২০ নভে, ২০১৯

মোচা নামচা

ভোর ভোর হাঁটতে গিয়ে ১০টাকার এক বান্ডিল ধবধবে দুধসাদা বকফুল কিম্বা সদ্য কমল মুকুলদল উন্মোচিত কুমড়োফুল কিনে ফেলতে পারলে গিন্নীমায়ের সেদিন দুপুরের মেন্যু করতে মোটেও অসুবিধে হয়না। বাড়ি এসেই কাজের মাসীকে সমানুপাতে বেসন, চালের গুঁড়ো মিশিয়ে নিতে বলে।
- মনে করে এক টুসকি লংকাগুঁড়ো, আধ চামচ হলুদ, নুন, দু'চামচ পোস্ত আর একটু কালোজিরে ছড়িয়ে  বেশ করে ফর্ক দিয়ে ঘেঁটে ফ্রিজে রেখে দিও কিন্তু। যা রাঁধো বাপু আজকাল! পোলাও, কালিয়া, মুর্গি, মাটন বাদ দিয়ে পিঁয়াজ, ধনেপাতা দিয়ে পাতলা মুসূরডাল চাপাও তো দেখি।
এদিকে গিন্নীমা টিভিতে গান শুনতে শুনতে একে একে মোচার খোলস ছাড়াতে ছাড়াতে একবার বাটার টোস্টে কামড় আর একবার লাল চায়ে চুমুক দেন। মোচার খোলস ছাড়াতে গেলেই মনে পড়ে নিজের জীবনের কথা। একটা করে মেরুন খোলা যেন নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কথা মনে করায়। ছোটবেলায় মানুষ চিনতে পারেনা কেউ। বড় হতে হতে মেরুন খোলায় হালকা হলুদ রঙের ছোঁয়া ধরতে শুরু করে। বুদ্ধি আর বয়স সমানুপাতে চলে।
- কি গো বৌদি? সব খোলা ফেলে দিলে আর পড়ে র‌ইল কি?
-আহ! দিচ্ছি বাপু। একটু রোসো দিকিনি। গান শুনতে দাও।আমি জানি হলুদ অংশ ফেলতে নেই।
ভেতর থেকে শুধুই পুষ্টিতে ঠাসা হলদে মোচাটুকুনি বেরিয়ে আসে। জীবনের সারাত্সার যেন। অভিজ্ঞতার পারদ চড়তে চড়তে নধরকান্তি মোচার এডিবল পার্টটুকুনি মনে করিয়ে দেয় জীবনের কথা। পরমহংসের কথা। সারটুকুনি নিয়ে অসারটুকুনি ফেলে দেয় সেই প্রজাতির হাঁসেরা। কত বুদ্ধি তাদের।
-দাও বৌদি, আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে কিন্তু
- আমি তো তবু ছাড়িয়ে দিচ্ছি, কোন্‌ বাড়ির বৌদিরা ছাড়িয়ে দেয় বলতো?
- তা ঠিক বৌদি। তবে এবার ছোট ছোট কলাগুলো দাও এদিকে। ওগুলোতেই সময় লাগে বেশি।
- দিচ্ছি বাবা। আমি অনেকটা কাজ সেরে রেখেছি তোমার। ন্যানো কলাদের প্ল্যাসটিকের জ্যাকেট ফেলে দিয়েছি। তুমি কেবল ওদের ভেতর থেকে কাঠির মত গর্ভদন্ডটা ফেলে দাও। হাতের তেলোয় রাখো। যেমন আমায় রেখেছে এবাড়ির লোকজন আর আমি রেখেছি  তোমাকে। একসঙ্গে চাপ দিয়ে টেনে বের করে ফেল। তাড়াতাড়ি হবে। কতবার বলব? একটা একটা করে বের করলে সময় বেশি লাগে।
মোচার পরত খুলতে খুলতে জীবনের গল্পেরা ভীড় করে গিন্নীমায়ের ঘাড়ে।
ছোট্ট ছোট্ট ন্যানো কলাগুলো যেন জীবনের প্রতি মুহূর্তের ছোট ছোট কর্মফল, তাইনা? ওদের আর গর্ভাধান হলনা  এজন্মে। খসেও গেলনা বাকী জীবনটা। ঝরেও পড়েও মরতে পারত গাছের নীচে, মায়ের কোলে। মোচার পরতে পরতে কেউ যেন চেপে গলা টিপে ওদের বিকাশ টা রুখে দিল জন্মের মত। অ্যাবরশান করে দিল ন্যাচারালি। অত ফুল কি হাবে ফুটে? অত কি হবে জন্মের? ঘেটি ধরে আবারো জাঁতা কলে  পিষতে হবে তাকেও। জীবন যুদ্ধ সবার জন্য নয়।
- আজ নিশ্চয়ই গল্প ফাঁদছ তুমি!
- ঠিক ধরেছ, এই না হলে তুমি!

১৭ নভে, ২০১৯

নবনীতা দেবসেনের সঙ্গে কিছু মূহুর্ত












নবনীতাদির সঙ্গে এবছর পয়লাবৈশাখের আগে কৌশিক গুড়িয়া সম্পাদিত, বহরমপুর থেকে প্রকাশিত রবিবার পত্রিকার বিশেষসংখ্যার জন্য জানতে চেয়েছিলাম তাঁর ছোটবেলার নতুন বছরের স্মৃতি নিয়ে। বলেছিলেন, হোয়াটস্যাপে লিখে জানাবেন সময়মত। দিয়েওছিলেন দু একদিনেই। সেটাই আমার প্রাপ্তি। 

সাহিত্যিক নবনীতা দেব সেনের ছোটবেলায় পয়লা বৈশাখ কাটত শান্তিনিকেতনের বর্ষবরণের উত্সবে।
 "তখন বিদ্যালয়ের ছুটি হয়ে যেত বলে রবীন্দ্র জন্মোত্‌সব পয়লা বৈশাখেই উদ্‌যাপিত হতে দেখেছি। মা, বাবা ওখানেই যেতেন পয়লা বৈশাখে। আমার নতুন জামা, জুতো হত। আমার ভালো লাগত মাটির বড় জালা ভরা ঠাণ্ডা শরবত দেখে।সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল নন্দলাল বসুর স্ত্রীর শালপাতায় ফুল সেলাই করে অপূর্ব গয়না বানানো। নতুন বছর উপলক্ষে আনন্দনাড়ুও হত। উপাসনা ঘরে প্রার্থণা হত। নতুন বছরের অনেক গান থাকত। এইসব ভালোলাগা গুলো জড়িয়ে থেকে গেল আজো আমার সঙ্গে। আমার হৃদয়ে মাখামাখি হয়ে। কত গান, কত স্বাধীনতা, ছোটদের সঙ্গে ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ। মা কোনোদিনো আটকাতেন না আমাকে। সব মিলিয়ে খুব রঙ্গিন এখনো সেইসব স্মৃতি"

১ নভে, ২০১৯

ছট পুজো ভার্সেস যমপুকুর ব্রত


আজ আমার ঘর থেকে দেখতে পাচ্ছি পন্ডিতিয়া পুকুর টি। আসন্ন ছট পুজোর সুবিধার্থে বানিয়ে দিলেন আমাদের সবার প্রিয় দেবা দা। যিনি সারাবছর ধরে প্রচুর সমাজ কল্যাণ মূলক কাজ করেন। আমি তার সাক্ষী আছি। আজ এই দীঘি ভরা জল করে টলমল দেখে অনেক কিছু মিল খুঁজে পেলাম আমাদের বাঙালীর ব্রতর সঙ্গে তাই এই লেখা।

কার্তিকমাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে ছটপুজো সূর্যের পুজো হলেও মূলতঃ এটি গঙ্গাদেবী বা মা অন্নপূর্ণার পুজো। আন্নপূর্ণা দুর্গার আরাধনা শুক্লাষষ্ঠীতেই হয় তাই বুঝি ষষ্ঠ>ষট> ছট কথাটি প্রচলিত। কারো মতে ছট্‌ অর্থাৎ ছটা বা সূর্যরশ্মির পুজো । কারো মতে সূর্যের দুই স্ত্রী ঊষা এবং প্রত্যুষা কে স্মরণ করা হয়। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে আবারো সেই নারীশক্তির আরাধনা। এবং মা ষষ্ঠীর সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া।এবার বাংলার বারোমেসে ষষ্ঠী নিয়ে একটি বড় কাজ করতে গিয়ে দেখলাম ছট মাঈ অর্থাত এটিও আমাদের ষষ্ঠীদেবীর মত, বিহারের ব্রত। কি অদ্ভূত মিল! শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতেই তিনি আরাধ্যা আমাদের সব ষষ্ঠীর মতোই। আবার সূর্যের দুই স্ত্রী'র উদ্দেশ্যে প্রণতি জানানো দেখে মনে পড়ে যায় আমাদের আসন্ন কৃষি উত্সব নবান্ন বা হেমন্ত লক্ষ্মীর কথা। বিদেশেও হবে থ্যাংকসগিভিং অর্থাত কৃষিদেবতা সারাবছর ধরে ভরে দেন মনুষ্য জীবনযাপনের খোরাকি। বিনিময়ে আমরা কি‌ই বা দিতে পারি তাঁকে? তাই "অনেক দিয়েছ নাথ" এই বলে স্মরণ করে কৃষকরা, বরণডালা সাজিয়ে নিবেদন করে। আমাদের ইতুপুজো‌ও কিছুটা তেমনি। তবে গত যে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া থেকে আগামীকাল ষষ্ঠীর দিনে বহু প্রাচীন যমপুকুর ব্রতের অদ্ভূত এক সংযোগ পাওয়া যায়। যমের বোন যমী ভাইয়ের মঙ্গলকামনায় ভাইফোঁটা দিয়েছিলেন। সেই সূত্র ধরেই যমের জন্য পুকুর কাটিয়ে এই কার্তিকেই হয় যম পুকুর ব্রত।

ভ্রাতৃদ্বিতীয়া হল যমরাজের পুজো । অবিভক্ত বাংলার গ্রামে গ্রামে পালিত হত যম পুজো। মেয়েরা পড়ত যমপুকুর ব্রতকথা। আজও আছে ব্রতকথার বইতে। গোটা কার্তিক মাস ধরেই আত্মা বা মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত নানা পার্বন হয়। শুধু আমাদের ই নয় বিদেশেও অল সোলস ডে বা হ্যালোউইনের অনুরূপ। কার্তিক অমাবস্যায় শ্মশানে বিচরণকারী দেবী কালীর পুজো, আগের দিন ‘ভূত চতুর্দশী’ এবং কার্তিক মাসেই আমাদের মৃত পূর্বপুরুষদের আত্মাদের পথ চেনানোর উদ্দেশ্যে বাড়ির ছাদে ‘আকাশপ্রদীপ' জ্বালার চল । ঘটিবাড়িতে কালীপুজোর প্রদোষে ‘অলক্ষ্মী’ বিদায় করে দীপান্বিতা লক্ষ্মীর পুজো হয়। সেই ভাবনাও আসলে ভুত-প্রেত-অশরীরী আত্মা জাতীয় ‘অলক্ষ্মী’ বা নেগেটিভ শক্তি ঘর থেকে বিদায়ের রীতি হয়ত।
এই কালীপুজোর পরদিন থেকেই গ্রাম বাংলায় শুরু হয় ‘যমপুকুর ব্রত’। বিহারেও ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার চার দিন পর পালিত হয় ছট পুজো।সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় অব্ধি সূর্যকে দেখে ছটমাঈয়ের ব্রত পালন শুরু করে ব্রতীরা।কারও মতে সূর্যের পুত্রই হলেন যম। গ্রাম বাংলার কুমারীরা এইসময় পালন করে যম পুকুর ব্রত ।কি অদ্ভুত এই মিল!

গবেষিকা রীতা ঘোষের মতে বাড়ির উঠোনে এক হাত পরিমান চৌকো পুকুর কেটে বা চিত্র এঁকে তার চারদিকে চারটি ঘাট বানিয়ে, দক্ষিণ দিকে যমকে বসিয়ে ব্রত পালিত হয়। যমের সঙ্গে থাকেন যমরানি এবং যমের মাসী। অন্য ঘাটগুলিতে (উত্তরে) থাকেন জেলে-জেলেনী, (পুর্বে) ধোপা-ধোপানী, শাকওয়ালা-ওয়ালী, পশ্চিমে কাক, বক, হাঙ্গর ও কচ্ছপ। নানা জীবজন্তু রেখে ‘বৈতরণী’ পার করার মত কঠিন কাজের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। পুকুরে রাখা হয় বা আঁকা হয় কলমি, হিংচে, কচু, ও হলুদ গাছের চারা। তারপর পুকুরে জল ঢেলে ব্রত শেষ করার আগে মন্ত্র বা ছড়া পড়া হয় --
শুষনি-কলমি ল-ল করে
রাজার ব্যাটা পক্ষী মারে
মারণ পক্ষী শুকায় বিল,
সোনার কৌটা রূপার খিল
খিল খুলতে লাগলো ছড়
আমার বাপ-ভাই হোক লক্ষেশ্বর।“
বাপ-ভাই কে লক্ষেশ্বর করার কামনা করার পর শেষে বলেন – “লক্ষ লক্ষ দিলে বর/ ধনে পুত্রে বাড়ুক ঘর।“ অর্থাৎ, কেবল ধনী করাই নয়, যমের কাছে সন্তান-সন্ততিও কামনা করেন তারা। আর এখানেই যম কেবল মৃত্যুর দেবতা না থেকে হয়ে যান জীবনের দেবতা – যিনি না চাইলে কারও মৃত্যু হবে না। 

আজকের খবরের কাগজে আমাদের Panditia Pond সহ শহরে আরো বেশ কিছু পুকুর কাটানো দেখে মনে পড়ে গেল কতকিছু। বাংলার ব্রতে পরিবেশের কারণে উদ্যোগী হতেন তখনকার মানুষ। পুকুর বোঁজানো তো দূর অস্ত বৃষ্টির আশায় বৈশাখে পুণ্যিপুকুর ব্রত, ভাদ্রে চাপড়া ষষ্ঠীতেও সেই পুকুর খাটানোর গল্প আবার কার্তিকেও যমপুকুর ব্রত। প্রচুর জল ঢেলে ছটপুজোর জন্য পুকুর খোঁড়া হয়েছে। এগুলি অস্থায়ী। সেটাই দুঃখের। এত খরচাপাতি করে যখন করাই হল তখন পুকুরগুলি থাক না। আরো গভীর করে খুঁড়ে দেওয়া হোক। গঙ্গার ধারে পুকুরে জলের অভাব হবেনা।