১৪ ফেব, ২০১৭

ভ্যালেন্টাইনস ডে

ভ্যালেন্টাইনস ডে ছিল না আমাদের সময়ে । কিন্তু তখনো প্রেমে পড়ত ছেলেমেয়েরা । আর বসন্ত এলেই প্রেমের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিত তারা । যেমন এখনো দেয় সকলে।  পালন করত নিত্য নতুন ভ্যালেন্টাইনস ডে । কখনো হোলি, কখনো সরস্বতী পুজো কে উপলক্ষ করে। 
আর প্রণয়ের পারাবারে সাঁতার কাটতে কাটতে বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীরা ? দৈনন্দীন জীবনের একঘেয়েমিতে কেমন পাগল পাগল ভাব নিয়ে  তারাও মাঝে মাঝে পালন করত ভ্যালেন্টাইন্স ডে । স্বামী তার বিশেষ দিনটিতে স্ত্রীয়ের জন্য ছোট খাট সোনার গয়না কিনে উপহার দিতেন । অথবা আচমকা নিয়ে আসতেন বম্বেডাইং এর ফুলকাটা সুন্দর ডাবল বেডশিট। কোনও বার গিন্নীর জন্যে একটা ফুরফুরে পাতলা ডি সি এম এর ভয়েল কিম্বা  ফুলিয়ার টাঙ্গাইল।  অফিস থেকে ফেরার পথে, জলযোগের মাংসের প্যাটিস কিম্বা ফারপোর ফ্রেশলি বেকড কেক নিয়ে বাড়ি ফিরে বলতেন... 
"কি গো চা বসাও ? দেখ আজ কি এনেছি, তোমার জন্যে" 
কিম্বা পকেট থেকে বের করতেন বিশ্বরূপা, রঙমহল এর নাটকের সস্তার টিকিট দুটি। 
সদ্য শীতের আলস্য কাটিয়ে তাঁর গৃহিণীটি ঘরের মধ্যে থেকে গা ধুয়ে কিউটিকিউরার ফুলেল গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে নরম ছাপা শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে সলজ্জে যেন হাতে চাঁদ পেতেন। কত অল্পে খুশী ছিলেন এঁরা। এগুলি যেন সংসার করার পার্কস বা উপরি পাওনা, বোনাসের মত। এ সব দেখেছি আমাদের বাবা মায়েদের আমলে ।
মনে আছে এমনি মধুর নাতিশীতোষ্ণ সময়ে একবার কলকাতার বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনের সারারাত ব্যাপী জলসার টিকিট এনেছিলেন বাবা। হেমন্ত-আরতির গান দুজনেরি খুব পছন্দ। আর তখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় খ্যাতির শীর্ষে আর আরতি মুখোপাধ্যায় নবাগতা। এই সারপ্রাইজে মায়ের মুখের হাসিটুকু বাঁধিয়ে রাখা হয়নি কারণ আমি তখন মাত্র ক্লাস ফোর এ।   
স্কুল জীবনের সরস্বতী পুজোর স্মৃতিটা বেশ অন্য ধরণের । যত বড় ক্লাস তত দায়িত্ত্ব । আর ক্লাস টেনের পুজোটা সবচেয়ে সুখের । সেখানে ছোটোদের ওপর দিদিগিরি আর যারপরনেই ফতোয়া জারি করা । সরস্বতী পুজোটা যেন প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পাসপোর্ট হাতে পাওয়া । মায়ের হলদে শাড়ি পরে সেজে গুজে একদম ফিল্মি লুক নিয়ে স্কুলের পুজোয় সামিল হওয়া । কিন্তু আমি যে কলেজে পড়েছি সেই কলেজে মা সরস্বতী কলেজ-কন্যাদের রক্ষণশীলতার বেড়াজালেই শুধু আবদ্ধ রেখেছিলেন । মা সরস্বতীর পুজো সে কলেজে ব্রাত্য । অগত্যা বাড়িতে নিজেদের মত করে পুজো করে যে যার গ্রুপ তৈরী করে বেরোনো । ঠাকুর দেখা, খাওয়াদাওয়া, সিনেমা দেখা ব্যাস্‌ ! ঐ অবধি । ভ্যালেন্টাইনস ডে ছিলনা শেষ আশির দশকে । অতএব নো প্রেম-প্রেম খেলা বা ভ্যালেন্টাইন উত্সব । সরস্বতী পুজোই আমাদের বসন্তের একমাত্র বহু প্রতীক্ষিত বসন্ত উত্সব ছিল । ফাগুণ হাওয়ায়, রঙে রঙে বেশ ছিলাম আমরা । ডিজিটাল গোলাপ ছিলনা, মুঠোফোনের রিংটোনে সংক্ষিপ্ত সংবাদ আসতনা হয়ত কিন্তু ভালোবাসা ছিল সরস্বতীর প্রতি ।



আমাদের বিয়ের ঠিক আশপাশের সময় থেকে শুরু হ'ল ভ্যালেন্টাইন্স ডে । লেট আশির দশকে । ব্যাস! সেই থেকে শুরু "ভ্যালেন্টাইন প্যাকেজ"  ফুলের দোকান থেকে শুরু করে গ্রিটিংস কার্ড , গয়না থেকে কেক, মকটেল, কফি, আইস ক্রিম সর্বত্র সেই তীর বিদ্ধ হৃদয়ের ছবি !  শপিং মলে ঝুলছে বিশাল বিশাল রক্তাক্ত হৃদয়, টিভির পরদায় প্রেমের গান, প্রেমের ছবি, প্রেমের কবিতা আবৃত্তি । আর এসেমেসের চোটে আগের দিন মধ্য রাত থেকে সেলফোনের নেট ওয়ার্ক হ'ল বেজায় স্লো হওয়া... এসব ও দেখেছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেলফোন হাতে নিয়ে মুচকি হেসে কথা বলা? এসব ও দেখেছি বহুত। আর ল্যাপটপে চ্যাটালাপ? আর ম-বাবার ঝটিতি আগমন এ কন্ট্রোল টি মেরে অন্য ট্যাব খুলে গা ঢাকা দেওয়া? তাও দেখেছি। 
সামনেই সব ছেলেপুলেদের বড় বড় পরীক্ষা ! তো কি ? পরীক্ষার আগে একটু ডাইভারশান চাই না ? তাই তো সাধু ভ্যালেন্টাইন এই উপায় বাতলেছেন ।
গতবছর ভ্যালেন্টাইন্স ডে'র দিন সকালে মর্নিং ওয়াকে গেছি; এক ভদ্রলোক তার সহধর্মিনীকে বলছেন " এই রোজ রোজ তোমার পাল্লায় পড়ে সকালে হাঁটতে বেরোনো আমার জীবন বিষময় করে তুলছে" 
নীরব স্ত্রীটি হাঁটতে লাগলেন আরো জোরে জোরে । 
ভদ্রলোক বললেন " খাবার ওপর ট্যাক্স ও বসালে , আর হাঁটাও ধরালে ...তাহলে যেকোনো একটাই করো হয় খেতে দিও না, নয় হাঁটতে  বোলোনা"আমার মা বেঁচে থাকলে দেখিয়ে দিত তোমার মজা  সব কিছুতেই  কাঁটছাঁট ! চায়ে চিনি বন্ধ , সকালে একগাদা ফল খাও , দুপুরে ভাত নৈব নৈব চ ! রাতে মোটে একটা রুটি ! কি কুক্ষণে একটা সেমি-ডায়েটিশিয়ান বৌ এনেছিলাম" 
বেচারী বৌটি তখনো চুপ !  
স্বামীটি আবারো বললে " দাঁড়াও দেখাব মজা , অফিসের বেয়ারাকে দিয়ে ভাল ভাল খাবার আনিয়ে খাব, তুমি জানতেও পারবে না" 
তখন বৌটি আর থাকতে না পেরে মুখ খুলল "আজকের দিনে ঝগড়া করতে  নেই গো , আজ প্রেমের দিন, আজ আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা প্রেমের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে আর তুমি কি না শুধুমুদু আমাকে সক্কালবেলা গালাগালি দিচ্ছ ? আমি যে তোমার ওয়ান এন্ড ওনলি ভ্যালেন্টাইন !" 
একটা সময় ছিল যখন বসন্তের প্রথমদিনে লালগোলাপ দিয়ে ভালোবাসার কোর্টশিপ চালু  হত । দোল  রঙীন হত  নীল খামে পারফিউম মাখানো চিঠির ভাঁজে লিপষ্টিকের চুমু দিয়ে ।  লুকিয়ে চুরিয়ে পার্কে গিয়ে দেখা করে কিম্বা কলেজ পালিয়ে কফিহাউসের টেবিলে মুখোমুখি হয়ে, হেদুয়া থেকে শ্যামবাজার গা ঘেঁষে ঘেঁষে হেঁটে  বাসে ওঠা ; আবার মনখারাপের পার্টির তোড়জোড় । আবার কবে হবে দেখা ? বাড়ির বড়দের চোখ এড়িয়ে চুপিচুপি লেটারবাক্স হাতড়ে চিঠি খোঁজা । টানটান উত্তেজনায় চিলেকোঠার দুপুরগুলোয় সেই কফিহাউসের স্মৃতির লালন চলত আবার যতদিন না দেখা হয় দুটিতে ।

ভাগ্যি সোশ্যালনেটওয়ার্ক ছিল প্রেমের সাথে । ভালোবাসার বৃত্তটা কিন্তু ছড়িয়েছে আগের থেকে । কত চোখ এড়িয়ে প্রেম বেঁচে বরতে থাকে দিনের পর দিন রাতের পর রাত ।    এখন   ভালোবাসার বাতাস বয় অর্কুট অলিন্দে। ফেসবুক উজাড় করে ঘন্টার পর ঘন্টা  ভালোবাসা পেরয় ডিঙিনৌকো করে । ডিজিটাল ঢেউ পেরিয়ে ট্যুইটারের চিলেকোঠাতেও মুখ লুকোয় সেই প্রেম ।


 প্রেম ছিল তাই রক্ষে! প্রোপোজ ডে, কিসিং ডে, ভ্যালেন্টাইন্স ডে, হাগ ডে,  দোল   ... এই সব দিনগুলোতো  ঐ প্রেমকেই ঝালিয়ে নেবার জন্যেই। প্রেম না থাকলে সকালটা এত মিষ্টি হত? সারারাত ধরে অনলাইন চ্যাট করে রাতে আধোঘুমে স্বপ্নসুন্দরীকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে কোথা দিয়ে একটা সুন্দর সকাল এসে পড়ল ! আর এই মোবাইলফোন ? সেও তো প্রেমের একটা দারুন পজিটিভ ক্যাটালিস্ট । কত সহজে একটা কথা মেসেজ করে জানিয়ে শুরু হয়ে যায় প্রেম । আর ঐ বিশেষ দিন গুলোতে  মনের মানুষটির হাতের মুঠোয়   ভালোবাসার দুটো কথা টুক করে চলে যায় । আঙুলে আঙুলে এমন চটপট প্রেম কিন্তু আগে ছিল না । এখন অনেক সহজ হয়েছে দুনিয়া ।বাজারে   গ্রিটিংস কার্ডের হার্ডকপি  ফুরোল, ভালোবাসার নটেগাছ লকলক করে ডালপালা বিস্তার করে দিল ওয়েব দুনিয়ায় ।


ভালোবাসার উপহারের তালিকায় কাফলিঙ্ক, টাইপিন  এখন অবসোলিট ; আইপড কিম্বা পেনড্রাইভের কাটতি বেশী ।   ভালোবাসার কবিতার খাতা লুকিয়ে থাকত বালিশের নীচে । আর এখন সেই কবিতা ঝরে ঝরে পড়ছে ফেসবুকের বারান্দায়, কার্ণিশে সর্বত্র । তবে ভালোবাসা আছে ভালোবাসাতেই । ভালোবাসা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে । শুধু আগে  শাড়িতে ব্লাউজে ছিল এখন কুর্তি, কেপরি লেহেঙ্গা আর জিনসে ।
তখন ছিল তরতাজা সত্যি গোলাপ । আর এখন তা ডিজিটাল গোলাপ । ছিল বসন্ত কেবিনে দুজনে মুখোমুখি দুটো ডিমের ডেভিল কিম্বা ফাউল কাটলেট । এখনো সেই সংজ্ঞা বদলায়নি কিন্তু চপ-কাটলেট থেকে প্রেম এখন বার্গার-মকটেলে আছড়ে পড়েছে অবিরত । 


ভালোবাসার চুপকথারা তখনো ছিল এখনো আছে শুধু বদলেছে তার মোড়ক । এখন চুপকে চুপকে নয়, ওপেন সিকরেট ।   তখন এই কূলে আমি আর ঐ কূলে তুমি টাইপের একটা ব্যাপার ছিল আর এখন অর্কুটে আমি আর ফেসবুকে তুমি মাঝখানে একরাশ ডেজিটাল ঢেউ । কিন্তু এখন ভালোবাসা আরো স্মার্ট হয়েছে ।  গুরুজনের সামনে ধরা পড়ে গেলে  কন্ট্রোল টি মেরে পালাও । তখন কিন্তু কাপড়ে চোপড়ে টাইপের অবস্থা ছিল । ভালোবাসার আয়ু বেড়ে গেল ভ্যালেন্টাইন পুজোর দৌলতে, আন্তর্জালের কৃপায় । মাঝখান থেকে বসন্তের কোকিল এই টেক দুনিয়া ছেড়ে পালিয়ে গেল । মোবাইল  রিংটোনের  দাপটে তার নিজেরই আজ ভাল্লাগেনা কুহুতান  ধরতে ।

আর ভালোবাসার উষ্ণতার পারদও চড়ছে বসন্ত সমাগমে । কারণটা কি গ্লোবাল ওয়ার্মিং ???    

বসন্ত এসে গেছে

তুচক্রের নির্ঘন্ট মেনে বসন্ত এসে গেছে। শীত পড়বে কি পড়বে না এই শুনতে শুনতে সুপর্ণারাও হাঁফিয়ে উঠেছে  আর সেই ফাঁকে সব শত্রুমুখে ছাই দিয়ে  মাঘের মধ্যিখনেই বিদায়ী শীতের পাততাড়ি গুটিয়ে নিয়ে ফিরে যাবার তোড়জোড়। আর আমাদেরো লেপ-বালাপোষ-লাইসেম্পি আর যাবতীয় শখের শীত পোষাকদের ন্যাপথলিন বলের আড়ালে মুখ লুকোনো।
শান্তিনিকতনি ঘরাণায় কলকাতার বাঙালীর মাঘোত্সব যেন ব‌ইমেলা। আর সেই ব‌ইমেলার ফুরিয়ে যাওয়া মানেই শীতের যাই যাই ভাব। তখন স্মরণে, মননে বসন্ত জাগ্রত তার ঘরে। যেন এইটুকুনির পথ চেয়ে সারাটা বছর বসে থাকা। আর যদি শীত বাই বাই করে নাকের ডগা দিয়ে চলেই যায়, তাকে অলবিদা জানিয়ে বসন্তকে ওয়েলকাম করাটাই আমাদের একমাত্র লুকিং ফরওয়ার্ড, গোল অফ লাইফ। বসন্ত এসে গেছে।
যাই দেখি কোকিলার প্রসব বেদনা উঠল কি না! কোকিলগুলো ঠিক বুঝতে পারে। ওদের বাসা বানানোর চাপ নেই। স্বার্থপরের মত কাকের বাসায় ডিমটা পেড়েই খালাস। করণটা বসন্ত। এখন আর সময় নেই বাসা বাঁধবার। অলস কোকিল এর  পত্নী আসন্নপ্রসবা।  এখন সময় নষ্ট না করে প্রাণ উজাড় করে তাকে ভালোবাসা দাও। ট্যাঁপোর টোপর কোকিল বৌ টির থৈ থৈ রূপ তায় আবার সে বিয়োবে। অতএব এক্সট্রা কেয়ার নাও।  বাসা বাঁধতে গিয়ে যদি বৌটা হাতছাড়া হয়ে যায়! অগত্যা বরিষ্ঠ পক্ষী বাসিন্দা কাকেশ্বরই ভরসা।
এ বসন্তের প্রতিটি মূহুর্ত  বাঁচো নতুন করে। প্রেমে প্রেমে, নূতন রতনে স্বাগত জানাও। বাদাম গাছের পাতাগুলো ঝরে গিয়ে কেমন বৈধব্য পর্ব চলছিল। হঠাত তাকিয়ে দেখি তার পাতার অগ্রভাগ থেকে মুকুলোদ্গম হয়েছে। কচি পাতা সবে গজাতে শুরু করেছে। কমল মুকুলদল খুলিল বুঝি!  আগুণ রং তার। পাতাশূন্য, রিক্ত গাছ সেই আগুণ রঙে সিক্ত।  সেই গাছের শুকনো ডালে বসে কোকিল তার সন্তানসম্ভবা প্রণয়ীকে খোঁজে আর শিস্‌ দেয়। বসন্তের হিম জোছনায় ভোররাত থেকে কোকিলটা প্রহর গোনে। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই তার সঙ্গীটিকে কাছে পাবার আশায় ডাকতেই থাকে সে। পুরুষ হয়ে স্ত্রী টির ওপর গুরু দায়িত্ব পালন করেছে সে। সর্বশক্তি দিয়ে গলা ফাটিয়ে চিত্কার করে বলেছে, আমি তোমায় বড় ভালবাসি। কিন্তু তারপর? আরো বড় কাজটি করেছে। তাকে ইমপ্রেগনেট করেছে। অথচ তারপর সে কোথায় বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সংসার পাতবে তা নিয়ে একটুও মাথাব্যাথা নেই তার। একেই বলে উদাসী বসন্ত। কবির কথায় সেই উদাসী বসন্তের হাওয়াতেই পথে পথে মুকুল ঝরে।   
-এই কোকিল ডাকিস কেন রে ? তোর জীবনে এত্ত বোলবোলা কিসের? 
দেখছিস্‌ না? বাইরে পৃথিবীটা কত অশান্ত? তবুও এত্ত স্বার্থপরের মত ফূর্তি তোদের? ভোর থেকেই ডেকেই চলেছিস তোরা। আহাম্মক! 
কোকিল সাড়া দিয়ে আবার বলে, কুহু। কু-কু...উউউউ ।
-আ মলো যা! আবার ডাকে! এই ডাক ঝালাপালা করে দেবে চৈত্রের শেষদিন পর্যন্ত। বাইরের বিশ্বে কি হচ্ছে তার কোনো হেলদোল নেই, ডেকেই চলেছে। তোর কর্কশ স্বর বৌটাকে ভাল লাগিয়েই ছাড়বি?  আমাদের জীবন থেকে বসন্ত বিদায় নিয়েছে রে মুখপোড়া। তবুও বসন্ত এসেছে বুঝতে পারি তোর জন্যে। এই কোকিল, রাগ করলি?
কোকিল বলে পি----উ..উ ।
-এবার অন্য সুর? তার মানে বুঝেছিস আমার কথা? ধরে নিলাম আগেরটা ছিল বসন্তরাগ। এবার ধরলি বেহাগ...কি তাই তো?
কোকিল বলে কু-উ-উ-উ।
-কি মিষ্টি ডাকছিস রে! নে, তোরা বরং প্রেম কর। আমি একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে আসি। বসন্ত আর কোকিল বিলাস করতে করতে যদি ঠান্ডা লেগে যায়! নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু ডেঞ্জারাস বুঝলি কোকিলা? তোদের নেই কো উত্তরপুব তাই তোদের মনে সদাই সুখ। 
শীতের অন্তিম নিঃশ্বাসটুকুনি থাকতে থাকতেই ভুঁইচাঁপা গাছগুলো কেমন শ্রীহীন। কেন বলতো? ওরাও ফুল ফোটাবে এইবারে। পাতাগুলো কেমন মন মরা তাই। সারাটা বছর যেমন তেমন পড়ে থাকে এই সময়টার অপেক্ষায়। তার পরেই বসন্তের দখিণা হাওয়া গায়ে মেখে মাটির মধ্যে থেকে ওদের স্টকগুলো বিকশিত হয়ে সদর্পে ঘোষণা করে তাদের অস্তিত্ব। আম্মো পারি ওদের মত। মানে বাগানের আর পাঁচটা ফুলগাছের মত। 
শীতের অবসান মানেই বাঙালীর ঘরে নিম বেগুণের গন্ধ। কাঁচা আম দিয়ে টকের ডাল আর সজনে ডাঁটা দিয়ে চচ্চড়ি, টোপাকুলের অম্বল । এসব নাকি খেতেই হয় এসময় । "রুড ফুড অফ বেঙ্গল"... নাম করা ফুড জার্নালিষ্ট ভীর সাঙ্ঘভির দেওয়া অনবদ্য নাম। সিম্পলি অসাম এই সময়। শীতের পার্টির অবসান। তেল-ঝাল-গরগরে রান্নাবাটির বিরাম। বসন্তে চাই হালকাপুলকা মানে সহজপাচ্য। কারণ পেট ঠান্ডা রাখো নয়ত রোগের প্রকোপে পড়বে বাপু! জন্মেছ ট্রপিকাল দেশে, মরিবে কি অবশেষে?  তাই বুঝি এদেশের আমগাছে বউল এসেই গেছে আর চিরুনির মত সারে সারে সজনে ডাঁটা ঝুলছে তো ঝুলাছেই। বাতাসে সজনে ফুলের ঘ্রাণ। নিমগাছে কচি কচি সবুজ নিমপাতা ধরেছে মনের সুখে। আবার কোকিলটা সেই নিমগাছটাতেই বসে দোলা খাচ্ছে। কারণ বসন্ত এসে গেছে। 
-ও কোকিলা, তোরে শুধাই রে? আবার সেই এক কথা। কেন রে তোর কোকিলটা বাসা বাঁধে না?
এই বসন্তটাকে  আষ্টেপৃষ্টে সে গায়ে মেখে নিচ্ছে আর তুই কেবলি তাকে সিডিউস করছিস যাতে সে অন্য কারো দিকে না চলে যায়। আচ্ছা কোকিলা তুই সত্যি সত্যি ওকে খুব ভালোবাসিস না রে? কিন্তু তোর ডিম পাড়া হয়ে গেলে  ঐ কোকিলটা আর তোর হয়ে থাকবে সারা জীবন? না কি আসছে বছর বসন্তে সে অন্য এক কোকিলার জন্য ডেকেই চলবে? আর ভুলে যাবে তোকে।
যাক আর ভ্যানতাড়া না করে সকলে বসন্তের পায়ে পড়ে থাকো দিন কয়েক। সে আসতে না আসতেই বন্ধু দিবস,  গোলাপ দিন, প্রোপোজ দিন, চকোলেট দিন, জড়িয়ে ধরার দিন, চুমুর দিন...করতে করতেই ভালবাসাবাসির দিন। এবার সে যেতে না যেতেই দে দোল, দে  দোল... দোলের দিন । রাধাকৃষ্ণের ফষ্টিনষ্টির দোহাই দিয়ে আমজনতার মাতামাতি ইত্যাদি। ওদিকে বসন্ত সমাগমে সারস্বত সমাজ হাইপার।  সোশ্যাল নেটে সাহিত্যের ঝলক। আর কেন‌ই বা লিখবেনা তারা?  মধুর বসন্ত এলে তারা " কুহক লেখনী ছুটায়ে কুসুম তুলিছে ফুটায়ে, লিখিছে প্রণয়-কাহিনী বিবিধ বরন-ছটাতে..." রবিঠাকুরের কথা। 
কি মহিমা এ বসন্তের! তবুও শান্ত হয়না পৃথিবী, সেটাই বড় কষ্টের।
একটু বিষাদ, একটু বিরহ, একটু প্রেম, একটু ভালোলাগা সব মিলিয়ে আমাদের বেশ একটা ফিল গুড ফ্যাক্টর কাজ করে এই সময়। ভোগ্য পণ্য সবেতেই অফ সিজন ডিসকাউন্ট। কেন রে ভাই? বসন্ত তোদের কাছে একটা অফ  সিজন? ব্যবসায়িক কেমিষ্ট্রি অবিশ্যি আমরা বুঝব না। আসলে  লোকটানার কৌশল। ছুতোয় নাতায় স্প্রিং ফেস্টের আকর্ষণ। ছলে বলে কৌশলে কখনো গোলাপ ফুল, কখনো চকোলেট, কখনো বা টেডি বেয়ার আর ভ্যালেন্টাইন গিফ্ট তো হাতের পাঁচ।  বসন্তে মানুষের সম্পর্ক ঝালিয়ে নেবার পালা। সেই আবার নতুন করে পাব বলে।
কখনো হেঁটে পেরুব শিমূল বিছানো গালচের পথ, কখনো মহুয়া সরণী, কখনো পলাশ কুড়িয়ে নেব দুহাত ভরে । সেই রং চোখ থেকে মুছতে না মুছতেই আবার এসে পড়বে আমাদের বসন্তের রংয়ের উত্সব।
 ছোটবেলায় বসন্তের খোলা জানলায় দাঁড়ালে বড়রা বলতেন বসন্ত কিন্তু ভয়ানক। যতটা দেয় ততটাই নেয় উশুল করে।  সত্যি তো, ঘরে ঘরে অসুখ এই সময়ে। আর ঋতু পরিবর্তনে এই মারণ ব্যাধির থেকে মুক্তিলাভের আশায় আবার নতজানু আমরা নারীশক্তির কাছে। বাসন্তীপুজোর আয়োজন। কারণ যমদংষ্ট্রা বসন্ত ঋতুর রোগের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে অতি প্রাচীনকাল থেকেই আমরা পরিচিত।  ঋতুর নামে রোগ‌ও রয়েছে বটে। কি আর করি? ফাগুণ হাওয়ায় সব দান করেছি যে আজ। তাই তো আমার আপনহারা, বাঁধনহারা প্রাণ।
কলকাতা ২৪x ৭ 

১১ ফেব, ২০১৭

কন্যাশ্রী সরস্বতী

 রস্বতীপুজোর  ভোর হতে না হতেই একছুট্টে কলঘরে।  তারপরেই হুড়োতাড়া করে  ফ্রকের ওপরে  কষে  মাড় দেওয়া ফুল ফুল নতুন বৃন্দাবনী ছাপাশাড়ী চাপিয়ে  কাবুলিওয়ালার মিনি সেজে, জড়ভরত মার্কা হয়ে ইস্কুলের সরস্বতী পুজো ।  শাড়ির কুঁচি, বোঁদের সঙ্গে লুচির কুচি, খিচুড়ির সাথে গরম বেগুনী আর শাড়ির  কড়কড়ে আঁচল নিয়ে আমি থরথর যেন। ল্যাজেগোবরে অবস্থা কুমারীর ।  তখন আমি দশ কি নয় । নো চাপ তখন! বড় হয়নিতো মেয়ে তাই কিছুটা নিশ্চিন্ত মা, বাবা।

এরপর বোধবুদ্ধি বিকশিত হবার আগেভাগেই  মিষ্টি টিনের আমি। একটা ফক্কড় ছোঁড়া স্কুল যাবার পথে রোজ সাইকেল চড়ে চারপাশে ঘুরপাক খেত। যদিও ধর্ষণের ধারাপাত অধরা তখন। কারণ এত মিডিয়ার প্রবচন নেই আকাশে, বাতাসে। বাড়িতে এসে জানালাম মা'কে। মা বাবাকে পাঠালো । চুপিচুপি বাবা আমাকে ফলো করল আর সেই ছোঁড়াকে ভয়টয় দেখিয়ে সেযাত্রায় তার নতুন সাইকেল চড়া মাথায় ওঠালো। তাই টিনে পা দিতেই  মায়ের চোখ ঘুরছে সর্বত্র। পারলে শ্যাম্পু করা উড়ো উড়ো মাথায় একখাবলা তেল ঢেলে দিল বলে! পাছে আমাকে ছেলেরা ঝাড়ি করে । পরেছিও জম্পেশ একখানা ডিসিএমের ভয়েল শাড়ি । আগুণ-ফাগুণ-বেগনী ফুলফুল ছাপা। শ্যম্পু চুল হাওয়ায় উড়িয়ে  লাস্যময়ীরা এমন পরেন সানন্দাতে। চেখে পড়েছে সেই টিনেই । যাবার সময় ক্যাচাল্! চুলটা বেণী করতেই হবে।মায়ের ফতোয়া। আবার ডবল ঝুঁটি। নো ওয়ে! আমিও নাছোড় । তারপর দর কষাকষি। অগত্যা মধুসূদনের মত রক্ষা করলেন বাবা। " আহা! ছেড়েই দাওনা একটা দিন্! সরস্বতী পুজো বলে কথা।  নিজের দিনগুলোর কথা ভাব দিকিনি!” 

তারপর টিন পেরোনো আমি যুবতী। যেন বেতস লতা। চোখে মুখে শিক্ষা আর কথার খ‌ই অনবরত ফুটছে টগবগ করে । একটু একটু করে বোধশক্তির অধিকারিনী হচ্ছি । মানে জাগো কুমারী, বুদ্ধিরূপেণ সংস্থিতা কন্যাশ্রী !   সেই কলঘরের ভোর পেরিয়ে বাথরুমে গ্লেজড টাইলস আর বাথরুমের আয়নায় নিজেকে আবিষ্কার করার পালা। সরস্বতীপুজো যেন পড়ার চাপে ফেড একটু। তবুও বছরে একটা দিন আগলছাড়া পাগল পাগল ভাব। তখনো মায়ের চোখ সামনে পেছনে। প্রেম হলনা তখনো। স্কুলের আলপনা, লুচি-আলুর দম-বেগুনী,বোঁদে আর মায়ের দামী সিল্কের শাড়ি তখন পরণে। কিছুটা বড় মাপের চামড়ার চটি পায়ে দিয়ে গেছি। আর সেই চটি  হারিয়ে ফেলে কি বিপত্তি!   সেটা ছিল মায়ের সে বছরের পুজোর নতুন চটি। বাটিকের কাজ করা । কলেজস্ট্রীটের রাদু থেকে কেনা ।
তারপর খালিপায়ে সাইকেল রিকশা চড়ে বাড়ি ফিরে বেদম বকুনি! বারণ করা সত্ত্বেও নতুন চটিজোড়া পরে গেলি! দিন দিন যেন উড়ছে মেয়ে! ঘুচিয়ে দেব উড়নচন্ডী ভাব, ইত্যাদি ইত্যাদি! 

তারপর ভাইয়ের সাথে আলমবাজার থেকে বরানগর বাজার সার্ভে করে সরস্বতী পছন্দ করা।  যেন কনে দেখতে যাওয়া। চোখ চাই বড় বড়, নাকটা টিকোলো। পাতলা ঠোঁটদুটো আর কুচযুগ শোভিত কুঁচ বরণ কন্যা ।  মনের মত করে পুজোর বাজার আর বাবা নামক পুরোহিতের দ্বারা  পুজো উতরোনো ।  ধান-যবের শীষ থেকে শুরু করে আমের মুকুল, পলাশকুঁড়ি থেকে প্যাঁড়া, চিঁড়ে-মুড়কি থেকে খৈ-দৈ... এক্কেবারে ষোড়শ উপচার । কোনও অনুষ্ঠানের ত্রুটি নেই।  কলেজবেলা তখন আমার । বীরখন্ডি-কদমায় তদ্দিনে ফ্যাশন আউট সানন্দার । ক্যালরি কনশাস তন্বী তনয়া। খাগের কলম ডোবানো মাটির দোয়াতে ভায়ের জন্য ডুবু ডুবু কাঁচা দুধ ঢালা।যেন ভায়ের হল শুরু, আমার হল সারা। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পেরোনো আমি যেন মুক্ত বিহঙ্গ। স্বাধীনতার পাসপোর্ট তখন আমার বগলে। বাব তখন বন্ধু আমাদের । পুজোয় বসে তিনি বলেন নিদেন একখান বিড়ি না হলে পুজোয় বসবেননা তিনি।পুরুতমশাইরা নাকি কানে বিড়ি গুঁজে আসেন পুজো করতে!   এবার মায়ের কাছে কাকুতি মিনতি করে বাবার জন্যে স্পেশ্যাল চা হাতে দিতেই তিনি গলে জল হয়ে পুজোয় বসলেন।  বুঝলাম, কত বিচক্ষণ হলে সংসারে গিন্নীর কাছ থেকে এক্সট্রা এককাপ চা আদায় করা যায়! 

দুই বিরুণী থেকে এক বিরুণী ও শেষে অলবিরুণি gone! খোলা চুলে ট্রানজিশান । সায়েন্স কলেজের গন্ডী পেরুনো। কোর্টশিপ চলছিল হবু বরের সাথে ।  সেবছর ভ্যালেন্টাইন্স ডে আর সরস্বতী পুজো পড়েছিল পিঠোপিঠি। নীলখামে একখানা প্রেমপত্র এসে পড়ল ঐদিনেই । যেন সুরের ঝর্ণায় হায় মরি হায় মরি হায়রে! ঝর্ণা ঝরে রে! রহিনা ঘরেরে। সেই থেকে প্রেমপত্র চালাচালিতে সাহিত্যচর্চা জেগে ওঠা।  সালটা ১৯৮৯। আটপৌরে, সাদামাটা আমি। কিছুটা আবেগে, কিছুটা ভালোলাগায় ভালোবাসতে শিখলাম আমার প্রথম প্রেমকে।

বিয়ের পর  সরস্বতীপুজো জমিয়ে শুরু করলাম আবারো ছেলের হাতেখড়ি দিয়ে । তারপর মা হওয়ামাত্র‌ই সরস্বতীপুজো আসা মানেই গোটাষষ্ঠীর তোড়জোড়। মানে সব গিয়ে রান্নাঘরের খুন্তি-কড়াইতে । 
সরস্বতীপুজোর পরদিন গোটাষষ্ঠী বা শীতল ষষ্ঠী পশ্চিমবঙ্গের রীতি । অনেক পূর্ববঙ্গের মানুষও শখে করেন । আমাদের অরন্ধন । পাথরের শিলকে তেল হলুদ জলে স্নান করিয়ে তার কোলে নোড়াটি রেখে দিতে হবে আর জোড়া শিম, ফুল দিয়ে তার পুজো করতে হবে । সব ঠাণ্ডা। তাই বুঝি নাম শীতল ষষ্ঠী। শ্রীপঞ্চমী তিথি থাকতে থাকেতেই গোটা রেঁধে রাখতে হয় । গোটা মুগডাল (সবুজ মুগকলাই ), গোটা শিম, গোটা মটরশুঁটি, গোটা রাঙা আলু, গোটা আলু, গোটা বেগুণ জোড়া সংখ্যায় দিয়ে  (কমপক্ষে ৬টি করে ) গোটা সেদ্ধ হয় নুন দিয়ে । সাথে গোটা শুকনো লঙ্কা আর নুন ।  গোটা মুগ ডালকে শুকনো খোলায় একটু নেড়ে নিতে হবে যতক্ষণ না হালকা গন্ধ বেরোয় । কিন্তু প্রেসারে রাঁধা চলবে না । আর কিছু পরে ঢাকা খুলে দেখতে হবে কিন্তু ডাল বা সবজীকে হাতা দিয়ে ফাটানো চলবেনা ।   সেদ্ধ হয়ে গেলে কাঁচা সরষের তেল দিয়ে নামিয়ে রাখা হয় ।  সাথে পান্তাভাত আর সজনেফুল ছড়ানো কুলের অম্বল ও টক দৈ । সরস্বতীপুজোর পরদিন আমাদের দুপুরের আহারে  সবকিছু বাসি রান্না  খাওয়া হ'ল আমার শ্বশুরবাড়ির রীতি ।
সারাটা পশ্চিমবাংলার মায়েরাই এমন করে গোটাষষ্ঠী করেন ছেলেমেয়ের মঙ্গলকামনায়।  কিন্তু যখন দেখি আজকের ছেলেমেয়ের মায়ের জন্য সেই গোটাষষ্ঠীর পুণ্যফল রেসিপ্রোকেট না করা তখন আমার এ যাবত সঞ্চিত বোধ-বুদ্ধি সব বিসর্জন হয়! 
পুজোর পরদিন পান্তা আর গোটাসেদ্ধ খেয়েদেয়ে বোধহয় একটু ঝিমুনি এসেছিল। 
দেখি বাসন্তী, ভুবনমোহিনী সরস্বতীর উপছে পড়া কলকাতায়  ব্যালকনির সুখ । মনে মনে ডাকি তাঁকে। শুধু বলি আর বছরে আবার এসো মাগো। ভেলায় ভাসতে ভাসতে বেলপাতা বোঝাই হলুদ গাঁদার ঝুড়ি তখন বোধহয়  গঙ্গার মোহানায়  । জলের বুকে ভাসমান সরস্বতী মুখে তাম্বুল আর কপালে সিঁদুর নিয়ে দুলতে থাকে ঢেউয়ের ওঠানামায় । ফিরে আসে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক। "বিদ্যাস্থানে ভয়ে-বচ"দের যেন কৃপা করেন তিনি।  বস্তির সেই ছেলেগুলো যারা বাড়িবাড়ি চাঁদা তুলতে এসে ভুল বানানে নষ্ট করে ডটপেনের সস্তার কালি।  সরস্বতী যাদের কাছে শুধুই একটা পুজো, আনন্দের হৈ হল্লা, আর পাঁচটা হুজুগের মত, খিচুড়ি-বোঁদে-দধিকর্মার সুখ আর পড়ায় ফাঁকির সুখ।  আর মাইকে জোরসে পাগলু থেকে রামলীলা অথবা শীলার জওয়ানি থেকে মুন্নির বদনাম ।  চোখ বুঁজে ফুল ছুঁড়ে আসছি আমরাও ওদের সাথে প্রতিবছর সেই মেয়ের পায়ে যার নাম সরস্বতী।
তখনো জানতাম না আমাদের আদরের সরস্বতী আজীবন কুমারী।  তখন তো জানি তিনি শিব-দুগ্গার শান্তশিষ্ট কন্যা, নারায়ণের ঘরণী।  শুধু লক্ষী মেয়ের মত লেখাপড়া আর গানবাজনা নিয়েই থাকতে পছন্দ করেন। আর তাই ছাত্রছাত্রীরা চোখ বুঁজে সরস্বতীপুজোর দিনে তাঁর পায়ে ফুল ছোঁড়ে। আমিও  ছুঁড়েছি সেই হাতেখড়ির বেলা থেকে আর এখনো ছুঁড়ে চলি মন দিয়ে।  তবে এখন এই সরস্বতীকে আমি কেবল ই বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী বলে ভাবতে পারিনা। তাঁকে একজন প্রতিবাদী মেয়ে হিসেবে দেখি যিনি অত্যন্ত লড়াকু ছিলেন। 
নিজেকে অনেকবার প্রশ্ন করেছি এই সরস্বতীর বিয়ে নিয়ে। আমাদের এই মেয়েটি কি সুখী বিবাহিত জীবন পেয়েছিল নাকি কদর্য এই পুরুষ শাসিত সমাজের প্রতি ঘৃণায়, লাঞ্ছনায় বিয়ের মত প্রহসনের দিকে পা দেন নি ? না কি আজকের দিনের মত বিবাহ-বিচ্ছিন্নাই থেকে গেলেন আজীবন? অথবা  একাধিক সপত্নীর সাথে ঘর করার অসহ্য বেদনা বুকে নিয়ে পালিয়ে গেলেন এই পৃথিবী ছেড়ে ?  
না:,পুরাণ বলে, পালিয়ে তিনি যান নি। পরাজিতও হন নি । তিনি দাপটের সঙ্গে লড়ে গেছেন পুরুষের বিরুদ্ধে। যুদ্ধ করে গেছেন পুরুষের কামনার স্বীকার হতে হতে । কিন্তু বেঁচে রয়েছেন আজো মানুষের মনে কারণ তিনি জয়ী ।  সে যুগে বিয়ের ফাঁদে আদৌ কি বাঁধা পড়তেন দেবদেবীরা ? রক্তমাংসের সম্পর্কের মত দেবদেবীদেরও তো কৈশোরে বয়ঃসন্ধির সুবাদে দেহরসের ক্ষরণ ও সেই হেতু ছোঁকছোঁকানিও ছিল । ছিল ইভ-টিজিং ও মোলেষ্টশান । আর জিভ কেটে কানে হাত দিয়ে বলি দেব-দৈত্যকুলে রেপিষ্টের সংখ্যাও নিদেন কম ছিলনা সেযুগে । তারা লিভটুগেদার বা "থাকাথাকি" তে বিশ্বাসী ছিলেন না বিয়ের মত লিগাল ইনস্টিটিউশানে বিশ্বাসী ছিলেন সে তো পরের কথা।  সেক্স ও ভায়োলেন্স এর দাপট কিন্তু এ যুগের চেয়ে সেযুগে কিছু কম ছিলনা । সরস্বতী তাঁর সাজগোজ, পোশাক-আষাকের মধ্য দিয়ে আর সর্বোপরি তাঁর গুণ, বুদ্ধি আর বিদুষী ব্যক্তিত্ত্বের দ্বারা পিতৃসম ব্রহ্মা থেকে শুরু করে প্রেমিক তুল্য নারায়ণের মাথাটা ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন এক্কেবারে । যাকে আমরা এখন শহুরে ভাষায় বলি "হেড টার্নার" ; তিনি এমনি ছিলেন ।মানে এখনকার দিনে যাকে বলে পেজ থ্রি কাঁপানো।   সমাজে এমন মেয়ের কদর তো হবেই যিনি একাধারে রূপসী আবার বিদুষী । পুরাণ কিন্তু অন্য কথা বলে।  সরস্বতী ছিলেন অসম্ভব ঝগড়াটে আর তাঁর মেজাজ ছিল দাপুটে । হতেই পারে । যিনি একহাতে বশিষ্ঠ থেকে বিশ্বামিত্র আর অন্যহাতে ব্রহ্মা থেকে বিষ্ণুকে নাচাতে পারেন তিনি তো অযোনিসম্ভবা, অসামান্যা । কিন্তু আজকের সমাজের চিত্রটাও ঠিক তেমনি আছে অনেক ক্ষেত্রে । তবে এমনি মেয়েই তো আসল কন্যাশ্রী আজকের সমাজে। এমনি তো চাই আমাদের। এ কথা কেন বলছি তা বুঝতে গেলে জানতে হবে সরস্বতীর পুরাণ বেত্তান্ত ।
  সরস্বতীর জন্মবৃত্তান্ত এবং বিবাহ এই দুই নিয়ে অনেক কিংবদন্তী আছে । কেউ বলেন পরমাত্মার মুখ থেকে নির্গত হয়ে তিনি পাঁচ ভাগে বিভক্ত হন : রাধা, পদ্মা, সাবিত্রী, দুর্গা ও সরস্বতী । আবার কারো মতে পিতা ব্রহ্মার মানসকন্যা তিনি । ঠিক যেমন গ্রিক দেবী কুমারী এথেনা পিতা জিউসের কপাল থেকে নির্গত হয়েছিলেন । যদিও ব্রহ্মার মানসকন্যা সরস্বতী তবুও পিতা ব্রহ্মা তাঁর এই সুন্দরী কন্যাটিকে কামনা করে বসলেন । বৃদ্ধের এই চাহনি  কন্যার  পছন্দ হলনা । কন্যা এড়িয়ে চলতে লাগল পিতাকে ।পালিয়ে বেড়াতে লাগল । ব্রহ্মা অসন্তুষ্ট হলেন । কামদেব মদনকে অভিশম্পাত করলেন যে কেন এই সুন্দরী কন্যার প্রতি  তাঁর সম্ভোগ লালসা রূপায়িত হচ্ছেনা এই বলে । অচিরেই শিবের দ্বারা মদন ভস্মীভূত হল সেই ক্ষমতার অপব্যবহার ! আর  প্রতি পদে পদে পুরুষশাসিত সমাজে নারীর লাঞ্ছনার গল্প উঠে এল ।
বিশ্ব ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির মূলে যখন অগ্নির করাল গ্রাসে সৃষ্টি প্রায় ধ্বংসের মুখে তখন এই বিপর্যয়কে রুখতে দেবরাজ ইন্দ্র গেলেন নদী সরস্বতীর কাছে । সরস্বতীকে তার গতিপথ পরিবর্তন করে আগুন নেভাতে আদেশ দিলেন । সরস্বতী তখন সমুদ্রের দিকে ধাবমান । সে তখন বলল ব্রহ্মা স্বয়ং আদেশ দিলে তবেই সেই আগুন নেভাতে তার গতিপথ ঘোরাবে । ব্রহ্মা ইন্দ্রের অনুরোধে সরস্বতীকে আদেশ দিলেন । সরস্বতী সম্মত হল । গঙ্গা, যমুনা, মনোরমা, গায়ত্রী ও সাবিত্রী এই পাঁচ নদী তার সঙ্গ নিতে চাইল কিন্তু সরস্বতী একাই গেলেন সেই অগ্নিনির্বাপণ কাজে । পথে ক্লান্ত হয়ে ঋষি উতঙ্কর আশ্রমে বিশ্রাম নিতে গেলেন আর তখুনি মহাদেব সমুদ্রাগ্নিকে একটি পাত্রে ভরে সরস্বতীর সম্মুখে হাজির করলেন । সরস্বতী তখন উত্তরে ব‌ইতে শুরু করল । ভারতের উত্তরপশ্চিমে পুষ্করে গিয়ে তার দ্বিতীয় বিশ্রাম হল । যার জন্য পুষ্কর হ্রদ হল এখনো একটি তীর্থক্ষেত্র । নারীর মহিমায় ভারতের কোণায় কোণায় বিখ্যাত ও স্মরনীয় হয়েছে অনেক এমন স্থান । পুরাণের সরস্বতী থেকে রামায়ণের সীতা কিম্বা চিরস্মরণীয়া পঞ্চকণ্যাঃ অহল্যা, দ্রৌপদী, কুন্তী, তারা, মন্দোদরী... এঁদের প্রত্যেকের জন্য বিখ্যাত অনেক তীর্থস্থান।
এমন আরো একটি গল্প ভাবিয়ে তোলে আজো যেখানে সরস্বতী নামের মেয়েটি  পুরুষের লালসার স্বীকার হয় একাধিকবার । সেই সমাজের দুটি শক্তিমান পুরুষের সম্ভোগ লালসার টানাপোড়েনে বিপর্যস্ত হয়ে যায় মেয়েটির জীবন । তবুও সে ক্ষতবিক্ষত হয়ে বেঁচে থাকে । 

একবার ঋষি বশিষ্ঠ সরস্বতীর তীরে তপস্যায় মগ্ন ছিলেন । তাঁর শত্রু মুনি বিশ্বামিত্র এসে সরস্বতীকে বললেন বশিষ্ঠকে নিয়ে প্রচন্ড বেগে তাকে লন্ডভন্ড করে প্রবাহিত হতে । সরস্বতী প্রথমে রাজী হননি । অবশেষে বিশ্বামিত্রের অনুরোধ উপেক্ষা না করতে পেরে দুকুল ছাপিয়ে ধ্যানমগ্ন বশিষ্ঠকে নিয়ে বানভাসি হলেন । নদীর ঢেউয়ের সর্বোচ্চ শিখরে ধ্যানমগ্ন বশিষ্ঠ । একবার উঠছেন আবার একবার নামছেন ঢেউয়ের দোলায় । বিশামিত্র তো বেজায় খুশি । কিন্তু এই প্লাবনে বশিষ্ঠের কোনো হেলদোল নেই দেখে তাঁর একটু সন্দেহ হল । বিশ্বামিত্র বুঝলেন সরস্বতী বশিষ্ঠকে নিশ্চয়ই রক্ষা করছে । অতএব সরস্বতীর এইরূপ ছলকলায় যারপরনেই অসন্তুষ্ট হয়ে বিশ্বামিত্র সরস্বতীকে অভিশাপ দিলেন ও সরস্বতী অচিরেই রক্ত রূপী নদীতে পরিণত হল । মুনি ঋষিরা যখন সরস্বতীর তীরে স্নান করতে এলেন তখন বিশুদ্ধ জলের পরিবর্তে রক্ত দেখে খুব আশ্চর্য হলেন । এর অর্থ আমার জানা নেই। তবে হয়ত মেয়েটি প্রতিবাদ করে বলেছিল, আমি ঋতুমতী। আমাকে রেহাই দাও। নাকি জলে ঝাঁপ দিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছিল তা?  সরস্বতী তাঁদের কাছে কেঁদেকেটে সব কথা খুলে বললেও রেহাই পান নি? বিশ্বামিত্রের এহেন দুরাভিসন্ধির কথাও জানালেন  । নিজের মুক্তি চাইলেন ও পুনরায় পূত:সলিলা সরস্বতী রূপে ফিরে চাইলেন নিজের জীবন ।  দয়ালু মুনিঋষিদের প্রার্থনায় শাপমুক্ত হলেন সরস্বতী এবং পুনরায় বিশুদ্ধ হল নদীর জল । এই কারণে সরস্বতীর অপর এক নাম "শোন-পুণ্যা" ।
পুরাণের আরেকটি গল্পের মতে সরস্বতী, লক্ষ্মী এবং গঙ্গা ছিলেন বিষ্ণুর তিন পত্নী । বিষ্ণু কিন্তু গঙ্গার প্রতি একটু বেশিমাত্রায় আসক্ত ছিলেন ।  নম্রস্বভাবের লক্ষ্মী এই ঘটনায় মনে মনে খুব দুখঃ পেতেন কিন্তু কিছু প্রকাশ করতেন না । সরস্বতী কিন্তু বিষ্ণুর এই অতিরিক্ত গঙ্গাপ্রেমকে প্রশ্রয় না দিয়ে অশান্ত এবং রুষ্ট হয়ে উঠেছিলেন ।  একদিন তার মাথায় একটা বুদ্ধি এল ।  প্রচন্ড উগ্রমূর্তি ধরলেন তিনি ।   গঙ্গার মুখোমুখি হলেন । লক্ষ্মী একটি ভয়ানক কলহের পূর্বাভাস পেয়ে সরস্বতী ও গঙ্গার মধ্যিখানে এসে দাঁড়ালেন । সরস্বতী লক্ষ্মীকে অভিশাপ দিয়ে একটি গাছে পরিণত করলেন । লক্ষ্মী আবার সেই অভিশাপে প্রচন্ড আঘাত পেয়ে সরস্বতীকে নদীতে রূপান্তরিত করলেন । সরস্বতী নিজেও তখন উগ্রচন্ডা । নিজে নদীতে পরিণত হয়েছেন বলে গঙ্গাকেও নদী হতে অভিশাপ দিলেন । ইতিমধ্যে বিষ্ণু সেইখানে হাজির হলেন । এতসব ঝগড়া বিবাদ দেখে ও শুনে স্থির করলেন সরস্বতী ও গঙ্গার সাথে আর নয় । এখন থেকে তিনি কেবলমাত্র লক্ষ্মীর সাথেই ঘর করবেন । সরস্বতীকে ব্রহ্মার হাতে এবং গঙ্গাকে শিবের হাতে সমর্পণ করে বিষ্ণু  হলেন লক্ষ্মীর প্রিয় পতিদেবতা । আর  সরস্বতী ও গঙ্গার ওপর এরূপ অন্যায় শাস্তির জন্য  লক্ষ্মী মনে মনে ব্যথিত হলেন আবার বিষ্ণুকে একান্ত নিজের স্বামীরূপে বরণ করে আনন্দিতও হলেন  । বিষ্ণুকে শান্ত হতে বললেন এবং তাদের দুজনের আশীর্বাদে লক্ষ্মী ও গঙ্গা মর্ত্যের ওপর দিয়ে নিজ নিজ গতিপথে ব‌ইতে লাগল । স্বর্গে তাদের দুজনার একটি করে শাখা বিষ্ণুর হাত ধরে র‌ইল।

এমন সরস্বতী যেন বারবার ফিরে আসে আমাদের সমাজে  যাকে মনে রাখার জন্য বছরে একটি নির্দ্দিষ্ট দিন পালন করা হবে আর পূজা-পাঠ-অঞ্জলি-আরতি এ সব তো মনগড়া! আসল তো সে মেয়ের ব্র্যান্ড যা যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে দাগ কেটে দিয়ে যাবে ।   সে তো আমাদেরই ঘরের চেনা একটা মেয়ে অথবা শুধুই মেয়ে নয় দেবতা নিশ্চয় !!!
 কলকাতা ২৪ x ৭