লিঙ্গরাজ টেম্পলে...
বেশ কয়েকবছর আগের কথা। আমার উনির ভুবনেশ্বর আইআইটিতে পরীক্ষা নেবার ভার পড়ল শিবরাত্রির ঠিক আগেই। উড়িষ্যার নাম শুনলেই আমার পূর্বপ্রেমগুলো উঁকি দিয়ে ওঠে। বুকের মধ্যিখান টা টনটনিয়ে ওঠে। এক জগাদা দুই সমুদ্র । এদের দুজন কে কিছুতেই ভুলতে পারিনা আমি। অতএব চলো লেটস গো। জগা দার পাড়ায় একটিবার হাই হ্যালো করব, সমুদ্রের জলে পা ভেজাব কিন্তু। আর সেই ফাঁকে ভুবনেশ্বর ও ঘুরে নেব। শুনেছি খুব সুন্দর শহর। আর শোনো ভুবনেশ্বর থেকে পুরী যাবার পথেই পিপলি পড়বে। হ্যান্ডিক্রাফটস কিনব কিন্তু। আর যদি সময় থাকে তবে পুরী থেকে চিলকা যাব। ব্যাস! যে কথা সেই কাজ। ঝটিতি প্ল্যান। একগুচ্ছ গল্পের বই, আমার সঙ্গের সাথী ল্যাপটপ আর আমরা দুজনে ট্রেনে চেপে বসলাম। প্রথমে কাজ সারতে হবে মানে ভুবনেশ্বরের হোটেলে দুরাত বাস করতে হবে। উনি পরীক্ষা নেবেন আর আমি ঘরে বসে বইপত্র ঘাঁটব আর মনের সুখে ব্লগ লিখব। অফুরন্ত অবকাশ। কেউ কড়া নাড়বেনা। কেউ বিরক্ত করবেনা। চার বেলার খাবার চিন্তা নেই।
ভুবনেশ্বরের হোটেলে ডেরা বেঁধে একদিন কাটল এভাবে। পরদিন ওনার সেকেন্ড হাফে ইনভিজিলেশান। অতএব ভোরবেলা উঠে, অটো ভাড়া করে কাছেই লিঙ্গরাজ মন্দির। শুনেছি অন্যতম বৃহত স্তম্ভাকৃতির শিবলিঙ্গ সেখানে। শিবরাত্রির ঠিক আগেই বেশ পুণ্যি হবে দর্শণ করে...মনে মনে সেই আশা পোষণ করেই পা বাড়ালাম। অদ্ভূত সুন্দর এক সকাল। হালকা ঠান্ডার রেশ সে ফাগুণেও। প্রাচীন মন্দির। অদ্ভূত কারুকার্য পঞ্চরত্ন মন্দিরের। অপূর্ব মন্দিরময়তা পুরো চত্বর জুড়ে। ছোট, বড়, মেজো, সেজো, রাঙা, ফুল, কুট্টো, আন্না...কত মন্দির! আমাদের সময় সীমিত। অতএব লিঙ্গরাজার জন্য মাটির ঘটে দুধ-জল সহ আকন্দ ফুল, বেলপাতা কিনে মন্দিরের দিকে চলি ।
ঊড়িষ্যার কোনো মন্দিরে দর্শনার্থীরা লিঙ্গের মাথায় জল, ফুল বা দুধ চড়াতে পারেনা । একদল পান্ডাদের স্বেচ্ছাচারিতা, অহমিকা আর ট্যুরিষ্ট বিদ্বেষ জায়গাটির স্থান মাহাত্ম্যকে কিছুটা ম্লান করে দিয়েছে । যারাই আসছেন দূর দূর থেকে সকলের মুখেই সেই এককথা । স্বয়ংভূ মহাদেব লিঙ্গরাজ যেন ঐ প্রদেশের পূজারী এবং মন্দিরের সেবায়েতদেরই সম্পত্তি । উত্তর বা পূর্ব ভারতের আর কোথাও এমনটি খুঁজে পাইনি ।
ঊড়িষ্যা যাবেন শুনেই আমার কেমন ছোঁক ছোঁক অবস্থা । আকুলিবিকুলি প্রাণ ; সমুদ্রের ঢেউ যেন ডাকতে লাগল আমাকে । ভাবলাম উনি হয়ত বলবেন "পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য নইলে খরচ বাড়ে" কিন্তু পরদিনই দুটো টিকিট দেখালেন উনি । চোখ চিকচিক করে উঠল । তাহলে এই ফাগুণেই দেখা হবে তার সাথে । ১৭ই ফেব্রুয়ারি খড়গপুর থেকে ট্রেনে চড়ে সোজা ভুবনেশ্বর । বিকেলে বিকেল হোটেলে যাওয়া । তারপরই প্ল্যান ছকে নেওয়া হল । ওনার পরীক্ষা নেওয়া ১৮তারিখে হোটেলের পিছনেই আইআইটি ভুবনেশ্বর সেন্টারে । হেঁটে ১৭তারিখেই আশপাশ দেখে নেওয়া হল । কোথায় অটোরিক্সা পাওয়া যায় , কোথায় ভাড়ার গাড়ি পাওয়া যায় ইত্যাদি । পরদিন ভোরে উনি পরীক্ষা নেবেন ১০টায় চলে যাবেন সেন্টারে । তার জন্য আমি প্রচুর ম্যাগাজিন , গল্পের বই আর আমার সর্বক্ষণের সাথী ল্যাপটপটিকে নিয়ে গেছি । হোটেলের ঘরে টিভিও আছে একখানি । সেখানে বাংলা চ্যানেল ও আসে খান কয়েক । কিন্তু ইন্টারনেট কানেকশান খুব হতাশ করল ।তবু একটু বইপড়া আর টিভি দেখা হল । ১৮তারিখে ভোরে উঠে স্নান সেরে আমরা দুজনে অটোরিক্সা করে ভোর সাতটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ টেম্পলের উদ্দেশ্যে ।
মন্দিরময় ভুবনেশ্বরে এটি একটি অন্যতম বৃহত মন্দির । কলিঙ্গ স্থাপত্যে একে পঞ্চরথের আদল বলা হয় । ১১ th century তে প্রতিষ্ঠিত এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন সোমবংশীয় রাজা জজাতি কেশরী । ভুবনেশ্বরের সবচেয়ে বড় মন্দির এটি ।
ঊড়িষ্যার কোনো মন্দিরে দর্শনার্থীরা লিঙ্গের মাথায় জল, ফুল বা দুধ চড়াতে পারেনা ।একদল পান্ডাদের স্বেচ্ছাচারিতা, অহমিকা আর ট্যুরিষ্ট বিদ্বেষ জায়গাটির স্থান মাহাত্ম্যকে কিছুটা ম্লান করে দিয়েছে । যারাই আসছেন দূর দূর থেকে সকলের মুখেই সেই এককথা । লিঙ্গরাজ যেন ঐ প্রদেশের পূজারী এবং সেবায়েতদেরই সম্পত্তি । উত্তর বা পূর্ব ভারতের আর কোথাও এমনটি খুঁজে পাইনি । ভূবনেশ্বরী, কালী, সাবিত্রী, যমরাজ ইত্যাদি কয়েকটি মন্দিরে প্রবেশ করলাম । মন্দিরের ভেতরে সেলফোন ও ক্যামেরা নিষিদ্ধ । এযুগেও এত রক্ষণশীলতা । যারপরনেই অবাক হলাম ।
মন্দিরের প্রবেশদ্বার
আসার পথে রামেশ্বর মন্দির দেখলাম আর দূর থেকে দেখলাম বিন্দুসাগর । হোটেলে ফিরে এলাম সাড়ে আটটার মধ্যে । এসে নিরামিষ ব্রেকফাস্ট । দুধ কর্ণফ্লেক্স, ফল, এবং পুরী সবজী । এবার উনি চলে গেলেন পরীক্ষা নিতে আর আমার অখন্ড অবসরের সঙ্গী তখন বইমেলায় কেনা একরাশ বই । গৌতম ঘোষদস্তিদারের "পুরুষ ও প্রকৃতি" বইখানি পড়লাম । দারুন আনন্দ পেলাম । জয়দেব-পদ্মাবতী, চন্ডীদাস ও রজকিনী রামিনী এবং বিদ্যাপতির কাব্য রচনায় নারীর প্রভাব আর সেই নিয়ে এক নিখুঁত প্রেমের গল্প । এযুগের কবি ও লেখক গৌতম ঘোষ দস্তিদারের অপূর্ব লেখনীতে তা বড়ৈ সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে । বাংলাসাহিত্যের ইতিহাস আমার একটি অতি প্রিয় বিষয় ছিল উচ্চমাধ্যমিকে । আবার বেশ ঝালিয়ে নিলাম সেই অবসরে । দুপুরে কোলকাতা দূরদর্শনে "কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী" সিনেমাটি দেখলাম । টিভিতে সিনেমা বড় একটা দেখিনা । সেই অবসরে বেশ আনন্দ দিল । সন্ধেবেলায় উনি ফিরলেন সাড়েসাতটায় । ডিনার খেলাম । অনবদ্য এক কাবাব প্ল্যাটার নিলাম । চিকেন্, মাটন কাবাব এর সাথে স্যালাড, তন্দুরী চিকেন, একবাটি ডাল মাখানি ও নান । সব দু পিস করে খেতে খেতে পেট ভরে যায় । বেশ ভ্যালু ফর মানি ডিশ । শেষে একটু আইসক্রিম । আবার একটু হেঁটে আসা ফাগুণের হাওয়া গায়ে মেখে । পরদিন ১৯তারিখে একটু দেরী করে ঘুম ভাঙল । যথারীতি ব্রেকাফাস্ট খেয়ে ন'টার মধ্যে উনি চলে গেলেন শেষদিনের পরীক্ষা কন্ডাক্ট করতে । আর আমার অবসর শুরু হল গীতগোবিন্দমের বাংলা অনুবাদের চেষ্টা নিয়ে । সেদিন দুটো বাংলা ম্যাগাজিন ছিল সঙ্গী । দুটোর মধ্যে হোটেল থেকে চেক আউট করে আমি নীচে হোটেলের লাউঞ্জে এসে বসলাম । উনি আসবেন দুটোনাগাদ । একখানা ভাডার গাড়ী করে এবার গন্তব্য ভুবনেশ্বর থেকে পুরী ।
পথে পড়ল পিপলি ।
পিপলি ট্যুরিস্ট মার্কেট
ওড়িশার একটি গ্রাম আজ থেকে বহুবছর ধরে তাদের এপ্লিক শিল্পের সুচারু কারিগরীকে বাঁচিয়ে রেখেছে । হাইওয়ের দুধারে পিপলি আজ একটি ট্যুরিস্ট মার্কেট । ওড়িশার যাবতীয় দৃষ্টিনন্দন হ্যান্ডিক্রাফট পাওয়া যায় এখানে । তারপর পুরী পৌঁছলাম বিকেলে । সমুদ্রের ধারেই একটা হোটেলে ঢুকে চেক ইন করলাম । ঘর থেকে সমুদ্র দেখা যায় । ব্যস ! আর কিছুই প্রত্যাশিত ছিলনা সেই মূহুর্তে । ব্যাগপত্র রেখে রিক্সো করে সোজা জগন্নাথ মন্দির । পান্ডার সাহায্যে একদম তিন জ্বলজ্যান্ত বিগ্রহের সম্মুখে আমি । শিহরিত, তৃপ্ত এক মাদকতায় আপ্লুত আমরা । পুজো দিলাম । প্রসাদ পেলাম । জগন্নাথের ভোগ খেলাম । আগুণ গরম ভাত, পোলাও, খিচুড়ি, সুক্তো, অড়হর ডাল এবং পায়েস । সেই সন্ধ্যে বেলায় একসাথে লাঞ্চ এবং ডিনার হয়ে গেল জগন্নাথের কৃপায় । হোটেলে ফেরার পথে শঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠিত পুরীধামের আশ্রমে গেলাম । তারপর হোটেলে ফিরে বিশ্রাম সেরাতের মত । পরদিন স্মার্টফোনের সাহায্যে জানা গেল পুরীর সি বিচে সমুদ্রদয়ের সময় । সেই মত বিছানা ছেড়ে পায়ে পায়ে বালির চরে ।
সেই চেনা বঙ্গোপসাগরের পুরীর সমুদ্রতট
সূর্যদেব গুগলের নির্ঘন্ট মেনে যথারীতি উঠে পড়লেন ঘুম থেকে । পুবের আলো, লালচে আকাশ, সমুদ্রের রাশি রাশি ঢেউ, নোনাজলের ফেনা সবকিছু মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছিল সেই ভোরে । সেদিন ছিল শিবরাত্রি । পুরীতে কোনো শিবলিঙ্গ খুঁজে পেলামনা যে গিয়ে একটু জল ঢেলে পুজো করব । অগত্যা বালির চরে নিজেই বালি দিয়ে এক ঢিপি বানিয়ে মন্ত্র বলে জাল ঢাললাম তার মাথায় আঁচলা ভরে । তারপর জলযোগ করলাম কচুরী তরকারী দিয়ে । এবার হোটেলে ফিরে এসে স্নান সেরে একটা গাড়িভাড়া করে চিল্কার পথে ।
চিল্কায় পৌঁছে স্পীডবোটে ভাসমান.... ডলফিন, রেড ক্র্যাব ও পরিযায়ী পাখির উদ্দেশ্যে