২৪ অক্টো, ২০১৮

কোজাগরীর চিঠি

সুজনেষু সব ব্রতীরা আমি আজ জেগেই থাকব সারাটা রাত। যতক্ষণ না পূর্ণিমার চাঁদ ডুবে যায় আকাশের মধ্যে। যতক্ষণ না আমার চোখের পাতা ক্লান্ত হয়। যতক্ষণ না আমি তার দেখা পাই। কেউ ঘুমিওনা আজ রাতে। ঘুমিয়ে পড়লেই আমার শব্দ শুনতে পাবে। কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে আমি চুপিচুপি বলব "জাগদেরহো"! আমার ঘুম নেই চোখে। আর আমিও ঘুমোতে দেবনা কারোকে। শারদপূর্ণিমা আমার যে ভীষণ প্রিয়। আশ্বিন-কার্তিকের এই পূর্ণিমার সময় বর্ষা ঋতু ফিরে যায় একবছরের মত। মৌসুমীবায়ু বিদায় নেয়। শস্যশ্যামলা মাটিতে নতুন আউস ধানের গন্ধ ওঠে। তোমাদের ঘরে ঘরে পরব আর আমি তখন কোজাগরী। আমার তখন কৌমুদী-উত্সব। চাঁদের আলোয় তখন আমার রাত পরিক্রমার শুরু। আমি কোজাগরী হয়ে দেখব কে আমাকে চায়। কে আমার পালন করে। কে আমাকে বেঁধে রাখে আজীবন। জানো ? আমরা দুই যমজ বোন। লক্ষ্মী আর অলক্ষ্মী। আমার সব সোজাসাপটা, সাধাসিধে । আমার ধীরস্থির চলনবলন। আমি শান্তশিষ্ট, বেশী আওয়াজ আমার নাপসন্দ। বেশী খাওয়া দেখলেই আমার বমি আসে। আমি মিষ্টি, দুধের খাবার পছন্দ করি। আর আমার বোন অলক্ষ্মীর সব উল্টো। সে যেমন কলহপ্রিয়া তেমনি কোলাহল প্রিয়া। সে বড্ড বেশী খায় আর যতসব টক, ঝাল আর বিদঘুটে সব খাবার তার পছন্দের। সে যেমনি বাচাল তেমনি চঞ্চল। আমাকে ছাড়তে নাছোড় সে। আমারো খুঁতখুঁতানি থাকে তাকে নিয়ে । নিজের সংস্কারটা শুদ্ধ রাখতে চাই যে! ওর সঙ্গদোষে যদি আমি খারাপ হয়ে যাই! ভয় হয়। অলক্ষ্মী যেমনি হোক, আমার আশেপাশেই থাকে। বোন তো! ফেলতে পারিনা, গিলতেও পারিনা তাকে। তবে আমার দাপটে সে একটু হলেও চাপে থাকে সর্বদা। সাধারণ মানুষ বিষ্ণুর অবতারত্ব নিয়ে কতকিছু বলে কিন্তু আমি মেয়ে বলে আমার কথা কেউ বলেনা। আমি ত্রেতায় রামের সহধর্মিণী সীতা, দ্বাপরে কৃষ্ণের পত্নী রুক্মিনী। পুরাণে বলে সমুদ্রমন্থনের সময় ক্ষীরসাগর থেকে পদ্মফুল হাতে আমি উঠে এসেছিলাম। তাই আমার অপর নাম পদ্মা। আমি আবার নাকি পদ্মফুলে বসি তাই আমার নাম কমলা। আমি বিষ্ণুর প্রেমিকা তাই আমার নাম বিষ্ণুপ্রিয়া। এমন সব কত আদরের, আহ্লাদের নাম আমার । সমুদ্রমন্থনের সময় উঠে এসেছিলাম তাই কেউ আমায় বলে সমুদ্রকন্যা। কেউ আবার ডাকে ভূদেবী অর্থাত সারা পৃথিবীর, সমগ্র প্রকৃতির পালনকর্ত্রী নাকি আমি। ঐ দ্যাখো সকলেই বলে "বিশ্বরূপস্য ভার্য্যাসি পদ্মে পদ্মালয়ে শুভে সর্বতো পাহি মাং দেবী মহালক্ষ্মী নমোহস্তুতে" তবুও দেখো আমার না আছে পিতামাতা। না আছে স্বামীসন্তানের সুখ। তাই তো আমি সেই দুঃখ ভুলে গিয়ে জগতের পালন করতে তোমাদের ধনদৌলত আগলাতে সর্বদা ব্যস্ত থাকি। আমার আর কে আছে তোমরা ছাড়া! আর কোজাগরীর দিনে মানে বছরের ঐ একটি বিশেষ পূর্ণিমা তিথিতে আমার কাজ হল ঘুরে ঘুরে দেখা কোথায় নষ্ট হল ধান, কার গৃহে অলক্ষ্মী বাস করল, কে খেতে পেয়েও রাখতে পারলনা আর কে তিলতিল করে সঞ্চয় করে ঘরে আনল লক্ষ্মী। উজ্জয়িনীর এক ধার্মিক রাজা তাঁর প্রজাপালনের জন্য খুব সুখে কাল যাপন করতেন। একবার তিনি ঢেঁড়া পিটিয়ে জানিয়ে দিলেন যে তাঁর রাজ্যের হাটে কোনো অবিক্রিত জিনিষ যেন না পাড়ে থাকে। দিনের শেষে তিনি‌ই সেই জিনিষটি কিনে নেবেন দোকানীর কাছ থেকে। রটে গেল খবর। জানা গেল এক কামারের কাছে এক ভয়ানক চেহারার বিশ্রী নারীমূর্তি পড়ে রয়েছে। কামারকে জিগেস করতেই সে বলল, মহারাজ এটি নাকি অলক্ষ্মী মূর্তি তাই কেউ কিনতে চাইছেনা। মহারাজ বললেন, তিনি যখন কথা দিয়েছেন তখন সেটি কিনে নিয়েই বাড়ি ফিরবেন। নয়ত অধার্মিক রাজা হিসেবে তাঁকে রাজ্যের মানুষ চিনে যাবে। রাজা অগত্যা সেই লোহার মূর্তিটি কিনে এনে নিজের ঠাকুরবাড়িতে তাকে আশ্রয় দিলেন। মাঝরাতে নিজের রাজপুরীর মধ্যে মেয়েলি কান্নার কন্ঠস্বর শুনে রাজা দেখতে পেলেন এক ক্রন্দনরতা নারীমূর্তিকে। রাজা তাকে জিগেস করলেন" তুমি কাঁদছো কেন মা?" সেই নারী বললে," মহারাজ, আমি আপনার রাজলক্ষ্মী, আজ আপনার বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছি" রাজা বললেন, কেন মা? আমি কি অন্যায় করেছি? জানতে পারি? " সেই নারীমূর্তি বললে," আপনি রাজবাড়িতে অলক্ষ্মীকে ঠাঁই দিয়েছেন। অতএব আমি আর এখানে থাকতে পারবনা। " এই বলে অন্তর্হিতা হলেন। আবার কিছুপরে রাজা দেখলেন আরেক সুন্দরী, সুশীলা নারী প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। সে হল ভাগ্যলক্ষ্মী। তার কিছুপরেই যশোলক্ষ্মী, কুললক্ষ্মী, সকলেই একে একে রাজপুরী থেকে বিদায় নিল। রাজার সেরাতে ঘুম এলনা। এবং সকলেরি বিদায় নেবার কারণ হল সেই অলক্ষ্মীমূর্তিটি যেটি রাজা কিনে এনেছিলেন। এভাবেই তাঁর দিন কাটে। তবুও শিল্পীর হাতে বানানো সেই অলক্ষ্মীমূর্তিটি ফেলে দিতে রাজার মন চায়না। শিল্পীতো আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরী করেছে তাকে। শিল্পীর শিল্পীসত্তায় আঘাত করতে মন চায়না রাজার। তাই প্রাসাদ থেকে একটু দূরেই সরিয়ে রাখেন তাঁকে কিন্তু ফেলতে পারেন না। ক্রমে তিনি দরিদ্র হতে থাকলেন। ধন, মান, যশ, সাফল্য ভাগ্য তাঁকে ছেড়ে চলে যায়। একদিন রাজা দেখতে পেলেন ধর্মরাজ তাঁকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। রাজা তখন নিরূপায় হয়ে ভাবলেন এটা মেনে নেওয়া যায়না। ধর্ম তাঁকে ত্যাগ করলে তিনিতো অধার্মিক রাজা রূপে পরিগণিত হবেন। রাজা তখন ধর্মকে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেন। ধর্মরাজা রাজার যুক্তি শুনে খুব খুশি হলেন। ধর্মরজের কথায় আশ্বিনমাসের পূর্ণিমায় রাণীকে কোজাগরী ব্রত পালন করতে বললেন । রাণী সারারাত জেগে বসে র‌ইলেন। আর নিষ্ঠাভরে লক্ষ্মীর পুজো করে রাজা সব ফিরে পেলেন। আবার আগের মত তাঁর রাজবাড়ি ভরে উঠল জাঁকজমকে, ধনসম্পত্তিতে। এইগল্পটা শুনে তোমরা বলবেতো নিজের ঢাক নিজে পেটালাম? আসলে কি জানো? আমি তো চাই তোমাদের ঘরে আটকে থাকতে। তোমাদের ভালোর জন্যে অর্থ, যশ, প্রতিপত্তি সব দিয়ে তোমাদের ধনী করতে। কিন্তু তাই বলে অলক্ষ্মীর জন্যে সত্যকে, অধর্মকে তো আর মেনে নিতে পারিনা। ঐ রাজার চরিত্রের সবচেয়ে বড়ো গুণ হল তিনি সত্‌ এবং ধার্মিক। আর তাইতো ধর্মরাজা সবকিছু ফিরিয়ে দিলেন রাজাকে। অলক্ষ্মীর প্রতিও অবিচার করেননি রাজা আর শিল্পীর প্রতি তো নয়‌ই। আমার জীবনের কত গল্পের কথা আর বলি তোমাদের? নারায়ণের পাশে আজীবন সদা সুহাসিনী লক্ষ্মীকে দেখে তোমরা ভাবো এই দম্পতির কত সুখ! আদর্শ স্বামীস্ত্রী ইত্যাদি ইত্যাদি। তাহলে শোনো আমার সপত্নীর সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের গল্প। কত ঝড় বয়ে গেলে একটা মেয়ে লক্ষ্মীমেয়েতে পরিণত হয় দ্যাখো তোমরা! কত অসহনীয় টানাপোড়েন একজন নারীকে লক্ষ্মী করে তোলে! পুরাণের আরেকটি গল্পের মতে সরস্বতী, লক্ষ্মী এবং গঙ্গা ছিলেন বিষ্ণুর তিন পত্নী । বিষ্ণু কিন্তু গঙ্গার প্রতি একটু বেশিমাত্রায় আসক্ত ছিলেন । নম্রস্বভাবের লক্ষ্মী এই ঘটনায় মনে মনে খুব দুখঃ পেতেন কিন্তু কিছু প্রকাশ করতেন না । সরস্বতী কিন্তু বিষ্ণুর এই অতিরিক্ত গঙ্গাপ্রেমকে প্রশ্রয় না দিয়ে অশান্ত এবং রুষ্ট হয়ে উঠেছিলেন । একদিন তার মাথায় একটা বুদ্ধি এল । প্রচন্ড উগ্রমূর্তি ধরলেন তিনি । গঙ্গার মুখোমুখি হলেন । লক্ষ্মী একটি ভয়ানক কলহের পূর্বাভাস পেয়ে সরস্বতী ও গঙ্গার মধ্যিখানে এসে দাঁড়ালেন । সরস্বতী লক্ষ্মীকে অভিশাপ দিয়ে একটি গাছে পরিণত করলেন । লক্ষ্মী আবার সেই অভিশাপে প্রচন্ড আঘাত পেয়ে সরস্বতীকে নদীতে রূপান্তরিত করলেন । সরস্বতী নিজেও তখন উগ্রচন্ডা । নিজে নদীতে পরিণত হয়েছেন বলে গঙ্গাকেও নদী হতে অভিশাপ দিলেন । ইতিমধ্যে বিষ্ণু সেইখানে হাজির হলেন । এতসব ঝগড়া বিবাদ দেখে ও শুনে স্থির করলেন সরস্বতী ও গঙ্গার সাথে আর নয় । এখন থেকে তিনি কেবলমাত্র লক্ষ্মীর সাথেই ঘর করবেন । সরস্বতীকে ব্রহ্মার হাতে এবং গঙ্গাকে শিবের হাতে সমর্পণ করে বিষ্ণু হলেন লক্ষ্মীর প্রিয় পতিদেবতা । আর সরস্বতী ও গঙ্গার ওপর এরূপ অন্যায় শাস্তির জন্য লক্ষ্মী মনে মনে ব্যথিত হলেন আবার বিষ্ণুকে একান্ত নিজের স্বামীরূপে বরণ করে আনন্দিতও হলেন । বিষ্ণুকে শান্ত হতে বললেন এবং তাদের দুজনের আশীর্বাদে লক্ষ্মী ও গঙ্গা মর্ত্যের ওপর দিয়ে নিজ নিজ গতিপথে ব‌ইতে লাগল । স্বর্গে তাদের দুজনার একটি করে শাখা বিষ্ণুর হাত ধরে র‌ইল। তবে যাই বলো সেই বৈদিকযুগ থেকে আমি স্বীকৃতি পেয়ে আসছি সৌভাগ্য ও ঋদ্ধিদায়িনী দেবী রূপে। আমি যখন শুভদায়িনী তখন কল্যাণী বা পুণ্যলক্ষ্মী আর অশুভদায়িনী যখন তখন আমি অলক্ষ্মী। কেউ বলেন আমি মাদুর্গার কন্যা । কেউ বলেন আমি মায়ের অন্য একটি রূপ । মহাদেব নিজের দেহ থেকে সৃষ্টি করেছিলেন ঊমাকে এবং ঊমা পরে সৃষ্টি করেন লক্ষ্মী, সরস্বতী, দুর্গা এবং কালীকে । শ্রী শ্রী চন্ডীতে দুর্গাদেবীকেই মহালক্ষ্মী রূপে আখ্যা দেওয়া হয় । বাঙালী কল্পনাপ্রবণ জাতি । সপরিবারে মা দুর্গাকে না দেখলে তাদের যে মন ভরেনা । তাই তো দুই শক্তি লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে দুপাশে আমরা দেখি এবং মহানন্দে বরণ করি । লক্ষ্মীদেবী হলেন বিষ্ণুপ্রিয়া বা নারায়ণী যিনি সৌভাগ্য, ঐশ্বর্য্য এবং সমৃদ্ধির প্রতীক আর সরস্বতী হলেন বাগদেবী, বিদ্যা-বুদ্ধির অধিষ্ঠাত্রী, জ্ঞানদায়িনী। অর্থাত এই দুই নারীশক্তি সকল শুভ, সৃজনশীল, গঠনমূলক ক্রিয়াকলাপের উত্স । তাই শুভ শক্তির প্রতীকও বটে । আমার বাহন পেঁচা। তাই বলে ঐটুকুনি পেঁচার ওপরে আমি বসে থাকি আর সে আমাকে নিয়ে উড়ুক আর কি! এসব বাহন তত্ত্ব মনগড়া। লক্ষ্মীর বাহন নিশাচর পেঁচা । অন্ধকার যার আশ্রয় । লক্ষ্মী সৌভাগ্য-সমৃদ্ধির আলোর দিশা দেখান পেঁচাকে সাথে নিয়ে অর্থাত অন্ধকার ও আলোর মধ্য থেকে জীবজগত আলোর দিশা খুঁজে নেবে । কারণ জীবনে ঘাত-প্রতিঘাতের লড়াইতে সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য উভয়ই থাকবে কিন্তু সব পরিস্থিতিতেই অবিচল থেকে আলোর পথ যাত্রী হয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলতে হবে । জাগতিক সত্ত্ব ও তমগুণের মধ্য থেকে সত্ত্বটুকুকে বেছে নিতে হবে । তাই বলে তমকে বাদ দিলেও বাদ দেওয়া যাবে না তাই এই নিশাচর । এত জ্ঞান দিলাম চিঠিতে কিন্তু কেউ কি জানবে আমার কথা? ইতি আমি কোজাগরী

১৫ অক্টো, ২০১৮

কাউন্টডাউনঃ৬- এক মেয়ের এত নাম???

নামদুর্গা
মাদুর্গার এক অঙ্গে বহুরূপ। এক রূপে বহুনাম্মী আমাদের মা দুর্গা ।
অদ্রিজা মাদুর্গার আরেক নাম । অদ্রি অর্থাত পর্বত হিমালয়ের কন্যা বলে তাঁকে এই নামে ভূষিত করা হয় ।
দুর্গা শব্দটির অর্থে আসা যাক ।
দুর্গা =  দুর্গ + আ =  দ্+উ+র্+গ্ +আ


দ এর অর্থ দৈত্যনাশ
উ এর অর্থ বিঘ্ননাশ
র এর অর্থ রোগনাশ
গ এর অর্থ পাপনাশ এবং
আ এর অর্থ ভয় ও শত্রুবিনাশ ।


দুর্গ শব্দের অর্থ দৈত্য, বাধাবিঘ্ন,  দুঃখশোক, নরকযন্ত্রণা, রোগব্যাধি… এহেন নানাবিধ অশুভকিছু  আর “আ” অর্থটি বাংলাভাষায় নাশ করা বা বধ করা বোঝায় । সেই কারণে দুর্গা শব্দের অর্থ দাঁড়ায়  জীবের জীবন থেকে যা কিছু অশুভ শক্তির বিনাশ কারী দেবী শক্তি । নিজের নাম প্রসঙ্গে দেবী বলেছেন চন্ডীতে


“তত্রৈব চ বধিষ্যামি দুর্গমাখ্যং মহাসুরং
দুর্গা দেবীতি বিখ্যাতং তন্মে নাম ভবিষ্যতি” ।।


কিন্তু দুর্গা নাম এল কিভাবে? পুরাকালে দুর্গম নামক এক অত্যাচারী অসুর দেবতাদের পরাজিত করে বেদ শাস্ত্রকে হরণ করে । তার উদ্দেশ্য ছিল জীবজগতে ধর্মের বিনাশ ঘটানো । সমাজে এমন বিশৃঙ্খলা দেখে দেবতারা সমবেত ভাবে মহামায়ার শরণাপন্ন হন । কোনো অসুর যাতে ভবিষ্যতে এমন অনিষ্ট সাধন না করতে পারে তাই দেবী দেবতাদের আরাধনায় তুষ্ট হয়ে সমগ্র “বেদ”কে স্বীয় দেহে ধারণ করেন । বেদময়ী দেবীকে দেবগণ “দুর্গা”  নামে ভূষিত করেন । দেবী পুরাণ মতে দুর্গা নাম স্মরণ করলেই ত্রিতাপ দুঃখ, জ্বালা যন্ত্রণা মুক্ত হয়  এবং এরূপে তিনি জীবের কল্যাণদায়িনী, রোগ-শোক বিনাশিনী রূপে জীবকে অশুভ শক্তির হাত থেকে উদ্ধার করেন  । অথবা বলতে পারি মহাশক্তিকে লাভ করার দুর্গম পথকে যিনি সুগম করে দেন তিনিই দুর্গা ।
  শিবঘরণী, শিবসোহাগীনি দুর্গা হিমালয় পর্বতের কন্যা বলে তাঁর এক নাম পার্বতী। তিনি বিশ্বচরাচরের অন্নদায়িনী তাই অন্নপূর্ণা, সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। স্যার ফ্রেজার তাঁর  Adonis গ্রন্থে  প্রাচ্যের এক বৃষভবাহন দেবতা ও সিংহবাহিনীদেবীর উল্লেখ করেছেন। তিনি শিব বা দুর্গার নাম উল্লেখ করেননি কিন্তু তারাই যে আদতে আমাদের হর-গৌরী তা একেবারে সুস্পষ্ট। A short history of religion গ্রন্থে কেলেট সাহেব মুক্তকন্ঠে প্রকাশ করেছেন শস্যাধিষ্ঠাত্রী দেবতা সর্বপ্রথম প্রাচ্যেই বিকাশ লাভ করেছিলেন। তাঁর ব‌ইতে বোনদিয়া (Bona Dea) নামক এক দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায় যিনি a deity of fertility বলে প্রচলিত এবং এই বোনদিয়া আমাদের সুন্দরবনের বনদুর্গা বা বনবিবি যিনি আমাদের শাকম্ভরী দুর্গা সে কথা বুঝে নিতে আমাদের অসুবিধা হয়না ।  এই শাকম্ভরী হল মাদুর্গার অনেকগুলি নামের মধ্যে অন্যতম।
শরতঋতুতে আবাহন হয় বলে দেবীর আরেক নাম শারদীয়া। এছাড়া মহিষাসুরমর্দিণী, কাত্যায়নী, শিবাণী, ভবানী, আদ্যাশক্তি, চন্ডী  এইসব নামগুলি বাংলাদেশেই প্রচলিত। নেপালে দেবী নবরাত্র, কাশ্মীরে অম্বা, গুর্জরে হিঙ্গলা বা রুদ্রাণী, কনৌজে কল্যাণী, দাক্ষিণাত্যে অম্বিকা , মিথিলায় ঊমা নামে তিনি পূজিতা ।  এছাড়া বাংলাদেশের সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা মাটির বুকে শক্তির আরাধ্যারূপে পূজিতা দেবী শীতলা, মনসা, বাশুলি, ষষ্ঠী, মঙ্গলচন্ডী সকলেই মা দুর্গার অংশ বিশেষ। শ্রীশ্রীচন্ডীর একাদশ অধ্যায়ে আছে অনাবৃষ্টির সঙ্কটে পৃথিবী যখন দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে তখন ঋষিদের স্তবে তুষ্ট হয়ে শক্তিময়ী দেবী নিজের দেহ থেকে উত্পন্ন শাকসব্জীর দ্বারা বিশ্ববাসীর প্রতিপালনে সচেষ্ট হন। সেই শাক ভক্ষণ করে মানুষ প্রাণ ফিরে পায়। ইনিই দেবী শাকম্ভরী।  যতদিন না পর্যন্ত বৃষ্টি হয় ততদিন সমগ্র বিশ্বের মানুষকে দেবী নয়রকম শাক খাইয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। তাই এই শাকম্ভরী ই শতাক্ষী, দুর্গা, ঊমা, গৌরী, সতী, চন্ডী, কালিকেশা ও পার্বতী নামে বিদিতা। রাজস্থানের কাছে আজমীরে শাকম্ভরী তীর্থে এই কাহিনী বর্ণিত আছে। শ্যামল সবুজবর্ণ শাকসব্জীর রঙে ভূষিতা বলেই দেবী শাকম্ভরী নীলোত্পল বর্ণা। পশ্চিমবাংলার কাটোয়া থেকে আট মাইল দূরে মঙ্গলকোট থানার অন্তর্গত মাজিগ্রামে শাকম্ভরী দেবীর পুজো হয়।
সতী, পার্বতী, ঊমা এবং গৌরী দুর্গার এই চারটি রূপ হল শিবের পত্নী রূপ। তাই শিবাণী, রুদ্রাণী, অদ্রিজা,  এই নামগুলি হল আমাদের মনগড়া এবং বাংলাসহিত্যের অভিধানে বর্ণিত মাদুর্গার নামান্তর মাত্র। দক্ষযজ্ঞের প্রলয়ের কারণে  দক্ষকন্যা সতীর অপর নাম দাক্ষায়নী। এবার বেদের সপ্তমাতৃকায় আসি। দুর্গার এই সপ্তমাতৃকার নামগুলি হল ব্রহ্মাণী, মাহেশ্বরী, বৈষ্ণবী ইন্দ্রাণী বা ঐন্দ্রী বা কৌমারী, নারসিংহী, বারাহী এবং চন্ডী  ।  এই মহাশক্তিময়ী দেবীরা অগ্নিরূপী শিবের বা সূর্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। শ্রী শ্রী চন্ডীতে দেবীকবচে একাদশ মাতৃকার উল্লেখ আছে। এই একাদশ মাতৃকা পূর্বে উল্লিখিত  নবদুর্গা ও সপ্তদুর্গার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ।
ঘুরেফিরে সব রূপগুলিতেই সর্বকালে চামুন্ডা শবাসনা, বারাহী মহিষারূঢ়া, ইন্দ্রাণী গজাসনা, বৈষ্ণবী গরুড়াসনা ও  মহাবীর্যা নারসিংহী, মহাবলা শিবদূতি, বৃষাঢ়া মাহেশ্বরী, শিখিবাহনা কৌমারী , পদ্মাসনা লক্ষ্মী, বৃষবাহনা ঈশ্বরী, হংসারূঢ়া ব্রাহ্মী এবং এঁরা সকলেই একাদশ মাতৃকার বৈচিত্রময়ী রূপ।  দুর্গার এই নামগুলি ছাড়াও শ্রীশ্রীচন্ডীতে মহালক্ষ্মী, মহামায়া, মহাবিদ্যা, মহাবাণী, ভারতী, বাক্‌ সরস্বতী, আর্যা, ব্রাহ্মী, কামধেনু, বেদগর্ভা, ধীশ্বরী, সুরেশ্বরী, দেবেশী, অশোকা, বিপদতারিণী, শতাক্ষী প্রভৃতি অগণিত নামের উল্লেখ আছে। এছাড়া দুর্গাপূজার পর বিজয়াদশমীতে এ অপরাজিতা পূজা হয় সেই অপরাজিতা এবং দুর্গা এক ও অভিন্ন। এই অপরাজিতা দেবী দুর্গার চৌষট্টি যোগিনীদের মধ্যে অন্যতমা। এমনকি জগদ্ধাত্রী পুজোতেও নবশক্তির অর্চনারপর দেবতাদের পুজোর মধ্যেও “অপরাজিতায়ৈঃ” মন্ত্রে দেবীপূজা করা হয়। মত্স্যপুরাণে এই অপরাজিতাকে মায়ানুচরী বলা হয়েছে। বামনপুরাণে ইনি গৌতম মুনি ও অহল্যার চারকন্যা জয়া, বিজয়া, জয়ন্তী ও অপরাজিতা। সেখানে আবার এই চারভগ্নী শিবজায়া সতীর সহচরী সখী রূপে অভিহিত। দেবী অপরাজিতা প্রণাম মন্ত্রে রুদ্রলতা নাম পাওয়া যায়। তাই তিনিই যে শিবসঙ্গিনী দুর্গা সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই ।
দেবীপুরাণে দেবীর আরো নানাবিধ নামের উল্লেখ আছে। দেবী দুর্গার সন্ধিপূজায় দেবীর চামুন্ডারূপের পূজা হয়। দেবর্ষি নারদ সেখানে দেবীকে অর্চণা করছেন নিম্নলিখিত নাম ধরে। দুর্গা, শাকম্ভরী, গৌরী ছাড়াও বিন্ধ্যবাসিনী, কাত্যায়নী, কৌষিকী, কৈটবেশ্বরী, মহাদেবী, মহাশ্বেতা, মহেশ্বরী, ত্রিদশবন্দিনী, ঈশানী, ভবানী, ভূতভবানী, জ্যেষ্ঠ্যা, ব্রহ্মবাদিনী, অপর্ণা, কপালা, সুবর্ণা, গায়ত্রী, সাবিত্রী, ত্রিশূলিনী, ত্রিনয়না, ত্রিপদা, ত্রিগুণাত্মিকা, শ্রদ্ধা, স্বাহা, সর্বজ্ঞা, সর্বতোভদ্রা, সর্বোতক্ষী, সর্বভূতাদিমধ্যান্তা, সর্বলোকেশস্বরূপা, কামরূপিণী, যাদবী, যোগীন্দ্রা, বৈষ্ণবী, অরূপা, ভদ্রকালী, স্কন্দমাতা, শ্রুতি, স্মৃতি, কালরাত্রি, মহারাত্রি, কপালিনী, চামুন্ডা, চন্দ্রিকা, চন্ডী, চন্ডমুন্ডবিনাশিনী, রুদ্রাণী, পার্বতী, ইন্দ্রাণী, দাক্ষায়নী, নারী, নারায়নী, শুম্ভ-নিশুম্ভ দলনী, মহিষাসুরমর্দিণী, সহস্রলোচনা, ধীরা, রেবতী, সিংহবাহিনী, বিশ্ববতী, বেদমাতা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, মায়াবতী, ভোগাবতী, সতী, সত্যবতী, ভীমা, উগ্রা, ধূম্রা, অম্বিকা, ত্রম্ব্যকপ্রিয়া, জটা, বিজয়া, অজিতা, অপরাজিতা, পাপনাশিনী প্রভৃতি । মহিষাসুরমর্দিণী দুর্গার সবচেয়ে রুদ্ররূপ যেখানে তিনি একাধারে  দনুজদলনী আবার অন্যদিকে কল্যানী এবং বরাভয়দায়িনী। তিনি ঘোরা আবার প্রসন্না। আসলে বিশ্বমাতা মা দুর্গা এই সকল রূপের সমষ্টি মূর্তি। একই দেবী দুর্গা আবার কামেশ্বরী ও ভদ্রকালী। উভয়েই শাক্তদেবী, এক ও অভিন্না। দশমহাবিদ্যা কালীর দশটি রূপ কিন্তু তত্ত্বগত ও আদর্শগত দিক থেকে এক ও অদ্বিতীয়। কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী, কমলা  এই দশটি রূপ কিন্তু একাধারে কালী অন্যধারে দুর্গাকে বর্ণিত করে।
এছাড়া শ্রীশ্রী চন্ডীতে নবদুর্গার নয়টি নামের উল্লেখ আছে। এই নয়টি নাম হল
শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘন্টা, কুষ্মান্ডা, স্কন্দমাতা,কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরী ও সিদ্ধিদাত্রী । 

মহাষষ্ঠীর বোধন আবার কি?

  
 


সীতাহরণের পর রামচন্দ্র বানরসেনাদের সাহায্যে সেতুবন্ধ করে লঙ্কায় হাজির হলেন । ব্রহ্মা তখন রামকে আদেশ করলেন অপরাজিতা দুর্গার পুজো করে জগতের উদ্ধারে নেমে পড়তে । সমগ্র রাক্ষসকুলকে ধ্বংস না করতে পারলে যে ধরিত্রীর নিস্তার নেই । তাই কৃষ্ণপক্ষেই নিদ্রিতা দেবীকে অকালে জাগ্রত করে অকালে অর্থাত শরতকালে  (পূর্বে বসন্তকালে শুক্লপক্ষে দেবলোক জাগ্রত অবস্থায় পুজো হত)   কাজে নেমে পড়েছিলেন রামচন্দ্র স্বয়ং । তাই তো অকাল বোধন । ব্রহ্মার পরামর্শে দেবী দুর্গার দশভুজা মূর্তি মাটি দিয়ে গড়ে ব্রহ্মা স্বয়ং বিল্ব বৃক্ষমূলে সিংহবাহিনী সেই দেবীর বোধন করেছিলেন । সেই দিনটিই ছিল শুক্লপক্ষের মহাষষ্ঠী ।
রামচন্দ্র স্তব করলেন :

নমস্তে ত্রিজগদ্বন্দ্যে সংগ্রামে জয়দায়িনী
প্রসীদ বিজয়ং দেহি কাত্যায়নি নমোহস্তুতে ।।

পূজা শুরু হল । পিতামহ  ব্রহ্মা  রামচন্দ্রের সাথে বললেন
“হে দেবী! যত দিন না পর্যন্ত রাবণ বধ হয়, রাক্ষসকুল ধ্বংস না হয় আমাদের পূজা গ্রহণ করে তুষ্ট হোন ”   

মিথিলার কবি বিদ্যাপতির দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী গ্রন্থে ষষ্ঠীতে মায়ের বোধনের উল্লেখ আছেঃ ষষ্ঠ্যাং বিল্বতরৌ বোধঃ সায়ংসন্ধ্যাসুকারয়েত্‌। বসন্তকালের দুর্গাপুজোয় বোধনের প্রয়োজন হয়না কারণ দেবতারা ঐ সময়  জাগ্রত থাকেন। সমগ্র দেবকুলকে শরতকালে জাগানোর উদ্দেশ্যেই এই বোধন। বোধনের অর্থ হল জাগরণ। কালিকাপুরাণে পাওয়া যায় এই বোধন নিয়ে...

"বোধয়েদ্বিল্ব্শাখায়াং ষষ্ঠ্যাং দেবীফুলেষু চ"

১৪ অক্টো, ২০১৮

কাউন্টডাউন-৩ : নবরাত্রি



ত্রেতাযুগে শ্রীরামচন্দ্র শারদীয়া দুর্গাপূজার  প্রচলন করেন  । রাবণবধ ও সীতাউদ্ধারের জন্য রামচন্দ্র দুর্গতিনাশিনী দুর্গার অকালবোধন করে নবরাত্র ব্রত পালন করেছিলেন। নবরাত্র ব্রত আশ্বিনের শুক্লা প্রতিপদ থেকে নবমী পর্যন্ত । মা দুর্গা এই সময় অর্থাত আশ্বিনের শুক্লা প্রতিপদ তিথি থেকে নবমী অবধি মোট ন’দিন নয়টি রূপ ধারণ করেন। পিতামহ ব্রহ্মা দেবীর এই নয়টি রূপের নামকরণ করেছিলেন। নয়টি নামের নয়টি বৈচিত্রময় রূপভেদ। এঁরা প্রত্যেকেই দেবীর নয়টি কায়াব্যূহ মূর্তি। নবদুর্গা নামে এঁরা বিশেষ পরিচিত। শ্রীশ্রী চন্ডীতে এই নয়টি নামের উল্লেখ আছে। নবদুর্গার এই নয়টি নাম হল
  • শৈলপুত্রী ( পর্বতের কন্যা)
  • ব্রহ্মচারিণী (যিনি ব্রহ্মাকে স্বয়ং জ্ঞান দান করেন, ভক্তকেও ইনি ব্রহ্মপ্রাপ্তি করান )
  • চন্দ্রঘন্টা ( দেবীদুর্গার মহিষাসুর বধের জন্য দেবরাজ ইন্দ্রের প্রদত্ত ঘন্টা যার মধ্যে গজরাজ ঐরাবতের মহাশক্তি নিহিত ছিল, চন্দ্রের চেয়েও লাবণ্যবতী ইনি  )
  • কুষ্মান্ডা ( উষ্মার অর্থ তাপ । দুর্বিষহ ত্রিতাপ হল কুষ্মা। আর যিনি এই ত্রিতাপ নিজের উদরে বা অন্ডে ধারণ করেন অর্থাৎ সমগ্র সংসার ভক্ষণ করেন ইনি  )
  • স্কন্দমাতা ( দেব সেনাপতি কার্তিকেয় বা স্কন্দের মা )
  • কাত্যায়নী ( কাত্যায়ন ঋষির আশ্রমে দেবকার্যের জন্য আবির্ভূতা ইনি বৃন্দাবনে দেবী গোপবালা রূপে পূজিতা। ব্রজের গোপবালারা এই কাত্যায়নীর কাছে প্রার্থণা করেছিলেন নন্দের নন্দন শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে পাওয়ার জন্য তাই ব্রজের দুর্গার নাম কাত্যায়নী )  
  • কালরাত্রি ( ঋগ্বেদের রাত্রিসুক্তে পরমাত্মাই রাত্রিদেবী। মহাপ্রলয়কালে এই রাত্রিরূপিণী মাতার কোলেই বিলয় হয় বিশ্বের।অনন্ত মহাকাশে নৃত্যরত কালভৈরবের দেহ থেকেই আবির্ভূতা ইনি দেবী যোগনিদ্রা মহাকালিকা বা কালরাত্রি নামে আখ্যাত )
  • মহাগৌরী (তিনি সন্তানবত্সলা, শিবসোহাগিনী, বিদ্যুদ্বর্ণা  মা দুর্গার প্রসন্ন মূর্তি) এবং
  • সিদ্ধিদাত্রী ( অপরূপ লাবণ্যময়ী চতুর্ভুজা, ত্রিনয়নী, প্রাতঃসূর্যের মত রঞ্জিতা যোগমায়া মাহেশ্বরী ইনি সকল কাজে সিদ্ধি প্রদান করেন
শ্রীশ্রীচন্ডীর দেবীকবচ অধ্যায়ের তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্লোকে নবদুর্গার উল্লেখ আছেঃ

প্রথমং শৈলপুত্রীতি দ্বিতীয়ং ব্রহ্মচারিণী।
তৃতীয়ং চন্দ্রঘন্টেতি কুষ্মান্ডেতি চতুর্থকম্‌।।
পঞ্চমং স্কন্দমাতেতি ষষ্ঠং কাত্যায়নী তথা।
সপ্তমং কালরাত্রীতি মহাগৌরীতি চাষ্টমম্‌।।
নবমং সিদ্ধিদাত্রী চ নবদুর্গা প্রকীর্তিতাঃ।
উক্তোন্যেতানি নামানি ব্রহ্মনৈবমহাত্মানা।। 

শ্রীশ্রীচন্ডীতেই প্রথম মহিষাসুরমর্দ্দিণী মাদুর্গার নয়টি রূপের বর্ণনা ও মহিমা প্রকাশিত। 

মহালয়ার সাথেসাথে কৃষ্ণপক্ষের অবসান হয়। দেবীপক্ষের সূচনা হয়। পরদিন অর্থাত শুক্লপক্ষের প্রতিপদ থেকে নবমী পর্যন্ত ন'টি রাত্রি অবধি মাদুর্গার নয়টি রূপের পুজো চলে।  শরতকালীন এই নবরাত্রি উত্সবকে বলা হয় শারদ নবরাত্রি।  মূলত এটি শক্তির আরাধনা।  নবরাত্রির পরদিন বিজয়াদশমীর সাথে সাথে এই শক্তিপূজার সমাপন হয়। 

১২ অক্টো, ২০১৮

কাউন্টডাউন-২ : বলি মায়ের আশেপাশে একগন্ডা পশুপাখী কেন??

স্বজন পরিবৃতা মাদুর্গার সাথে আমরা দেখি একগন্ডা পশুপাখীকে। দেবীর বাহনরূপে পশুরাজ সিংহ, মহিষের দেহ থেকে নির্গত অসুর, লক্ষ্মীর পায়ের কাছে পেঁচা, সরস্বতীর রাজহাঁস, গণেশের পায়ের কাছে ছোট্ট ইঁদুর আর কার্তিকের পাশে ময়ূরকে। আদতে ঐ একরত্তি পাখীগুলি বা ইঁদুরের ওপরে চড়ে বসলে দেবতার ভারে তাদের প্রাণ বেরিয়ে যাবার কথা। মাদুর্গা না হয়  সিংহবাহিনী হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। অসুর না হয় স্ত্রী মহিষের পেটে জন্মেছিলেন আর পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে মায়ের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। তাই বলে অন্যদের সাথে এত পশুপাখীর কি সম্পর্ক?   


মহিষাসুর =  মহিষ + অসুর
পুরাণে বর্ণিত আছে রম্ভাসুর ও গর্ভবতী এক মহিষীর মিলনে জন্ম হয়েছিল মহিষাসুরের । তার বৈশিষ্ট্য হল তার হাত-পা সব মানুষের মত কিন্তু মুখটি শিং সহ মহিষের মত । সে জন্মের  পরেই স্বর্গরাজ্য লাভের আশায় তপস্যা শুরু করেছিল । বহুকাল কঠোর তপস্যার পর ভগবান ব্রহ্মা তুষ্ট হয়ে তাকে অমরত্ব ছাড়া যেকোনো  বরদান করতে সম্মত হলেন । এই বরে দেবতা, যক্ষ, রক্ষ, গন্ধর্বাদি কেউই তাকে হত্যা করতে পারবেনা  এবং কেবল কোনো অবলা নারীর হাতেই  সে ধ্বংস হবে এরূপটিই চাইলেন মহিষাসুর । তাই  তুমুল যুদ্ধের পর মা দুর্গাই একমাত্র পেরেছিলেন একে বধ করতে । মহিষ তমোগুণের প্রতীক । মহিষাসুর মহিষ থেকে জাত বলে সে ভয়ংকর এবং যুদ্ধে দুর্গার সত্ত্বগুণের দ্বারা সেই তমোগুণের বিনাশ হয়  ।
সিংহারূঢ়া দেবী
দেবীর বাহন সিংহ । তাঁর পায়ের নীচে সিংহের অবস্থান । দুর্গা হলেন সমস্ত শুভ শক্তির কান্ডারী । আর এমন গুণকে ধারণ করে দেবীর মন ।  সিংহ মানুষের জৈবপ্রবৃত্তি তথা পশুভাবকে লালন করে  । অরণ্যে ঘুরে শিকার সংহার করে । এহেন জৈব প্রবৃত্তির বিনাশ ঘটান মা দুর্গা । আর এরূপ পুরুষসিংহই  মা’কে শুভ কার্যে বহন করে নিয়ে চলে  । সে থাকে পায়ের নীচে অর্থাত দুর্গা হলেন জয়ী আর অশুভ সেই সংহার মনোবৃত্তি মায়ের পায়ের তলায় ধ্বংস হয় । সিংহরূপী মনকে বয়ে বেড়ান মা দুর্গা এবং অবশেষে তার পাশবিক স্বার্থপরতাকে গ্রাস করে তার শুভবুদ্ধির উদয় ঘটান ।
পেঁচা
লক্ষ্মীর বাহন নিশাচর পেঁচা । অন্ধকার যার আশ্রয় । লক্ষ্মী সৌভাগ্য-সমৃদ্ধির  আলোর দিশা দেখান  পেঁচাকে সাথে নিয়ে  অর্থাত অন্ধকার ও আলোর মধ্য থেকে জীবজগত আলোর দিশা খুঁজে নেবে । কারণ জীবনে ঘাত-প্রতিঘাতের লড়াইতে সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য উভয়ই থাকবে কিন্তু  সব পরিস্থিতিতেই অবিচল থেকে আলোর পথ যাত্রী হয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলতে হবে । জাগতিক সত্ত্ব ও তমগুণের মধ্য থেকে সত্ত্বটুকুকে বেছে নিতে হবে । তাই বলে তমকে বাদ দিলেও বাদ দেওয়া যাবে না তাই এই নিশাচর ।
রাজহাঁস
সরস্বতীর বাহন শ্বেত রাজহংস ।  সরস্বতী পুরাণে বর্ণিত গঙ্গার মত এক পুতঃসলিলা নদী । তাই সরস্বতীর সাথে রাজহংস অনুষঙ্গটি  মনে করিয়ে দেয় নদীর জলপ্রসঙ্গকে । এবার রাজহংস জল ও দুধের মিশ্রণ থেকে সারটুকু অর্থাত কেবলমাত্র দুধটুকু গ্রহণ করে । তাই বিবেকমান জীবজগত সংসারের অসার বা অনিত্যকে সারটুকু গ্রহণ করার বারতাই বোধহয় ছড়ায় রাজহাঁস । আর সবকিছু সাদা রং বহন করে অমলিনতা যে শ্বেত রাজহংসের গায়ে কখনো অবিদ্যারূপ মলিনতা স্পর্শ করতে পারেনা ।
ইঁদুর
বিশালাকার গণপতির বাহন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মুষিক । এখানে গণেশ নেতা বা গণশক্তির প্রতীক । আর তার অনুপাতে অতি ক্ষুদ্র ইঁদুর জীবের ছোট ছোট কর্মফলের কর্তনকারী । অর্থাত অতি বৃহত শুভ কর্মের দ্বারা কৃত সুফল বিনষ্ট হয়ে যায় ছোট্ট কোনো মন্দ কর্মের দ্বারা । তাই ষড়রিপু বা কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ ইত্যাদির মত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কর্মফল বিনাশ করে ইঁদুর যাতে কিনা বৃহত সিদ্ধিলাভে বাধা না ঘটে ।
ময়ূর
কার্তিকের বাহন আমাদের জাতীয় পাখী আলস্যহীন ময়ূর । ময়ূর অত্যন্ত সজাগ এবং কর্মচঞ্চল পাখী । সৈনিক কার্তিকের সবগুণ গুলি সে বহন করে ।   মেঘ দেখলেও সে  উত্ফুল্ল হয় এবং তার মত ধীর স্থির হয়ে  যুদ্ধক্ষেত্রে নিরলস লড়াই করে যাবেন সৈনিক কার্তিক ।  এবং লোকশিক্ষাও যোগাবে তার কর্মোদ্দীপনা ।

কাউন্টডাউন- ১ : তা সদলবলে কেন গো মা? একা এলেই বা কি ক্ষতি?

তোমাদের কি মত???

এরা কেউ মায়ের পেটের ছেলেমেয়ে নয়। এরা যে কি করে সব উড়ে এসে জুড়ে বসল দুর্গার পরিবারের সাথে! মাদুর্গা কি সকলকে ঠাঁই দেন এভাবেই? নাকি নিজের সুবিধার্থে? মনে মনে ভাবি, এই কি তবে আমাদের সংস্কার? 

মহিষাসুরমর্দিণী দুর্গাপূজার সূত্রপাত ঘটে গুপ্তযুগে । বাঙালী কল্পনাপ্রবণ জাতি । সপরিবারে মা দুর্গাকে না দেখলে তাদের যে মন ভরেনা । তাই তো দুই শক্তি লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে দুপাশে আমরা দেখি এবং মহানন্দে বরণ করি । গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতী সকলেই তো অন্যসময়ে আসেন একবার করে তাহলে মায়ের সাথে কেন তাদের আসা চাই-ই??? অথচ দুর্গাপুজোর সময় চালচিত্রের মাথায় ছোট্ট করে লুকিয়ে থাকেন মহাদেব। উনি কি তবে নাটের গুরু? 
কার্তিক না হয় দেবসেনাপতি। সে তরুণ সদৃশ, সুকুমার, শক্তিধর এবং সর্বসৈন্যের পুরোভাগে অবস্থান করে । তাই মাদুর্গার যুদ্ধযাত্রায় এমন শৌর্যবীর্য সম্পন্ন পুত্র সঙ্গী না হয়ে যায় কোথায় ! অসুরের সাথে যুদ্ধের সময় তাকে মায়ের খুব প্রয়োজন। 
গণেশ না হয় ত্রিকাল জ্ঞানী, সিদ্ধিদাতা, বিঘ্নেশ অর্থাত সকল বাধা বিঘ্ন নাশ কারী । যুদ্ধের মত ভয়ানক পরিস্থিতিতে তাঁর স্মরণ অবশ্য কর্তব্য কিন্তু বাকীরা? অর্থাত লক্ষ্মী-সরস্বতী? তাঁদের কি ভূমিকা এই দুর্গাপুজোতে?
কেউ বলেন এঁরা মায়ের অন্য দুটি রূপ। শ্রী শ্রী চন্ডীতে দুর্গাদেবীকেই মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতী রূপে আখ্যা দেওয়া হয় । লক্ষ্মীদেবী হলেন বিষ্ণুপ্রিয়া বা নারায়ণী যিনি সৌভাগ্য, ঐশ্বর্য্য এবং সমৃদ্ধির প্রতীক আর সরস্বতী হলেন বাগদেবী, বিদ্যা-বুদ্ধির অধিষ্ঠাত্রী, জ্ঞানদায়িনী। অর্থাত এই দুই নারীশক্তি সকল শুভ, সৃজনশীল, গঠনমূলক ক্রিয়াকলাপের উত্স । তাই শুভ শক্তির প্রতীকও বটে ।

১১ অক্টো, ২০১৮

কাউন্টডাউন-৪ঃ সায়ুধায়ৈ






  • কে এই মহিষাসুর? কিভাবেই বা তার জন্ম?

মহিষাসুরমর্দ্দিণি দুর্গা বৃত্তান্তের খলনায়ক হলেন অপরাজেয় দোর্দ্দন্ডপ্রতাপ মহিষাসুর।  
বরাহপুরাণের মতে বিপ্রচিত্তি নামক দৈত্যের মাহিষ্মতী নামে একটি মেয়ে ছিল। ছোট মেয়ে খেলার ছলে সিন্ধুদীপ নামে এক তপস্যারত ঋষির সামনে গিয়ে মহিষীর বেশে তাকে ভয় দেখাতে লাগল। ঋষির তপস্যাতো লাটে উঠল। ক্রুদ্ধ ঋষি ছোট মেয়েটিকে তখন “তাহলে মহিষী‌ই হয়ে যাও” বলে অভিশাপ দিলেন। সেই মহিষীরূপী মাহিষ্মতীর গর্ভে যে পুত্রসন্তান হল তার নাম মহিষাসুর।
কালিকাপুরাণে বলে মহিষাসুর হল রম্ভাসুরের পুত্র। প্রবল ক্ষমতাশালী রম্ভাসুর মহানন্দে এক সুন্দর মহিষীকে বিবাহ করে। বিবাহ করে ফেরার পথে আর এক অসুরের দ্বারা রম্ভাসুর নিহত হয় আর তার নবপরিণীতা স্ত্রী কিছুদিন পর জন্ম দেয় মহিষাসুরের। যে কিনা মহাদেবের আরাধনা করে দেবীর সাযুজ্যলাভের বর লাভ করে। কঠোর তপস্যার দ্বারা ব্রহ্মার কাছ থেকে অমরত্ব পায় । ব্রহ্মা যেমন মহিসাসুরকে অমরত্ব দিলেন তেমনি বললেন একমাত্র নারীশক্তির দ্বারাই এই মহিষাসুর বধ হবে।
একের পর এক বরলাভের পর এই মহিষাসুরের দাপট ক্রমশঃ বাড়তেই থাকে।
পুরাণ আর শাস্ত্রের পাতায় আমরা দেখি আবির্ভূতা হতে এক অসামান্যা নারীর যিনি একহাতে বরাভয় অন্যহাতে তুলে নেন অস্ত্র। দশপ্রহরেণ সেই দেবীশক্তির হাতে পরাজিত হন মহিষাসুর। এবার দেখা যাক এই দেবীশক্তির রহস্যের পেছনে কোন্‌ ঘটনা ছিল।

  • মেধাঋষির মুখে মহামায়ার উত্পত্তি সমূহ আখ্যান : কিসের বলে মাদুর্গার এত শক্তি? 

মহিষাসুর তখন অসুরগণের রাজা। দেবতাদের বলে অমরত্ব লাভ করে তার বিশাল প্রতিপত্তি। অত্যাচারী মহিষাসুর তখন দেবতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে ঠিক করেছে । স্বর্গ তার পাখির চোখ। যেনতেনপ্রকারেণ দেবতাদের পরাজিত করে স্বর্গরাজ্য তার দখলে আনতেই হবে। একশো বছর ধরে যুদ্ধ করে স্বর্গরাজ্য নিজের করায়ত্বে আনল সে। দেবসেনাবাহিনী পরাজিত হল আর মহিষাসুর হল স্বর্গের রাজা। দেবতাগণ একত্র হয়ে বিষ্ণু ও মহাদেবকে সঙ্গে নিয়ে প্রজাপিতা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হল। একজন অসুরের কাছে তাঁরা কি করে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন সব কাহিনী জানালেন ব্রহ্মাকে। দেবতাদের মুখে মহিষাসুরের দ্বারা এমন লাঞ্ছনার ঘটনা শুনে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহাদেব যারপরনাই ক্রুদ্ধ হলেন। তাঁদের মুখমন্ডল থেকে এক মহাতেজ নির্গত হল। হিমালয় অঞ্চলে ঋষি কাত্যায়ণের আশ্রমে সেই মহাতেজ থেকে জন্ম নিল এক দেবী। আশ্বিনমাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে তাঁর আবির্ভাব হল আর ঋষি কাত্যায়ণের আশ্রমে জন্ম বলে তাঁর নাম হল কাত্যায়ণি। এই দেবীর শরীরের এক একটি অংশ এক একজন দেবতার তেজে তেজোপ্রাপ্ত হল।
শিবের তেজে দেবীর মুখ, যমের তেজে কেশপাশ, বিষ্ণুর তেজে বাহুসমূহ, চন্দ্রের তেজে কুচযুগ, ইন্দ্রের তেজে শরীরের মধ্যভাগ, বরুণের তেজে জঙ্ঘা ও উরুদ্বয়, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্রহ্মার তেজে পদযুগল, সূর্যের তেজে পায়ের অঙ্গুলিসমূহ, এবং কুবেরের তেজে তৈরী হল উন্নত নাসিকা। অষ্টাবসুর তেজে তার হাতের আঙুল তৈরী হল। দক্ষাদি প্রজাপতিগণের তেজে তাঁর দন্তসকল এবং বহ্নির তেজে দেবীর ত্রিনয়ন সৃষ্টি হল। সন্ধ্যাদেবীদ্বয়ের তেজে ভ্রূযুগল ও বায়ুর তেজে উত্পন্ন হল কর্ণদ্বয় । দেবী এরূপে তেজসম্ভূতা হলেন কিন্তু মহিষাসুরকে বধ করবার জন্য তো তেজই যথেষ্ট নয়। তাই সকল দেবতারা এই দেবীকে অসুর বধের জন্য নানাবিধ দিব্যাস্ত্র যোগাতে লাগলেন। 



  • কোন্‌ কোন্‌ দেবতারা মাদুর্গাকে কি কি অস্ত্র দিয়ে মা'কে "সায়ুধা"(আয়ুধ-অস্ত্র) করলেন?   


  • হাদেব তাঁর স্বীয় শূল থেকে সৃষ্ট একটি ত্রিশূল দিলেন । 
  • বিষ্ণু তাঁর সুদর্শণ চক্র থেকে সৃষ্ট চক্র দিলেন। 
  • রুণ দিলেন শঙ্খ ও নিজের পাশ থেকে তৈরী করে আর একটি পাশ। 
  • গ্নিদেব দিলেন শক্তি। 
  • বনদেবতা দিলেন একটি ধনুক ও দুটি বাণপূর্ণ তূণীর । 
  • দেবরাজ ইন্দ্র দিলেন বজ্র ও ঐরাবত নামক স্বর্গের হাতির গলদেশের ঘন্টা থেকে ঘন্টা তৈরী করে দিলেন ঘন্টান্তর। 
  • মৃত্যুরাজ যম দিলেন কালদন্ড। 
  • প্রজাপতি ব্রহ্মা দিলেন একটি রুদ্রাক্ষের মালা ও কমন্ডলু। 
  • দেশিল্পী বিশ্বকর্মা দিলেন কুঠার ও নানাপ্রকার অস্ত্র ও অভেদ্য কবচ। 
  • সূর্যদেব দেবীর লোমকূপে তাঁর তেজরাশি সমর্পণ করলেন। 
  •  কালের দেবতা দিলেন একটি উজ্জ্বল ধাতব ঢালও প্রদীপ্ত খড়্গ। 
  • ক্ষীরসমুদ্র দিলেন পদ্মের মালা, হাতে দিলেন পদ্মফুল এবং নানাবিধ অলঙ্কার যেমন, মুক্তামালা, দিব্যচূড়ামণি, কর্ণকুন্ডল, হাতের বলয়, ললাটভূষণ, বাজু, নির্মল নূপুর, অত্যুত্তম কন্ঠহার ও সমস্ত অঙ্গুলিতে শ্রেষ্ঠ অঙ্গুরীয়। 
  • হিমালয় দিলেন দেবীর বাহন সিংহকে।  
  • কুবের দিলেন একটি সুরাপূর্ণ পানপাত্র। 
  • নাগরাজ বাসুকি দিলেন একটি মহামণিশোভিত নাগহার। 

এইরূপে দিব্য আয়ুধে দশভুজা দেবীমূর্তি সজ্জিত হয়ে উঠলেন। এবং প্রস্তুত হলেন সেই মহাসংগ্রামের জন্য।
যেহেতু ব্রহ্মার বরে মহিষাসুর দেবাসুর-দানবের অবধ্য হলেও স্ত্রীবদ্ধ হবে তাই বুঝি ঋষি কাত্যায়ণ সকল দেবতার তেজ এবং ক্রোধানলের শক্তি ও দিগন্তব্যাপী সংহত তেজ দিয়ে তৈরী করলেন এই কাত্যায়ণীকে।
গভীর গর্জণে আকাশবাতাস ধ্বনিত হল। দেবীর সিংহনাদে দশদিশি কম্পিত হল। পৃথিবী ও পর্বতসকল বিচলিত হল। দেবগণ সানন্দে সিংহবাহিনী দেবীর জয়ধ্বনি দিলেন। মুণিগণ দেবীর স্তব শুরু করলেন। অসুরগণ ত্রিলোকবাসী দেবতাদের উদ্দেশ্যে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ধেয়ে এল। যুদ্ধ শুরু হল প্রবল।
বিন্ধ্যপর্বতে এই তিলোত্তমা দেবী মহামায়া বা কাত্যায়ণি সসৈন্যে অগ্রসর হয়ে অচিরেই বধ করলেন মহিষাসুর নামক দোর্দ্দন্ডপ্রতাপ ঐ দৈত্যটিকে। আর এই মহিষাসুরকে বধ করে দেবীর অপর নাম হল মহিসাসুরমর্দ্দিণি ।

৯ অক্টো, ২০১৮

পুজোসহিত্য ২০১৮

উপন্যাস- কালকাহিনী - পুরুলিয়া দর্পণ
বড় গল্প- পঞ্চকন্যা এবং - যুগশংখ শারদীয়া 
ছোটগল্প- সহজ লতা - মাতৃশক্তি শারদীয়া
          সুহাগ রাত - রবিবার শারদীয়া 
          ঠিক-ভুল - মালিনী
          ছায়াশরীরি - পূর্বভারত         
          নষ্টরূপ - তারুণ্য পুজোসংখ্যা
          লেডিজ রাইটিং টেবিল - শারদীয়া প্রবাহ 
          দেখা - নিউজ ক্যাফে বাংলা
          স্বপ্ন - কলকাতা ২৪x৭
নিবন্ধ- চালচিত্র কথা - চিন্ময়ী (বাংলাদেশ)
অণুগল্প দুটি- হীরের নাকছাবি, দ‌ইমাছ - ত্রিধারা শারদসংকলন  
             ঠাকুরগড়া -          প্রথম আলো 
ভ্রমণঃ কৈলাস পর্বত ও মানস সরোবর- ভ্রমণ শারদীয়া
স্যুইটজারল্যান্ডে - যুগসাগ্নিক শারদীয়া  
মোনালিসা, হাঞ্চব্যাক ও ক্যাবারের শহরে - ম‌উল 
ফিলি ডায়েরী- শব্দের মিছিল উত্সব সংখ্যা 
বিভ্রম কাহিনী- শারদ অর্ঘ্য (মহুয়া প্রকাশনী) 
কিশোর গল্পঃ  তিব্বতী কিংবদন্তী অনুসারেঃ ইচ্ছামতী, ম্যাজিক ল্যাম্প
              ছোটগল্প কন্যাশ্রী- দোয়েল পত্রিকা
              স্মৃতিচারণা- একপর্ণিকা  

২৯ আগ, ২০১৮

স্বপ্ন

এক ঘর ময়দা মেখেছি আমি। ময়দা ঠাসছি তো ঠাসছিই। তারপর সেই ময়দা কে আমি একা হাতে ফ্ল্যাট করে আমার ঘরের মেঝেতে পাতছি। কোথাও একটু অসমতল থাকবে না। আমি খুব যত্ন করে পিত্‌জা বানাচ্ছি আজ। বাড়ির সকলকে সারপ্রাইজ দেব বলে একান্তে নিজের ঘরে চুপিচুপি কাজ সারছি। সেই এক ঘর ময়দা আমার এক ঘর বর্গক্ষেত্র মেঝেতে তখন। আমি দেখছি তাকে। এবার পিত্জা সস হাতে করে নিয়ে এক খাবলা তার ওপরে রাখি। আবারো পুরোটায় সমান করে ব্রাশ করি। তারপরে টপিং দেবার পালা। পেপারনি স্লাইস, হ্যামের কুচি, চিকেন সসেজ সব কিনে এনেছি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে। সেগুলোকে ম্যারিনেট করে ননস্টিক প্যানে এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েলে স্টার ফ্রাই করেছি উল্টেপাল্টে। সেগুলো কে সাজিয়েছি ময়দার ওপরে বেশ ডিজাইন করে। এবার ক্যাপসিকাম, পিঁয়াজ, টোম্যাটো স্লাইস আর একটু ব্ল্যাক অলিভ কুচি দিয়েছি মাংসের ফাঁকে ফাঁকে। এবার আসল জিনিস। মানে চিজ। মোতজারেল্লা চিজ গ্রেট করে চলেছি তো চলেইছি। অতবড় একঘর পিতজা! একের পর এক চিজের স্ল্যাব ঘষছি আমি। কি অপূর্ব রঙের বাহার! সবশেষে অরেগ্যানো আর চিলি ফ্লেক্স ছড়িয়েছি মনের সুখে। সবশেষে আভেন অন করতে গিয়ে মনে হল আগুণ টা দেব কোথায়? আমার ঘরের মেঝের নীচে এবং ছাদে থিয়রিটিক্যালি আগুণ জ্বালানোর কথা। তবে দুদিকেই বেকড হবে এই সুস্বাদু পিতজা। কিন্তু আমি আগুণ দেব আমার নিজের ঘরে? জেনেশুনে? ভাবতে ভাবতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল আজ ভোরে। এমন আজব স্বপ্ন কেন দেখলাম ?

৮ জুল, ২০১৮

২১ মে, ২০১৮

যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক" / জেনে শুনে বিষ করেছি পান




ভোর ভরেছি ভেজালে । শুরু ভেজাল দুধ দিয়ে । তাতে নাকি মিশ্রিত চকের গুঁড়ো, ডিটারজেন্ট,এমোনিয়াম সালফেট, বোরিক এসিড, কস্টিক সোডা। হাঁস মুরগীর খাবারে Astaxanthin মিশিয়ে ডিমের কুসুম টুকটুকে কমলা করার পদ্ধতিও বহুদিনের। আর ব্রেড?  ময়দা নাকি সবচেয়ে বড় শত্রু  আমাদের শরীরের। কারণ প্রোসেসিং এর সময় সব নিউট্রিয়েন্টস ঝেড়ে পুছে ফেলে দেওয়া হয়। তবে ব্রাউন ব্রেড ? বেশীর ভাগ দোকানেই ব্রাউন ব্রেড ময়দা দিয়েই বানান হয় । আর বাদামীর কারণ ক্যারামেল। জানতেন না? কি করে জানবেন? উইক এন্ডে লঙ ড্রাইভে গিয়ে ধাবার খাটিয়ায় বসে মনের সুখে তন্দুরি রুটি আর মাংস খেয়ে সুখ ঢেকুর তোলেন নি? তখন জানতেন ওই মাংস ভাগাড়ের মৃত পশুর? 
তাহলে মুড়িই খান। সেখানেও মুড়িভাজার আগে নাকি ইউরিয়া মেশানো হয়। লম্বা লম্বা ধবধবে সাদা, ফুরফুরে জুঁইফুলের মত মুড়ি দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়ি আমরা। অথচ গ্রামের মেয়েরা যে মুড়ি নিয়ে বাজারে বসে সেগুলি অপেক্ষাকৃত মোটা, লাল মুড়ি। সেগুলোর দিকে ফিরে চাই না। পহেলে দর্শণধারী চাই যে আমাদের।       
চা' পাতায় রং করা কাঠের গুঁড়ো, লোহার গুঁড়ো । এবার চাল সেখানেও পাউডার মেশানো । নয়ত পোকা লেগে যাবে । সবজী তে পর্যাপ্ত পেস্টিসাইড। ফলন হবেনা যে। তুঁতে গোলা জলে সবজী ? টাটকা, সবুজ দেখাবে যে বহুক্ষণ। মাছ? সেখানেও বাইরে থেকে রোডামিন বি  ইঞ্জেক্ট করা কানকোর মধ্যে। মাছ কে তাজা দেখাবে তাই।
আর বিশেষ রোগে আক্রান্ত মরা মাছ সস্তায় কিনে এনে সস্তায় বিক্রি করা?  বা মরা চিকেন ফরমালিন দিয়ে তাজা রাখার কৌশল? ব্যাবসায়ীরা খুব ভালই আয়ত্ত করেছেন এসব।
মাংস? যাকে খাসি বলে ভাবছ, সে আসলে মেয়ে ছাগল। সরকারি নীল ছাপ মেরে ঝুলছে চোখের সামনে। মুরগী? তার মৃত্যু যে কবে হয়েছে না জেনে কিনলেই মরেছ তুমি। নতুন হাইপ। তাহলে খাবটা কি? হাওয়া খেয়ে থাকব?  পওহারী বাবার মত।

এই সেবার ম্যাগি নিয়ে গেল গেল রব উঠল। হেলে ধরতে পারিনা, কেউটে ধরতে যাই আমরা।

ফুড সেফটি এন্ড স্ট্যান্ডার্ডস অথোরিটি অফ ইন্ডিয়া নামে একটি খাদ্য নিয়ামক সংস্থা আছে।  কিছুদিন আগে যারা ম্যাগির মধ্যে নিষিদ্ধ সীসে আর আজিনামোতোর উপস্থিতিতে ম্যাগির গুষ্টির তুষ্টি করে ছাড়ল।  আচ্ছা তারা দেখতে পান না রাস্তার মোড়ের তেলেভাজা কিম্বা কচুরিভাজার দোকানের তেলের রং? বারেবারে উচ্চ তাপমাত্রায় তেল কে গরম করলে HNE(বা ৪-হাইড্রক্সি ট্রান্স-২ ননেনাল্) নামক যৌগটি ডিপ ফ্রায়েড ফুডে শোষিত হতে থাকে যা দীর্ঘদিন সেবন করলে কার্ডিওভাসকুলার এবং নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের সৃষ্টি করে।
সব্জির বাজারে উচ্ছে, পটল বা কাঁকরোল কে তুঁতের জলে ডোবানো ?  তুঁতে মানে কপার সালফেট। নির্ভেজাল বিষ মশাই। পোকা মারার অব্যর্থ দাওয়াই। মানে যাকে বলে ইনসেকটিসাইড। 
মাঝেমাঝেই কর্মকর্তারা নড়েচড়ে বসেন খাদ্যের মান নির্ধারণ নিয়ে। কমিটি গঠন হয়। সব্জিতে রং মিশিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে ব্যাপারী।  টিভি চ্যানেলে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়।  এগুলি জামিন অযোগ্য অপরাধ বলে। তারপর চুপচাপ । কোয়ালিটি কন্ট্রোল হবে, অপরাধীর সাজা হবে। স্তোক দেওয়া অব্যাহত থাকে। পরিকাঠামোর অভাব আছে বুঝি? কেন্দ্র দেবেন না অনুদান? ভাইটাল ব্যাপার।

নাগরিক স্বাস্থ্য বলে কথা। আর অনুদান পেলে বেসরকারী সংস্থারা এগিয়ে আসছেন না কেন? ফুটপাথীয় ফার্ষ্টফুডের রমরমা চলতেই থাকবে?  মরুক মানুষ। মরুক সমগ্র জাতি। তৃতীয় বিশ্বে এমনি হবেক। বিদেশে কিন্তু খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের বিশেষ সেল থাকে। তারা গুণমান দেখে। আর আমরা কিনা দেখি হোটেলের সিংকের নীচে স্তূপীকৃত নুডলস সেদ্ধ তে আরশোলার সানন্দে চরে বেড়ানো।  নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাব প্রায়শ‌ই দেখি নড়েচড়ে বসেন। লম্বাচওড়া বাতেলা আওড়ান । কিন্তু তারপরেও কচুরীর ভাজার তেলটি বদলানো হয় না দিনের পর দিন। আমাদের আর্থসামাজিক পরিস্থিতিটা এমনি থাকবে মশাই?  আমরাও  ঘুমে অচেতন থাকব।  আমাদের উচিত তর্পণে গাঙ শুকোয় । এত কাজ কে করবে বলুন তো?

হলুদ গুঁড়োর সঙ্গে মিশ্রিত থাকে হলুদের চেয়েও উজ্জ্বল কার্সিনোজেনিক লেড ক্রোমেট। আর টকটকে লাল লঙ্কার গুঁড়োয়  ? লাল cayenne পাউডার মেশানো হয়।  এই রং না মেশালেই নয়? আজ কি তাই ঘরে ঘরে এত কিডনির অসুখ ?  রান্নাঘরে এমন থৈ থৈ ভেজাল আমাদের। এছাড়া ঐ সব মনোহারী শরবত, দর্শনধারী বোতলবন্দী পানীয়? গ্রিন ম্যাঙ্গোয় ম্যালাকাইট গ্রিন, টুকটুকে লাল গোলাপের মত পানীয়ে কঙ্গো রেড বা এলিজারিন? এ সব রাসায়নিক আমাদের শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক । ভোজ্য সর্ষের তেলে রেড়ির তেল, শিয়ালকাঁটার তেল, আর্জিমোন অয়েলের  উপস্থিতি তো সর্বজনবিদিত।? সেও তো ড্রপসি, অষ্টিও আরথাইটিসের কারণ। বেসনের মধ্যে খেসারির ডালের গুঁড়ো? সেও তো মারাত্মক। গোলমরিচের মধ্যে পেঁপের শুকনো বীজ মিশিয়ে দেওয়া? জানেন এইসব কারণেই লিভারের সমস্যা থেকে দৃষ্টিশক্তি, নার্ভ থেকে আর্থাইটিস এসব রোগ অপ্রতিরোধ্যভাবে বেড়েই চলেছে। মিষ্টির দোকানে রূপোলী তবক দেওয়া মিস্টিগুলি দেখেই কিনতে ছোটেন তো? একদম না। ওগুলি তো ক্রেতা কে আকৃষ্ট করার উপায়। যাহা চকচক করে তাহা বিষ। জেনেশুনে বিষ পান করবেন কেন? অন্য মিষ্টি নিন। এই এলুমিনিয়াম ফয়েলে পেটের সমস্যা হয়। এযুগের আরেকটা হাইফাই ব্যাপার হল সুগারফ্রি মিষ্টি? চিনির বিকল্প হিসেবে ব্যাবহৃত স্যাকারিন সস্তা কিন্তু ব্যানড বহুদিন। আর এসপার্টেম অথবা সুক্রালোজ? কোনোটাই দরকার নেই আমাদের শরীরে। চিনি বাদ দিন। বিকল্প খাবেন না। আর মন না মানলে একটু চিনি ই খান। সুগার ফ্রি নৈব নৈব চ। 
টালা থেকে টালিগঞ্জে, বালি থেকে বালিগঞ্জে, খিদিরপুরে অথবা ভবানীপুরে, মল্লিকবাজার কিম্বা বাগবাজারে সর্বত্র‌ই জেনেশুনে বিষ পানের বিশাল আয়োজন কিন্তু। টিভি বলবে জাগো গ্রাহক জাগো। ক্রেতা সুরক্ষার কচকচি আওড়াবেন নেতারা। কিন্তু শরীর আমার। স্বাস্থ্য‌ও আমার। সেখানে নো কম্প্রোমাইজ। 

বিশ্বসংস্থার স্বাস্থ্য রিপোর্টে আবারো হুঁশিয়ারি। চাপান উতোর। জলঘোলা। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশেও ভবি ভোলার নয়। অতএব জুভেনাইল হৃদরোগ, স্নায়ুরোগ, ক্যানসার ইত্যাদি মারণরোগের বাড়বাড়ন্ত, এটাই সত্য। ওবেসিটি আজকের সমাজের অভিশাপ। এও সত্য।

এখন আবার শুনছি একজনের এঁটো পাতকুড়োনোও দিব্য চালান হচ্ছে অন্যের প্লেটে। রেস্তোঁরার ফ্রিজের খাবারদাবারে নাকি পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাংগাস। টেলিভিশনে টক শো। হট কেক টপিক। দেখেছেন তো? হ্যান করেঙ্গা, ত্যান করেঙ্গা। রেস্তোঁরার ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করেঙ্গা। চার্জশিট পেশ। জরিমানা, কারাবাস। আবার সব ধামাচাপা। 
আরো কত বলব? স্বনামধন্য ফুড ব্র্যান্ডে চানাচুরে নাকি বহুদিন কুড়মুড়ে রাখার জন্য মার্বেল ডাস্ট মেশানো হয়? অথবা কেশরী বিরিয়ানী কিম্বা রাবড়ি তে মেটানিল ইয়েলো? এটি ক্যানসারকারক কেমিক্যাল। তবে এবার যারা সক্কলকে ঘোল খাইয়েছেন ভাগাড়ের পচা মাংস বেচে তাদের রাজ্য-শ্রী এওয়ার্ড দেওয়াই যায় সত সাহসের জন্য।
হিমঘরে উদ্ধার হওয়া এই মাংসের মধ্যে কুকুরের মাংসও রয়েছে। বজবজ থেকে রাজাবাজার, ধাপার মাঠ থেকে সোনার পুর, এমনকি বিহার অবধি ব্যাপ্তি এই মাংস চক্রের।   এজেন্ডা হল এমনি। পশুর মৃত্যু, কোল্ড স্টোরেজ, কেমিক্যালস প্রয়োগ, আবারো হিমঘর তারপর প্যাকেজিং। ব্যাস! আম আদমীর ঘরে পৌঁছে যাবার সুনিপুণ ব্যবস্থা।
লজ্জা, ঘেন্না, ভয়, এই তিনের কোনোটিই নেই এই চক্রের। অতএব ব্যবসার খাতিরে গো এহেড!  যতদিন না ধরা পড়ছি লজ্জাই বা কিসের্, ভয় ই বা কেন আর ঘেন্না? ওসব থাকলে কেউ ভাগাড়ের মাংস মানুষের খাবারের জন্য ভাবতে পারে?  ছিঃ আমার তো ভেবেই ঘেন্না করছে। 
কিছু মানুষের অবিশ্যি ভাবখানা এমন যে, ভাগাড় থেকে মৃত পশুর টন টন মাংস সস্তায় বিকোচ্ছে বুঝি? ঠিক আছে ক'দিন মাংস খাব না বাবা। তারপর? তার আর পর নেই। পচন ধরা আমিষ অথবা কৃত্রিম রং মেশানো খাবারদাবার। সব গা সওয়া আমাদের। অতএব যা চলছে চলুক। তৃতীয় বিশ্বের চতুর্থ শ্রেণীর নাগরিকদের এমনি প্রাপ্য।
আবার স্যাম্পেল এনালিসিস হবে। ঠগ বাছার প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে । কসাই ধরপাকড় হবে । ফরেনসিক এক্সপেরিমেন্ট হবে। উদ্দিষ্ট চক্র ছাড়াও পাবে। আপনার আমার নাকের ডগায় আবার বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে তারা । একদিন এ ঝড় ঠিক থেমে যাবেই। পৃথিবী আবার শান্ত হবেই। 
মাংসাশী মানুষ তখন আবার জোর কদমে ঘেন্না, ভয় ভুলে মাংসের ঝোল খাবে কব্জি ডুবিয়ে। বলবে খেয়ে তো নি আগে, তারপর দেখা যাবে। জেনে শুনে বিষ পান? ওসব রবিঠাকুরের কাব্যেই হয়। আমাদের কি এসে যায়?

যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক"

যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক" / কে দেবে গো মায়েদের বেকারভাতা ?

মায়ের দিন? সে ত রোজদিন। মা-দিবসের প্রাক্কালে এ আর এমন কি? দেশের অগণিত মায়েদের জন্যই এ লেখা।  সেই আসনতলে, মাটির পরে তাদের স্থানটি বেশ শক্তপোক্ত তো এখনো? না মানে আজ কেবলই গৃহবধূ মায়েদের কথাই মনে করছি। এক একটা দিন এই অবলা গৃহবধূদের কথা খবরের কাগজে শিরোনামে স্থান পায়। মনে পড়ে? উত্তরপ্রদেশের গৃহবধূ রেণু আগরওয়ালের রোড একসিডেন্টে মৃত্যু? তার স্বামী অরুণ আগরওয়াল আদালতের দ্বারস্থ হয়ে ইন্সিওরেন্স কোম্পানির থেকে  ক্ষতিপূরণ স্বরূপ ১৯.২ লক্ষ টাকা দাবী করেন আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে। এলাহাবাদ হাইকোর্ট, এবং মোটর একসিডেন্ট ক্লেম ট্রাইব্যুনাল সেটি মেনে নিল না এবং তখনই শুরু গৃহবধূ ওরফে হোমমেকার চ্যাপটার । একজন গৃহবধূর ন্যাজ্য মূল্য কি হতে পারে সেই নিয়ে চাপানউতোর ।  গৃহবধূর প্রাণের মূল্য থেকে একজন হোমমেকারের income potential সব উঠে এল। পার্লামেন্টে ও চিন্তা ভাবনা শুরু হল।  এই হোমমেকারের সঠিক মূল্য কত হওয়া উচিত?  আর সংসারে তার অবদান কড়ায় গন্ডায় হিসেব করে একটি ন্যাজ্য মাপকাঠিতে তার জন্য একটি পে-রোল স্ট্রাকচার খাড়া করা যায় না কি?  তাহলে রেণুর মত কোনো গৃহবধূর পথ দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলে তার স্বামী যাতে ন্যাজ্যমূল্যের অঙ্কটি ক্ষতিপূরণ রূপে পান ।
অন্যথায় সেনসাস 2001 অনুযায়ী ৩৬কোটি এরূপ গৃহবধূ মা' কে ভিখারিণী, বারবণিতা এবং বন্দিনীর সঙ্গে একই আসনে সেবার রাখা হল কারণ এই চার ধরণের মায়েরা নাকি অকর্মার ঢেঁকি এবং দেশের nonproductive population এর মধ্যে পড়ে তারা । এর অর্থ মায়েরা তবে র‌ইলেন অবহেলিতা, স্থান পেলেন না সেই আসনতলে? পেলেন না তাঁর কাজের প্রাপ্য মূল্য ।

ভিখারীনি মা দেশের অর্থনীতিতে কিছু contribute করেনা। কিন্তু ভিখারীনি তার লোটা-কম্বল সম্বল করে ফুটপাথের স্নিগ্ধ সুশীতল ছায়াতরু তলে লালন করেন তার সংসার। কেউ কি স্বেচ্ছায় ভিক্ষা করে ? তাঁর প্রাপ্য মর্যাদাটুকু কে দেবেন?
বন্দিনী মা ? সেও তো অর্থনীতিতে এক নয়া পয়সা contribute করে না বরং উল্টে তার জন্য সরকারের প্রচুর টাকা ব্যয় হয় । বারবণিতা মা, ত স্টেজ পারফর্মারের মত মনোরঞ্জন করছেন জনতার । তিনি  সমাজে না থাকলে ঘরের মায়েদের রাস্তায় টেনে আনা হত। তিনি নৈতিক না অনৈতিক কাজ করছেন সেটা আলোচনার বিষয় বস্তু নয় কিন্তু তিনি উত্‌পাদনে তথা দেশের জিডিপিতে পরোক্ষভাবে কিছু contribute করছেন  । তাকে আন-প্রোডাক্টিভ বললে তো সিগারেট বা লিকার মার্চেন্টদেরও সেই পর্যায়ে ফেলতে হয়  ।
এদের সঙ্গে একবার হোমমেকারদের পঙতিভোজনে বসানো হয়েছিল সেবার। আজ মা দিবসের প্রাক্কালে কেবলই এই প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে। দেশের গ্রস ডোমেষ্টিক প্রোডাক্ট বাড়া কমায় একজন হোমমেকারের অবদান তবে কি শূন্য ?
এবার বলি ?  "শিশুরাই জাতির ভবিষ্যত'।  তা বলি এই শিশুদের দশমাস দশদিন নিজের জঠরে ধারণ করে, তারপর জন্মের পর থেকে  মায়ের স্নেহটি দিয়ে লালন করেন সেই মা । আবার তাকে স্কুলের জন্য তৈরী করে, পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করে তাকে কত টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে মানুষ করেন কে শুনি ? আর ঘর গেরস্থালী? বাড়িতে কাজের লোক না এলে, বাড়ির সব লোকের দেখাশুনো করা থেকে শুরু করে ইলেকট্রিক বিল, টেলিফোনবিল জমা দেওয়া, ডাক্তার ডাকা, প্রত্যেক সদস্যের জন্য কাস্টমাইজড সার্ভিস দেন এই মা । কথায় বলে "খুজরো কাজের মুজরো নেই' । তাই  গৃহবধূ মা'দের কাজের কোনো দাম নেই । অনেকে বলেন  "বাড়িতে থাকো, কি আর কর, আমাদের মত  দশটা-পাঁচটা তো আর করতে হয়না'  বা "বুঝতে ঠেলা যদি বাইরে বেরোতে হত, তুমি আর কি কর, রান্না ? সে  কাজ তো সবাই পারে'।
অতএব মা তার দৈনন্দীন কৃতকর্মের জন্য  অর্থনৈতিক ভাবে উতপাদনশীল বলে আখ্যা পাক অন্ততঃ । নয়ত তারা কেবলই দেশের জনসংখ্যা বিস্ফোরণের দায়টি মাথায় তুলে নিয়ে তাদের উত‌পাদনহীনতার মুকুট পরে বসে থাকবে  আজন্মকাল । একটি কোম্পানির সারাবছরের হিসাবের খাতাটিকে বলে অ্যানুয়াল রিপোর্ট যেখানে দুটি টেবল থাকে একটি ব্যালেন্সড শিট অন্যটি লাভ-ক্ষতির হিসাব; এই মা  সেই দেশের অর্থনৈতিক হিসাবের খাতায় ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রতিপালন করে জাতীয় সম্পদ বা capital asset তৈরী করছেন । চুলোয় যাক বাসন মাজা, ঘরপোঁছা, রান্না করা, ঝুল ঝাড়া । লাভ-ক্ষতির একাউন্টে তাকে না আনাই শ্রেয় । তিল তিল করে সঞ্চিত হচ্ছে সেই সব ধনরত্ন সেই শিশু নাগরিকের মধ্যে । যার মধ্যে থেকেই কেউ গিয়ে নাসায় রকেট চড়ছে, কেউ বৈজ্ঞানিক হয়ে জীবনদায়ী ওষুধ তৈরী করছে, কেউ বানাচ্ছে  অটোমোবাইল, কেউ বা হচ্ছে সৌরভ, লিয়েন্ডার-বিশ্বনাথনের মত কিম্বা রবীন্দ্রনাথ, অমর্ত্য সেনের মত নোবেল লরিয়েট !
আর সেই মা যিনি নেপথ্যের নায়িকা? ভোর থেকে রাত্রি পর্যন্ত সংসারের স্টিয়ারিংটি হাতে নিয়ে সংসারটিকে চালনা না করতেন তাহলে জানিনা কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়াত । তাঁর প্রতিপক্ষ বলবে কারোর জন্য কারোর আটকায় না কিন্তু যতক্ষণ দাঁত থাকে ততক্ষণ দাঁতের মর্যাদা বোঝা যায় না । বাড়ির যে খরচাগুলি সেই মহিলা বাঁচান ততটাই টাকা রোজগারের সমতুল্য ।

আর মা তাঁর সেই ব্যস্ততায় ছেলের জ্বরে মাথায় জলপটিতে ওডিকোলন, নুন-হলুদ মাখা আঁচলে পোঁছেন মেয়ের টিফিনকৌটোটি, স্বামীর ওয়ালেট্, রুমাল, কলম হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন অফিসের তাড়ায়, তারপর বাজারের ব্যাগ হাতে বেরোন ইলেকট্রিক, টেলিফোন বিল, গ্যাসের দোকান, ওষুধের দোকান,  আর এটিএম মেশিনের লাইনে ।

মায়েদের জীবন অনেকটাই বহুজন হিতায়, সুখায় চ। এ নারীর বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না । তাই চালু হোক গৃহবধূ মায়ের বেকারভাতা।

যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক"

যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক" / তথ্যচুরি ভুরিভুরি


গেল গেল রব উঠল। সব ডেটা নাকি উধাও। ফেসবুক থেকে সব তথ্য নাকি চুরি হচ্ছে। এমন কি অ্যান্ড্রয়েড ফোনে লোকেশান অন্  করলেও গুগল আমাদের সব গতিবিধি জেনে যাচ্ছে। জি-মেইল এর প্রত্যেকটি ই মেইলের অ্যালগরিদম নাকি ওরা পড়ে । আর সেই বুঝে আমাকে অ্যাড দেখায়।  হোয়াটস্যাপের প্রত্যেকটি মেসেজ নাকি ফেসবুক কর্তাদের রেকর্ডে থাকে। কি জ্বালা রে বাবা! অথচ আমরা এখন প্রত্যেকেই সোশ্যালনেটওয়ার্কিং সাইটের দলদাস। আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা। তাই বলে আমার একান্ত আপন জীবনপঞ্জীতে নাক গলানোর কে হে তুমি ? কোথাকার হরিদাস পাল ই বা আমি যে আমার সবকিছু ডেটা তোমার নখদর্পণে রাখাটা জরুরী? সেদিন এই নিয়ে একজন ডেটা সায়েন্টিস্ট এর পোস্ট টা মনে রাখার মত । “if you are not paying for the product then you are the product” আর তাই বুঝি এইসব ফ্রি সার্ভিস। যা কিছু ফ্রি তাই সস্তার। কথায় বলে সস্তার তিন অবস্থা। তাই বলে আলাপচারিতার তথ্যও সস্তা। হ্যাঁ, ওদের মারফত তথ্য যখন অবাধে বিকোচ্ছে তখন সস্তা ত বটেই । যত্তসব ধান্দাবাজের কারবারি। ফ্রি তে পাওয়া বলেই এত বাড়বাড়ন্ত ওদের। অতএব  যখনি ফ্রি কোনো পরিষেবা পাচ্ছ তখনি কেয়ারফুল। আমাকে কেন সে দিচ্ছে এই পরিষেবা? নিশ্চয়‌ই বিনিময়ে আমাকে ইউজ করছে। আমাকে মানে আমার প্রোফাইল সম্বলিত ডেটাকে বা তথ্যপঞ্জী কে।

হঠাত সেদিন ঘুম ভেঙে গেল মাঝরাত্তিরে। চোর ঢুকেছে। রাতবিরেতে চোর ঢুকলে চীত্কার করে সিকিউরিটি ডেকে, থানায় ফোন করে কিছু একটা ব্যবস্থা নিতে পারি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখছি গুগল, ট্যুইটার, ফেসবুক, হোয়াটস্যাপ এ আমার ডেটা বেস থেকে আমার ডেটাগুলো নিয়ে ওরা কিসব করছে। শুধু আমার নয়। সকলেরি এই প্রবলেম। ইউজারদের তথ্য ভান্ডারে উঁকি দিচ্ছে ওরা প্রতিনিয়ত। শুধু উঁকি নয়। রীতিমত হানা দিয়ে তথ্য চুরি করে বিজনেস অ্যানালিসিস করাই ওদের কাজ। ডেটা পরখ করেন এইসব ডেটা অ্যানালিস্ট রা।  কি করেন ডেটা পরখ করে? মেঘের মধ্যে বসে আছি আমি আর আমার সোশ্যাল নেটের বন্ধুবান্ধবরা। আড্ডা জমে উঠেছে। কেউ ব্লগ লিখছিলাম মনের সুখে। কেউ ইমেইল পাঠাচ্ছি দরকারে। কেউ ফেসবুক অলিন্দে কমেন্টের ফোয়ারা ছোটাচ্ছি। কেউ হোয়াটস্যাপে গুলতানি । আর ডেটা সায়েন্টিস্ট রা আমাদের আড্ডা মহলের প্রলোভন দেখানোর সুযোগে সব ডেটা মাইনিং করে ফেলছে। আসলে এটাই তাদের রুজি রোজগার। থৈ থৈ ডেটা চাই তাদের।
আমরা কি তবে এদের হাতে বিক্রী হয়ে যাচ্ছি প্রতি মূহুর্তে?  
এইসব ছাইপাঁশ ভাবছিলাম আর ঘন নীল মেঘ সমুদ্রে বোঝাই করছিলাম তথ্য। কেউ কবিতা, কেউ গল্প, ভ্রমণবেত্তান্ত, কেউ রাজনীতির কূটকাচালী আর ছবি। তথ্য প্রযুক্তির ভাষায় একেই কয় ক্লাউড কম্পিউটিং। নিজের মেশিনে ডেটা না বোঝাই করে মেঘের মধ্যে মানে ডিজিটাল মেঘ সমুদ্রে থরে থরে ভরে দাও তথ্য। দরকার মত ঘাড় ধরে মেঘের মধ্যে ঢুকে বের করে নাও তোমার ডেটা। সবই ত ক্লাউড কম্পিউটিং।  ওরা জানছে। আর সেইজন্যেই তো আমাকে টার্গেট করে সুতীক্ষ্ণ বিজ্ঞাপন দেখিয়ে প্রভাবিত করছে। ক্লিক করলেই রেভিনিউ পাচ্ছে। ব্যাবসার প্রোটোকল। ধরুণ আমি একটি বিশেষ ব্র্যান্ডের পোষাক পচ্ছন্দ করি। ফেসবুকে ঢুকলেই তাদের রঙচঙে সেই বিজ্ঞাপনে ক্লিক করি। আর সেই সুযোগ নেয় ওরা। যতবার আমি ফেসবুকে ঢুকি সেই বিজ্ঞাপন ওরা আমাকে দেখাতে বাধ্য। ই কমার্সের সুযোগ নেব কি নেব না সেটা অন্য কথা।জিনিষটি কিনলে লাভ সেই কোম্পানির।কিন্তু এক ক্লিকেই তথ্য প্রযুক্তির কৌশল "আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স' প্রযুক্ত হল আমার ওপর। এ আই এর চোখ ঘুরছে অহোরাত্র। ফেসবুক ইউজারের ক্লিক ক্লিক মানেই তাদের ফেসবুক থেকে রেভিনিউয়ের ঝুড়ি উপচে ওঠা। এই ত সুযোগ মুরগী করার।
আসলে "ব্যাবসার জাল পাতা যন্ত্রজালে, কখন কে ধরা পড়ে তলে তলে'  
এর সঙ্গে রয়েছে  গরগরে প্রলোভনে পা দেবার তথ্যচক্র। তোমার প্রিয়, প্রিয়তর, প্রিয়তম বন্ধু কে,  মানের ক্রমানুসারে উঠে আসবে মাত্র একটি ক্লিকে। তুমি যাকে যত বেশী মেসেজ কর সে প্রিয়তম হতে বাধ্য। যার ছবি বা স্টেটাস আপডেটে নিয়মিত কমেন্ট কর সে প্রিয়তর আর যার পোষ্ট কেবল বুঝে বা না বুঝে লাইক মেরে পালাও সে থাকছেই প্রিয়র তালিকায়। জানো কি? 
আরো আছে। তুমি কোন বলিউড সুন্দরীর মত দেখতে অথবা কোন সেলিব্রিটি কে তোমার সবচেয়ে পছন্দ, শচীন না সৌরভ এসব জানতে চেয়েও ফাঁদে ফেলা যায়। একটাই উদ্দেশ্য কাজের ফাঁকে মুঠোফোনের এক ক্লিকে ফেসবুক বা গুগল আইডি দিয়ে লগ ইন, দেন স্টার্ট(ওদের কাছে তোমার ডেটা পৌঁছচ্ছে কিন্তু)। আর তারপর বিন্দাস! উতল হাওয়া। ঝলমল করে উঠল চিত্ত। উত্তর দেখে চমকিত আমি ও তুমি। আর মাঝখান থেকে ওদের ডেটা কালেকশান আর তারপর মাইনিং বা হান্টিং যাই বল।
মেঘের কোলে বসে ভাবছিলাম আবারো। তবে কে আমি ? বা আমার মত নগন্যের এহেন ডেটাবেস? হাতে স্মার্ট ফোন, কোলে ল্যাপটপ, ব্লগ লিখছি আমি। হাত নিশপিশ ক্লিকের জন্য। কিন্তু আর নয়। ক্লাউডে ভাসছে সব ডেটা। ওরা খুঁড়ে ফেলছে ডেটার খনি। ফেসবুকের নীল স্ক্রীনে আমার চোখ। মেঘের আড়াল থেকে বিভীষণ যুদ্ধ করেছিলেন না? আমিও তাই করি? নক্ষত্রপুঞ্জ ধেয়ে আসছে আমার দিকে। মহাস্থবির গ্রহেরা হাঁ করে গিলছে আমাকে।  সতর্কবাণী তাদেরঃ বুঝেসুঝে চলো হে! কেয়ারফুল্! তাই বলে কেয়ারলেস নয় কিন্তু'
 আমি কি তবে চুরি হয়ে গেলাম? ঘুম ভেঙে যায়। স্বপ্নের জাল ছিঁড়ে দেখি ধুস্! আমার মত নগন্য পাবলিকের গোলাপ না পলাশ কি প্রিয় জানতে চেয়ে প্রশ্নবাণ আবারো ধেয়ে আসছে আমার দিকে। আমি এড়িয়ে যাই এবার। কারণ কয়েক বছর আগেই  নীল রং না লাল রং সেটা সাধারণ লোকেদের কাছে জানতে চেয়েই ক্ষুদ্রতর স্বার্থ বৃহত্তর স্বার্থে প্রতিপন্ন হয়েছিল। সে ডেটা হান্টিং ছিল নীল পার্টি না লাল পার্টির পক্ষে না বিপক্ষে জানার কৌশল। আর তলে তলে আমেরিকার ভোটযুদ্ধে ফেসবুক ইউজারদের রাজনৈতিক প্রেম কোন দলে সেই তথ্যটুকুনি ওরা কাজে লাগিয়ে নিল সুকৌশলে। অর্থাত ভোটদাতারা প্রভাবিত হল এভাবেই। বিজ্ঞাপনের দ্বারা। এবার বুঝুন আপনি। কি করবেন। 
যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক"

যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক" / পরীক্ষা বাতিল

 
এখন পরীক্ষা হয়ে যাবার পর ক্যান্সেল শুনলেই  মনে পড়ে যায় ১৯৮৪ সালের কথা। সে আশির কথা ভাবলে এখনো বিস্ময়ে হতবাক হ‌ই। আশি না আশীবিষ এ শহরের বুকে? আমি তখন ঊণিশ-কুড়ি। আমার গর্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম পরীক্ষা পার্ট ওয়ান অনার্স শুরু। তারিখ ৫ইজুন, সাল ১৯৮৪। ৪ঠা জুন থেকে প্রচন্ড বৃষ্টির দাপটে পুরো শহর জলমগ্নতায় ।  সিট পড়েছিল কলেজস্ট্রীটের জলজমার আড়ত সংস্কৃত কলেজে। খবরে শেষ অবধি কোনো ঘোষণা হলনা পরীক্ষা স্থগিতের। অগত্যা চাল-চিঁড়ে বেঁধে সব বন্ধুরা হাজির হতে শুরু করলাম সংস্কৃত কলেজের দোরগোড়ায়। পরীক্ষা দিয়ে উদ্ধার হব আমরা। উদ্ধার করবেন আমাদের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়। 
হরিপাল থেকে দত্তপুকুর, আলমবাজার থেকে বাগবাজার, নিমতলা থেকে শ্যামবাজার....সকলেই চলেছি এক‌ই দিকে। মাথায় অনার্স পরীক্ষার চিন্তার জটগুলো ক্রমশঃ পাকিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্নপত্র সোজা না কঠিন হবে সে প্রশ্নটা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়ে আপাততঃ শ্যামবাজারে বাস থেকে নেমে পড়তে হল। বাস আর যাবেনা। বিধানসরণী, ভূপেন বোস এভিন্যু, সার্কুলার রোড, সর্বত্র জলময়। পরীক্ষা শুরু দুপুর বারোটায়। চারঘন্টা মেয়াদ তার।  সমুদ্রে পেতেছি শয্যা, শিশিরে কি ভয়! কলকাতায় জন্মে অবধি জলজমা দেখে আসছি, তাই বানভাসি শহর নতুন নয়।  
এক টানা রিকশোতে চড়ে বসলাম। রিকশার পাদানিতে জল থৈ থৈ । আকাশটা থমথমে। বৃষ্টি নেই কিন্তু মেঘ আছে । আমাদের পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে  আকাশেরো যেন চাপা দুঃখ । ব্যাগে এক্সট্রা পোষাক আছে অতএব চিন্তা নেই। এখন ধ্যান, জ্ঞান শুধু সংস্কৃত কলেজে আমার জন্য নির্ধারিত বেঞ্চিটি। হাজির হলাম ফড়িয়াপুকুর, হাতিবাগান, হেদুয়ার বন্যা পেরিয়ে। তখন বাজে সকাল সাড়ে দশটা। ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে থাকল। বারোটার আশেপাশে পরীক্ষা শুরু হবার কোনো লক্ষণ দেখলাম না। এবার ঘোষণা হল, প্রশ্নপত্র হাজির হয়নি তাই পরীক্ষা মনে হচ্ছে স্থগিত হবে। তখন দেখি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বন্ধুবান্ধবরা জলে ভিজে এসে গেছে ঠিক সময় মত। বাড়ি চলে যাবার ধান্দা করছি, তখন ঘোষণা হল প্রশ্নপত্র এসেছে, পরীক্ষা শুরু হবে বেলা দুটোর সময়। আমাদের পেটে তখন ভুখছানি। চারঘন্টা ধরে মাথা খাটিয়ে কেমিষ্ট্রি অনার্স পেপার ওয়ান দেব। জীবনে প্রথম। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা, পার্ট ওয়ান বলে কথা!
ঠিক দুটোর সময় যখন হলে প্রবেশ করলাম তখন ইলেকট্রিকের কেবল ফল্ট হল। ঝুপসি অন্ধকার ক্লাসরুম। টেবিলে একটা করে মোমবাতি এল। পরীক্ষা শুরু হল। জানা জিনিষগুলো তখন মনে হতে লাগল অজানা। সোজা উত্তরগুলো মনে হচ্ছিল ভীষণ কঠিন। পেরোলাম চারটে ঘন্টা। খাতা জমা দিয়ে এলাম । খাওয়াদাওয়া নেই। জল জমে আছে তখনো। বাড়ি ফিরলাম একরাশ মনখারাপ নিয়ে। শরীরটাও যেন ট্রমাটাইজড। পার্ট ওয়ান শুরুটা মনের মত হলনা। বাড়ি ফিরে দূরদর্শনের খবরে ঘোষণা করা হল সেদিনের সেই কাঠ খড় পোড়ানো পাহাড়ে ওঠার  পার্ট ওয়ান পরীক্ষা ক্যানসেল হয়েছে।  এই হল আমাদের  শিক্ষা ব্যবস্থা। নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়নি রক্ষে!
উতরেছিলাম ঠিকই কিন্তু সেবারের পার্টওয়ান এই ঘটনা আমার জীবনকে নাড়া দিয়েছিল।  পরেরবছর পার্ট টু পরীক্ষা। থিওরির পর প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার সিট পড়েছিল আরেক নাম করা ছেলেদের কলেজে।  সেখানে পৌঁছে রোল নাম্বার অনুয়ায়ী লটারীতে নির্ধারিত স্যাম্পল সল্ট অ্যানালিসিসের শিশিটি  হাতে নিয়ে ল্যাবরেটরিতে প্রবেশ করতে যাব, এমন সময় ল্যাবের একজন অ্যাসিট্যান্ট আমাকে চুপুচুপি ডেকে বলল
"তোমার অজানা সল্টের স্যাম্পলে কি আছে জানতে চাও? পার সল্ট চল্লিশ টাকা লাগবে।" তাহলে আমি আর টেস্ট না করেই শুধু লিখে খাত জমা দিয়ে ফুল মার্ক্স পেয়ে বেরিয়ে যাব। রোল নাম্বার সাঁটা শিশির গায়ে। রেজিষ্টার খুলে সেই ল্যাব অ্যাসিট্যান্ট যেন হাঁ করে বসে আছে। প্রত্যেককেই সে এমন প্রস্তাব দিচ্ছিল। কেউ টোপ গিলছে কেউ গিলছেও না। সাদা, লাল, নীল, সবুজ, কমলা...কত রংবেরংয়ের সল্ট স্যাম্পল। দুটি করে রাসায়নিক যৌগ আছে যার মধ্যে । নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টেস্ট করে বের করতে হবে সেই দুই যৌগের নাম। কেমিষ্ট্রি যারা পড়েছে তারা জানে এ হল সবচেয়ে কঠিনতম প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা।  
অন্যায়ের সঙ্গে কোনোদিনো আপোষ করিনি তাই নিজে নিজেই লড়ে সেই সল্ট অ্যানালিসিস উতরে গেছিলাম কিন্তু মনের কোণায় সেই যে একটা খেদ, গ্লানি আর ন্যায়ের জন্য  যুদ্ধ শুরু হল সেই যুদ্ধ আমার এখনো চলছে। মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে গেছে সেদিন থেকে, অন্যায়ের সঙ্গে  আপোষ না করা । সেদিন পরীক্ষা হলের বাতাবরণে হয়ত প্রতিবাদী হয়ে উঠিনি কিন্তু যতটুকুনি পড়াশুনো করেছি সেটুকুনি কাজে লাগিয়েছি, তাই মনে মনে আজো গর্ববোধ করি।  আশীর দশকের এই দুটো শিক্ষা সম্বন্ধীয়  ঘটনা মনকে আজো নাড়া দেয় আর এখনো ভাবি কিসের শিক্ষা? কেন এই শিক্ষা? সেখানেও রাজনীতি না কি অন্য কোনো ছক কষাকষি থাকে? উত্তরটা খুঁজে চলেছি এখনো ।
তাই আজ যখন বোর্ডের প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য পরীক্ষা ক্যান্সেল হল তখন মনের মধ্যে তোলপাড়। বেচারা পড়ুয়াদের জন্য। যারা কেউ ভেবেছে পরীক্ষা দিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচবে। কেউ ভেবেছে বেড়াতে বেরুবে, তা না তাদের আজ ট্রমায় দিন কাটছে। উপযুক্ত শাস্তি পাক এই চক্র তবে রিএক্সাম কি এর সমাধান? জানি হয়ত রিটেস্ট তাদের দিতেই হবে কিন্তু যারা নির্বিবাদে পরীক্ষা দিল, যারা ঘুণাক্ষরে টের পেল না তারা কেন এই যজ্ঞে আবার সামিল হবে? রিএক্সামের ট্রমা যে কি জিনিষ তা আমার মত সেই ৮৪ র পরীক্ষার্থীরা সকলেই হাড়েহাড়ে বুঝি।
যারা এই প্রশ্নপত্র ফাঁস কাণ্ডের  মধ্যমণি তাদের যেনতেনপ্রকারেণ জবরদস্ত শাস্তি হোক। আর যাই করুণ ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন না দয়া করে। এবছরের প্রশ্নপত্রে যা সম্ভাব্য ছিল তা  ত এসেই গেল। পরীক্ষা দেওয়া হয়েই গেছে। আবার পরীক্ষা হলে ওরা পারবে ত?    
যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক"

যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক" / কালবোশেখি

 প্রতীক্ষা এক অদ্ভূত রকমের প্রচ্ছন্ন আবেগ। আর সে যদি অনিশ্চিত প্রতীক্ষা হয় তবে উথালপাথাল। চৈত্র বৈশাখ মাসের অপরাহ্নিক ঝড়, ঈশান কোণে কালো মেঘ জড়ো হওয়া আর সেই নিকষ কালো, ঘুটঘুটে ঘন মেঘ ? এদের সমন্বয়ে যদি শান্তিধারা নামে তাহলে বাঙালীর বছরের প্রথম বরফ কুচি ছড়ানো আমপান্নায় কে যেন জল ঢেলে দেয়। আচমকা বহু কাঙ্খিত নাভিশ্বাস আবার সর্বনাশ! 
দুপুর থেকেই ছমছমে আকাশ, গুমরে মরছিল।তারপরেই কালভৈরব ঝড়ের তান্ডব আর কিছুপরেই শান্তির ধারাবর্ষণ। পুরুষ আর প্রকৃতির খেলা যেন। সবুজ আর সজীবের প্রাণ ফিরে পাওয়া। দরজার পাল্লা পড়ছে, জানলার কাঁচ ভাঙছে। কত শব্দ। আর সবচেয়ে দাপট দেখায় শালপ্রাংশু বৃক্ষগুলি। একবার আটকে গেছিলাম  চিলেকোঠায়। নীচে নামতে না পেরে দু চার লাইন কাব্যি করেছিলাম। কবিতার নাম দিয়েছিলাম কালবোশেখি। অকালবোশেখির মত আমার কাছে সব কালবোশেখিই যেন বড় অকালে আসে। তাকে বুঝতে না বুঝতেই সে এসে চলে যায় দুমদাম পা ফেলে।    
এখনো কালবোশেখির স্মৃতি মেদুর বিকেলগুলোয় চোখ বুঁজলে কিউটিকিউরা পাউডারের হালকা গন্ধ পাই কালবৈশাখীর বিকেলে । গা ধুয়ে নরম ছাপা শাড়ি পরে মায়েদের দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেই মাদুর নিয়ে ছাদ সংসার পাতার তোড়জোড় । মায়ের হাতে একটা হাতপাখা আর অন্যহাতে বাড়িতে পাতা টক দ‌ইয়ের ঘোল। ওপরে কাগচিলেবুর সুবাস । ফ্রিজ তখনো ঢোকেনি বাড়িতে। বরফ যেন আমাদের কাছে সোজা হিমালয় পৌঁছনোর মত ব্যাপার। বাজারে একটা দোকানে সন্ধ্যের ঝুলে বরফ বিকত। সেখান থেকে বরফ কিনে এনে শরবত খাওয়া হত। সেদিন যেন চাঁদ হাতে পাওয়া। তখন "হিমক্রিম' পাওয়া যেত।  সেও যেন এক অতি আশ্চর্য রকমের প্রাপ্তি। মিষ্টির দোকানে আইসক্রিম মিলত। কোয়ালিটির আইসক্রিমের কাপ।কোনোকোনো দিন দুধের বড় ক্যানের মধ্যে বরফ দিয়ে সেই আইসক্রিম আসত গরমের ছুটির বিকেলে। ছাদের ওপর হয়ে যেত আমাদের ছোট্টবেলার আইসক্রিম পার্টি। বাবা একবার সেই আইসক্রিম আনতে গিয়ে কালবোশেখির ঝড়ে পড়লেন। কি চিন্তা আমাদের! যত না চিন্তা মানুষটির জন্য তত চিন্তা আইসক্রিমের জন্য। মা খুব বকুনি দিয়েছিলেন। আগে বাবা না আগে আইসক্রিম এই বলে।

তখন আমাদের স্কুলজীবনে গরমকালের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল লোডশেডিং।  ইনভার্টার ছিলনা । রোজ নির্দ্দিষ্ট সময়েই পাওয়ার কাটের পূর্বাভাস পেয়ে যেতাম আমরা। আর কালবোশেখি হলেও ঝড়ের তাণ্ডবে পাওয়ার চলে যেত। তখন দখিণের খোলা বারান্দাই ভরসা। সেখানেই জ্যামিতি, পরিমিতি আর উপপাদ্যে নিয়ে জোর কসরত চলত । সকাল থেকেই হ্যারিকেনে কেরোসিন ভরে, ঝেড়ে পুঁছে রেখে, তার সলতে ঠিকমত কেটে সমান করে দেওয়া হত । এখন শিল্পের বাড়বাড়ন্ত অতটা নেই তাই বিদ্যুতের চাহিদাও নেই। অবশ্য বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে শপিং মলে, মেট্রো রেলে। মাল্টিপ্লেক্সে, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে, সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে।  বিশ্বায়নের স্বীকার আমাদের শহর।আর সেই সঙ্গে আমরাও। তবে কলকারখানাও নেই বড় একটা তাই লোডশেডিং মুক্ত আমরা । তাই স্কুলের শিশুরা আরামেই গ্রীষ্মের ছুটির হোমওয়ার্ক করে । হোম মেকারের বাতানুকূল দিবানিদ্রা দিব্য যাপন।

রাতে লোডশেডিংয়ে মা টানতেন হাতপাখা। শাড়ির পাড় দিয়ে মোড়া থাকত হাতপাখাটি। টেঁকশ‌ই হবে বলে । ছোটদের বেয়াদপির দাওয়াই ছিল এই পাখার বাড়ি। যে খায়নি এই পাখার বাড়ি সে জানেওনা তা কেমন খেতে । সেই তালপাতার পাখাখানি টানতে টানতে বাইচান্স আমাদের গায়ে ঠুক করে লেগে গেলেই মায়ের যেন একরাশ মনখারাপ। যেন কি ভুলই না করেছেন। সেই পাখা সাথে সঙ্গে সঙ্গে ঠকাস করে মাটিতে ঠুকে তিনবার আমাদের কপালে, চিবুকে হাত রেখে চুক চুক করে ক্ষমা চাইতেন। দোষ কাটিয়ে নিতেন। সন্তানের গায়ে হাতপাখা লেগে যাওয়া যেন দন্ডনীয় অপরাধ।  মাটির কুঁজো বা জালার জল ছিল আরেক প্রাণদায়ী বন্ধু সে গরমে। মা আবার এক ফোঁটা কর্পূর দিয়ে রাখতেন জালার জলে। জীবাণুনাশক আবার সুন্দর গন্ধ হবে বলে। জলের লীনতাপকে ধাক্কা দিয়ে বাইরে বের করে দেবার জন্য সকাল থেকেই লাল শালু ভিজিয়ে জড়িয়ে দেওয়া হত মাটির জালার বাইরে। এখন গর্বিত বাঙালির ঘরে ঘরে ফ্রিজ। সে মাটির কুঁজোও নেই আর নেই সেই হাতপাখা। 

এখন সকলে বলে গরম বেড়েছে। কারণ নাকি বিশ্ব উষ্ণায়ণ। পরিবেশের নাকি বেজায় দম্ভ। বাড়ীর গরম, গাড়ীর গরম। সেই সঙ্গে মানুষের মাথাও গরম। টিভির চ্যানেলে অহোরাত্র ঘটি গরম। তাই মেঘ জমে কালবোশেখি হবার আগেই সব মেঘ বাষ্পমুক্ত হয়ে শুকিয়ে যায়। মায়ের এখন থাইরয়েড তাই গরম আরো বেশি। হোমমেকারের হটফ্লাশ তাই গরম বেশি। বাজারদরের আগুণ নেভেনা তাই বাবার কপালের ঘাম শুকোতে চায়না। ছেলেপুলেরা জন্মেই ফ্রিজ দেখেছে তাই ফ্রিজে জল না থাকলে তারাও অগ্নিশর্মা। ওরা শিখল মকটেল। পেপসি। বাড়ীতে সফট ড্রিংক্স রাখা যায় এসব ছিল আমাদের ধারণার বাইরে। বাড়ীতে পাতা টক দৈয়ের ঘোলের স্বাদ ওরা পেল না। কি জানি লোডশেডিং, মাটির জালা, হাতপাখার বাতাস, ছাদে বসে বরফকুচি দেওয়া সীমিত শরবত এগুলোই বোধ হয় ভালো ছিল। তাই বুঝি এত গরম অনুভূত হতনা। আর কালবোশেখির প্রতীক্ষাও ছিল না। তিথি নির্ঘণ্ট মেনে ঠিক ঈশানকোণে মেঘ জমে উঠত। 
আর কালবোশেখি এলেই কাঁচা আম ঝরে পড়া? ঝড়ে আম কুড়োয় এখনো কোনো দস্যি ছেলে। তবে পথেঘাটে নয়। শিলাজিতের গানেই। এখন ওদের আর রাখাল সাজা হয় না। কারণ তারাও এখন চাপে। তাই ঠাম্মার কপালে ভাঁজ। আমকাসুন্দি বানাতে হবে। আমবারুণীর পুজো করতে হবে না গঙ্গায় গিয়ে?  কিন্তু কে কুড়োবে সেই আম। আম পাড়ার নেশা যে কি জিনিষ তা যে পেড়েছে সেই জানে। এখন রিয়েল এস্টেটের রমরমায় নেই সেই আমগাছ। নেই সেই আম রাজত্ব। বাজারের কেনা আমে সাধ মেটাও হে বঙ্গললনা। 
তাই কালবোশেখি আসুক আর না আসুক গ্রীষ্মকাল সমাগত!

যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক"

যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক" / পহেলা নেশা

আবার পহেলা নেশা। বাঙালীর বৈশাখ বিলাস। কি পেয়েছি আর কি যে পেলাম ভাববার অবকাশ নেই। 
একদিকে রাজনীতির রঙ্গ । পহেলা উত্তেজনার পারদ তুমুলে । অন্যদিকে তাপমাত্রার পারদ চড়চড় করে উঠছে সেই ভয়ে কুপোকাত বাঙালী। তবুও  বিরিয়ানি, পোলাও কালিয়া, কোর্মা, পটলের দোলমা, নতুন জামা, নতুন ছবি, নতুন ম্যাগাজিন আত্মপ্রকাশ, সিডি রিলিজ, বর্ষ বরণের ঢালাও আয়োজন । বৈশাখের আগমনী আর চৈত্রের স্মৃতি ঝেড়ে ফেলে আবার রবীন্দ্রজয়ন্তীর রিহার্সাল। কেন বাপু কাজকম্ম নেই ? পাড়ায় পাড়ায় রাজনৈতিক এজেন্ডা। মঞ্চ প্রস্তুত। শিল্পীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে প্রোগ্রাম। নামীদামী শিল্পীকে পার্টি ফান্ড থেকে সাম্মানিক দেওয়া হয় অবশ্যি। ছোট ছোট ম্যাগাজিনের বর্ষ পূর্তি সংখ্যা প্রকাশেও তাই। ছোট ছোট লেখক নিজের লেখা ছাপার অক্ষরে দেখবেন বলে কিনছেন । কি জ্বালা!
আর আছে অকালবোশেখির হঠাত মেঘ কিম্বা কালবৈশাখির পরিকল্পনা।সেটা অবিশ্যি ওপরওয়ালার। ঝোড়ো হাওয়ার দাপটে বানভাসি বৈশাখ বিলাস বেল-জুঁই এর গন্ধ এ ভরপুর । বর্ষবরণ বা বৈশাখ-উত্সব চৌপাট তখন। যতসব!

আমরা বাপু নববর্ষের শুভ মহরত বুঝি নতুন খাওয়াদাওয়ায়। বাঙালির ঝালিয়ে নেবার পালা সেই চিরাচরিত বং-কানেকশান । যত‌ই ইংরেজী ছবি দেখি, ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করে অনর্গল কথা বলি আর গোগ্রাসে কন্টিনেন্টাল খাবারদাবার গিলি না কেন আদতে আমরা ঝোল-ঝাল-অম্বলের ভক্ত ।
আমারা যেমন নিউইয়ারে কেকও কাটি, দোলে ঠাণ্ডাইতেও চুমুক দি আবার পহেলা বৈশাখে কব্জি ডুবিয়ে বাঙ্গালী খানা খাই। এ বোধহয় আমাদের মত হুজুগে বাঙালির পক্ষেই সম্ভব ।কিন্তু হুজুগই কি শেষ কথা বাঙ্গালীর?
সেই পয়লা বৈশাখের দিন বাবার সঙ্গে দোকানের হালখাতার চিঠি নিয়ে, বরফকুচি দেওয়া কাঁচের গ্লাস উপচোনো অরেঞ্জ স্কোয়াশ আর বগল দাবা করে মিষ্টির বাক্স নিয়ে ফেরা? ঠাকুমার জন্য নিয়ে যেতে হবে সোনার গয়নার দোকানে নতুন বাংলা ক্যালেন্ডার । দিদিমার জন্য বুকষ্টল থেকে নতুন পঞ্জিকা । সবচেয়ে মজা লাগত মাছের বাজারেও হালখাতার মৌরসী পাট্টা দেখে । সেদিন মাছবাজার ধুয়ে মুছে সাফ এক্কেবারে । লক্ষ্মী গণেশের একযোগে পুজোয় মাছের আঁশটে গন্ধ কাটানোর জন্যে ফিনাইল, ধূপ ধুনো । আর মাছওয়ালাও ধবধবে পাজামা-পাঞ্জাবী চড়িয়ে বসেছে জম্পেশ করে । আমি বাবার হাত ধরে লেসের ফ্রিল দেওয়া,  নতুন ছিটের নরম ফ্রকে ।   প্রথমবার গিয়ে ভেবেছিলাম সে বুঝি মাছ দেবে ফ্রি তে । সে গুড়ে বালি! পয়লা নাম্বার মিষ্টির বাক্স নিয়ে থরে থরে বসে আছে সেও ! তার মানে বুঝলাম মিষ্টিমুখ না করলে বাঙালির শুভ কাজ হয়না । এই ছোটখাটো বাঙালিয়ানা গুলোই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে বহুযুগ ধরে। নিকুচি করেছে। এই নিয়েই পড়ে থাকল বাঙ্গালী। শুধু ধুয়ে ধুয়ে জল খেল আর পেট ফোলাল।

রেস্তোরাঁয়  বৈশাখী হেঁশেলের তোড়জোড়। মোচ্ছব সেখানেও। রসিক বাঙালীর বৈশাখী রসনা বিলাস। শুরুতেই কাঁচা আমের জুসের সঙ্গে ভদকার অভিনব ককটেল। অথবা তরমুজের লাল রসে পুদিনার সবুজ। ওপর থেকে আধ পেগ হোয়াইট রাম। যাকে বলে ফিউশান শরবত। তারপরেই লুচি, বেগুনভাজা, শাক-শুক্তো-ছ্যাঁচড়া-মুড়িঘন্ট। পরের দফায় ঘি ভাত, তপসে ফ্রাই। নির্গুণ, নির্গন্ধা বেগুণ দিয়ে বেগুণ বাসন্তী থেকে শুরু করে সারাবছর অচল পটলের দোলমা। ঘিভাতের কত রকম নাম হয় আজকাল! মোরগ পোলাও থেকে আফগানী জাফরানি মোতি পলান্ন। মানে পল অর্থাৎ মাংস মিশ্রিত অন্ন মানে যাকে বিরিয়ানি বলি আমরা। একই অঙ্গে ভাতের কত রূপ! সে কখনো দারুচিনি দেশে, কখনো মখমলি জুঁইফুলের বাগিচায়। মানে যাকে বলে সিনামন রাইস অথবা জেসমিন রাইস।
চিতলমাছের অনুকরণে গাছপাঁঠার মুইঠ্যা তো পনীর পসন্দ।  যশুরে তেল কৈ কিম্বা বরিশালী ইলিশ। কোথাও মৈথিলী ভেটকি, কোথাও আবার মাটন মনোহরা। শুধু চমকে যাওয়া নামের অভিনবত্বে।  আবার কোথাও মশলা মাখানো ভেটকি ফিলের পাতুড়ি কলাপাতায় আবার কোথাও লাউপাতায় ।
বাঙালী রেস্তোরাঁগুলো এই একটা মাস ষোলো আনা বাঙালী । মধুরেণ সমাপয়েত ম্যাজিক মিহিদানার বেকড ভার্সন  অথবা রসোগোল্লার পুডিং দিয়ে। অথবা  কোকো দিয়ে চোকোগোল্লার পাশাপাশি কফি গোল্লাও চলছে দিব্যি । এমন ইনোভেশনে আছে বাঙালী! সন্দেশের সঙ্গে ফ্রুট ফিউশানে কিম্বা জলভরা জলপরী কিম্বা দৈ কলসের ঠান্ডা ছোঁয়ায় । মাটির ছোট্ট কলসে প্রথমে দৈ, তারপর মাখা সন্দেশ আর টপিং এ গারণিশ করা এক চামচ রাবড়ি। পেস্তা কুচিয়ে দাও ব্যাস! অনবদ্য বং মিষ্টি । আর তারপরেও চালিয়ে দেওয়া যায় কেশরীয়া মালপোয়া কিম্বা গুলাবী জিলিপিকে। রামকৃষ্ণদেবের কথায় ভরাপেটেও জিলিপি জিভ থেকে টুকুস করে, অতি অনায়াসে গলার মধ্যে দিয়ে সোজা পেটে চালান করা যায় । যেমন খুব ভীড়ে লাটসাহেবের গাড়ির চাকা ফাঁকফোকর দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে যায় সাবলীল গতিতে। 
এসব রেস্তোঁরায় খেতে যায় বহু মানুষ পয়লা বৈশাখে। আমাদের তো আসলে রোজ রোজ বৈশাখী। রোজ রোজ পয়লা নম্বর ভুরিভোজ চাই-ই। মাদার্স ডে, ফাদার্স ডে, ভ্যালেন্টাইন্স ডে' র মত বেঙ্গলি নিউইয়ার্স ডে আমাদের রোজ রোজ। বাকী যেটুকু করি সবটাই হুজুগে। তবে যাই বলুন মিডিয়ার দৌলতে পয়লা বৈশাখের একটা দিব্যি ব্র্যান্ড তৈরী হয়ে গেছে। সেটাই যা ভালোলাগার। গর্ব বোধ করার। কিন্তু এসব আর কদ্দিন! উত্তিস্থিত জাগ্রত বাঙ্গালী! বেলা বয়ে যায় যে!

এবারের বৈশাখী শ্লোগান ছিল নোট বাতিলের একবছর পর বাঙালির উত্থান । থুড়ি কেউ বলছে পতন । ডিজিটাল ভারতের স্বপ্ন দেখতে দেখতে  ডিজিটাল শপিংও করেছে বাঙ্গালী । বৈশাখে খাদ্যবিলাসেও সামিল হয়েছে । আমিও  হোমমেকারের হেঁশেলের চাক্কা বন্ধ করেছি পয়লা বৈশাখে। রাঁধছিনা, রাঁধবনা। স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ সব সঁপেছি  পয়লা বৈশাখকে।
এসব ত ভাল কথা কিন্তু এবার নতুন বছরের পহেলা রেজলিউশান কি হবে জানেন কেউ?

যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক"

যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক" / যদি মন চৈত্র সেলে, ফ্রকের ঝুলে

 " যদি মন মেঘলা দিনে ওড়ায় নিজের মন পাখীকে?' অথবা "যদি মন গড়িয়াহাটে চৈত্র সেলে ফ্রকের ঝুলে?'  
মনে পড়ে রূপঙ্করের সেই বিখ্যাত গান? আর হ্যাঁ, বছরের এই একটা সময় যদি মন আস্কারা পায় যখন তখন মাথায় চড়ে হাত পা ছোঁড়ে। চৈত্রসেলের জন্য । ভিনরাজ্যে গিয়ে থেকে তো দেখেছি । এই চৈত্তসেলের জন্যে ফাগুণ পড়তেই মন কেমন উশখুশ করে! আনচান করে। এমন সেলের পসরা কোথাও দেখিনি আমি ।
সেবার সেই বাম জমানায় সুভাষ চক্কোত্তির তাড়ায় অপারেশন সানশাইনের কবলে পড়ে রাতারাতি গড়িয়াহাট খালি। ফাগুণে সে বিরহব্যথা যে কি জিনিষ তা আমি হাড়েহাড়ে বুঝেছিলাম । কোথায় বাবার পায়জামার দড়ি! কোথায় গেল জামাকাপড় শুকোনোর ক্লিপ্! কোথায় পাই আমার সাধের জাঙ্ক জুয়েলারি, টিপ-ক্লিপ আর কুশন কভার? আর পয়লাবৈশাখে বাড়ির দোরে নতুন ডোরম্যাট? কিনব‌ না? বলুন ত? সব চাই যে আমাদের এই চৈত্রেই।
পথেঘাটে প্রাক্‌বৈশাখী প্রস্তুতি। চাদ্দিকে চৈত্তসেলের হাতছানি। নানান অফার বর্ষবিদায়ের আনন্দে। এক চিত্র গড়িয়াহাটার মোড়ে, হাতিবাগানের ধারে কিম্বা নিউমার্কেটের আশেপাশে । বছরের বস্তাপচা জিনিষ পত্তরের স্টক ক্লিয়ারেন্স সেল।  কোথায় লেডিজ প্রিমিয়াম টপস  "বাই ওয়ান, গেট ওয়ান' । কুর্তা, কুর্তি কেপরি, প্যালাজোয় প্রচুর ছাড় । কারে ছেড়ে কারে ধরি!  আনারকলি, নূরজাহান সকলেই আছেন এক ছাদের নীচে। শুধু অপেক্ষা পার্স খোলার।
পোলকা ডটের কুশন কভার, হালকা-পুলকা কস্টিউম জ্যুয়েলারি, প্যাস্টাল শেডের সুদৃশ্য বেডস্প্রেড এমন কি গৃহসজ্জার দৃষ্টিনন্দন আর্টিফ্যাক্টসও।  বুদ্ধ-গান্ধী-বিবেকানন্দ সকলেই উপস্থিত! সখের পোশাকী চটি জোড়া থেকে গুরুগম্ভীর স্নিকার্স, রান্নাঘরের ঘটিবাটি থেকে ময়লা ফেলবার ভ্যাট। সবেতেই সেল ।

কি ভালো আমার সেই হকার ভাইদের অমায়িক আমন্ত্রণ !  থরে থরে সাজানো সেলের পসরা। আর মধ্যে মধ্যে গলা ফাটিয়ে চীৎকার। মাঝবয়সী একজন আমাকে এখনো বৌদি বলে ডাকে। একবাক্যে জিনিষের দাম আর্ধেক করে হাসিমুখে বলে, নিয়ে যান, পরে দাম দেবেন। এত আন্তরিকতা কোথায় পাব বলুন ত ? তাই ওদেরি আমার এত পছন্দ।
মায়ের জন্য ফাইন মলমলের ফুল ফুল ছাপাশাড়ি আর শ্বশুরমশাইয়ের হাফপাঞ্জাবি না হয় কিনলাম দোকান থেকে। তাই বলে নিজের হাউসকোট কিম্বা কাজের মেয়ের ম্যাক্সি? কক্ষণো নয়। বেঁচে থাক আমার ফুটপাথ! আমার প্রাণের মাঝে চলে গেলে আর পাব না তারে। আর ওখানে কেনার চার্মটাই আলাদা! কত্ত চয়েস! কত্ত আন্তরিকতা হকার ভাইদের! এদের চাকরীবাকরী জোটেনি তাই হকার দলে নাম লিখিয়েছে এরা। এই আমিও ত টুকটাক লিখি আর টিউশানির পয়সায় আমার গুড টাইমপাস করি চৈত্র সেলে ।বড়বড় দোকানের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত উইন্ডোয় চোখ রাখি আর উইন্ডো শপিং করি। কিন্তু কিনি ফুটপাথ থেকে। আমার হকার ভাইটিও বি এ পাস করে হকার হয়েচে। গর্বের সঙ্গে বলে সে। তাই আমি এদেরকেই পেট্রনাইজ করি। আমার এই হকার ভাইকেই খুব দরকার এই চৈত্তসেলে, কুর্তির ঝুলে। এইজন্যেই তো পড়ে র‌ইলাম কলকাতায়। ম্যাটিনি শোয়ে সিনেমা দেখে লেবু চা খেয়ে বিকেলে নন্দন চত্বরে কবিতা পড়ব আর ফেরার পথে সেলের পসরায় ঢুঁ মারব একটিবার। এই ত জীবন।

এই শহরটার জন্মলগ্নে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৃহস্পতি তুঙ্গে জানেন তো? তাই কর্তা অফিস ফেরত নামেন বালিগঞ্জ স্টেশনে, গিন্নী নামেন গড়িয়াহাটে। তারপর ছুঁচোয়  ডন বৈঠক দেওয়া পেটে ঐ ফুটপাথের এগরোল কিম্বা চাউমিন, মোমো কিম্বা ফিশফ্রাই সাবাড় করে চৈত্তসেলে পথ পেরোন তাঁরা। আহা কি আনন্দ তখন সেই পথ চলায়! যিনি মেট্রো করে নামেন রাসবিহারী তাঁর জন্য আছে রাসবিহারীর বিস্তীর্ণ দুপারের প্লাসটিক বালতি, মেলামিনের বাসন থেকে কাটগ্লাসের সুরাপাত্র, বাথরুম সেট, পুরণো ম্যাগাজিন থেকে পাইরেটেড সিডি, রেডিমেড ব্লাউজ, সায়া থেকে শার্ট-প্যান্টের পিসে ঢালাও সেল। কি চাই! রাসবিহারীর মোড় থেকে রসা রোডের দিকে কালীঘাট  পেরিয়ে হাজরা আর এপাশে দেশপ্রিয় পার্ক পর্যন্ত সেলে ডুবে আছে মহানগরী। ভেতরের জামা, বাইরের জামা, পর্দার কাপড়  সবেতেই সেল। গয়নার মজুরি ফ্রি। আবার সোনা কিনলে সম ওজনের রূপো ফ্রি! ভাবা যায় এইআসন্ন পয়লা বৈশাখে চৈত্র সেলের  কি মহিমা?

ওদিকে গেরস্ত বঙ্গললনার এখন টেলিভিশনে মাস্টারশেফ দেখেবড় সাধ জাগে একবার কন্টিনেন্টাল বানানোর। বিশ্বায়নের ঢেউ লাগা রাস্তার আনাচেকানাচে  এখন বাটন মাশরুম থেকে বেবিকর্ণ, সুইট কর্ণ থেকে ব্রকোলি, তেরঙ্গা সিমলা মির্চ কি না পাওয়া যায়!
কেউ নামেন শ্যামবাজার মেট্রো স্টেশনে। তাঁর গার্ল ফ্রেন্ড হয়ত কলেজ ফেরত আসেন সেথায়। তারপর শুরু হয় সেল পরিক্রমা। আদিগন্ত হাতীবাগান জুড়ে সেল, সেল, সেল।
আর সে যুগে যারা স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের অমোঘ বাণীকে পাথেয় করে ব্যবসায় নেমেছিলেন তাদের দোকানে হাহুতাশ! নিউমার্কেটে তারা নাকি অবস্থান করছেন হকারদের বিরুদ্ধে। আরে বাবা ! বোঝেনা সে বোঝেনা।  তার বাপ-ঠাকুরদার এদ্দিনের ব্যাবসাপাতি নাকি হকারদের কল্যাণে লাটে ওঠার উপক্রম! ক্রেতা বলেন  যেখানে সস্তা পাব, সেখানে যাব। বিক্রেতা বলেন এসি দেব, জিএসটি নেব, রসিদ দেব। আর নেতা বলেন হকার আমার মাটি। হকার আমার ভোট। হকার আমার ভাগ্যনিয়ন্তা। "সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই".... চন্ডীদাসের অমোঘ বাণী । সুভাষবাবুর অপারেশন সানশাইনের পর হকার পুনর্বাসন হয়েছিল। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি জানেন? কেউ যায়নি নতুন বাড়িতে। ক্রেতা খোঁজে সস্তার জিনিষ। বিক্রেতা চায় বিকোতে। কারণ এ শহরে শিল্পের জোয়ার আসেনি তেমন করে। তাই ইকনমিক গ্রোথ নেই । তাই ক্রয় ক্ষমতা বাড়লনা বোধহয়। তাই ফুটপাথেই উঁকিঝুঁকি আর হাতড়ে মরা সাধের জিনিষগুলোর জন্যে।
ওদিকে উঁচু উঁচু শপিং মলের বাতানুকুল বায়ুমন্ডলে ম্যানেকুইন ডুকরে কাঁদে। পথিক আসে দর্শক হয়ে। চোখ বুলায়, হাত বুলায়। পিছন পানে চায়।

যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক"

২২ এপ্রি, ২০১৮

৩ এপ্রি, ২০১৮

কর্ণাটকের আনেগুডি গ্রামে মধ্যাহ্ন ভোজনে

তুঙ্গভদ্রা নদী

কিস্কিন্ধ্যা হেরিটেজ ট্যুর। আদিবাসীদের প্রত্যন্ত আনেগুডি গ্রামে পায়ে হেটে ঘুরে দেখা। জোয়ার বাজরার খেত। একটু সবুজ ধান জমি। আধটু আখের বন, কলাগাছের সারি। ভাঙ্গা পরিত্যক্ত মন্দির। আর তারপরেই স্থানীয় ননদ ভাজের একটুকরো ঘরে ঢুকে আতিথেয়তা প্রাপ্তি। হাত ধোয়ার জল, গামছা। তারপর দ্বিপ্রাহরিক ভোজে আপ্যায়ন। কড়িবরগার ঘরের মাথায় আকাশ আলো থেকে চুইয়ে পড়া রোদে ভেসে যাওয়া খাবার টেবিল। সারে সারে তামার ঘড়া, কলসী তাকে তোলা। আর তারপর? থালার ওপর কলাপাতায় লেবুর মিষ্টি আচার, বাদাম গুঁড়ো। বাজরার তুলতুলে পরোটা।আর পঞ্চ ব্যঞ্জন, লেবু ভাত, টক দই, স্টার ফ্রায়েড স্প্রাউট উইথ তড়কা " উসলি", রসম, রেড সয়াবিন বা লোবিয়া র পদ, কারামনি কাড়লু আর সদ্য খেত থেকে তুলে আনা অনবদ্য খুদে বেগুণের গা মাখা কারী। মধুরেণসমাপয়েৎ শুকনো খোলায় নেড়ে নেওয়া অড়হর ডাল বাটা আর গুড় এর পুর ভরা ঘিয়ে ভাজা পরোটা মিষ্টি বা পূরণ পলি দিয়ে। মেয়েটি হাল্কা হাতে নরম চোখে একটু ঘিয়ের ছিটে দিয়ে দিল।



১৯ মার্চ, ২০১৮

যিনি বাসন্তী তিনিই অন্নপূর্ণা আবার তিনিই মা দুর্গাশোকা

এইসময় ১৯ শে মার্চ ২০১৮

 বাসন্তীপুজো এবং অথ অশোকষষ্ঠী কথা

আমাদের দেশে শীতের শেষে চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষে মাদুর্গার পুজোকে বাসন্তীপুজো বলে। শাস্ত্রে শরত ও বসন্ত এই দুই ঋতুকে বলা হয় "যমদংষ্ট্রা" অর্থাত এই দুই ঋতুতে মানুষ দুরারোগ্য ব্যাধি ভোগ করে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। শরত এবং বসন্ত এই দুই ঋতুর আগমনেই ভারতবর্ষের মত গ্রীষ্মপ্রধান দেশে ঋতু পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। ফলে রোগের প্রকোপ বাড়ে। দুর্গা দুর্গতিনাশিনী তাই আবির্ভূতা হন এই দুই সময়ে।
সূর্যের গতিপথে সূর্য ছয়মাস উত্তরদিকে ও ছয়মাস দক্ষিণদিকে গমন করে। উত্তরায়নের সময় দেবকুলের দিন আর দক্ষিনায়নে তাদের রাত্রি।
 বসন্তকালেই দুর্গাপূজা নির্দ্দিষ্ট ছিল কারণ এই সময় সূর্যের উত্তরায়ণের ফলে দেবতারা জাগ্রত থাকেন। কিন্তু  শরতকাল হল সূর্যের দক্ষিণায়নের সময়। রামচন্দ্র রাবণ বধের জন্য এইসময় দেবতাগণকে জাগ্রত করে দুর্গাপূজা করেছিলেন। তাই রামচন্দ্র প্রবর্তিত শরতকালীন দুর্গাপুজোকে অকালবোধন বলা হয়।  
শস্যাধিষ্ঠাত্রী দেবীর আরেক নাম শাকম্ভরী।  একবার দুর্ভিক্ষের সময় দেবী দুর্গা তাঁর অর্থাত পৃথিবীর সমস্ত উত্পন্ন শাক দিয়ে জগত পালন করেছিলেন। শাককে এখানে সমস্ত প্রকার শস্যের প্রতিনিধি বলা হযেছে।  দেবী শাকম্ভরীর আরেক প্রকাশ হল অন্নপূর্ণা বা অন্নদা। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। 
পন্ডিতেরা আমাদের অন্নপূর্ণা ও দুর্গার সাথে মিশরের আইসিস ও গ্রীসের সিরিসের সাদৃশ্য খুঁজে পান। সিরিয়া, গ্রীস, সাইপ্রাস, এথেন্স ও ক্রীটে আমাদের দেশের মত শস্যদেবীর পূজা দেখা যায়। শরতকালে বাসন্তী বা দুর্গাপূজার মত পাশ্চাত্যে ইস্তারাদেবীর পূজা হয়। এই ইস্তারাদেবীর রূপটি অনেকাংশেই আমাদের দুর্গার মত। তিনিও সিংহারূঢ়া ও অসুর নিধনে মগ্ন। এই ইস্তারাদেবীর উত্সব সেখানে হয় বসন্তকালে ইষ্টারের সময়। মন্ডি থার্সডে , গুডফ্রাইডে, হোলি স্যাটারডে, ইষ্টার সানডে ও ইষ্টার মানডে এই পাঁচদিন ধরে আমাদের দুর্গাপুজোর মত উত্সব চলে। 

বাসন্তীপূজার দিন পশ্চিমবাংলার রীতি অশোক ষষ্ঠী পালনের। কি এবং কেন এই অশোক ষষ্ঠী?  




বহুযুগ আগে অশোকবনের মধ্যে এক ঋষির পর্ণকুটীর ছিল ।

একদিন সেই ঋষি স্নান সেরে ফেরার পথে অশোকগাছের নীচে এক সদ্য প্রসূতা কন্যাকে কাঁদতে দেখলেন । দৈবযোগে ধ্যানের মাধ্যমে ঋষি জানতে পারলেন কন্যাটি এক শাপভ্রষ্টা হরিণী মায়ের । ঋষি মেয়েটিকে আশ্রমে এনে লালন করতে লাগলেন । তার নাম দিলেন অশোকা । ঋষিকন্যা বড় হতে লাগল । যৌবনে উত্তীর্ণ হল  ।

এক রাজপুত্র মৃগয়ায় বেরিয়ে ঐ পরমাসুন্দরী অশোকাকে একদিন দেখতে পেয়ে তার পরিচয় জানতে পারলেন । ঋষিকন্যার সঙ্গে রাজপুত্রের কথোপকথনের মধ্যেই ঋষির আগমন হল সেই স্থানে । রাজপুত্র অশোকার পাণিপ্রার্থী হয়ে ঋষিকে অনুরোধ জানালে ঋষি যারপরনাই আনন্দিত হয়ে তাতে সম্মতি দিলেন ।

অশোকাকে রাজপুত্রের হাতে সঁপে দিয়ে ঋষি বললেন  :

" আজ থেকে তুমি রাজার ঘরণী হ'লে কন্যা । যদি কখনো বিপদে পড় আশ্রমে চলে এস । আর রাজপুরী থেকে চিনে একাএকা এই আশ্রমে যাতে আসতে পারো তাই এই অশোকফুলের বীজ তোমাকে দিলাম । এখন যাবার সময় এই বীজ ছড়াতে ছড়াতে যেও । পরে কখনো প্রয়োজন হলে এই বীজ থেকে উত্পন্ন অশোকগাছ বরাবর   চিনে পায়েহেঁটে তুমি চলে আসতে পারবে "

অশোকফুলের বীজ  সযত্নে আঁচলে বেঁধে নিয়ে অশোকা রাজপুত্রের সাথে পতিগৃহে যাত্রা করল । যাত্রাপথে বীজ ছড়াতে ছড়াতে চলল অশোকা । রাজপুরীতে পৌঁছালে রাজা-রাণী সস্নেহে তাদের বরণ করে ঘরে তুললেন । অশোকা আর রাজপুত্রের বাড়বাড়ন্ত সংসারে সুখের বন্যা । অশোকা ক্রমে সাত ছেলে ও এক মেয়ের মা হল । অশোকার শ্বশুর রাজামশাই মারা গেলেন শ্রাদ্ধের দিন অশোকষষ্ঠীর কথা বিস্মৃত হল অশোকা । ভাত মুখে দিয়েই মনে পড়ল ষষ্ঠীর কথা । রাতে শুয়ে পড়ল মনখারাপ নিয়ে । পরদিন ভোরে উঠে দেখল সাতছেলে-বৌ যার যার ঘরে মরে পড়ে আছে আশোকা তা দেখে ঋষির কথা ভাবলে । রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে আশ্রম বরাবর চলতে লাগল ।

ততদিনে বীজ থেকে অশোকগাছ মহীরুহের আকার ধারণ করেছে । চৈত্রমাসে ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে তার শাখাপ্রশাখা । ঋষির আশ্রমের কাছে এসেই  অশোকা ঋষিকে দেখে কেঁদে উঠলো । ঋষি ধ্যানের বলে সব অবগত ছিলেন । কন্যাকে সাথে করে রাজবাড়ী ফিরে গেলেন । কমন্ডুলু থেকে জল ছিটিয়ে  দিলেন  অশোকার মৃত ছেলে বৌ নাতিপুতির গায়ে  । দৈবগুণে সকলে চোখ মেলে চাইল ।

ঋষি বললেন অশোকষষ্টীর ব্রত পালন করলে  কখনো শোক প্রবেশ করবেনা সংসারে ।

২৬ ফেব, ২০১৮

চাঁচর

দোলের আগের দিন চাঁচরের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছি সেখানে বাপ-বেটার ইগো, পিসির মায়াচাদর বা invisible cloak, অধুনা suicide bomber ব্যাবহারে উদ্দিষ্ট কে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র..... সব মিলিয়ে মিশিয়ে...
এইসময় ২৬শে ফেব্রুয়ারি ২০১৮

৪ ফেব, ২০১৮

ত্রিধারা উপন্যাস বইমেলা ২০১৮


স্বনামধন্য সাহিত্যিক সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ধানসিড়ির কর্ণধার শুভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে 

সেবন্তী ঘোষ, যশোধরা রায়চৌধুরী এবং সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে 

নব্ব‌ইয়ের দশকের দুই লেখকের সঙ্গে 
নবনীতা দি' র সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া ত্রিধারার আনন্দ
প্রখ্যাত সাহিত্যিক অমর মিত্র এবং জয়ন্ত দের সঙ্গে ধানসিড়ির স্টলে

প্রিয় কবি জয় গোস্বামী প্রথম কবিতার ব‌ইপ্রকাশ করেছিলেন ২০০৯ এ। আবারো ২০১৮ ব‌ইমেলায় দ্বিতীয় উপন্যাসের সঙ্গে
দেশ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন 
দৈনিক যুগশঙ্খে ত্রিধারার প্রথম রিভিউ 

  



দ্বিতীয় রিভিউ- সংবাদনজর দৈনিক এ ৬ই ফেব্রিয়ারি ২০১৮
ব‌ইমেলা বাইট(১)

ব‌ইমেলা বাইট(২)