২২ সেপ, ২০১৫

প্যাপিরাস পুজোসংখ্যা ২০১৫ আসছে...

সোনারতরী থেকে প্রকাশিত "প্যাপিরাস" ই-পত্রিকার পুজোসংখ্যা আসছে কয়েকদিনের মধ্যেই । "চক্রবৈঠক" এবার জমজমাট আলোচনা নিয়ে। বিভিন্ন পেশার সাথে যুক্ত মানুষদের মুক্ত কলমে উঠে আসছে বিতর্ক। "সংস্কার না সংস্কৃতি? কোনটির প্রয়োজন এ যুগে "...তা নিয়ে। আর আছে মেয়েদের লেখা একগুচ্ছ থিম অণুগল্প। বিষয়ঃ দুর্গাপুজো। এছাড়াও থাকছে নিয়মিত বিভাগ স্মৃতিকণা, রম্যরচনা এবং ভিন্নস্বাদের নিবন্ধ।

১৮ সেপ, ২০১৫

জয় বাবা গণেশ !

তিনি হলেন গিয়ে "গণানাং পতি", গণশক্তির প্রতীক, গণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ (গণ+ঈশ)  । বিনায়ক (বি+নী+অক) তাঁর অপর নাম।  প্রমথগণ হলেন শিবের অনুচর এবং সঙ্গী। তাঁরা নাচগানে পারদর্শী । সন্ধ্যার অন্ধকার প্রমথগণের আশ্রয়। বিনায়ক হলেন সেই প্রমথগণের পতি। সন্ধ্যার অধিপতি দেবতা বলে সন্ধ্যারূপিণী লক্ষ্মীদেবীর পাশে গনেশের অবস্থান। ভূতপ্রেতদের দৌরাত্ম্যি ও সকলপ্রকার বাধাবিঘ্ন নাশ করার জন্য প্রমথগণ গণপতিকে সন্তুষ্ট রাখতেন তাই গণপতির অপর নাম বিঘ্নেশ।  তাঁকে পুজো করলে সিদ্ধিলাভ হয় তাই তিনি সিদ্ধিদাতা গণেশ। গ্রীসে ও রোমে গণেশ "জুনো(Juno)" নামে পুজো পান। হিন্দুধর্ম ছাড়া বৌদ্ধধর্মেও গণপতিকে " ওঁ রাগ সিদ্ধি সিদ্ধি সর্বার্থং মে প্রসাদয় প্রসাদয় হুঁ জ জ স্বাহা" মন্ত্রে পুজো করা হয়।  কিন্তু তফাত হল হিন্দুদের গণপতি সিদ্ধিদাতা আর বৌদ্ধদের সিদ্ধিনাশক যা সম্পূর্ণ বিপরীত। হিন্দুদের দেবী অপরাজিতা মা দুর্গার ডানদিকে থাকেন গণপতি। কিন্তু মহাযানী বৌদ্ধদের অপরাজিতা দেবীর সাধনায় লক্ষ্য করা যায় গণপতি চিরবিঘ্ন প্রদায়ক। সেখানে দেবীর বাঁ পা  গণেশের উরুতে আর ডান পা ইন্দ্রের ওপরে ন্যস্ত। বিনায়ক দেবীর পদভারে আক্রান্ত। আবার পুরাণের মতে গণেশ কেবলমাত্র শিব-দুর্গার পুত্ররূপে পরিচিত। বহুযুগ আগে সমাজে দুধরণের সম্প্রদায় ছিল যাঁরা দুটি ভিন্ন মতবাদে গণেশের পূজা করত। একদল নাগ-উপাসক ছিল তাই গণেশের গলায় যে যজ্ঞ-উপবীত বা পৈতেটি রয়েছে সেটি নাগোপবীত তথা নাগের অলঙ্কারের পরিচায়ক। আর অন্য সম্প্রদায় আবার স্কন্দ বা কার্তিকের পূজারী। তারা নাগ-উপাসনার বিরোধী হয়ে কার্তিকের বাহন ময়ূরকেই বেশী প্রাধান্য দিত । ময়ূর হল নাগেদের শত্রু।
বর্তমান দুর্গাপুজোতে আমরা মা দুর্গার দুই পাশে কার্তিক ও গণেশ উভয়েরি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান লক্ষ্য করি। অর্থাত নাগ-উপবীতধারী গণেশও র‌ইলেন আবার ময়ূরবাহন কার্তিকও র‌ইলেন।  আর সেই রূপটি‌ই সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে আজো সমাদৃত।  
ছবিঃ রুচিরা চ্যাটার্জি 
মা দুর্গা  একদিন কৈলাসে বসে স্নানের পূর্বে তেলহলুদ মেখে গাত্রমার্জণা করছিলেন। মায়ের দুই সহচরী  জয়া-বিজয়া কাঁচা হলুদ বেটে তার মধ্যে সরষের তেল দিয়ে মায়ের সর্বাঙ্গে  মাখিয়ে দিতে ব্যস্ত। মা সেই আরাম পাবেন কি, মনে তাঁর খুব দুঃখ। মহাদেব কত নারীকে পুত্র দিয়ে তাদের আকাঙ্খা পূর্ণ করেন আর দুর্গাই স্বপুত্র থেকে বঞ্চিত। কার্তিককে পেয়েছেন যদিও কিন্তু সে তো তাঁর গর্ভের নয়। সে শিবের ঔরসজাত, গঙ্গার কানীনপুত্র আর ছয় কৃত্তিকার দ্বারা পালিত।  গাত্রমার্জণা শেষের দিকে। মা জয়া-বিজয়াকে বললেন, তোরা যা দেখি একটু ওদিকে, বাবার সাথে আমাকে একটু একা থাকতে দে। মা নিজের তেলহলুদ মাখা গায়ের ময়লাগুলি তুলতে তুলতে মহাদেবকে বলেই ফেললেন" আজ আমার একটা ছেলে থাকলে..." মহাদেব বললেন, তুমি ত্রিলোকের যত পুত্রসন্তান আছে তাদের সকলেরি মা"  মা বললেন,"তবুও, একটুতো দুঃখ হয়, বুঝলেনা" মহাদেব বললেন" কত ঝামেলা করে চন্দ্রলোক থেকে কৃত্তিকাদের অমতেও কার্তিককে এনে দিলাম তাও তোমার দুঃখ ঘুচলোনা?"  মা বললেন " ঠিক আছে আর বলবনা" বলতে বলতে নিজের গায়ের ময়লাগুলি তুলে তুলে মাটিতে ফেলছিলেন মনের দুঃখে। হঠাত তাঁর কি মনে হল, সেই ময়লাগুলি দিয়ে একটি পুতুল গড়ে ফেললেন মাদুর্গা। নারায়ণ সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি ঐ পুতুলের মধ্যে সূক্ষ্ম শরীরে প্রবেশ করা মাত্র‌ই পুতুলটি প্রাণ পেল আর মাদুর্গাকে "মা, মা" বলে ডেকে উঠল। মায়ের বুকের ওপরে উঠে তাঁর দুধ খেতে শুরু করে দিল। দুর্গা আনন্দে আত্মহারা হয়ে সেই ছেলেকে কোলে নিলেন। মহাদেব আবার কার্তিককে এনে তাঁর আরেক কোলে দিলেন। । এবার কৈলাসে মহাভোজ। দুর্গার সুখ আর দ্যাখে কে! দুই পুত্র নিয়ে, দুই কন্যা নিয়ে সুখের সংসার শিব-দুর্গার। কৈলাসের সেই মহাভোজে সব দেবতারা নিমন্ত্রিত হলেন। সকলেই নির্ধারিত দিনে এলেন কেবল শনি মহারাজ ছাড়া। শিব ক্ষুণ্ণ হলেন শনি না আসায়। শনি সম্পর্কে দুর্গার ভাই।  একবার দুর্গা শনিকে বর দিয়েছিলেন, সে যার দিকে চাইবে সাথে সাথে তার মাথাটা খসে পড়বে। মহাদেবের অসন্তোষের কারণে সেদিন শনি অবশেষে দুচোখ হাত দিয়ে ঢেকে প্রবেশ করলেন। এদিকে মহাদেব তো আর সেকথা জানেননা। তাঁদের ছেলেকে দেখছেন না শনি, সেও তো এক অপমানের বিষয়। শনি বাধ্য হয়ে  চোখ খুলে সেই ছেলের দিকে চাইতেই ছেলের মুন্ডুটি খসে পড়ে গেল মাটিতে। মাদুর্গা কাঁদতে লাগলেন। 
দুর্গা নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকল দেবতারা বিচলিত হয়ে পড়লেন। তাঁদের আদেশে মহাদেব নন্দীকে বললেন ত্রিভুবন ঘুরে উত্তরদিকে শয়নরত যে কোনো ব্যক্তির মুন্ডটা কেটে আনতে। নন্দী বেরিয়ে পড়ল। স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল ঘুরে দেখতে পেল উত্তরদিকে মাথা করে একটা সাদা হাতি শুয়ে আছে।  সেই হাতীর মাথাটা কেটে এনে সে মহাদেবের কাছে নিয়ে এল। মহাদেব তখুনি মাথাটা ছেলের কাঁধে জোড়া দিলেন ছেলে আবার মা, মা করে ডাকতে শুরু করে দিল। মা দুর্গার একাধারে মা ডাক শুনে আনন্দ হল আবার অন্যথায় ছেলের হাতীর মাথা দেখে দুঃখে প্রাণ কেঁদে উঠল। তাঁর দুঃখ দেখে দেবতারা বললেন, মা তুমি দুঃখ কোরোনা, তোমার এই ছেলের নাম দিলাম গণপতি। সকল দেবতার পুজোর আগে এঁর পুজো হবে সর্বাগ্রে।  মা দুর্গা ছেলের এই সম্মানে গর্বিত হলেন।আর মর্ত্যলোকে  ভাদ্রমাসের শুক্লা চতুর্থীতে গণেশের জন্মদিন পালন করা হয়।   

১৭ সেপ, ২০১৫

হ্যাপি কন্যা সংক্রান্তি!


তিনি সব্বোঘটে ক্যাঁটালি কলা। তিনি সব কাজ করতে পারেন। তিনি জ্যাক অফ অল ট্রেডস আবার মাষ্টার অফ অল ও। সবেতেই পারদর্শী।  তিনি একাধারে আর্কিটেক্ট অন্যধারে প্রোমোটার। একাধারে ইঞ্জিনিয়ার অন্যদিকে কার্পেন্টার। আবার তিনি নাকি ছিলেন ফ্যাশান কাম জুয়েলারি ডিজাইনার । তাঁর আবার অস্ত্রশস্ত্র বানানোর ফ্যাক্টরিও আছে। তাই বুঝি তিনি দেবলোকের স্থপতি, কারিগর, শিল্পী। মর্ত্যে যাকে বলে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার  কিম্বা ওয়েল্ডার, বা আর্কিটেক্ট বা পাতি মিস্ত্রী।  সমুদ্রমন্থনের একটি অনবদ্য ফলস্বরূপ তাঁর জন্ম।  সত্যযুগে যিনি স্বর্গ, ত্রেতায় লঙ্কাপুরী, দ্বাপরে শ্রীকৃষ্ণের রাজধানী দ্বারকা ও পান্ডবদের ইন্দ্রপ্রস্থের রাজধানী নির্মাণ করেছিল। তিনি যেন ত্রিযুগের পারদর্শী এক স্থপতি।   প্রতিবছর ১৭ই সেপ্টেম্বর তাঁর পুজো হয়। কেন হয়? সেদিন নাকি তাঁর জন্মদিন। বিশ্বকর্মাজয়ন্তী বলে অন্য প্রদেশে।  একাধারে তিনি ডিজাইনার আবার একাধারে তিনি  স্থপতি। দেবতাদের রথ থেকে অস্ত্রশস্ত্র, অলঙ্কার থেকে নানাবিধ ক্ষুদ্র এবং কুটির শিল্পের প্রস্তুতকারক।  বিশ্বকর্মার চারহাতের একটিতে জলভর্তি কমন্ডলু, অন্যহাতে কুঠার। অপরদুটি হাতে ফাঁসযুক্ত দড়ি এবং ব‌ই থাকে।  ঠিক যেমন বাস্তব জগতের মিস্ত্রির মত।  পুরাণের মতে বাস্তু হল বিশ্বকর্মার পিতা।   প্রতিবছর কন্যাসংক্রান্তির দিনে, ১৭ই সেপ্টেম্বর বা ভাদ্রমাসের শেষদিনে তাঁর পুজো হয়। সূর্য সেইদিন থেকে কন্যারাশিতে গমন করে তাই এই সংক্রান্তির অপর নাম কন্যাসংক্রান্তি। 
বেদে বলা হয়, বিষ্ণুর সুদর্শণ চক্র, মহাদেবের ত্রিশূল, দেবরাজ ইন্দ্রের বজ্র এবং পুষ্পক রথ তিনি বানিয়েছিলেন। সীতার স্বয়ংবর সভায় যে বিশাল ধনুকটিতে জ্যা পরিয়ে ধনুকটি ভঙ্গ করে  রামচন্দ্র সীতাকে পেয়েছিলেন সেই  হরধনুটিও বিশ্বকর্মার হাতে তৈরী।  


 দক্ষিণবঙ্গে বর্ষার পরে  সরীসৃপের বাড়বাড়ন্ত হয়। জলে জঙ্গলে মানুষদের কাল কাটানো, বিশেষতঃ সাপখোপেদের সাথে তাদের অহোরাত্র ওঠাবসা। একটু অসতর্ক হলেই বনে জঙ্গলে সাপেকাটার খবর। তাই বর্ষা গিয়ে ভাদ্রের জল থৈ থৈ গ্রামবাংলায় শরতের নীল আকাশের আবাহনে আগমনীর সুর যেন সবে শুনতে পায় গ্রামবাসীরা। ভাদ্রমাসের সংক্রান্তিতে তারা করে রান্না পুজো। রাঁধে ভাদ্রের শেষ দিনে। আর সেই বাসি খাবার খায় আশ্বিনের প্রথমদিনে। তাদের বিশ্বাস তাদের প্রত্যেকের ঘরের নীচে যে বাস্তুসাপ আছে , যে সারাবছর তাদের বালবাচ্ছাদের বাঁচিয়ে রেখেছে, যার নজরদারিতে তারা সম্বচ্ছর বেঁচেবর্তে রয়েছে তাকে এবছরের একটা দিন মনে করে পুজো করা। সাপেদের দেবী মা মনসার পুজো এটাই। মা মনসা তুষ্ট করলে তবেই সাপেরা উত্পাত করবেনা। এই তাদের বিশ্বাস। গোবরছড়া দিয়ে রান্নাঘর, উঠোন নিকিয়ে, শুকনো করে,  ধোয়ামোছা করে, ঘর রং করে ষোড়শ উপচারে সংক্রান্তির দিন রাতে তারা নতুন উনুনে রান্না করে। 
ভাত, তরকারি, ডাল চচ্চড়ি, কচুশাক, ইলিশমাছ, চিংড়িমাছ, চালতার টক, পাঁচ রকম ভাজা, আবার পিঠেপুলি, পায়েস...সব রেঁধে বেড়ে মনসাদেবীকে উত্সর্গ করে তারপর দিন সব ঠান্ডা খাবে তারা। যদি রান্নাবান্নায় কোনো অসংগতি থাকে কিম্বা পরিচ্ছন্নতায় দোষত্রুটি থাকে তবে ঐ দিন মনসাদেবী সাপকে পাঠিয়ে সব খাবার বিষাক্ত করে দেন তাই দক্ষিণবাংলার মানুষদের এই পুজোতে নিষ্ঠা চোখে দেখবার মত।
তারা কাঁটা মনসার ঝোঁপেঝাড়ে এখনো রেখে আসে দুধের বাটি আর কলা। সাথে কিছু রান্নাপুজোর ভোগদ্রব্য।   দক্ষিণবঙ্গের মেয়েরা অনেকে আজো বলে আন্নাপুজো। তারা "র" উচ্চারণে অক্ষম। তারা বলে আন্নাপুজোয় পান্না খাওয়া। পান্না হল পান্তাভাত।  ভাদ্রের পচা গরমে কখনো রোদ, কখনো বৃষ্টি। তাই বাসিভাতে ঠান্ডা জল ঢেলে রাখার রেওয়াজ। পরদিন ভাত টাটকা থাকবে। আর এই পান্তাও নাকি খুব স্বাস্থ্যকর।  সাথে কেউ রাঁধে ডালবড়া, মাছভাজা। কেউ উচ্ছেচিংড়ি, গাঁটিকচুর দম। কেউ আবার মহা উদ্যমে রাঁধে  ঘেঁটুফুল ও কচুপাতা বাটা, নারকোল কোরা, সর্ষে-বাটা আর সর্ষের তেল দিয়ে মাখা,  সর্ষে দিয়ে কচুর লতি আর শাপলা ডাঁটার ডাল ।  তবে ডালচচ্চড়ি, কচুরশাক, ইলিশ-চিংড়ি রাঁধতেই হয়। আর অগাধ বিশ্বাস নিয়ে তারা সেই পঞ্চ ব্যঞ্জন নিবেদন করে মনসা ঠাকুরাণী আর তাঁর চ্যালা নাগনাগিনীদের।     
বিশ্বকর্মাপুজোর দিনে এই উত্সবকে বলা হয় অরন্ধন বা রান্না পুজো।  


এই বিশ্বকর্মা তথা মনসাপুজোর পর আমাদের আর কোনো উত্সব নেই। আবার সেই শরত্কালের দুর্গোত্সব হবে মহালয়ার পর, সুপর্বে।  তখন হবে সুসময়, পুণ্যকাল। আমাদের পরবের দিন শুরু হবে। তাই তো মাদুর্গার অরেক নাম "সুপর্বা"। তাই বুঝি আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, বিশ্বকর্মা পুজো শেষ হল মানেই দুর্গাপুজোর ধুম লেগে গেল হৃদিকমলে। আর হিন্দুদের এই পরব চলবে চৈত্রের সংক্রান্তিতে চড়কপুজো অবধি । পুরণো বছর চলে যাবে আবার নতুন বাংলা সন পড়বে তারপর। 
 
 এই দিনে বাংলার আরেকটি উল্লেখযোগ্য উত্সব হল ঘুড়ি উত্সব। সব কলকারখানা বন্ধ বিশ্বকর্মা পুজোর কারণে। সব যন্ত্রপাতি ধোয়া মোছা করে তাদের সম্বচ্ছরি বিশ্রাম ঐদিন। আর তাই বুঝি সেই আনন্দযজ্ঞে মেতে ওঠে ছোটবড় সকলেই। অনাবিল আনন্দ। অফুরন্ত সময় ঘুড়ি ওড়ানোর। শরতের নীল, মেঘমুক্ত আকাশে রং বেরংয়ের ঘুড়ি আর ঘুড়ি। কত রকমের নাম তাদের। কত রং তাদের।  দুদিন আগে থেকে ঘুড়ি তৈরী আর সেই সাথে ঘুড়ি ওড়ানোর সূতোয় মাঞ্জা দেওয়া। কাঁচের গুঁড়োর সাথে গদের আঠা মিশিয়ে কড়কড়ে করে সেই মিশ্রণ সূতোয় লাগানো। এ প্রান্তে একটা গাছের গুঁড়িতে সুতো বেঁধে ও প্রান্তে আরেকটা গাছের গায়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পাক দিয়ে সুতোয় মাঞ্জা দেবার পালা। তারপর সেই সুতো গুটিয়ে নেওয়া কাঠের লাটাইয়ে। রান্নাবান্না বন্ধ। মেয়েদের আজ জিরেন। আর ছেলেদের মনের সুখে ঘুড়ি ওড়ানো। নীল আকাশে ঘুড়ির মেলা। আর এ পাড়ার টুবলুর দল ও পাড়ার বাপ্পার দল। কে কাকে কাটবে আজ? অসীম আকাশে উভয়েরি ঘুড়ির রাজ্যপাট । কে কার এক্তিয়ার অতিক্রম করে কাকে কাটতে পারে সেই হল গোল। একবার কাটতে পারলেই চীতকার..."ভোকাট্টা....দুয়ো, দুয়ো" আর সাথে সাথেই যারা অন্যপক্ষের ঘুড়ি কাটলো তাদের বাঁশী, কাঁসি, ঢাক, ঢোল পিটিয়ে প্রতিপক্ষকে হিউমিলিয়েট করা। সেই ফাঁকে মাঞ্জা দেওয়া সুতোয় হাত কেটে রক্তারক্তি। রোদ্দুরে ঘুড়ি উড়িয়ে ছাদ থেকে তরতর করে নেমে গিয়ে ঠান্ডা জলে ঢকঢক। ব্যাস্! সর্দ্দিগর্মি। মায়ের বকুনি। পেটকাটি,  চাঁদিয়াল, একতে, দোতে, বাতিয়াল,  ঘয়লা, ময়ূরপঙ্খী,  শতরঞ্চি,  বামুনপেড়ে,
রসোগোল্লা,  মুখপোড়া, চৌখোপ্পি, জয়হিন্দ...   আরো কত নাম সব ঘুড়ির।  আর আছে হরেক কিসিমের ঘুড়ির সুতো.. ডেক্রণ, স্পেকট্রা, ডিকট। কাজ সকলের এক‌ই কিন্তু  কোন্‌ ঘুড়ি যে কাকে কাটবে ঐদিনে আর কার সুতোয় যে কত জোর অথবা পাড়ার কোন ছেলে সেদিন সবচেয়ে বেশী ঘুড়ি কাটবে আর গলা ফাটিয়ে তার বন্ধুরা তার জন্য চীতকার করবে তা ছিল দেখার মত।  
মফঃস্বলে আজো দেখি ঘুড়ির দোকান।  কিন্তু নিজের বাড়ির ছাদ তো অপ্রতুল শহরে। তাই শহুরে ছেলেপুলেদের ঘুড়ি ওড়ানোয় সেই মাদকতা চোখে পড়েনা। ঘুড়ির পাতলা, ফিনফিনে রঙীন কাগজের বদলে এখন পলিথিন হয়েছে ঘুড়ির অঙ্গশোভা। আজ সে আমাকে তেমন করে টানেওনা। আর শহরের হাইরাইজের ছেলেপুলের এখন সময়‌ই বা কোথায় ঘুড়ি ওড়ানোর? সব ফ্ল্যাটবাড়ির ছেলেরা তো একত্র হয়ে মেতে উঠতেই পারে এই ঘুড়ি উত্সবে??

১৩ সেপ, ২০১৫

মনসুন মোমেন্টস-২


ভেজা টাওয়েলটা আবার বিছানার ওপর রেখেছিস? ….সরি মা! তুমি তো আছো তাই।
দাদাই বলল, পরের বারে এসে হয়ত আমার সাথে আর দেখাই হবেনা তোর।.... ধুস্! দাদাই! কি যে বলো! 
দিদা বলল, আর কি পরের বার তোকে নিজের হাতে মাংস রেঁধে খাওয়াতে পারব? ….ঠিক পারবে দিদা। 
ঠাম্মা বলল, কি রে আরেকবার আজ দেশপ্রিয় পার্ক খেলনার দোকানে যাবি নাকি? হট-হুইলসের গাড়ি কিনতে? ….এখন আর অত ছোট্ট গাড়িতে হবেনা ঠাম্মা। রিয়েল মডেল চাই ফর্মুলা ওয়ান কারের।  

.....আইনক্সের সেই মুভিটা? মানিস্কোয়ারের সেই আইসক্রিমটা? গড়িয়াহাটের মোড়ের সেই রোলকর্ণার? মনে পড়ছে কি তোমার বলো? বলো? চুপ করে আছো কেনো মা? নিউমার্কেট যাবে যে বলেছিলে? সেই কত কত ফেক ঘড়ি ছিল ! পার্কস্ট্রীটের চেলো কাবাবটা খাওয়ানো হলনা তোমাকে আজো! প্রিয়ার কাছে সেই দুপুরগুলো? তুমি ফুটপাথী মোমো খেতে দিতেনা, বলতে বানিয়ে দেবো। মায়ের কেবিনের চপ আজো খাওয়া হলনা আমাদের্! এখনো ফুটপাথে বিরিয়ানির হাঁড়িগুলো বসানো থাকে মা? কি উগ্র গন্ধ বেরোয় আশপাশ থেকে। 
….
তোমাদের ধর্মের সংজ্ঞাটা আজো ক্লিয়ার না আমার কাছে। জানো মা ? আজ আমাদের দেশে এত রেপ হয় কেন?
এই তোমাদের মত অর্থডক্স যারা সংস্কারের বশে হাত ধুয়ে পুজো করো, পুজোর ফুল মাথায় ঠেকাও তাদের জন্য। মেয়েদের জন্যে যারা একটুও ভাবোনা তাদের জন্যে।  ঠাম্মা-দিদাই তো বলে ফুলো লুচিগুলো আমার পাতে দিতে। আর তোমরা সব মিয়োনো, ন্যাতন্যাতে, পোড়াগুলো নাও নিজেদের পাতে। ছেলেদের উচ্চাসনে বসিয়ে কি লাভ মা? সমান করতে শিখলেনা আজো? আমের আঁটিটা তুমি‌ই কেন খাবে? বাবার পাতে কেন দেবেনা মা? মেয়েদের এত নীচু করে রেখে আসার মাশুল দাও এবার। 
….
মা, আবার তুমি আজ সেই চিকেনটা বানিয়েছো? জিও! বেশী রুটি করেছ তো ?   
মা, জিনসের এই বাটনটা  একটু সেলাই করে দিও প্লিজ! কতবার বললাম এই নিয়ে!
ঘুম থেকে উঠবনা, ব্যাস্! আজ রোববার! আজ দেরী করব‌ই।
মা, রান্নার মাসী আসেনিতো কি? আজ তাহলে রান্না কোরোনা। কাবাব খেতে যাব চলো। প্লিজ মা, কাবাব এন্ড বিয়ার !!!
ফাটাফাটি হয়েছিল কালরাতের  পুডিংটা। আবার বানিও। ওজন বাড়ছে বাড়ুক, নো চাপ! চিল, চিল! কুল, কুল!
….
এই উইকএন্ডে তবে শান্তিনিকেতন ফাইনাল তো ?... ইয়েস!
মা শুনেছো? ইউটিউবে শানের রবীন্দ্রসংগীত! হোয়াট এন ইম্প্রোভাইজেশান! কর্ডগুলো ফলো করলে? এই নেক্সট উইকেন্ডে কিন্তু উইকেন্ডার কলকাতায়। ফসিলস থাকছে। যাবে তুমি?
নজরুল মঞ্চে ইন্দ্রায়ুধের বাবা তেজেন্দ্র নারায়ণ আছেন, সাথে জাকির হোসেনের তবলা। যাবে তো ? 
ঐ দ্যাখো মা, আমার সেন্ট জেভিয়ার্সের বন্ধু কবীর তোমার তারা মিউজিকে পারফর্ম করছে!
….
মা, রান্নার মাসীরো তো ছুটির দরকার আছে? সপ্তায় সাতদিন তোমার ছেলে যদি কাজ করত?
চিনি-দুধ না দিয়ে ঐ অখাদ্য চা যে তোমরা কি করে খাও?  
আমার ডিমের পোচে "মোলগরিচ" মাস্ট কিন্তু!    
….
 বিয়েবাড়ি থেকে ফিরে বাড়ির মেয়েরা বলাবলি করছিলাম "বৌ কিন্তু বেশ ময়লা। রং টা আমাদের বাড়ির মতো নয়" ব্যস! ঝাড় খেলাম সক্কলে ছেলের কাছে।
আচ্ছা মা গায়ের "কমপ্লেকশান"টা কি  মেয়েটার দোষ? গায়ের ওপরে কি কোনো ট্যাগ লাগানো থাকে? "ফর্সা", "কালো" এইসব? তোমরা কতবড়ো হিপোক্রিট বলো! মাকালীর পুজো করো আবার কালো বৌ বাড়িতে এলে ক্রিটিসাইজ করো! 
….
অবশেষে ভরে গেল তার স্ট্রলি ব্যাগ। মামা-মামীর আদরে উপচে পড়া সেই হাসিটা ডোরবেল শুনে দৌড়ে গিয়ে রিসিভ করতেই থাকল সুদূর ব্যাঙ্গালোর থেকে পাঠানো  একের পর এক গিফ্ট...পারকার পেন, টাই, লেদার ওয়ালেট, ফার্ষ্টট্র্যাক ঘড়ি ....মায়ের চুপিচুপি ওয়েষ্টসাইডে গিয়ে  কিনে আনা পুজোর জামা, টিশার্ট- ব্লু জিন্স, মোজা, রুমাল, ভেস্ট, ড্রয়ার, ট্র্যাকস্যুটস, মেডিসিন, আর বাবার  ওয়ালেটে পড়ে থাকা কিছু খুচরো ডলার নোটস। ঠাকুমা, দাদু-দিদারা আলমারী ঘেঁটে আরো কয়েকটা ছোট নোট।
…..
মামাদাদুর ওভারকোর্টটাই নেব আমি। ড্রাই ক্লিন করিয়ে দাও। ওটা উইসকনসিন থেকে এবার ফিলি যাবে আমার সাথে।  তনুমা লাস্ট-ইয়ার  পুজোতে যে ব্লু শার্টটা দিয়েছিল? আর সেই ফুলস্লিভ রেড গেঞ্জীটা? দিয়েছো তো মা? 
….
ঠাম্মা, আজ বাজারে তপসে মাছ পেলে নাকি?  মৌরলাটা পেলেও এনো প্লিজ!
দিদা, তোমার সব লুচিগুলো গোল হয় কি করে? 
দাদাই,  তুমি তো কানে শুনতে পাবেনা, বরং আবার বলো সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের গল্পগুলো। 
কাজের মেয়ে বলে, ও বৌদি, খুব ভালো করে উজালা দিয়ে দিলাম গেঞ্জীগুলোতে....ওখানে বেচারার কি হবে কে জানে?
রান্নার মাসী বললে, ও দিদি? ওকে সহজে চিকেন স্ট্যু-টা শিখিয়ে দি চলো।
বাবু, কিচেনে ঢোকার আগে হাতটা ওয়াশ করে নিস। কুকিং রেঞ্জে হাত দেবার আগে গ্লাভস পরে নিস।  কি যে করবি তুই একা একা!  বাবু, ওখানে একটা মিক্সার-গ্রাইন্ডার কিনে নিস কিন্তু। মাসী নেই যে শিলে তোর মাংসের মশলা বেটে দেবে। 
দ্যাখ, এমনি করে স্ক্রেপার নিয়ে আলু ছাড়িয়ে, চপিং বোর্ডে রেখে তারপর ছুরি দিয়ে.....ব্যাস, ব্যাস! আর বলতে হবেনা মা, তোমার রান্নার ব‌ইটাতে এসব আছে তো ?
আমি বললাম, ধুস্! সেখানে তো শুধুই রেসিপি! এগুলো আস্তে আস্তে শিখে যাবি দেখিস!দেখিস বাবা হাতটা কেটে ফেলিসনি যেন! তুই যা ধড়পড়ে!  
আর তোমার সেই প্রেসারকুকারে ফেমাস চিকেন বিরিয়ানির রেসিপি? ওটাতো লাইফসেভার, মামু বলেছিল ফার্গোতে পৌঁছেই। 

সত্যি খুব ইজিরে ওটা। সকালবেলা কলেজ যাবার আগে চিকেনটা মশলাপাতি দিয়ে ম্যারিনেট করে, ইয়োগার্টে ভিজিয়ে ফ্রিজে রেখে দিবি।  সন্ধ্যেবেলা ঘরে এসেই প্রেসারকুকারে রিফাইন্ড তেলে গরমমশলা, আলু, পেঁয়াজটা বাসমতী চালের সাথে ভেজে নিয়ে চিকেনটা দিয়েই একটা সিটি ব্যাস! আর্সেনালের ম্যাচ আর আর্সেলানের বিরিয়ানি জমে দৈ এক্কেরে! ও হ্যাঁ, জলটা দিবি ডাবল অফ রাইসের একটু কম।
মা আমার দ্বারা এত্তসব হবেনা। ঠিক হবে দেখিস! একদিন বানিয়ে দু দিন খাবি। আর খিচুড়ি, ফ্যানেভাতে, ডাল সেদ্ধ, ওমলেট, আলুভাজা তো এতবার শেখালাম।