হল আমাদের ডিজিটাল চৈত্তসেল। সেল, সেল, সেল, ফেসবুক পাড়ার সেল । দুটাকা বাঁচানোর সেল, পয়লা বৈশাখী সেল। এই এক হয়েচে বাপু। প্রতিবছরে চৈত্র গিয়ে বৈশাখ আসবে আর তার জন্যে বছরের বস্তাপচা জিনিষ পত্তরের স্টক ক্লিয়ারেন্স সেল হবে। তুমি বাপু বিক্কিরি কত্তে পারছোনা তাই দাম বাড়িয়ে সেল ঘোষণা করেছ আর আম-আদমী ভাবছে কি সস্তা! কোথায় লেডিজ প্রিমিয়াম টপস পাওয়া যাচ্ছে দুটো, একটার দামে। "বাই ওয়ান, গেট ওয়ান" যাকে বলে। কোথাও আবার বিক্রি বাড়াতে হবে বলে বাই টু গেট টু। ঐ দোকানে বেষ্ট ডিল অফ ইয়ারিংস। আসলি মুক্তো, আসলি জারকোন মাত্র ঐ দামে? নো ওয়ে! এমন স্বপ্ন কখনো দেখিনি আমি! কুর্তা, কুর্তি অনবরত দৃষ্টি কেড়ে নেয় । কারে ছেড়ে কারে ধরি! আনারকলি, নূরজাহান সকলেই আছেন এক ছাদের নীচে। শুধু অপেক্ষা একটা ক্লিকের।
পোলকা ডটের কুশন কভার, হালকা-পুলকা কস্টিউম জ্যুয়েলারি, প্যাস্টাল শেডের সুদৃশ্য বেডস্প্রেড এমন কি গৃহসজ্জার দৃষ্টিনন্দন আর্টিফ্যাক্টসও, বুদ্ধ-গান্ধী-বিবেকানন্দ সকলেই উপস্থিত! সখের পোশাকী চটি জোড়া থেকে হাঁটার জন্য গুরুগম্ভীর স্নিকার্স, রান্নাঘরের ঘটিবাটি থেকে পড়বার ঘরের তাক, ময়লা ফেলবার ভ্যাট। সবেতেই সেল দিচ্ছে তারা সারা বছর ধরে। শুধু তোমার ক্লিকের অপেক্ষা। আর তারপর এড টু কার্ট, ব্যস! বেশ করব কিনব। মাই চয়েস!
চৈত্রসেল পেরোতে পেরোতেই বৈশাখী হেঁশেলের তোড়জোড়। মোচ্ছব সেখানেও। হোটেলে হোটেলে রসিক বাঙালীর খাদ্য বিলাস। শুরুতেই কাঁচা আমের জুসের সাথে ভদকার অভিনব ককটেল।অথবা তরমুজের লাল রসে পুদিনার সবুজ। ওপর থেকে আধ পেগ হোয়াইট রাম। যাকে বলে ফিউশান শরবত। তারপরেই লুচি, বেগুনভাজা, শাক-শুক্তো-ছ্যাঁচড়া-মুড়িঘন্ট। পরের দফায় ঘি ভাত, তপসে ফ্রাই। নির্গুণ, নির্গন্ধা বেগুণ দিয়ে বেগুণ বাসন্তী থেকে শুরু করে সারাবছর অচল পটলের দোলমা। ঘিভাতের কত রকম নাম হয় আজকাল! সে কখনো দারুচিনিদেশে, কখনো মখমলি জুঁইফুলের বাগিচায়। গাছপাঁঠার মুইঠ্যা তো পনীর পসন্দ। যশুরে তেল কৈ কিম্বা বরিশালী ইলিশ। কোথাও মৈথিলী ভেটকি, কোথাও আবার মাটন মনোহরা। শুধু চমকে যাওয়া নামের অভিনবত্বে। মধুরেণ সমাপয়েত ম্যাজিক মিহিদানা অথবা রসোগোল্লার পুডিং দিয়ে। আরো ভালো যদি থাকে জলভরা জলপরী কিম্বা দৈ কলসের ঠান্ডা ছোঁয়া। আর তারপরেও চালিয়ে দেওয়া যায় কেশরীয়া মালপোয়া কিম্বা যুবতী এক জিলিপিকে। ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব স্বয়ং বলেছিলেন ভরাপেটেও জিলিপি জিভ থেকে টুকুস করে, অতি অনায়াসে গলার মধ্যে দিয়ে সোজা পেটে চালান করা যায় । যেমন খুব ভীড়ে লাটসাহেবের গাড়ির চাকা ফাঁকফোকর দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে যায় সাবলীল গতিতে।
সব শেষে বলি এবারের বৈশাখী শ্লোগান হল পুরভোটের। থুড়ি মেয়েদের জন্যে। স্থলে-জলে-অন্তরীক্ষে আমি আছি আমার পছন্দ নিয়ে। মাই চয়েস! বেশ করেছি, ফুটপাথ থেকে জিনিস কিনেছি, মাই চয়েস! বেশ করেছি হকারকে প্রশ্রয় দিয়েছি। মাই চয়েস! ডিজিটাল শপিংও করেছি অনেক। কারণ মাই চয়েস। পার্সে ক্রেডিট আর ডেবিট কার্ড। আমাকে আর পায় কে? বৈশাখে খাদ্যবিলাসেও সামিল হয়েছি কারণ মাই চয়েস! হোমমেকারের হেঁশেলের চাক্কা বন্ধ পয়লা বৈশাখে। কারণ মাই চয়েস! রাঁধছিনা, রাঁধবনা। আজ স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ সব তোমাকে দিলাম পয়লা বৈশাখ। কারণ মাই চয়েস!
কলকাতায় প্রেম হেঁটে বেড়ায় মাইলের পর মাইল, মনের আনন্দে।
কত অজানা মন্দিরের অলিগলি, গুরুদ্বারের শান্ত পাঁচিল অথবা গির্জার নিরালা সেমেট্রি কিংবা জুম্মা পীরের দরগা সাক্ষী থেকে যায় প্রেমের কলকাতার। ভালবাসার-মন্দবাসার কলকাতার। শহুরে হাওয়ায়, নীরব প্রেমের পথচলায় সঙ্গী হয় দূর থেকে ভেসে আসা আজানের সুর, কালীমন্দিরের আরতির ঘণ্টাধ্বনি যুগপত ভাবে। উত্তর কলকাতার হেদুয়ার পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যায় রোজ কত কত প্রেম-অপ্রেম। এই প্রেম গিয়ে আছড়ে পড়ে কলেজ স্কোয়্যারে। যার নাম বদলে হয় বিদ্যাসাগর উদ্যান। এই কলেজ স্কোয়্যারের পুরনো নাম গোলদিঘি। গোলপাতা জন্মাত বলে অমন নাম বোধহয়। যাই হোক গোল হোক বা স্কোয়্যার এই পুকুর অনেক প্রেমের দলিল বহন করে চলেছে। কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট ধরে কলেজ স্ট্রিট ছাড়িয়ে ওয়েলিংটন মোড়ে গেলে এখনও ধাক্কা খাই গোলগাল ভুটিয়া মাসিদের রংবেরঙের শীত পোশাকের পসরায়। সকলকে জায়গা দেয় আমাদের কলকাতা।
প্রেমের পাতা উল্টে চলে কল্লোলিনী। কত প্রেমের বর্ণপরিচয় হয় গোলদিঘিতে এখনও। ব্রা-ব্রেসিয়ারের কিশোরীর যুগ বদলে যায়। বদলায় না আমাদের প্রেম।
মামারবাড়ি দক্ষিণেশ্বরে। মায়ের ডেলিভারি পেন থেকে শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় পেরিয়েই পলাশির যুদ্ধ খ্যাত রাজবল্লভদের বাড়িতে বহু দিনের পুরনো নর্থ ক্যালকাটা নার্সিংহোমে জন্মেই যেন উত্তর কলকাতার সঙ্গে প্রেম হয়ে গেল আমার। আরে তখন কি জানতাম আমার স্কুল কলেজ, ইউনিভার্সিটি, সিনেমা, থিয়েটার, শপিং— সবকিছু জুড়ে থাকবে এই উত্তর কলকাতা! পুরনো কলকাতার মেয়েদের স্কুলগুলোর মধ্যে অন্যতম বরাহনগর রাজকুমারী বালিকা বিদ্যালয়ে টেন প্লাস টু। ওই স্কুলে নাকি প্রথম চালু হয়েছিল বিজ্ঞান শাখা! আর ছিল কেতাদুরস্ত ল্যাবরেটারি। লাইব্রেরিতেও ছিল বিশাল বইয়ের সম্ভার। ছিল খেলার মাঠ।
তার পর আমরা একপাল মেয়ে জড়ো হয়েছিলাম কলকাতার হেদুয়ার পাড়ে এক ঐতিহ্যবাহী মেয়েদের রক্ষণশীল কলেজে। সেই ছাব্বিশ নম্বর ঘরটা! কাচের সার্শি সরিয়ে, পুরনো গন্ধ বুকে নিয়ে, খড়খড়ির দরজা ঠেলে অন্ধকার ঘরে ঢুকেছিলাম হুড়মুড় করে। কিছুটা উচ্চাশা নিয়ে, আর কিছুটা দুরুদুরু বুকে। ভেতরে ঢুকতে না ঢুকতেই পচা ডিমের হাইড্রোজেন সালফাইডের সেই চেনা উচ্চমাধ্যমিক-গন্ধটা অবশ করে দিল সুষুম্না স্নায়ুগুলোকে। বিবেকানন্দের সিমলে স্ট্রিটের পাশে বিডন স্ট্রিটের উপর জন ডিঙ্কওয়াটার বেথুন সাহেবের কলেজে। উল্টো দিকে হেদুয়ার সরোবর আর স্কটিশচার্চ কলেজ। আবারও প্রেম উত্তর কলকাতার সঙ্গে। সে বার সিমলেপাড়ায় স্বামীজির বাড়ি দেখতে গিয়ে ছেলে জিগেস করল, ‘‘মা, হেদো নাম কেন?’’ সত্যি তো ভাবিনি কখনও। তিন বছর পড়েছি হেদুয়ার কাছে বিখ্যাত কলেজে। হেঁটেছি অহোরাত্র। এই কলকাতার বুকেই রচিত অদ্রীশ বর্ধনের ‘আমার মা সব জানে’। অতএব আমার মা বললেন, ‘‘হেদো মানে মজা পুকুর।’’ বাংলায় আটপৌরে নাম হেদো আর পোশাকি নাম হেদুয়া। আর কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের উপর অত্ত বড় পুকুরের ইংরেজি নাম কর্নওয়ালিশ স্কোয়্যার। এখন স্কটিশচার্চ কলেজের দর্শনের নাম করা অধ্যাপক আর্কহার্ট-এর নামে আর্কহার্ট স্কোয়্যার বলা হয়।
আমার কলেজবেলায় কলকাতা ছিল ট্রামময়। কি কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট, কি সার্কুলার রোড— এই ট্রাম যানের নেটওয়ার্কটি ছিল বড় বন্ধুতায় ভরা, মায়াময়। এখন তো গ্যালিফ স্ট্রিট থেকে চিত্পুরের দিকে হাতে গোনা এই ‘স্ট্রিট কার’ উত্তর কলকাতার বুক চিরে ধুঁকতে ধুঁকতে চলে ঠিক কলকাতার সিনিয়র সিটিজেনদের মতো। সেই সিনিয়র সিটিজেনরাও এই কলকাতার প্রতি তাদের প্রেমটাকে নিয়েই শুধু বেঁচে থাকেন দিনের পর দিন এই শহরে। কি ভাগ্যি গত শতাব্দীর কলকাতার সার্কুলার ও ইস্টার্ন ক্যানাল সমূহের সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার ও ক্যানালের টোল কালেকটর এই গ্যালিফ সাহেবের রাস্তাটি এখনও টেনেটুনে বাঁচিয়ে চলেছে পুরনো কলকাতার ট্রামলাইনের টুংটাং ঘণ্টি নাড়া। ৯ নম্বর গ্যালিফ স্ট্রিটে তাঁর অফিস বাড়িটি এখনও আছে, যার নাম ক্যানাল ভিলা। আমরা ধরে রাখতে পারি না সেটা আমাদের ধর্ম, কিন্তু গর্ব করে বলতেও ছাড়ি না তার কথা।
কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের ফুটপাথ ধরে আমাদের কলেজের গল্প-পথ আনন্দে হেঁটে পাড়ি দিয়েছিল রাজাবাজারের দিকে। পুরনো কলকাতার গন্ধ নাকে। উত্তর কলকাতার বনেদি সব গলি ছায়াময় আর রহস্যময়। গল্প ফুরোত না। ধাক্কা খেত আপার সার্কুলার রোডে সায়েন্স কলেজের পাশের রাস্তা পারসিবাগান স্ট্রিটে। কি নিরিবিলি আর নিঝুম ছিল পারসিবাগান স্ট্রিট। রুস্তমজি কাওয়াসজিরা ছিলেন কলকাতার বনেদি এক ব্যবসায়ী পারসি পরিবার। এঁর নামে বরাহনগর কাশীপুরে একটি রাস্তা আছে রুস্তমজি পারসি রোড। দক্ষিণ কলকাতায় বিয়ে হয়ে দেখি গড়িয়াহাট রোড থেকে বেরিয়েছে আর এক রাস্তা যার নাম রুস্তমজি স্ট্রিট। মাঝে মাঝে কলকাতার উদারতা আর ব্যাপ্তি দেখে বিস্মিত হই আজও। রুস্তমজির পুত্র মানেকজি রুস্তমজি তাঁর পিতার মতো কলকাতার পারসি সম্প্রদায়ের নেতা ছিলেন। শেরিফ হয়েছিলেন তিনি। তাঁর নামেই মানিকতলার নাম হয়েছিল। পারসিবাগান এখনও অনেক প্রেমের ওঠাপড়া আর অপ্রেমের চোখের জলের ফোঁটায় বেঁচে রয়েছে।
ছুটে চলত আমাদের উচ্ছ্বাসেরা, ফুটে উঠত ছোট ছোট উল্লাস। চাহিদা ছিল কম। প্রেম এখনকার মতো অত দুর্মূল্য ছিল না। আধখানা এগরোল কিম্বা দু’টাকার ফুচকাই সম্বল ছিল বন্ধুতার। কাঠফাটা রোদ্দুর মাথায় করে প্যারামাউন্টের ঠান্ডা রঙিন শরবত নিয়ে আড্ডা জমত কলেজ স্কোয়্যারে। কিন্তু, দাঁড়িয়েই থাকত প্রেম আমাদের। একান্ত মুখোমুখি বসে একটু পড়াশোনার চেষ্টা বা নোট তৈরির অছিলায় কফিহাউস ছিল হাতের পাঁচ... যে ধরত মাথার ওপর বিশাল ছাতা। আমাদের রোদ-বৃষ্টি-ঝড় সব কিছুর থেকে আগলে রাখার ঠেক।
মায়ের মুখে শুনেছি, বেথুন কলেজের তন্বী তনয়ারা ষাটের দশকে সুইমস্যুট পরে হেদোর সুইমিং পুলে সাঁতার কাটত কলেজের পর। কলেজ কেটে প্রেমিকের সঙ্গে মুখ লুকোত সার্কুলার রোডে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের পাশের রাস্তা দিয়ে গিয়ে বেপট এক নিরালায় পরেশনাথ জৈন মন্দিরে। তা হলেই বুঝুন, কত আধুনিক ছিল এই কল্লোলিনী! এখনও সেই ট্র্যাডিশন চলেছে একই রকম ভাবে। কত প্রেম, কত কথা আর প্রতিশ্রুতিতে সেই নিস্তব্ধ জৈন মন্দিরের আনাচকানাচ অবিরত মুখর হয় আজও। সে দিন নিজের চোখে গিয়ে দেখে এলাম।
কলকাতার সত্যিকারের লম্বা ও চওড়া রাস্তা হল এই সার্কুলার রোড। আমার রোজের ট্রামচড়ার পথ। শ্যামবাজার থেকে সায়েন্স কলেজ অবধি ১২ নম্বর লেডিজ ট্রাম চলত তখন। আপার সার্কুলার রোডের নাম আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোড। বিধান সরণির সঙ্গে সমান্তরাল। এটি নাকি ছিল প্রথম পাকা রাস্তা। আজ সেখানে ওই ১২ নম্বর ট্রামের অভাবটা ভীষণ প্রকট। কলকাতা ট্রাম ওয়েজ কোম্পানির এই বিশাল নেটওয়ার্কের অবনমন আমার কলকাতা প্রেমকে একটু একটু করে কমিয়ে দেয়।
আর সেই অলিগলি, কানাগলি, বাই লেন? আর সাহেবসুবোর নামের রাস্তাগুলো? গ্রে স্ট্রিট মানেই হাতিবাগান আর তার সঙ্গে উঠে আসে ডাইনে বাঁয়ে সিনেমা হল আর থিয়েটারশালা! ঘোষ-কাজিনের গলি থেকে গোলবাড়ির কষামাংস-রুটির প্রেম! আর জলযোগের কি রমরমা তখন! পয়োধিও মিলত জলযোগে, যা খেয়ে রবিঠাকুর স্বয়ং জলযোগের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন। মাত্র এক টাকায় মাংসের প্যাটিস। ভাবা যায়! কি অনবদ্য সেই স্বাদ! সেই থেকেই যেন শহরটা সস্তা হয়ে গেল। সকলের কাছে সস্তা। যে আসে সে যেতে চায় না। বাঙালি ব্যবসার পাততাড়ি গোটায়। অবাঙালির শহর হয়ে উঠে ক্রমশ। কেমন যেন রোমান্টিক হয়ে যাই আজও। রাস্তার নামগুলো বদলে যায় আমার বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। মানতে পারি না। ভীষণ কষ্ট পাই। আপার সার্কুলার রোড, বিধান সরণি আর সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ কেমন সুন্দর সমান্তরাল এখনও। কত ভীড়, কত মিছিল তবুও আমার কলকাতা, আমাদের কলকাতা। আজও যখন চৌরঙ্গী থেকে শ্যামবাজার ক্রশ করি... চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, যতীন্দ্রমোহন অ্যাভিনিউ, গিরীশ অ্যাভিনিউ, ভূপেন বোস অ্যাভিনিউ... ক্যালকাটা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্টকে মনে মনে ধন্যবাদ জানাই।