২৮ ফেব, ২০২০

সুলতার শাড়ি - বম্বে Duck বইমেলা সংখ্যায় প্রকাশিত

সুলতার এখন মধ্যবয়স। এমনিতে শারীরিক এবং মানসিকভাবে বেশ ফিট তিনি কিন্তু আগের মত তণ্বী নন আর। একসময় নিত্যনতুন শাড়িতে ক্লাবে গেলেই তাকে দেখে সবাই বলত ঐ যে এসে গেছে আমাদের হেড টার্নার। এখন ক্লাবে তিনি অনিয়মিত । আগের চেয়ে একটু পৃথুলা তাই শাড়ি বড় একটা পরা হয়না।


কিন্তু বাঙালীদের আড্ডায় শাড়ি মাস্ট। তখন শাড়ির আলমারীখানি খুলতেই হয়। আজকেই কিছু বন্ধুবান্ধব ক্লাবে ডেকেছে অতএব না গিয়ে উপায় নেই তাঁর ।

একসময় এই শাড়ি পরে সেজেগুজে ক্লাবে যাওয়া ছিল নেশার মত। সেই তাগিদটাও আর অনুভব করেন না সুলতা।

আলমারির দিকে এগিয়ে যান। পঙ্খের কাজ করা, মেহগিনি পালিশের কেতাদুরস্ত কাঠের আলমারীতে শাড়ী সম্ভার বন্দী হয়ে পড়েই থাকে। সুলতার মনখারাপ হয় ঐ শাড়ির আলমারীটির দিকে চোখ পড়লেই। এমনিতে আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড। আলমারী খুললেই শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা খুচরো গল্পের স্মৃতিরা বেরিয়ে আসে শাড়ির পরত খুলে। সুলতার মনখারাপ সজোরে যেন আছড়ে পড়ে বার্মাটিকের পাল্লায়, ড্রয়ারে এমন কি দামী শাড়ি ঝোলানোর রডের ওপরে। বাঁদিকের পাল্লার ওপরে আবার পেতলের ছোট্ট ছিটকিনি। সেটি খুলতে আঙুলের জোর লাগে এখন। সুলতা ভাবেন, কি যে হবে এত শাড়ি তাঁর! মনের ভেতর থেকে কে যেন বলে ওঠে...

"কি আবার হবে? তুমি কেটে পড়লে শাড়িরাও ঠিক নিজেদের জায়গা করে নেবে, তাদের ভাবনা তারাই ভাববে, তুমি তখন বিন্দাস, সুখস্বপনের পারে, শ্মশানের ধারে"


সুলতা ভাবেন, যাক্‌ গে! সত্যি‌ই তো একসময় প্রয়োজন ছিল, নেশা ছিল শাড়ি কেনার। এখন আর নেই। তিনি চলে গেলে তো আর কেউ ভাববে না এই শাড়িগুলোর অবস্থা। যা হবার হবেখন। ছিটকিনি টা খুলেছেন। হাতে অল্প চোট পেলেন। আঙুলটা লাল হয়ে গেল। একটু জিভ দিয়ে চেপে ধরে র‌ইলেন কয়েক সেকেন্ড। মনে পড়ে গেল তমালের কথা। একসময় হাত কেটে গেলে তমাল এভাবেই নিজের ঠোঁটের মধ্যে পুরে নিত সুলতার নরম আঙুল। তমাল প্রসঙ্গ মাথায় এলেই মনে পড়ে কতকিছু ।


আলমারীর বাঁদিকের পাল্লা খুলতেই তমালের স্মৃতি সব। প্যান্ডোরার বাক্স যেন। চেপে রাখা যায়না তাদের। শাড়ি ঠাসাঠাসি । আলমারীর চাপে বশীভূত ছিল। চাপ মুক্ত হতেই একের পর এক পড়ে গেল মেঝের ওপর। শাড়ি, শাড়ি আর শাড়ি। সব তমালের দেওয়া। কোনোটা বিয়ের প্রথম বছরে। পিচ রঙের বালুচরী। আঁচলে পাড়ে মীনাকারীর কাজ। রাধাকৃষ্ণের গল্প। ঠিক সুলতা আর তমালের প্রেমের মতোই । একসময় মুক্তোর সেটের সঙ্গে খুব পরেছেন সুলতা। এখন বালুচরী অবসোলিট। ভাল্লাগেনা পরতে। তমাল সেবার বিষ্ণুপুর থেকে কিনে এনে চমকে দিয়েছিল। ক্লাবের রবীন্দ্রজয়ন্তীতে পরে গান গেয়েছিল সুলতা।


এবার চোখ পড়ে গেল প্রুশিয়ান ব্লু রঙের সিল্ক শিফনের দিকে। পিঁজে গেছে শাড়িখানা। মখমলি জমিন থেকে রেশমের পাড়খানি আলাদা হয়ে আসছে। ঠিক যেন এটাই চেয়েছিলেন সুলতা। এই শাড়ির প্রতি তাঁর কোনো দুর্বলতা অবশিষ্ট নেই। নিউমার্কেট গিয়ে সেবার বিয়ের তারিখে পছন্দ করেছিলেন ।

স্লিভলেস ব্লাউজের সঙ্গে অমন সি থ্রু শাড়ি পরে ক্লাবে যাবে তুমি? তমাল বলেছিল।

সুলতা বলেছিল, কেন আপত্তি আছে বুঝি?

তা আছে, আমার ব‌উয়ের শরীরের ভাঁজ, খাঁজ অন্য পুরুষ দেখুক আমি চাইনা।

তা মশাই? আপনি যখন বন্ধুর স্ত্রীয়ের চুলকাটার প্রশংসা করেন? সেটা বুঝি আমার খুব ভালো লাগে? এমন সব উত্তপ্ত বচসার পর ব্লেড দিয়ে সেই সিল্ক শিফনের কিছুটা চিরে ফেলেছিল সুলতা। ছিঁড়ুক শাড়ি। মরুক গে।

খুব শখ করে কেনা শাড়িখানা আর অঙ্গে তোলেনি সুলতা। পায়ের কাছে একটা শাড়ি অনেকক্ষণ পায়ের পাতা ছুঁয়েই চলেছে। হাতে তুলে নিল সুলতা তাকে। বাবা দিয়েছিলেন কলেজে পড়াকালীন তার জন্মদিনে। বাংলাদেশী ঢাকাই। হালকা গোলাপী রঙের ওপর ঘন গোলাপীর কাজ। মধ্যে মধ্যে রূপোলী জরির বুটি। এই শাড়িটার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তমালের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার মূহুর্ত। দুইবাড়ির মধ্যে গ্রিন সিগনালের পরে ছাদে উঠে জীবনের প্রথম পুরুষের হাতের ছোঁয়া, চুমুর স্মৃতি। সেদিন রোমকূপের শিহরণ টের পেয়েছিল একমাত্র এই গোলপী ঢাকাইখানি। তমাল কেমন বদলে গেল তাইনা সুলতা? শাড়ি যেন তাকে প্রশ্ন করল। সুলতা বলল তাকে, এমনি হয় গোলাপী। সময় বদলে দেয় কতকিছু। এই যেমন তোকেও আমি কত্তখানি ভালোবেসেছিলাম আমার কলেজ জীবনে। তুইও তো একদিন নিজে থেকেই ঐ জরির বুটি থেকেই ফাটতে শুরু করলি। সুতো সরে সরে আমাকে কত কষ্ট দিয়েছিলি। সবাই এমনি হয় সংসারে। তোর কাজ সেদিন শেষ হয়ে গেছিল রে গোলাপী। সেদিন বিকেলের কনে দেখা আলোয় তোকে জড়িয়েছিলাম বলেই নাকি আমায় ওরা পছন্দ করেছিল। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা পাত্রীর জন্য কনে দেখা আলোয় গোলাপী রং নাকি উত্কৃষ্ট রে। মা বলেছিল। আমায় নিয়ে কত চিন্তা ছিল মায়ের! গায়ের রং কেন আরেকটু উজ্জ্বল হলনা মেয়ের। তা তুই আমায় উতরে দিয়েছিলি সেদিন, গোলাপী। তবুও তমালের সঙ্গে ঠিক জমল না আমার।


এবার চোখ গেল হ্যাঙারে ঝোলানো ইঁট রঙা মাইশোর জর্জেটের দিকে। সোনালী সুতোর পার্শি কাজ করা। জমিনে ঝকমকে চুমকী যেন আজো জ্ব্বলছে চিকমিক করে। এই শাড়িখানি পরে বিয়ের পরে নেমন্তন্ন খেতে গেছিল কটকটে রোদ্দুরে। তমালের সঙ্গে জোড়ে, মাসীর বাড়ি। ঘরে ঢোকা মাত্তর মাসীর মেয়েরা খুব হেসে উঠেছিল। তুই এই রোদে এমন ঝকমকে শাড়ি পরে এলি কি করে কলকত্তাওয়ালি? বারাকপুরে অবিশ্যি চলে এ সব। তবে তোদের ওখানে ভরদুপুরে এই শাড়িখানা পরলে সবাই আওয়াজ দেবে কিন্তু।

মাসীর ছোট মেয়ে ফিক করে হেসে বলেই ফেলল, "মেটিয়াবুরুজ"। জ্বলছিস পুরো। সোনার গয়না আর সোনালী জরি, সেই সঙ্গে চুমকি।

মেটিয়াবুরুজ? সে তো মুসলমানদের পাড়া। তমাল বলেছিল।

তাই তো বলছি মশাই। আপনারা খাস দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা হয়ে...

মাসি বলেছিল, আরে ওদের ঢুকতে তো দে আগে। শাড়ি প্রসঙ্গ ধামা দিয়ে চাপা পড়ে গেছিল।সেদিনের পর আর পরা হয়নি শাড়িখানা। শাড়ির আবার পাড়া হয়? জাতপাঁত হয় বুঝি?

এরপর কত শীত, বসন্ত পেরিয়ে এসেছে সুলতা-তমালের জীবন। শাড়ি জমা হয়েছে আলমারীর অন্দরে। উপলক্ষ্য পয়লা বোশেখ, পুজো, জন্মদিন, বিয়ের তারিখ। যেমন হয় সব মেয়েদের জীবনে। হাইফাই কর্পোরেট স্বামীর জীবনসঙ্গিনী সুলতা ক্লাব কালচারে অভ্যস্ত হয়েছে। শাড়ি কিনতে হয়েছে আরো আরো। বন্ধুদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। ব্যোমকাই থেকে গাদোয়াল, ধর্মাভরম্‌ থেকে কলাক্ষেত্র কতরকমের শাড়িরা এসেছে জীবনে তার। ঠিক যেন মানুষের জীবনে কতরকমের, কত স্বভাবের মানুষের আনাগোনা হতেই থাকে সারাটা জীবন ধরে।

তবু এত সুখের জীবনে সুলতার মা হওয়া হয়ে ওঠেনি। শাড়ি জানে সেই দুঃখ। শাড়ি সাক্ষী আছে সব ঘটনার। প্রথমবার পেটে এসেছিল মেয়ে।

"সেক্স ডিটারমিনেশন ইজ নট ডান হিয়ার" লেখাটাকে এড়িয়েছিল তমাল। একবার নয় দুবার। দুবার‌ই মেয়ে ছিল যে। তাই ফেলে দিল তমাল। অমন সব নার্সিংহোমে লেখা থাকে। চুপ করে থাকো, বলেছিল তমাল। ডাক্তারবাবুরাও জেনেবুঝেই ফেলে দেন। কিন্তু ...সুলতার মুখটা চাপা দিয়েছিল তমাল। চল। আজ বেরিয়ে আমরা ক্লাবে গিয়ে খাব আর তোমায় সেই কি যেন বলছিলে? কোন্‌ শাড়িটার কথা? তোমার সেই ফেবারিট শাড়িটা?অনুসন্ধানে  রাখী পরেছিল যেটা? স্কার্ট পাড় পিওর সিল্ক তাই তো? মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল সুলতা। খুব দুর্বল ছিল শরীর। প্রচুর রক্তপাত হয়েছিল দুমাসের বাচ্ছাটাকে ফেলতে। শরীরের কষ্টের চেয়েও প্রবল ছিল মনের কষ্ট, না পাওয়ার খেদ, তমালের ওপর ঘেন্না। নিকুচি করেছে অনুসন্ধানের শাড়ির।

সুলতার মায়ের ওপরেও ছিল প্রচ্ছন্ন অভিমান। কলেজের কেমিষ্ট্রি প্র্যাকটিকাল ক্লাসগুলোয় মায়ের ভালো ভালো তাঁতের শাড়িগুলো এক একদিন একএকটা পাট ভেঙে পরে যেত আর এসিডের ফোঁটায় ফুটো করে বাড়ি ফিরত। কপালে জুটত মায়ের বকুনি। এতকিছুর পরেও বিয়ের পরদিন চলে আসার সময় মায়ের পুরনো একটা সাধারণ শাড়ি বাক্সের মধ্যে ভরে নিয়েছিল সুলতা। সেটা ছিল মায়ের আর তার বৃষ্টিশাড়ি। অক্ষয় অব্যয়। বড়বাজারের সিন্থেটিক কোটা শাড়ি। কি অপূর্ব প্রিন্ট শাড়িটার। সুলতার আলমারীর সবচেয়ে সস্তার শাড়ি ছিল সেটা। পরীক্ষার দিন পরত। খুব পয়া ছিল তার। কি আর হল তাকে বয়ে শ্বশুরবাড়ি এনে? নতুন ব‌উয়ের উচ্চশিক্ষা, চাকরীর মুখে নুড়ো জ্বেলে দিয়ে শাশুড়ি ঠাকরুণ কিছুদিনের মধ্যেই গত হলেন।

এরপরে আরো একটা মেয়ের মুখ দেখা হলনা ঠিক আগের মতোই। সেই দুঃখ ঘোচাতে আরেকটা শাড়ি, দুটো শাড়ি, হঠাত শাড়ি, কারণে, অকারণে আরো শাড়ির আগমন হল বটে কিন্তু জীবনে আর মা হওয়া হলনা সুলতার।

কেমন বদলে গেছিল তমাল ঠিক সেই কথা জানার পরেই। আলমারীর ডানদিকের তাকে ন্যাপথলিন বল রেখেছিল সুলতা। পাতলা ন্যাকড়ার পুঁটলিতে ভরে। ও মা! কেমন দাগ লেগে গেছে শাড়ির ভাঁজে। কি শাড়ি এটা? ওহ্! সেই লাল পাড় গরদ। সুলতার মা দিয়েছিলেন সেবার পুজোয়। বলেছিলেন আমি থাকব কিনা তাই এটা রাখ। বাচ্চা পেটে সাধ দেবার দিন, লক্ষ্মীপুজোর ভোগ রাঁধার দিন এমন সব শাড়ি নাকি পরতে হয়। আর পরা হয়নি সেই শাড়ি। সাদা শাড়ি জুড়ে ন্যাপথলিন কলঙ্কের দাগ। মনখারাপ হল সুলতার। শাড়িখানা খুলতেই একটা লালচে হয়ে যাওয়া কাগজের টুকরো পড়ে গেল টুক করে । পাখার হাওয়ায় উড়ে পালাচ্ছিল চিরকূটটা। সুলতার পায়ের জোর কমে গেছে। তবু ছুটে গিয়ে ধরে আনল হাতের মুঠোয়। কাগজের ভাঁজে ভাঁজে কত কথা। তমালের অফিসের সহকর্মী লগ্নজিতার চিঠি। সেই প্রেমপত্র আমূল বদলে দিয়েছিল সুলতার জীবনটাকে। তমাল কে আর ধরে রাখতে পারেনি সে। সংসারের অজস্র টানাপোড়েনের মধ্যেও টিকে থাকা সম্পর্কের সুতোটা টুক করে একদিন ছিঁড়ে ফেলেছিল সুলতা। গাছেরো খাব, তলারো কুড়োব করে আমার সঙ্গে থাকতে পারবে না তুমি। চলে যাও আমার কাছ থেকে।

তমাল বলেছিল, তাই যাব। একটা ছেলের জন্য যা করতে হয় তাই করব। গাড়িবাড়ি, ক্লাব মেম্বারশিপ সবকিছু থাক তোমার নামে। তবুও যা পড়ে থাকবে তা আমার ছেলের। লগ্নজিতা আমায় ছেলে তো দিল। তুমি আর পারলে ক‌ই ?

নিজের মনেই দু-হাত বাজিয়ে তালি দিয়ে সুলতা বলে উঠল

"সাবাস্! সাবাস্! গরদের শাড়ি, এইজন্যেই তোমার গায়ে বুঝি এত কলঙ্ক "


শাড়ি ঘাঁটতে ঘাঁটতে বেলা বাড়ল সেদিন। হঠাত কলিংবেল। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন সুলতা। সুদর্শন এক যুবক দাঁড়িয়ে। হাতে একটি চিঠি।

কে আপনি? আমার নাম প্রত্যয়। বাবা চলে গেলেন। মা আগেই চলে গেছেন। বাকীটা চিঠিতেই লেখা আছে। এটা আপনার জন্য, বলে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিল সে সুলতার দিকে।


সুলতা কিছুই বুঝতে পারলেন না। চিঠিখানি হাতে নিয়ে তিনি চমকে উঠলেন । তমালের হাতের লেখা। ছেলেকে দিয়ে গেছে সুলতার জন্য? একটা মধুবনী শাড়ি । যেটা খুব পছন্দ ছিল সুলতার একসময়। কেনা হয়ে ওঠেনি নানা কারণে।

প্রত্যয় বলল, আন্টি হ্যাপি বার্থ ডে।

ওহ! দ্যাট রিমাইন্ডস মি। সুলতা বলে উঠলেন । ভাবলেন, তাই বুঝি আজ ক্লাবে বন্ধুরা ডেকেছে তাকে। সারপ্রাইজ পার্টি তে তমালের দেওয়া জন্মদিনের সেই মধুবনী শাড়িখানাই পরেই তবে বন্ধুদের সারপ্রাইজ দেবেন তিনি ।


২১ ফেব, ২০২০

আমার ভাষা

আমার ভাষাতেই দিদা বলতেন, খুব "তার" হয়েছে আজ আমার রাঁধা আলুর দমে। সেই শুনে মা বলতেন "বাসি" বলে "মজেছে" আরো। ঠাম্মা আমার চিবুক ছুঁয়ে বলতেন, "আমার এক ভুবন আকাশ"। ভাইকে বলতেন "আমার শিব্রাত্তিরের সলতে"। বুড়ো বাবা সেই শুনে দুই ভাই বোনের মাথায় দুটো হাত রেখে বলতেন, এরা "আমার এক‌ বৃন্তে দুটি কুসুম"।রান্নাঘর থেকে প্রায়শ‌ই মুখ বাড়িয়ে ফোন ধরে মা এখনো বলেন "নাটাঝামটা" খাচ্ছি। বাবা টিভিতে খবর শুনতে শুনতে চেঁচিয়ে আজো বলেন "উচিত তর্পণে গাঙ শুকলো" উন্নতি আর হল না রাজ্যের। মা বিয়ের পর আমার নতুন সংসার দেখে বলেছিলেন" কি সুন্দর "ঘরুনি-গেরুনি" হয়েছিস!   
সেই ভাষায় জ্বর আসে "তাড়সে" আর কাঁচালংকা আজও কামড়ে খাই প্রতিটি "গরাসে"।আজও সেই ভাষায় কাজের পরে লাগে একটু "জিরেন"। আজও হাতড়ে এই যে ভাষায় খুঁজি আমার "দোসর"। আজও মিস্ত্রীর পারিশ্রমিক দিই "ফুরোনে"।এই ভাষায় মা এখনও সামলায় "ভাঁড়ার"। এই ভাষাতেই বাবা লেখাপড়ায় ফাঁকি দিলে এখনও বলেন বলে "ব্যাদড়া"। অশীতিপর শাশুড়ি মা এখনও বলেন দিনভর "ব্যারাম" এর কথা।
আবার ঘুম এলে এই ভাষায় চোখের "পাতা ভারি" হয়ে আসে আবার সারারাত জেগে থেকে দুচোখের "পাতা এক" করা যায় না যে ভাষায়। এই ভাষাতেই বহুদিন আড়ির পর দুই বন্ধু আবার "আমে-দুধে" মিশে যায়। বড় ঘরে মেয়ের বিয়ে দিয়ে যে ভাষায় মেয়ের মায়ের "পায়াভারি" হয়। সেই মিষ্টি ভাষাতেই আবার বন্ধু বন্ধুকে তেড়ে যান "ষাঁড়ের নাদ" বলে। বিষহীন সাপ এই ভাষায় "ঢ্যামনা"। বেকার পুত্রকে বাবা রেগে গিয়ে বলে ওঠেন "ঢেঁড়স"। শাশুড়িকে ব‌উ ঝগড়ার সময় বলেন তাঁর "শাঁখের করাতের" মত অবস্থার কথা অথবা বলে ওঠেন মা কি "মুখে মধু" দেয় নি গা? শাশুড়ি আরও বলেন বৌয়ের মুখে "কুলুপ আঁটার" কথা। সেই শুনে শ্বশুর বলেন নিজের "উভয়সংকটের" কথা। ট্রেন যাত্রায় "ভোগান্তির" কথা বলে সেই ভাষা, অথচ সেই ট্রেনে চড়ার জন্য "হত্যে" দিয়ে থাকে কত মানুষ। মা সংসারে দেন "গতর" আর "আলটপকা" কিছু বলে ফেলেই বিপদ বাড়ান তিনি। মা বলেন সারাদিন পিঠটা "দোমড়" করতে পারিনি। এই ভাষাতেই কেউ তাঁর কাজের "কদর" করে না বলে অভিযোগ জানান তিনি। "আগুপিছু" কিছু না ভেবেই এ ভাষায় মন্তব্য করি আমরা।
সেই ভাষা হল আমাদের মিষ্টি মাতৃভাষা। আমাদের বাংলাভাষা।
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়