১৪ ফেব, ২০২২

আমার প্রথম ভ্যালেন্টাইন / ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়


আমার প্রথম ভ্যালেন্টাইন / ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

এই তো সেদিন তার সাথে কফিহাউজের 
দুধসাদা টেবিল লিনেনে হাত রেখে। 
এই তো সেদিন ট্রামের সিটে... 
মিউজিয়ামের করিডোরে। বইমেলার চাঁদের হাটে। 
ল্যাবের প্রতিটি দরজা, কাচ সর্বস্বতা ছুঁয়ে, 
দিব্যি দিয়ে। ছিল তবু সে আমার হয়ে। হাত ধরে। 
 
আমার ইগো, পাগলামি, পাপপুণ্যের ফিরিস্তি, 
ধোপা-কাগজওয়ালার হিসেব থেকে শুরু করে সব কিছুই 
আমাপা দিয়েছিলাম তাকে উপুড় করে ।  

অস্পষ্ট কৈশোরের আবছায়ায় এসেছিল না একদিন? 
পাগলের মত নীল খুঁজে চলেছিলাম তখন কপার সালফেটে
বিষ ভেবে নয়। ফুল ভেবে। 
সবুজ খুঁজে চলেছি তখন হিরাকষের ক্রিস্টালে। 
রঙের মোহে, তার চিকন স্ফটিকে। 
নিউমার্কেটে হাতড়ে মরছি নিকেল সালফেট রঙা শাড়ি। 
প্যারামাউন্টের শরবতে খুঁজছি পার্কিন সাহেব কে। 
আলাদা আলাদা ফ্রুটি স্মেল চিনছি কুলে, কলায়... 
পচা আমণ্ড বাদামের তেতো গন্ধ? সেও তো তার জন্যেই। 
সুগন্ধি মাথা ধরার বাম? উইন্টার গ্রিন তেলের? 
তাও আমার বাঁহাতের খেল তখন। 
আমি সবই দিয়েছিলাম তাকে উজাড় করে। তবু সে আর আমার রইল কই? 
মঙ্গলকাব্য সে রঙ চেনে না। ম্যাজিক রিয়ালিজম সেই মজা বোঝে না। 
সাইফাই গল্প? সে তো সেসব সূক্ষ্ম গন্ধও পায়না। 
সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর ধুলোপড়া জার্নালে খুঁজেলে হয়ত পাবে তারা।  
কফিহাউসের নিঃস্ব টেবিলেও 
কিন্তু আমায় তো আর পাবেনা সে। 
যদিও সে ই ছিল আমার প্রথম ভ্যালেন্টাইন। 





 


৫ ফেব, ২০২২

একলা একলা গোটাসেদ্ধ

 মা, আমি এই প্রথম না গতবারেও একাহাতে সব বাজার করে গোটাসেদ্ধ করেছিলাম। তুমি তখন বিছানায় পড়ে।বারব্রত, স্ত্রীআচার, বিচার কিছুতেই হুঁশ ছিলনা। তবুও ছিলে একপাশটায় পড়ে। এবছর আমি আরও একা। তবুও সব মেনেছি মা। ঠিক যেমনটি শিখেছি তোমার কাছে। সব পেলেছি একাহাতে ঠিক যেমনটি এবাড়ির আচারবিচার। আমি বেছে বেছে ছোটো ছোটো গোল আলু, লাল আলু, শিম, কড়াইশুঁটি, কুলি বেগুণ সব এনেছি মা। একটার গায়েও দাগ নেই। বেঁকা ট্যারা নয়। তোবড়ানো বা ঠসকে যাওয়া নয় কেউ। সবুজ গোটা মুগ আনিয়েছি মা। সঙ্গে টকটকে লাল বড়বড় শুকনো লঙ্কা। ঠিক যেমন তুমি বলতে। নতুন সরষের তেলের প্যাকেট কেটেছি দিন কয়েক আগেই। নুনও তাই। অত তুমি মানতে না। বলতে সংসারের জিনিষই তো মা ষষ্ঠীর। এঁটোকাঁটা আবার কী? তোমার নিষ্ঠা ছিল কিন্তু ছুতমার্গ ছিলনা একদম। সেটাই আমার ভালো লাগত বড়। 

মা আমি পঞ্চমী তিথি না পেরোতেই গোটা সেদ্ধ, আতপচালের ভাত আর সজনে ফুল ছড়ানো কুলের অম্বল রেঁধে নিয়েছি। আমি ভাতের মধ্যে দুটো গোটা আলু সেদ্ধও দিয়েছি মনে করে। তুমি বলতে একটা তোমার ছেলের জন্য আরেকটা আমার ছেলের। রাতে শোওয়ার আগে ঠাণ্ডা ভাতে আজ জল ঢেলে দেব মনে করে ঠিক। তুমি তো নেই মনে করিয়ে দেবার তাই মনে রেখেছি গতবারের মত। কুলের অম্বলে সর্ষে ফোড়ন ভুলিনি মা। এবার সজনেফুলগুলো বাছতে হয়নি মা। কলেজ থেকে দিয়ে গেছে একদম জুঁইফুলের চেয়েও সাদা। গতকালের বৃষ্টিতে এক্কেবারে তাজা। আমি গোটাসেদ্ধর একটা আনাজ কিম্বা ডাল হাতায় করে টিপে দেখিনি মা। তুমি বকুনি দিতে। মনে আছে। বলতে ওগুলো আজ মা ষষ্ঠীর ছানা। টিপে মেরে ফেলবে না। ঢাকাচাপা দিয়ে রেখে দাও সারারাত। কাল দেখবে কেমন ন্যায়দম খেয়েছে। মুখ থেকে পাছে থুতু পড়ে তাই আমি কথা বলিনি মা, গোটাসেদ্ধ করতে গিয়ে। 

ও হ্যাঁ, মিষ্টি দই এনেছি মা। কাল ষষ্ঠীর শেষপাতের জন্য। মনে করে। সব ঠাণ্ডা। সব ঠান্ডাঠুন্ডি করলে এই ঋতু পরিবর্তনের সময় শরীর খারাপ হবেনা। গোটাসেদ্ধ দিয়ে পান্তা খেয়েই তুমি ছটফট করতে সেদিন দুপুরঘুমের জন্য। শেষবার মানে ২০২০ তে আমি যাব বইমেলায়। তুমি বললে, এই চলল মেয়ে আবার। কোথায় পান্তা খেয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে জম্পেশ ঘুম দেবে তা না। মনে পড়ছে সব। মনে আছে সব। ভুলতে তো পারছিই না আমি। কাল ভোরে আবার কনকনে ঠাণ্ডায় শিলনোড়া চান করিয়ে তেল, হলুদ, সিঁদুর জল...ভেজা গামছা গায়ে শিল... তাঁর কোলের কাছে জোড়া শিম, কড়াইশুঁটি... সব করতে পারি এখন একা একা। আমার একলা ঘরে। 

তবে আমি কিন্তু আমার ছেলে, বৌ দুজনের জন্যেই ষষ্ঠীর পয়সা তুলে রাখি কৌটোয়। দুর্গাষষ্ঠীতে একসঙ্গে সব ষষ্ঠীর পুজো দেব বলে। তুমি কিন্তু শুধু তোমার ছেলের মাথায় কয়েন ঠেকিয়ে কৌটোবন্দী করতে। আমার তাই দেখে খুব অভিমান হত মা। তুমি বলেছিলে সেবার "তোমার জন্য তোমার মা আছে"। বুক ফেটে গেছিল আমার সেদিন।