৩০ জুল, ২০১৩

ওয়েব ম্যাগাজিন সেমিনার

বন্ধু
আগামী ১২ই আগস্ট,  ২০১৩ সন্ধ্যে ৬টা থেকে ৯টার মধ্যে বাংলা একাডেমীর জীবনানন্দ সভাঘরে সকল সাহিত্যপ্রেমী এবং লেখক-পাঠককে উপস্থিত থাকতে অনুরোধ জানাই ।  বাংলাভাষায় ইন্টারনেটের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি ওয়েব ম্যাগাজিন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে ইতিমধ্যে । এক আকাশের নীচে সেই ওয়েবম্যাগাজিনের সম্পাদক মন্ডলী এবং গুণিজনের ভীড়ে, বন্ধু আপনার উপস্থিতি একান্ত কাম্য । 
সাথে র‌ইল আমন্ত্রণের ই-পত্র ।  


২৩ জুল, ২০১৩

বেথুন জার্নাল (২)


মার বেথুন কলেজ নিয়ে সবচেয়ে সুখের স্মৃতি হল ফড়িয়াপুকুরের টাউন স্কুলের পাশে স্যারের বাড়িতে সপ্তাহে একদিন করে পড়তে যাওয়াকে ঘিরে । আমরা বেথুনের সাত-আটজন প্রতি শনিবার কলেজ ছুটির পর হাঁটতে হাঁটতে হেদো থেকে বিধান সরণী হয়ে পৌঁছাতাম টাউন স্কুলের সামনে । আমাদের পথ-গল্পের মুচমুচে গসিপ আর রূপবাণী সিনেমা হলের উল্টোদিকের ভুজিয়াওয়ালার কুড়মুড়ে সাড়ে বত্রিশভাজা চলত মুঠো থেকে মুঠোর পরে । অনার্সের পড়ার চাপে আর কলেজ যাতায়াতের ক্লান্তি যেন শনিবারের নিয়মিত পথচলায় এক দমকা ঠান্ডা হাওয়া বয়ে আনত । আমাদের স্যার মানে প্রোফেসার বিবেক চ্যাটার্জি তখন জয়পুরিয়া কলেজের কেমিষ্ট্রির অধ্যাপক । নিঃসন্তান বিবেকবাবু ও ওনার স্ত্রী (আমাদের কাকীমা) যেন আমাদের সকলের পরিবারের দু'জন হয়ে উঠেছিলেন । জীবনের ভালোলাগা, মন্দলাগা, সাহিত্যচর্চা থেকে সিনেমা রিভিউ, পিকনিক যাওয়া থেকে হর্টিকালচারে সদলবলে ফ্লাওয়ার শো সবকিছুর সঙ্গী ছিলেন এই দুজন মানুষ । আমরা পড়তে যেতাম ইনর্গ্যানিক কেমিষ্ট্রি বা বাংলায় যাকে বলে অজৈব রসায়ন । স্যারের ঐটি স্পেশ্যালাইজেশান । কলেজের সবচেয়ে বোরিং ক্লাসগুলো বিবেকস্যারের কৃপায় যেন সবথেকে ইন্টারেস্টিং হয়ে উঠত । ওই বিষয়গুলো পড়তে ইচ্চে করত না যতক্সণ না স্যার বুঝিয়ে দিতেন গল্পের মত করে আর কোথা থেকে কতটুকুনি পড়তে হবে বলে দিতেন । বিশাল সিলেবাসের মধ্যে স্যারের পরামর্শ পেলে পড়তে আনন্দ হত । স্যার বলতেন " যে খাতা বা নিজের তৈরী করা নোটটা থেকে পড়তে শুরু করবে সেই নোটটাই পরীক্ষার শেষ দিন অবধি দেখে যাবে তবে মনে গেঁথে থাকবে ।
আমরা দলবেঁধে গল্প করতে করতে যেতাম স্যারের বাড়ি । কোনো কোনো দিন যেতে যেতে খিদে পেয়ে যেত খুব । টাউন স্কুলের নীচেই একটা মাদ্রাজী দোকানে অথেন্টিক দোসা পাওয়া যেত । দোসা খেতাম হৈ হৈ করে । তারপর শ্যামপুকুর স্ট্রীট দিয়ে স্যারের বাড়ি পৌঁছে আবার কাকীমর হাতের আচার অথবা পড়ানোর ব্রেকে স্যারের আনানো কচুরী-আলুরদম । বৃষ্টি পড়লেই আমাদের বরাদ্দ ছিল মোড়ের মাথার বিখ্যাত একটা দোকানের তেলেভাজা-মুড়ি । সেদিন আর পড়া হত না । ভূতের গল্প শুনতে বসতাম । কাকীমাও যোগ দিতেন আমাদের আসরে । এইভাবে চলত আমাদের কেমিষ্ট্রি টিউশান আর ফাঁকে ফাঁকে আমাদের অনাবিল আনন্দের মূহুর্তেরা ।
ইনর্গ্যানিক কেমিষ্ট্রির বোরিং লেকচারগুলো অনায়াস মনসিঁড়ি বেয়ে গেঁথে যেত মাথায় । বিবেকস্যারের অপত্যস্নেহে আর বৈচিত্রে সেই বোরিং লেকচারগুলো যেন ভালোলাগায় পরিণত হত । একটু পড়া একটু গান অথবা একটু খাওয়াদাওয়ার অনুষঙ্গ যে রেগুলার পড়াশোনায় কতটা জরুরী সেটা উপলব্ধি করেছিলাম কলেজে পড়াকালীন ।
১৯৮৫ এ ইন্দিরা গান্ধী যখন নিহত হলেন সারা কলকাতা জুড়ে কি অবস্থা । পথরোখো, বাস বন্ধ । আমাদের ফিজিক্স প্র্যাক্টিকাল পরীক্ষা ছিল । মনে আছে বাস টবিন রোড অবধি গিয়ে বলল আর যাবেনা । পরীক্ষা দিতে হবে বলে পায়ে হেঁটে টবিন রোড থেকে বিডন স্ট্রীট পৌঁছেছিলাম । ফেরার সময় শিয়ালদহ অবধি হেঁটে তারপর লোকাল ট্রেনে দক্ষিণেশ্বর ফিরে মনে হয়েছিল রাজ্য জয় করেছি । মনে মনে একদিকে যেমন পায়ে ব্যথার জন্য এ শহরকে কটাক্ষ করেছি আবার বাসের বিকল্প ট্রেনের সান্নিধ্যে এসে মনে হয়েছিল কি সুন্দর এই শহরের যাতায়াতের নেটওয়ার্ক ।
আরেকবার ৫ই জুন ১৯৮৪ । কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ট ওয়ান শুরু । বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম পরীক্ষা । সংস্কৃত কলেজে সিট পড়েছিল আমাদের । ৪ঠা জুন থেকে অবিরাম বর্ষণে শহর কলকাতা বিপর্যস্ত । আমাদের মফঃস্বলও জলমগ্ন ।
সকাল আটটায় বাড়ি থেকে বেরুলাম । একটি ৩২ নম্বর বাস শ্যামবাজার পাঁচমাথা মোড়ে নামিয়ে দিল । বিধানসরণীতে হাঁটু জল । সেন্ট্রাল এভিনিউ আর সার্কুলার রোডও তথৈবচ । একটি টানা রিক্সা ৫০টাকায় কলেজ স্ট্রীট পোঁছে দিতে রাজী হল । বাবার সাথে রিক্সায় চড়ে বসলাম । রিক্সার পাদানীতে থৈ থৈ জল । তখন না আছে সেলফোন না আছে ইন্টারনেট । এমন বন্যা কবলিত হয়ে আশা করেছিলাম অন্তত সংবাদের মাধ্যমে পরীক্ষা বন্ধের আদেশ দেবেন কর্তৃপক্ষ । কিন্তু সেখানে পৌঁছে অগণিত ছাত্রছাত্রী পরিবেষ্টিত আমি... কিছুটা ধিক্কার দিয়েছিলাম এ শহরকে । দশটা থেকে বারোটা বেজে গেল কিন্তু কোনো খবর এলনা । প্রশ্নপত্র পৌঁছায়নি তখনো আর আমরা ব্‌ইপত্র উল্টে চলেছি । বারাসাত, বসিরহাট থেকে যারা এসেছে তারা তখন ফিরে যাবার তোড়জোড় করছে । অশনি সঙ্কেতের মত প্রশ্নপত্র হাজির হল । বলা হল বেলা দুটোয় পরীক্ষা শুরু হবে । আমরা সেই না খাওয়া দাওয়া স্টেজে ম্লান মুখে পরীক্ষার হলে প্রবেশ করে দেখি কোনো বিজলীবাতি নেই । অতিবৃষ্টিতে ইলেকট্রিক কেবল জলের নীচে । মোমের আলোয় জীবনের প্রথম এবং কঠিন অনার্সের পরীক্ষা দিতে দিতে সোজা প্রশ্নের উত্তর গুলোও মনে পড়ছিলনা ঠিকঠাক । এভাবে চার ঘন্টা পার করে বাইরে এলাম । বাড়ি ফেরা হল আমার সেই বন্ধু মল্লিকার গাড়িতে ; ফিরে এসে দূরাদর্শনের সংবাদে ঘোষণা হল সেদিনের পরীক্ষা বাতিলের কথা । এত কাঠখড় পোড়ানো সেই পরীক্ষা বাতিলের খবরে খুব রাগ হয়েছিল এ শহরের ওপর আর পরীক্ষা কর্তৃপক্ষের ওপর । এমন নাম করা বিশ্ববিদ্যালয় ! তার কি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ! আমারো তখন ভোটাধিকারের বয়স । আমিও তো এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এক জনমত । কিন্তু এ কি হাল আমার শহরের !
কলকাতার নামকরা মিষ্টি কেসিদাসের বাড়ির মেয়ে মল্লিকার বাড়িতে আমাদের ছিল নিত্যি আনাগোনা । বাগবাজারের নবীন ময়রার বিখ্যাত সেই বাড়িটা ছিল আমাদের নিজের বাড়ির মত । কতবার যে ওর সাথে আমরা ঐ বাড়িতে গেছি তার ঠিক নেই । মল্লিকা খুব শান্ত স্বভাবের মেয়ে ছিল । ও বেশি কথা বলত না কিন্তু বলত তোরা বলে যা আমি শুনে মন্তব্য করব । কলেজ ছুটি থাকলে মল্লিকার সাথে আমার চলত পত্র বিনিময় । আমার লেখার ভীষণ ভক্ত ছিল সে । আমাকে সমানে মল্লিকা বলত "তুই কিন্তু লেখাটা চালিয়ে যা" আমি কোনো গুরুত্ব দিতামনা । মল্লিকার বাবা-মায়ের ২৫ বছরের বিয়ের তারিখে আমাকে কবিতা লিখতে বলেছিল । কুড়িবছরের সেই আমি ছাই তখন বিয়ের কি বুঝি !
যাইহোক লিখে ফেললাম একখানা। সেটা আবার ছাপিয়ে অতিথিদের হাতে হাতে বিলি করা হয়েছিল । আমার কাছে সেটা বিশেষ পাওনা । ওদের বাড়িতে যাওয়া মানেই এক থালা নানা রকম মিষ্টি ও নোনতা সহযোগে জলযোগ । কলেজজীবনের আনন্দটা আরেক কাঠি বেড়ে যেত সেই আতিথেয়তায় । তারপর মল্লিকা বায়োকেমিস্ট্রি নিয়ে মাস্টারস করল বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজ থেকে আর আমি গেলাম পিওর কেমিস্ট্রি পড়তে রাজাবাজারে ।

১৬ জুল, ২০১৩

বেথুন-জার্নাল -১

-->

মরা একপাল মেয়ে জড়ো হয়েছিলাম ১৯৮২ সালে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা পাসের পর কোলকাতার এক ঐতিহ্যবাহী মেয়েদের রক্ষণশীল কলেজে । সকলের মধ্যে দুটি বিষয় অন্ততঃপক্ষে কমন ছিল । এক হল সকলের কেমিস্ট্রি অনার্স আর দুই সকলেই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বেশ কনফিডেন্ট পড়াশুনোর ব্যাপারে । আমাদের অনেকের আবার আরো একটা জিনিস কমন ছিল সেটা হল কেমিস্ট্রি অনার্সের সাথে ম্যাথস আর ফিজিক্স । 
 

সেই ছাব্বিশ নম্বর ঘরটা ! কাঁচের সার্শি সরিয়ে, পুরোণো গন্ধ বুকে নিয়ে, খড়খড়ির দরজা ঠেলে অন্ধকার ঘরে ঢুকেছিলাম হুড়মুড় করে । কিছুটা উচ্চাশা নিয়ে আর কিছুটা দুরুদুরু বুকে । ভেতরে ঢুকতে না ঢুকতেই পচাডিমের হাইড্রোজেন সালফাইডের সেই চেনা উচ্চমাধ্যমিক গন্ধটা অবশ করে দিল সুষুম্না স্নায়ুগুলোকে ।

ব্যাক্তিত্ত্বময়ী জ্যোত্স্নাদি এসেছিলেন । অনেকটা সেই মূর্তিমতী করুণায় শ্রদ্ধা উপছে উঠেছিল । তারপর রেডক্স ইক্যুয়েশান ব্যালেন্সিংয়ের দাপটে কেমন যেন সব ওলটপালট ! আবার হাতীবাগানের ড্রেসের ঝুলে সব যেন উথালপাথাল... কিছুটা অনাস্বাদিত মুক্তির আস্বাদে, কিছুটা শেষ ঊণিশ-কুড়ির ভালোলাগায়, ফুচকার তেঁতুলগোলা জলে ...

কিন্তু মনের মধ্যে একটু আধটু খচখচানি সেই ছাব্বিশ নম্বরের । আমি অ-পাঙক্তেয় ন‌ই তো সেখানে ? আমার জীবন রসায়নের সাথে রসায়নের দোস্তি সত্যি হবে তো?
বরানগর থেকে প্রথম একা বেরুলাম বেথুন কলেজে ভর্তি হয়ে । বাবা কলেজে ভর্তি করে চেনালেন পথঘাট, দোকানপাট । ১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বর । ১৭ বছরের আমি । মফস্বলী শহর আলমবাজার থেকে নিয়মিত শুরু হল আমার কলকাতা অভিযান । ছোটবেলায় শ্যামবাজার যেতে হবে শুনলেই বাবা বলতেন "কোলকাতা" যেতে হবে । আমি ভাবতাম অনেক দূর বুঝি! কোলকাতা যাওয়া মনেই এটা ওটা সেটা । শ্যামবাজার থেকে ড্রাই ফ্রুটস, ফড়িয়াপুকুরের অর্ফ্যানের চা পাতা, অমৃত'র লাল দৈ, জলোযোগের প্যাটিস আরো কত বলব ! ঠাকুমার জাফরাণী জর্দা, ঘোষকাজিনে চোখ দেখিয়ে চশমা করতে দেওয়া কিম্বা কুমার্স কনসার্ণ থেকে আঁকার স্কুলের রঙ-তুলি ! বাবা চেনাতেন পথঘাট । পাঁচমাথার মোড়ে পাঁচটা বড় রাস্তা কোন্‌টির কি নাম ও তারা সব শেষে কোথায় গিয়ে পড়েছে । পঞ্চমুন্ডির আসনে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে নেতাজী সুভাষের ইতিবৃত্ত ! কিছুটা অজানা আনন্দ আর সাথে কিছুটা অচেনা ভয় নিয়ে শুরু হল কলেজ জীবন । এতদিন ছিল মা-বাবার হাত ধরে শখের বাজার । এখন সেটা নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হল ।
কলেজ কেটে রূপবাণী সিনেমায় দু একবার সিনেমা ও হাতীবাগানের স্টার থিয়েটারে মায়ের সাথে সুপ্রিয়া দেবীর "বালুচরী" দেখেছি । ফেরার পথে সিলভার ভ্যালী রেস্তোরাঁয় কবিরাজী কাটলেট ভুলতে পারিনি এখনো । হাতীবাগানে একটা পেন সারানোর দোকান ছিল । নাম "পেন কেবিন্" । আমরা ফাউন্টেন পেন ব্যবহার করতাম । তাই ভালো মন্দ নানা পেনের নিব বদলানো লেগেই থাকত । এখনকার মত "ইউস এন্ড থ্রো" এর বাতাবরণ ছিলনা । কলেজ বান্ধবী মল্লিকা তখন টেনে নিয়ে যেত ওর বাড়ি । রসোগোল্লা আবিষ্কারক নবীন চন্দ্র দাসের বাগবাজারের বাড়িতে । বহুবার গেছি আর কে সি দাসের লোভনীয় সব মিষ্টিতে উদরপূর্তি করে বাড়ি ফিরেছি । কি আতিথেয়তা তাঁদের !
বিবেকানন্দের সিমলে স্ট্রীটের পাশে বিডন স্ট্রীটের ওপর জন ডিঙ্কওয়াটার বেথুন সাহেবের কলেজে।উল্টোদিকে হেদুয়ার সরোবর আর স্কটিশচার্চ কলেজ । বৈকুন্ঠ বুক হাউসে অনার্সের প্রথম ব‌ইট‌ই কেনা ; কলেজ ফেরত স্বাস্থ্যকর সুখাদ্যের হ্যাবিট ধরানোর জন্য সিমলেপাড়ার বিখ্যাত আইসক্রিম সন্দেশের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন অভিভাবক । দক্ষিণেশ্বর-বাবুঘাট, মিনিবাস রুট নং ১৫৮ তে চড়ে রোজ কলেজ যেতাম । কোনোদিন আবার আড়িয়াদহ-বাবুঘাট, মিনিবাস রুট নাম্বার ১৮১তে চড়ে শ্যামবাজারে নেমে বিধান সরণীর ট্রামে করে । বিধান সরণীর নাম ছিল একসময় কর্ণওয়ালিস ষ্ট্রীট । তখন আলমবাজার থেকে বিডন স্ট্রীট যেতে মিনিবাসে লাগত ১টাকা ৫ পয়সা । সেই ৫ পয়সা আজ অবলুপ্ত আর মিনিবাসের সেই চেহারাও বদলেছে । প্রায়শ‌ই বাসে উঠত বরানগর বাজার থেকে কাশীপুরের সুমিত্রা অথবা বাসবী ।
কোলকাতার পথঘাট চিনেছি কলেজবেলায় । প্রায়শই পাঁচমাথার মোড়ে জ্যাম থাকার দরুণ আরজিকর রোড দিয়ে বাস ঘুরে দীনেন্দ্র স্ট্রীট দিয়ে বেরিয়ে বিধানসরণী ধরত । বুক ধড়পড় করত অচেনা জায়গা দিয়ে যখন বাস যেত কিন্তু ঐ ভাবে এঁকে বেঁকে বাস যখন আমাকে বেথুন কলেজের সামনে নামিয়ে দিত তখন এই শহরটার ওপর বেশ অদ্ভূত ভালোলাগায় আবিষ্ট হতাম ।
ভরতবর্ষের প্রথম মহিলা কলেজ বেথুন কলেজ । প্রতিষ্ঠাতা জন ইলিয়ট ড্রিংকওয়াটার বেথুন । সেযুগে আমাদের দেশে নারীশিক্ষা প্রসারে যাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য । ১৮৪৯ এ তিনি স্থাপন করেন বেথুনস্কুল ও পরে ১৮৭৯ এ বেথুন কলেজ নির্মিত হয় । আমাদের সময় বেথুন কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন শ্রীমতী দীপ্তি ত্রিপাঠী । কলেজে ভর্তির পর শুনেছিলাম আরো অনেক মহিয়সীর নাম যাঁরা এখান থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলেন ।এঁদের মধ্যে সুখলতা রাও অন্যতম । আমাদের বাংলাভাষায় হাতেখড়ি হবার সাথে সাথে যাঁর অ, আ ক, 'র ছড়ার ব‌ই পড়ে আমাদের স্কুল যাবার ভিত তৈরী হয়েছিল । বেথুনে পড়েছিলেন মহিলা কবি কামিনী রায় যাঁর কবিতা আমাদের একাধিকবার সিলেবাসের মধ্যে ছিল । এছাড়া স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রীতিলতা ওয়াদেদার পড়েছিলেন এই কলেজে । নেতাজী সুভাষচন্দ্রের খুব কাছের বন্ধু, সে যুগের রাজনৈতিক এবং সমাজসংস্কারক লীলা রায় (আগে নাগ ছিলেন ) সে যুগে বেথুন কলেজ থেকে ইংরেজীতে প্রথম হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গোল্ড-মেডেল পেয়ে ছিলেন । এছাড়াও রয়েছেন পদ্মাবতী স্মর্ণপদক প্রাপ্তা সরলা দেবীচৌধুরাণী , শ্রীমতী সীতাদেবী, ডাঃ দীপ্তি ত্রিপাঠী, বৈজ্ঞানিক ডাঃ অসীমা চট্টোপাধ্যায়, থিয়েটার ও ছায়াছবি ব্যাক্তিত্ত্ব শোভা সেন, সঙ্গীতজ্ঞা পূরবী মুখোপাধ্যায়, নৃত্যশিল্পী মঞ্জুশ্রী চাকী, বাচিকশিল্পী ব্রততী বন্দোপাধ্যায় যাঁরা এই বেথুন কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশান করেছিলেন । বেথুন কলেজের দুজন প্রথম গ্র্যাজুয়েট হলেন ডাঃ কাদম্বিনী গাঙ্গুলী এবং শিক্ষাবিদ চন্দ্রমুখী বসু । ১৮৮৩ সালে এঁরা বেথুন কলেজ থেকে পাশ করেন । গ্র্যাজুয়েশানের পর কাদম্বিনী দেবী কলকাতা মেডিকেল কলেজে ডাক্তারী পড়েন । আর চন্দ্রমুখীদেবী বেথুন কলেজে লেকচারার পদে যোগ দেন । আমার ১৯৮৩ সালে বেথুন কলেজে সেকেন্ড ইয়ার । সেবছর এই প্রথম দু'জন মহিলার গ্র্যাজুয়েশানের শতবছর উদ্‌যাপন মহা আড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল । নানারকম বর্ণময় অনুষ্ঠান এবং খাওয়াদাওয়ার মধ্যে দিয়ে পালিত হয়েছিল সেই সেন্টিনারি । বেথুন কলেজের গ্র্যাজুয়েট হবার সুবাদে আর ঠিক ঐ বছরেই স্টুডেন্ট হিসেবে উপস্থিত থাকার সুবাদে আমিও খুব গর্বিত ।

৯ জুল, ২০১৩

ঘটি-বাঙালের কাজিয়া শুনে বড় হয়েছি যে...


-->

এহেন "আমি"র শিরা-উপশিরায় শতকরা পঞ্চাশ ভাগ বাঙাল রক্ত ও বাকী পঞ্চাশ ভাগ ঘটি রক্ত বহমান । আমার মায়ের বাবা এবং বাবার মা দুজনের বাংলাদেশের খুলনাজেলার সাতক্ষীরায় জন্ম । তাই এহেন "আমি" সেই অর্থে হাফ বাঙাল ও হাফ ঘটি । অন্তত: আমার শ্বশুরালায়ের মন্তব্য তাই । ইলিশ আর চিংড়ি দুইয়ের সাথেই আমার বড় দোস্তি । যেমন রাঁধতি পারি ঝরঝরে ভাত তেমন ভাজতি পারি ফুলকো ফুলকো নুচি। তবে ঘটির ওপর আমি পক্ষপাতদুষ্ট । কারণ রক্ত ।
উপাদেয় পোস্তর বড়ার স্বাদ পেতে আমাকে ছুটতে হয় বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার বন্ধুর বাড়িতে । আর নারকোল-বড়ি দেওয়া মোচার ঘন্ট খাবার জন্যে আমাকেই ছুটতে হয় রান্নাঘরে । আমাদের ঘটি বাড়ির হেঁশেল আবার একটু বেশি মিষ্টি তাই বেশির ভাগ রান্নাবান্নাই শর্করায় পুষ্ট । কুটিঘাটের মেয়ে আমার দিদিমা ছিলেন খাস ঘটিবাড়ির মেয়ে । বিয়ের পরদিন বাঙাল শ্বশুরবাড়ির রান্নায় চিনি ছড়িয়ে খেয়েছিলেন । তাই বোধহয় আমার ঠাকুরদাদার মুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনেছি । সব ক্রিয়াপদে এলুম, গেলুম, খেলুম মার্কা কথা । আমাদের বন্ধুরা হেসে বলত এই এল হালুম-হুলুম করতে । কি আর করি ! জন্ম-দোষ যে!
স্কুল থেকে ফিরে বন্ধুরা সকলে ভাত খেত আর আমরা খেতাম লুচি-পরোটা বা রুটি কিন্তু দুবেলা ভাত নৈব নৈব চ ! কি আর করে বন্ধুরা! ওদের মা ময়দার কাজে মোটেও পটু নন, ভাতের রকমারিতে পটু তাই ঘটির বৈকালিক জলযোগের ময়দা বুঝি ওদের কাছে অধরা ।
ওদের সেই চিতলামাছের মুইঠ্যা একবগ্গা মাছের এক্সোটিক ডিশ ফর গ্যাস্ট্রোনমিক তৃপ্তি । আর কালোজিরে-কাঁচালঙ্কা দিয়া ইশে... সেই বাদলা দিলে কাদলা মাছের পাদলা ঝোল না খেয়ে কাতলার ক্রোকে, দৈ-মাছ, কোর্মা, মাছের পোলাও, মাছের কচুরী, চপ আরো কত বলব ! ঘটি হেঁশেলে শুঁটকি ফুটকির নো এন্ট্রি ! একবার বাঙাল-ঘটির কাজিয়ায় আমার ঠাকুর্দা তার এক বাঙাল বন্ধুকে বলেছিলেন "কচুরী আর রাধাবল্লভীতে যে বিস্তর ফারাক সেটাই জানোনা? আর কি করেই বা জানবে "ময়দার" ব্যাপারে তোমাদের তো হাঁটুতে খঞ্জনী বাজে। চাড্ডি ভাত চাপিয়েই খালাস তোমরা । জমিয়ে মিষ্টি মিষ্টি নাউ-চিংড়ি খাও মশাই। দেখবে মনের কাদা সাদা হয়ে গেছে । এট্টু চিনি ছড়িয়ে কড়াইয়ের ডাল আর ঝিঙেপোস্ত খাও । দিল খুশ হয়ে যাবে । মিষ্টি কথা কি এমনি কৈতে পারি? মিষ্টি মিষ্টি ব্যবহার কি এমনি পারি! সবের মূলে ঐ ঘেটো মিষ্টি"
বাজার গেছি একবার জ্যাঠামশাইয়ের হাত ধরে । সদ্য কৈশোরে পা দিয়েছি তখন । পুলিশে কর্মরত জ্যাঠামশাই তাঁর চাঁচাছোলা ভাষায় গঙ্গার ঘাটে তাঁর এক পুরোণো সহপাঠীকে বলছেন :
"তোমরা হলে গিয়ে, ইশে "অরিজিনাল দেশি" তাই বলে আমরা এবরিজিনাল দেশি ন‌ই গো দাদা ! এট্টু ঘুসোচিংড়ির বড়া খেয়ে দ্যাখেন মশাই ! অথবা কষে চিনি দিয়ে ছোলারডাল আর ঐ আপনাগো "ময়দা" মানে আমাগো "নুচি" । চিল্লোতে পারিনা আমরা, আট ডেসিবেল কি সাধে ক্রস করিনা? ভেতরটা সত্যিসত্যি মিষ্টি হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে"
জ্যাঠামশাইকে আমরা জ্যাঠা বলতাম । খুব রসিক মানুষ ছিলেন । আর বাঙাল দেখলেই তাকে কচুকাটা করে দিতেন, কেন তা জানিনা। ওনার অফিসে একজন পেটরোগা কন্ষ্টেবল ছিল । প্রায়ই সে কাজে আসতে লেট করত । লোকটির পেটের ব্যারাম ছিল । সে জ্যাঠামশাইকে দেখলেই সেলাম করত ভয়ে ভয়ে আর তখুনি জ্যাঠা নিজের পেটটা বাজিয়ে তাকে বলত "প্যাটের ভিতর গেস হৈসে, চুয়া চুয়া ডেকুর মারে?"
একবার ওনার এক বাঙাল কনস্টেবলের ছেলে পরীক্ষায় পাশ না করে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে পুলিশে বেয়ারার চাকরীর জন্য দরখাস্ত দিয়েছে । জ্যাঠামশাইকে আগেই তার বাবা বলে দিয়েছে "স্যার, আমার ছেলেটা সব লিখেছিল কিন্তু ইংরেজীটায় মোটে চোদ্দ পেয়ে গেল এবার, তাই আর পাশ করতে পারলনা"
সে ছেলেকে প্রশ্ন করার আগেই জ্যাঠা হাসতে হাসতে বলে বসল "কি ল্যাখসি জানিনা তবে চোদ্দ পাসি"
আরেকটা গল্প জ্যাঠা প্রায়ই বলতেন আমাদের । একজন কানহার জঙ্গলে বাঘ দেখে এসে ভয়ানক অত্যুক্তি করে বলছে । যত না বাঘ দেখেছে তার চেয়ে অতিরঞ্জিত তার বাঘের দৈর্ঘ্য । লোকটির গিন্নীও তার সঙ্গে গেছিল তাই সে প্রকৃত দৈর্ঘ্য সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল । বারবার লোকটি অমন বাঘের গল্প শোনায় আর তার বৌ ভাবে এমন মিথ্যা বলে কেন তার স্বামী ! তারা তো ছোট্ট একটা বাঘের ল্যাজের দিকটা একটু দেখেও ঠিক মত দেখতে পায়নি , ভারি লজ্জা হত বৌটির । বৌ বলেছে দ্যাখো, এবার তুমি যখন তোমার বন্ধুদের ঐ গল্প আবার শোনাবে আমি পাশের ঘর থেকে জোরে জোরে কাশব আর তুমি তখন বাঘের সাইজটা কমাবে কিন্তু। লোকটি বলতে শুরু করেছে আট-দশ-বারো.. হাত যেই বলেছে তার বৌ কেশে উঠেছে । খুব কাশছে বৌটি । তখন লোকটি বলছে "গিন্নী, তুমি কাইস্যা কাইস্যা মৈরা গ্যালেও আমি দশ হাতের নীচে নামুম না "
এভাবেই আমি এলুম, দেখলুম, ছিলুম বলে । একবার জ্যাঠামশাইয়ের স্পেশাল ব্রাঞ্চের আপিস গেলুম, আমের সময় মিষ্টি আঁব খেলুম, হ্যান্ডলুম পরলুম ! এতে লজ্জার কিছু নেই । আমাদের রান্নার সোশ্যাইটি জুড়ে, হেঁশেলের ঝুলকালিতে শুধু একটাই কথা :

শুক্তো, ঘন্ট, ছ্যাঁচড়া, সাথে অম্বল আমড়া ।
চিনির রসে হাবুডুবু ঘটির প্রাণে খুশি
ঝাল-ঝাল-টক-টক-মেছো শুঁটকি বাসি ।
নাউ-নঙ্কা-নেবু-নুচি-নেপ-নাট্টু-নাটাই
বিঘা বিঘা ধানজমি আর তালদীঘিটা নাই।
রামদা নিয়ে, চোখ পাকিয়ে আসি নাকো তেড়ে
ঝগড়া করার জোর যে নাই লড়ব কেমন করে ?

১ জুল, ২০১৩

স্মৃতিরূপেণ-১


মামারবাড়ি দক্ষিণেশ্বরে মায়ের ডেলিভারি পেন উঠেছিল ।  তখন পৌষমাসের ঠান্ডায় মা নাকি দাপুটে ব্যাথায় ঘেমে নেয়ে সারা । পাড়াপড়শীর মতে ছেলে হওয়াটাই স্বাভাবিক । তবুও ছেলে হতে হতে মেয়ে । কি কুলুক্ষুণে জানিনা!

যাইহোক, উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারের নার্সিংহোমে ঘুমবিছানার বেবিকটে  প্রথম আলো দেখা... প্রথম কান্নার সাথে হাতেখড়ি ।

সকলে মা'কে বলেছিল "প্রথম মেয়ে সন্তান হোলো"?

মা বলেছিল  "কেন? আমার বন্ধু হবে, রুটি বেলে দেবে, আর আমরা সিনেমা যাব একসাথে "

অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মা বঙ্কিমের "ইন্দিরা" পড়েছিলেন  । সেই থেকে ঐ নামের ওপর ভালোলাগা ।

তবুও ১৯৬৫ সালেও নাক সিঁটকোনো ভাবসাব বাড়ির সকলের । বাবা  কিন্তু সিস্টারদের বখশিস দিয়েছিলেন "মেয়ে" হবার খবরটা জানানোর জন্য ।

দিদা বলেছিল "আমাদের বাড়ির মত রং পেলনা"

মা বলেছিল "হীরের আংটি, আবার বেঁকা !  যেমন তেমন মেয়ে বিয়োবো, বয়সকালে গুণ দেখাবো"

কি গুণ যে মা দেখালেন জানিনা তবে আমার গ্রুমিংটা সম্পূর্ণ মায়ের জন্য সম্ভব হয়েছিল । আড়িয়াদহে গঙ্গার তীরে বাবাদের ভাগের বাড়িতে এসেছিলাম মুখেভাতের সময় । পাশে পুকুর, পেছনে ঘন সিংহি বন আর পুরোণো বাড়ির ফাটল থেকে উঁকিঝুঁকি দেওয়া তেঁতুলে বিছে । বাবা জমি কিনে বাড়ি করলেন  কিছুদূরে আলমবাজারে ।  বাড়িতেই আমার পড়াশোনা শুরু হল মায়ের কাছে । আর রোজ দুপুরে, রাতে শোয়ার আগে গল্প পড়ে শোনানো শুরু মায়ের । বাবা বলত যুদ্ধের গল্প, পশুপাখীর গল্প । মা পড়ে শোনাত রুশ দেশের উপকথা, উপেন্দ্রকিশোরের মহাভারতের গল্প । নিজে নিজে পড়তে শুরু করলাম কিছুপরে । পাঁচবছরের জন্মদিনে দাদু উপহার দিলেন "আবোলতাবোল" ।  বাবা দিলেন পুতুল । 

সুকুমার-সাহিত্য মজ্জাগত হতে হতে হাতে এল "ছোটদের বুক অফ নলেজ" । সে ব‌ই আমার চেয়েও ভারী । সেই ব‌ইকে বালিশে রেখে আমি বসতাম খাটে আর উল্টে যেতাম পাতাগুলো । হঠাত সেই পাতা উল্টোতে গিয়ে এসে পড়ল ইস্কুলবেলা । সাথে গানভাসি হল কৈশোর । 

স্কুলে ভর্তির আগেই মোটামুটি দ্বিতীয়শ্রেণীর পাঠ কমপ্লিট । মুখে মুখে আর লিখে লিখে । মফস্বলের নাম করা মেয়েদের স্কুল বরানগর রাজকুমারী বালিকা বিদ্যালয়ে সেই ভর্তি হওয়া পাঁচবছরে ক্লাস টু'তে । পুরোণো কোলকতার মেয়েদের স্কুলগুলোর মধ্যে অন্যতম । প্রথম চালু হয়েছিল বিজ্ঞান শাখা । আর ছিল কেতাদুরস্ত ল্যাবরেটারি । লাইব্রেরীতেও ছিল বিশাল ব‌ইয়ের সম্ভার । ছিল খেলার মাঠ । একটা প্রকান্ড চেরী গাছ আর তার পাশে লিলিপুল । মাঠের একদিকে ছোটমোট গ্রিণ হাউস । অনামা সব ফুলেল ক্যাকটাস থাকত সেই গ্রিণহাউসে। স্কুলের দুটো গেট । একটা কেবল সকালে খুলত প্রাথমিক সেকশানের জন্য আর দুপুরে খুলত দুটোই  । দুই গেটের মাথায় জুঁইফুলগাছের আর্চ আর দুই গেট পেরিয়ে স্কুল অফিসে ঢোকার মুখে দুপাশে গোলাপের কেয়ারি । কি সুন্দর পরিবেশ !  রাজকুমারীদেবীরা ক্রিশ্চান ছিলেন ।   স্কুলের মধ্যে ছিল একটা সেমেটারি ।  সেমেটারীতে বসে টিফিন খেতাম আমরা ।

স্কুলের বাতাবরণ রবীন্দ্রগানে উদ্বুদ্ধ করেছিল । প্রতিবছর স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠান আর বর্ষাশেষে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে রবীন্দ্রচর্চা অব্যাহত ছিল বারোটা বছর ।

বাড়িতে হত ক্লাসিক্যাল গানের চর্চা । জ্যাঠামশাই ছিলেন বেতারশিল্পী, তারাপদ চক্রবর্তীর ছাত্র । মায়ের কাছে কীর্তনে নাড়া বেঁধে নেওয়া খুব ছোট বয়সে । মা ছিলেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ছাত্রী ।

গ্রীষ্মের   ছুটির পরেই  বৃক্ষরোপণ উত্সবের তোড়জোড়  । দস্তুর মত রিহার্সাল কমন রুমে । বনমহোত্সবের একটা স্ক্রিপট বছর বছর হয়ে আসছে । একটু রদ বদল করে কয়েকটা গান এদিক ওদিক করে নৃত্যনাট্য দাঁড় করানো হয়। সবুজ গাছ লাগানো হয় । খুব উত্সাহে মেয়েরা নাচ গান প্র্যাকটিস করে প্রতিবছর । অনুষ্ঠান শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের গান 'আয় আমাদের অঙ্গনে, অতিথিবালক তরুদল ' দিয়ে আর শেষ হয় 'মরুবিজয়ের কেতন ওড়াও, এ শূন্যে ওড়াও ওড়াও হে প্রবল প্রাণ' দিয়ে ।   প্রথম দৃশ্যে একদল মেয়ে নেচে নেচে মঞ্চে এসে প্রবেশ করে আর শেষ দৃশ্যে তারাই আবার প্রত্যেকে হাতে একটা করে সবুজ চারা গাছ নিয়ে  মঞ্চ থেকে নেমে এসে খোলা স্কুল মাঠের ধার দিয়ে নেচে নেচে চলে । গাইতে থাকে বাকি সকলে যারা এতক্ষণ ধরে গান পরিবেশন করছিল । নাচের মেয়েদের মেঘ রংয়ের শাড়ি আর সবুজ উড়নি মাথায় । গানের মেয়েরা কচিকলাপাতা রঙের শাড়ি আর মেঘ নীল ব্লাউজে । আগে থেকে স্কুলের মালি যেখানে যেখানে নতুন গাছ পোঁতা হবে তার জন্য মাটি খুঁড়ে নির্দ্দিষ্ট ব্যাবধানে গর্ত করে রাখে । নাচের মেয়েরা  নাচ করতে করতে একে একে  গাছগুলি সেইখানে রেখে দেয় আর গানের মেয়েরা জলঝারি দিয়ে জল দান করে সেই নতুন গাছের চারায় ।  এভাবেই হয়ে আসছে বছরের পর বছর ।