২১ মে, ২০১৮

যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক" / জেনে শুনে বিষ করেছি পান




ভোর ভরেছি ভেজালে । শুরু ভেজাল দুধ দিয়ে । তাতে নাকি মিশ্রিত চকের গুঁড়ো, ডিটারজেন্ট,এমোনিয়াম সালফেট, বোরিক এসিড, কস্টিক সোডা। হাঁস মুরগীর খাবারে Astaxanthin মিশিয়ে ডিমের কুসুম টুকটুকে কমলা করার পদ্ধতিও বহুদিনের। আর ব্রেড?  ময়দা নাকি সবচেয়ে বড় শত্রু  আমাদের শরীরের। কারণ প্রোসেসিং এর সময় সব নিউট্রিয়েন্টস ঝেড়ে পুছে ফেলে দেওয়া হয়। তবে ব্রাউন ব্রেড ? বেশীর ভাগ দোকানেই ব্রাউন ব্রেড ময়দা দিয়েই বানান হয় । আর বাদামীর কারণ ক্যারামেল। জানতেন না? কি করে জানবেন? উইক এন্ডে লঙ ড্রাইভে গিয়ে ধাবার খাটিয়ায় বসে মনের সুখে তন্দুরি রুটি আর মাংস খেয়ে সুখ ঢেকুর তোলেন নি? তখন জানতেন ওই মাংস ভাগাড়ের মৃত পশুর? 
তাহলে মুড়িই খান। সেখানেও মুড়িভাজার আগে নাকি ইউরিয়া মেশানো হয়। লম্বা লম্বা ধবধবে সাদা, ফুরফুরে জুঁইফুলের মত মুড়ি দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়ি আমরা। অথচ গ্রামের মেয়েরা যে মুড়ি নিয়ে বাজারে বসে সেগুলি অপেক্ষাকৃত মোটা, লাল মুড়ি। সেগুলোর দিকে ফিরে চাই না। পহেলে দর্শণধারী চাই যে আমাদের।       
চা' পাতায় রং করা কাঠের গুঁড়ো, লোহার গুঁড়ো । এবার চাল সেখানেও পাউডার মেশানো । নয়ত পোকা লেগে যাবে । সবজী তে পর্যাপ্ত পেস্টিসাইড। ফলন হবেনা যে। তুঁতে গোলা জলে সবজী ? টাটকা, সবুজ দেখাবে যে বহুক্ষণ। মাছ? সেখানেও বাইরে থেকে রোডামিন বি  ইঞ্জেক্ট করা কানকোর মধ্যে। মাছ কে তাজা দেখাবে তাই।
আর বিশেষ রোগে আক্রান্ত মরা মাছ সস্তায় কিনে এনে সস্তায় বিক্রি করা?  বা মরা চিকেন ফরমালিন দিয়ে তাজা রাখার কৌশল? ব্যাবসায়ীরা খুব ভালই আয়ত্ত করেছেন এসব।
মাংস? যাকে খাসি বলে ভাবছ, সে আসলে মেয়ে ছাগল। সরকারি নীল ছাপ মেরে ঝুলছে চোখের সামনে। মুরগী? তার মৃত্যু যে কবে হয়েছে না জেনে কিনলেই মরেছ তুমি। নতুন হাইপ। তাহলে খাবটা কি? হাওয়া খেয়ে থাকব?  পওহারী বাবার মত।

এই সেবার ম্যাগি নিয়ে গেল গেল রব উঠল। হেলে ধরতে পারিনা, কেউটে ধরতে যাই আমরা।

ফুড সেফটি এন্ড স্ট্যান্ডার্ডস অথোরিটি অফ ইন্ডিয়া নামে একটি খাদ্য নিয়ামক সংস্থা আছে।  কিছুদিন আগে যারা ম্যাগির মধ্যে নিষিদ্ধ সীসে আর আজিনামোতোর উপস্থিতিতে ম্যাগির গুষ্টির তুষ্টি করে ছাড়ল।  আচ্ছা তারা দেখতে পান না রাস্তার মোড়ের তেলেভাজা কিম্বা কচুরিভাজার দোকানের তেলের রং? বারেবারে উচ্চ তাপমাত্রায় তেল কে গরম করলে HNE(বা ৪-হাইড্রক্সি ট্রান্স-২ ননেনাল্) নামক যৌগটি ডিপ ফ্রায়েড ফুডে শোষিত হতে থাকে যা দীর্ঘদিন সেবন করলে কার্ডিওভাসকুলার এবং নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের সৃষ্টি করে।
সব্জির বাজারে উচ্ছে, পটল বা কাঁকরোল কে তুঁতের জলে ডোবানো ?  তুঁতে মানে কপার সালফেট। নির্ভেজাল বিষ মশাই। পোকা মারার অব্যর্থ দাওয়াই। মানে যাকে বলে ইনসেকটিসাইড। 
মাঝেমাঝেই কর্মকর্তারা নড়েচড়ে বসেন খাদ্যের মান নির্ধারণ নিয়ে। কমিটি গঠন হয়। সব্জিতে রং মিশিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে ব্যাপারী।  টিভি চ্যানেলে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়।  এগুলি জামিন অযোগ্য অপরাধ বলে। তারপর চুপচাপ । কোয়ালিটি কন্ট্রোল হবে, অপরাধীর সাজা হবে। স্তোক দেওয়া অব্যাহত থাকে। পরিকাঠামোর অভাব আছে বুঝি? কেন্দ্র দেবেন না অনুদান? ভাইটাল ব্যাপার।

নাগরিক স্বাস্থ্য বলে কথা। আর অনুদান পেলে বেসরকারী সংস্থারা এগিয়ে আসছেন না কেন? ফুটপাথীয় ফার্ষ্টফুডের রমরমা চলতেই থাকবে?  মরুক মানুষ। মরুক সমগ্র জাতি। তৃতীয় বিশ্বে এমনি হবেক। বিদেশে কিন্তু খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের বিশেষ সেল থাকে। তারা গুণমান দেখে। আর আমরা কিনা দেখি হোটেলের সিংকের নীচে স্তূপীকৃত নুডলস সেদ্ধ তে আরশোলার সানন্দে চরে বেড়ানো।  নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাব প্রায়শ‌ই দেখি নড়েচড়ে বসেন। লম্বাচওড়া বাতেলা আওড়ান । কিন্তু তারপরেও কচুরীর ভাজার তেলটি বদলানো হয় না দিনের পর দিন। আমাদের আর্থসামাজিক পরিস্থিতিটা এমনি থাকবে মশাই?  আমরাও  ঘুমে অচেতন থাকব।  আমাদের উচিত তর্পণে গাঙ শুকোয় । এত কাজ কে করবে বলুন তো?

হলুদ গুঁড়োর সঙ্গে মিশ্রিত থাকে হলুদের চেয়েও উজ্জ্বল কার্সিনোজেনিক লেড ক্রোমেট। আর টকটকে লাল লঙ্কার গুঁড়োয়  ? লাল cayenne পাউডার মেশানো হয়।  এই রং না মেশালেই নয়? আজ কি তাই ঘরে ঘরে এত কিডনির অসুখ ?  রান্নাঘরে এমন থৈ থৈ ভেজাল আমাদের। এছাড়া ঐ সব মনোহারী শরবত, দর্শনধারী বোতলবন্দী পানীয়? গ্রিন ম্যাঙ্গোয় ম্যালাকাইট গ্রিন, টুকটুকে লাল গোলাপের মত পানীয়ে কঙ্গো রেড বা এলিজারিন? এ সব রাসায়নিক আমাদের শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক । ভোজ্য সর্ষের তেলে রেড়ির তেল, শিয়ালকাঁটার তেল, আর্জিমোন অয়েলের  উপস্থিতি তো সর্বজনবিদিত।? সেও তো ড্রপসি, অষ্টিও আরথাইটিসের কারণ। বেসনের মধ্যে খেসারির ডালের গুঁড়ো? সেও তো মারাত্মক। গোলমরিচের মধ্যে পেঁপের শুকনো বীজ মিশিয়ে দেওয়া? জানেন এইসব কারণেই লিভারের সমস্যা থেকে দৃষ্টিশক্তি, নার্ভ থেকে আর্থাইটিস এসব রোগ অপ্রতিরোধ্যভাবে বেড়েই চলেছে। মিষ্টির দোকানে রূপোলী তবক দেওয়া মিস্টিগুলি দেখেই কিনতে ছোটেন তো? একদম না। ওগুলি তো ক্রেতা কে আকৃষ্ট করার উপায়। যাহা চকচক করে তাহা বিষ। জেনেশুনে বিষ পান করবেন কেন? অন্য মিষ্টি নিন। এই এলুমিনিয়াম ফয়েলে পেটের সমস্যা হয়। এযুগের আরেকটা হাইফাই ব্যাপার হল সুগারফ্রি মিষ্টি? চিনির বিকল্প হিসেবে ব্যাবহৃত স্যাকারিন সস্তা কিন্তু ব্যানড বহুদিন। আর এসপার্টেম অথবা সুক্রালোজ? কোনোটাই দরকার নেই আমাদের শরীরে। চিনি বাদ দিন। বিকল্প খাবেন না। আর মন না মানলে একটু চিনি ই খান। সুগার ফ্রি নৈব নৈব চ। 
টালা থেকে টালিগঞ্জে, বালি থেকে বালিগঞ্জে, খিদিরপুরে অথবা ভবানীপুরে, মল্লিকবাজার কিম্বা বাগবাজারে সর্বত্র‌ই জেনেশুনে বিষ পানের বিশাল আয়োজন কিন্তু। টিভি বলবে জাগো গ্রাহক জাগো। ক্রেতা সুরক্ষার কচকচি আওড়াবেন নেতারা। কিন্তু শরীর আমার। স্বাস্থ্য‌ও আমার। সেখানে নো কম্প্রোমাইজ। 

বিশ্বসংস্থার স্বাস্থ্য রিপোর্টে আবারো হুঁশিয়ারি। চাপান উতোর। জলঘোলা। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশেও ভবি ভোলার নয়। অতএব জুভেনাইল হৃদরোগ, স্নায়ুরোগ, ক্যানসার ইত্যাদি মারণরোগের বাড়বাড়ন্ত, এটাই সত্য। ওবেসিটি আজকের সমাজের অভিশাপ। এও সত্য।

এখন আবার শুনছি একজনের এঁটো পাতকুড়োনোও দিব্য চালান হচ্ছে অন্যের প্লেটে। রেস্তোঁরার ফ্রিজের খাবারদাবারে নাকি পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাংগাস। টেলিভিশনে টক শো। হট কেক টপিক। দেখেছেন তো? হ্যান করেঙ্গা, ত্যান করেঙ্গা। রেস্তোঁরার ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করেঙ্গা। চার্জশিট পেশ। জরিমানা, কারাবাস। আবার সব ধামাচাপা। 
আরো কত বলব? স্বনামধন্য ফুড ব্র্যান্ডে চানাচুরে নাকি বহুদিন কুড়মুড়ে রাখার জন্য মার্বেল ডাস্ট মেশানো হয়? অথবা কেশরী বিরিয়ানী কিম্বা রাবড়ি তে মেটানিল ইয়েলো? এটি ক্যানসারকারক কেমিক্যাল। তবে এবার যারা সক্কলকে ঘোল খাইয়েছেন ভাগাড়ের পচা মাংস বেচে তাদের রাজ্য-শ্রী এওয়ার্ড দেওয়াই যায় সত সাহসের জন্য।
হিমঘরে উদ্ধার হওয়া এই মাংসের মধ্যে কুকুরের মাংসও রয়েছে। বজবজ থেকে রাজাবাজার, ধাপার মাঠ থেকে সোনার পুর, এমনকি বিহার অবধি ব্যাপ্তি এই মাংস চক্রের।   এজেন্ডা হল এমনি। পশুর মৃত্যু, কোল্ড স্টোরেজ, কেমিক্যালস প্রয়োগ, আবারো হিমঘর তারপর প্যাকেজিং। ব্যাস! আম আদমীর ঘরে পৌঁছে যাবার সুনিপুণ ব্যবস্থা।
লজ্জা, ঘেন্না, ভয়, এই তিনের কোনোটিই নেই এই চক্রের। অতএব ব্যবসার খাতিরে গো এহেড!  যতদিন না ধরা পড়ছি লজ্জাই বা কিসের্, ভয় ই বা কেন আর ঘেন্না? ওসব থাকলে কেউ ভাগাড়ের মাংস মানুষের খাবারের জন্য ভাবতে পারে?  ছিঃ আমার তো ভেবেই ঘেন্না করছে। 
কিছু মানুষের অবিশ্যি ভাবখানা এমন যে, ভাগাড় থেকে মৃত পশুর টন টন মাংস সস্তায় বিকোচ্ছে বুঝি? ঠিক আছে ক'দিন মাংস খাব না বাবা। তারপর? তার আর পর নেই। পচন ধরা আমিষ অথবা কৃত্রিম রং মেশানো খাবারদাবার। সব গা সওয়া আমাদের। অতএব যা চলছে চলুক। তৃতীয় বিশ্বের চতুর্থ শ্রেণীর নাগরিকদের এমনি প্রাপ্য।
আবার স্যাম্পেল এনালিসিস হবে। ঠগ বাছার প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে । কসাই ধরপাকড় হবে । ফরেনসিক এক্সপেরিমেন্ট হবে। উদ্দিষ্ট চক্র ছাড়াও পাবে। আপনার আমার নাকের ডগায় আবার বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে তারা । একদিন এ ঝড় ঠিক থেমে যাবেই। পৃথিবী আবার শান্ত হবেই। 
মাংসাশী মানুষ তখন আবার জোর কদমে ঘেন্না, ভয় ভুলে মাংসের ঝোল খাবে কব্জি ডুবিয়ে। বলবে খেয়ে তো নি আগে, তারপর দেখা যাবে। জেনে শুনে বিষ পান? ওসব রবিঠাকুরের কাব্যেই হয়। আমাদের কি এসে যায়?

যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক"

কোন মন্তব্য নেই: