৩০ মার্চ, ২০২৩

শান্তা

হে পিতা দশরথ! 

আজ আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রামচন্দ্রের জন্মদিনে এই চিঠি। জানো পিতা? রামের দিদি শান্তা আজো  বিস্মৃত । রামায়ণ পাঠকের প্রিয় কথাকার বাল্মিকী  আমার কথা খুব সামান্য লিখেছেন । রাজশেখর বসুর রামায়ণে শান্তা অনুপস্থিত । অথচ শান্তা তার প্রিয় ভাই রামের দিদি। রামায়ণ পাঠকদের প্রিয় কবি কৃত্তিবাস সাফাই গাইলেন। নাকি লোমপাদ আর তাঁর স্ত্রী বর্ষিণী মানে আমার মা কৌশল্যার বোন নাকি আমাকে দত্তক নিয়েছিলেন। কিন্তু কেন পিতা? আমি কন্যা বলে? 

দেখো পিতা দশরথ, আমি তোমার ঔরসজাতা । কৌশল্যা আমার মাতা। কিন্তু তুমি  আর আমাকে মনে রাখলে কই? আমিই তো সেই ইক্ষাকু রাজপরিবারের প্রথম সন্তান, রাজতনয়া শান্তা। আমি যে মেয়ে তাই আমাকে বিলিয়ে দেওয়া যায়। কী বল? কারণ তোমার বংশের ধারক হবে তোমার পুত্র। কী ঠিক বলছি তো  আমি? আমার জন্মের পরে তাই অযোধ্যায় কোনো সাজো সাজো রব নেই। নেই কোনো আনন্দোৎসব, শঙ্খধ্বনি। সিংহাসনের দাবীদার তো মেয়ে হতে পারেনা। এমনি চলে আসছে। তাই আমি আসায় সন্তুষ্ট হলে না তুমি। তবুও আমি ভূমিষ্ঠ হলাম। রাজা-রাণীর মধুর দাম্পত্যের প্রথম প্রেমের ফসল এক সামান্য মেয়ের মূল্যায়ণ হলনা রাজবাড়িতে, নিজের পরিবারে। আমার পরিচয়, জন্মসূত্র যেন কিছুটা গোপন রইল। পায়েসের বাটি, চূড়াকরণ, অন্নপ্রাশন, আদিখ্যেতা সব শিকেয় তোলা রইল তোমাদের আগামী  উত্তরাধিকারের জন্য। তবুও জন্মপরিচয়ে দশরথ আমার বাবা, কৌশল্যা আমার মা।   

অথচ আমি হলাম গিয়ে বুদ্ধিমতী, বিদুষী, সুন্দরী শান্তা। ব্রাত্য, উপেক্ষিতা  রাজ পরিবারে। কারণ তোমার চাই পুত্র সন্তান। সিংহাসন রক্ষা করবে সে পুত্র। রাজ পরিবারে মন্ত্রী সান্ত্রী, দাস দাসী সবাই বুঝেছিল এই শান্তাকে। কতটা সর্বগুণসম্পন্না হতে পারে এই মেয়ে জানতেন তাঁরা। কিন্তু আমি যতই বিকশিত হতে থাকলাম ততই যেন অবসাদগ্রস্ত হতে থাকলে তুমি। মা কৌশল্যার কিছুটা স্নেহ পেলেও তুমি মুখ ঘুরিয়ে রেখেছিলে আমার থেকে। মা এবং মায়ের বাকী তিন সপত্নী কেউই ছেলে দিতে পারছে না তোমায়। সেই চিন্তায় তোমার রাতের ঘুম গেল। তারপর? সবাই জানে সে ঘটনা। কোথা থেকে যেন খবর পেলে তুমি।

পিতা, সেদিন আমি ভগ্ন হৃদয়। মুখ ফুটে কিছু বলতে পারিনি। তোমার পরম বন্ধু লোমপাদের কাছে দান করে  দিয়েছিলে আমায়। সবার মুখে সেদিন কুলুপ। 

 বোধহয় লোমপাদই জানালেন তোমায়। ছেলে হবার কৌশল। ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির খবর । তিনি করবেন পুত্রেষ্টি যজ্ঞ। তা করলে আমার চার মায়েদের নাকি কোল আলো করে পুত্র সন্তান আসবে। কিন্তু তারপর? সেই মুনির নাকি যজ্ঞের আগে প্রয়োজন নারী সঙ্গের। সেখানে আমাকে দিব্য কাজে লাগালে তুমি আর আমার পালক পিতা লোমপাদ । বালিকা বয়সেই মুনির সঙ্গে বিয়ে দিলে তোমরা । মুনির সঙ্গে আমার সহবাস হল। তৃপ্ত হলেন মুনি। তোমার কন্যা শান্তার স্বামী ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিই সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে সপরিবারে শান্তাকে সঙ্গে নিয়ে অযোধ্যায় এসে প্রথমে অশ্বমেধ যজ্ঞ, তার পরে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করেন। যে যজ্ঞের প্রসাদ খেয়ে শান্তার ভাইদের জন্ম হল শান্তার পয়েই। 

 একটা নয়, চার চারটে ছেলে পেলে তুমি। রাজপ্রাসাদের জীবন চিরকালের মত ছেড়ে শান্তার শুরু হল আশ্রমিক জীবন। আমি হলাম গিয়ে মুনিপত্নী। আর পুত্রলাভের আনন্দে তখন বানভাসি অযোধ্যা। আমাকে কেউ আর মনে রাখেনি। রাজ পরিবারের চাহিদা মেটাতে আমি এসেছিলাম আবার হারিয়েও গেলাম অনাদরে, অবহেলায়। 

হ্যাঁ, পিতা, আমি তো দন্ডকারণ্যে ওদের বনবাসে গিয়ে তোমার পুত্র এবং পুত্রবধুর খোঁজখবর নিতে দেখা করে এসেছিলাম। আমার সুলক্ষ্মণা, সাধ্বী, সুন্দরী ভ্রাতৃবধূ সীতার সঙ্গে সভ্য ননদিনী সুলভ আচরণও  করে এসেছিলাম।আমিই তো ওদের অনসূয়া আর অত্রিমুনির আশ্রমে নিয়ে গেছিলাম।  

আজ খুব মনে পড়ছে ভাইকে। ভায়ের জন্মদিনের সেই শ্লোক? বারাণসীর দশাশ্বমেধ ঘাটে বসে সেই যে রামায়ণী পাঠকদের তুলসীদাস লিখলেন? ভাইয়ের গুণগান করে। অথচ দেখ তিনিও আমায় ভুলে গেলেন। 

"নৌমী তিথি মধুমাস পুনীতা 

সুকল পচ্ছ অভিজিত হরিপ্রীতা 

মধ্য দিবস অতি সীত ন ঘামা 

পাবন কাল লোকবিস্রামা।।" 

চৈত্র মাস মধুমাস। তার শুক্লা নবমী তিথি। ঈশ্বরের প্রিয় অভিজিত মুহূর্তে দুপুরবেলায় নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায়,  মানুষের   আনন্দদায়ক এক পবিত্র সময়ে জন্মেছিল আমার ভাই, রামচন্দ্র। 

কোশল দেশের শোভা, তোমাদের পুত্র রামচন্দ্র। কী অপূর্ব রূপবান সে! সর্বাঙ্গে সুলক্ষণ চিহ্নিত। পেটে ত্রিবলী রেখা, গভীর নাভি, প্রশস্ত স্কন্ধ, উন্তত ললাট, আজানুলম্বিত দুই বাহু, শাঁখের মত গ্রীবা, নীল পদ্মের মত চোখ, কুঞ্চিত কেশরাজি আর? কত কত বলব আর ?  চাঁদের কিরণের মত ভায়ের দন্তরুচিকৌমুদী ছড়িয়ে পড়ে চারিদকে। ভায়ের নখ, আঙুল, চিবুক, পক্ক বিম্বের ন্যায় ওষ্ঠ দেখে রাজ জ্যোতিষী বলেছেন বীরের সমস্ত লক্ষণ ভায়ের দেহে।

মিটেছে তো পিতা ? তোমার মনে সেই পুত্রের হাহাকার চিরকালের মত মিটেছে আশাকরি। বশিষ্ঠদেব  ঠিকই আদেশ দিয়েছিলেন কী বল? পুত্রেষ্টি যজ্ঞ না করলে কী আর তোমার জ্যেষ্ঠ পুত্র রামচন্দ্রের জন্ম হত?  


ইতি 

তোমার পয়মন্তী  শান্তা    


২৬ মার্চ, ২০২৩

গঙ্গোপাধ্যায়দের কিংবদন্তীর হেঁশেলে / ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

 

ছবি সূত্রঃ ইরাবতী ডট কম 

গঙ্গোপাধ্যায়দের কিংবদন্তীর হেঁশেলে

ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

বাজার সফর’ বইতে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় সেই কবে যেন লিখেছিলেন, ‘ঘুম থেকে উঠে অনেকে ঈশ্বরের কথা ভাবেন, কেউ বা তক্ষুণি করার মতো কাজ, আগের থেকে ঠিক করে রাখেন৷ আমি তো ভাবি আজ কী খাব? তার মানে আজ কী বাজার করব? কেমনভাবে করব? এই মন দিয়ে বাজারে গেলে দাউ দাউ আগুন বাজারকেও মনে হবে শীতলা এবং রহস্যময়৷’

এমন রসরচনায় নাল ঝরে আজও আমার। ঠিক যেভাবে লিখেছিলেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, তার মধ্যে দিয়ে বাঙালির বাসনার সেরা বাসাটা এখনও আমাদের অন্তরে, যাপনে আর জিভের ডগায় সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। আমি বলে না। সব বাঙালীরই এই রসনা সংস্কৃতি বুঝি উথলে ওঠে সেই আদিম কাল থেকেই। আসলে রোজ ভোরে উঠে আমাদের সবার এই রকম একটা মন তৈরি করার দরকার।

তাঁর লেখাতেই রয়েছে...

"ভাত ডাল, ভাজা এবং কাটা পোনা এই চেনা ছকের খাবার থেকে বাঙালি কবে বেরোবে?’ আমি নিজে অবশ্য এই ছকের বাইরের নানান খাওয়া খেতে বরাবরই পছন্দ করি৷ হয়ত একটা পদই খেলাম, মানে ধরুন কেবল মাত্র বাটি চচ্চরিই খেলাম, তার পরের দিন হয়তো আমি খেলাম লাল শাক এবং বড়ি, আবার তার পরের দিন হয়ত আমি খেলাম আড় মাছের কালিয়া, তার পরের দিন হয়তো খেলাম লইট্যা মাছের ঝুড়ো, আর তারও পরের দিন খেলাম ধোকার ডালনা যেটা আবার ছোলা সেদ্ধতে পরিকীর্ণ৷ এই রকমভাবে আমার মনে হয় যে যদি একটা নিশ্চিদ্র এবং নিখুঁত পরিকল্পনা করা যায় যে অমুক দিন এক পদই খাব এবং এই দিয়ে খাব তাহলে সেই এক পদী আহারই হয়ে উঠবে প্রায় যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের সমান৷"


সাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভোজন রসিকতা সাহিত্যমহলে সর্বজনবিদিত। আদ্যোপান্ত ফুডি এই সাহিত্যিকের হেঁশেল ঘরের সেই পরম্পরা আজো বহন করে চলেছেন তাঁর সুযোগ্যা কনিষ্ঠা কন্যা ডক্টর ললিতা চট্টোপাধ্যায়। ডাক্তারির ব্যাস্ত কর্মজীবন সামলিয়ে তিনিও তাঁদের গঙ্গোপাধ্যায় পরিবারের ঘরানায় মাংস রাঁধেন এখনো। ললিতার রান্নাবান্নার শখ তাঁর মা ইতি গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। বড় মেয়ে মল্লিকা অত রাঁধিয়ে নন তবে ইতিদির বেশির ভাগ জবাবের খুঁটিনাটিগুলো মলিদিই দিলেন। এবং তার থেকে প্রমাণিত হল তিনিও বেশ রান্নাবান্না জানেন এখনো। আর আড্ডা দিতে গিয়ে মনে হল পুরো গঙ্গোপাধ্যায় পরিবার একসময় তাঁদের এই কিংবদন্তীর হেঁশেল টিকে পরিপূর্ণতায় ভরিয়ে রাখতেন পঞ্চব্যঞ্জনের সুঘ্রাণে।

এই রান্নাবাটি নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে চুলোচুলি হত খাদ্যরসিক শ্যামলবাবুর। হঠাত অসময়ে, নিদারুণ গরমে পাঁচ, 'রকম মাছ এনে হাজির করে উনি বলতেন সেগুলি এখুনি রান্না করে দিতে। আর অচেনা, অজানা সব মাছ কি দিয়ে, কেমন করে রাঁধতে হবে তা ও তিনি জেনে আসতেন বাজারের লোকজনের কাছ থেকে। ইতি দি বিরক্ত হয়ে বাপের বাড়ি যাবার ধান্দা করতেন। বলতেন, বরং কাল কাজের লোকেরা এসে কেটেকুটে, ধুয়ে বেছে দিক। আমি রান্না করে দেব। কিন্তু শ্যামলবাবুর যে সেদিনই খেতে হবে সেই টাটকা মাছ।

সেই মতস্যসূত্র ধরেই আবার দু'জনের ভাব‌ও হয়ে যেত কিছু পরেই। রান্নার সুঘ্রাণে ভরে উঠত তাদের হেঁশেল। আড়ি আড়ি ভাব ভাব। আর সেটা খাওয়াদাওয়া নিয়েই। তারমানেই বুঝে দেখুন কেমন খাদ্যচর্চার রমরমা ছিল তাঁদের হেঁশেলে। আর জন্মসূত্রে যিনি বাংলাদেশের খুলনার আর কর্মসূত্রে বরিশালের বানোরী পাড়ার তাঁর তো এমন হতেই পারে।


মলি দি বললেন, বাবাদের পূর্ববঙ্গের রান্নায় একফোঁটা মিষ্টি পড়ত না। আর মা নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের মেয়ে। মা রান্নায় একটু করে চিনি দিতেন। ব্যাস! বাবার সেটাই মনে ধরে গেল। মায়ের হাতের রান্না খেতে বাবা সবচেয়ে পছন্দ করতেন। বাবার সব রান্নায় চাই নুন-মিষ্টির পারফেক্ট ব্যালেন্স।

হোটেলের রান্না বাড়িতে এনে বাবা মা'কে বলতেন, খেয়ে বল, কি করে রেঁধেছে এরা? মশলাপাতি কী দিয়েছে?আমাকে ঠিক এমনি করে বানিয়ে দাও।

বললাম, ইতি দির হাতের কোন্‌ পদটি এ বাড়ির অথেন্টিক ডেলিকেসির পর্যায়ে পড়ে? মলি দি লালায়িত হয়ে বললেন, কচ্ছপের মাংস। মা যে কী ভাল রাঁধতেন! গোল গোল আলু, মূলো, কচ্ছপের ডিম আর মাংস একসঙ্গে প্রেসার কুকারে দিয়ে কষতেন মা। আর রাঁধতে রাঁধতে আমাদের চাখা আর সেই মাংস টেবিলে সার্ভড হবার আগেই ফুরিয়ে যেত। আরেকটা নিরামিষ রান্না বাবার বড্ড প্রিয় ছিল কচি লাউশাকের ডগা দিয়ে সাদা ঝোল। বললাম সেটা কেমন?

তেলের মধ্যে পাঁচফোড়ন আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে আলু একটু ভেজে নিতে হয়। তারপর লাউডগা দিয়ে নুন দিয়ে সেদ্ধ হয়ে এলে দুধ, ময়দা আর পোস্তবাটা দিয়ে নামাতে হয়। আর সামান্য চিনি। আর বাবা খেতেন গন্ধরাজ লেবু দিয়ে মূসুর ডাল। স্যুপের মত চুমুক দিতেন ডালে। মা রান্না করতে ভালবাসতেন আর বাবা তাড় কদরও করতেন। আর তাই বুঝি রান্নাটা মায়ের নেশা হয়ে উঠেছিল। বাবাদের মামাবাড়ি ছিল ঢাকার বিক্রমপুরে। সেখানে রান্নায় মিক্সড কালচার। ওদের হিট রেসিপি হল শোল-মূলো। ওরা ব্রেকফাস্টেও মাংসভাত খেতেন শুনেছি।

এছাড়াও মায়ের হাতে পিঠেপুলি, পাটিসাপটা, রাঙ্গা আলুর পান্তুয়া, রসপুলি দারুণ লাগত আমাদের। মা ছাঁচে ফেলে অপূর্ব ক্ষীরের সন্দেশ করতেন।

বললাম আর আপনাদের বাড়ির রোজকার রান্না ? মানে শ্যামলবাবু যখন সাহিত্যজগতে বেশ উদীয়মান, আনন্দবাজার পত্রিকার দফতর যাঁর কর্মজগত অথবা যুগান্তর-অমৃতবাজারে যখন চাকুরীরত সেই সময়টায়?

ইতি দি জানালেন, ওল-চিংড়ি কিম্বা মোচা-চিংড়ি, কাঁচা ইলিশের ভাপা, মৌরলা, কাচকি কিম্বা আমুদি মাছের চচ্চড়ি, তেল কৈ, কচুর লতি, কচুর শাক, কালোজিরে কাঁচালঙ্কা আর বেগুন দিয়ে ইলিশের পাতলা ঝোল কিম্বা মাছের মাথা দিয়ে ডাল যেমন হয় সব বাড়িতে। বললাম ইলিশের ভাপার রেসিপিতে বিশেষ কিছু দিতেন ? বললেন, নাহ্! কাঁচা মাছ নুন, সর্ষে কাঁচালঙ্কা বাটা দিয়ে ম্যারিনেট করে সামান্য নারকোল বাটা দিতাম। এবার সর্ষের তেল আর চেরা কাঁচালঙ্কা ছড়িয়ে বন্ধ কৌটোয় পুরে মিনিট পাঁচেক। ব্যাস!

আর মেয়েদের হাতের রান্না ? মলিদি বললেন, এ ব্যাপারে মা'কেই বাবা হায়েষ্ট নম্বর দিতেন। আর আমরা দুই বোনে রাঁধলে খুঁতগুলো ধরিয়ে দিতেন পরিষ্কার ভাবে। কোনো রাখঢাক নেই সে ব্যাপারে। বাবা মাটন পছন্দ করতেন একটু শক্ত, তবে ছিবড়ে না। প্রেসারে গলিয়ে ফেললে চলবেনা। মাটন কারিতে মা সামান্য আদা, পিঁয়াজ, জিরে, গোলমরিচ বাটা দিতেন। মাংস রিচ হবে না গুচ্ছের পিঁয়াজ, আদা, রসুন পড়বে না।

বললাম ইতি দির হাতের মাটন কারির স্ট্যু এর খুব সুনাম শুনেছি। স্পেশ্যাল টিপস আছে কিছু? বৃদ্ধা বেশ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে স্মৃতির সরণি বেয়ে চললেন খানিক।

ধর ৫০০ গ্রাম খাসির মাংস সেদ্ধ করে, গোল গোল আলু কেটে সামান্য আদাবাটা আর চার টুকরো করা দুটো কাঁচা পিঁয়াজ দিয়ে ফুটবে। এবার সেই উপাদেয় স্ট্যু উনি রোজ রাতে খাবেন কড়া করে টোষ্ট করা পাউরুটির সঙ্গে।

আর রোজকার রুই বা কাতলার ঝোলের রেসিপি? বললেন, সব বাড়িতে যেমন হয়। জিরে ফোড়ন, আদা-জিরে বাটা দিয়ে, তেমনি। অর্থাৎ বাড়ির রান্নাই তবে বেশি ভালবাসতেন তিনি।

মলি দি বললেন, সে তো বটেই। আমাদের ছোটবেলায় বাইরের খাবারের চল কম ছিল। তবে আমরা সপরিবারে জিলিপি-সিঙ্গাড়ার পাশাপাশি চাইনিজ খেতাম চাঙোয়ায় বা ওয়ালড্রফে গিয়ে। বাবা তখন আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরী করতেন। ১৯৭২ সালে কলকাতায় পাকাপাকি ভাবে আসার আগে আমরা থাকতাম ক্যানিং লাইনের চম্পাহাটিতে। পত্রিকার অফিসের উল্টোদিকে তৃপ্তি বলে একটা অসামান্য রেস্তোঁরা ছিল। বাবা ফেরার পথে আমরা দুই বোন আর মা সকলে মিলে খেতে যেতাম সেখানে। গিয়ে দেখতাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় কে। জমিয়ে আড্ডা হত খাওয়াদাওয়ার সঙ্গে। তারপর খেয়েদেয়ে আমরা শেষট্রেনে বাড়ি ফিরতাম চম্পাহাটির বাড়িতে ।

দুই মেয়েই জানালেন আরেকটি রান্নার কথা। চিতলমাছের গাদায় খুব কাঁটা তাই গাদা ঘষে নিয়ে আলুসেদ্ধ দিয়ে মেখে ধোঁকার মত কেটে পিস করে। ওরা বলেন মুঠিয়া। তাঁদের বাবার পছন্দের ডিশ । এছাড়া শুক্তো, আলু-উচ্ছে-কুমড়ো ভাজা ছিল খুব প্রিয় পদ। থোড় দিয়ে চিংড়ি করতেন মা। বললাম শিগগির রেসিপি দিন।

মলি দি বললেন, থোড় কেটে সেদ্ধ করে নিতে হবে। এবার তেলে পাঁচফোড়ন আর লঙ্কা দিয়ে চিংড়িমাছ দিয়ে নাড়াচাড়া করে থোড় সেদ্ধ দিয়ে সামান্য মিষ্টি আর নামানোর সময় নারকোল কোরা ছড়িয়ে দিতে হবে। আর আমাদের বাড়িতে শুক্তোয় আমরা দুধ, আদা আর পোস্তবাটা দি।

আপনারা দুই বোন বাবা কে রান্না করে কী খাইয়েছেন?

মলি দি বললেন, আমি কোনোদিন কোনো ডিফিকাল্ট রেসিপিতে অভ্যস্ত ন‌ই। সে ব্যাপারে আমার বোন পারদর্শী। আমি খাওয়ালে স্রেফ মাংস-ভাত।

এই খাওয়াদাওয়া নিয়ে আপনাদের হেঁশেলের কোনো স্মরণীয় ঘটনা?

তাহলে তো বলতে হয় সরস্বতী আর লক্ষ্মীপুজোর কথা। বছরে এই দুটোদিন হৈ হৈ করে কব্জ্জী ডুবিয়ে সবাই খিচুড়ি ভোগ, পায়েস খেত। মায়েরা সব জায়ে জায়ে মিলে একসঙ্গে রান্না করতেন। লক্ষ্মীপুজোর ভোগে পরিবারের রীতি অনুযায়ী বাড়ির লোকেদের জন্য মোচা দিয়ে চিংড়ি , লালশাক ভাজা আর মুগের ডাল হত। সরস্বতীপুজোয় হত জোড়া ইলিশ। আর ওদিকে বাবা আর কাকাদের জন্য হত স্পেশ্যাল মাংস, ভাত। পুজো শুরু হয়েছে। বাবারা উশখুশ করতেন কখন পুজো শেষে ওরা মাংস ভাত খাবেন। এমন শুনেছেন কোনোদিন? মলি দির ট্রু কনফেশন।

আচ্ছা আদ্যোপান্ত খাদ্যরসিক এই মানুষটি নিজে রেঁধেছেন কোনোদিন?

যদ্দূর মনে পড়ে একবার মোটে মাছের ঝোল রেঁধেছিলেন। ইতি দি স্মৃতি হাতড়ে বের করে আনলেন। সেই প্রথম আর সেই শেষ।


ওনার বিদুষী কন্যা ললিতা এখনো রন্ধনে দ্রৌপদী, পেশায় ডাক্তার। ফোন করতেই বললেন, বাবার জন্য স্পেশ্যাল লালমংস হত বাড়িতে। খুব স্বাস্থ্যকর নয়। তবে একটু তেল গড়ানো মাংসের ঝোল মাঝেমধ্যে খাওয়া যেতেই পারে। সেটা কী করে বানাতেন বলায় উচ্ছ্বসিত হয়ে ললিতা বললেন, ১ কেজি খাসির মাংসে মোটে তিনটে মাঝারি সাইজের পিঁয়াজ কুচো, এক চামচ রসুন বাটা, একচামচ আদাবাটা আর একটু বেশি সরষের তেল লাগবে। এই হল কেমিষ্ট্রি। প্রেসার কুকারে তেল দিয়ে পিঁয়াজ, তেজপাতার সঙ্গেই দিতে হবে সামান্য পরিমানে অল্প জলে ভিজিয়ে রাখা গোলমরিচ-জিরে-ধনে-বাড়ির তৈরি গরমমশলা গুঁড়ো। বাদামী হয়ে এলে মাংস দিয়ে কষতে হবে আরো কিছুক্ষণ। তারপরেই এবার দু চামচ ফেটানো টক দৈ, আদা-রসুনবাটা দিয়ে কষে জল দিতে হবে সামান্য। ঠিক যতটুকুনি জল প্রয়োজন তার বেশি নয় কিন্তু। ব্যাস্! সেদ্ধ হলেই নামিয়ে রেডি টু সার্ভ।

জানালেন আরেকটি হালিমের সমতুল্য পদের কথা। যেটি হত তাঁদের বাড়িতে। মুসুর ডাল, মাংস, আদা, পিঁয়াজ, রসুন দিয়ে প্রেসারে সেদ্ধ করে গলিয়ে নিতে হবে। তারপর ঘিয়ের মধ্যে শুকনো লঙ্কা আর গরমমশলার ছঁক দিয়ে পরিবেশিত হবে।


বাবা আমার হাতে মাটন কাবাব খুব পছন্দ করতেন। জানালেন ললিতা। রেসিপি জানতে চাইলেই বললেন,

ধর ২৫০ গ্রাম মাংসের কিমা। তার সঙ্গে একমুঠো ছোলার ডাল, পিঁয়াজ কুচি, রসুন, গোটা গোলমরিচ, দারচিনি আর কয়েকটা শুকনোলঙ্কা সামান্য জল দিয়ে সবশুদ্ধ প্রেসারে সেদ্ধ করবে।তারপর পুরো মিশ্রণটি মিক্সিতে কিম্বা শিলে বেটে নিয়ে বীজমুক্ত কাঁচালঙ্কা কুচি, সামান্য আদা কুচি, নুন, সাজিরে গুঁড়ো আর গরমমশলা দিয়ে মেখে নেবে শক্ত করে। তারপর টিকিয়ার মত করে মাটন কাবাব গড়ে ভেতরে একটি করে লঙ্কা কুচি পুরে দিয়ে তাওয়ায় ঘি মাখিয়ে সেঁকতে হবে। রুটির সঙ্গে স্যালাড সহযোগে জমে যায় এই কাবাব।

এবার বললাম শ্যামলবাবুর খাওয়া নিয়ে কোনো মজার ঘটনা?

ললিতা বললেন,

মারা যাবার আগে বাবা দক্ষিণ কলকাতার মুদিয়ালির কাছে একটি স্কুলের সেক্রেটারি হন। আমি হঠাত একদিন স্কুলে গেছি । গিয়ে দেখি একটি ছেলে স্কুলে নতুন চাকরী পাওয়ার খুশিতে এসেছে বাবার সঙ্গে দেখা করতে।

বললাম, তা সঙ্গে ওটা কি? সে জানাল, স্যার কে বললাম, স্যার, আপনাকে চাকরী পাবার খুশিতে কি দেব ভেবে পাচ্ছি না।

স্যার বললেন, বাড়িতে যা রান্না হবে তাই এনো একদিন। তাই আজ ওনার প্রিয় বিউলির ডাল আর পোস্তর বড়া এনেছি ওনাকে খাওয়াব বলে।

২৪ মার্চ, ২০২৩

মুলুক শ্রীপাট / ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

 


প্রাচীন শিব মন্দির 


শ্রীপাট বলতে বোঝায় বৈষ্ণব মহাপুরুষদের জন্মভূমি বা ভজনস্থান বা লীলাক্ষেত্র।গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক ঘটনার তীর্থক্ষেত্র হল এই শ্রীপাট। সারা বাংলার বিভিন্ন জেলা জুড়ে রয়েছে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর স্মৃতি বিজড়িত এমন তীর্থক্ষেত্র। শ্রী চৈতন্য ভাগবত রচয়িতা বৃন্দাবন দাসের শ্রীপাট রয়েছে বর্ধমান জেলার দিনেশ্বর বা দেনুড় গ্রামে। তেমনি রয়েছে এই জেলায়  মহাপ্রভুর পদধূলি ধন্য বৈষ্ণব তীর্থ অম্বিকা কালনা শ্রীপাট। রয়েছে এই জেলার কন্টকনগর বা কাটোয়ার ঘাটকুড়ি শ্রীপাট। যেখানে নীলাচল যাবার পথে মহাপ্রভু কেশব ভারতীর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে সপার্ষদ এই ঘাটকুড়ির ন'পাড়া গ্রামে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। এখন সেটি কেতুগ্রামের  ঘাটকুড়ি বিশ্রামতলা শ্রীপাট নামে পরিচিত। ঠিক তেমনি বীরভূমের অন্যতম বৈষ্ণব তীর্থ ক্ষেত্র হল শ্রীপাট মুলুক।  

এবার আসি মুলুক প্রসঙ্গে।পদকর্তা  বৃন্দাবন দাস তাঁর চৈতন্য ভাগবতে অম্বিকা কালনাকে উল্লেখ করে এভাবে বলেছেন... 

‘এই মতে সপ্তগ্রামে অম্বয়া মুলুকে।/ বিহরেন নিত্যানন্দ পরম কৌতুকে।’ অর্থাৎ মুলুক মানে গ্রাম বা স্থান বোঝায়। 




তমাল গাছ 


সেই মন্দির যেখানে রয়েছে মহাপ্রভুর বিগ্রহ 


বোলপুর থেকে মাত্র  চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে বোলপুর-পালিতপুর রাস্তার ধারেই এই ছোট্ট গ্রাম মুলুক শ্রীপাট।  সবুজ এই গ্রামখানি তমাল গাছের স্নিগ্ধ ছায়ায় গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর পদধূলি ধন্য। সম্ভবত বীরভূমের প্রথম শ্রীপাট। প্রচুর অলৌকিক কাহিনী শোনালেন স্থানীয় মানুষ, অধ্যাপক, গবেষক। রামকানাই ঠাকুরের বংশধর। এই রামকানাই ঠাকুরই মন্দির গড়ে মুলুক গ্রাম টিকে প্রতিষ্ঠা করেন। ভর ভরন্ত তমালগাছ বসন্তের ফুলে, কচি পাতায় টইটুম্বুর। সেগাছে কখনো ফল ধরে না। অর্থাৎ কর্মফলের কথা মাথায় রেখে বুঝি গাছ বিস্তার লাভ করেনি এখানে। আশ্চর্যের কথা হল বেদির নীচে তমালের ডালপালা লুটিয়ে হাওয়ায় দোল খাচ্ছে কিন্তু গরু ছাগল ভুলেও সেই পাতা খেতে আসছে না। তমাল গাছের এমন সুশীতল ছায়া আছে বৃন্দাবনে। তাই বীরভূমের মানুষ এই মুলুক শ্রীপাট কে গুপ্ত বৃন্দাবন বলে আঁকড়ে পড়ে থাকেন। তো এই রামকানাই ঠাকুর এখানে বৈষ্ণব মন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন। মাটি খোঁড়া শুরু হল। মাটির নীচে পাওয়া গেল এক চতুর্ভুজা দেবী মূর্তি। রামকানাই মাথায় করে তাঁকে অপরাজিতা দেবী রূপে প্রতিষ্ঠা করলেন তমাল গাছের পাশেই। অর্থাৎ বৈষ্ণব মন্দিরে ঢোকার আগেই  শক্তির আরাধ্যা কে প্রণাম জানিয়ে প্রবেশ করতে হবে ভক্তি অঙ্গনে। কুলুঙ্গীতে রাখা সেই মূর্তি। দর্শন হল না। তিনি মহা জাগ্রত। ঘেরাটোপের মধ্যে তালা বন্ধ সেই কুলুঙ্গী। যতবার চুরি করে পালিয়েছে কেউ ততবারই এসে আবারো পরিত্যাগ করে সেখানেই ফেলে রেখে গেছে তাঁকে। তিনি যে অপরাজিতা। কেউ জিততে পারবে না তাঁকে। ব্যাবসায়িক কাজেও মন্দির গড়ে নিত্য পুজো পাঠেও ভয় পান বুঝি মানুষ। 

আরো আছে এমন গল্প। তমাল গাছের পাশে বিশাল বৃক্ষের নীচে লেখা থেকে জানলাম তা। সেকালে ভোগ রান্নার হাতা খুন্তি ছিল না। গাছের ডাল দিয়েই উনুনের রান্না ঘেঁটে দেওয়ার চল ছিল। রান্নার পর সেই ডাল পুঁতে দেওয়া হত মাটিতে আর সেই সব ডাল থেকে গাছ বেরিয়ে প্রকান্ড রূপ আজ। ভাতকাঠি বলা হয় এই গাছের ডাল কে। 

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর পরে এই কৃষ্ণাঙ্গন এক অন্য মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে ছিল। বাংলার ধর্ম ও সংস্কৃতির ক্ষেত্র হিসেবেও মুলুকের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। তবে শ্রীপাট মুলুকের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে ‘জলন্দার গড়’-এর কাহিনি। যা আজ জলুন্দি গ্রাম নামে পরিচিত।


বৈষ্ণবদের কৃষ্ণলীলার রস আস্বাদনের কেন্দ্র হিসাবে উন্মোচিত হয়েছিল আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে। জলন্দার গড় বা জলুন্দি ছিল তেমনি স্থান ।চৈতন্যদেবের অন্যতম প্রিয় পার্ষদ ধনঞ্জয় ঠাকুরের বাসভূমি। এই জলুন্দিতেই শ্রীপাট প্রতিষ্ঠা করেন ধনঞ্জয় ঠাকুর। সেটিই জলন্দার গড়ের অনতিদূরেই মুলুক গ্রামের অবস্থান। তবে মুলুকের ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন ধনঞ্জয় পণ্ডিতের কনিষ্ঠ ভ্রাতা তথা শিষ্য সঞ্জয় পণ্ডিতের বংশধর রামকানাই ঠাকুর। রামকানাই ঠাকুরের পিতা যদুচৈতন্য আদিকাল থেকেই ছিলেন পরম বৈষ্ণব। মুলুক গ্রামে শ্রীপাটের প্রতিষ্ঠাতাও রামকানাই। 


লেখাপড়ায় মন নেই বালক রামকানাইয়ের। পিতার কাছে  কেবলি জোটে তিরস্কার । তিরস্কারের ভয়ে গৃহত্যাগ করলেন  এবং বৃন্দাবন যাত্রা করবেন ঠিক করলেন। সন্ধ্যাসমাগমে মুলুক প্রান্তরে এসে উপস্থিত হলেন । পথশ্রমের  ক্লান্তিতে  এক বটগাছের নীচে আশ্রয় নেন তিনি । সেখানে অস্তগামী সূর্যালোকে গরুর পাল ও রাখাল বালকের দল দেখে ও তাদের মুরলীর ধ্বনিতে বিভোর হয়ে যান এবং তাঁর অন্তরের মধ্যে জাগ্রত হয়ে ওঠে বৃন্দাবনের কৃষ্ণলীলার স্মৃতি। উপলব্ধি করেন কৃষ্ণপ্রেমের মাহাত্ম্য এবং তারই ফলশ্রুতিতে শ্রীপাট মুলুক আখ্যাত হয় গুপ্তবৃন্দাবন নামে।

রামকানাই ঠাকুর মুলুকে বসবাস করবেন ঠিক করলেন। তাঁর নিজের বাস্তুবাড়ি তৈরি করার উদ্দেশ্যে মাটির সন্ধান করতে করতে পৌঁছে গেলেন  জঙ্গলের মধ্যে। সেখানে তিনি মাটি খুঁড়তে শুরু করলে বেরিয়ে এল এক দেবীমূর্তি। এই দেবীমূর্তি ছিল চতুর্ভুজা মহিষমর্দিনীর। রামকানাই ঠাকুর সেই দেবী চতুর্ভুজার নাম দেন ‘অপরাজিতা দেবী’ এবং তাকে তিনি নিজ গৃহে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সময় থেকেই শারদ শুক্লপক্ষে সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত দেবীর বিহিত পূজাব্যবস্থা আজও অনুসৃত হয়ে আসছে। এই মহাশক্তির প্রতিষ্ঠার পরেই রামকানাই নিজ নামে এক মহাদেব প্রতিষ্ঠা করলেন । এই মহাদেবই পরে রামেশ্বর রূপে পূজিত হন রামকানাই প্রতিষ্ঠিত দেবী অপরাজিতার এবং রামকানাইদেবের পুজো রাঢ়বঙ্গের বীরভূমিতে বৈষ্ণব ও শক্তিসাধনার বিস্ময়কর সম্মিলনের নিদর্শনরূপে গণ্য হয়ে থাকে।


ইতিহাস বলছে এই মুলুক গ্রামের পূর্ব নাম মল্লিকপুর। পরে সুলতান গিয়াউদ্দিন ইয়ুজের সেনাপতি মুলুক খান তাঁর নিজের নাম অনুসারে মল্লিকপুরের নামকরণ করেন মুলুক। তবে জনশ্রুতি আছে, কোনও এক সময়ে রামকানাই ঠাকুর সুলতান জুম্মা খান কে  ‘মুলুক খাঁ’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং সেই সূত্র ধরেই তাঁর সম্মানে গ্রামটি মুলুক নামে পরিচিত হয়। 

এখানে জনশ্রুতি আছে যে নবাব জুম্মা খাঁ একবার  এসে পড়লেন হঠাত করেই। সঙ্গে তাঁর ৩০০ অনুগামী। তখন অন্নভোগ বিতরণ চলছে। কিন্তু সেই বিশাল অতিথি সমাবেশেও এক গামলা ভাত ফুরোয় নি। সবার কুলিয়ে গেছিল। বিস্মিত নবাব তা দেখে দেবসেবার জন্য প্রায় ৩৬০ বিঘা নিস্কর জমি দিতে চাইলে রামকানাই তা নামমাত্র খাজনায় গ্রহণ করেন। এক স্থানে দাঁড়িয়ে এক মুঠো ভাত তিনি ছড়াতে থাকেন নিজের  এলাকা চিহ্নিত করার জন্য। সেই ভাত যতদূর ছড়িয়ে পড়ে ততদূর অবধি 'ভাতুরার মাঠ' নামে খ্যাত হয়। মুলুক শ্রীপাট থেকে ৩ মেইল পূর্বে এই মাঠ। 

রামকানাই ঠাকুরের মুলুকে আগমন, বসবাস এবং গোষ্ঠযাত্রার স্মৃতি স্মরণে প্রতি বছর গোষ্ঠাষ্টমীতে মুলুককে কেন্দ্র করে রামকানাইদেবের বিশেষ পূজানুষ্ঠান এবং প্রধান মেলা উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এই উৎসবে হরিনাম সংকীর্তন, বাউল, নানা ধরনের মন্ত্রপাঠ হয়ে থাকে। প্রভু রামকানাই নবরূপে সুসজ্জিত হয়ে ওঠেন। অষ্টমী থেকে দ্বাদশী পর্যন্ত মেলার স্থায়িত্ব কাল। সেখানে উৎসব উপলক্ষে নানা ধর্মের, সম্প্রদায়ের মানুষের সমাগম ঘটে। জন্মাষ্টমী ও নন্দোৎসবে মুলুকের রামকানাই মন্দির প্রাঙ্গণে এক বিশেষ ধরনের নারকোল খেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। তা ছাড়াও জ্যৈষ্ঠ মাসে অষ্টপ্রহর হরিনাম সংকীর্তন, ঝুলনযাত্রা, রথযাত্রা ইত্যাদি উৎসবগুলিও বিশেষ সমারোহের সঙ্গে পালিত হয়।

রামকানাই মন্দিরের মধ্যে প্রাচীন দালানরীতি লক্ষ্য করা যায়। ছোট ছোট খিলানে সাজানো বারান্দা এবং গর্ভগৃহের মধ্যে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি ছাড়াও গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর মূর্তি, নবগোপালের কষ্টিপাথরের অসংখ্য শালগ্রাম শিলা এবং গণেশের মূর্তিও রয়েছেয। মুলুকের মন্দির চত্বরের পাশাপাশি অন্যান্য দর্শনীয় স্থানও স্বমহিমায় চিরজ্জ্বল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল অপরাজিতা দেবীর মন্দির, শিবমন্দির সমূহ, ভাতুরার মাঠ প্রভৃতি।

সচ্চিদানন্দন ঠাকুরের সঙ্গে 




২৩ মার্চ, ২০২৩

ইটান্ডা

 






বর্গি এল দেশে, বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেব কিসে? 


এই বর্গি কারা ছিল? তাদের এত ভয় পাওয়ারই বা কী কারণ? 


অষ্টাদশ শতাব্দীর কুখ্যাত এবং দুর্ধর্ষ অশ্বারোহী মারাঠা হানাদার এই বর্গি। ১৭৪১ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত দশ বছর ধরে বাংলার পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলিতে নিয়মিতভাবে লুঠতরাজ চালাত এরা। বীরভূম জেলাও বাদ পড়েনি এদের বীভৎস অত্যাচার থেকে।  

তখন বাংলায় আলিবর্দি খাঁর যুগ। হঠাৎ একদিন বাংলার আকাশে দুর্যোগ ঘনিয়ে এসেছিল। 


আচমকা একদল লুটেরার উৎপাত শুরু হল এ গ্রামেও । রাতের অন্ধকারে একদল লোক টগবগ করে ঘোড়া ছুটিয়ে হানা দিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে, লোকজনকে মেরে-ধরে তাদের সবকিছু কেড়ে নিল। ভাঙচুর করল।  তাদের অত্যাচারে স্বাভাবিক জনজীবন বিপর্যস্ত হল। মানুষজন ভয়ে ঘর থেকে বেরুনো বন্ধ করে দিল।গ্রামবাসীর কাছ থেকে জোরজুলুম করে খাজনা বা কর আদায় করত বলেই সেই ছড়া "বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেব কিসে" র প্রাসঙ্গিকতা।  


এই দুবৃ‌র্ত্তরাই আমাদের পরিচিত ছড়ার সেই বর্গি। বর্গি শব্দটা এসেছে ফারসি ‘বারগিস’ থেকে, যার অর্থ ‘প্রাচীন মারাঠা যোদ্ধা’। জাতে মারাঠি। হাতে তীক্ষ্ণফলার বর্শা। আসল নিবাস ভারতের মহারাষ্ট্র হলেও দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারত জুড়েই ছড়িয়ে তখন তারা। বাংলার সিংহাসনে আলিবর্দি খাঁ আর দিল্লির মসনদে মোগলরা। মারাঠাদের যোদ্ধা হিসেবে বেশ নামডাক তখন। ইতিমধ্যে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে মোগলদের সঙ্গে মারাঠাদের ভয়ংকর যুদ্ধ হয়েছিল। কিছু দলছুট বিপথগামী মারাঠা সেনাই একসময় বাংলা জুড়ে শুরু করে দোর্দণ্ড তাণ্ডব।


তাদের আক্রমণ আর যেন কমেই না। তারা বাংলায় এসে পড়লে আলিবর্দি খাঁ সৈন্যসামন্ত বাড়িয়ে তাদের দেশছাড়া করতে আসেন। কিন্তু বর্গিরা সহজে পিছু হটার পাত্র নয়। একের পর এক তারা নতুন আস্তানা গেড়ে একসময় পালিয়ে যায় দক্ষিণে হুগলিতে। 


ব্যবসাবাণিজ্য তখন লাটে ওঠার জোগাড়, মানুষ না খেতে পেয়ে মরার পথে। বর্গিদের দস্যুবৃত্তি কে ন্যায়দম  খাওয়াতে নবাব হিমশিম। অতঃপর দেনাপাওনার চক্করে একপ্রকার কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করেই কিন্তু বাংলা থেকে ওদের দূর করতে হয়েছিল। প্রায় এক যুগের ত্রাসের অবসান ঘটেছিল তারপর। 


জেলা আমাদেরই বীরভূমি। মহকুমার নাম বলিপুর যার থেকে হয়েছে বোলপুর আর তার অনতিদূরেই প্রত্যন্ত ইটান্ডা গ্রাম। ইটান্ডার করুণ ইতিহাস রয়েছে। প্রায় চারশো বছর আগে বর্গী হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় এই গ্রাম।  গ্রামের বেশীটাই বাজারপাড়ায় মানে বহুকাল আগে একটা বাজার ছিল হয়তবা। এখন আর নেই। আমরা পৌঁছে গেলাম প্রান্তিক থেকে পালিতপুরের রাস্তায়। গুগল ম্যাপই সেখানে ভরসা। স্থানীয় মানুষজন কে জিগেস করলে সদুত্তর মেলে না। অথচ ম্যাপ দেখাচ্ছে পঞ্চরত্ন শিব মন্দির, বিষ্ণু মন্দির, কালী মন্দির। তাই যেনতেনপ্রকারেণ পৌঁছতেই হবে। অতটা পথ এসে তো আর ফিরে যাব না বিফল মনোরথ হয়ে। অকস্মাৎ লাল তাগা পরিহিতা এক বঙ্গললনার আবির্ভাব। তিনি সধবা না বিধবা না হতবান্ধবা তা জানিনা। খুব অনিচ্ছা সত্ত্বেও রুক্ষুসুক্ষু মহিলা  জানালেন, আরেকটু এগিয়ে গেলেই একটা পেরাইমারি ইশকুল পড়বে। তার পাশ দিয়ে গেলেই দেখতে পেতে পারেন। মানে তিনিও বেশ কনফিডেন্ট নন। আশ্চর্য! সেখানকার বাসিন্দা বলেই তো মনে হল তাঁকে। একটু গাইড করতেও আপত্তি? মানে বুঝলাম আপনার ঈশ্বরে তেমন বিশ্বাস নেই। তাই মন্দির টন্দিরের ব্যাপারে আগ্রহ খুব কম। আরে আপনি যে বসতবাড়ি থেকে বেরুলেন তখন তার সদরের মাথায় তো দেখলাম জ্বলজ্বল করছে প্রাচীন রাধাকৃষ্ণের খোদাই করা বিগ্রহ। তার মানে ভগবান হয়ত আপনাকে বিট্রে করেছে তাই আস্থা হারিয়েছেন। এনি ওয়ে। আমি এই ইটান্ডার কথা পড়েছিলাম একটি ভ্রমণ গাইডে। পরশপাথর প্রকাশনার  "পায়ে পায়ে বীরভূম" সিরিজের বইটিতে। তা থেকেই আগ্রহ বাড়ে। তারপর সেই ইশকুল ও তার পাশ দিয়ে, ধানের গোলা, খড়ের গাদা, বড় পুকুর পেরিয়ে সোজা মন্দিরময় সেই ইটান্ডায় হাজির হতেই স্থানীয় এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে নমস্কার জানালেন। তাঁর পূর্বসুরী রাষানন্দ সাধু খাঁর তৈরী একের পর এক মন্দির।  পঞ্চরত্ন  শিব মন্দির, দোতলা শ্রীধর মন্দির, বাংলার চালার আদতে বিশাল কালী মন্দির দেখে আমার অবস্থা সেই গুহার  মধ্যে এলাহি ধনসম্পদ দেখে আলিবাবার যেমন হয়েছিল আর কী ! এত সুন্দর টেরাকোটার কাজ! এত অপূর্ব পরিবেশ! হে ঈশ্বর! পঞ্চরত্ন শিবমন্দিরের পাশেই  সম্প্রতি সংস্কার হয়েছে আরেকটি দক্ষিণ মুখী রেখদেউল। প্রবেশ দ্বারের মাথায় খোদাই করা ইন্সক্রিপশনে লেখা ১২২২ বঙ্গাব্দ  বা ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দ। সেটির প্রতিষ্ঠাতা স্থানীয় পাইন পরিবার। খিলানের ওপর কৃষ্ণলীলা ও খিলানের ওপর সিংহাসনে উপবিষ্ট রাম সীতা জ্বল জ্বল করছে। নতুন সংস্কার করেছে বটে তবে রঙ চঙ মোটেও ভালো মানায় নি এত সুন্দর টেরাকোটা মন্দিরে। কুলুঙ্গীর মধ্যে অসাধারণ সব মূর্তি এখনো পড়ে আছে কিছু। 

পঞ্চরত্ন মন্দিরটি তার তুলনায় বিশাল। তা সারানোর লোক পাওয়া যাচ্ছেনা জানালেন সেই সাধু খাঁ পরিবারের ভদ্রলোক। এটিও দক্ষিণমুখী আর গায়ে টেরাকোটার কাজ দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। গর্ভগৃহে প্রবেশের একটিই দ্বার। নিত্য পুজো হয়। রাষানন্দ সাধু খাঁ প্রতিষ্ঠা করেন ১২৩৫ বঙ্গাব্দে বা ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে। টেরাকোটার নিখুঁত স্থাপত্যে  ষড়ভুজ গৌরাঙ্গ থেকে মনসা, ত্রিপুরাসুন্দরী থেকে  রাম সীতা, কালী, গরুড়ের পিঠে চতুর্ভুজ বিষ্ণুমূর্তি দেখলে হতবাক হতে হয়। দশাবতারের কূর্ম, বামন বা মৎস্য অবতার এখনো নজর কাড়ে। পোড়া মটির এত সূক্ষ্ম শৈলী সে যুগেও? কিছু কিছু নষ্ট হয়েছে তবে এখনো অনেকটাই অক্ষত। মন্দিরের বাইরের চাতালে একটি বিশাল পালকি নজর কেড়ে নিল। পাশে দোতলা শ্রীধর নারায়ণের মন্দিরটিও দারুণ। তবে রক্ষণাবেক্ষণ না করলে কালের স্রোতে মিশে যাওয়াটা অসম্ভব নয়। পায়ে হেঁটে কিছুদূর এগুতেই দেখি সব মন্দির কে টেক্কা দেওয়া জোড়বাংলা কালী মন্দির। মূল মূর্তির বদলে নতুন মূর্তি কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে বিষ্ণুপুরের পোড়ামাটির মন্দিরের গন্ধ পেলাম যেন। মন্দিরের নিলয় অলিন্দে, কুলুঙ্গি, স্তম্ভে আবারো অসামান্য সব টেরাকোটার কাজ। ঘোড়ায়  চড়ে মানুষের শিকার তো ঘোড়সওয়ার, যুদ্ধযাত্রায় রণতরীর সজ্জা অসাধারণ। কৃষ্ণ বলরাম থেকে শুম্ভ নিশুম্ভ দলনী দেবী, সেনাবাহিনীর কুচ কাওয়াজ, বগলামুখী কালী... এমন কত বলব?  এখন অবিশ্যি এ গ্রামে গোলা ভরা ধান রয়েছে বোঝাই। দেখে চোখ জুড়োয়। মানুষ কে অযথা খাজনার চাপে বুলবুলির ঘাড়ে দোষ দিতে হয়না। তবুও দারিদ্র্য আছে। পুকুর আছে। গোরু আছে। ভেড়াও আছে। আবার কাছেই নার্সিং স্কুলও  হয়েছে বিশাল। 






একদা এ গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে যেত অজয় নদ। নৌকো ভাসিয়ে ব্যবসা বাণিজ্যও হত । মশলাপাতির আড়তদার ছিলেন এই সাধু খাঁ পরিবার। তাই বুঝি এত রমরমা ছিল ইটান্ডা গ্রামে। এত মন্দির টন্দির... খিলান ওয়ালা প্রকান্ড দোতলা বাড়ির ছাদে ছিল সেই শ্রীধর মন্দির। পরে যা নামিয়ে আনা হয় একতলায়। সব ঘটনার জলজ্যান্ত সাক্ষী অজয় নদ। দুর্ভাগ্য হল নদের নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় আজ স্থানীয় লোকেরা বলে কেবলি 'অজয়ের খাত' । যার পাশ দিয়ে বাইক হাঁকিয়ে, স্মার্ট ফোন হাতে ঊর্ধ্বশ্বাসে চলে যায় বীরভূমির যুবক। এ গাঁয়ের পথিপার্শ্বে পড়ে থাকে ম্যাগির হলদে প্যাকেট, স্প্রাইটের সবুজ বোতল। মেয়েরা এখনো আদুড় গায়ে পুকুরে নাইতে নামে। 

সাধু খাঁ বাবু জানালেন এই কালীর নাম ছিল এক কালে হাড়কাটা কালী। কারণ এখানে ঘরে ঘরে কারিগরেরা একসময়  হাড় ( সম্ভবত তন্ত্রসাধনা হত কালীমন্দিরে ) দিয়ে নানা রকম গয়নাগাটি ও শিল্পদ্রব্য বানাতেন। 

এ বসন্ত ফুরায়। তার আগেই... ক্রমশই শেষ হয়ে আসছে বীরভূম জেলার সব প্রাচীন দর্শনীয় স্থানগুলি। এখনো বাকী আছে অবিশ্যি কয়েকটা প্রাচীন শিব মন্দির দেখা ও তা নিয়ে লেখা। 

১৩ মার্চ, ২০২৩

লালটুপি রহস্য / ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

 লালটুপি রহস্য 

ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় 


অনুপম আজ এসেছেন  অনেকদিনের পুরণো কলেজ বন্ধু সুপ্রিয়র বাড়ি । অনুপম এখন বিদেশে বাস করেন ছেলের কাছে । কোলকাতায় মাঝেমধ্যে এসে পুরণো ফ্ল্যাট বাড়ি, ব্যাঙ্ক-পোষ্ট অফিস, গ্যাসের কানেকসান, কর্পোরেশন ট্যাক্স, সিকিওরিটিকে ইলেকট্রিক বিল বাবদ এডভান্স টাকা, ফ্ল্যাট-মেন্টেনেন্স মিটিয়ে কিছুদিন আত্মীয় বন্ধুদের সাথে দেখা সাক্ষাত করে আবার ফিরে যান ছেলের কাছে ।  স্ত্রী চম্পা  অনেকদিন আগেই গত হয়েছেন ।  ছেলের বৌটিও বেশ ভালো । বিদেশের জলহাওয়ায় হাঁপানি রোগটাও ভালো থাকে তাঁর তাই বেশিটাই ছেলের কাছে থাকেন । ঝকঝকে শহর সিঙ্গাপুরে বাস ওনার একমাত্র পুত্র অভীকের ।  

ফেসবুকের মাধ্যমে দুই প্রৌঢ় একে অপরকে খুঁজে পেয়ে যারপরনেই আপ্লুত । সত্তরের দশকে ওরা পড়তেন  এক নামী  ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে । তারপর যা হয় কেরিয়ার আর চাকরীর সুবাদে একজন বিদেশে আরেকজন কলকাতার বাইরে । অতঃপর চেনাবন্ধুদের ভীড়ে ফেসবুকে অনুপমের কাছ থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েষ্ট এল সুপ্রিয়র কাছ থেকে । তারপর মোবাইল, এসেমেস, ফেসবুকের মেসেজ পর্বের পর এদ্দিনে সশরীরে চাক্ষুষ ভেট দুজনের ।

প্রথম যেদিন ফেসবুকে সুপ্রিয়র প্রোফাইল ছবি দেখলেন অনুপম তাঁর সে কি নির্ভেজাল হাসি চোখেমুখে!  সেই থেকে প্ল্যান করছিলেন এবার কোলকাতায় গেলেই সুপ্রিয়র সাথে দেখা করে আসবেন । কত দিনের বন্ধু ওঁরা ! কত হাসিকান্নার দোলদোলানো শীত বসন্ত একসাথে পেরিয়েছেন তাঁরা ! কতদিন জমিয়ে আড্ডা দেওয়া হয়নি কলেজের বন্ধুদের সাথে !  


সুপ্রিয় চাকরীবাকরীর পাট চুকিয়ে কনসালটেন্সি করেন । বৌ চন্দ্রাবলী লেখালেখি করেন বহুদিন ধরে । ওদের একমাত্র ছেলে রণজয় আর তার বৌ সাগরী দুজনেই  ডাক্তার । বাড়ির নীচেই রণজয়ের চেম্বার আর সাগরী এমএস করছে শিশুমঙ্গলে । ফুটফুটে একরত্তি নাতি ঝুমঝুমকে নিয়েই সুপ্রিয়-চন্দ্রাবলীর দিনকাবার হয়ে যায় । 


অনুপম সুপ্রিয়র বাড়িতে ঢোকার মুখেই যে ফুটফুটে শিশুটির হাত ধরে কাজের মেয়ে লতা চিনিয়ে দিয়েছিল সুপ্রিয়দের ফ্ল্যাট তার সাথে কিছু পরেই সন্ধ্যে হতে না হতেই দেখা হল সুপ্রিয়র ড্র‌ইংরুমে । টুকটুকে লাল, পেল্লায় মাঙ্কিটুপি পরে  ঝুমঝুম ; হাতে একটি হট-হুইলসের গাড়ি নিয়ে বছর চারেকের শিশুটি অনুপমের দিকে এগিয়ে এল । বিকেলবেলায়  বাইরে  বেড়িয়ে ফিরলে শিশুদের মনমেজাজ খুব ফুরফুরে থাকে । 

- কি দাদুভাই ? তোমার চেয়ে তো তোমার টুপিটা একটু বেশিই বড় মনে হচ্ছে !  অনুপম বললেন  আর পকেট থেকে একটি  হেজেলনাট চকোলেট বাক্স আর  নাটিবার বের করে তার হাতে দিলেন । 

-আর বলবেন না, ঐ টুপি ছাড়া সে রাস্তায় বেরোবে না । ঐ টুপি কাচা চলবেনা । ওটি ওর বড্ড প্রিয় , বলতে বলতে বিলিতী পেয়ালায় সুগন্ধী কফি আর  এক প্লেট কুড়কুড়ে আর সাথে কিছু রোস্টেড আমন্ড বাদাম নিয়ে চন্দ্রাবলী ঢুকলেন বসার ঘরে । 

- না, না ঝুমঝুম এবার টুপিটা খুলে ফেলতো বাবু । ঘরে বড্ড গরম যে,  সুপ্রিয় বললেন ।  

ঝুমঝুমকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে গিয়ে হঠাত অনুপম লক্ষ্য করলেন সেই অতি চেনা লালটুপিটা । জানো দাদুভাই? শুধু তুমি কেন আমারো এই লালটুপিটা বড প্রিয়...অনুপম বললেন।  

"ল অফ এসোসিয়েশান" বলে সাইকোলজিতে একটা কথা আছে । লালটুপি চোখে পড়ার পর থেকেই অনুপম উশখুশ করছিলেন সেই সন্ধ্যার অবকাশে স্মৃতির অতলে ঝাঁপ দেবার জন্যে ।  ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ঐ দিনগুলো তাকে সবথেকে বেশি টানে এখনো, এত বছর বাদে । অনুপম  বড় চাকরী করেছেন । সে তো  ডিগ্রীর সৌজন্যে, নামী কলেজের খাতিরে । কিন্তু এই কলেজ তাকে শিখিয়েছে ডিসিশন নিতে, মানুষের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলতে । যার অনেকটাই তিনি দিয়েছেন ছেলেকে ।  

তখন না ছিল ইন্টারনেট, না ছিল স্মার্টফোন । নিজেদের  নিয়েই মেতে থাকতাম আমরা । ক্যাম্পাস ছিল ফাঁকা । শুধু সবুজ চারিধার । প্রত্যেক ছেলের নিজস্ব ঘর ।  

এই সব স্মৃতিরোমন্থনের পালা চলছিল দুজনার মধ্যে । চন্দ্রাবলী তার মধ্যে একপ্লেট মাইক্রোওয়েভে সেঁকা পাপড়ভাজা নিয়ে এলেন ।  

মাঝেমাঝেই চন্দ্রাবলীর কানে আসছিল সব রসাল চুটকি আর ঠাট্টা ইয়ারকির  কানাঘুষো  কথা ।  পৃথিবীর সর্বকালের সকল প্রৌঢ় প্রৌঢ়ারা পুরোণো স্মৃতির সরণি বেয়ে হাঁটতে যে কি ভালোটাই বাসেন সেই কথা ভাবছিলেন চন্দ্রাবলী । বাড়িতে আসাযাওয়া আজকাল কমে গেছে বলেই বুড়োবুড়িদের মধ্যে এত ডিমেনশিয়া, এত এলঝাইমারস আর ডিপ্রেশান বেড়েছে । 

ভাগ্যি আপনি আজ এলেন অনুপমদা, আমরা দুটি একটু প্রাণ খুলে হেসে বাঁচছি । নয়ত এতক্ষণে আপনার বন্ধুটি টিভির খবর নিয়ে আর আমি আমার উপন্যাসের চরিত্রগুলো নিয়ে নাটাঝামটা খাচ্ছি । এবার থেকে দেশে এলেই চলে আসবেন সকাল থেকে, আগাম বলে রাখলাম.. চন্দ্রাবলীর আন্তরিক অনুরোধ ।  

-তুই আর মানুষ হলিনা ব্যাটা , চুপ কর দিকিনি, নাতি হয়ে গেল আমাদের, বল, তোর নাতনীর কথা-- পাপড়ের অপ্রত্যাশিত আগমনে সুপ্রিয় যারপরনেই খুশি হয়ে বললেন । 

চন্দ্রাবলী  কফির পেয়ালা হাতে ধীরে ধীরে এসে বসেছেন তাঁদের আসরে ... নিন ঠান্ডা হয়ে গেল যে ।  

-হ্যাঁরে এই কি সেই লালটুপিটা না কি ? বলে হো হো করে অনুপম হাসছিলেন ।  

ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ঢোকাটাই কষ্টের । পরের পার্টটা এখনকার ভাষায় "নো চাপ"  অথবা " চাপ দেনেকে লিয়ে, লেনে কে লিয়ে নেহি " 

হষ্টেলের স্মৃতিগুলো হাতড়াতে   গিয়ে তাঁর এখনো মনে হয় সেই দিনগুলোতে ফিরে যেতে । কলেজের এই স্মৃতিগুলো বেশিটাই সুখের শুধু পরীক্ষার দিনগুলো বাদ দিয়ে । চম্পার সাথে ভাব-ভালোবাসা, সুপ্রিয়র মত আরো দশ বারোজন ভালো বন্ধুর সাথে অহোরাত্র ওঠাবসা, ক্যান্টিনে গিয়ে দলবেঁধে চা-আর চপ খাওয়া । কত কম পকেটমানি ছিল তাঁদের । কত সিভিলাইজড  ragging ছিল  সে সময় । একজন মেয়েকে ফার্স্ট ইয়ারে  ragging এ প্রশ্ন করা হল "হাউ ডু ইউ টেক কেয়ার অফ ইয়োর হেয়ার?” 

মেয়েটার নাম এখন মনে নেই । সে তো প্রাণপণে মুক্তি পাবার জন্য লড়ে গিয়ে বলতে লাগল " আই ওয়াশ মাই হেয়ার উইথ বেবি শ্যাম্পু, নেভার আই কোম্ব ওয়েট হেয়ার্, আই এপ্লাই হট অয়েল,  এভরি সানডে " 

তখন তাকে বলা হল " এ তো গেল মাথার চুলের কথা " 

সেই শুনে মেয়েটা লজ্জায় মাথা নীচু করে পালাতে পারলে বাঁচে ।   কলেজে ঢোকার পর  ragging এর দাপটে জীবনের আদ্দেক গ্রুমিংটাও বুঝি হয়ে গেছিল । কলেজে যাবার আগে বাড়ির বড় দাদা আগেভাগেই বলে দিয়েছিলেন  ragging না ফেস করলে স্পাইনাল কর্ডটা সিধে হয়নারে ! তবুও ভয়ে ভয়ে গুডি গুডি অনুপম কলেজে এডমিশনের পর প্রায়  প্রতি হপ্তায় বাড়ি পালাত । তারপর বাড়ি যাওয়া কমতে শুরু করল ।   মায়ের কথা মত পোষ্টকার্ডে " পৌঁছেচি ও ভালো আছি " লিখে স্টেশনে দাঁড়িয়ে পোষ্ট করেই আবার হষ্টেলে ফিরে আসা । মা ইচ্ছে করেই নিজে হাতে পোষ্টকার্ডের ওপর লিখে দিতেন তাঁর ঠিকানা যাতে ছেলে অন্তত: ঠিকানা লেখার আলস্যটা ত্যাগ করে উত্তরটুকুনি দেয় । 

 তারপর ছুটির অবকাশ ছাড়া নো বাড়ি ফেরার টান । উইকএন্ডে যত দল বেঁধে বদমায়েসি । প্রথমে রাস্তার সাইনবোর্ড খুলে নিয়ে উইং এ নিয়ে গেল । সে এক চ্যালেঞ্জ । অপর এক দল সেই চ্যালেঞ্জকে টেক্কা দিয়ে  স্টেশন থেকে রাতেরবেলায়  রেলের নাম লেখা "করমন্ডল এক্সপ্রেস" খুলে  এনে ঘরে ঝোলাল । সেই দেখে হলের ওয়ার্ডেন খুব বকুনি দিল । কিন্তু ওয়ার্ডেনও জানেন এমনটি যুগ যুগ ধরে চলে আসছে । কখনো আবার জলের ট্যাঙ্কের ওপর উঠে সুইমিং পুলের লেডিস আওয়ারে দূরবিন করা কিম্বা  ঘাড় ধরে জুনিয়ারের গোঁফের একপাশ কামিয়ে দেওয়া এই সব কত কত মজা হয়েছিল । তখন শপিং মল ছিল না, মাল্টিপ্লেক্স ছিলনা। আড্ডা দেবার জন্য হুঁকা লাউঞ্জ বা সিসিডি ছিলনা কিন্তু নির্ভেজাল সস্তার আনন্দটা ভীষণ ছিল ।  সাইকেল চালিয়ে একদল ছেলে সেবার দীঘার উদ্দেশ্যে যাত্রা করল । একবার শান্তিনিকেতন চলে গেল । রবিঠাকুরের পাড়ায় নাকি  সুন্দর সুন্দর রাবিন্দ্রিক মেয়েরা পড়াশুনো করতে আসে । তাদের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মেয়েগুলো বড্ড কাঠখোট্টা ।  সেখানে গিয়ে একরাত থাকার জায়গা জোগাড় করতে না পেরে সারারাত রাস্তার ফুটপাথেই শুয়ে কাটিয়ে দিল তারা । তারপর শান্তিনিকেতন থেকে কোলকাতা ফিরে অনুপমের মাথায় উকুন দেখে  তার মায়ের সে কি রাগ !  

আর সবচাইতে বড়কথা এক ছাদের নীচে, অতগুলো বছর ভারতবর্ষের নানাপ্রান্ত থেকে  আসা ছেলেপুলেদের সাথে মিশে মনের গঠনটা কেমন যেন বদলে যায় । একটা বৈচিত্র্যপূর্ণ আউটলুক তৈরী হয়ে যায় ।  কত কিছু শিখে ফেলে ছেলেগুলো।  

এইসব পুরোণো দিনের গল্প করতে করতে আবার ঝুমঝুম এসে পড়ল তাদের মধ্যে । এবার লালটুপিটা তার হাতে । দাদুর দিকে টুপিটা এগিয়ে দিয়ে সে বলে উঠল " এতা নাও, গওম হচ্চে"

-আর এই সেই লালটুপি! বাপরে! বাপ! হনুমান টুপি,  সে কি কান্ড..অনুপম হা হা করে হেসে উঠলেন !  

-আজ বড্ড মিস করছি চম্পাকে । সুপ্রিয় বলেই ফেললেন । 

-আপনাদের সেই জন্মদিনের গল্পটা কতবার শুনেছি ওঁর কাছে,  চন্দ্রাবলী বললেন  

অনুপম তো হেসেই খুন । বললেন আরে বুদ্ধিটা তো মেকানিকাল ডিপার্টমেন্টের মেধাবী ছাত্র সুপ্রিয় মুখার্জির । 

তাই বুঝি?  চন্দ্রাবলী বলেন । 

-আমার বৌ চম্পা তো তখন ইন্টিগ্রেটেড এমএসসি  করছে, আমাদের থেকে দু'ধাপ জুনিয়র । সুপ্রিয়র কাছে অফ থাকলেই অঙ্ক বুঝতে যেত । আমি প্রোপজটা আগেভাগে  না করে দিলে তো সুপ্রিয় ঐ পাকা ঘুঁটিটা ঘরে এনে ফেলেছিল বলে । 

কি আবোলতাবোল বকছিস! আমার বাবা মা কায়স্থর মেয়ে ঘরে আনতে দেবেই না আগেভাগেই গেয়ে রেখেছিল । তাই জন্যে আমি তো আমার শ্যালকের এই সুন্দরী বোনটির বাগদত্তা হয়েই ছিলাম । 

চন্দ্রাবলী লজ্জায় একটু ব্লাশ করলেন । জন্মদিনের গল্পটা যদি বলেন...   

"আরে আমাদের সময় বেশকিছু ক্রিয়েটিভ ছাত্রছাত্রীর ভীড় হয়েছিল কলেজে  । আমার জন্মদিনে ওরা সুপ্রিয়র পরামর্শে ঠিক করল জন্মদিনের ভোরে আমাকে গিফ্ট পাঠাবে । সুপ্রিয় মেক-ডিপার্টমেন্টের কায়দাকৌশলে এক বড় ঢাউস কাঠের বাক্স তৈরী করে তার মধ্যে চম্পাকে বন্দী করল ; বাক্সের গায়ে ড্রিল দিয়ে ছ্যাঁদা করা হল যাতে দম আটকে না বন্দিনী মারা যায় ।  সকলে মিলে গিফ্ট নিয়ে হাজির হল আমার রুমে ।  আমি অত্তবড় গিফ্টের বাক্স দেখে স্তম্ভিত ।   তারপর যখন বাক্স খুললাম তখন সকলের সামনে পরিষ্কার হয়ে গেল অনুপম-চম্পার মধুর প্রেমকাহিনী । অনুপম যে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিল সকলেই তার প্রমাণ পেল হাতেনাতে । সেই সাথে আমি আর চম্পাও বেশ লজ্জায় পেড়ে গেলাম । দুজনার পকেটমানি দিয়ে সেরাতের জন্মদিনের ভোজ খাওয়াতে হয়েছিল সকলকে । 

-সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে চম্পা কখন বাক্সের মধ্যে শুলো জানো? অনুপমকে জিলিপি খাওয়াতে নিয়ে গেল একদল ছেলে ।  মানে বার্থডে ট্রিট আমাদের পক্ষ থেকে ওনলি জিলিপি দিয়ে  আর সেই ফাঁকে চম্পা মেয়েদের  হষ্টেল থেকে ভোরবেলা বেরিয়ে,  ছেলেদের হষ্টেলের পাঁচিল টপকে চুপিচুপি এসে আমার প্ররোচনায় বাক্সের মধ্যে ঢুকে সটান চিতপটাঙ.. সুপ্রিয় জুড়লেন ।  

আর টুপি নিয়ে সে কি ধুন্ধুমার কান্ড ! জানো চন্দ্রাবলী ?  অনুপম বললেন 

ও তাই আপনি এসে থেকে ঝুমঝুমের টুপিটা নিয়ে কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন ! চন্দ্রাবলী বললেন ।  

-লালটুপির গল্পটা শুনবে ? অনুপম বললেন 

সুপ্রিয় বললেন "তার আগে বল,  সিঙ্গল মল্ট চলবে তো?"  

অনুপম বললেন "বিদেশের ডাক্তারবাবুদের কথামত রোজ দু'পেগ সিঙ্গল মল্টের কৃপায় বেঁচে আছি গুরু, চম্পার কথা মনে হলে বড্ড ভারী হয়ে যায় মনটা, এক সিঙ্গল মল্ট, দুই ফেসবুক আর ট্যুইটারের স্টেটাস আপডেট আমাকে একটু মুক্তি দেয়" 

-গ্লেনমোরাঞ্জি না টালিস্কার কোন্‌টা খাবি বল? সেবার রণজয়-সাগরী  পেপার পড়তে গিয়ে লন্ডন থেকে নিয়ে এসেছে আমার জন্যে, সুপ্রিয় বললেন ।  

-তুই-আমি মহুয়া খাওয়া পার্টি ভাই । ছেলেদের পয়সায় এখন সিঙ্গলমল্ট পেয়ে বরতে গেছি কি বল? অনুপম বললেন ।  

-তাহলে ক'টা ফিশ ক্রোকে ভেজে নিয়ে আসি, চন্দ্রাবলী শশব্যস্তে রান্নাঘরের দিকে গেলেন ।  

আমাদের সময় মোবাইল নেই, ইমেল নেই । ট্রাঙ্ককল আর টেলিগ্রাম বড্ড বেদনাদায়ক ।  পিওন গুলোর কত কাজ । ছাত্রাবাসে কত চিঠি বিলি করতে হত । বাড়ির চিঠি আসত একদল ছেলেমেয়ের । সেগুলো হত মুক্তচিঠি বা পোষ্টকার্ড।  রঙীন স্ট্যাম্প ওলা,  বড় বড় খামে বিদেশ থেকে ভারী ভারী চিঠি আসত ।  যেসব ছাত্র স্কলারশিপের জন্য  বাইরে এপ্লাই করছে সেগুলি তাদের জন্যে । কিছু হত কন্ফিডেন্সিয়াল লেটার , খামে ভরে আসত । যার মধ্যে  গুটিকয়েক প্রেমপত্র থাকবেই । সুপ্রিয়র এক হলমেট আশিস ছিল বড় ফোক্কর । সারাদিন পড়াশোনা না করে গিটার বাজাত আর পিওন এলে দৌড়ে গিয়ে খামে ভরা চিঠির বাইরে মেয়েলি হাতের লেখা দেখলেই ছোঁ মেরে নিয়ে ও তা খুলে পড়ে ফেলে যার চিঠি তার কাছ থেকে এক ভাঁড় বাংলু কি আধ বোতল মহুয়া কিম্বা কমপক্ষে এক ছিলিম গাঁজার টান আদায় করে নিত ।  কখনো সে কেবলি চিঠিটা পড়ে ফেলে আবার চুপচাপ চিঠির মুখ বন্ধ করে টেবিলে ফেলে দিত । সব ধরণের চিঠির ভীড়ে সেই খোলা চিঠি মুখ বন্ধ হয়ে পড়ে থাকত । আবার কখনো মুখরোচক কোনো খবর থাকলে যার চিঠি তার নাকে ডগায় চিঠিখানা মেলে ধরত । ব্ল্যাকমেলড  হবার ভয়ে সে ছেলেগুলো গোবেচারার মত অশিস যা চাইত তখনকার মত তাই দিত তার হাত থেকে চিঠি পাবার আশায় । লালটুপি হল সেই চিঠি হাইজ্যাকিং এর এক গল্প । 

-সেটা কি রকম ?  চন্দ্রাবলী গরম গরম রুইমাছের ক্রোকে এনে রাখলেন সামনে । সাথে ফ্রেশ কাসুন্দি আর একটু স্যালাড ।  

-আগে খেয়ে নিন তো গরম গরম রুইমাছের ক্রোকে গুলো । চন্দ্রাবলী বললেন । 

-আহা! কদ্দিন গঙ্গার রুইমাছ খাইনি ।  অনুপম বেজায় খুশি হলেন গরম ক্রোকেতে কামড় বসিয়ে ।  

-একবার  একখানা চিঠি এসেছে  ডাকে, খামে ভরে , টানা টানা হাতে যতনে লেখা, বুঝলে চন্দ্রাবলী?    

আশিস যথারীতি চিঠিখানা খুলে পড়ে তার নীচে পুনশ্চ: বলে হাতের লেখা নকল করে লিখে দিল 

"খড়গপুর প্ল্যাটফর্মে, সামনের রবিবার রাত ১টায় চলে এসো কিন্তু, আমি অপেক্ষায় থাকব আর  তোমার  মাথায়  যেন  একটা লাল মাঙ্কিটুপি পরা থাকে  । তুমি সব কম্পার্টমেন্টের জানলার ধারে এসে খুক খুক করে কাশবে ।  যেই আমি লালটুপি দেখতে পাব আর খুক খুক কাশির শব্দ শুনব বাইরে এসে তোমার সাথে দেখা করব "

তারপর ?

তারপর দেখি সুপ্রিয় হল থেকে হলের দিকে , মেস থেকে ক্যান্টিনের দিকে দৌড়চ্ছে পাগলের মত আর বলছে " হ্যাঁরে লাল মাঙ্কি ক্যাপ আছে? " 

গরমকাল তখন ;  মাঙ্কিক্যাপ কারো কাছে নেই । আর মাঙ্কিটুপি পরার মত শীতও তেমন পড়েনা । তাই কেউ ওকে আশার আলো দেখাতে পারলনা । শেষে এগ্রিকালচারের প্রোফেসার গুপ্তর বাড়ি গিয়ে "স্যার, প্রাকপূজোর নাটকের জন্য একটা মাঙ্কিক্যাপ চাই" এই বলে অশিস নিজেই যোগাড় যন্ত্র করে লালটুপি এনে দিয়েছিল সুপ্রিয়কে । পরে সেই টুপি  কেচেকুচে ফেরত দেওয়া হল প্রফেসার গুপ্তকে  ।

-তুমি এতসব তো আমাকে বলোনি কোনোদিনো । চন্দ্রাবলীর নরম সুরে অভিযোগ ।    

-ব্যাটা সুপ্রিয় ভাদ্রমাসের পচা গরমে সেই লাল মাঙ্কিটুপি পরে গলদঘর্ম ; তাতে আবার সাইকেলে করে ষ্টেশনে যাবার পথে একটা স্মার্ট শাওয়ারে টুপি থেকে ট্রাউজার বেশ ভিজে টিজে একাকার ।   সেবারের মত রাত একটায় নির্ধারিত সময়ে ষ্টেশনে গিয়ে হাজির । কোলকাতার ট্রেন এসে যেই থেমেছে সে বেচারা লালটুপিয়া খুক খুক শব্দ করতে করতে ট্রেনের সব কামরার জানলায় এল ।

আমরা তিনবন্ধু সেই মজা দেখতে লাগলাম প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে । সে কি লম্ফঝম্প! সে বেচারা পাগলপ্রায় । কেউ আর ট্রেন থেকে নামেনা...  কত দৌড়োদৌড়ি, খুক-খুক, খক-খক কত শব্দ ... আমরা দূর থেকে দাঁড়িয়ে শুনছি,  ট্রেন ছেড়ে চলে গেল । তখন তার মুখটা যদি দেখতে চন্দ্রাবলী! 

তারপর্? 

-আমাদের তো পেট গুলোচ্ছে । সকালবেলা লালটুপিটা সুপ্রিয়র কাছে গিয়ে চাওয়া হল । সুপ্রিয় দারুণ রেগে আছে । সে বলল "টুপির কি দরকার তোদের্"   

অমরা তখন খুক খুক করে সকলে মিলে কাশতে লাগলাম । ততক্ষণে ব্যাটা ধরে ফেলেছে ।  সকালবেলা  মেসের ব্রেকফাস্ট টেবিলে সকলে যখন মন দিয়ে রোববারের স্পেশাল দোসা খেতে ব্যস্ত । আমরা তিনজনে সকলের সামনে এই লাল মাঙ্কি টুপি-রহস্য উন্মোচন করলাম ।


ব্যাটাকে জাপটে ধরে বলে "ডুবে ডুবে জল খাচ্ছ তুমি? ঘড়িঘড়ি কোলকাতায় যাওয়া তোমার বের করছি ।  প্রেম করা হচ্ছে? আগে ছবি দ্যাখা নয়ত সিনিয়রদের বলে দেব । 

-এ সবের তো আমি কিছুই জানিনা । চন্দ্রাবলী অনুযোগ করলেন । 

-তুমি তো চিঠি লিখেই খালাস ।  আর সেবারের সেই লালটুপির চিঠি তো আর তোমার কাছে ফেরত যায়নি ।  সপ্তায় প্রায় প্রতিদিনই তোমার চিঠি আসে কোলকাতা থেকে ।  পিওন ব্যাটা তো পুজোর পর মোটা বখশিস আদায় করে ছাড়ত সুপ্রিয়র কাছ থেকে.. ঠাট্টার সুরে অনুপম বললেন ।

-ধুস্‌ কি যে বলেন আপনি! দাদা যে আমাকে রোজ জপাত "কি রে চিঠিটিঠি লিখছিস তো সুপ্রিয়কে? নয়ত অমন ভালো পাত্রটা হাতছাড়া হয়ে যাবে"

-তারপর আর কি ?  নিয়ে আয় তোর সিঙ্গল মল্ট, অনুপমের আবদার ।  

-আজ তোমাদের ফ্ল্যাটে ঢোকার মূহুর্তে ঝুমঝুমের মাথায় লাল মাঙ্কিটুপি দেখেই আমি মনেমনে পল গুনছিলাম কখন তোমাদের এই গল্পটি শোনাব ।  

-আর তাই সেই লাল মাঙ্কিটুপিকে স্মরণ করে বুঝি আমাদের শীতকালের বিয়েতে আপনারা একরাশ শীতের জামাকাপড়ের সাথে একজোড়া লাল মাঙ্কিটুপি উপহার দিয়েছিলেন ? চন্দ্রাবলী হো হো করে হেসে লুটিয়ে পড়লেন । 

-ইয়েস অফকোর্স ! দ্য ভেরি স্পেশ্যাল রেডলেটার ডে !  সুপ্রিয় বললেন ।  


(প্রকাশিত এবেলা, আনন্দবাজার পত্রিকা)