-->
আমরা
একপাল মেয়ে জড়ো হয়েছিলাম ১৯৮২
সালে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা
পাসের পর কোলকাতার এক ঐতিহ্যবাহী
মেয়েদের রক্ষণশীল কলেজে ।
সকলের মধ্যে দুটি বিষয় অন্ততঃপক্ষে
কমন ছিল । এক হল সকলের কেমিস্ট্রি
অনার্স আর দুই সকলেই উচ্চমাধ্যমিক
পাশ করে বেশ কনফিডেন্ট পড়াশুনোর
ব্যাপারে । আমাদের অনেকের
আবার আরো একটা জিনিস কমন ছিল
সেটা হল কেমিস্ট্রি অনার্সের
সাথে ম্যাথস আর ফিজিক্স ।
সেই
ছাব্বিশ নম্বর ঘরটা !
কাঁচের
সার্শি সরিয়ে,
পুরোণো
গন্ধ বুকে নিয়ে,
খড়খড়ির
দরজা ঠেলে অন্ধকার ঘরে ঢুকেছিলাম
হুড়মুড় করে । কিছুটা উচ্চাশা
নিয়ে আর কিছুটা দুরুদুরু বুকে
। ভেতরে ঢুকতে না ঢুকতেই
পচাডিমের হাইড্রোজেন সালফাইডের
সেই চেনা উচ্চমাধ্যমিক গন্ধটা
অবশ করে দিল সুষুম্না স্নায়ুগুলোকে
।
ব্যাক্তিত্ত্বময়ী
জ্যোত্স্নাদি এসেছিলেন ।
অনেকটা সেই মূর্তিমতী করুণায়
শ্রদ্ধা উপছে উঠেছিল । তারপর
রেডক্স ইক্যুয়েশান ব্যালেন্সিংয়ের
দাপটে কেমন যেন সব ওলটপালট !
আবার
হাতীবাগানের ড্রেসের ঝুলে
সব যেন উথালপাথাল...
কিছুটা
অনাস্বাদিত মুক্তির আস্বাদে,
কিছুটা
শেষ ঊণিশ-কুড়ির
ভালোলাগায়,
ফুচকার
তেঁতুলগোলা জলে ...
কিন্তু
মনের মধ্যে একটু আধটু খচখচানি
সেই ছাব্বিশ নম্বরের । আমি
অ-পাঙক্তেয়
নই তো সেখানে ?
আমার
জীবন রসায়নের সাথে রসায়নের
দোস্তি সত্যি হবে তো?
বরানগর
থেকে প্রথম একা বেরুলাম বেথুন
কলেজে ভর্তি হয়ে । বাবা কলেজে
ভর্তি করে চেনালেন পথঘাট,
দোকানপাট
। ১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বর ।
১৭ বছরের আমি । মফস্বলী শহর
আলমবাজার থেকে নিয়মিত শুরু
হল আমার কলকাতা অভিযান ।
ছোটবেলায় শ্যামবাজার যেতে
হবে শুনলেই বাবা বলতেন "কোলকাতা"
যেতে
হবে । আমি ভাবতাম অনেক দূর
বুঝি!
কোলকাতা
যাওয়া মনেই এটা ওটা সেটা ।
শ্যামবাজার থেকে ড্রাই ফ্রুটস,
ফড়িয়াপুকুরের
অর্ফ্যানের চা পাতা,
অমৃত'র
লাল দৈ,
জলোযোগের
প্যাটিস আরো কত বলব !
ঠাকুমার
জাফরাণী জর্দা,
ঘোষকাজিনে
চোখ দেখিয়ে চশমা করতে দেওয়া
কিম্বা কুমার্স কনসার্ণ থেকে
আঁকার স্কুলের রঙ-তুলি
! বাবা
চেনাতেন পথঘাট । পাঁচমাথার
মোড়ে পাঁচটা বড় রাস্তা কোন্টির
কি নাম ও তারা সব শেষে কোথায়
গিয়ে পড়েছে । পঞ্চমুন্ডির
আসনে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে নেতাজী
সুভাষের ইতিবৃত্ত !
কিছুটা
অজানা আনন্দ আর সাথে কিছুটা
অচেনা ভয় নিয়ে শুরু হল কলেজ
জীবন । এতদিন ছিল মা-বাবার
হাত ধরে শখের বাজার । এখন সেটা
নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হল ।
কলেজ
কেটে রূপবাণী সিনেমায় দু একবার
সিনেমা ও হাতীবাগানের স্টার
থিয়েটারে মায়ের সাথে সুপ্রিয়া
দেবীর "বালুচরী"
দেখেছি
। ফেরার পথে সিলভার ভ্যালী
রেস্তোরাঁয় কবিরাজী কাটলেট
ভুলতে পারিনি এখনো । হাতীবাগানে
একটা পেন সারানোর দোকান ছিল
। নাম "পেন
কেবিন্"
।
আমরা ফাউন্টেন পেন ব্যবহার
করতাম । তাই ভালো মন্দ নানা
পেনের নিব বদলানো লেগেই থাকত
। এখনকার মত "ইউস
এন্ড থ্রো"
এর
বাতাবরণ ছিলনা । কলেজ বান্ধবী
মল্লিকা তখন টেনে নিয়ে যেত
ওর বাড়ি । রসোগোল্লা আবিষ্কারক
নবীন চন্দ্র দাসের বাগবাজারের
বাড়িতে । বহুবার গেছি আর কে
সি দাসের লোভনীয় সব মিষ্টিতে
উদরপূর্তি করে বাড়ি ফিরেছি
। কি আতিথেয়তা তাঁদের !
বিবেকানন্দের
সিমলে স্ট্রীটের পাশে বিডন
স্ট্রীটের ওপর জন ডিঙ্কওয়াটার
বেথুন সাহেবের কলেজে।উল্টোদিকে
হেদুয়ার সরোবর আর স্কটিশচার্চ
কলেজ । বৈকুন্ঠ বুক হাউসে
অনার্সের প্রথম বইটই কেনা
; কলেজ
ফেরত স্বাস্থ্যকর সুখাদ্যের
হ্যাবিট ধরানোর জন্য সিমলেপাড়ার
বিখ্যাত আইসক্রিম সন্দেশের
সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন অভিভাবক
। দক্ষিণেশ্বর-বাবুঘাট,
মিনিবাস
রুট নং ১৫৮ তে চড়ে রোজ কলেজ
যেতাম । কোনোদিন আবার
আড়িয়াদহ-বাবুঘাট,
মিনিবাস
রুট নাম্বার ১৮১তে চড়ে
শ্যামবাজারে নেমে বিধান সরণীর
ট্রামে করে । বিধান সরণীর নাম
ছিল একসময় কর্ণওয়ালিস ষ্ট্রীট
। তখন আলমবাজার থেকে বিডন
স্ট্রীট যেতে মিনিবাসে লাগত
১টাকা ৫ পয়সা । সেই ৫ পয়সা আজ
অবলুপ্ত আর মিনিবাসের সেই
চেহারাও বদলেছে । প্রায়শই
বাসে উঠত বরানগর বাজার থেকে
কাশীপুরের সুমিত্রা অথবা
বাসবী ।
কোলকাতার
পথঘাট চিনেছি কলেজবেলায় ।
প্রায়শই পাঁচমাথার মোড়ে জ্যাম
থাকার দরুণ আরজিকর রোড দিয়ে
বাস ঘুরে দীনেন্দ্র স্ট্রীট
দিয়ে বেরিয়ে বিধানসরণী ধরত
। বুক ধড়পড় করত অচেনা জায়গা
দিয়ে যখন বাস যেত কিন্তু ঐ
ভাবে এঁকে বেঁকে বাস যখন আমাকে
বেথুন কলেজের সামনে নামিয়ে
দিত তখন এই শহরটার ওপর বেশ
অদ্ভূত ভালোলাগায় আবিষ্ট
হতাম ।
ভরতবর্ষের
প্রথম মহিলা কলেজ বেথুন কলেজ
। প্রতিষ্ঠাতা জন ইলিয়ট
ড্রিংকওয়াটার বেথুন । সেযুগে
আমাদের দেশে নারীশিক্ষা
প্রসারে যাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য
। ১৮৪৯ এ তিনি স্থাপন করেন
বেথুনস্কুল ও পরে ১৮৭৯ এ বেথুন
কলেজ নির্মিত হয় । আমাদের সময়
বেথুন কলেজের প্রিন্সিপাল
ছিলেন শ্রীমতী দীপ্তি ত্রিপাঠী
। কলেজে ভর্তির পর শুনেছিলাম
আরো অনেক মহিয়সীর নাম যাঁরা
এখান থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলেন
।এঁদের মধ্যে সুখলতা রাও
অন্যতম । আমাদের বাংলাভাষায়
হাতেখড়ি হবার সাথে সাথে যাঁর
অ, আ
ক, খ'র
ছড়ার বই পড়ে আমাদের স্কুল
যাবার ভিত তৈরী হয়েছিল । বেথুনে
পড়েছিলেন মহিলা কবি কামিনী
রায় যাঁর কবিতা আমাদের একাধিকবার
সিলেবাসের মধ্যে ছিল । এছাড়া
স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রীতিলতা
ওয়াদেদার পড়েছিলেন এই কলেজে
। নেতাজী সুভাষচন্দ্রের খুব
কাছের বন্ধু,
সে
যুগের রাজনৈতিক এবং সমাজসংস্কারক
লীলা রায় (আগে
নাগ ছিলেন )
সে
যুগে বেথুন কলেজ থেকে ইংরেজীতে
প্রথম হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে
গোল্ড-মেডেল
পেয়ে ছিলেন । এছাড়াও রয়েছেন
পদ্মাবতী স্মর্ণপদক প্রাপ্তা
সরলা দেবীচৌধুরাণী ,
শ্রীমতী
সীতাদেবী,
ডাঃ
দীপ্তি ত্রিপাঠী,
বৈজ্ঞানিক
ডাঃ অসীমা চট্টোপাধ্যায়,
থিয়েটার
ও ছায়াছবি ব্যাক্তিত্ত্ব
শোভা সেন,
সঙ্গীতজ্ঞা
পূরবী মুখোপাধ্যায়,
নৃত্যশিল্পী
মঞ্জুশ্রী চাকী,
বাচিকশিল্পী
ব্রততী বন্দোপাধ্যায় যাঁরা
এই বেথুন কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশান
করেছিলেন । বেথুন কলেজের দুজন
প্রথম গ্র্যাজুয়েট হলেন ডাঃ
কাদম্বিনী গাঙ্গুলী এবং
শিক্ষাবিদ চন্দ্রমুখী বসু
। ১৮৮৩ সালে এঁরা বেথুন কলেজ
থেকে পাশ করেন । গ্র্যাজুয়েশানের
পর কাদম্বিনী দেবী কলকাতা
মেডিকেল কলেজে ডাক্তারী পড়েন
। আর চন্দ্রমুখীদেবী বেথুন
কলেজে লেকচারার পদে যোগ দেন
। আমার ১৯৮৩ সালে বেথুন কলেজে
সেকেন্ড ইয়ার । সেবছর এই প্রথম
দু'জন
মহিলার গ্র্যাজুয়েশানের
শতবছর উদ্যাপন মহা আড়ম্বরে
অনুষ্ঠিত হয়েছিল । নানারকম
বর্ণময় অনুষ্ঠান এবং খাওয়াদাওয়ার
মধ্যে দিয়ে পালিত হয়েছিল সেই
সেন্টিনারি । বেথুন কলেজের
গ্র্যাজুয়েট হবার সুবাদে আর
ঠিক ঐ বছরেই স্টুডেন্ট হিসেবে
উপস্থিত থাকার সুবাদে আমিও
খুব গর্বিত ।