প্রতীক্ষা এক অদ্ভূত রকমের প্রচ্ছন্ন আবেগ। আর সে যদি অনিশ্চিত প্রতীক্ষা হয় তবে উথালপাথাল। চৈত্র বৈশাখ মাসের অপরাহ্নিক ঝড়, ঈশান কোণে কালো মেঘ জড়ো হওয়া আর সেই নিকষ কালো, ঘুটঘুটে ঘন মেঘ ? এদের সমন্বয়ে যদি শান্তিধারা নামে তাহলে বাঙালীর বছরের প্রথম বরফ কুচি ছড়ানো আমপান্নায় কে যেন জল ঢেলে দেয়। আচমকা বহু কাঙ্খিত নাভিশ্বাস আবার সর্বনাশ!
দুপুর থেকেই ছমছমে আকাশ, গুমরে মরছিল।তারপরেই কালভৈরব ঝড়ের তান্ডব আর কিছুপরেই শান্তির ধারাবর্ষণ। পুরুষ আর প্রকৃতির খেলা যেন। সবুজ আর সজীবের প্রাণ ফিরে পাওয়া। দরজার পাল্লা পড়ছে, জানলার কাঁচ ভাঙছে। কত শব্দ। আর সবচেয়ে দাপট দেখায় শালপ্রাংশু বৃক্ষগুলি। একবার আটকে গেছিলাম চিলেকোঠায়। নীচে নামতে না পেরে দু চার লাইন কাব্যি করেছিলাম। কবিতার নাম দিয়েছিলাম কালবোশেখি। অকালবোশেখির মত আমার কাছে সব কালবোশেখিই যেন বড় অকালে আসে। তাকে বুঝতে না বুঝতেই সে এসে চলে যায় দুমদাম পা ফেলে।
এখনো কালবোশেখির স্মৃতি মেদুর বিকেলগুলোয় চোখ বুঁজলে কিউটিকিউরা পাউডারের হালকা গন্ধ পাই কালবৈশাখীর বিকেলে । গা ধুয়ে নরম ছাপা শাড়ি পরে মায়েদের দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেই মাদুর নিয়ে ছাদ সংসার পাতার তোড়জোড় । মায়ের হাতে একটা হাতপাখা আর অন্যহাতে বাড়িতে পাতা টক দইয়ের ঘোল। ওপরে কাগচিলেবুর সুবাস । ফ্রিজ তখনো ঢোকেনি বাড়িতে। বরফ যেন আমাদের কাছে সোজা হিমালয় পৌঁছনোর মত ব্যাপার। বাজারে একটা দোকানে সন্ধ্যের ঝুলে বরফ বিকত। সেখান থেকে বরফ কিনে এনে শরবত খাওয়া হত। সেদিন যেন চাঁদ হাতে পাওয়া। তখন "হিমক্রিম' পাওয়া যেত। সেও যেন এক অতি আশ্চর্য রকমের প্রাপ্তি। মিষ্টির দোকানে আইসক্রিম মিলত। কোয়ালিটির আইসক্রিমের কাপ।কোনোকোনো দিন দুধের বড় ক্যানের মধ্যে বরফ দিয়ে সেই আইসক্রিম আসত গরমের ছুটির বিকেলে। ছাদের ওপর হয়ে যেত আমাদের ছোট্টবেলার আইসক্রিম পার্টি। বাবা একবার সেই আইসক্রিম আনতে গিয়ে কালবোশেখির ঝড়ে পড়লেন। কি চিন্তা আমাদের! যত না চিন্তা মানুষটির জন্য তত চিন্তা আইসক্রিমের জন্য। মা খুব বকুনি দিয়েছিলেন। আগে বাবা না আগে আইসক্রিম এই বলে।
তখন আমাদের স্কুলজীবনে গরমকালের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল লোডশেডিং। ইনভার্টার ছিলনা । রোজ নির্দ্দিষ্ট সময়েই পাওয়ার কাটের পূর্বাভাস পেয়ে যেতাম আমরা। আর কালবোশেখি হলেও ঝড়ের তাণ্ডবে পাওয়ার চলে যেত। তখন দখিণের খোলা বারান্দাই ভরসা। সেখানেই জ্যামিতি, পরিমিতি আর উপপাদ্যে নিয়ে জোর কসরত চলত । সকাল থেকেই হ্যারিকেনে কেরোসিন ভরে, ঝেড়ে পুঁছে রেখে, তার সলতে ঠিকমত কেটে সমান করে দেওয়া হত । এখন শিল্পের বাড়বাড়ন্ত অতটা নেই তাই বিদ্যুতের চাহিদাও নেই। অবশ্য বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে শপিং মলে, মেট্রো রেলে। মাল্টিপ্লেক্সে, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে, সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে। বিশ্বায়নের স্বীকার আমাদের শহর।আর সেই সঙ্গে আমরাও। তবে কলকারখানাও নেই বড় একটা তাই লোডশেডিং মুক্ত আমরা । তাই স্কুলের শিশুরা আরামেই গ্রীষ্মের ছুটির হোমওয়ার্ক করে । হোম মেকারের বাতানুকূল দিবানিদ্রা দিব্য যাপন।
রাতে লোডশেডিংয়ে মা টানতেন হাতপাখা। শাড়ির পাড় দিয়ে মোড়া থাকত হাতপাখাটি। টেঁকশই হবে বলে । ছোটদের বেয়াদপির দাওয়াই ছিল এই পাখার বাড়ি। যে খায়নি এই পাখার বাড়ি সে জানেওনা তা কেমন খেতে । সেই তালপাতার পাখাখানি টানতে টানতে বাইচান্স আমাদের গায়ে ঠুক করে লেগে গেলেই মায়ের যেন একরাশ মনখারাপ। যেন কি ভুলই না করেছেন। সেই পাখা সাথে সঙ্গে সঙ্গে ঠকাস করে মাটিতে ঠুকে তিনবার আমাদের কপালে, চিবুকে হাত রেখে চুক চুক করে ক্ষমা চাইতেন। দোষ কাটিয়ে নিতেন। সন্তানের গায়ে হাতপাখা লেগে যাওয়া যেন দন্ডনীয় অপরাধ। মাটির কুঁজো বা জালার জল ছিল আরেক প্রাণদায়ী বন্ধু সে গরমে। মা আবার এক ফোঁটা কর্পূর দিয়ে রাখতেন জালার জলে। জীবাণুনাশক আবার সুন্দর গন্ধ হবে বলে। জলের লীনতাপকে ধাক্কা দিয়ে বাইরে বের করে দেবার জন্য সকাল থেকেই লাল শালু ভিজিয়ে জড়িয়ে দেওয়া হত মাটির জালার বাইরে। এখন গর্বিত বাঙালির ঘরে ঘরে ফ্রিজ। সে মাটির কুঁজোও নেই আর নেই সেই হাতপাখা।
এখন সকলে বলে গরম বেড়েছে। কারণ নাকি বিশ্ব উষ্ণায়ণ। পরিবেশের নাকি বেজায় দম্ভ। বাড়ীর গরম, গাড়ীর গরম। সেই সঙ্গে মানুষের মাথাও গরম। টিভির চ্যানেলে অহোরাত্র ঘটি গরম। তাই মেঘ জমে কালবোশেখি হবার আগেই সব মেঘ বাষ্পমুক্ত হয়ে শুকিয়ে যায়। মায়ের এখন থাইরয়েড তাই গরম আরো বেশি। হোমমেকারের হটফ্লাশ তাই গরম বেশি। বাজারদরের আগুণ নেভেনা তাই বাবার কপালের ঘাম শুকোতে চায়না। ছেলেপুলেরা জন্মেই ফ্রিজ দেখেছে তাই ফ্রিজে জল না থাকলে তারাও অগ্নিশর্মা। ওরা শিখল মকটেল। পেপসি। বাড়ীতে সফট ড্রিংক্স রাখা যায় এসব ছিল আমাদের ধারণার বাইরে। বাড়ীতে পাতা টক দৈয়ের ঘোলের স্বাদ ওরা পেল না। কি জানি লোডশেডিং, মাটির জালা, হাতপাখার বাতাস, ছাদে বসে বরফকুচি দেওয়া সীমিত শরবত এগুলোই বোধ হয় ভালো ছিল। তাই বুঝি এত গরম অনুভূত হতনা। আর কালবোশেখির প্রতীক্ষাও ছিল না। তিথি নির্ঘণ্ট মেনে ঠিক ঈশানকোণে মেঘ জমে উঠত।
আর কালবোশেখি এলেই কাঁচা আম ঝরে পড়া? ঝড়ে আম কুড়োয় এখনো কোনো দস্যি ছেলে। তবে পথেঘাটে নয়। শিলাজিতের গানেই। এখন ওদের আর রাখাল সাজা হয় না। কারণ তারাও এখন চাপে। তাই ঠাম্মার কপালে ভাঁজ। আমকাসুন্দি বানাতে হবে। আমবারুণীর পুজো করতে হবে না গঙ্গায় গিয়ে? কিন্তু কে কুড়োবে সেই আম। আম পাড়ার নেশা যে কি জিনিষ তা যে পেড়েছে সেই জানে। এখন রিয়েল এস্টেটের রমরমায় নেই সেই আমগাছ। নেই সেই আম রাজত্ব। বাজারের কেনা আমে সাধ মেটাও হে বঙ্গললনা।
তাই কালবোশেখি আসুক আর না আসুক গ্রীষ্মকাল সমাগত!
যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক"
দুপুর থেকেই ছমছমে আকাশ, গুমরে মরছিল।তারপরেই কালভৈরব ঝড়ের তান্ডব আর কিছুপরেই শান্তির ধারাবর্ষণ। পুরুষ আর প্রকৃতির খেলা যেন। সবুজ আর সজীবের প্রাণ ফিরে পাওয়া। দরজার পাল্লা পড়ছে, জানলার কাঁচ ভাঙছে। কত শব্দ। আর সবচেয়ে দাপট দেখায় শালপ্রাংশু বৃক্ষগুলি। একবার আটকে গেছিলাম চিলেকোঠায়। নীচে নামতে না পেরে দু চার লাইন কাব্যি করেছিলাম। কবিতার নাম দিয়েছিলাম কালবোশেখি। অকালবোশেখির মত আমার কাছে সব কালবোশেখিই যেন বড় অকালে আসে। তাকে বুঝতে না বুঝতেই সে এসে চলে যায় দুমদাম পা ফেলে।
এখনো কালবোশেখির স্মৃতি মেদুর বিকেলগুলোয় চোখ বুঁজলে কিউটিকিউরা পাউডারের হালকা গন্ধ পাই কালবৈশাখীর বিকেলে । গা ধুয়ে নরম ছাপা শাড়ি পরে মায়েদের দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেই মাদুর নিয়ে ছাদ সংসার পাতার তোড়জোড় । মায়ের হাতে একটা হাতপাখা আর অন্যহাতে বাড়িতে পাতা টক দইয়ের ঘোল। ওপরে কাগচিলেবুর সুবাস । ফ্রিজ তখনো ঢোকেনি বাড়িতে। বরফ যেন আমাদের কাছে সোজা হিমালয় পৌঁছনোর মত ব্যাপার। বাজারে একটা দোকানে সন্ধ্যের ঝুলে বরফ বিকত। সেখান থেকে বরফ কিনে এনে শরবত খাওয়া হত। সেদিন যেন চাঁদ হাতে পাওয়া। তখন "হিমক্রিম' পাওয়া যেত। সেও যেন এক অতি আশ্চর্য রকমের প্রাপ্তি। মিষ্টির দোকানে আইসক্রিম মিলত। কোয়ালিটির আইসক্রিমের কাপ।কোনোকোনো দিন দুধের বড় ক্যানের মধ্যে বরফ দিয়ে সেই আইসক্রিম আসত গরমের ছুটির বিকেলে। ছাদের ওপর হয়ে যেত আমাদের ছোট্টবেলার আইসক্রিম পার্টি। বাবা একবার সেই আইসক্রিম আনতে গিয়ে কালবোশেখির ঝড়ে পড়লেন। কি চিন্তা আমাদের! যত না চিন্তা মানুষটির জন্য তত চিন্তা আইসক্রিমের জন্য। মা খুব বকুনি দিয়েছিলেন। আগে বাবা না আগে আইসক্রিম এই বলে।
তখন আমাদের স্কুলজীবনে গরমকালের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল লোডশেডিং। ইনভার্টার ছিলনা । রোজ নির্দ্দিষ্ট সময়েই পাওয়ার কাটের পূর্বাভাস পেয়ে যেতাম আমরা। আর কালবোশেখি হলেও ঝড়ের তাণ্ডবে পাওয়ার চলে যেত। তখন দখিণের খোলা বারান্দাই ভরসা। সেখানেই জ্যামিতি, পরিমিতি আর উপপাদ্যে নিয়ে জোর কসরত চলত । সকাল থেকেই হ্যারিকেনে কেরোসিন ভরে, ঝেড়ে পুঁছে রেখে, তার সলতে ঠিকমত কেটে সমান করে দেওয়া হত । এখন শিল্পের বাড়বাড়ন্ত অতটা নেই তাই বিদ্যুতের চাহিদাও নেই। অবশ্য বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে শপিং মলে, মেট্রো রেলে। মাল্টিপ্লেক্সে, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে, সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে। বিশ্বায়নের স্বীকার আমাদের শহর।আর সেই সঙ্গে আমরাও। তবে কলকারখানাও নেই বড় একটা তাই লোডশেডিং মুক্ত আমরা । তাই স্কুলের শিশুরা আরামেই গ্রীষ্মের ছুটির হোমওয়ার্ক করে । হোম মেকারের বাতানুকূল দিবানিদ্রা দিব্য যাপন।
রাতে লোডশেডিংয়ে মা টানতেন হাতপাখা। শাড়ির পাড় দিয়ে মোড়া থাকত হাতপাখাটি। টেঁকশই হবে বলে । ছোটদের বেয়াদপির দাওয়াই ছিল এই পাখার বাড়ি। যে খায়নি এই পাখার বাড়ি সে জানেওনা তা কেমন খেতে । সেই তালপাতার পাখাখানি টানতে টানতে বাইচান্স আমাদের গায়ে ঠুক করে লেগে গেলেই মায়ের যেন একরাশ মনখারাপ। যেন কি ভুলই না করেছেন। সেই পাখা সাথে সঙ্গে সঙ্গে ঠকাস করে মাটিতে ঠুকে তিনবার আমাদের কপালে, চিবুকে হাত রেখে চুক চুক করে ক্ষমা চাইতেন। দোষ কাটিয়ে নিতেন। সন্তানের গায়ে হাতপাখা লেগে যাওয়া যেন দন্ডনীয় অপরাধ। মাটির কুঁজো বা জালার জল ছিল আরেক প্রাণদায়ী বন্ধু সে গরমে। মা আবার এক ফোঁটা কর্পূর দিয়ে রাখতেন জালার জলে। জীবাণুনাশক আবার সুন্দর গন্ধ হবে বলে। জলের লীনতাপকে ধাক্কা দিয়ে বাইরে বের করে দেবার জন্য সকাল থেকেই লাল শালু ভিজিয়ে জড়িয়ে দেওয়া হত মাটির জালার বাইরে। এখন গর্বিত বাঙালির ঘরে ঘরে ফ্রিজ। সে মাটির কুঁজোও নেই আর নেই সেই হাতপাখা।
এখন সকলে বলে গরম বেড়েছে। কারণ নাকি বিশ্ব উষ্ণায়ণ। পরিবেশের নাকি বেজায় দম্ভ। বাড়ীর গরম, গাড়ীর গরম। সেই সঙ্গে মানুষের মাথাও গরম। টিভির চ্যানেলে অহোরাত্র ঘটি গরম। তাই মেঘ জমে কালবোশেখি হবার আগেই সব মেঘ বাষ্পমুক্ত হয়ে শুকিয়ে যায়। মায়ের এখন থাইরয়েড তাই গরম আরো বেশি। হোমমেকারের হটফ্লাশ তাই গরম বেশি। বাজারদরের আগুণ নেভেনা তাই বাবার কপালের ঘাম শুকোতে চায়না। ছেলেপুলেরা জন্মেই ফ্রিজ দেখেছে তাই ফ্রিজে জল না থাকলে তারাও অগ্নিশর্মা। ওরা শিখল মকটেল। পেপসি। বাড়ীতে সফট ড্রিংক্স রাখা যায় এসব ছিল আমাদের ধারণার বাইরে। বাড়ীতে পাতা টক দৈয়ের ঘোলের স্বাদ ওরা পেল না। কি জানি লোডশেডিং, মাটির জালা, হাতপাখার বাতাস, ছাদে বসে বরফকুচি দেওয়া সীমিত শরবত এগুলোই বোধ হয় ভালো ছিল। তাই বুঝি এত গরম অনুভূত হতনা। আর কালবোশেখির প্রতীক্ষাও ছিল না। তিথি নির্ঘণ্ট মেনে ঠিক ঈশানকোণে মেঘ জমে উঠত।
আর কালবোশেখি এলেই কাঁচা আম ঝরে পড়া? ঝড়ে আম কুড়োয় এখনো কোনো দস্যি ছেলে। তবে পথেঘাটে নয়। শিলাজিতের গানেই। এখন ওদের আর রাখাল সাজা হয় না। কারণ তারাও এখন চাপে। তাই ঠাম্মার কপালে ভাঁজ। আমকাসুন্দি বানাতে হবে। আমবারুণীর পুজো করতে হবে না গঙ্গায় গিয়ে? কিন্তু কে কুড়োবে সেই আম। আম পাড়ার নেশা যে কি জিনিষ তা যে পেড়েছে সেই জানে। এখন রিয়েল এস্টেটের রমরমায় নেই সেই আমগাছ। নেই সেই আম রাজত্ব। বাজারের কেনা আমে সাধ মেটাও হে বঙ্গললনা।
তাই কালবোশেখি আসুক আর না আসুক গ্রীষ্মকাল সমাগত!
যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক"
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন