-->
এহেন
"আমি"র
শিরা-উপশিরায়
শতকরা পঞ্চাশ ভাগ বাঙাল রক্ত
ও বাকী পঞ্চাশ ভাগ ঘটি রক্ত
বহমান । আমার মায়ের বাবা এবং
বাবার মা দুজনের বাংলাদেশের
খুলনাজেলার সাতক্ষীরায় জন্ম
। তাই এহেন "আমি"
সেই অর্থে
হাফ বাঙাল ও হাফ ঘটি । অন্তত:
আমার
শ্বশুরালায়ের মন্তব্য তাই
। ইলিশ আর চিংড়ি দুইয়ের সাথেই
আমার বড় দোস্তি । যেমন রাঁধতি
পারি ঝরঝরে ভাত তেমন ভাজতি
পারি ফুলকো ফুলকো নুচি। তবে
ঘটির ওপর আমি পক্ষপাতদুষ্ট
। কারণ রক্ত ।
উপাদেয়
পোস্তর বড়ার স্বাদ পেতে আমাকে
ছুটতে হয় বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার
বন্ধুর বাড়িতে । আর নারকোল-বড়ি
দেওয়া মোচার ঘন্ট খাবার জন্যে
আমাকেই ছুটতে হয় রান্নাঘরে
। আমাদের ঘটি বাড়ির হেঁশেল
আবার একটু বেশি মিষ্টি তাই
বেশির ভাগ রান্নাবান্নাই
শর্করায় পুষ্ট । কুটিঘাটের
মেয়ে আমার দিদিমা ছিলেন খাস
ঘটিবাড়ির মেয়ে । বিয়ের পরদিন
বাঙাল শ্বশুরবাড়ির রান্নায়
চিনি ছড়িয়ে খেয়েছিলেন । তাই
বোধহয় আমার ঠাকুরদাদার মুখে
মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনেছি ।
সব ক্রিয়াপদে এলুম,
গেলুম,
খেলুম মার্কা
কথা । আমাদের বন্ধুরা হেসে
বলত এই এল হালুম-হুলুম
করতে । কি আর করি !
জন্ম-দোষ
যে!
স্কুল
থেকে ফিরে বন্ধুরা সকলে ভাত
খেত আর আমরা খেতাম লুচি-পরোটা
বা রুটি কিন্তু দুবেলা ভাত
নৈব নৈব চ ! কি
আর করে বন্ধুরা!
ওদের মা
ময়দার কাজে মোটেও পটু নন,
ভাতের রকমারিতে
পটু তাই ঘটির বৈকালিক জলযোগের
ময়দা বুঝি ওদের কাছে অধরা ।
ওদের
সেই চিতলামাছের মুইঠ্যা
একবগ্গা মাছের এক্সোটিক ডিশ
ফর গ্যাস্ট্রোনমিক তৃপ্তি
। আর কালোজিরে-কাঁচালঙ্কা
দিয়া ইশে... সেই
বাদলা দিলে কাদলা মাছের পাদলা
ঝোল না খেয়ে কাতলার ক্রোকে,
দৈ-মাছ,
কোর্মা,
মাছের পোলাও,
মাছের কচুরী,
চপ আরো কত
বলব ! ঘটি
হেঁশেলে শুঁটকি ফুটকির নো
এন্ট্রি ! একবার
বাঙাল-ঘটির
কাজিয়ায় আমার ঠাকুর্দা তার
এক বাঙাল বন্ধুকে বলেছিলেন
"কচুরী
আর রাধাবল্লভীতে যে বিস্তর
ফারাক সেটাই জানোনা?
আর কি করেই
বা জানবে "ময়দার"
ব্যাপারে
তোমাদের তো হাঁটুতে খঞ্জনী
বাজে। চাড্ডি ভাত চাপিয়েই
খালাস তোমরা । জমিয়ে মিষ্টি
মিষ্টি নাউ-চিংড়ি
খাও মশাই। দেখবে মনের কাদা
সাদা হয়ে গেছে । এট্টু চিনি
ছড়িয়ে কড়াইয়ের ডাল আর ঝিঙেপোস্ত
খাও । দিল খুশ হয়ে যাবে । মিষ্টি
কথা কি এমনি কৈতে পারি?
মিষ্টি
মিষ্টি ব্যবহার কি এমনি পারি!
সবের মূলে
ঐ ঘেটো মিষ্টি"
বাজার
গেছি একবার জ্যাঠামশাইয়ের
হাত ধরে । সদ্য কৈশোরে পা দিয়েছি
তখন । পুলিশে কর্মরত জ্যাঠামশাই
তাঁর চাঁচাছোলা ভাষায় গঙ্গার
ঘাটে তাঁর এক পুরোণো সহপাঠীকে
বলছেন :
"তোমরা
হলে গিয়ে, ইশে
"অরিজিনাল
দেশি" তাই
বলে আমরা এবরিজিনাল দেশি নই
গো দাদা ! এট্টু
ঘুসোচিংড়ির বড়া খেয়ে দ্যাখেন
মশাই ! অথবা
কষে চিনি দিয়ে ছোলারডাল আর
ঐ আপনাগো "ময়দা"
মানে আমাগো
"নুচি"
। চিল্লোতে
পারিনা আমরা, আট
ডেসিবেল কি সাধে ক্রস করিনা?
ভেতরটা
সত্যিসত্যি মিষ্টি হয়ে আসছে
যুগ যুগ ধরে"
জ্যাঠামশাইকে
আমরা জ্যাঠা বলতাম । খুব রসিক
মানুষ ছিলেন । আর বাঙাল দেখলেই
তাকে কচুকাটা করে দিতেন,
কেন তা জানিনা।
ওনার অফিসে একজন পেটরোগা
কন্ষ্টেবল ছিল । প্রায়ই সে
কাজে আসতে লেট করত । লোকটির
পেটের ব্যারাম ছিল । সে
জ্যাঠামশাইকে দেখলেই সেলাম
করত ভয়ে ভয়ে আর তখুনি জ্যাঠা
নিজের পেটটা বাজিয়ে তাকে বলত
"প্যাটের
ভিতর গেস হৈসে, চুয়া
চুয়া ডেকুর মারে?"
একবার
ওনার এক বাঙাল কনস্টেবলের
ছেলে পরীক্ষায় পাশ না করে
লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে পুলিশে
বেয়ারার চাকরীর জন্য দরখাস্ত
দিয়েছে । জ্যাঠামশাইকে আগেই
তার বাবা বলে দিয়েছে "স্যার,
আমার ছেলেটা
সব লিখেছিল কিন্তু ইংরেজীটায়
মোটে চোদ্দ পেয়ে গেল এবার,
তাই আর পাশ
করতে পারলনা"
সে
ছেলেকে প্রশ্ন করার আগেই
জ্যাঠা হাসতে হাসতে বলে বসল
"কি
ল্যাখসি জানিনা তবে চোদ্দ
পাসি"
আরেকটা
গল্প জ্যাঠা প্রায়ই বলতেন
আমাদের । একজন কানহার জঙ্গলে
বাঘ দেখে এসে ভয়ানক অত্যুক্তি
করে বলছে । যত না বাঘ দেখেছে
তার চেয়ে অতিরঞ্জিত তার বাঘের
দৈর্ঘ্য । লোকটির গিন্নীও
তার সঙ্গে গেছিল তাই সে প্রকৃত
দৈর্ঘ্য সম্বন্ধে যথেষ্ট
ওয়াকিবহাল । বারবার লোকটি
অমন বাঘের গল্প শোনায় আর তার
বৌ ভাবে এমন মিথ্যা বলে কেন
তার স্বামী ! তারা
তো ছোট্ট একটা বাঘের ল্যাজের
দিকটা একটু দেখেও ঠিক মত দেখতে
পায়নি , ভারি
লজ্জা হত বৌটির । বৌ বলেছে
দ্যাখো, এবার
তুমি যখন তোমার বন্ধুদের ঐ
গল্প আবার শোনাবে আমি পাশের
ঘর থেকে জোরে জোরে কাশব আর
তুমি তখন বাঘের সাইজটা কমাবে
কিন্তু। লোকটি বলতে শুরু করেছে
আট-দশ-বারো..
হাত যেই
বলেছে তার বৌ কেশে উঠেছে । খুব
কাশছে বৌটি । তখন লোকটি বলছে
"গিন্নী,
তুমি কাইস্যা
কাইস্যা মৈরা গ্যালেও আমি দশ
হাতের নীচে নামুম না "
এভাবেই
আমি এলুম, দেখলুম,
ছিলুম বলে
। একবার জ্যাঠামশাইয়ের স্পেশাল
ব্রাঞ্চের আপিস গেলুম,
আমের সময়
মিষ্টি আঁব খেলুম,
হ্যান্ডলুম
পরলুম ! এতে
লজ্জার কিছু নেই । আমাদের
রান্নার সোশ্যাইটি জুড়ে,
হেঁশেলের
ঝুলকালিতে শুধু একটাই কথা :
শুক্তো,
ঘন্ট,
ছ্যাঁচড়া,
সাথে অম্বল
আমড়া ।
চিনির
রসে হাবুডুবু ঘটির প্রাণে
খুশি
ঝাল-ঝাল-টক-টক-মেছো
শুঁটকি বাসি ।
নাউ-নঙ্কা-নেবু-নুচি-নেপ-নাট্টু-নাটাই
বিঘা
বিঘা ধানজমি আর তালদীঘিটা
নাই।
রামদা
নিয়ে, চোখ
পাকিয়ে আসি নাকো তেড়ে
ঝগড়া
করার জোর যে নাই লড়ব কেমন করে
?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন