আজ দেখে এলাম খড়গপুর থেকে বেরিয়ে একটা ছোট্ট গ্রাম কাশীজোড়ায় মকর সংক্রান্তির মেলা । খড়গপুর আইআইটি ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে প্রেমবাজারের পরই সালুয়া । সেখানে এয়ারফোর্সের বেস । ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলসের হেড কোয়ার্টার এই সালুয়া । সালুয়া ক্রস করে যখন ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে চললাম তখন বিকেল সাড়ে চারটে । সূর্য তখন পশ্চিম মেদিনীপুরের পশ্চিম আকাশের কোলে ঢলে পড়েছে । মাইলের পর মাইল ধরে চলল অনাবাদী জমিও । ফসল নেই কোনো ।লালমাটির রাস্তা খুব চওড়া নয় । প্রত্যন্ত গ্রাম । আবার কিছুটা ধানজমি । ফসল উঠে গেছে পোষের পরবে । গ্রামের লোককে জিগেস করে করে পৌঁছে গেলাম কাশীজোড়া আর বেশ অনেকটা ধানক্ষেতের এবড়োথেবড়ো জমির ওপর মহা ধূমধামে বসেছে এই মকর সংক্রান্তির মেলা কুঝলাঝেঠি গ্রামের নাম । মেলার একপাশে মহাপুরুষ-থান অর্থাত সব দেবদেবীর মূর্ত্তি পূজো হয়েছে । আর নবান্নে ওঠা সদ্যপ্রসূত ধানগাছের গোড়ায় শুকনো মাটিতে বসেছে মেলা । সাতদিন ধরে চলে এই মেলা । জমজমাট মেলা প্রাঙ্গণ । একদিকে হচ্ছে তরজা গান ।
অন্যদিকে খাবারদাবার । আর পাঁচমিশেলী হরেকরকম জিনিষপত্র বিক্রি হচ্ছে । আমি কিনলাম একটি ছোট্ট শিবলিঙ্গ । আর পাঁচটা মেলার মত লোহার সব জিনিষ, প্লাস্টিকের জিনিষ, খেলনা, বাসনকোসন তো আছেই । আর চোখে পড়ল দূর দূর গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে আসা সব মানুষ গুলো। কত আনন্দে ঘুরছে মেলায় । শীতের বিকেলে মা বাবার হাত ধরে কত কুচোরা বায়না ধরেছে এটাসেটা কেনার ।
ফেরার সময় দেখলাম গ্রামের মাটীর সব দোতলা বাড়ি । আর দেখলাম ধানের গোলা । ঢেঁকিও দেখলাম । কিন্তু খুব গরীব এই গ্রাম । ঠিক আর পাঁচটা বাংলার গ্রাম যেমন । বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া সর্বত্র একরকম গ্রাম । একধরণের মেলা । অনেকটা একই রকমের দেখতে মানুষগুলো ও । কেউ পায়ে হেঁটে মেলায় গেছে কেউ সাইকেলে ডাবল ক্যারি করে । কেউ আবার নতুন কাপড় ও পরেছে , কেউ বা একখানা নতুন চাদর । কোনো বাচ্চা মেয়ের মাথায় টুকটুকে লাল ফিতে আর তার মায়ের মাথায় একগাদা তেলমাখা সিঁথিতে টকটকে সিঁদুর । কিন্তু সূর্য ছিল একটাই ! পশ্চিম মেদিনীপুরের পশ্চিম আকাশে । একাই রঙ ছড়িয়ে চলেছে আপন মনে ....ঠিক যেমন ছড়ায় রোজ রোজ এই গ্রাম বাংলার আকাশে । মনে হল, এত দারিদ্রের মধ্যেও এদের মেলা বসে, এরা মকর সংক্রান্তি পালন করে ধূমধাম করে । সদ্য উঠেছে ধান তাদের ঘরে । কি জানি তাই বুঝি এত মজা তাদের !
গত ২৩শে ডিসেম্বর ২০১০, তারা নিউজ চ্যানেলে "আজকের সুবর্ণলতা" অনুষ্ঠানের অতিথি হয়ে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম সাধারণ হোমমেকার হয়ে "সোশ্যাল নেট ওয়ার্কিং" নিয়ে আলোচনা করার জন্য :
সোশ্যাল নেট ওয়ার্কিং বা সামাজিক জটাজাল নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই উদ্ধৃতি "কত অজানারে জানাইলে তুমি কতঘরে দিলে ঠাঁই, দূরকে করিলে নিকট বন্ধু পরকে করিলে ভাই" আমরা আজ অনেক যান্ত্রিক অনেক বেশি আধুনিকতার স্বীকার হয়েছি । আমরা আজ হারিয়েছি যৌথ পরিবার । পরিবার পরিকল্পনার স্বার্থে আমরা আজ একটি কিম্বা দুটির প্রতিপালনে রত । অণু পরিবারের সদস্য হয়ে আজ আমরা বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছি কেরিয়ার, চাকরী আর প্রতিদিনের ইঁদুর দৌড়ে । ভুলতে বসেছিলাম বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে শীতের রোদে দুটি পাশের বাড়িতে ঘন্টার পর ঘন্টা উলবোনার আড্ডা, লুডো খেলা ; ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম ক্যারামের স্ট্রাইকার, ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম মেয়েদের বিন্তিখেলার তাসগুলোকে । ঠিক তখনই ঝোড়ো হাওয়ার মত যন্ত্রজালে পেয়েছিলাম ছোট ছোট আড্ডার ঠেক, সেই হারিয়ে যাওয়া ঘোষবাড়ি, বোস বাড়ির সান্ধ্য আড্ডা, সেই ফিরে পাওয়া পুরোণো বন্ধুত্ব ।
রবীন্দ্রনাথ সেই কবে বলেছিলেন " তুমি মোর পাও নাই পাও নাই পরিচয় " । কিন্তু পরিচয় বোধ হয় মানুষের বন্ধুত্বে কোনো বাধা নয় আর । বিশ্ব জোড়া যন্ত্রজালের ফাঁদে স্থান কাল পাত্র ভেদে মানুষ পরিচয় পায়নি অনেকের কিন্তু অপরিচিতকে বন্ধু করে অনেক ভাল সময় পেয়েছে । একটু চোখ কান খোলা রাখতে হবে । একটু যাচাই করে নিতে হবে সেই বন্ধুত্বকে আর মাঝে মধ্যে ঝালিয়ে নিতে হবে । সব কিছুরই যেমন পজিটিভ ও নেগেটিভ দিক আছে তেমনি সোশ্যালনেট ওয়ার্কিং এর মাধ্যমে বন্ধুত্ব করতে গেলে একটু সংযত হতে হবে আর সময়টি একটু মেপে দিতে হবে নয়ত বিপদ হতে পারে । সমাজে যেমন খারাপ বা ভালো দুরকমই আছে , খারাপ ভালো বন্ধু নির্বাচনও যেমন কিছুটা নিজের ওপর নির্ভর করে ডিজিটাল আড্ডার এই ঠেকেও সেই সম্ভাবনা থেকে যায় । প্রথমে আলোচনা করি সোশ্যাল নেট ওয়ার্কিং এর ভাল দিক গুলি ।
সারাদিনের ব্যস্ততায় সোশ্যাল নেট ওয়ার্ক মানুষকে দিতে পারে কিছু ভাল সময়। যে বোর্ড হোমমেকারটি দিনের পরদিন সংসারের টানাপোড়েনে নিজের আইডেন্টিটি হারিয়ে ফেলেন তার কাছে এর জুড়ি আর কিছু নেই। ছেলে মেয়ে বিদেশে বাস করছে যে বাবা মায়ের তাদের কাছে সোশ্যাল নেট ওয়ার্ক মরুভূমিতে ওয়েসিসের মত । হঠাত সংসারের সব কর্তব্য শেষ হয়েছে মনে হলে, মধ্য বয়সে সোশ্যাল নেট ওয়ার্কিং এর যজ্ঞে সামিল হ'লে এর থেকে ভাল আর কিছুই নেই । সর্বোপরি যে স্কুলের বা কলেজের বন্ধুটিকে এতদিনে চেয়েও পাইনি তার দেখা মিলে গেলে তার চাইতে ভালো কিছুও বুঝি আর হয়না । আবার মনে পড়ে যায় কবিগুরুর সেই গান " কাছে থেকে দূর রচিল " ছোটবেলা থেকে আমরা শিখেছিলাম "Birds of a same feather flock together" এই সোশ্যাল নেটের দুনিয়ায় এমন সমমনস্ক বন্ধু খুঁজে পাওয়া বোধ হয় আজকের দিনে অত্যন্ত সহজ হয়ে গেছে । আগে যে ভৌগোলিক বাধা ছিল আজ আন্তর্জালের কৃপায় তা আর বাধা নয় ।
অত্যন্ত কম খরচে ( কেবল সুস্থিত ইন্টারনেট কানেকশন এবং একটি কম্পিউটার যা বোধ করি টেলিভিশনের মত ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে আজকাল ) সোশ্যালনেটে বন্ধুবান্ধবের আড্ডায় নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করা ও অনেক কিছু শেখা যায় । নিজের ভালোলাগা অনেক জিনিষপত্র ( বই বা সিডি , ডিভিডি , অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ পত্র ) প্রোমোশানের মাধ্যমে অনেকের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় বিনাপয়সায় । সোশ্যাল নেটের বন্ধুর কমিউনিটি থেকে বন্ধু সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য উঠে আসতে পারে যা জানলে সেই বন্ধু সম্পর্কে মানুষ সচেতন হতে পারে ।
তবে সোশ্যাল নেট ওয়ার্কিং এর নেগেটিভ দিক ও আছে । স্টুডেন্ট যখন সোশ্যাল নেটের দুনিয়ায় হাজির হচ্বে তখন তার ব্যাবহার সম্পর্কে মা বাবাকেই সচেতন করে দিতে হবে । পারলে টিন এজ ছেলে বা মেয়েটির বন্ধু হয়ে যেতে হবে সোশ্যালনেটের সেই আড্ডার ঠেকে । তাহলে সে কার সঙ্গে বন্ধু পাতাচ্ছে বা সে কোন কমিউনিটির মেম্বার হচ্ছে সেটাও খেয়াল রাখতে হবে তাহলে বা মায়ের সাথে ছেলে মেয়ের তদানীন্তন জেনারেশন গ্যাপ ও হবে না আর উভয়ের বন্ধুতাতে স্বচ্ছতাও আসবে । তাকে শিখিয়ে দিতে হবে অনিয়ন্ত্রিত ব্যাবহার করলে তার পড়াশোনার ক্ষতি হতে পারে । অচেনা বন্ধুত্ব থেকে তার ভবিষ্যতে কি ক্ষতি হতে পারে । সবচেয়ে বড় সমস্যা হল privacy violation আর তারপরের সমস্যা হল false impersonation এবং identity theft । নিজের ছবি না দিয়ে অন্য কিছুর ছবি যখন প্রোফাইল পিকচার হিসেবে লাগায় তখন যাচাই করে নিতে হবে তার অন্য বন্ধু মারফত এবং সে কোন কোন কমিউনিটির মেম্বার তা দেখে ।
আর সবশেষে বলি, রেসিডেনশিয়াল এড্রেশ আর টেলিফোন নাম্বার সোশ্যাল নেট ওয়ার্কিং সাইটে না দেওয়াই বাঞ্ছনীয় ।
কর্ণ তোমাকে, আজ আমরা মহাপ্রস্থানের পথে পা বাড়িয়ে, হিমালয়ের কত নাম না জানা হিমবাহ, পেরিয়ে পঞ্চকেদার অভিমুখে পাড়ি দিলাম পারিজাতের দেশে, পাখিদের স্বর্গরাজ্যে..তুমি হয়ত পুনর্জন্ম নিয়ে আবার আসবে এ পথে, তাই পাহাড়ের গায়ে লিখে রেখে গেলাম এই স্বগতোক্তি ; আমার ইহকাল পরকাল সবই কালের স্রোতে ভেসে চলে গেছে জম্বুদ্বীপের জ্বালাময়ী আগুণে, আমার অভিশপ্ত জীবনের শেষ ইচ্ছের তাগিদে এই চিঠি তোমাকে লেখা । শেষ হতে হতে তবুও এখনও শেষ হলাম না | এইবার বোধ হয় আমার মোক্ষলাভ হবে তাই সেই মুক্তিপ্রদেশে পৌঁছনোর অপেক্ষায় রয়েছি | স্বর্গরাজ্যের আঙিনায় এ চিঠি লিখে রেখে গেলাম পাহাড়ের গায়ে, প্রযত্নে হিমালয়, এই ঠিকানায় । এই ঠিকানায় কোনোও এক সময়ে জোনাকগুচ্ছ আলো দেখিয়ে আর আমার গন্ধবাতাস পথ চিনিয়ে নিয়ে আসবে এখানে; এই পাথরে খোদাই করে রেখে গেলাম আখরগুলি, আমার চিহ্ননাম, শুধু তোমার জন্য | এই চিঠিতে আমি প্রায়শ্চিত্ত করে যাবো স্বয়ংবরা হয়ে যে অপমান একদিন তোমায় করেছিলাম, সেই না বলা কাহিনী ; সারা জম্বুদ্বীপের মানুষেরাও জেনে যাবে সেই সব না বলা কথা । পাঞ্চালদেশে আমার জন্ম কিনা জানিনা তবে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ, তাঁর কন্যার পরিচয়ে | যজ্ঞাগ্নিসম্ভূতা বানিয়ে ইন্দ্রজালের মোহে, ধোঁয়ার আড়ালে যজ্ঞের আগুণের মধ্যে থেকে আমাকে বেরিয়ে আসতে বলা হয়েছিল আর সাথে বেরিয়ে এসেছিল আমার দাদা ধৃষ্টদ্যুম্ন । জনসাধারণ জানত না এত সব । আমার নাম হল যাজ্ঞসেনী, আমি হলাম দ্রুপদরাজের অগ্নিকন্যা দ্রৌপদী, কৃষ্ণরূপা, কৃষ্ণকলি, আর সমগ্র জম্বুদ্বীপের কৃষ্ণা। যজ্ঞের অলৌকিক শক্তির মাহাত্ম্যে আমার গোধূমবর্ণ পুড়ে এই হাল হল, জানল সকলে, দেখল সকলে । আর পুড়েছিল আমার অদৃষ্ট। তুমি জানতে কর্ন যে রাজা দ্রুপদ আমাকে দত্তক নিয়েছিলেন ? এছিল রাজামশায়ের রাজনৈতিক চাল। ধনুর্ধর দ্রোণ আর পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কোঁদল অনেককালের | একসময়ে তারা ছিলেন হরিহর আত্মা । কিন্তু দ্রুপদ প্রতিপত্তিময় হয়ে ওঠার পর অভাবের তাড়নায় আশ্রয়প্রার্থী বাল্যবন্ধু দ্রোণকে সপরিবারে আশ্রয় দেননি সেই কারণে অপমানিত দ্রোণ আশ্রয় নিয়েছিলেন হস্তিনাপুরে, ধৃতরাষ্ট্রের রাজপ্রাসাদে । বুকে ছিল তাঁর একরাশ ক্ষত, চোখে ছিল প্রতিশোধের আগুণ । কৌরবদের অস্ত্রশিক্ষাগুরু দ্রোণ আক্রমণ করলেন পাঞ্চাল , বন্দী করলেন দ্রুপদকে । দ্রুপদ ও সেই রাগে দ্রোণকে বধ করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন । কুরু-পাঞ্চাল বিবাদ আজও মেটেনি কর্ণ এখনও ধিকি ধিকি জ্বলছে, জম্বুদ্বীপের অভ্যন্তরেও সেই আগুণের ফুলকি এসে লেগেছে। মহারাজ দ্রুপদ শুধুই দ্রোণের ওপরে প্রতিশোধ নিলেন না দ্রোণকে উপলক্ষ করে সমগ্র কুরুবংশের ওপরে প্রতিশোধ নিলেন। ক্ষুদ্র লক্ষ্য দ্রোণাচার্য বিশেষ লক্ষ্য হস্তিনাপুর। হস্তিনাপুরের কুরু-পান্ডবদের অন্তর্দ্বন্দ তো তুমি জানই । রাজনীতির এ জট খুলতে আমার সখা কৃষ্ণও পদে পদে ব্যর্থ হয়েছেন তাও তুমি জানো। আমার স্বয়ংবর সভা কেন হোল তাও তোমায় বলি শোনো। দ্রোণাচার্য যখন পাঞ্চাল আক্রমণ করলেন তখন দুর্যোধন আর তার ভাইদের, আর এমন কি তোমাকেও প্রতিহত করেছিলেন মহারাজ দ্রুপদ। কিন্তু আক্রমন করতে গিয়ে যে তরুণ বীর যোদ্ধার হাতে দ্রুপদ বন্দী হয়েছিলেন সেই তরুণটি দ্রুপদকে রাজোচিত মর্যাদার সঙ্গে সসম্মানে নিয়ে গেছিলেন দ্রোণের সামনে । দ্রুপদ মুগ্ধ হয়েছিলেন সম্বর্ধনায়। স্বপ্নের আবেশে আবিষ্ট হয়ে সেই তরুণটিকেই মনে মনে চেয়েছিলেন যে কিনা তাকে সাহায্য করতে পারবে যদি কুরু-পাঞ্চাল যুদ্ধ হয়। এই তরুণটিই ছিল অর্জুন যার জন্য আয়োজন হল স্বয়ংবর সভার । কৌরবরা কখনো পান্ডবদের পক্ষে যুদ্ধ করবে না আর কৌরবরাই দ্রুপদের শত্রু অতএব এই তরুণ পান্ডব অর্জুনকেই চাইলেন দ্রুপদ। এদিকে যখন দুর্যোধনের চক্রান্তে সারাদেশের মানুষ জানল যে অজ্ঞাতবাসের প্রথম পর্যায়ে একই গৃহের মধ্যে আগুণে পুড়ে ভস্মীভূত পঞ্চপান্ডব সহ কুন্তী | দ্রুপদ সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন এক মহান রাজনৈতিক চাল চেলে যার প্রথম পদক্ষেপই ছিল স্বয়ংবর সভা। আসলে দ্রুপদের নিকট খবর ছিল যে পান্ডবরা বারণাবতে পুড়ে মরেননি তাই শূন্য থেকে ঝোলানো মাছের চোখে লক্ষ্যভেদের মত কঠিন পরীক্ষার আয়োজন করলেন যা ঊত্তীর্ণ হবার যোগ্যতা একমাত্র অর্জুনেরই আছে। আর আমিই হলাম সেই তুরুপের তাস যে অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ভাবে অর্জুনের গলায় মাল্যদান করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। এও আমাকে শেখানো হয়েছিল। চার প্রোথিতযশা বীর ছিলেন স্বয়ংবর সভায় ,কর্ণ তুমি, দ্রোণপুত্র অশ্বথামা, যাদব কৃষ্ণ আর অর্জুন। প্রতিশোধী পিতা দ্রোণের পুত্র অশ্বত্থামা তার মাতুল কৃপাচর্যের মত চিরকৌমার্যব্রত পালন করছেন অতএব তিনি প্রতিযোগী নন |কৃষ্ণ নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন প্রতিযোগী হিসেবে নয় অতএব কর্ণ তুমি আর অর্জুন ছিলে সেদিনের দুই প্রধান প্রতিযোগী। দ্রুপদ পাখিপড়া করে আমাকে শিখিয়ে ছিলেন অর্জুনকে মাল্যদান করতেই হবে | আমার চোখের সামনে দুই পুরুষ; দুজনেই বীর, যোদ্ধা, সুন্দর পুরুষ ; তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা একটা ঝোড়োবাতাস আমাকে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল ...তোমাকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল এই পুরুষই আমার প্রথম প্রেম ! তোমার ডান মণিবন্ধে তখন শানিত তরবারি, বামহস্তে পাণিগ্রহণের অঙ্গীকার ! বিহ্বলা, চঞ্চলা নবযৌবনা কৃষ্ণা তখন ষোড়শী শ্রীময়ী | যজ্ঞাগ্নিসম্ভূতার চোখে তখন একরাশ কামনা, আমি চেয়েছিলাম শুধু তোমার কৃষ্ণা হতে । আমি লক্ষী মেয়ের মত তোমাকে সূতপুত্র বলে অভিহিত করলাম, গান্ডীব ধরতে নিরস্ত করলাম, সেও দ্রুপদের আদেশে। বিশ্বাস করো, অর্জুন কে চিনতাম না, ভলোওবাসিনি । যুগ যুগ ধরে জম্বুদ্বীপের ইতিহাস আমার মত কালো মেয়েকে এই ভাবেই কাজে লাগিয়ে আসছে, অবলা করে রেখে দিয়েছে। অর্জুনের অপলক দৃষ্টি ছিল মীনের অক্ষিগোলক আর আমার ছিলে তুমি । আমি ক্ষণেকের জন্যে তোমার বলিষ্ঠতা, পৌরুষে আকৃষ্ট হয়েও নিজেকে সংযত করেছিলাম অনেক কষ্টে। স্বামী সোহাগিনী , আদর্শ বধূ হতে চাইনি, ইতিহাস রচনা করতে চেয়েছিলাম, দেশ গড়তে চেয়েছিলাম, ইতিহাসের পাতায় পঞ্চকন্যার সাথে স্মরনীয়া ও বরনীয়া হতে চেয়েছিলাম ; তার জন্য যা করতে হয় সেই উচ্চাশার সিঁড়ি বেয়ে ওঠার আশায়..সেই স্বপ্নকে সার্থক রূপ দেবার আশায়। যদিও সাধারন পাতিব্রত্য আর ঘরগেরস্থালিও আমার মাথায় ছিল । তাই তোমাকে দূরে সরিয়ে দিলাম নিমেষেই । স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলাম , স্বপ্ন নিয়েই চলে এসেছি এই মহাপ্রস্থানের দুর্গম পথে। স্বপ্ন পূরণ হলনা । শুধু রূপেই তোমাদের ভোলাব না এ ছিল আমার অমোঘ মন্ত্র। নিছক যৌবনই আমার সম্বল নয়। তিল তিল করে নারীত্বের সবটুকু দিয়ে সর্বগুণান্বিতা, তিলোত্তমা করে পাঠিয়েছিলেন বিধাতা আমাকে । রূপে লক্ষী, গুণে সরস্বতী রন্ধনে পটিয়সী চলনে বলনে, চিন্তা শক্তির দূরদশিতায় আমি হয়ে উঠেছিলাম যুগশ্রেষ্ঠা। তোমাদের সেই কালো মেয়ে দ্রৌপদী যার নাম, নারী থেকে পূর্ণ মানবী হতে চেয়েছিল যে, তাই সেদিন স্বয়ংবরা হয়ে দ্রুপদের কথায় বাধ্য মেয়ের মত মালা পরিয়েছিলাম অর্জুনকে আর প্রত্যাখান করেছিলাম তোমায়, অঙ্গরাজ তোমাকে । ধৃষ্টদ্যুম্ন আর দ্রৌপদী এক সাথে যজ্ঞের আগুণ থেকে উঠে এসেছিল দ্রুপদের বাসনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে। ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণ বধের কারণে আর দ্রৌপদী অর্জুনের ঘরণী হয়ে পান্ডবপক্ষে থাকলে দ্রুপদেরই সুবিধে সেই কারণে। অর্জুনের মত বীরজামাইকে পাশে নিয়ে রাজা দ্রুপদ শক্তিবৃদ্ধি করতে চেয়েছিলেন। বিবাহ না করলে কুরুবংশের অন্দরমহলে প্রবেশ করে তথ্য সংগ্রহ করবে কে? আর আমার মত উপযুক্ত নারী যার চালনা শক্তি আছে তার ঠিকুর্জি-কুষ্ঠি সব বিচার করেই খুঁজে আনা হয়েছিল আমাকে । স্বয়ংবরসভা রচনা করল ইতিহাস আর সকলের অলক্ষ্যে ঘটে গেল কত কিছু। সেদিনটার কথা মনে পড়ে যায় ...পাঞ্চালনগরীর আকাশে বর্নালীর ছটা ! ফুলেল বাতাস সংপৃক্ত কেওড়া-কস্তুরী-আতরের গন্ধে, একনারীকে জয়ের জন্য কত পুরুষের আগমন | আমি তোমাদের সেই কালো মেয়ে পুতুলের মত মালা হাতে জীবনের সর্বপ্রথম রাজনীতির অচেনা, অদেখা সুপরিকল্পিত এক মঞ্চে হাজির ! আমার মত কালো মেয়ের এত দাম? আমাকে লাভ করার জন্য এত বড় বড় বীরেরা, রাজপুত্রেরা পরীক্ষা দেবেন? আমার অদম্য ইচ্ছা ছিল নারীত্বের পূর্ণতা পেতে সেটা বধূ বা মাতারূপে নয় সমগ্র জম্বুদ্বীপের ইতিহাসে মানবী রূপে প্রতিষ্ঠা পেতে।আদর্শ দেশ গড়ার ব্রতে ব্রতী হতে চেয়েছিলাম । সেই কারণেই রাজী হয়ে গেছিলাম স্বয়ংবর সভার প্রস্তাবে। আমার জীবন বাঁক নিল অন্যধারায়, জীবনধারা বইতে শুরু করল অন্যখাতে, জীবনদর্শন বদলে গেল নিমেষে। তোমাকে জাতপাঁত তুলে "সূতপুত্র" বলতে চাইনি আমি । বিশ্বাস করো। তুমিও পরিস্থিতি সামলে নিয়েছিলে যদিও তা তোমার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল ; তোমার বক্র হাসিতে সেদিন ঝরতে দেখেছিলাম প্রচ্ছন্ন ক্রোধাগ্নি, অপমানের নীরব অশ্রু ; সর্ব সমক্ষে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছিল তোমার বীরত্বের অহঙ্কার। সেই মূহুর্তে আমার মনে হয়েছিল পৃথীবিতে তোমাকেই আমি সবচেয়ে ভালোবাসি, সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি, আরো আরো ভালবাসি। কিন্তু রাজনীতির মারপ্যাঁচে তোমার সঙ্গসুখ থেকে চিরকালের মত বঞ্চিত হলাম।আর সেই সাথে জননী কুন্তীর আদেশে আমার পাঁচস্বামীর ব্যবস্থাটিও পাকাপাকি হয়ে দাঁড়াল। কৃষ্ণা হোল ভাগের স্ত্রীরত্ন । উত্কৃষ্ট ভোগ্যবস্তু, লোভনীয় বিলাসিতার দ্রব্য যেমন মিলেমিশে ভাগ করতে হয়... তেমন এক ভোগ্যপণ্যে পর্যবাসিত হল দ্রৌপদীর মেয়েবেলা । দ্রুপদ ব্যবহার করলেন আমায়, অর্জুনকে পাওয়া তো হয়েই গেছে এখন আরো চারজন কে বিনামূল্যে জামাই রূপে পাওয়া... সে তো তাঁরই দলের শক্তিবৃদ্ধি ঘটাবে আর স্বার্থসিদ্ধির ব্যাঘাত ঘটাবে না অতএব মোটেই উদ্বেগ প্রকাশ করলেন না আমার এমন বহুস্বামিনী হওয়ার ঘটনায় । ধৃষ্টদ্যুম্ন আপত্তি করেছিলেন বলেছিলেন খুব অধর্ম এটা..একপুরুষের অনেক স্ত্রী থাকে কিন্তু একনারীর অনেক স্বামী ? প্রবাদপুরুষ কৃষ্ণ দ্বৈপায়ণ বেদব্যস দিয়েছিলেন ধর্মের প্রতিবিধান বলেছিলেন এ নাকি আমার ভাগ্যলিপি ! মোটকথা তোমার কৃষ্ণা হোল রাজমহিষী, পঞ্চস্বামীর ভার্য্যা। এবার বলি আমার রাজ অন্তঃপুরের বেত্তান্ত। ইন্দ্রপ্রস্থের পাঁচকুমারের ভোগ্যবস্তু হলাম ঠিকই কিন্তু যাকে তুমি ভালবাসা বল সেই ভালোবাসার কড়িখেলা আমার কোনোদিনও খেলা হল না অঙ্গরাজ। স্বয়ংবরসভায় তোমাকে প্রত্যাখান করবার পরেই আমার রূপ, মন, যৌবন সব কিছুই ভেবেছিলাম সঁপে দেব অর্জুনকে মিথ্যে বলব না, তার বীরত্ব, ব্যাক্তিত্ত্বকেও মনে মনে সেলাম করেছিলাম ! যুধিষ্ঠিরের জ্ঞানবত্তাকে শ্রদ্ধা জানাই, কিন্তু পতিরূপে তাঁকে ভাবিনি কখনো, তিনিও আমাকে তাঁর ধর্মপথের সঙ্গিনী করেই রেখেছিলেন আজীবন। স্ত্রীর মর্যাদা দেননি তাই পাশাখেলায় পণ রাখতেও দ্বিধা করেন নি। ভীমসেন যদিও পাঞ্চাল যাবার পূর্বেই আরণ্যক কন্যা হিড়িম্বাকে গান্ধর্ব মতে বিবাহ করেছিলেন এবং ঘটোত্কচ নামে তাদের একটি পুত্র ও ছিল তবু এ বিবাহকে আমি মেনে নিয়েছিলাম কারণ আমি আসার আগেই তা অতীত । আর আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে আমাকে লাভ করার পর ভীমসেন পুনরায় বিবাহ করতেন না আর সেই কারণেই যত বার আমি বিপদে পড়েছি এই মধ্যম পান্ডবই একমাত্র আমাকে সাহারা যুগিয়ে গেছেন । ভীম আমাকে একটু উগ্র ভাবেই ভালোবেসেছিলেন আমি বহুবার হাতেনাতে সে প্রমাণ পেয়েছি । দুর্যোধনের অশালীন ইঙ্গিতে আমার সম্মানরক্ষা করার জন্য তার উরু ভঙ্গ করার প্রতিজ্ঞাও পালন করেছিলেন |পাশাখেলায় সর্বস্বান্ত হয়ে বনবাসে তখন আমি পঞ্চপান্ডবের সাথে, একদিন যুধিষ্ঠির ধর্মের অমোঘ বাণী শুনিয়ে আমাকে ঈশ্বর সম্পর্কে তাত্ত্বিক আলোচনা ব্যাখ্যা করতে বসলেন । ভীমসেন থাকতে না পেরে সেদিন বলেছিলেন "এত তত্ত্ব কথা তোমার কোথায় ছিল সেদিন যেদিন তুমি পাশা খেলতে বসেছিলে আর স্ত্রী সহ সবকিছু পণ রাখলে, আর আজ তোমার জন্য আমাদের রাজসুখ ছেড়ে বনে বাদাড়ে ঘুরতে হচ্ছে" দ্যূতসভায় সর্বস্ব খুইয়ে যুধিষ্ঠির যখন আমাকে পণ রাখলেন তখন আমি একবস্ত্রা, রজস্বলা ; লাজলজ্জা বিসর্জন দিয়ে আমাকে আসতে হল সেখানে, যেখানে একপাল নীতিবাগীশ, নপুংসকের দল বসে উপভোগ করছেন আমার লজ্জাডুবে যাওয়ার চরম মূহুর্ত, আমার লাঞ্ছনার প্রতিটি দন্ড, প্রতিটি পল। না কর্ণ না ভালোবাসা আঘাত দেয়, দেয় আরো নিবিড় করে কাছে পাওয়ার আকুতি। কাছে না পাওয়ার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয় কিন্তু অপমান করতে কি শেখায়? আমি তোমার জন্যে যে অপমানের আখরগুলো ছুঁড়েছিলাম তার কি হবে কর্ণ? আমিও তো রক্তমাংসের মানুষ ছিলাম, ছিলাম যৌবনসর্বস্ব একনারী । এখনও শুনি ইতিহাস রচনা করার কলমের শব্দ, দেখতে পাই সংগঠিকার বেশে, দেশনেত্রী রূপে কল্পনা করে যাই নিজেকে । তুমি ফিরিয়ে দিয়েছো সেই অপমানের কিছুটা ; রাজবধূ, রাজনন্দিনীর কি এই প্রাপ্য ছিল? চুলোয় গেল রাজেন্দ্রাণীর পদমর্যাদা, ঘুচে গেল স্বপ্ন, রসাতলে গেল তার ইজ্জত। পদ্মপলাশ অক্ষি, কুঞ্চিত দীর্ঘ কেশ, সর্বাঙ্গসুন্দরী তোমার না পাওয়া কৃষ্ণাকে নিয়ে জম্বুদীপের ইতিহাসে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মত টানা হেঁজড়া করা হল । সেই কালোমেয়েটার রূপের অহঙ্কার মাটিতে মিশে গেল । একদল অতি বৃদ্ধ, বৃদ্ধ, প্রৌঢ়, যুবক তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলেন আমার লাঞ্ছনার সে সব দৃশ্য | ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ, আর ভীষ্ম, বিদূর, দ্রোণেরা মনে প্রাণে ছিলেন চির-অন্ধ | চিনলাম যুধিষ্ঠিরকে আরো একবার| নারীচোখের চিরায়ত ইশারায় সাড়া দিলেন না অর্জুন । মনে মনে ধিক্কার দিলাম তাকে | ভীমসেন মূহুর্তের জন্যে বারে বারে মন ছুঁয়ে গেলেন | কৌরবদের অট্টহাসিতে দাসীরূপে বন্দী হল তোমাদের কৃষ্ণা আর তুমি নিলে প্রতিশোধ! স্খলিত আমার ঊর্ধাঙ্গের বসন, লজ্জারূপ ভূষণ, জলাঞ্জলি ততক্ষণে। একপাল লোলুপ লোভাতুর চোখ আমাকে গিলছে তখন | ক্লীবেদের বোধবুদ্ধি তখন ভেসে চলে গেছে নদীমাতৃক জম্বুদ্বীপের মোহানায়, গড্ডলিকা প্রবাহে, তুমিও তার ব্যাতিক্রম ছিলেনা | নতুন সমাজ গড়বে তোমরা? সেদিনই বুঝেছিলাম... নতুন দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যত্ গড়বে এই মানুষ গুলো? ধর্ম-অধর্ম, ইহকাল-পরকাল সবকিছুর বিসর্জন সেই মূহুর্তে। দুঃশাসন আমার কেশাকর্ষণ করে সকলের সম্মুখে নিয়ে এসে একে একে আমার বস্ত্র উন্মোচিত করতে শুরু করলেন ...সে তো তুমি ও দেখেছো তাই না? আর সেই স্বয়ংবরসভার প্রতিশোধ সেদিন তুমি নিলে কর্ণ? আমায় বেশ্যা-বারাঙ্গনা বলেছিলে কারণ আমি তো "নাথবতী অনাথবত্"| আমায় বেশ্যা বলে অভিহিত করতেও তোমার বাধ সাধলো না ? দুঃশাসনের ওপরে প্রতিশোধ নিয়েছিলেন মধ্যম পান্ডব ভীম । তার বুক চিরে রক্ত পান করবার প্রতিজ্ঞা পালন করেছিলেন।বিরাটের রাজসভায় আমরা যখন ছদ্মবেশে সেদিনও কীচকের লোভাতুর চোখ থেকে আমাকে বাঁচিয়েছিলেন ভীম | নকুল-সহদেব তো বড়দের ছত্রছায়ায় আজন্মকাল অতিবাহিত করলেন | কাব্যে উপেক্ষিতর মতই রয়ে গেলেন। অর্জুন হয়ত চেয়েছিল আমায় ভালোবাসতে একান্ত নিজের করে নিতে কিন্তু চার ভাইয়ের লোভ তো তিনি চাক্ষুষ দেখেছিলেন । সেই অভিমানে আমার প্রতি নীরব ঔদাসিন্য দেখিয়েছিলেন বরাবর।যুধিষ্ঠিরের সাথে অস্ত্রাগারে আমি সেদিন বক্ষলগ্না ; রতিক্রীড়ায় উন্মত্ত যুধিষ্ঠির সেদিন আমাকে নিয়ে মেতে রয়েছেন রাজপুরীর নিভৃতে, । নারদমুনির নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ধনুর্বান আনার অছিলায় অর্জুন প্রবেশ করলেন সেখানে ফলস্বরূপ নিয়মভঙ্গ হেতু বারোবছরের বনবাস আর ব্রহ্মচর্য যাপন সেই মূহুর্তে অর্জুনের পরম কাঙ্খিত ছিল যাতে রাজপুরী ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে তিনি যৌবনের স্বাদ গ্রহন করতে পারেন | যৌবনের উন্মাদনায় বহুস্বামিনী কৃষ্ণাকে সেদিন ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেছিলেন রাজপুরী ছেড়ে বহুদূরে | পাঞ্চালীর একেশ্বরাধিপতি না হতে পারার ক্রোধে আর কামাগ্নি নির্বাপনের জন্য একে একে নাগরাজ কন্যা উলুপী, মণিপুরের রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা আর সব শেষে দ্বারকায় কৃষ্ণের ভগিনী সুভদ্রাকে বিবাহ করে আমার প্রাসাদে এনেই তুললেন। পরে জানলাম উলুপীকে তিনি দিয়েছেন ইরাবান নামে এক সন্তান, চিত্রাঙ্গদার শরীর চিনে তাকে গোপনে দিয়েছেন বভ্রূবাহনকে আর আমার সামনেইতো সুভদ্রার কোলে এল অভিমন্যু। তিন নারীর উদ্দাম শরীরী ঝঞ্ঝায় উড়ে গেছিল অর্জুনের প্রতিজ্ঞা । এর পরেও তুমি বলবে অর্জুন কে আমি ভালবাসি? যুদ্ধ থেমে গেছে কর্ণ। অভিমন্যুর পুত্র পরীক্ষিত হয়েছে জম্বুদ্বীপের রাজা | আমি আমার পাঁচস্বামীর অনুগামিনী হয়ে যাত্রা করলাম মহাপ্রস্থানের পথে, আবার আদর্শ স্ত্রীলোকের মত জীবনের শেষ বেলাতেও তাঁদের সঙ্গীনী হলাম, আবার শেষ চেষ্টা করে দেখি নারী থেকে মানবী, তারপর মানবী থেকে ইতিহাস গড়তে পারি কিনা, এ হোল যুক্তিহীন স্বামীর সঙ্গে অনুগমন । আমার চারিপাশের স্বপ্নের বর্নালীরা, ব্যথার ঝরাপাতারা না বলা বর্ণমালারা টুপটাপ ঝরে পড়ে গেল | আমার জন্য বেঁচে থাকার প্রহরগুলো আর অবশিষ্ট নেই । জীবনটাকে নিজের মত করে পেলাম না । শেষের সেদিন সত্যি ভয়ংকর ! আজ আমার রূপ-যৌবন বয়সের ভারে কুব্জ এবং ন্যুব্জ। চলেছি নিরুদ্দেশের পথে যেখানে নেই কোনো কামনা, নেই কোনো ভোগবিলাসের হাতছানি। আছে আমার জন্য অপেক্ষমানা ধরিত্রীর একটুকরো মাটি । হয়তো অচিরেই মিশে যাবো সেই মাটিতে, কোনো হিমশীতল গ্লেসিয়ারে অচিরেই ভেসে চলে যাবে তোমার কালোমেয়ের পায়ের ছাপ। ফুরিয়ে যাবে শ্বাস, নিবে যাবে প্রাণপ্রদীপ | আবার এই মাটিতেই ফিরে আসার ইচ্ছে থেকে যাবে সঙ্গে । সত্যের পথে আবার পা বাড়াতে চেষ্টা করবে তোমার কৃষ্ণা | শুধু সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসবে তার না দেখা স্বপ্নগুলোকে... আজ থেকে কাল, কাল থেকে পরশু কিম্বা ভবিষ্যতের সীমানায়। সেদিন দেখবে জম্বুদ্বীপের সার্থক সকাল একটা, ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে পা রাখবে তোমাদের কৃষ্ণা।পঞ্চভ্রাতাকে একসূত্রে বন্ধনকারী গ্রন্থীস্বরূপ নারীর মর্যাদায়, পঞ্চস্বামীর পত্নীরূপে সতীত্ব রক্ষায়, সপত্নীদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে আর পাঁচস্বামীর কাছ থেকে পাওয়া পাঁচটি পুত্রের অভাগীনি জননী রূপে, ইতিহাস তাকে মনে রাখবে যুগ যুগ ধরে | যেখানেই থাকো ভালো থেকো কর্ণ ! আমায় যেন ভুল বুঝোনা তুমি ও তোমরা | ইতি, তোমার দ্রৌপদী