২৪ আগ, ২০২০

রসনাপুরাণ

 

রসনাপুরাণ / ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় ( লেখাটি প্রকাশিত গুরুচণ্ডালী ই-ম্যাগাজিনে) 

আমার মায়ের বাবা এবং বাবার মা দুজনেরি জন্ম বাংলাদেশের খুলনা জেলার সাতক্ষীরায় তবে কর্ম কোলকাতায় । তাই এহেন "আমি"র  সেই অর্থে শিরা উপশিরায় বাঙাল ও ঘটি উভয় শোণিত স্রোত বহমান । অন্তত: আমার শ্বশুরালায়ের মন্তব্য তাই ।


উপাদেয় পোস্তর বড়ার স্বাদ পেতে আমাকে ছুটতে হয় বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার বন্ধুর বাড়িতে । আর নারকোল-বড়ি দেওয়া মিষ্টি মোচার ঘন্ট খাবার জন্যে আমাকেই ছুটতে হয় রান্নাঘরে । আমাদের ঘটি বাড়ির হেঁশেলের বেশির ভাগ রান্নাবান্নাই শর্করায় পুষ্ট । কুটিঘাটের মেয়ে আমার দিদিমা ছিলেন খাস ঘটিবাড়ির মেয়ে । বিয়ের পরদিন বাঙাল শ্বশুরবাড়ির রান্নায় চিনি ছড়িয়ে খেয়েছিলেন । 


সেইকারণেই  বুঝি আমার ঠাকুরদাদার মুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনেছি । সব ক্রিয়াপদে এলুম, গেলুম, খেলুম শুনে বন্ধুরা হেসে বলত এই এল হালুম হুলুম করতে । কি আর করি ! জন্ম-দোষ যে! তাই বুঝি আমি মিসডি কথাও বলতি পারি আবার আট ডেসিবেল ক্রস ক‌ইরা ঝগড়া করতিও পারি । আমাদের সব রান্নায় যেমন মিষ্টি, তেমনি ঝাল। অভিনব এক কেমিস্ট্রি হয়েছে জানেন?  ইলিশ আর চিংড়ি দুইয়ের সঙ্গতে  আমার রসনা পুরাণ জমে গেছে । আমি যেমন রাঁধতি পারি ঝরঝরে ভাত তেমন ভাজতি পারি ফুলকো ফুলকো নুচি। তবে ঘটির ওপর আমি পক্ষপাতদুষ্ট । কারণ ঐ শোণিত স্রোতের সংকরায়ন ।  


ছোট্টবেলা থেকে শুনে আসছি খুলনা হল পশ্চিম আর পূর্ববাংলার সীমানার কাছে অতএব আমরা বাঙাল ন‌ই। আরে বাবা তাতে আমারই বা কি আপনারই বা কি! আমি বাঙালী ঘরে জন্মেছি সেটাই আমার কাছে বড় কথা। রবিঠাকুর, নজরুল, মাছের ঝোলভাত, কড়াইয়ের ডাল-আলুপোস্ত আমার শয়নে-স্বপনে-জাগরণে।  আমি বাঙালী বলেইতো বাংলাভাষা আমার সহজাত  আর বাংলার শিল্প-কলা-কৃষ্টি আমার রোমকূপের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সিঁধিয়ে আছে। কি ঠিক বলছি তো না কি? 


আমার একরত্তি একাদশী দিদিমা, ঘটিবাড়ির মেয়ের বাঙাল ঘরে বিয়ে হয়ে আসাটা যেন তার জীবনের ভোল পাল্টে দিয়েছিল রাতারাতি। ঐটুকুনি মেয়ে বিয়ের কি বোঝে! সে আবিষ্কার করতে শুরু করেছিল গ্রাম্য পরিবেশের মাধুর্য্য। গাছের ফলপাকড়, টাটকা শাকসব্জী, নদী-পুকুর থেকে মাছ ধরে আনা সেই বিবাহিতা কিশোরীর কাছে যেন বিস্ময় তখন। শহর বরানগর তখন অনেকটাই আটপৌরে গেঁয়োপনা ছেড়ে সবেমাত্র শহুরে হতে শিখেছে। কাজেই প্রকৃতি, সবুজের মাঝে অবাধ বিচরণ সেই কিশোরীর জীবনে অধরা ছিল । শ্বশুরবাড়িতে সকাল হতেই ঘি অথবা কাঁচা সরষের তেল ছড়িয়ে আতপ চালের ফেনাভাত খাওয়া তার কাছে অপার আনন্দ বয়ে আনত। বরানগরে তিনি শিখেছিলেন সকালের প্রাতরাশ হিসেবে পাঁউরুটি-মাখন খাওয়া অথবা লুচি-পরোটা কিম্বা রুটি তরকারী । বাংলাদেশে এসে সেই ফেনাভাত তার কাছে অবাক করা এক ব্রেকফাস্ট সেই মুহূর্তে। দুপুর হলেই পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরা ছিল তার কাছে এক আশ্চর্য্যের বিষয়। 


ননদীনিরা গরম গরম জ্যান্ত ট্যাংরা মাছভাজা আর তেল দিয়ে একথালা ভাত  নতুন বৌকে বসিয়ে আদর করে খেতে দিয়েছিলেন জলখাবারে। দিদার মুখে কতবার শুনেছি এ কথা। নদীর টাটকা মাছ আর অমন যত্ন দিদার মাও বুঝি করেনি তাকে..তিনি বলতেন।


এইভাবে পূর্ব ও পশ্চিমবাংলার সারটুকুনি আর উভয় পরিবারের আত্মীয়তায় গড়ে ওঠে আমাদের পরিবার। আমরা এর মধ্যে দিয়েই বড় হলাম, শিখলাম আর এখনো ভাবতে থাকলাম....পূর্ববাংলায় সেই আমাদের মরাই ভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, পুকুরভরা মাছের কথা। দুইবাংলার সংস্কৃতি তখন মিলেমিশে একাকার । জমে গেল ঘটি-বাঙালের রসনা, হেঁশেল বেত্তান্ত ।  আর এহেন ক্ষুদ্র আমি মেলবন্ধন ঘটালাম এপার বাংলা ও ওপার বাংলার সেরা রসনার ।  


বিকেলে ইস্কুল থেকে ফিরে বন্ধুরা সকলে ভাত খেত আর আমরা খেতাম লুচি-পরোটা বা রুটি কিন্তু দুবেলা ভাত নৈব নৈব চ ! কি আর করে বন্ধুরা! ওদের মা ময়দার কাজে মোটেও পটু নন, ভাতের রকমারিতে পটু তাই ঘটির বৈকালিক জলযোগের ময়দা বুঝি ওদের কাছে অধরা । 


ওদের সেই চিতলামাছের মুইঠ্যা একবগ্গা মাছের এক্সোটিক ডিশ ফর গ্যাস্ট্রোনমিক তৃপ্তি । আর কালোজিরে-কাঁচালঙ্কা দিয়া সেই বাদলা দিনের কাদলা মাছের পাদলা ঝোল না খেলে হয় না। আমাদের তার চেয়ে কাতলার কালিয়া, ক্রোকে, দৈ-মাছ, কোর্মা, মাছের পোলাও, মাছের কচুরী, চপ আরো কত বলব ! ঘটি হেঁশেলে শুঁটকি ফুটকির নো এন্ট্রি ! একবার বাঙাল-ঘটির কাজিয়ায় আমার ঠাকুর্দা তার এক বাঙাল বন্ধুকে বলেছিলেন "কচুরী আর রাধাবল্লভীতে যে বিস্তর ফারাক সেটাই জানোনা? আর কি করেই বা জানবে "ময়দার" ব্যাপারে  তোমাদের তো হাঁটুতে খঞ্জনী বাজে। চাড্ডি ভাত চাপিয়েই খালাস তোমরা । জমিয়ে মিষ্টি মিষ্টি নাউ-চিংড়ি খাও । দেখবে মনের কাদা সাদা হয়ে গেছে । এট্টু চিনি ছড়িয়ে কড়াইয়ের ডাল আর ঝিঙেপোস্ত খাও । দিল খুশ হয়ে যাবে । মিষ্টি কথা কি এমনি কৈতে পারি? মিষ্টি মিষ্টি ব্যবহার কি এমনি পারি! সবের মূলে ঐ ঘেটো মিষ্টি" 


বাজার গেছি একবার জ্যাঠামশাইয়ের হাত ধরে । সদ্য কৈশোরে পা দিয়েছি তখন । পুলিশে কর্মরত জ্যাঠামশাই তাঁর চাঁচাছোলা ভাষায় গঙ্গার ঘাটে তাঁর এক পুরোণো সহপাঠীকে বলছেন :

"তোমরা হলে গিয়ে, ইশে "অরিজিনাল দেশি" তাই বলে আমরা অ্যাবরিজিনাল দেশি ন‌ই গো দাদা ! এট্টু ঘুসোচিংড়ির বড়া খেয়ে দ্যাখেন মশাই ! অথবা কষে চিনি দিয়ে ছোলারডাল আর ঐ আপনাগো "ময়দা" মানে আমাগো "নুচি" । চিল্লোতে পারিনা আমরা, আট ডেসিবেল কি সাধে ক্রস করিনা? ভেতরটা সত্যিসত্যি মিষ্টি হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে"


এভাবেই আমি এলুম, দেখলুম, ছিলুম বলে । আমের সময় মিষ্টি আঁব খেলুম, হ্যান্ডলুম পরলুম ! নাউচিংড়ি রাঁধলুম নঙ্কা দিয়ে। সাদা ময়দার ফুলকো নুচি ভাজলুম ছোট্ট ছোট্ট। ডালের সঙ্গে নেবু ডললুম। এতে নজ্জার কিছু নেই । ঘটি রান্নার সোশ্যাইটি জুড়ে, হেঁশেলের ঝুলকালিতে শুধু একটাই কথা । রান্নায় মিষ্টি। জলখাবারে ময়দা আর রাতে রুটি। 


আমাদের ঘটিবাড়িতে জন্মেস্তক দেখছি চিংড়ির অবাধ ও অনায়াস গতায়ত। বারোমেসে বাজারের ফর্দে মহার্ঘ গলদা নয় তবে লবস্টারের বাবালোগ অর্থাত ঘুসো/কাদা/ফুল চিংড়ি থেকে কুচো কিম্বা ধানক্ষেতের জ্যান্ত চাবড়া চিংড়ি থাকবেই।  


চিংড়ি আর কাঁকড়া মাছ নয় বলে আর সম্পূর্ণ অন্যজাতের সজীব বলে বুঝি ওদের এত স্বাদ। আঁশটে ব্যাপরটা নেই। আছে এক অন্য রসায়ন। 


বাড়িতে কাউকে নেমন্তন্ন করে খাওয়ানো মানেই চিংড়ি মালাইকারি যেন অন্যতম প্রধান পদ ঘটিবাড়িতে। 


আজকাল হোটেলে ডাবচিংড়ি নামে একটি মাগ্যির ডিশ সার্ভ করা হয়। এমনকিছু আহামরি নয়, শুধু দামে গালভারী। দেখনদারির পণ্য। অথচ আজ থেকে একশো বর্ষ আগে আমার মামারবাড়িতে এই রান্না হত ডাব দিয়ে নয়। নারকোলের শাঁসসুদ্ধ দুটি মালার মধ্যে বাগদাচিংড়ি সর্ষে-পোস্ত-কাঁচালঙ্কা বাটা দিয়ে মেখে, কাঁচা সর্ষের তেল, হলুদ, লঙ্কা, নুন দিয়ে নারকোলের মালায় রেখে এবার নারকোলটিকে বন্ধ করে সেই ফাটা অংশে ময়দার পুলটিশ লাগিয়ে মরা উনুনের আঁচে ঐ নারকোলটি রেখে দেওয়া হত ছাইয়ের ভেতরে । ঘন্টা দুই পরে তাক লাগানো স্বাদ ও গন্ধে ভরপুর ভাপা চিংড়ি নাকি খুঁড়লেই বেরিয়ে আসত নারকোলের শাঁসের সঙ্গে। চিংড়ির মালাইকারীও এভাবে রাঁধা হয়েছে বহুবার। সেখানে সর্ষের বদলে পিঁয়াজ, আদা-রসুন গরমমশলা বাটা আর তেলের বদলে ঘি দেওয়া হত। 


চিংড়ি মাছের কথা উঠলেই মনে পড়ে যায় আমার এক রগুড়ে মামার কথা। ওনাদের সময় কত্ত বড় চিংড়ি খেয়েছিলেন তা বোঝানোর জন্য উনি একবার বলেছিলেন "জানিস? এ আর কি চিংড়ি? আমাদের সময়ে যে চিংড়ি খেয়েছি তার খোলাগুলো ডাস্টবিনে পড়ে থাকলে তার মধ্যে দিয়ে কুকুরের বাচ্ছা ঢুকতো আর বেরুত।"     


পুঁইশাক বাদ দিলে আমাদের মোচা, লাউ, ওলকপি, ওল, ফুলকপি, ডুমুর, প্যাঁজকলি সবের অন্যতম অনুপান হল চিংড়ি। চিংড়ি ছাড়া এসব সবজী রাধুমই  না। আবার পটল-আলু পোস্ত চচ্চড়ি তে আমার ঠাম্মা চিংড়ি দেবেন ই।  দিদিমার সিগনেচার ডিশ ছিল চিংড়ির বাটি চচ্চড়ি। দাদু তো শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো প্রায় বলেই ফেলেছিলেন  "এই বাটি চচ্চড়ি পেলে সব লণ্ডভণ্ড করে চলে যাব" । না এটা আমি বললাম। উনি বলতেন, "থাক, এটা আর খাব না। মাথার বালিশের পাশে নিয়ে শোব। খেলেই ফুরিয়ে যাবে।" 


তবে চিংড়ির পাশাপাশি ইলিশ‌ও তাই বলে ঘটিবাড়িতে ব্রাত্য এমন নয়। বাবার মুখে শুনেছি আড়িয়াদহের গঙ্গায় নামতেন তেল মেখে। কোমরের গামছায় চার আনা পয়সা বেঁধে। সাঁতরে ওপার থেকে ফেরার পথে মাঝিদের ধরা  ইলিশ কিনে নৌকোয় চড়ে বাড়ি ফিরেই মা'কে ভাত বসাতে বলতেন। তবে ঘটিবাড়িতে ইলিশ মানে বাঙালদের কালোজিরে, কাঁচালঙ্কা বা বেগুণ দিয়ে পাতলা ঝাল নয় । ভাতের মধ্যে কৌটোবন্দী ভাপা অথবা সর্ষে ইলিশ। কৌটোর মধ্যেই নুন মাখানো ইলিশের গাদা-পেটি সর্ষে, কাঁচালঙ্কা বাটা, কাঁচা সর্ষের তেল আর বেশ কয়েকটি চেরা কাঁচালঙ্কার সাথে জারিয়ে ভাত ফোটবার সময় হাঁড়ির মুখে মিনিট দুয়েক রেখে দিলেই এই অমূল্য পদ তৈরী।  আমার রন্ধন পটিয়সী দিদিমা তার বিশাল সংসারে বিরাট এক হাঁড়ির মুখে বিশাল এক কচুপাতার মধ্যে মাছগুলিকে ম্যারিনেট করে পাতাটি সুতো দিয়ে বেঁধে ভাত ফোটবার সময় হাঁড়ির মুখে রাখতেন। মা বলত, সে ভাপা ইলিশের নাকি অন্য স্বাদ। আমি একটু ইম্প্রোভাইজ করে এই কায়দাটি করি লাউপাতায় মুড়ে এবং ননস্টিক প্যানে অর্থাত পাতুড়ির স্টাইলে। যাই করো এ কানুর তুলনা নেই। কাঁচা তেলঝাল, ভেজে ফোড়ন দিয়ে ঝাল, গায়ে মাখামাখা হলুদ সর্ষেবাটার ঝাল, বেগুন দিয়ে বাঙালদেশের পাতলা ঝোল...সব‌ই যেন বর্ষায় দৌড়তে থাকে গরম ভাতের সঙ্গে।


আবার ইলিশের মুড়ো দিয়ে পুঁইশাক, কুমড়ো, মূলো, আলু দিয়ে অমৃতসম ছ্যাঁচড়া। এই ছ্যাঁচড়াতে পাঁচফোড়ন, কাঁচালঙ্কা আর নামানোর সময় সর্ষেবাটা। কড়াইয়ের গায়ে লাগা লাগা হয়ে রান্নাঘরময় পোড়া পোড়া গন্ধ বেরুবে তবেই সার্থক সে ছ্যাঁচড়া। দাদু মায়েদের নিয়ে পিওরসিল্ক কিনতে গিয়ে বলতেন শাড়ির কোল আঁচল থেকে একটি সুতো বের করে দেশলাই কাঠিতে ধরে যদি ছ্যাঁচড়াপোড়া গন্ধ বেরোয় তবেই সেটা আসল রেশম। এখন বুঝি তার অর্থ।  মেছো গন্ধে ভরপুর ছ্যাঁচড়া কাঁটা-অপ্রেমীদের কাছে যত‌ই কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর মত বস্তু হোক মাছের মাথা মিশে তা প্রোটিনে ভরপুর এক রসায়ন। তাই বুঝি পিওরসিল্কে সেই প্রোটিন পোড়া গন্ধটাই প্রকট। 


তবে দুই বাংলার পুণ্য তিথিতে শাক-সুক্তোয় শুরুয়াত হলে মন্দ হয় না মধ্যাহ্নভোজন। শুভদিনে ডালের সঙ্গে পাঁচ ভাজাও আবশ্যিক। দুই বাংলার ফোড়ন বিনে রান্না অচল। দুই বাংলাতেই  মূলো বিনে কিম্বা ঘি ছাড়া শুক্তো নৈব নৈব চ। 


আর দুই বাংলাতেই 


" বৃষ্টি মানেই পিটারপ্যাটার বৃষ্টি মানে টুপটাপ

বৃষ্টি মানেই মায়ের হাতে ভুনি খিচুড়ির উত্তাপ।" 


 


গোবিন্দভোগ চাল আর শুকনোখোলায় ভেজে রাখা সোনামুখ ডাল মেপে ধুয়ে ভিজিয়ে ডুমো ডুমো ফুলকপি, কুচোনো গাজর, বিনস আর ফ্রোজেন মটরশুঁটি দিয়ে আদা, ট্যোম্যাটো কুচি কষিয়ে খিচুড়ির রেসিপি কিন্তু এক মোটামুটি। জিরে আর ধনের গুঁড়োর সঙ্গে সামান্য লাল লঙ্কার গুঁড়ো। সামান্য ঘিয়ে তেজপাতা, জিরে আর গোটা গরমমশলার ফোড়ন। চড়বড়িয়ে উঠলেই আদা-মশলার পেষ্ট। সবশেষে চালডাল দিয়ে নাড়াচাড়া, ওলটপালট। এবার সব্জী দিয়ে মেপে জল। ঢাকা খুলে নেড়েচেড়ে নুন্, মিষ্টি, হলুদ ছেটানো। পরিবেশনের আগে ঘি ছড়িয়ে গরমমশলা গুঁড়ো।তবে বাঙ্গালদের এই খিচুড়িকে জব্দ করেই লাবড়ার তুমুল যোগাড়।আমরাও শিখে গেছি । ঘটিদের পাঁচমেশালি চচ্চড়ির মত। ঘটির ছ্যাঁচড়া আর বাঙালের লাবড়া কে কার অপভ্রংশ তা জানা নেই। খিচুড়ির সঙ্গে লাবড়া অথবা ছ্যাঁচড়া কে কার অলংকার!  


ঘটি বাঙাল উভয় হেঁশেলের গ্রীষ্ম-বর্ষার অগতির গতি ছেঁচকি রান্নার চল খুব। চাইনিজদের স্টার ফ্রাই আমাদের অল্প তেলে ফোড়ন দিয়ে ঢাকাচাপা দিয়ে ঝিরিঝিরি করে কাটা সবজী কে ন্যায়দম খাওয়ানোর নাম ছেঁচকি। আলু, পটল, ফুলকপিই হোক কিম্বা কুঁদরী অথবা ঢেঁড়শ। হাতের কায়দায়, গ্যাসের ঢিমে আঁচে সব সবজীর আস্ফালন নিমেষেই ফুরোয়। তাপের চাপে সব্বাই জব্দ হয়ে কেঁচোর মত গুটিয়ে যায়। আর যত গুটোবে তত স্বাদ হবে সেই ছেঁচকির। বাঙালীর আদি অকৃত্রিম কালোজিরে মেথি, শুকনোলংকা বা কাঁচালঙ্কা অথবা পাঁচফোড়ন, রান্নাঘরের সব্বোঘটে কাঁঠালিকলা। 


ছেঁচকির কথায় মনে পড়ে আমার যশুরে জেঠিমা শাশুড়ির লাউয়ের খোসার ছেঁচকির কথা। আগেকার গিন্নীদের সব রান্নার শেষে উনুনের ঢিমে আঁচে বসানো হত এই ছেঁচকি। আমরা এখন গ্যাস সিম করে বানাই। তবে উনুনের নিবু নিবু মরা আঁচে সেই ছেঁচকি বসিয়ে জ্যেঠিমার নাইতে যাওয়া আর ফিরে এসে বারেবারে নেড়েচেড়ে তাকে ন্যায়দম খাওয়ানো...আর তাতেই বুঝি ছেঁচকির স্বাদ বেড়ে যাওয়া। সরু সরু করে কাটা লাউয়ের খোসা ধুয়ে নিয়ে হালকা ভাপিয়ে রাখতে হবে। প্রেসারে নয় কিন্তু। তারপর কড়ায় সামান্য সর্ষের তেলে কালোজিরে, শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে সেই খোসা সেদ্ধ দিয়ে নুন দিয়ে চাপা দিতে হবে। তারপর নাড়া আর চাড়া। যতক্ষণ না লাউয়ের খোসা স্প্রিং এর মত গুটিয়ে যায়। তখন সামান্য চিনি, পোস্তদানা। লঙ্কা গুঁড়ো, অল্প আটা আর বেসন আলগোছে ছড়িয়ে আরো কিছুক্ষণ স্টারফ্রাই। দরকারে একটু তেল ছড়ানো যেতে পারে। শুকনো ভাতে গরম গরম এই খোসার ছেঁচকির বিকল্প নেই। আমাদের সব শাকভাজাই এমন। জল পড়বেনা মোটেও। তেলের মধ্যে ফোড়ন আর শাক দিয়ে জব্দ করা হবে। নেতিয়ে পড়বে লকলকে টাটকা সবুজ শাক। শুকনো ভাতে অমৃত। একেক রকমের স্বাদ একেক শাকের। 


ছেঁচকি ছাড়া বাঙালীর আরেক অগতির গতি মাগো তুমি পোস্তবাটা। এই কাঁচা পোস্তবাটার যেমন গুণ তেমনি তা দিয়ে একথালা ভাত উড়িয়ে দেওয়া যায়। সঙ্গে যদি থাকে কাঁচা সর্ষের তেল, পিঁয়াজ কুচি আর কাঁচালঙ্কার ছোঁয়া। আর রেঁধে নিয়ে আলুপোস্ত, ঝিঙেপোস্ত কিম্বা পটল পোস্ত, আর পোস্তর বড়া বানিয়ে খেতে পারলে কথাই নেই। গরমের দিনে নরম মেনু। পোস্ত বাটার সঙ্গে লাউশাকের ডগা সেদ্ধ অথবা গোটা পটল সেদ্ধ দিব্য যায়। তবে সঙ্গত হিসেবে কাঁচা সরষের তেল, নুন আর লংকা মাস্ট।


এমনি আরেক গ্রাম্য খাবার হল শীতের রাঙা মূলো, ওল বা কচু ভাতে। এই দুইয়ের সঙ্গে কাঁচা লংকা দিয়ে সরষে বাট, সরষের তেল আর নারকোল কোরার কেমিস্ট্রি অনবদ্য জমে। তবে বাঙাল বাড়ির কচুবাটা দারুণ খেতে। 


আমি ছোটবেলায় খুব রোগা ছিলাম আর আমিষের বড় একটা ভক্ত ছিলাম না মোটেও। তাই বাবা প্রায়ই বলতেন  


মাংসে বাড়ে মাস

ঘৃতে বাড়ে বল,

দুধে শুক্র বাড়ে

শাকে বৃদ্ধি মল। 


আবার বাড়িতে কারোর সর্দিকাশি হলেই বাবা ব্যাগ দুলিয়ে চলতেন মাংসের দোকানে। তখন মাংস বলতে আমরা খাসির মাংস‌ই বুঝতাম। মুরগী ঢুকত না ঠাম্মার জন্য। বলতেন একটু মাংসের ঝোল ভাত খা। সব সর্দ্দি সেরে যাবে। আমার ঠাকুরদা নাকি বাবাদের ছোটবেলায় বলতেন  


"নস্য মাংস উপবাস তিনটিতে করে শ্লেষ্মা নাশ" 


আর পরে যখন মাংস খেতে ইচ্ছে করত, বাবা দোহাই দিতেন রেডমিটের ওপর জারি নিষেধাজ্ঞা, কোলেস্টেরলের কচকচানি এইসব আর মা আমার পক্ষ নিয়ে বলতেন, 


"জমিদারের দাঁত পড়ল, পাঁঠা বলি বন্ধ হল"  


আর জামাইষষ্ঠীতে সেই প্রবাদটি "জামাইয়ের জন্য মারি হাঁস গুষ্টি শুদ্ধ খায় মাস” ?


কোথায় লাগে মশাই হাঁস, মুরগী, কচ্ছপ, কোয়েল ?


খাসি‌ই বলুন আর পাঁঠাই বলুন এ কানুর তুলনা নাই। অবিশ্যি ভাগাড় কাণ্ডের পর সে খাসিও নেই আর নেই সেই পাঁঠাও। রেডমিট হারিয়েছে তার কৌলীন্য। তবুও খুঁজে পেতে বাজারে গিয়ে কাটিয়ে এনে খেলেই বুঝি সার্থক মাংস মঙ্গল।   


জানেন তো ? কালীঘাটের বলিপ্রদত্ত পাঁঠার মাংসে পিঁয়াজ রসুন পড়েনা। জিরেবাটা, হিং, আদা আর গরমমশলা দিয়েই তৈরী হয় সুপক্ক উৎকৃষ্ট মাংস। তবে আমরা বাড়িতে সেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একধরণেরই মাংসের ঝোলে অভ্যস্ত। হয় মায়ের হাতের গরগরে লাল মাংস কিম্বা নিজের ব্যস্ততায় সাদামাটা স্ট্যু। আবার রবিবারের রাতের মাংসে সকাল থেকে টক দৈ, পেঁপে কুরোনো আর সব মশলা মাখিয়ে দমে বসানো রেওয়াজি খাসির কষা মাংসের আরেক স্বাদ। আর এখন কেটারারের দেখাদেখি মাটন রেজালা বাঙালী বাড়িতে ঢুকে পড়েছে।অথবা খুব খাটতে পারলে হরা মাটন মনোহরা। মানে সবুজ মাংস। কষে ধনেপাতা, পালংশাক বাটা দিয়ে মাটন।


তবে মাটন রান্নার মদ্যা কথাটা হল ঠান্ডা জল নৈব নৈব চ। এটা জেনেছিলাম অবিশ্যি আদর্শ হিন্দু হোটেলে। আর আমার মায়ের একটা ভাল টিপ্‌স হল


"মাছ ধুলে মিঠে, মাংস ধুলে রিঠে"


তাই বাজার থেকে কিনে এনে মাত্র একবার ধুলেই যথেষ্ট। মা অবিশ্যি প্রচুর সরষের তেল দেয়। মাঝেমাঝেই সেই তেল ওপর থেকে ডিক্যান্ট করে আমি রেখে দিই পরদিনের ডিমের কারি বা ঘুগনির জন্য। সে ঘুগনি বা এগ কারির  স্বাদ অনবদ্য।

২০ আগ, ২০২০

কি চেয়েছি আর কিপাইনি

 আমি চেয়েছিলাম স্বাধীনতা। পাইনি। আমি চেয়েছিলাম খোলা চুলে বিয়েবাড়ি যেতে। পারিনি। আমি চেয়েছিলাম বুকের কাছে ফ্রিল ছাড়া ফ্রক পরতে। পরতে দেওয়া হয় নি। এ ছিল টিন-বেলার দুঃখের কিস্‌স্যা । সবে তে বসানো হত টেকশো। মা বলত আমার ভালোর জন্য। বাবা বলত কথা শুনলে লক্ষ্মী মেয়ে বলবে সবাই। 

আমি চেয়েছিলাম জৈব রসায়ন বিজ্ঞানী হতে। আত্মীয়স্বজনের প্ররোচনায় বাড়ির সবচেয়ে "কালো মেয়ের" বিয়ে দিয়ে দিলেন বাবা। বিশ্ববিদ্যালয়ে র‍্যাঙ্ক করেও আমি বঞ্চিত হয়েছিলাম গবেষণা থেকে। আবারো করের বোঝা। 

বিয়ের পরেও স্বাধীনতা পাইনি। এক রক্ষণশীল পরিবার থেকে আরেক রক্ষণশীল পরিবারে এলাম। ভেবেছিলাম  নদীর ওপারে অনেক সুখ। তেমনি বিশ্বাস ছিল আমার। সেই বিশ্বাসে জল ঢেলে দিল শ্বশুরবাড়ির মাথারা। আগুণকে সাক্ষী করে নেওয়া ব‌উ তার স্বামীর পাশাপাশি বারান্দায় দাঁড়ালে, শোবার ঘরে দরজা আঁটলে নাকি অশালীন। 

তবে আমি যা চাইনি তা সত্যি পেলাম একদিন। তাই হিসেব মিলোতে চাইনা আর। এসব কি চেয়েছি আর কি পাইনির টানাপোড়েনে বিদ্ধ্বস্ত না হয়ে সোজা হাজির হয়েছিলাম সব পেয়েছির দেশে, আমার লেখালেখির জগতে। 

৭ আগ, ২০২০

বাইশের সবুজায়ন



ঠাকুরের মৃত্যু হয়না। তিনি চির সবুজ উদ্ভিদের মত। বেঁচে থাকেন আমাদের মধ্যে, আমাদের জীবনে, যাপনে, জন্মে, মরণে। বেঁচে ওঠেন তাঁর লেখায়, গানে, কবিতায় বারেবারে।  

আজ অরণ্যমেধ যজ্ঞের সামিল হয়ে মানুষ যখন পরিবেশ সচেতনতার বাণী আওড়ায় তখন মনে পড়ে বাইশে শ্রাবণের কথা। মরণশীল রবিঠাকুরের মৃত্যুদিন বাইশে শ্রাবণকে তার আশ্রমের বৃক্ষরোপণের দিন হিসেবে ধার্য করেছে বিশ্বভারতী। যেন তিনি ঐ উত্সবের মধ্যে দিয়ে নবজীবন লাভ করেন প্রতিবছর। ১৯৪২ সাল থেকে এমনটি হয়ে আসছে অথচ বিষয়টির ওপর বিশেষ আলোকপাত দেখিনা।  

শ্রাবণের ধারায় সিক্ত মাটিতে উদ্ভিদ তার সঞ্জিবনী শক্তি পায় ও ধীরে ধীরে  মহীরুহে রূপান্তরিত হয়। তাই তার নবীন জীবন বরণের এই উত্সবে কবির গতজীবন স্মরণ-মননের এবং বৃক্ষের নবজীবন বরণের। শান্তিনিকেতনে বিগত এই এতগুলি বছর ধরে কত নামী মানুষের হাতে পোঁতা বৃক্ষের তালিকাসূচি পাওয়া যায় । শ্রাবণ যেন দিনের শেষে যেতে গিয়েও যেতে পারেনা। বাইশেও তাকে নতুন করে ফিরে পাওয়া আমাদের। প্রকৃতিপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে ছিলেন। তাঁর ছিন্নপত্রে তার উল্লেখ পাই আমরা। 


কবির  কথায় "এই পৃথিবীটি আমার অনেক দিনকার এবং অনেক জন্মকার ভালোবাসার লোকের মত আমার কাছে চিরকাল নতুন। আমি বেশ মনে করতে পারি, বহুযুগ পূর্বে তরুণী পৃথিবী সমুদ্রস্নান থেকে সবে যখন মাথাতুলে উঠে তখনকার নবীন সূর্যকে বন্দনা করছেন তখন আমি এই পৃথিবীর  নূতন মাটিতে কোথা থেকে এক প্রথম জীবনোচ্ছ্বাস গাছ হয়ে পল্লবিত হয়ে উঠেছিলেম।"

বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানের সূচনা কবি প্রথম করেছিলেন তাঁর জন্মদিনে। আর কেন এই উত্সব সেই কারণ হিসেবে কবি বলেন" পৃথিবীর দান গ্রহণ করবার সময় মানুষের লোভ বেড়ে উঠল। অরণ্যের হাত থেকে কৃষিক্ষেত্রকে সে জয় করে নিলে, অবশেষে কৃষিক্ষেত্রের একাধিপত্য অরণ্যকে হটিয়ে দিতে লাগল। নানা প্রয়োজনে গাছ কেটে কেটে পৃথিবীর ছায়াবস্ত্র হরণ করে তাকে নগ্ন করে দিতে লাগল। তার বাতাস হল উত্তপ্ত, মাটির ঊর্বরতার ভান্ডার নিঃস্ব হল।"


এই কথা মাথায় রেখেই বৃক্ষরোপণ বা বনমহোত্সব্ বা তাঁর ভাষায় "অপব্যায়ী সন্তান কতৃক মাতৃভান্ডার পূরণের কল্যাণ উত্সব"।   

তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। কবির পরিবেশ বান্ধব মনের কোণে জেগে থাকা কত ইচ্ছে পূরণ হয়নি। তাঁর ইচ্ছেগুলোর সুবিচার হয়েও হয় নি। বিচারের বাণীগুলি নীরবে, নিভৃতে কেঁদেছে। সোনাঝুরির খালপাড়ে কত চাঁদ-সূয্যি উঠে অস্ত গেছে। আশ্রমের আম্রকুঞ্জ থেকে ছাতিমতলা অবধি কত গৃহবাসী দ্বার খুলেছে। কত বসন্ত, কত পৌষ দেখেছে। গোয়ালপাড়া থেকে তালতোড়, ফুলডাঙা থেকে শ্যামবাটিতে কত জনসমাগম হয়েছে। খোয়াইহাটে কত কত কাঁথা বাটিকের পসরা সেজেছে। ভুবনডাঙায় কত টেরাকোটার ঢোলক, নোলক নাড়াচাড়া হয়েছে । কত আউল বাউল উজাড় করে গেয়ে উঠেছেন মন প্রাণ ঢেলে। হৃদমাঝারে তবুও ধরে রাখতে পারলনা তাদের কবিগুরুকে । একরত্তি কোপাইয়ে যে জল সেই জলই রয়ে গেল যেন। আজ তিনিও পণ্য। বসন্ত উৎসবে, পৌষ মেলায় তাঁকে বেশী করে স্মরণ, মনন, তাও নিজেদের স্বার্থে। বৃক্ষরোপণ আজও হয় বাইশে শ্রাবণে তবু আরও সবুজায়ন হয়েছে কি? শান্তিনিকেতনের চারিপাশে আবর্জনার দূষণ কমেছে কি? গুরুকুলে শিক্ষার মান বেড়েছে কি? বিশ্বভারতী তেমন করে কবির ঠাটঠমক আর ধরে রাখতে পারল কই? 



তথ্যসূত্রঃ রবীন্দ্রনাথ ও মানুষ ছিলেন, আবদুস শাকুর ( দীপ প্রকাশন্ )