২৮ সেপ, ২০২৩

কোভিড কালে হুতোম এল / ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় রিভিউ লিখলেন ডঃ জয়ন্তী মণ্ডল (রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা বিভাগ)



কোভিড কালে হুতোম এল

ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

মূল্য - ২০০

রা' প্রকাশন

বই নয় যেন দেড়শ বছর আগের পুরোনো কলকাতার এক ঘন কালো ছবি। এটাও একপ্রকার স্মৃতি গ্রন্থ। তবে কলকাতার এক ঘন পাতার জামরুল গাছের ডালে বসেছিল দেড়শ বছর আগের বাঙালি বাবু বিবিদের অশরীরী ভূতেদের স্মৃতির আড্ডা। এদের সঙ্গে এসে জুটল দেড়শ বছর আগের ক্ষণজন্মা বাঙালি বাবু কালীপ্রসন্ন সিংহ। কালীপ্রসন্ন অবশ্য একালে হুতোম প্যাঁচা হয়েই জন্মেছে। সেও প্রাণের শহর কলকাতাকে দেখবে বলে অশরীরী বাবু বিবিদের আড্ডায়। পাঠক গ্রন্থটি পড়তে পড়তে চলে যাবেন আগেকার পুরনো কলকাতায়। স্মৃতিপটে ভেসে উঠবে সেকালের কলকাতাবাসীর এক চমৎকার ছবি। এই অশরীরী ভূতেদের চোখ দিয়েও যদি পুরনো কলকাতাকে একবার দেখতে  পায় তো মন্দ কী?

লেখকের কল্পনার সুতোয় জাল বোনা এক অদ্ভুত কাহিনি যেন। প্রতি মুহূর্তেই লেখক শরণাপন্ন হয়েছেন সেই বহু চর্চিত, বিতর্কিত কালজয়ী গ্রন্থ "হুতোম পেঁচার নকশা"র উল্লেখযোগ্য অংশগুলির উল্লেখ বর্তমান প্রজন্মের পাঠক পাঠিকাদের ভাবাবে। আর সেই পুরনো কাহিনির মোড়কে নতুন এবং আধুনিক ভাবে লেখা বাংলার সব নামীদামী মানুষের চরিত্রেরা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে এ বইতে। 

অনেক খুঁজে খুঁজে হুতোম কলকাতাতে এসে জুটেছে। কেমন লাগছে হুতোমের? বহুকাল আগের দেখা কলকাতা আর এখন চলমান কলকাতাকে সে মেলাতে চাই। কখনো স্মৃতির অতলে অবগাহন করে তুলে আনতে চায় পুরনো সেসব দিনের কথা। হুতোমের চোখে ভেসে ওঠে পুরনো কলকাতার বাবুরা কেমন করে ঘোড়ায় চড়ে অফিসে যেতেন। তারপর এল জমিদারদের বজরা, সাহেব বিবিদের ফিটন গাড়ি থেকে যানবাহন জায়গা নিল ঘোড়ায় টানা ট্রাম। হুতোম দেখে ঘোড়ার গাড়ির বংশ পরম্পরায় মালিকেরা এখনো এই শহরেই রয়ে গেছে। তবে তারা অন্য পেশায় অবাঙ্গালীদের বিয়ে বাড়ির প্রশেসনে ঘোড়াগুলোকে ভাড়া দিয়ে জীবন চালায়। হুতোম অবশ্য ট্রাম দেখে যেতে পারেনি। 

এখন তার আস্তানা কখনো পুরনো বাড়ির ছাদের আলসেতে তো কখনো কারো জানালার কার্নিশে। গাছের কোটরে বসে বসে তার স্মৃতি ছুটে বেড়াই একবার এ জন্মে আর একবার গত জন্মের কলকাতাতে। মাত্র তিরিশটা বছর সে কলকাতাকে দেখেছিল। হুতোমের একটাই আফসোস আগের জন্মের মতো যদি কলকাতাকে নিয়ে এ জন্মে দুটো কথা লিখতে পারত। 

এক অশরীরী ভুতের সঙ্গে হুতোমের কলকাতার অলিগলি বেয়ে চলা ট্রামে গল্প জমে ওঠে। তবে অশরীরী বন্ধু ভূত হুতোমকে জানাই খুব শীঘ্রই ট্রাম এ শহর থেকে বিদায় নেবে। হুতোম এর চোখে ভেসে ওঠে পুরনো কলকাতার গোবিন্দরাম মিত্রের আপার সার্কুলার রোডে বাগানবাড়ির নন্দন বাগানের কথা। গোবিন্দ রাম  চিতপুর রোডে নবরত্ন মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যার চূড়া ১৬৫ ফুট মনুমেন্টের চেয়েও উঁচু। অবশ্য ১৭৩৭ এর ভূমিকম্পে মন্দিরের চূড়া ভেঙে যায়। এসব কথা সে বই এ পড়েছে।

কখন যেন ভূত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব একসঙ্গে কথা বলে ওঠে এ উপন্যাসের মাধ্যমে। 

হুতোম ঠাকুমার মুখে শুনেছে, জব চার্ণক যখন কলকাতায় আসেন তখন কলকাতার লালদিঘি নিয়ে খুব উত্তেজনা ছিল। পলাশীর যুদ্ধের ঠিক আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ভয়ানক যুদ্ধ হয়েছিল এই লালদিঘিতে। হুতুম তার নকশাতে লিখেছিল কলকাতায় কেমন সন্ধ্যে বেলা রামায়ণ,মহাভারত, পুরাণ পাঠের সমবেত আসর বসার কথা। একালে টপ্পা গান বাজলে বা চড়ক এলে হুতোমের কানে ভেসে ওঠে সেকালের টুনোয়ার সেই টপ্পা গান – 

' কহই টুনোয়া -

শহর শিখাওয়ে কোতোয়ালী ' 

চিৎপুরের রাস্তায় জেলেপাড়ার সঙ্গের কথা লিখেছিল সে তার নকশায়। বাবুরা কালীঘাটের চড়ক দেখতে গিয়ে দেখতেন মত্ত সন্ন্যাসীদের নৃত্য আর কেরাঞ্চি গাড়ি করে বেশ্যার আগমন।

স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে মাহেশের স্নানযাত্রা। বাবুরা বজরা ভাড়া করে মদ গাঁজা নিয়ে নৌকায় উঠতেন। স্নানযাত্রার পর বাইনাচের আসর বসত। বাবুদের সাজসজ্জা ছিল তেমন। গায়ে পিতলের বোতাম দেওয়া সবুজ ফ্তুই, আর ঢাকায় উড়নি। পরনে শান্তিপুরী ধুতি। রাতের কলকাতায় কান পাতলেই শোনা যেত ঘুঙুরের আওয়াজ। এখন শহরজুড়ে শুধুই হইহুল্লোড়।

কখনো কখনো আকাশপথে উড়তে উড়তে হুতোম একালের রথযাত্রা দেখে। মনে পড়ে সেকালের রথের কথা। জানবাজারের রাসমণির স্বামী রামচন্দ্র দাসের রুপোর রথ টানতো দুটি সুসজ্জিত ঘোড়া, রথের সঙ্গে বের হতো কলকাতার সং।

দুর্গাপুজো এলে হুতোমের বুকটা হুহু করে ওঠে। তখন দুর্গাপুজো হতো কি বিরাট করে বাবুদের বাড়িতে। পাল্লা দিয়ে চলত সাহেব বিবিদের নেমন্তন্ন। তাদের বিনোদনের জন্য নর্তকীদের আনা হতো মোটা মাইনে দিয়ে। নিকি নামের নর্তকী ছিল সবার সেরা। তারপর এসেছিল বুলবুল। এখনকার শহরের আনাচে-কানাচে থিমের বারোয়ারি পূজোর আলোর ঝলকানিতে চোখ ঝলসে যায় হুতোমের। পুজো মিটলে বাঁচে হুতোম।

লেখক চমৎকার বয়ানে, কল্পনার জাল বুনেছেন ধীরে ধীরে। সেখানে বাস্তব আর কল্পনা যেন রুপকথা হয়ে উঠেছে এক একবার। 

হুতোম দক্ষিণ কলকাতার এক বিরাট গাছের মগডালে বসে বসে কখনো দেখে এ কালের আবাসনের ঝগড়া। তার চোখ চলে যায় বাবুদের হাতে শ্লেট এর মতো জিনিসটাই। এ যুগের বাবুরা আঙুল দিয়ে তার উপর কি সব হিসেব করে চলে।  হুতোম ভাবে এই বাবুরাই আবার গাড়ি হাঁকিয়ে সন্ধ্যেবেলা কোথায় যায়? 

অমনি গাছের ফাঁক থেকে নাকি সুর এক অশরীরী বলে ওঠে কোথায় আবার ক্লাবে আড্ডা দিতে যাচ্ছে। একালের বাবুদেরও এক আধটা উপপত্নী থাকে। কিন্তু স্ত্রীকে তারা সম্মানও দেয় আসলে বুদ্ধিমান নব্য বাবুরা আটঘাট বেঁধে নামে। হুতোম দেখে একালের বিবিরা সন্ধ্যেবেলা লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়ে না। তখন তারা কিটি পার্টি করে, ফেসবুক করে। অশরীরী ভূত নাকি কণ্ঠে আর হুতোম গাছের ডালে ঠোঁট ঠুকে ঠুকে দুজনেই স্মৃতির অতলে ডুব দিয়ে চলে যায় মহাভারতের যুগে, শশাঙ্কের আমলে, ইসলামী আমল হয়ে একেবারে ইংরেজ আমল।

এমন সময় এসে জুটলো এক নারী কণ্ঠী পেত্নী সে যুগের কবিয়াল এন্টনি ফিরিঙ্গির স্ত্রী সৌদামিনী। সেকালের বিখ্যাত টপ্পা গায়ক রামনিধি গুপ্তের অশরীরী  ভূত সঙ্গ দিল এদের সঙ্গে। তিনজনে মিলে বেশ জমেছে আড্ডা। লেখিকা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাবু রাজা নব কৃষ্ণের অশরীরী ভূতটাকেও এনে জমিয়ে দিলেন ভূতেদের আড্ডায়। অবশ্য হুতোম এ যুগে জীবন্ত একটা পাখি হয়ে জন্মেছে।

রাজা নব কৃষ্ণের অশরীরী ভুতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে আড্ডা অন্য মাত্রা পেল। হুতোম যেন তার নকশায় আঁকা বাবুদের এ যুগে একবার হাতে পেল। ক্লাইভের সঙ্গে নবকৃষ্ণ বাবুর জোট বেঁধে সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসন চ্যুতের কথা গল্পচ্ছলে বলতে ছাড়ল না হুতোম। টপ্পা ভূত আর হুতোমের কথোপকথনে সেকালের বাবুদের স্বেচ্ছাচার, জমিদারদের আমোদ প্রমোদ, বাংলার দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর, যুদ্ধে ক্ষত বিক্ষত বাঙালির কথা যখন ওঠে তখন বাবুভূত রেগে ওঠেন। রামনিধি বাবুর সেই কালজয়ী টপ্পা অশ্লীলতা দায় দেখিয়ে রক্ষণশীলদের জোটবদ্ধ হওয়ার কথা  রমনিধি গুপ্তের ভূত বলে আস মেটাল একালে। সে দুঃখ আজও টপ্পা ভূতের রয়ে গেছে। একটা শান্তি যখন দেখে তাদের গান নিয়ে এখনকার ছাত্র-ছাত্রীরা গবেষণা করছে তখন আনন্দে ভরে ওঠে মনটা তার।

ভূত পেত্নীদের আড্ডা শেষ হতে হতে ভোর। গাছের কোটরে হুতোম ঘুমোয় । মানুষের কলরবে ঘুম পাতলা হয়ে যায় হুতোম এর। রাতের মজলিসের কথা বসে বসে ভাবে সে। এ জন্মে তো সে লিখতে পারেনা। সেকালে কলকাতাকে দেখে নকশা লিখেছিল সে। সবে বাবুদের জমিদারি শুরু।  বাঙালি সেদিন কেমন করে বাবু তৈরি হয়েছিল তা হুতোমের নিজের চোখে দেখা তাই তো সে তার নকশা তে লিখেছিল। তা নিয়ে সমাজ উত্তাল। এর জন্য বাবুদের কাছ থেকে কম লাঞ্ছনা গঞ্জনা শুনতে হয়নি তাকে। শেষে মহাভারতের অনুবাদ করে সেই বই বিলিয়ে দিয়ে দেউলিয়া হয়ে গেল।

এর মধ্যে আবার নতুন বিপদ। হুতোম পেঁচা কে দেখে তার ডাক শুনে আবারো অমঙ্গলের ইঙ্গিত পায় কলকাতাবাসী। কোভিড কালে হুতোম এলো। অতিমারি সে দেখেনি। মন্বন্তরের নাম শুনেছিল। এই অতিমারি তাও তার প্রাণের শহর কলকাতায়! হুতোম দেখে কোভিডের হাত থেকে বাঁচার জন্য বস্তির পাগলী শারি সকলের মঙ্গলের আকাঙ্ক্ষায় বন্ধ শেতলা মন্দিরে গিয়ে অশ্বস্থ গাছের নিচে ফুল আর একটা টাকা রেখে আসে। হুতোম এমন একটা শারি কে সে জীবনে চেয়েছিল কিন্তু পাইনি।

শারিকে দেখে হুতোমের মনে পড়ে যায় গত জন্মের কথা, ছ বছর বয়সে বাবা মারা যান। হিন্দু কলেজে ভর্তি হলেও ঠাট্টা ইয়ার্কি আর দুষ্টুমিতে ওস্তাদ ছেলের কলেজের পাঠ চুকোতে হলো। অগত্যা বাড়িতেই পাঠ নিতে হয় তাকে। রাতে ঘুমোতে গিয়ে ঠাকুমার মুখে রামায়ণ, মহাভারতের গল্প শোনে। ঠাকুমা শোনান তার জন্মের ও আগের কলকাতার গল্প।

গাছের কোটোরে বসে গোল গোল চোখ ঘুরিয়ে অতীতের স্মৃতিতে ডুব দেয় তের বছরের কিশোরের বিয়ের স্মৃতি। বর কালীপ্রসন্ন সিংহ। কি বিরাট আয়োজন হয়েছিল সেদিন। একদিন দেশীয় বাবুদের নিয়ে নাচ গান উৎসব। ব্রাহ্মণদের বিদায় দক্ষিণার কি আয়োজন! ঘড়া, থালা, শঙ্খ, রুপোর থালা-বাসন আরো কত কি! ক বছরের মধ্যে চলে গেল বাগবাজারের বসু পরিবারের একরত্তি মেয়েটা। আবার দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ সেও টিকলো না। সারস্বত সমাজকে নিয়েই সে ভুলে থাকতে চাইলে সবকিছু। দান  ধ্যানেও সিদ্ধ হস্ত ছিল হুতোম। কখনো বিদ্যাসাগর কে কখনো মধুসূদন কে দিয়েছেন টাকা। শেষে নিজেই হয়ে গিয়েছিল মাথা অবধি দেনার দায়ী।

কলকাতার বাঙালি বাবুরা যখন দিনে ঘুমিয়ে রাতে বাইজি নৃত্য দেখে, ঘুড়ি উড়িয়ে, পায়রা উড়িয়ে, বুলবুলির লড়াই দেখে দিন যাপন করে হুতোম তখন সারস্বত চর্চার নতুন নেশায়। মাত্র তখন তার ষোল বছর বয়স। বাংলার নাট্যমঞ্চের দরকার ভেবে নিজের বাড়িতেই তৈরি করল 'বিদ্যোৎসাহিনী' থিয়েটার। সেখানে রামনারায়ণ তর্ক রত্নের ' বেণীসংহার' নাটক মঞ্চস্থ হলো। প্রশংসিত জনতার মুখের দিকে তাকিয়ে হুতোম আবার কালিদাসের বিক্রমোবর্শী, নাটকের অনুবাদ করে মঞ্চস্থ করল। কালীপ্রসনের অভিনয় দেখার জন্য হলে সেদিন লোক ধরেনি। ফিরে যেতে হয়েছিল অনেককে। পরে কেউ কেউ বিশ্বাসই করলেন না এটা একটা নাবালকের লেখা নাটক। এরপর ' সাবিত্রী সত্যবান ' ' মালতী লতা' মঞ্চস্থ করল হুতোম। যত্নের অভাবে সবই হারিয়ে গেল। জামরুল গাছের মগডালে বসে শুধুই হা-হুতাশ।

এমন মন কষ্টের সময় গাছের কোটোরে বসে হুতোম মন ফিরিয়ে নেয় বস্তির মেয়ে শারির দিকে। কোভিড কালে সে কি প্রাণশক্তি নিয়ে বস্তির আবাসনের মানুষজনকে কোভিডের হাত থেকে রক্ষা করছে শারি। লেখিকা হুতোমের চোখ দিয়ে কোভিড কালে আধুনিক কলকাতার আবাসনের বাস্তব চিত্রটিও তুলে ধরেছেন।

কোভিড কালে হুতোম এর আর এক বিপদ আমফানের ঝড়। সে একবার এডালে বসে তো আর একবার কারো  আবেস্টারে বসে। হুতোম দেখে মিছিল নগরী কলকাতা জনশূন্য। সেদিন বেশ মিটিং বসেছিল। আবার কবে হবে সেই মিটিং ভয় হয় হূতোম এর।

আম ফানের ঝড়ে সব তছনছ। কোথায় সেই উদীয়মান শিল্পী মঞ্জুরীর দাদু রণদেব বাবুর বাড়ি। ঝড়ে হারিয়ে গেছে বাড়ির নিশানা। জন্মের আগে একবার এমন ঝড় হয়েছিল বই পড়ে জেনেছিল সে। হুতোমের কালেও একবার আশ্বিনের ঝড় হয়েছিল। যাক ভাবতে ভাবতে অবশেষে হুতোম খুঁজে পেল সেই বাক্স বাদাম গাছ।

হুতোম এর ডাকে এসে জুটলো রাজাবাবু ভূত। শাঁখ চুন্নি সৌদামিনী ও হাজির। '  ভালবাসিবে বলে ভালবাসিনে। ' নাকি সুরে গাইতে গাইতে এসে হাজির হল টপ্পাভূত। কিন্তু বাবু ভূতের বড় দুঃখ হয় এখন তাকে তেমন কেউ সম্মান করে না। চেনেও না। তবে শোভাবাজার রাজবাড়িতে ধুম করে দুর্গা পুজোটা এখনো হয়।

বিদ্যাসাগরকে বড্ড মিস করে হুতোম তার নকশাকে কলকাতার কেচ্ছা বলে দাগিয়ে দিল কলকাতার বাবুরা। তারপর বিদ্যাসাগরের অনুরোধে সে লিখেছিল মহাভারত। দ্বিতীয় অধিবেশন জমে উঠলো রণদেব মুখুজ্জের বিয়ের গল্পে। হুতোমের আসরে লেখিকা সেকালের বাংলার পটচিত্র শিল্পের কথা পাঠককে কিছুটা হলেও ধারণা দিলেন।

হুতোম গাছের মগডালে বসে মনে মনে একপ্রকার প্রতিজ্ঞাই করে ফেলল এই প্যাঁচার শরীর ছেড়ে দুর্গা বাবু বা লক্ষী বাবু হয়ে এই কলকাতা শহরেই জন্ম নিতে চায়। আড়াই লক্ষ টাকা নিজের পকেট থেকে খরচ হয়েছিল তার মহাভারতের অনুবাদ করতে গিয়ে। একের পর এক মামলাতে সিংহ বাড়ির সব সম্পত্তি বিক্রি হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত কাঠগড়ায় পর্যন্ত যেতে হয়েছিল তাকে। সেসব কথা মনে পড়তেই দু'চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে তার। গাছের ডালে চোখের জল মোছে হুতোম। শেষমেষ বাবু ভূত আর হুতোম দুজনেই একসঙ্গে ঠিক করে এবার জন্ম নিয়ে তারা বাঙালি বাবুর চরিত্র নিয়ে হাইপোথিসিস লিখবে।

হুতোম এর মুখ দিয়ে লেখিকা সে কালের পুরনো কলকাতার চিত্রটি চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। তবে হুতোম যেখানে নায়ক সেখানে কৌতুক প্রিয়তার আর একটু থাকলে ভালো লাগত। বইটির প্রচ্ছদে ই হুতোম এর ভারাক্রান্ত মুখের ছবি। হুতোম তাকিয়ে আছে একালের কলকাতার মানুষের দিকে। আজকাল খুব কম পাঠকই হুতোম পেঁচার নকশা বইটি পড়ে। এমন সহজ সরল গদ্যে পুরনো কলকাতার গল্প শুনতে হলে  ' কোভিড কালে হুতোম এল '  বইটি সংগ্রহে রাখা ভালো। সেইসঙ্গে মারণ সেই কোভিড রোগে আমাদের সবার যাপন এই বইয়ের শারি চরিত্রটিকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে যেন। তাই হুতোমের ভূতপূর্ব সেই প্রেমিকা বর্তমানের এই শারির মুখ দিয়ে লেখিকা বলিয়েছেন কোভিডকাল যাপনের সংলাপ। সেও আমাদের বড় প্রাপ্তি। 


কোন মন্তব্য নেই: