২৯ সেপ, ২০২৩

বীরভূমের শিবমন্দির











পশ্চিমবাংলার বীরভূম জেলা শিবক্ষেত্রের অন্যতম স্থান। এখানকার দ্বাদশ শিবমন্দির নিয়ে এই প্রবন্ধের অবতারণা। 
  • জুবুটিয়ার জপেশ্বর
 
প্রান্তিক থেকে লাভপুর হয়ে কীর্ণাহার থেকে অনতিদূরেই জুবুটিয়া গ্রাম গেছিলাম এবার পৌষে। এখানকার জপেশ্বর মন্দির অতি প্রাচীন। গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের দেওয়ান চক্রধরের অম্লশূল নিরাময়ের কারণে এই শিব মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই কারণে স্থানীয় মানুষজন জপেশ্বরকে খুব জাগ্রত বলে মনে করে। প্রাচীন শিব মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার ভাস্কর্য এখনো অমলিন। তবে কালের ঝড়ঝাপটায় এবং বিধ্বংসী যবন শত্রুর অত্যাচারে অনেকাংশেই ক্ষতিগ্রস্ত। ২০০২ সালে প্রধান মন্দিরটি ভেঙ্গে পড়ে যায়। তদানীন্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় নিজের গ্রাম মিরিটি কীর্ণাহারেই। তাঁর আনুকুল্যে মন্দিরটির নতুনভাবে সংস্কার হয়। মন্দিরটি বিশাল এলাকা জুড়ে। আর রয়েছে সংলগ্ন বিশাল ঘাট বাঁধানো পুকুর।

  • সাঁইথিয়ার কলেশ্বর
 
 
সাঁইথিয়া শহর থেকে ১২ মেইল দূরে কলেশ্বর গ্রামে অবস্থিত প্রায় ১১০ ফুট উঁচু কলেশ্বর বা কলেশনাথ শিব মন্দির। প্রাচীন মুনিদের সাধনা ক্ষেত্র ছিল এটি। অতীতের পার্বতীপুর। এখনকার কলেশ্বর গ্রামটি সাঁইথিয়ার ময়ূরেশ্বর থানার অন্তর্গত । অনাদিলিঙ্গ শিব কলেশ্বরনাথ অতি প্রাচীন। শিবের নামেই গ্রামের নাম। পর্বত নামে এক ঋষি দেবী পার্বতীর তপস্যায় রত ছিলেন। আবার কারো মতে ধানঘড়া গ্রামের কলেশ ঘোষ পুজো করে শিব কে তুষ্ট করেন। তাই অমন নাম। 
সপ্তদশ  শতকের শৈব রাজা  রামজীবন রায়চৌধুরী মন্দিরের নির্মাতা। কিন্তু সময়ের স্রোতে ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় এই মন্দিরের সংস্কার করেন দ্বারিকানাথ দেব তপস্বী। বর্তমানের প্রধান মন্দিরটি বিশাল নবরত্ন আকৃতির।  মুর্শিদাবাদের রাজা ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের  আর্থিক সহায়তায় মন্দির নির্মাণ হয়। প্রায় দু'মন ওজনের অষ্ট ধাতুর পার্বতী মূর্তি তিনি দান করেন। মন্দিরের পাশে পার্বতী মন্দির এবং শিবমন্দিরের অভ্যন্তরে অষ্ট্ধাতুর দুর্গামূর্তি আছে। এখানকার প্রচলিত প্রবাদ আজো লোক মুখে ছড়ায়ঃ
কুমারী পাবিরে তুই মনের মত বর
হৃদি ভক্তি রেখে কলেশনাথের উপোস কর।
স্থানীয় কিংবদন্তী বলে প্রাচীনকালে জঙ্গলাকীর্ণ এই অঞ্চলে ভয়ানক অসুরের অত্যাচার ছিল। কলাসুরের দাপটে সবাই থরহরিকম্প। কলাসুরের সুন্দরী কন্যা কলাবতী কে পত্নীরূপে লাভ করার জন্য আরেক অত্যাচারী বিল্বাসুর ব্যাকুল হলে যুদ্ধ বাধে কলাসুরের সঙ্গে। অবশেষে শিব পার্বতীর বরে সেই যুদ্ধ থামে এবং বিল্বাসুর কলাবতীকে বিবাহ করেন। রাঢ় সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ ডাঃ অমলেন্দু মিত্রের মতে ইন্দোমঙ্গোলীয় কৌলিয় জাতির থেকে কলেশ্বর গ্রাম সৃষ্টি হয়। এই কৌলিয় মোঙ্গলীয় জাতি ভারতে প্রবেশ করার পর শৈবধর্ম গ্রহণ করে। তাই রাঢ়বাংলায় শিবমন্দিরের এত আধিক্য। আবার পণ্ডিত মাধবাচার্যের মতে মানুষের কার্য তিন প্রকারঃ বিদ্যা, কলা এবং পশু। পূর্বের যোগী সাধকগণ কলা সংস্পর্শ মুক্ত হওয়ার কারণে সাধনা করেছিলেন এই অঞ্চলে। শিব তাই এখানে কলেশ্বর। কলেশ্বরের শুকদেব মিত্রের "কলেশনাথ-কলেশ্বর' পুস্তকটিতে পাওয়া তথ্য অনুসারে অন্য্যন্য অঞ্চলের মত কলেশনাথের শিবলিঙ্গটিও জঙ্গলের মধ্যে থেকে কুড়িয়ে পাওয়া যায়। কেল্শ নামক এক গোয়ালার গোরুর দুধে স্নান করে তা আত্মপ্রকাশ করে। 
 
  • বক্রেশ্বর



বীরভূমের সতীপিঠ গুলির অন্যতম হল বক্রেশ্বর।
 
পানাগড়-মোরগ্রাম হাইওয়ের থেকে বেরিয়ে ঘুরে আসা যায় বক্রেশ্বরে যেখানে সতীর তৃতীয় নয়ন বা  'মন' পড়েছিল । বক্রেশ্বর নদীর ওপর "নীল-নির্জন' ড্যাম যা একটি ট্যুরিষ্ট স্পটও বটে । এই জলাধারটি বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুত কেন্দ্রের জল সরবরাহ করে ।
এবার আসি বক্রেশ্বরের মাহাত্ম্যে । ব্রহ্মাণ্ডপুরাণে এই তীর্থস্থানকে সিদ্ধপীঠ বলা হয়েছে। এবং পীঠমালা মহাতন্ত্রে এর স্পষ্ট উল্লেখ আছে। 

বক্রেশ্বরে মনঃ পাতু দেবী মহিষমর্দিনী ভৈরবো বক্রনাথস্ত নদীতত্র পাপহরা।।   

সুজাতা ও কহোর মুনির ছেলে সুব্রত। মায়ের গর্ভে থাকাকালীন সে শুনে শুনে বেদ শাস্ত্রে জ্ঞান লাভ করেছিল। একদিন সে তার পিতা কহোর মুনির বেদপাঠে ভুল ধরিয়ে দিলে অপমানিত মুনি ক্রোধবশত গর্ভস্থ পুত্র কে অভিশাপ দেন। পুত্রের অষ্টাঙ্গ বিকৃত হয়ে দেহে আটটি ভাঁজ পড়ে। এমন প্রতিবন্ধী ছেলের নাম হয় অষ্টাবক্র। 
আবার কারো মতে সত্যযুগে বৈকুন্ঠে আয়োজিত অযোনিসম্ভবা লক্ষ্মীদেবীর স্বয়ংবরা সভায় আমন্ত্রিত মহর্ষিদের সম্মুখে ইন্দ্রের দ্বারা সুব্রতমুনি অপমানিত হন। সুব্রতমুনির ক্রোধাগ্নি দমন হলেও তাঁর সেই ক্রোধ কবলিত দেহে আটটি ভয়ংকর ভাঁজ পড়ে যার জন্য তার নাম হয় অষ্টাবক্র মুনি । 
সেই যুগে জনক রাজার রাজসভায় আমন্ত্রিত হলেন শাস্ত্রজ্ঞ এই অষ্টাবক্র সুব্রত মুনি। রাজা বললেন জ্ঞান শোনালে পুরস্কৃত করবেন। সেখানে তাঁর পিতা কহোরও উপস্থিত। পিতা কে হারিয়ে দিলেন রাজার সভা পন্ডিত। কহোর মুনি নিযুক্ত হলেন সেবার কাজে। দ্বাদশ বর্ষীয় জ্ঞানী অষ্টাবক্র পিতার এহেন পরাজয়ে অপমানিত হলেন। বাবা কে মুক্ত করতে রাজার কাছে গিয়ে উপস্থিত সব পন্ডিতদের তর্কে পরাজিত করলেন। কহোর মুনি মুক্ত হলেন। খুশি হয়ে পিতা সন্তান কে বললেন " যে নদী সমান গতিতে বয়ে চলে তাঁকে বলে সমঙ্গ  নদী। সেই নদীর জলে স্নান করলে তোমার সকল অঙ্গ বিকৃতি দূর হবে।" পুত্র নদী খুঁজতে খুঁজতে হাজির হলেন ডিহি নামক স্থানে। এই ডিহি আজকের বক্রেশ্বর। 

আবার কারো মতে এই অষ্টাবক্র সুব্রত মুনি এখানকার জঙ্গলে  বহুদিন শিবলিঙ্গের সন্ধান পেয়ে  তপস্যা করার পর শিবের আশীর্বাদে মুক্তি পান । তাই এই বক্রেশ্বর শিব বা বক্রনাথ খুব জাগ্রত । বর্তমান মন্দির ৭০০ বছরের প্রাচীন। নির্মাতা রাজা নরসিংহ দেব।  প্রস্তরফলক থেকে জানা যায় যে রাজনগরের রাজার মন্ত্রী দর্পনারায়ণ সুলতানি আমলে ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির কে  ১৭৬১ সালে আবার সংস্কার করেন। মন্দিরে পিতলের ধাতু মণ্ডিত শিলাই হলেন স্বয়ং অষ্টাবক্র মুনি। ঠিক পাশেই আরেকটি ছোটো শিলা হল বক্রনাথ শিবের। দেবী মন্দিরের গায়ে বটুক ভৈরবের অবস্থান। রয়েছে আরো ৫টি শিবলিঙ্গ। কুবেরেশ্বর, সিদ্ধেশ্বর, জ্যোতিরলিঙ্গেশ্বর, কালারুদ্রেশ্বর ও জম্ভশ্বর। রয়েছে দশটি উষ্ণ প্রস্রবণ আছে যাদের জল গড়ে ৬৫ থেকে ৬৬ডিগ্রি সেলসিয়াস । বক্রেশ্বরের মূল মন্দিরটি ঊড়িষ্যার প্রাচীন রেখাদেউল রীতি অনুসারে তৈরী । এই সতীপিঠের আরাধ্যা দেবী মহিষাসুরমর্দ্দিণি এবং পীঠাধীশ ভৈরব হলেন বক্রনাথ স্বয়ং ( মতান্তরে বটুক ভৈরব) । মূলমন্দিরের পশ্চিমাংশে একতলা দালানরীতির মন্দিরের মধ্যেই প্রস্তরবেদীর ওপরে অধিষ্ঠিতা দেবী । অষ্টধাতুর অসামান্যা এই অধুনা মূর্তিটি সাম্প্রতিককালের । পূর্বে পরপর দুবার দুটি ধাতব মূর্তি লুন্ঠিত হয়ে যায় । ঐ বেদীমূলের গহ্বরে সতীমায়ের শিলীভূত ভ্রূমধ্য স্থান বা ইন্দ্রিয় শ্রেষ্ঠ মন পতিত হয়েছিল দক্ষযজ্ঞের সময় । 
মন কোনো স্থুল  জাগতিক বস্তু বা অঙ্গস্বরূপ নয়। তাই পীঠমাহাত্ম্য অনুযায়ী দেবীর ভ্রূ যুগলের মধ্যিখানের অংশ পড়েছিল এখানে যাকে মন রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়ালে এখানকার পাশাপাশি দুটি কুণ্ডের একটিতে উষ্ণ এবং অন্যটিতে শীতল জল। মোট আটটি কুণ্ড আছে এখানে। ক্ষারকুণ্ড, ভৈরবকুণ্ড, অগ্নিকুণ্ড, সৌভাগ্যকুন্ড,  জীবিতকুণ্ড, ব্রহ্মাকুণ্ড, শ্বেতগঙ্গা এবং বৈতরণী। মহাতীর্থ বারাণসী যেমন বরুণা ও অসি নদীর দ্বারা বেষ্টিত তেমনি বক্রেশ্বরও পাপহরা ও বক্রেশ্বর নামে দুই পুণ্যতোয়া নদীর মাঝে।  

আপাত অনাড়ম্বর মহিষমর্দিনি মায়ের মন্দিরে দাঁড়ালে বেশ ছমছমে অনুভূতি হয় ।কত প্রাচীন এইসব মন্দির তা মন্দিরের চেহারা দেখলেই বোঝা যায় । বক্রেশ্বরের উষ্ণপ্রস্রবণে স্নানের ব্যাবস্থাও আছে । 
 

  • কাঞ্চীশ্বর
 
বোলপুরের প্রান্তিক থেকে কঙ্কালীতলা হল বীরভূমের পাঁচ সতীপিঠের অন্যতম। এই সতী পিঠের অন্য নাম কাঞ্চীপিঠ। উত্তরবাহিনী কোপাই নদী, শ্মশান আর কুন্ডটি সব মিলিয়ে বেশ সুন্দর জায়গা। প্রাচীন মন্দির টি সংস্কার হয়েছে নতুন রূপে। সেইসঙ্গে নতুন কলেবরে দেখতে পাই রুরু ভৈরবের মন্দিরটি। রুরু ভৈরব কঙ্কালী দেবীর পুরুষ। অষ্টাঙ্গ ভৈরবের অন্যতম। আমাদের দিকপাল। সর্বদা রক্ষা করেন। 

পীঠনির্নয়তন্ত্রে পাই  

কাঞ্চীদেশে চ কঙ্কালো ভৈরবো রুরু নামকঃ দেবতা দেবগর্ভাখ্যা 

অর্থাত কাঞ্চীদেশে দেবী দেবগর্ভার কঙ্কাল পতিত হয়েছিল।  এই দেবীর ভৈরবের নাম রুরু। 
মহাদেবের সবচাইতে ক্রোধিত রূপ নাকি এই রুরু ভৈরবের । ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর তাঁর অন্নদামঙ্গল কাব্যে এই সতী পিঠ কে কাঞ্চীপিঠ বলেছেন। 

কাঞ্চী দেশে পড়িল কাঁকালি অভিরাম।
বেদগর্ভা দেবতা ভৈরব রুরু নাম।।

দুয়ে মিলে ধরে নেওয়া যায় সতীর দেহত্যাগের  সময় বিষ্ণু চক্রে খণ্ডিত সতীর দেহাংশের কাঁখাল বা কোমরের অংশ কিম্বা কঙ্কাল পড়েছিল এই কুন্ডে। তাই একান্ন পীঠের একটি পীঠ এটি। কঙ্কালী মায়ের ভৈরব হলেন রুরু যার অপর নাম কাঞ্চীশ্বর।  স্বয়ংভূ লিঙ্গটি কালাপাহাড়ের অত্যাচারে বিনষ্ট । বর্তমানে গৌরীপট্টটি বর্তমান।
ইতিহাস বলছে রাজা রাজেন্দ্র চোল রাঢ়বঙ্গে রণশূর কে পরাজিত করে মহীপালের বিরুদ্ধে অভিযানের আগে কোপাই নদীর তীরে শিবির সন্নিবেশ করেছিলেন। তাই এই স্থানের নাম কাঞ্চীশ্বর।  

আমাদের চতুর্দিকে অবস্থান করেন দিকপাল অষ্টাঙ্গ ভৈরব যাঁরা আমাদের জগন্মাতার তন্ত্রধর্মের অতন্দ্র প্রহরী। এরা  আমাদের সীমান্ত প্রহরী। ভৈরবরা ভীতিজনক, কারণ তাঁরা শত্রুবিনাশক। ভৈরব শব্দের ব্যুৎপত্তি হল, যিনি ভীষণ রব করেন।
আমাদের পূর্বদিক রক্ষা করেন অসিতাঙ্গ ভৈরব ও রুরু ভৈরব। দক্ষিণ দিক রক্ষা করেন চণ্ড ভৈরব ও ক্রোধ ভৈরব। পশ্চিম দিকের প্রহরী হলেন উন্মত্ত ভৈরব এবং ভয়ঙ্কর ভৈরব। উত্তর দিকের প্রহরী হলেন কপাল ভৈরব এবং ভীষণ ভৈরব। এছাড়া মধ্যস্থল রক্ষায় আছেন সংহার ভৈরব।

  • নলহাটির যোগেশ  
নলহাটির ললাটেশ্বরী মন্দির একান্নপীঠের অন্যতম শক্তিপীঠ। নলহাটি স্টেশনের অনতিদূরেই একটি টিলার ঢালে এই পীঠস্থান। মন্দিরের পিছনে পাহাড় আর মন্দিরের সিঁড়ির মুখেই ললাটেশ্বরী দেবী কালিকা এবং ক্ষেত্রপাল ভৈরব যোগেশের অবস্থান। পীঠমালাতন্ত্রে বলে সতীর কনুইয়ের নিম্নভাগ বা নলা (সংস্কৃত শব্দ নলক থেকে উত্পত্তি) পড়েছিল এখানে। কেউ বলে ললাট আবার কারো মতে কন্ঠনালী পড়েছিল। 

নলহাট্যাং নলাপাতো যোগীশো ভৈরবস্তথা তত্র সা কালিকা দেবী সর্বসিদ্ধিপ্রদায়িকা ।। 

কারো মতে মন্দিরের প্রায় দু কিমি উত্তরপশ্চিমে হরিটোকা গ্রামের শিবলিঙ্গটিই আসল যোগেশ ভৈরবের। আবার ঐতিহাসিকদের মতে নিষাদরাজ্য ছিল পৌরাণিক নলের বাসভূমি। নলহাটির টিলাতে সীতার পদচিহ্ন এবং চুল্লীর পোড়া পাথর এখনো আছে। বনবাসকালে রামসীতা এই অঞ্চলের পাহাড়ে কিছুদিন বাস করেছিলেন বলে তাদের বিশ্বাস। এই নলহাটেশ্বরী মূলত নলদের মুখোস বা মুণ্ড পূজার অন্যতম কেন্দ্র ছিল। 
 

  • ফুল্লরাতলার বিশ্বেশ 
বোলপুর থেকে লাভপুরে নেমে যাওয়া যায় অথবা বোলপুর থেকে প্রান্তিক-কোপাইয়ের পথ ধরে ও যাওয়া যায়। মুসলমান যুগে লাভপুর এক প্রসিদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ব্যবসায় প্রভূত লাভ হওয়ার কারণে এর নাম লাভপুর। সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাসস্থান। লাভপুর স্টেশনের উত্তরপুবে ফুল্লরাপীঠ। রাঙামাটীর পাথুরে টিলার ওপরে মায়ের মন্দির। নীচে প্রবাহিত উত্তরমুখী কোপাই নদী। 
পীঠনির্ণয়তন্ত্রে আছে
অট্টহাসেচোষ্ঠপাতো দেবী সা ফুল্লরা স্মৃতা বিশ্বেশভৈরবস্তত্র সর্বাভীষ্ট প্রদায়কঃ।।  

সতীর দেহত্যাগের পরে তাঁর খণ্ডিত ৫১ দেহাবশেষের ৫টি পড়েছিল আমাদের বীরভূমে। এর মধ্যে অন্যতম হল  ময়ূরাক্ষী নদীর সমতলে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মস্থান লাভপুর যার অনতিদূরেই ফুল্লরা বা সতীপীঠ অট্টহাস । এখানে সতীমায়ের অধর ওষ্ঠ পড়েছিল । মন্দিরের পাশে বিরাট পুকুর । অট্টহাসে দেবী ফুল্লরার ভৈরব হলেন বিশ্বেশ । এখানেও প্রবাহিত উত্তরমুখী কোপাই নদী।শ্রী শ্রী চন্ডীতে আছে অসুর নিধনের সময় দেবী দুর্গা অট্টহাসিতে আকাশ বাতাস ভরিয়ে দিয়েছিলেন। কথিত আছে রামচন্দ্র যখন দুর্গাপুজো করেছিলেন তখন হনুমান ১০৮টি নীলপদ্ম ফুল্লরার সংলগ্ন পুকুর থেকে সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন রামচন্দ্রের পূজার জন্য । প্রতিবছর নাকি দুর্গাপুজোর আগে সেই জলাশয়ের উত্তর-পূর্ব দিক থেকে ভেসে আসে একটি অদ্ভুত শব্দ। যা শোনার পরই শুরু হয় দেবীর সন্ধিপুজো।  দেবীর অধরোষ্ঠ পড়েছিল সেই তীর্থের তেমন নাম অট্টহাস সেই অর্থে বেশ কাব্যিক বটে। কারো মতে বশিষ্ট মুনির পুত্র অট্টহাস ছিলেন এই সতীপীঠের প্রথম সাধক এবং তাঁর নামানুসারেই জায়গাটির তৎকালীন নাম ছিল অট্টহাস। কেউ বলে অট্টহাস এবং ফুল্লরাতলা ভিন্ন স্থান। কারো মতে দুটি  নাকি এক‌। দেবীর এখানে কোন বিগ্রহ নেই । মন্দিরের মধ্যে রয়েছে টকটকে লাল রঙের প্রকাণ্ড এক প্রস্তরখন্ড। সেই পাথরের সামনের ভাগটা ওষ্ঠাকৃতির। সেখানেই নিত্য পুজো হয়। এখানে দেবীর ভোগের অন্যতম পদ হল মাছের টক। 
  • নন্দীকেশ্বর 

বীরভূমের সাঁইথিয়ার অন্যতম নদী ময়ূরাক্ষীর তীরে এ জেলার অন্যতম সতীপীঠ নন্দীপুর।
পীঠনির্ণয় তন্ত্রে বলে 


হারপাতো নন্দিপুরে ভৈরব নন্দিকেশ্বরঃ
নন্দিনী সা মহাদেবী তত্র সিদ্ধিমাবাপ্নুয়াত।।  


এখানে মহাদেবী হলেন নন্দিনী বা নন্দিকেশরী এবং এর ভৈরব ক্ষেত্রপাল নন্দিশ্বর বা নন্দিকেশ্বর।  অতি সাধারণ মায়ের মন্দির দালান রীতিতে নির্মিত ছায়া ঘেরা বটগাছের নীচে এই মন্দির। দেবী এখানে মহাশক্তি দুর্গা ধ্যানে পূজিতা হন। প্রবেশপথের ডানদিকে পীঠভৈরব নন্দিশ্বরের অবস্থান একতলার দালান ঘরে।  দেবীর কন্ঠের অস্থি পড়েছিল এখানে। নিত্যভোগের আয়োজন এবং ধ্যানগম্ভীর পরিবেশে দাঁডালেই বেশ মাহাত্ম্য অনুভূত হয়।   


  • মল্লেশ্বর 
বাংলার বীরভূম । সীমানায় ঝাড়খন্ড। সেখানেই ময়ূরাক্ষী নদী। কাছেই  মল্লারপুর গ্রাম। মহাদেবের নাম মল্লেশ্বর। বীরভূমের অন্যতম শিব ভূমি। 
"বীরভূমৌ সিদ্ধিনাথ রাঢ়ে চ তারকেশ্বর" এটি হল মল্লেশ্বর  শিবের মন্ত্র। সঙ্গে দ্বাদশ শতাব্দীর সিদ্ধেশ্বরী শিলা মূর্তি। মল্লেশ্বরের শিবগঞ্জের মন্দির-পল্লি তে ঢুকলেই এখনো মহাভারতের গল্প জীবন্ত হয়ে ওঠে। 
চারিদিকে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এক বিরাট চৌহদ্দির মধ্যে মল্লেশ্বর শিব মন্দির ছাড়াও রয়েছে লাইন করে একের পর এক সব প্রাচীন  মন্দির। বেশিরভাগই ছোটো ও বাংলার চারচালা রীতিতে তৈরি। উত্তর দিকে দোতলা প্রধান তোরণদ্বারের ওপর নহবতখানা। আগে বোধহয় সানাই বাজত। শিববাড়ির ভেতরের মন্দিরগুলির গায়ে টেরাকোটার নানা অলংকরণ। অজস্র দেবদেবীর মূর্তি। এখনও অক্ষত। এই শিবপল্লি দ্বাদশ শতাব্দীর। 
সিঁদুরে লেপা সেই পাথরের সিদ্ধেশ্বরী দেবীর মুখমণ্ডলে এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে ত্রিনয়ন। সব শক্তি পীঠে  যেমন থাকে একজন পুরুষ আর একজন প্রকৃতি। তেমনি এখানে এই সিদ্ধেশ্বরী দেবী বুঝি মল্লেশ্বর শিবের শক্তিস্বরূপা। 

মল্লারপুরের ঘন জঙ্গলে এক মেষপালকের অসামান্য সুন্দরী মেয়ে পদ্মিনীর সঙ্গে স্থানীয় এক  সাধুর বিয়ে হয়। তাদের সন্তান মল্লনাথ। সবই জনশ্রুতি । একদিন গভীর বনের মধ্যে গোরু চরাতে গিয়ে মল্লনাথ চমকে ওঠে। একটি দলছুট গরু বটগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে দুধ দিচ্ছে আপনা আপনি। প্রকান্ড সেই ঝুরি নামা প্রাচীন বট এখনো আছে।  কয়েক দিন পরপর একই জিনিষ দেখে মল্লনাথ তার সেই সন্ন্যাসী বাবা কে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হতেই তার বাবা বলল গ্রামের আরও লোকজন নিয়ে জায়গাটা খুঁড়তে। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে উদ্ধার হল ঘড়া ঘড়া গুপ্তধন। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে তার কিছুপরেই কোদাল আর পাথরের ঘর্ষণে বিশাল শব্দ। হঠাত আগুন জ্বলে উঠতেই সবাই চমকে উঠল। মল্লনাথ নাকি দৈববাণী শুনতে পেয়েছিল তখনি। মাটির নীচে ছিল মহাভারতের রাজা জয়দ্রথের পূজিত শিব বাবা সিদ্ধিনাথ। বাবা সিদ্ধিনাথই এখানকার এই মল্লেশ্বর শিব। পাথরের শিলায় এখনও সেই কোদালের ক্ষতচিহ্ন আছে। আর সেই গুপ্তধনের মালিক হয়েছিল মল্লনাথ যার নামেই এই জায়গার নাম মল্লারপুর। 
মহারাজ মল্লনাথ সিংহই এই জনপদের উন্নয়ন করে রাজধানী নির্মাণ করান এবং শিব মন্দিরের সংস্কার করেন, তাই জনপদের নাম মল্লারপুর এবং শিবের নাম 'মল্লেশ্বর' হয়েছে।
পাশেই ফতেপুর গ্রামে অনেক প্রাচীন কালে এক জনজাতির বাস ছিল। এই দেখো না পড়ে। মল্লনাথের জন্মের কথা সব লেখা আছে পাথরে। 
মোট ২৩টা মন্দির এই শিব পল্লী তে। একটি মন্দিরে সিদ্ধেশ্বরী মূর্তি বাকি সব শিব মন্দির।
এই গ্রামের পুবদিকের জঙ্গলে গেলে শিবপাহাড়ি নামে এক পাহাড় আছে। পাণ্ডবরা বনবাসকালে যখন কাম্যক বনে বাস করছিলেন তখন মাতা কুন্তী এই শিব পুজো করতেন। দুর্যোধনের বোন দুঃশলার স্বামী রাজা জয়দ্রথ গিয়েছিলেন দ্রৌপদীকে হরণ করতে। ভীমের হাতে অপমানিত হয়ে জয়দ্রথ তখন কঠোর তপস্যা শুরু করেন।সিদ্ধিনাথ শিব শেষ পর্যন্ত জয়দ্রথের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে তাঁকে বর দেন এবং বর পান এমনি যে কেউ তাঁকে কোনোদিনও যুদ্ধে হারাতে পারবে না। 

  • মদনেশ্বর  (কোটাসুর, সাঁইথিয়া)   

 

২৮ সেপ, ২০২৩

কোভিড কালে হুতোম এল / ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় রিভিউ লিখলেন ডঃ জয়ন্তী মণ্ডল (রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা বিভাগ)



কোভিড কালে হুতোম এল

ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

মূল্য - ২০০

রা' প্রকাশন

বই নয় যেন দেড়শ বছর আগের পুরোনো কলকাতার এক ঘন কালো ছবি। এটাও একপ্রকার স্মৃতি গ্রন্থ। তবে কলকাতার এক ঘন পাতার জামরুল গাছের ডালে বসেছিল দেড়শ বছর আগের বাঙালি বাবু বিবিদের অশরীরী ভূতেদের স্মৃতির আড্ডা। এদের সঙ্গে এসে জুটল দেড়শ বছর আগের ক্ষণজন্মা বাঙালি বাবু কালীপ্রসন্ন সিংহ। কালীপ্রসন্ন অবশ্য একালে হুতোম প্যাঁচা হয়েই জন্মেছে। সেও প্রাণের শহর কলকাতাকে দেখবে বলে অশরীরী বাবু বিবিদের আড্ডায়। পাঠক গ্রন্থটি পড়তে পড়তে চলে যাবেন আগেকার পুরনো কলকাতায়। স্মৃতিপটে ভেসে উঠবে সেকালের কলকাতাবাসীর এক চমৎকার ছবি। এই অশরীরী ভূতেদের চোখ দিয়েও যদি পুরনো কলকাতাকে একবার দেখতে  পায় তো মন্দ কী?

লেখকের কল্পনার সুতোয় জাল বোনা এক অদ্ভুত কাহিনি যেন। প্রতি মুহূর্তেই লেখক শরণাপন্ন হয়েছেন সেই বহু চর্চিত, বিতর্কিত কালজয়ী গ্রন্থ "হুতোম পেঁচার নকশা"র উল্লেখযোগ্য অংশগুলির উল্লেখ বর্তমান প্রজন্মের পাঠক পাঠিকাদের ভাবাবে। আর সেই পুরনো কাহিনির মোড়কে নতুন এবং আধুনিক ভাবে লেখা বাংলার সব নামীদামী মানুষের চরিত্রেরা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে এ বইতে। 

অনেক খুঁজে খুঁজে হুতোম কলকাতাতে এসে জুটেছে। কেমন লাগছে হুতোমের? বহুকাল আগের দেখা কলকাতা আর এখন চলমান কলকাতাকে সে মেলাতে চাই। কখনো স্মৃতির অতলে অবগাহন করে তুলে আনতে চায় পুরনো সেসব দিনের কথা। হুতোমের চোখে ভেসে ওঠে পুরনো কলকাতার বাবুরা কেমন করে ঘোড়ায় চড়ে অফিসে যেতেন। তারপর এল জমিদারদের বজরা, সাহেব বিবিদের ফিটন গাড়ি থেকে যানবাহন জায়গা নিল ঘোড়ায় টানা ট্রাম। হুতোম দেখে ঘোড়ার গাড়ির বংশ পরম্পরায় মালিকেরা এখনো এই শহরেই রয়ে গেছে। তবে তারা অন্য পেশায় অবাঙ্গালীদের বিয়ে বাড়ির প্রশেসনে ঘোড়াগুলোকে ভাড়া দিয়ে জীবন চালায়। হুতোম অবশ্য ট্রাম দেখে যেতে পারেনি। 

এখন তার আস্তানা কখনো পুরনো বাড়ির ছাদের আলসেতে তো কখনো কারো জানালার কার্নিশে। গাছের কোটরে বসে বসে তার স্মৃতি ছুটে বেড়াই একবার এ জন্মে আর একবার গত জন্মের কলকাতাতে। মাত্র তিরিশটা বছর সে কলকাতাকে দেখেছিল। হুতোমের একটাই আফসোস আগের জন্মের মতো যদি কলকাতাকে নিয়ে এ জন্মে দুটো কথা লিখতে পারত। 

এক অশরীরী ভুতের সঙ্গে হুতোমের কলকাতার অলিগলি বেয়ে চলা ট্রামে গল্প জমে ওঠে। তবে অশরীরী বন্ধু ভূত হুতোমকে জানাই খুব শীঘ্রই ট্রাম এ শহর থেকে বিদায় নেবে। হুতোম এর চোখে ভেসে ওঠে পুরনো কলকাতার গোবিন্দরাম মিত্রের আপার সার্কুলার রোডে বাগানবাড়ির নন্দন বাগানের কথা। গোবিন্দ রাম  চিতপুর রোডে নবরত্ন মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যার চূড়া ১৬৫ ফুট মনুমেন্টের চেয়েও উঁচু। অবশ্য ১৭৩৭ এর ভূমিকম্পে মন্দিরের চূড়া ভেঙে যায়। এসব কথা সে বই এ পড়েছে।

কখন যেন ভূত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব একসঙ্গে কথা বলে ওঠে এ উপন্যাসের মাধ্যমে। 

হুতোম ঠাকুমার মুখে শুনেছে, জব চার্ণক যখন কলকাতায় আসেন তখন কলকাতার লালদিঘি নিয়ে খুব উত্তেজনা ছিল। পলাশীর যুদ্ধের ঠিক আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ভয়ানক যুদ্ধ হয়েছিল এই লালদিঘিতে। হুতুম তার নকশাতে লিখেছিল কলকাতায় কেমন সন্ধ্যে বেলা রামায়ণ,মহাভারত, পুরাণ পাঠের সমবেত আসর বসার কথা। একালে টপ্পা গান বাজলে বা চড়ক এলে হুতোমের কানে ভেসে ওঠে সেকালের টুনোয়ার সেই টপ্পা গান – 

' কহই টুনোয়া -

শহর শিখাওয়ে কোতোয়ালী ' 

চিৎপুরের রাস্তায় জেলেপাড়ার সঙ্গের কথা লিখেছিল সে তার নকশায়। বাবুরা কালীঘাটের চড়ক দেখতে গিয়ে দেখতেন মত্ত সন্ন্যাসীদের নৃত্য আর কেরাঞ্চি গাড়ি করে বেশ্যার আগমন।

স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে মাহেশের স্নানযাত্রা। বাবুরা বজরা ভাড়া করে মদ গাঁজা নিয়ে নৌকায় উঠতেন। স্নানযাত্রার পর বাইনাচের আসর বসত। বাবুদের সাজসজ্জা ছিল তেমন। গায়ে পিতলের বোতাম দেওয়া সবুজ ফ্তুই, আর ঢাকায় উড়নি। পরনে শান্তিপুরী ধুতি। রাতের কলকাতায় কান পাতলেই শোনা যেত ঘুঙুরের আওয়াজ। এখন শহরজুড়ে শুধুই হইহুল্লোড়।

কখনো কখনো আকাশপথে উড়তে উড়তে হুতোম একালের রথযাত্রা দেখে। মনে পড়ে সেকালের রথের কথা। জানবাজারের রাসমণির স্বামী রামচন্দ্র দাসের রুপোর রথ টানতো দুটি সুসজ্জিত ঘোড়া, রথের সঙ্গে বের হতো কলকাতার সং।

দুর্গাপুজো এলে হুতোমের বুকটা হুহু করে ওঠে। তখন দুর্গাপুজো হতো কি বিরাট করে বাবুদের বাড়িতে। পাল্লা দিয়ে চলত সাহেব বিবিদের নেমন্তন্ন। তাদের বিনোদনের জন্য নর্তকীদের আনা হতো মোটা মাইনে দিয়ে। নিকি নামের নর্তকী ছিল সবার সেরা। তারপর এসেছিল বুলবুল। এখনকার শহরের আনাচে-কানাচে থিমের বারোয়ারি পূজোর আলোর ঝলকানিতে চোখ ঝলসে যায় হুতোমের। পুজো মিটলে বাঁচে হুতোম।

লেখক চমৎকার বয়ানে, কল্পনার জাল বুনেছেন ধীরে ধীরে। সেখানে বাস্তব আর কল্পনা যেন রুপকথা হয়ে উঠেছে এক একবার। 

হুতোম দক্ষিণ কলকাতার এক বিরাট গাছের মগডালে বসে বসে কখনো দেখে এ কালের আবাসনের ঝগড়া। তার চোখ চলে যায় বাবুদের হাতে শ্লেট এর মতো জিনিসটাই। এ যুগের বাবুরা আঙুল দিয়ে তার উপর কি সব হিসেব করে চলে।  হুতোম ভাবে এই বাবুরাই আবার গাড়ি হাঁকিয়ে সন্ধ্যেবেলা কোথায় যায়? 

অমনি গাছের ফাঁক থেকে নাকি সুর এক অশরীরী বলে ওঠে কোথায় আবার ক্লাবে আড্ডা দিতে যাচ্ছে। একালের বাবুদেরও এক আধটা উপপত্নী থাকে। কিন্তু স্ত্রীকে তারা সম্মানও দেয় আসলে বুদ্ধিমান নব্য বাবুরা আটঘাট বেঁধে নামে। হুতোম দেখে একালের বিবিরা সন্ধ্যেবেলা লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়ে না। তখন তারা কিটি পার্টি করে, ফেসবুক করে। অশরীরী ভূত নাকি কণ্ঠে আর হুতোম গাছের ডালে ঠোঁট ঠুকে ঠুকে দুজনেই স্মৃতির অতলে ডুব দিয়ে চলে যায় মহাভারতের যুগে, শশাঙ্কের আমলে, ইসলামী আমল হয়ে একেবারে ইংরেজ আমল।

এমন সময় এসে জুটলো এক নারী কণ্ঠী পেত্নী সে যুগের কবিয়াল এন্টনি ফিরিঙ্গির স্ত্রী সৌদামিনী। সেকালের বিখ্যাত টপ্পা গায়ক রামনিধি গুপ্তের অশরীরী  ভূত সঙ্গ দিল এদের সঙ্গে। তিনজনে মিলে বেশ জমেছে আড্ডা। লেখিকা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাবু রাজা নব কৃষ্ণের অশরীরী ভূতটাকেও এনে জমিয়ে দিলেন ভূতেদের আড্ডায়। অবশ্য হুতোম এ যুগে জীবন্ত একটা পাখি হয়ে জন্মেছে।

রাজা নব কৃষ্ণের অশরীরী ভুতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে আড্ডা অন্য মাত্রা পেল। হুতোম যেন তার নকশায় আঁকা বাবুদের এ যুগে একবার হাতে পেল। ক্লাইভের সঙ্গে নবকৃষ্ণ বাবুর জোট বেঁধে সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসন চ্যুতের কথা গল্পচ্ছলে বলতে ছাড়ল না হুতোম। টপ্পা ভূত আর হুতোমের কথোপকথনে সেকালের বাবুদের স্বেচ্ছাচার, জমিদারদের আমোদ প্রমোদ, বাংলার দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর, যুদ্ধে ক্ষত বিক্ষত বাঙালির কথা যখন ওঠে তখন বাবুভূত রেগে ওঠেন। রামনিধি বাবুর সেই কালজয়ী টপ্পা অশ্লীলতা দায় দেখিয়ে রক্ষণশীলদের জোটবদ্ধ হওয়ার কথা  রমনিধি গুপ্তের ভূত বলে আস মেটাল একালে। সে দুঃখ আজও টপ্পা ভূতের রয়ে গেছে। একটা শান্তি যখন দেখে তাদের গান নিয়ে এখনকার ছাত্র-ছাত্রীরা গবেষণা করছে তখন আনন্দে ভরে ওঠে মনটা তার।

ভূত পেত্নীদের আড্ডা শেষ হতে হতে ভোর। গাছের কোটরে হুতোম ঘুমোয় । মানুষের কলরবে ঘুম পাতলা হয়ে যায় হুতোম এর। রাতের মজলিসের কথা বসে বসে ভাবে সে। এ জন্মে তো সে লিখতে পারেনা। সেকালে কলকাতাকে দেখে নকশা লিখেছিল সে। সবে বাবুদের জমিদারি শুরু।  বাঙালি সেদিন কেমন করে বাবু তৈরি হয়েছিল তা হুতোমের নিজের চোখে দেখা তাই তো সে তার নকশা তে লিখেছিল। তা নিয়ে সমাজ উত্তাল। এর জন্য বাবুদের কাছ থেকে কম লাঞ্ছনা গঞ্জনা শুনতে হয়নি তাকে। শেষে মহাভারতের অনুবাদ করে সেই বই বিলিয়ে দিয়ে দেউলিয়া হয়ে গেল।

এর মধ্যে আবার নতুন বিপদ। হুতোম পেঁচা কে দেখে তার ডাক শুনে আবারো অমঙ্গলের ইঙ্গিত পায় কলকাতাবাসী। কোভিড কালে হুতোম এলো। অতিমারি সে দেখেনি। মন্বন্তরের নাম শুনেছিল। এই অতিমারি তাও তার প্রাণের শহর কলকাতায়! হুতোম দেখে কোভিডের হাত থেকে বাঁচার জন্য বস্তির পাগলী শারি সকলের মঙ্গলের আকাঙ্ক্ষায় বন্ধ শেতলা মন্দিরে গিয়ে অশ্বস্থ গাছের নিচে ফুল আর একটা টাকা রেখে আসে। হুতোম এমন একটা শারি কে সে জীবনে চেয়েছিল কিন্তু পাইনি।

শারিকে দেখে হুতোমের মনে পড়ে যায় গত জন্মের কথা, ছ বছর বয়সে বাবা মারা যান। হিন্দু কলেজে ভর্তি হলেও ঠাট্টা ইয়ার্কি আর দুষ্টুমিতে ওস্তাদ ছেলের কলেজের পাঠ চুকোতে হলো। অগত্যা বাড়িতেই পাঠ নিতে হয় তাকে। রাতে ঘুমোতে গিয়ে ঠাকুমার মুখে রামায়ণ, মহাভারতের গল্প শোনে। ঠাকুমা শোনান তার জন্মের ও আগের কলকাতার গল্প।

গাছের কোটোরে বসে গোল গোল চোখ ঘুরিয়ে অতীতের স্মৃতিতে ডুব দেয় তের বছরের কিশোরের বিয়ের স্মৃতি। বর কালীপ্রসন্ন সিংহ। কি বিরাট আয়োজন হয়েছিল সেদিন। একদিন দেশীয় বাবুদের নিয়ে নাচ গান উৎসব। ব্রাহ্মণদের বিদায় দক্ষিণার কি আয়োজন! ঘড়া, থালা, শঙ্খ, রুপোর থালা-বাসন আরো কত কি! ক বছরের মধ্যে চলে গেল বাগবাজারের বসু পরিবারের একরত্তি মেয়েটা। আবার দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ সেও টিকলো না। সারস্বত সমাজকে নিয়েই সে ভুলে থাকতে চাইলে সবকিছু। দান  ধ্যানেও সিদ্ধ হস্ত ছিল হুতোম। কখনো বিদ্যাসাগর কে কখনো মধুসূদন কে দিয়েছেন টাকা। শেষে নিজেই হয়ে গিয়েছিল মাথা অবধি দেনার দায়ী।

কলকাতার বাঙালি বাবুরা যখন দিনে ঘুমিয়ে রাতে বাইজি নৃত্য দেখে, ঘুড়ি উড়িয়ে, পায়রা উড়িয়ে, বুলবুলির লড়াই দেখে দিন যাপন করে হুতোম তখন সারস্বত চর্চার নতুন নেশায়। মাত্র তখন তার ষোল বছর বয়স। বাংলার নাট্যমঞ্চের দরকার ভেবে নিজের বাড়িতেই তৈরি করল 'বিদ্যোৎসাহিনী' থিয়েটার। সেখানে রামনারায়ণ তর্ক রত্নের ' বেণীসংহার' নাটক মঞ্চস্থ হলো। প্রশংসিত জনতার মুখের দিকে তাকিয়ে হুতোম আবার কালিদাসের বিক্রমোবর্শী, নাটকের অনুবাদ করে মঞ্চস্থ করল। কালীপ্রসনের অভিনয় দেখার জন্য হলে সেদিন লোক ধরেনি। ফিরে যেতে হয়েছিল অনেককে। পরে কেউ কেউ বিশ্বাসই করলেন না এটা একটা নাবালকের লেখা নাটক। এরপর ' সাবিত্রী সত্যবান ' ' মালতী লতা' মঞ্চস্থ করল হুতোম। যত্নের অভাবে সবই হারিয়ে গেল। জামরুল গাছের মগডালে বসে শুধুই হা-হুতাশ।

এমন মন কষ্টের সময় গাছের কোটোরে বসে হুতোম মন ফিরিয়ে নেয় বস্তির মেয়ে শারির দিকে। কোভিড কালে সে কি প্রাণশক্তি নিয়ে বস্তির আবাসনের মানুষজনকে কোভিডের হাত থেকে রক্ষা করছে শারি। লেখিকা হুতোমের চোখ দিয়ে কোভিড কালে আধুনিক কলকাতার আবাসনের বাস্তব চিত্রটিও তুলে ধরেছেন।

কোভিড কালে হুতোম এর আর এক বিপদ আমফানের ঝড়। সে একবার এডালে বসে তো আর একবার কারো  আবেস্টারে বসে। হুতোম দেখে মিছিল নগরী কলকাতা জনশূন্য। সেদিন বেশ মিটিং বসেছিল। আবার কবে হবে সেই মিটিং ভয় হয় হূতোম এর।

আম ফানের ঝড়ে সব তছনছ। কোথায় সেই উদীয়মান শিল্পী মঞ্জুরীর দাদু রণদেব বাবুর বাড়ি। ঝড়ে হারিয়ে গেছে বাড়ির নিশানা। জন্মের আগে একবার এমন ঝড় হয়েছিল বই পড়ে জেনেছিল সে। হুতোমের কালেও একবার আশ্বিনের ঝড় হয়েছিল। যাক ভাবতে ভাবতে অবশেষে হুতোম খুঁজে পেল সেই বাক্স বাদাম গাছ।

হুতোম এর ডাকে এসে জুটলো রাজাবাবু ভূত। শাঁখ চুন্নি সৌদামিনী ও হাজির। '  ভালবাসিবে বলে ভালবাসিনে। ' নাকি সুরে গাইতে গাইতে এসে হাজির হল টপ্পাভূত। কিন্তু বাবু ভূতের বড় দুঃখ হয় এখন তাকে তেমন কেউ সম্মান করে না। চেনেও না। তবে শোভাবাজার রাজবাড়িতে ধুম করে দুর্গা পুজোটা এখনো হয়।

বিদ্যাসাগরকে বড্ড মিস করে হুতোম তার নকশাকে কলকাতার কেচ্ছা বলে দাগিয়ে দিল কলকাতার বাবুরা। তারপর বিদ্যাসাগরের অনুরোধে সে লিখেছিল মহাভারত। দ্বিতীয় অধিবেশন জমে উঠলো রণদেব মুখুজ্জের বিয়ের গল্পে। হুতোমের আসরে লেখিকা সেকালের বাংলার পটচিত্র শিল্পের কথা পাঠককে কিছুটা হলেও ধারণা দিলেন।

হুতোম গাছের মগডালে বসে মনে মনে একপ্রকার প্রতিজ্ঞাই করে ফেলল এই প্যাঁচার শরীর ছেড়ে দুর্গা বাবু বা লক্ষী বাবু হয়ে এই কলকাতা শহরেই জন্ম নিতে চায়। আড়াই লক্ষ টাকা নিজের পকেট থেকে খরচ হয়েছিল তার মহাভারতের অনুবাদ করতে গিয়ে। একের পর এক মামলাতে সিংহ বাড়ির সব সম্পত্তি বিক্রি হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত কাঠগড়ায় পর্যন্ত যেতে হয়েছিল তাকে। সেসব কথা মনে পড়তেই দু'চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে তার। গাছের ডালে চোখের জল মোছে হুতোম। শেষমেষ বাবু ভূত আর হুতোম দুজনেই একসঙ্গে ঠিক করে এবার জন্ম নিয়ে তারা বাঙালি বাবুর চরিত্র নিয়ে হাইপোথিসিস লিখবে।

হুতোম এর মুখ দিয়ে লেখিকা সে কালের পুরনো কলকাতার চিত্রটি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। তবে হুতোম যেখানে নায়ক সেখানে কৌতুক প্রিয়তার আর একটু থাকলে ভালো লাগত। বইটির প্রচ্ছদে ই হুতোম এর ভারাক্রান্ত মুখের ছবি। হুতোম তাকিয়ে আছে একালের কলকাতার মানুষের দিকে। আজকাল খুব কম পাঠকই হুতোম পেঁচার নকশা বইটি পড়ে। এমন সহজ সরল গদ্যে পুরনো কলকাতার গল্প শুনতে হলে  ' কোভিড কালে হুতোম এল '  বইটি সংগ্রহে রাখা ভালো। সেইসঙ্গে মারণ সেই কোভিড রোগে আমাদের সবার যাপন এই বইয়ের শারি চরিত্রটিকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে যেন। তাই হুতোমের ভূতপূর্ব সেই প্রেমিকা বর্তমানের এই শারির মুখ দিয়ে লেখিকা বলিয়েছেন কোভিডকাল যাপনের সংলাপ। সেও আমাদের বড় প্রাপ্তি।