২১ মে, ২০১৮

যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক" / পরীক্ষা বাতিল

 
এখন পরীক্ষা হয়ে যাবার পর ক্যান্সেল শুনলেই  মনে পড়ে যায় ১৯৮৪ সালের কথা। সে আশির কথা ভাবলে এখনো বিস্ময়ে হতবাক হ‌ই। আশি না আশীবিষ এ শহরের বুকে? আমি তখন ঊণিশ-কুড়ি। আমার গর্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম পরীক্ষা পার্ট ওয়ান অনার্স শুরু। তারিখ ৫ইজুন, সাল ১৯৮৪। ৪ঠা জুন থেকে প্রচন্ড বৃষ্টির দাপটে পুরো শহর জলমগ্নতায় ।  সিট পড়েছিল কলেজস্ট্রীটের জলজমার আড়ত সংস্কৃত কলেজে। খবরে শেষ অবধি কোনো ঘোষণা হলনা পরীক্ষা স্থগিতের। অগত্যা চাল-চিঁড়ে বেঁধে সব বন্ধুরা হাজির হতে শুরু করলাম সংস্কৃত কলেজের দোরগোড়ায়। পরীক্ষা দিয়ে উদ্ধার হব আমরা। উদ্ধার করবেন আমাদের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়। 
হরিপাল থেকে দত্তপুকুর, আলমবাজার থেকে বাগবাজার, নিমতলা থেকে শ্যামবাজার....সকলেই চলেছি এক‌ই দিকে। মাথায় অনার্স পরীক্ষার চিন্তার জটগুলো ক্রমশঃ পাকিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্নপত্র সোজা না কঠিন হবে সে প্রশ্নটা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়ে আপাততঃ শ্যামবাজারে বাস থেকে নেমে পড়তে হল। বাস আর যাবেনা। বিধানসরণী, ভূপেন বোস এভিন্যু, সার্কুলার রোড, সর্বত্র জলময়। পরীক্ষা শুরু দুপুর বারোটায়। চারঘন্টা মেয়াদ তার।  সমুদ্রে পেতেছি শয্যা, শিশিরে কি ভয়! কলকাতায় জন্মে অবধি জলজমা দেখে আসছি, তাই বানভাসি শহর নতুন নয়।  
এক টানা রিকশোতে চড়ে বসলাম। রিকশার পাদানিতে জল থৈ থৈ । আকাশটা থমথমে। বৃষ্টি নেই কিন্তু মেঘ আছে । আমাদের পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে  আকাশেরো যেন চাপা দুঃখ । ব্যাগে এক্সট্রা পোষাক আছে অতএব চিন্তা নেই। এখন ধ্যান, জ্ঞান শুধু সংস্কৃত কলেজে আমার জন্য নির্ধারিত বেঞ্চিটি। হাজির হলাম ফড়িয়াপুকুর, হাতিবাগান, হেদুয়ার বন্যা পেরিয়ে। তখন বাজে সকাল সাড়ে দশটা। ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে থাকল। বারোটার আশেপাশে পরীক্ষা শুরু হবার কোনো লক্ষণ দেখলাম না। এবার ঘোষণা হল, প্রশ্নপত্র হাজির হয়নি তাই পরীক্ষা মনে হচ্ছে স্থগিত হবে। তখন দেখি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বন্ধুবান্ধবরা জলে ভিজে এসে গেছে ঠিক সময় মত। বাড়ি চলে যাবার ধান্দা করছি, তখন ঘোষণা হল প্রশ্নপত্র এসেছে, পরীক্ষা শুরু হবে বেলা দুটোর সময়। আমাদের পেটে তখন ভুখছানি। চারঘন্টা ধরে মাথা খাটিয়ে কেমিষ্ট্রি অনার্স পেপার ওয়ান দেব। জীবনে প্রথম। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা, পার্ট ওয়ান বলে কথা!
ঠিক দুটোর সময় যখন হলে প্রবেশ করলাম তখন ইলেকট্রিকের কেবল ফল্ট হল। ঝুপসি অন্ধকার ক্লাসরুম। টেবিলে একটা করে মোমবাতি এল। পরীক্ষা শুরু হল। জানা জিনিষগুলো তখন মনে হতে লাগল অজানা। সোজা উত্তরগুলো মনে হচ্ছিল ভীষণ কঠিন। পেরোলাম চারটে ঘন্টা। খাতা জমা দিয়ে এলাম । খাওয়াদাওয়া নেই। জল জমে আছে তখনো। বাড়ি ফিরলাম একরাশ মনখারাপ নিয়ে। শরীরটাও যেন ট্রমাটাইজড। পার্ট ওয়ান শুরুটা মনের মত হলনা। বাড়ি ফিরে দূরদর্শনের খবরে ঘোষণা করা হল সেদিনের সেই কাঠ খড় পোড়ানো পাহাড়ে ওঠার  পার্ট ওয়ান পরীক্ষা ক্যানসেল হয়েছে।  এই হল আমাদের  শিক্ষা ব্যবস্থা। নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়নি রক্ষে!
উতরেছিলাম ঠিকই কিন্তু সেবারের পার্টওয়ান এই ঘটনা আমার জীবনকে নাড়া দিয়েছিল।  পরেরবছর পার্ট টু পরীক্ষা। থিওরির পর প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার সিট পড়েছিল আরেক নাম করা ছেলেদের কলেজে।  সেখানে পৌঁছে রোল নাম্বার অনুয়ায়ী লটারীতে নির্ধারিত স্যাম্পল সল্ট অ্যানালিসিসের শিশিটি  হাতে নিয়ে ল্যাবরেটরিতে প্রবেশ করতে যাব, এমন সময় ল্যাবের একজন অ্যাসিট্যান্ট আমাকে চুপুচুপি ডেকে বলল
"তোমার অজানা সল্টের স্যাম্পলে কি আছে জানতে চাও? পার সল্ট চল্লিশ টাকা লাগবে।" তাহলে আমি আর টেস্ট না করেই শুধু লিখে খাত জমা দিয়ে ফুল মার্ক্স পেয়ে বেরিয়ে যাব। রোল নাম্বার সাঁটা শিশির গায়ে। রেজিষ্টার খুলে সেই ল্যাব অ্যাসিট্যান্ট যেন হাঁ করে বসে আছে। প্রত্যেককেই সে এমন প্রস্তাব দিচ্ছিল। কেউ টোপ গিলছে কেউ গিলছেও না। সাদা, লাল, নীল, সবুজ, কমলা...কত রংবেরংয়ের সল্ট স্যাম্পল। দুটি করে রাসায়নিক যৌগ আছে যার মধ্যে । নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টেস্ট করে বের করতে হবে সেই দুই যৌগের নাম। কেমিষ্ট্রি যারা পড়েছে তারা জানে এ হল সবচেয়ে কঠিনতম প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা।  
অন্যায়ের সঙ্গে কোনোদিনো আপোষ করিনি তাই নিজে নিজেই লড়ে সেই সল্ট অ্যানালিসিস উতরে গেছিলাম কিন্তু মনের কোণায় সেই যে একটা খেদ, গ্লানি আর ন্যায়ের জন্য  যুদ্ধ শুরু হল সেই যুদ্ধ আমার এখনো চলছে। মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে গেছে সেদিন থেকে, অন্যায়ের সঙ্গে  আপোষ না করা । সেদিন পরীক্ষা হলের বাতাবরণে হয়ত প্রতিবাদী হয়ে উঠিনি কিন্তু যতটুকুনি পড়াশুনো করেছি সেটুকুনি কাজে লাগিয়েছি, তাই মনে মনে আজো গর্ববোধ করি।  আশীর দশকের এই দুটো শিক্ষা সম্বন্ধীয়  ঘটনা মনকে আজো নাড়া দেয় আর এখনো ভাবি কিসের শিক্ষা? কেন এই শিক্ষা? সেখানেও রাজনীতি না কি অন্য কোনো ছক কষাকষি থাকে? উত্তরটা খুঁজে চলেছি এখনো ।
তাই আজ যখন বোর্ডের প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য পরীক্ষা ক্যান্সেল হল তখন মনের মধ্যে তোলপাড়। বেচারা পড়ুয়াদের জন্য। যারা কেউ ভেবেছে পরীক্ষা দিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচবে। কেউ ভেবেছে বেড়াতে বেরুবে, তা না তাদের আজ ট্রমায় দিন কাটছে। উপযুক্ত শাস্তি পাক এই চক্র তবে রিএক্সাম কি এর সমাধান? জানি হয়ত রিটেস্ট তাদের দিতেই হবে কিন্তু যারা নির্বিবাদে পরীক্ষা দিল, যারা ঘুণাক্ষরে টের পেল না তারা কেন এই যজ্ঞে আবার সামিল হবে? রিএক্সামের ট্রমা যে কি জিনিষ তা আমার মত সেই ৮৪ র পরীক্ষার্থীরা সকলেই হাড়েহাড়ে বুঝি।
যারা এই প্রশ্নপত্র ফাঁস কাণ্ডের  মধ্যমণি তাদের যেনতেনপ্রকারেণ জবরদস্ত শাস্তি হোক। আর যাই করুণ ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলবেন না দয়া করে। এবছরের প্রশ্নপত্রে যা সম্ভাব্য ছিল তা  ত এসেই গেল। পরীক্ষা দেওয়া হয়েই গেছে। আবার পরীক্ষা হলে ওরা পারবে ত?    
যুগশঙ্খ "রবিবারের বৈঠক"

কোন মন্তব্য নেই: