লালটুপি রহস্য
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
অনুপম আজ এসেছেন অনেকদিনের পুরণো কলেজ বন্ধু সুপ্রিয়র বাড়ি । অনুপম এখন বিদেশে বাস করেন ছেলের কাছে । কোলকাতায় মাঝেমধ্যে এসে পুরণো ফ্ল্যাট বাড়ি, ব্যাঙ্ক-পোষ্ট অফিস, গ্যাসের কানেকসান, কর্পোরেশন ট্যাক্স, সিকিওরিটিকে ইলেকট্রিক বিল বাবদ এডভান্স টাকা, ফ্ল্যাট-মেন্টেনেন্স মিটিয়ে কিছুদিন আত্মীয় বন্ধুদের সাথে দেখা সাক্ষাত করে আবার ফিরে যান ছেলের কাছে । স্ত্রী চম্পা অনেকদিন আগেই গত হয়েছেন । ছেলের বৌটিও বেশ ভালো । বিদেশের জলহাওয়ায় হাঁপানি রোগটাও ভালো থাকে তাঁর তাই বেশিটাই ছেলের কাছে থাকেন । ঝকঝকে শহর সিঙ্গাপুরে বাস ওনার একমাত্র পুত্র অভীকের ।
ফেসবুকের মাধ্যমে দুই প্রৌঢ় একে অপরকে খুঁজে পেয়ে যারপরনেই আপ্লুত । সত্তরের দশকে ওরা পড়তেন এক নামী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে । তারপর যা হয় কেরিয়ার আর চাকরীর সুবাদে একজন বিদেশে আরেকজন কলকাতার বাইরে । অতঃপর চেনাবন্ধুদের ভীড়ে ফেসবুকে অনুপমের কাছ থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েষ্ট এল সুপ্রিয়র কাছ থেকে । তারপর মোবাইল, এসেমেস, ফেসবুকের মেসেজ পর্বের পর এদ্দিনে সশরীরে চাক্ষুষ ভেট দুজনের ।
প্রথম যেদিন ফেসবুকে সুপ্রিয়র প্রোফাইল ছবি দেখলেন অনুপম তাঁর সে কি নির্ভেজাল হাসি চোখেমুখে! সেই থেকে প্ল্যান করছিলেন এবার কোলকাতায় গেলেই সুপ্রিয়র সাথে দেখা করে আসবেন । কত দিনের বন্ধু ওঁরা ! কত হাসিকান্নার দোলদোলানো শীত বসন্ত একসাথে পেরিয়েছেন তাঁরা ! কতদিন জমিয়ে আড্ডা দেওয়া হয়নি কলেজের বন্ধুদের সাথে !
সুপ্রিয় চাকরীবাকরীর পাট চুকিয়ে কনসালটেন্সি করেন । বৌ চন্দ্রাবলী লেখালেখি করেন বহুদিন ধরে । ওদের একমাত্র ছেলে রণজয় আর তার বৌ সাগরী দুজনেই ডাক্তার । বাড়ির নীচেই রণজয়ের চেম্বার আর সাগরী এমএস করছে শিশুমঙ্গলে । ফুটফুটে একরত্তি নাতি ঝুমঝুমকে নিয়েই সুপ্রিয়-চন্দ্রাবলীর দিনকাবার হয়ে যায় ।
অনুপম সুপ্রিয়র বাড়িতে ঢোকার মুখেই যে ফুটফুটে শিশুটির হাত ধরে কাজের মেয়ে লতা চিনিয়ে দিয়েছিল সুপ্রিয়দের ফ্ল্যাট তার সাথে কিছু পরেই সন্ধ্যে হতে না হতেই দেখা হল সুপ্রিয়র ড্রইংরুমে । টুকটুকে লাল, পেল্লায় মাঙ্কিটুপি পরে ঝুমঝুম ; হাতে একটি হট-হুইলসের গাড়ি নিয়ে বছর চারেকের শিশুটি অনুপমের দিকে এগিয়ে এল । বিকেলবেলায় বাইরে বেড়িয়ে ফিরলে শিশুদের মনমেজাজ খুব ফুরফুরে থাকে ।
- কি দাদুভাই ? তোমার চেয়ে তো তোমার টুপিটা একটু বেশিই বড় মনে হচ্ছে ! অনুপম বললেন আর পকেট থেকে একটি হেজেলনাট চকোলেট বাক্স আর নাটিবার বের করে তার হাতে দিলেন ।
-আর বলবেন না, ঐ টুপি ছাড়া সে রাস্তায় বেরোবে না । ঐ টুপি কাচা চলবেনা । ওটি ওর বড্ড প্রিয় , বলতে বলতে বিলিতী পেয়ালায় সুগন্ধী কফি আর এক প্লেট কুড়কুড়ে আর সাথে কিছু রোস্টেড আমন্ড বাদাম নিয়ে চন্দ্রাবলী ঢুকলেন বসার ঘরে ।
- না, না ঝুমঝুম এবার টুপিটা খুলে ফেলতো বাবু । ঘরে বড্ড গরম যে, সুপ্রিয় বললেন ।
ঝুমঝুমকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে গিয়ে হঠাত অনুপম লক্ষ্য করলেন সেই অতি চেনা লালটুপিটা । জানো দাদুভাই? শুধু তুমি কেন আমারো এই লালটুপিটা বড প্রিয়...অনুপম বললেন।
"ল অফ এসোসিয়েশান" বলে সাইকোলজিতে একটা কথা আছে । লালটুপি চোখে পড়ার পর থেকেই অনুপম উশখুশ করছিলেন সেই সন্ধ্যার অবকাশে স্মৃতির অতলে ঝাঁপ দেবার জন্যে । ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ঐ দিনগুলো তাকে সবথেকে বেশি টানে এখনো, এত বছর বাদে । অনুপম বড় চাকরী করেছেন । সে তো ডিগ্রীর সৌজন্যে, নামী কলেজের খাতিরে । কিন্তু এই কলেজ তাকে শিখিয়েছে ডিসিশন নিতে, মানুষের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলতে । যার অনেকটাই তিনি দিয়েছেন ছেলেকে ।
তখন না ছিল ইন্টারনেট, না ছিল স্মার্টফোন । নিজেদের নিয়েই মেতে থাকতাম আমরা । ক্যাম্পাস ছিল ফাঁকা । শুধু সবুজ চারিধার । প্রত্যেক ছেলের নিজস্ব ঘর ।
এই সব স্মৃতিরোমন্থনের পালা চলছিল দুজনার মধ্যে । চন্দ্রাবলী তার মধ্যে একপ্লেট মাইক্রোওয়েভে সেঁকা পাপড়ভাজা নিয়ে এলেন ।
মাঝেমাঝেই চন্দ্রাবলীর কানে আসছিল সব রসাল চুটকি আর ঠাট্টা ইয়ারকির কানাঘুষো কথা । পৃথিবীর সর্বকালের সকল প্রৌঢ় প্রৌঢ়ারা পুরোণো স্মৃতির সরণি বেয়ে হাঁটতে যে কি ভালোটাই বাসেন সেই কথা ভাবছিলেন চন্দ্রাবলী । বাড়িতে আসাযাওয়া আজকাল কমে গেছে বলেই বুড়োবুড়িদের মধ্যে এত ডিমেনশিয়া, এত এলঝাইমারস আর ডিপ্রেশান বেড়েছে ।
ভাগ্যি আপনি আজ এলেন অনুপমদা, আমরা দুটি একটু প্রাণ খুলে হেসে বাঁচছি । নয়ত এতক্ষণে আপনার বন্ধুটি টিভির খবর নিয়ে আর আমি আমার উপন্যাসের চরিত্রগুলো নিয়ে নাটাঝামটা খাচ্ছি । এবার থেকে দেশে এলেই চলে আসবেন সকাল থেকে, আগাম বলে রাখলাম.. চন্দ্রাবলীর আন্তরিক অনুরোধ ।
-তুই আর মানুষ হলিনা ব্যাটা , চুপ কর দিকিনি, নাতি হয়ে গেল আমাদের, বল, তোর নাতনীর কথা-- পাপড়ের অপ্রত্যাশিত আগমনে সুপ্রিয় যারপরনেই খুশি হয়ে বললেন ।
চন্দ্রাবলী কফির পেয়ালা হাতে ধীরে ধীরে এসে বসেছেন তাঁদের আসরে ... নিন ঠান্ডা হয়ে গেল যে ।
-হ্যাঁরে এই কি সেই লালটুপিটা না কি ? বলে হো হো করে অনুপম হাসছিলেন ।
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ঢোকাটাই কষ্টের । পরের পার্টটা এখনকার ভাষায় "নো চাপ" অথবা " চাপ দেনেকে লিয়ে, লেনে কে লিয়ে নেহি "
হষ্টেলের স্মৃতিগুলো হাতড়াতে গিয়ে তাঁর এখনো মনে হয় সেই দিনগুলোতে ফিরে যেতে । কলেজের এই স্মৃতিগুলো বেশিটাই সুখের শুধু পরীক্ষার দিনগুলো বাদ দিয়ে । চম্পার সাথে ভাব-ভালোবাসা, সুপ্রিয়র মত আরো দশ বারোজন ভালো বন্ধুর সাথে অহোরাত্র ওঠাবসা, ক্যান্টিনে গিয়ে দলবেঁধে চা-আর চপ খাওয়া । কত কম পকেটমানি ছিল তাঁদের । কত সিভিলাইজড ragging ছিল সে সময় । একজন মেয়েকে ফার্স্ট ইয়ারে ragging এ প্রশ্ন করা হল "হাউ ডু ইউ টেক কেয়ার অফ ইয়োর হেয়ার?”
মেয়েটার নাম এখন মনে নেই । সে তো প্রাণপণে মুক্তি পাবার জন্য লড়ে গিয়ে বলতে লাগল " আই ওয়াশ মাই হেয়ার উইথ বেবি শ্যাম্পু, নেভার আই কোম্ব ওয়েট হেয়ার্, আই এপ্লাই হট অয়েল, এভরি সানডে "
তখন তাকে বলা হল " এ তো গেল মাথার চুলের কথা "
সেই শুনে মেয়েটা লজ্জায় মাথা নীচু করে পালাতে পারলে বাঁচে । কলেজে ঢোকার পর ragging এর দাপটে জীবনের আদ্দেক গ্রুমিংটাও বুঝি হয়ে গেছিল । কলেজে যাবার আগে বাড়ির বড় দাদা আগেভাগেই বলে দিয়েছিলেন ragging না ফেস করলে স্পাইনাল কর্ডটা সিধে হয়নারে ! তবুও ভয়ে ভয়ে গুডি গুডি অনুপম কলেজে এডমিশনের পর প্রায় প্রতি হপ্তায় বাড়ি পালাত । তারপর বাড়ি যাওয়া কমতে শুরু করল । মায়ের কথা মত পোষ্টকার্ডে " পৌঁছেচি ও ভালো আছি " লিখে স্টেশনে দাঁড়িয়ে পোষ্ট করেই আবার হষ্টেলে ফিরে আসা । মা ইচ্ছে করেই নিজে হাতে পোষ্টকার্ডের ওপর লিখে দিতেন তাঁর ঠিকানা যাতে ছেলে অন্তত: ঠিকানা লেখার আলস্যটা ত্যাগ করে উত্তরটুকুনি দেয় ।
তারপর ছুটির অবকাশ ছাড়া নো বাড়ি ফেরার টান । উইকএন্ডে যত দল বেঁধে বদমায়েসি । প্রথমে রাস্তার সাইনবোর্ড খুলে নিয়ে উইং এ নিয়ে গেল । সে এক চ্যালেঞ্জ । অপর এক দল সেই চ্যালেঞ্জকে টেক্কা দিয়ে স্টেশন থেকে রাতেরবেলায় রেলের নাম লেখা "করমন্ডল এক্সপ্রেস" খুলে এনে ঘরে ঝোলাল । সেই দেখে হলের ওয়ার্ডেন খুব বকুনি দিল । কিন্তু ওয়ার্ডেনও জানেন এমনটি যুগ যুগ ধরে চলে আসছে । কখনো আবার জলের ট্যাঙ্কের ওপর উঠে সুইমিং পুলের লেডিস আওয়ারে দূরবিন করা কিম্বা ঘাড় ধরে জুনিয়ারের গোঁফের একপাশ কামিয়ে দেওয়া এই সব কত কত মজা হয়েছিল । তখন শপিং মল ছিল না, মাল্টিপ্লেক্স ছিলনা। আড্ডা দেবার জন্য হুঁকা লাউঞ্জ বা সিসিডি ছিলনা কিন্তু নির্ভেজাল সস্তার আনন্দটা ভীষণ ছিল । সাইকেল চালিয়ে একদল ছেলে সেবার দীঘার উদ্দেশ্যে যাত্রা করল । একবার শান্তিনিকেতন চলে গেল । রবিঠাকুরের পাড়ায় নাকি সুন্দর সুন্দর রাবিন্দ্রিক মেয়েরা পড়াশুনো করতে আসে । তাদের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মেয়েগুলো বড্ড কাঠখোট্টা । সেখানে গিয়ে একরাত থাকার জায়গা জোগাড় করতে না পেরে সারারাত রাস্তার ফুটপাথেই শুয়ে কাটিয়ে দিল তারা । তারপর শান্তিনিকেতন থেকে কোলকাতা ফিরে অনুপমের মাথায় উকুন দেখে তার মায়ের সে কি রাগ !
আর সবচাইতে বড়কথা এক ছাদের নীচে, অতগুলো বছর ভারতবর্ষের নানাপ্রান্ত থেকে আসা ছেলেপুলেদের সাথে মিশে মনের গঠনটা কেমন যেন বদলে যায় । একটা বৈচিত্র্যপূর্ণ আউটলুক তৈরী হয়ে যায় । কত কিছু শিখে ফেলে ছেলেগুলো।
এইসব পুরোণো দিনের গল্প করতে করতে আবার ঝুমঝুম এসে পড়ল তাদের মধ্যে । এবার লালটুপিটা তার হাতে । দাদুর দিকে টুপিটা এগিয়ে দিয়ে সে বলে উঠল " এতা নাও, গওম হচ্চে"
-আর এই সেই লালটুপি! বাপরে! বাপ! হনুমান টুপি, সে কি কান্ড..অনুপম হা হা করে হেসে উঠলেন !
-আজ বড্ড মিস করছি চম্পাকে । সুপ্রিয় বলেই ফেললেন ।
-আপনাদের সেই জন্মদিনের গল্পটা কতবার শুনেছি ওঁর কাছে, চন্দ্রাবলী বললেন
অনুপম তো হেসেই খুন । বললেন আরে বুদ্ধিটা তো মেকানিকাল ডিপার্টমেন্টের মেধাবী ছাত্র সুপ্রিয় মুখার্জির ।
তাই বুঝি? চন্দ্রাবলী বলেন ।
-আমার বৌ চম্পা তো তখন ইন্টিগ্রেটেড এমএসসি করছে, আমাদের থেকে দু'ধাপ জুনিয়র । সুপ্রিয়র কাছে অফ থাকলেই অঙ্ক বুঝতে যেত । আমি প্রোপজটা আগেভাগে না করে দিলে তো সুপ্রিয় ঐ পাকা ঘুঁটিটা ঘরে এনে ফেলেছিল বলে ।
কি আবোলতাবোল বকছিস! আমার বাবা মা কায়স্থর মেয়ে ঘরে আনতে দেবেই না আগেভাগেই গেয়ে রেখেছিল । তাই জন্যে আমি তো আমার শ্যালকের এই সুন্দরী বোনটির বাগদত্তা হয়েই ছিলাম ।
চন্দ্রাবলী লজ্জায় একটু ব্লাশ করলেন । জন্মদিনের গল্পটা যদি বলেন...
"আরে আমাদের সময় বেশকিছু ক্রিয়েটিভ ছাত্রছাত্রীর ভীড় হয়েছিল কলেজে । আমার জন্মদিনে ওরা সুপ্রিয়র পরামর্শে ঠিক করল জন্মদিনের ভোরে আমাকে গিফ্ট পাঠাবে । সুপ্রিয় মেক-ডিপার্টমেন্টের কায়দাকৌশলে এক বড় ঢাউস কাঠের বাক্স তৈরী করে তার মধ্যে চম্পাকে বন্দী করল ; বাক্সের গায়ে ড্রিল দিয়ে ছ্যাঁদা করা হল যাতে দম আটকে না বন্দিনী মারা যায় । সকলে মিলে গিফ্ট নিয়ে হাজির হল আমার রুমে । আমি অত্তবড় গিফ্টের বাক্স দেখে স্তম্ভিত । তারপর যখন বাক্স খুললাম তখন সকলের সামনে পরিষ্কার হয়ে গেল অনুপম-চম্পার মধুর প্রেমকাহিনী । অনুপম যে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিল সকলেই তার প্রমাণ পেল হাতেনাতে । সেই সাথে আমি আর চম্পাও বেশ লজ্জায় পেড়ে গেলাম । দুজনার পকেটমানি দিয়ে সেরাতের জন্মদিনের ভোজ খাওয়াতে হয়েছিল সকলকে ।
-সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে চম্পা কখন বাক্সের মধ্যে শুলো জানো? অনুপমকে জিলিপি খাওয়াতে নিয়ে গেল একদল ছেলে । মানে বার্থডে ট্রিট আমাদের পক্ষ থেকে ওনলি জিলিপি দিয়ে আর সেই ফাঁকে চম্পা মেয়েদের হষ্টেল থেকে ভোরবেলা বেরিয়ে, ছেলেদের হষ্টেলের পাঁচিল টপকে চুপিচুপি এসে আমার প্ররোচনায় বাক্সের মধ্যে ঢুকে সটান চিতপটাঙ.. সুপ্রিয় জুড়লেন ।
আর টুপি নিয়ে সে কি ধুন্ধুমার কান্ড ! জানো চন্দ্রাবলী ? অনুপম বললেন
ও তাই আপনি এসে থেকে ঝুমঝুমের টুপিটা নিয়ে কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন ! চন্দ্রাবলী বললেন ।
-লালটুপির গল্পটা শুনবে ? অনুপম বললেন
সুপ্রিয় বললেন "তার আগে বল, সিঙ্গল মল্ট চলবে তো?"
অনুপম বললেন "বিদেশের ডাক্তারবাবুদের কথামত রোজ দু'পেগ সিঙ্গল মল্টের কৃপায় বেঁচে আছি গুরু, চম্পার কথা মনে হলে বড্ড ভারী হয়ে যায় মনটা, এক সিঙ্গল মল্ট, দুই ফেসবুক আর ট্যুইটারের স্টেটাস আপডেট আমাকে একটু মুক্তি দেয়"
-গ্লেনমোরাঞ্জি না টালিস্কার কোন্টা খাবি বল? সেবার রণজয়-সাগরী পেপার পড়তে গিয়ে লন্ডন থেকে নিয়ে এসেছে আমার জন্যে, সুপ্রিয় বললেন ।
-তুই-আমি মহুয়া খাওয়া পার্টি ভাই । ছেলেদের পয়সায় এখন সিঙ্গলমল্ট পেয়ে বরতে গেছি কি বল? অনুপম বললেন ।
-তাহলে ক'টা ফিশ ক্রোকে ভেজে নিয়ে আসি, চন্দ্রাবলী শশব্যস্তে রান্নাঘরের দিকে গেলেন ।
আমাদের সময় মোবাইল নেই, ইমেল নেই । ট্রাঙ্ককল আর টেলিগ্রাম বড্ড বেদনাদায়ক । পিওন গুলোর কত কাজ । ছাত্রাবাসে কত চিঠি বিলি করতে হত । বাড়ির চিঠি আসত একদল ছেলেমেয়ের । সেগুলো হত মুক্তচিঠি বা পোষ্টকার্ড। রঙীন স্ট্যাম্প ওলা, বড় বড় খামে বিদেশ থেকে ভারী ভারী চিঠি আসত । যেসব ছাত্র স্কলারশিপের জন্য বাইরে এপ্লাই করছে সেগুলি তাদের জন্যে । কিছু হত কন্ফিডেন্সিয়াল লেটার , খামে ভরে আসত । যার মধ্যে গুটিকয়েক প্রেমপত্র থাকবেই । সুপ্রিয়র এক হলমেট আশিস ছিল বড় ফোক্কর । সারাদিন পড়াশোনা না করে গিটার বাজাত আর পিওন এলে দৌড়ে গিয়ে খামে ভরা চিঠির বাইরে মেয়েলি হাতের লেখা দেখলেই ছোঁ মেরে নিয়ে ও তা খুলে পড়ে ফেলে যার চিঠি তার কাছ থেকে এক ভাঁড় বাংলু কি আধ বোতল মহুয়া কিম্বা কমপক্ষে এক ছিলিম গাঁজার টান আদায় করে নিত । কখনো সে কেবলি চিঠিটা পড়ে ফেলে আবার চুপচাপ চিঠির মুখ বন্ধ করে টেবিলে ফেলে দিত । সব ধরণের চিঠির ভীড়ে সেই খোলা চিঠি মুখ বন্ধ হয়ে পড়ে থাকত । আবার কখনো মুখরোচক কোনো খবর থাকলে যার চিঠি তার নাকে ডগায় চিঠিখানা মেলে ধরত । ব্ল্যাকমেলড হবার ভয়ে সে ছেলেগুলো গোবেচারার মত অশিস যা চাইত তখনকার মত তাই দিত তার হাত থেকে চিঠি পাবার আশায় । লালটুপি হল সেই চিঠি হাইজ্যাকিং এর এক গল্প ।
-সেটা কি রকম ? চন্দ্রাবলী গরম গরম রুইমাছের ক্রোকে এনে রাখলেন সামনে । সাথে ফ্রেশ কাসুন্দি আর একটু স্যালাড ।
-আগে খেয়ে নিন তো গরম গরম রুইমাছের ক্রোকে গুলো । চন্দ্রাবলী বললেন ।
-আহা! কদ্দিন গঙ্গার রুইমাছ খাইনি । অনুপম বেজায় খুশি হলেন গরম ক্রোকেতে কামড় বসিয়ে ।
-একবার একখানা চিঠি এসেছে ডাকে, খামে ভরে , টানা টানা হাতে যতনে লেখা, বুঝলে চন্দ্রাবলী?
আশিস যথারীতি চিঠিখানা খুলে পড়ে তার নীচে পুনশ্চ: বলে হাতের লেখা নকল করে লিখে দিল
"খড়গপুর প্ল্যাটফর্মে, সামনের রবিবার রাত ১টায় চলে এসো কিন্তু, আমি অপেক্ষায় থাকব আর তোমার মাথায় যেন একটা লাল মাঙ্কিটুপি পরা থাকে । তুমি সব কম্পার্টমেন্টের জানলার ধারে এসে খুক খুক করে কাশবে । যেই আমি লালটুপি দেখতে পাব আর খুক খুক কাশির শব্দ শুনব বাইরে এসে তোমার সাথে দেখা করব "
তারপর ?
তারপর দেখি সুপ্রিয় হল থেকে হলের দিকে , মেস থেকে ক্যান্টিনের দিকে দৌড়চ্ছে পাগলের মত আর বলছে " হ্যাঁরে লাল মাঙ্কি ক্যাপ আছে? "
গরমকাল তখন ; মাঙ্কিক্যাপ কারো কাছে নেই । আর মাঙ্কিটুপি পরার মত শীতও তেমন পড়েনা । তাই কেউ ওকে আশার আলো দেখাতে পারলনা । শেষে এগ্রিকালচারের প্রোফেসার গুপ্তর বাড়ি গিয়ে "স্যার, প্রাকপূজোর নাটকের জন্য একটা মাঙ্কিক্যাপ চাই" এই বলে অশিস নিজেই যোগাড় যন্ত্র করে লালটুপি এনে দিয়েছিল সুপ্রিয়কে । পরে সেই টুপি কেচেকুচে ফেরত দেওয়া হল প্রফেসার গুপ্তকে ।
-তুমি এতসব তো আমাকে বলোনি কোনোদিনো । চন্দ্রাবলীর নরম সুরে অভিযোগ ।
-ব্যাটা সুপ্রিয় ভাদ্রমাসের পচা গরমে সেই লাল মাঙ্কিটুপি পরে গলদঘর্ম ; তাতে আবার সাইকেলে করে ষ্টেশনে যাবার পথে একটা স্মার্ট শাওয়ারে টুপি থেকে ট্রাউজার বেশ ভিজে টিজে একাকার । সেবারের মত রাত একটায় নির্ধারিত সময়ে ষ্টেশনে গিয়ে হাজির । কোলকাতার ট্রেন এসে যেই থেমেছে সে বেচারা লালটুপিয়া খুক খুক শব্দ করতে করতে ট্রেনের সব কামরার জানলায় এল ।
আমরা তিনবন্ধু সেই মজা দেখতে লাগলাম প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে । সে কি লম্ফঝম্প! সে বেচারা পাগলপ্রায় । কেউ আর ট্রেন থেকে নামেনা... কত দৌড়োদৌড়ি, খুক-খুক, খক-খক কত শব্দ ... আমরা দূর থেকে দাঁড়িয়ে শুনছি, ট্রেন ছেড়ে চলে গেল । তখন তার মুখটা যদি দেখতে চন্দ্রাবলী!
তারপর্?
-আমাদের তো পেট গুলোচ্ছে । সকালবেলা লালটুপিটা সুপ্রিয়র কাছে গিয়ে চাওয়া হল । সুপ্রিয় দারুণ রেগে আছে । সে বলল "টুপির কি দরকার তোদের্"
অমরা তখন খুক খুক করে সকলে মিলে কাশতে লাগলাম । ততক্ষণে ব্যাটা ধরে ফেলেছে । সকালবেলা মেসের ব্রেকফাস্ট টেবিলে সকলে যখন মন দিয়ে রোববারের স্পেশাল দোসা খেতে ব্যস্ত । আমরা তিনজনে সকলের সামনে এই লাল মাঙ্কি টুপি-রহস্য উন্মোচন করলাম ।
ব্যাটাকে জাপটে ধরে বলে "ডুবে ডুবে জল খাচ্ছ তুমি? ঘড়িঘড়ি কোলকাতায় যাওয়া তোমার বের করছি । প্রেম করা হচ্ছে? আগে ছবি দ্যাখা নয়ত সিনিয়রদের বলে দেব ।
-এ সবের তো আমি কিছুই জানিনা । চন্দ্রাবলী অনুযোগ করলেন ।
-তুমি তো চিঠি লিখেই খালাস । আর সেবারের সেই লালটুপির চিঠি তো আর তোমার কাছে ফেরত যায়নি । সপ্তায় প্রায় প্রতিদিনই তোমার চিঠি আসে কোলকাতা থেকে । পিওন ব্যাটা তো পুজোর পর মোটা বখশিস আদায় করে ছাড়ত সুপ্রিয়র কাছ থেকে.. ঠাট্টার সুরে অনুপম বললেন ।
-ধুস্ কি যে বলেন আপনি! দাদা যে আমাকে রোজ জপাত "কি রে চিঠিটিঠি লিখছিস তো সুপ্রিয়কে? নয়ত অমন ভালো পাত্রটা হাতছাড়া হয়ে যাবে"
-তারপর আর কি ? নিয়ে আয় তোর সিঙ্গল মল্ট, অনুপমের আবদার ।
-আজ তোমাদের ফ্ল্যাটে ঢোকার মূহুর্তে ঝুমঝুমের মাথায় লাল মাঙ্কিটুপি দেখেই আমি মনেমনে পল গুনছিলাম কখন তোমাদের এই গল্পটি শোনাব ।
-আর তাই সেই লাল মাঙ্কিটুপিকে স্মরণ করে বুঝি আমাদের শীতকালের বিয়েতে আপনারা একরাশ শীতের জামাকাপড়ের সাথে একজোড়া লাল মাঙ্কিটুপি উপহার দিয়েছিলেন ? চন্দ্রাবলী হো হো করে হেসে লুটিয়ে পড়লেন ।
-ইয়েস অফকোর্স ! দ্য ভেরি স্পেশ্যাল রেডলেটার ডে ! সুপ্রিয় বললেন ।
(প্রকাশিত এবেলা, আনন্দবাজার পত্রিকা)