১৭ আগ, ২০১১
১৫ আগ, ২০১১
এ কি হাসিখেলা নাকি প্রমোদের বেলা ?
আমরা মনুষ্যজন্ম নিয়ে পৃথিবীতে এলাম । স্বাধীনদেশে জন্ম নিয়ে ভাবলাম কৃতার্থ । সার্থক জন্ম আমার জন্মেছি স্বাধীনদেশে । ভুলেও ভাবিনা যে আমরা মানুষ হয়েছি। আমরা নব্য সংস্কৃতির ধারা বহন করছি মাত্র। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুণধরা এই আধুনিক নগরসভ্যতার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে যন্ত্রমানবের ন্যায় কর্মবীর হয়ে উঠেছি। আমাদের সুদৃশ্য বাহ্যিক রূপোলী মোড়ক দেখলে ভুল হয় , অভ্যন্তরের রক্তমাংসের মানুষটির এহেন অন্তঃসার শূন্য রূপ ? আমরা পাশ্চাত্যের কাছ থেকে প্যাকেজিং শিখেছি, কিন্তু প্যাকেটের অন্দরমহলে "quality product" পুরতে অক্ষম, সে মানুষই হোক আর জিনিষই হোক।
তৃতীয়বিশ্বের চতুর্থশ্রেণীর নাগরিকদের কাছ থেকে এর থেকে বেশি কিছু আশা করাই বৃথা। স্বাধীনতার পরবর্তী কালে দেশনেতা সহ আপামর-জনসাধারণ বহুদিনের আকঙ্খিত স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করার বাসনা জাগল আর বেশ কিছু যুগ ধরে তার স্রোতে গা ভাসিয়ে মুক্ত হবার আনন্দ লুটেপুটে খেতে লাগল । ফলস্বরূপ অল্পদিনের মধ্যেই দেশের অভ্যন্তরে এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হল। দেশবাসী এতদিন ধরে সম্মিলিত ভাবে বিদেশীশক্তির আধিপত্য মানিয়া মেনে নিতে পারছিলনা |এখন তারা ক্ষমতাশীল মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে একসূত্রের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াতো দূরের কথা, স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ এবং নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করবার জন্য যা করণীয় তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
ফলস্বরূপ মতভেদের বিভিন্নতা এবং দলের বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হল। ভিন্ন ভিন্ন দলের অগণিত মানুষগণের বিচিত্র বুদ্ধি, বিভিন্ন মতামত প্রধান্য পেতে লাগল।। এহেন অরাজক পরিস্থিতিতে কিছু ক্ষমতাশালী ব্যক্তি 'বাবু' ব্র্যান্ডের তকমা এঁটে বুক ফুলিয়ে সমাজের আনাচে-কানাচে ঘুরতে লাগল, কেবলই দলের 'ব্রান্ডেড বাবুদের' কাছ থেকে স্বার্থসিদ্ধির আশায়। স্বার্থান্বেষী ব্র্যান্ডেড বাবুরা ধীরে ধীরে দেশের আপামর -জনসাধারণকে 'রাজনীতি' নামক এক ছদ্ম ও অলীক ন্যায়শাস্ত্রের মুখোশ পরিয়ে দিল এবং ক্ষমতার অপব্যাবহার করে অশিক্ষিত,মূর্খ অসহায় মানুষদের যেমনটি বোঝাল তারা তেমনটি বুঝল। শহর-গ্রাম নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ এক সুষুম্না-স্নায়ু অবশ করানো এক নঞর্থক মানসিকতায় পুষ্ট হল।
এদিকে ব্যাপক বিশ্বায়নের ঢেউ আছড়িয়ে পড়ল ভারতবর্ষের তটভূমিতে। প্রাচ্যের মানুষেরা পাশ্চাত্য রূপ পরমহংসের সভ্যতারূপ দুগ্ধের নবনীটুকু গ্রহণ করতে শিখল না ,কেবল জলীয় অংশটুকু গ্রহণ করে ভাবল "কি না হনু"! প্রাচ্যের জলের সঙ্গে পাশ্চাত্যের দুগ্ধের জলীয় অংশটুকুর মিশ্রণে সমাজের বুকে আরো নিকৃষ্ট সভ্যতার তরল-গরল উদ্-গিরণ হতে লাগল | প্রতিনিয়তঃ আমরা সেই গরলের আস্বাদ পাই ।
গ্রামের মানুষ এ যুগেও অশিক্ষা ও কুশিক্ষার বাতাবরণে কালাতিবাহিত করছে।। অনেক নিকটবর্তী গ্রামে মানুষ একালেও চিকিত্সার অভাবে প্রাণ হারাচ্ছে। এমনকি শহরেও বিদ্যালয়,মহাবিদ্যালয় , বিশ্ব-বিদ্যালয় , হাসপাতাল, পথ-ঘাট, সর্বক্ষেত্রে সুচিন্তিত পরিকাঠামো এবং দেখভালের অভাবে ভেঙে পড়ছে ।শিক্ষক অধ্যাপক এবং চিকিত্সক হারাল মূল্যবোধ । অনেক প্রত্যন্ত গ্রামে একালেও প্রাথমিক বিদ্যালয় , বিদ্যুত এ সব বিরল ; স্বাধীনতার আগে এমনটি কি ছিল ?
নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অবাধ ব্যক্তিস্বাধীনতা, নেতাগণের স্বেচ্ছাচারিতা, 'বীরভোগ্যা' বসুন্ধরার সম্পদের যথেচ্ছাচার, সরকারী অর্থের অপব্যবহার ,মানুষের নেতিবাচক মানসিকতা , পূর্বতন নেতার অযোগ্য উত্তরসুরি ....এই ষড়রিপু দেশের মানুষকে আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে , দেশের অর্থনৈতিক,সামাজিক, নৈতিক সর্বক্ষেত্রে ঘুণ ধরিয়ে দিল । স্বাধীনমানুষ মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে সভ্য হল। রাজনৈতিক নেতাগণ কেউ চাকরি, কেউ বসতবাড়ি , কেউ পদমর্যাদা ....এইসব মহত্স্বার্থে গণতন্ত্ররক্ষার বৃহত্-কর্তব্যে অবহেলা করলেন । আমরা শিখলাম বহুতল ফ্ল্যাট-কালচার, লেট্-নাইট পার্টি-কালচার , ডিস্কোথেক কালচার । কম্পিউটারাইজেশন হল | শুরু হল কেব্-ল্-টিভি , ইন্টারনেট , মোবাইলফোন ইত্যাদি অত্যাধুনিক পরিষেবা | স্বাধীনদেশের কালচার । আরো সভ্য হলাম । শিশু হারাল শৈশব। যৌবনের আগেই অকাল যৌবনের নিতে পেরে যারপরনাই কৃতার্থ হল। শুরু হল সমাজের সর্বস্তরে অবক্ষয়।স্বাধীনতার আনন্দে সমাজে হল বহু নায়ক... পুরুষ নায়ক, স্ত্রী নায়ক, শিশু নায়ক |মানুষ গোষ্ঠীভুক্ত হয়ে পড়ল এবং নিজেদের মধ্যে কলহ বাধাল ; দেশব্যাপী 'সভ্য' হবার হিড়িক পড়েছে কিনা! কিশোর উপেক্ষা করল কৈশোরকে আর অচিরেই পদার্পণ করল যৌবনে | সহসাগত যৌবনের আস্বাদ গ্রহণ রে নবীন প্রজন্ম আগলহীন নব্য-সংস্কৃতির বোরখা পরে নিল; প্রৌঢ়েরা পাত্তা না পেয়ে কৃতাঞ্জলিপুটে শিঙ ভেঙে বাছুরের দলে প্রবেশ করল | বৃদ্ধেরা উত্যক্ত হয়ে ব্যাপক বিশ্বায়নের ঊর্মিমালায় খাবি খেতে খেতে বাণপ্রস্থ নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে বাস করতে লাগল। একান্নবর্তী পরিবার বিভাজিত হয়ে এককোষী পরিবারে পরিণত হল | সমাজের অলিগলি দুষ্কৃতি দুরাত্মাদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হল। এই কি হল স্বাধীনতার ফল?
স্বাধীনতার প্রাক্কালে যখন দেশশুদ্ধ মানুষ যখন প্রাণ ঢেলে স্বাধীনতা দিবস উদ্-যাপনে ব্রতী হয়েছে তখন মনে হয় কিসের জন্য তাদের এত উত্সাহ? পাড়ায় পাড়ায় তরুণ-তরুণী স্বাধীনতা পালন করছে, মাননীয় নেতাগণ বীরবিক্রমে কন্ঠনালী ফুলিয়ে গগনভেদী চিত্কার করে বাতাস ভারী করছেন, প্রচার মাধ্যমগুলি প্রতি পলে পলে স্বধীনতার সংগীত , প্রতি দন্ডে দন্ডে স্মৃতিচারণ , সকালে স্বাধিনতা সংগ্রামের উপর তথ্যচিত্র তো বিকালে ছায়াছবি, প্রদর্শন করছে | কখনো বিরলকেশ ,বর্ষীয়ান নেতাকে বহুকষ্টে উপস্থিত করে তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা আমাদের পরিবেশন করছেন ,শহীদ-স্মৃতি ফলক শ্বেত-পুষ্পের অবগুন্ঠনে চলে গেছে , ব্রিগেডের মৃত্তিকা পুষ্পবৃষ্টিতে ছয়লাপ হয়েছে,শহীদমিনারের পাদদেশে লক্ষ মানুষ ভীড় করে নেতার জ্বালামুখী বক্তৃতা শুনছে, সারাদেশের আকাশে বাতাসে স্বাধীনতার পাঞ্চজন্যের বজ্রনিনাদ অনুরণিত হচ্ছে তখন স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে , কেনই বা এই উত্সব? কি জন্য পেয়েছিলাম স্বাধীনতা? আমরা কি স্বাধীনদেশের যোগ্য উত্তরসুরী?
১২ আগ, ২০১১
ঘুম ভাঙানিয়া, দুখ জাগানিয়া বৃষ্টি
আজ ন্যাশানাল হাইওয়ে-৬ এর ওপর দিয়ে খড়গপুর থেকে কোলকাতায় এলাম প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে । সেই সাথে হাইওয়ের দুধারে পশ্চিম মেদিনীপুর হয়ে পূর্ব মেদিনীপুর ,হাওড়া ও সব শেষে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা দিয়ে কলকাতায় ঢুকলাম । মেদিনীপুর ভাসছে জলে.. থৈ থৈ বন্যায় প্রকৃতি উদ্দাম নৃত্য করছে । বন্যার করালগ্রাস হাওড়াকে অতটা ছোঁয়নি যতটা ছুঁয়েছে মেদিনীপুর জেলাকে । গ্রাম গুলি, ধানক্ষেত সব জলে ডোবা । এত কাছ থেকে বন্যা দেখেছিলাম কলকাতায় ১৯৭৮ সালে ভাদ্রমাসে। অবিশ্যি কলকাতায় ভারিবর্ষায় প্রতিবছরই জল জমে যায় । কিন্তু মৌসুমীবায়ুর প্রভাব্, ঘূর্ণাবর্ত, ভরাকোটালে নদীতে বান আসা এবং পর্যাপ্ত বৃষ্টির ফলে নদীর ব্যারাজের স্লুইস গেট খুলে দিয়ে জলছাড়া এই সবকটির সম্মিলিত ফল কিন্তু বন্যার রূপ নেয় । এবছর ও মনে হচ্ছে তেমনটি হতে চলেছে । বিশাল রূপনারায়ণ নদীর ওপরে কোলাঘাট ব্রিজ পেরোলাম ভয়ে ভয়ে । জলছাড়ার ফলে যদি জল বেড়ে যেত তাহলে কি হত ! অসম্ভব বৃষ্টি হচ্ছিল কোলাঘাটে রূপনারায়নের বুকে । দুকুল ছাপানো হাসি সেই নদের ।
কোনা এক্সপ্রেস ওয়ে দিয়ে কোলকাতায় ঢুকে গঙ্গা পেরোতে গিয়ে দেখলাম তার বর্ষার ভরা যৌবন । সেকেন্ড হুগলি ব্রিজ বা বিদ্যাসাগর সেতুর ওপর থেকে ভারি সুন্দর লাগছিল তার ঢল ঢল রূপ! বৃষ্টি তখন অঝোরে ঝরছে । শেষ শ্রাবণের ধারাবর্ষণ । আকাশের ছন্নছাড়া কালচে ধূসর মেঘ ভেসে ভেসে ঝোড়ো হাওয়ার সাথে খেলাচ্ছলে জলবর্ষণ করে চলেছে অবিরত । দূর থেকে ইডেন গার্ডেন্স এর ভেজা ফ্লাডলাইট, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালকে দেখা গেল আবছাভাবে । বৃষ্টির মাদকতায় শ্রাবণ যেন ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে চলেছে বৃষ্টির সুরে । কোলকাতা হয়ত কর্মব্যস্ত তখন । হয়ত বা অলস দুপুরঘুমে অচ্ছন্ন । হয়ত কার ভাতঘুম কেড়ে নিল এই বৃষ্টি । চোখ খুলে দেখলাম ভবানীপুরের মোড় ।
১০ আগ, ২০১১
শীতল-লতা
ওকে রোজ দেখা যায়না । যেদিনই ভাবি ওর কথা, ওর চালচলন, ওর সাজগোজ আর রূপের কথা সেদিনই ও আমাকে দেখা দিয়েই চলে যায় । ঠিক কেমন যেন আমার সাথে টেলিপ্যাথি আছে ওর । ওকে প্রথম দেখেছিলাম বসন্তের শেষে একটা অকাল বোশেখের বিকেলে । ঝিরঝির বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে দিয়ে ঢুকে গেছিল ঘরের মধ্যে । একটু দেখতে না দেখতেই সেই চলে যাওয়াটা আমাকে আরো যেন উদাস করে দিয়েছিল । আবার অপেক্ষা সেই থেকে । পরদিন বৃষ্টি ভোরের ভেজা সকালে আবার দেখতে পেয়েই মনের মধ্যে সেই পাগলা হাওয়ার উদ্দাম নাচ অনুভব করলাম । হৃদয় অলিন্দে ধুকপুকুনিতে বুঝে গেলাম আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি । ভোরের হলুদ রোদের আলো তখন চুঁইয়ে এসে পড়েছে গাছের ডালপালার মধ্যে দিয়ে । সোজা এসে সেই আলো পড়েছে ওর চিকনকাজের শিফনে। ভোরের আলোর লালিত্যে ওর লাবণ্য যেন আরো বেড়ে গেল মনে হল । আমার শরীরের গোপন রহস্যে তখন কিসের যেন আলোড়ন । চোখ মুখ ধুয়ে এসে আবার দাঁড়ালাম বারান্দায় ততক্ষণে ও চলে গেছে ঘরের মধ্যে । এবার ভাবলাম ওকে বলতেই হবে আমার মনের কথাগুলো। আর এমনটি মানায় না । অসহনীয় এই অপেক্ষা। আমার ইহকাল, পরকাল সবকিছু ওকে দিয়ে দেব একদিন। আর পারছিনা এই এড্রিনালিনের যন্ত্রণা বইতে । হয় আমি এখান থেকে চলে যাব যাতে আমার আর ওকে দেখতে না হয় । কারণ আমার সংসারে ওর কোনোদিনো আসা সম্ভব নয় । সেকথা যেমন ও জানত তেমনি আমিও জানতাম । কিন্তু বলা হল না । এড্র্নালিনের টানাপোড়েনে বিপর্যস্ত আমি তখন বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি বাড়ি থেকে । সে এসে আমার পথে বাধা দিল । আবার ওর রূপ দেখলাম । যথারীতি ভালো লেগে গেল । ইচ্ছে হল আমার সবটুকুনি দিয়ে ওকে আমার করে নি। একটু আদর করে ঘরে তুলি । একসাথে থাকি আমরা দুটিতে । ওকে জড়িয়ে ধরতে গেলাম । মনে হল ওর ঠান্ডা মসৃণ ঠোঁট দুটো আমাকে চায় । পরেই মনে হল নাঃ এ আমার ভুল । হয়ত ও অন্য কারোকে ভালবাসে । ছোঁয়া হয়ে উঠলনা ওকে। ঠোঁট রাখাও হলনা ওর শরীরে । ভাবতে ভাবতে দেখি ও অনেক দূর এগিয়ে চলে গেছে । কেমন যেন একটা আওয়াজ করতে করতে । ঠান্ডা ঠান্ডা শরীরটার লালিত্য বয়ে নিয়ে । কি জানি উষ্ণতা ছিলনা বলেই আর ওকে পাওয়া হল না আমার ।
৯ আগ, ২০১১
প্যাটিপিসির আর্মানি আরশি [ "দেশ" পত্রিকায় প্রকাশিত (১৭ই জুন ২০১১) ]
পরমার
আজ খুব ভোর ভোর ঘুম ভেঙে গেছে
। ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই মনে পড়ে
গেল কাল দুপুরের সেই ঘটনা ।
সেটা সত্যি না মিথ্যে,
স্বপ্ন না
দু:স্বপ্ন
এখনো সেটাই বুঝে উঠতে পারছেনা
পরমা । কেবলই মনে হচ্ছে তার,
কেন কাল সে
গেল সেই চিলে কোঠার ছাদের ঘরে;
দীপাণ্বিতা
লক্ষ্মীপূজোর পেতল কাঁসার
বাসন বার করতে মা পাঠিয়েছিলেন
তাকে ঐ ঘরে । বড় একটা কর্পূরকাঠের
বাক্সে রাখা থাকে সব পূজোর
জিনিষ পত্র ।
প্রতিবছরই পরমার
কাজ সেগুলোকে বের
নারায়ণ
পুতুল, আর
অপরাজিতা পাতা বাটা দিয়ে সবুজ
কুবের পুতুল । কলার পেটোতে
সেই পুতুল তিনটিরই আসলে পূজো
হয় ঐদিন । আর একটি কলার পেটোতে
মাথা থেকে আঁচড়ানো চুলের নুড়ি,
একটু গোবর
আর একটা ভাঙা মোমবাতি রেখে
তৈরী হয় অলক্ষী । চাটাই পিটিয়ে,
মোমবাতি
জ্বেলে অলক্ষীকে বাড়ির বাইরে
বের করে পূজো করে,
লক্ষী,
নারায়ণ আর
ধনপতি কুবেরকে শাঁখ বাজিয়ে
বরণ করে প্রতিষ্ঠা করা হয় ।
সরমা দেবী তাঁর শাশুড়িমায়ের
খুব প্রিয়পাত্রী ছিলেন । সব
রীতি নীতি মেনে প্রতিবছর পূজো
করেন তিনি নিখুঁত ভাবে । এদিন
ভোরে পরমাদের বাড়িতে পরমার
দিদি পর্ণা,
জ্যাঠামশায়ের
ছেলে প্রমিত,
বড়পিসির
মেয়ে এষা ছাড়াও আসবে পরমার
ছোট পিসি প্যাটিপিসি । প্যাটিপিসির
নীলচে চোখ আর দুধের মত ফর্সা
গায়ের রঙ |
আদর করে
পরমার ঠাকুর্দা তার ছোট মেয়ে
পত্রলেখাকে ডাকতেন প্যাট্রিসিয়া
বলে । আর ছোটরা সংক্ষেপে ডাকত
প্যাটিপিসি বলে । পরমার চুল
একটু বাদামী বাদামী,
স্ট্রেট
হেয়ার । সরমার খুব গরব তাই
মেয়েকে নিয়ে । সরমার মত মাটা
মাটা নাক,
ভাসা ভাসা
চোখ আর ছোটপিসির মত গায়ের রং
। ছেয়ালো ছেয়ালো গড়ন । ঠিক যেন
পুতুল পুতুল ভাব । পরমা যেমন
পিসির মত কাজের তেমনি মায়ের
মত গোছালো । পিসি ভাইঝি একেবারে
হরিহর আত্মা । কতবার প্যাট্রিসিয়া
বলেছেন "বৌদি
দাও না বাপু,
তোমার তো
দুটি মেয়ে ,
আমি একটাকে
মানুষ করি "
কিন্তু
সরমার তো প্রাণ !
তাঁর বড়
মেয়েটিকে তাড়াতাড়ি বিয়ে থা
দিয়ে দিয়েছিলেন কালনার জমিদার
বাড়ির ছেলের সাথে । বর্ধিষ্ণু
পরিবার,
একমাত্র
ছেলে । সংসারে কোনো ঝক্কি নেই
। গ্র্যাজুয়েশানের পরপরই
সরমার ভাই সম্বন্ধ এনেছিলেন
আর এক দেখাতেই মেয়ে দেখে পছন্দ
হয়ে ঝপ করে বিয়ে হয়ে গেছিল
পর্ণার । তা সে ভালই হয়েছে ।
পর্ণা বিয়ের পর এম.এ
করেছে । এখন নাতি-নাতনীর
গৌরবে আটখানা সরমা আর তার
স্বামী । পরমাকে এখুনি বিয়ে
দেবেন না ঠিক করেছেন তারা ।
পরমা ম্যাথমেটিকসে এমএসসি
করছে বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে
।
লেখাপড়ার
সাথে সাথে মেয়েকে সবকাজও
শিখিয়েছেন সরমা । প্যাটিপিসির
মত অনূঢ়া থাকবেনা অবিশ্যি সে
। কিন্তু মনে মনে মাঝে মাঝে
প্রমাদ গনেন সরমা । সত্যি
সত্যি তার ছোট ননদটির মত আইবুড়ো
হয়ে থাকতে হবে না তো তার পরমাকে
? প্যাট্রিসিয়া
তাদের সাবেকী বাড়ি বারাসতে
একা থাকেন । বয়স প্রায় শেষ
ষাটের কোঠায় । এখনো যেমন সুন্দরী
তেমনি কর্মঠ । এই বিয়ের পরেই
বোধ হয় সব মেয়েরা বুড়িয়ে যায়
। ছেলেপুলে হয়ে রূপের দফা গয়া
হয়ে যায় । সংসারের কাজের চাপে
মাঝে মাঝেই এ কথা সরমা চিতকার
করে বলে ওঠেন স্বামীকে "দেখো
দিকিনি এই ছোট্ঠাকুরঝিকে,
বেশ কাটিয়ে
দিল জীবনটা । যখন খুশি যেখানে
খুশি বেড়িয়ে আসছে,
নেই তার
কোনো পিছটান । আমাদের মত ?
সেই কবে
পায়ে শেকল পরেছি । ব্যাস!"
স্বামী,
শ্বশুর
বাড়ি আর মেয়েদুটিকে মানুষ
করতে করতেই তাঁর দিন কাবার !
জম্মের
বুড়ি কম্ম বিয়ের পর একবার
দেওঘর আর একবার পুরী ব্যাস !
গত বছর তবু
তার বড় জামাই কালনা নিয়ে গেছিল
গাড়ি করে জন্মাষ্টমীর সময় ।
রাধা-দামোদরের
পুজোতে ।
সরমার
স্বামী সারাদিন ব্যস্ত থাকেন
বিজনেসের কাজকর্ম নিয়ে । সেই
কোন ছোট্টবেলা থেকে পরমা আর
পর্ণা এসব দেখে আসছে । বাবা
ভোরে বেরিয়ে পড়েন আর হঠাত করে
একদঙ্গল বন্ধু নিয়ে বাড়ি এসে
হাজির হন । মায়ের সামলাতে হয়
সে ঝক্কি । কোনোদিন বাবার সাথে
আসেন মিষ্টার সেন । এখানেই
স্নানখাওয়া সারেন । বিকেলে
চা খেয়ে সূর্যাস্তের পর আবার
গাড়ি নিয়ে চলে যান দুই বন্ধু
মিলে অফিসে । সরমার অবিশ্যি
এসব খুব যে খারাপ লাগে তা নয়
। খাবার টেবিলে বাবা,
মিষ্টার
সেন আর সরমা তিনটিতে মিলে কত
গল্প হয় । কতবার তো কলেজ থেকে
ফেরত এসে চায়ের টেবিলে পরমাও
যোগ দিয়েছে তাদের সাথে । একঘর
জলখাবারে মাত করেছেন সরমা
তাঁর ডাইনিং টেবিল । পরমা
বলেছে তার মা'কে
"মা,
তুমি
পারো বটে!
বাবা
বলল আর তুমি একাহাতে এতসব
বানালে!
"অভিযোগের
সুর নিয়ে মা'কে
বলেছে,
"লোককে
আপ্যায়ন করতে পারলে আর তুমি
কিছু চাও না তাই না মা ?
একটু
নিজের কথা ভাবো না মা,
চলো
না আমরা দিন কয়েক কোথাও ঘুরে
আসি"
পরমা
সেই কখন ভাত খেয়ে চিলেকোঠার
ছাদে গেছে ঠাকুরের বাসন কোসন
বের করতে । বিকেলের কাজের বৌকে
দিয়ে মাজাঘষা করতে হবে সেগুলোকে
। সরমা অনেকটা কাঁচা তেঁতুল
সেদ্ধ করে রেখেছেন বাসনগুলো
চকচকে করে মাজার জন্যে ।কর্পূরের
বাক্সে বাসন ছাড়াও থাকে ঠাকুরের
আরতি করার চামর । আসল চমরী
গাইয়ের লেজ দিয়ে বানানো চামর
। পোকা লাগবে না বলে কর্পূরের
বাক্সে রাখা থাকে সেটি । বাক্সের
ঢাকা খুলেই কেমন যেন হারিয়ে
যায় পরমা । কর্পূরের ভুরভুরে
গন্ধে মনে পড়ে যায় প্যাটিপিসির
কাছে শোনা তাদের বাড়ির পুরোণো
সব গল্প । এই বাক্সটি এনেছিলেন
তাদের ঠাকুর্দার বাবা যুদ্ধের
সময় জাপানে গিয়ে । আর্মিতে
ছিলেন তিনি । আসল চমরী গাইয়ের
লেজ থেকে বানানো এই চামরটি
এনেছিলেন তাদের ঠাকুর্দা কোন
এক ঠান্ডার দেশ থেকে । তার
ঠাকুমার অর্থাত প্যাটিপিসির
মায়ের বিয়ের দানের পরী-পিলসূজ,
কাঁসার
জাম্বো থালা যেটিতে প্রতিবার
মালক্ষ্মীকে ভোগ বেড়ে দেন
সরমা । যতদিন প্যাটিপিসি বেঁচে
থাকবে পরমাও যেন এই গল্প গুলো
শুনবে তার পিসির কাছ থেকে ।
আর এই বাক্সের ঢাকা খুলেই আবার
মন কেঁদে উঠল তার প্রিয়
প্যাটিপিসির জন্যে । কাল কখন
সকাল হবে আর বাবা গাড়ি পাঠাবে
প্যাটিপিসিকে নিয়ে আসার জন্যে
। একে একে পরমা বের করল সব
পূজোর বাসন কোসন । ছোট্টবেলা
থেকে মায়ের সাথে বছরে এই একটিবার
কর্পূরবাক্স খুলে সব কিছু
বের করতে করতে মুখস্থ হয়ে গেছে
পরমার । নিমেষের মধ্যে সব বের
করে পরমা চেয়ে চেয়ে সব দেখতে
লাগল । চিলেকোঠার এই ঘরখানা
খুব পছন্দ ছিল একদিন পরমার ।
সারাবাড়ির থেকে বিছিন্ন এই
ঘরটায় ছোটবেলা পুতুল খেলতে
আসত পরমা তার দিদি পর্ণার সাথে
। দিদির বিয়ে হয়ে যাবার পর
পরমার ও পড়াশুনোর চাপ
বেড়ে
যায় তাই বছরে এই একটা দিনই আসা
হয় । আর আসে ভূত চতুর্দশীর দিন
এই চিলেকোঠার দরজায় বাড়ির
চোদ্দতম প্রদীপ দিতে । সারাবছর
সরমাই কাজের লোককে বলেন চাবিখুলে
ঘর পুঁছে আসতে । ঐ কর্পূরবাক্স
ছাড়া আর বিশেষ কিছু প্রয়োজনীয়
জিনিষ নেই সেখানে । আছে কটা
পোঁটলা-পুটলি
আর একখানা এলুমিনিয়ামের
ইস্কুলবাক্স । কোনোদিন পরমার
মনে হয়নি খুলে দেখার মানে
তাগিদও অনুভব করেনি কিন্তু
সেদিন যেন কিসের টানে সেই
এলুমিনিয়ামের বাক্সটার দিকে
চোখ যেতেই তার মনে হল খুলে
দেখে তার মধ্যে কি আছে । যেই
ভাবা অমনি কাজ । বাক্সটা হঠাত
খুলে ফেলল সে । একখানা লালচে
রঙের কাগজে মোড়া কি যেন সব
রয়েছে । একখানা না,
অনেক গুলো
তো ! নিজের
ঔত্সুক্যকে বশে রাখতে না পেরে
খুলতে লাগল একটার পর একটা সেই
লালচেরঙের মোড়ক । ভাঙা আর্শির
টুকরো সব !
ধুর!
হাত কেটে
যাবে । কাল আবার পূজোর কাজকর্ম
আছে । মা যদি রাগ করে !
কিন্তু এত
গুলো ভাঙা আয়নার টুকরো সযত্নে
কে রেখে দিয়েছে ঐ বাক্সের
মধ্যে ?
চিলেকোঠার
ঘরেই বা রাখা কেন ঐ ভাঙা আর্শির
টুকরো ! ভাঙা
আয়না তো কারোর কোনো কাজে আসবে
না । তাহলে?
বাক্সের
মধ্যে ঐ লালচে কাগজ খুলছে পরমা
। এর মধ্যে একটা বোলতা এসে তার
ডান হাতের ওপরে যেখানে কামিজের
হাতাটা শেষ হয়েছে সেখানে
মোক্ষম কামড় বসাল । উ:,
আ:,
বলে চিতকার
করে বাসনের ঝাঁকাটা নিয়ে নীচে
নেমে এল চুপিচুপি। তাদের কাজের
মেয়ে রাধাকে বলা আছে তিনটের
সময় এসে তেঁতুল সেদ্ধ দিয়ে
মেজে চকচকে করবে সেই বাসন ।
রান্নাঘরের বারান্দায় একছুটে
বাসনের ঝাঁকা নামিয়ে রেখে
মায়ের ঘর থেকে হোমিওপ্যাথির
বাক্স খুলে বোলতা কামড়ানোর
ওষুধের পাঁচ-ছ'টা
গুলি খেয়ে,
রান্নাঘরের
তাক থেকে সোডি-বাই-কার্বের
গুঁড়ো জলে গুলে হাতের ওপরে
লাগিয়ে আবার চিলেকোঠার ঘরে
দে ছুট !
ভাঙা
আর্শিরটুকরো রহস্যের কিনারা
করতে হবে তাকে । কি আর্শি,
কেন আর্শি,
কখন আর্শি
! আর
তারপর কাল সকালে প্যাটিপিসি
এসে পড়লেই কেল্লাফতে !
সব রহস্যের
সমাধান হয়ে যাবে ।
একলাফে
চিলেকোঠার ছাদে পৌঁছে গেল
পরমা কিন্তু ঢোকার মুখে ঘরের
চৌকাঠে বেধড়ক হোঁচট খেল সে ।
ডান পায়ের নখ ভেঙে রক্ত বেরিয়ে
একাকার । ছাদে কটা টবে গাঁদা
ফুলের গাছ ছিল । কটা পাতা তুলে
হাতে করে পিশে লাগিয়ে দিল
পায়ের নখে । রক্ত বন্ধ হ'ল
বটে তবে প্রচন্ড ব্যথা হল পায়ে
। এবার সেই এলুমিনিয়াম বাক্স
রহস্যের কিনারায় মন দিল ।
একটা লালচে কাগজের মোড়ক খুলে
ভাঙা আর্শির টুকরোটাকে বের
করে রাখল নিজের পাশে অতি
সন্তর্পণে । আর তারপর পরের
টুকরোটাকে,
তারপর
আরেকটাকে ...
এই ভাবে
বড়, মেজ,
সেজ,
ছোট সব
টুকরোকে বের করে দেখল তখনো
বাক্সের মধ্যে প্রায় আট-দশটা
ভাঙা আয়নার টুকরো পড়ে রয়েছে
। বের করে রাখা পিস গুলোকে
ভালো করে দেখতে লাগল সে । অতি
দামী আয়না । বাবা বলতেন পল
কাটা । ইংরেজীতে বলে bevelled
অর্থাত
কিনা আলোক রশ্মি আয়নার পাশ
থেকে গেলে প্রিজমের মত বিচ্ছুরণ
ঘটায় । সে তো বিজ্ঞানের ছাত্রী
। এসব বিষয়ে তার সম্যক জ্ঞান
। হঠাত মোবাইল বেজে উঠল !
কে রে বাবা
এই ভর দুপুরে ?
মিসড কল
একটা কিন্তু অচেনা নম্বর ।
ধুস মানুষের খেয়ে দেয়ে আর কাজ
নেই । হয় ভুল নম্বর ডায়াল করে
আর নয় তো ইচ্ছে করে মানুষকে
বিরক্ত করে ।
আবার
আয়না , ভাঙা
আয়না , টুকরো
টুকরো করা দামী আয়নায় পেয়েছে
পরমাকে । চিলেকোঠার ঘর খুলে
আবার সেই এলুমিনিয়াম বাক্সের
ঢাকা খুলে উবু হয়ে বসে বের
করতে লাগল ভাঙা আয়নার টুকরো
গুলো একের পর এক । চকচকে আয়নার
টুকরো কিন্তু কোনো কাজে লাগবে
না আর কারণ এতো জুড়ে লাগিয়ে
ব্যাবহার করা যাবে না । কেন
যে বাড়ির মানুষেরা পুরোণো সব
জিনিষ গুলো এভাবে জমিয়ে রেখে
দেয় কে জানে ?
নস্টালজিয়া
! পুরোণোকে
ঝেড়ে না ফেলা !
যত সব ঘর
দোর নোংরা করে রাখার প্রবণতা
... চিরকালের
রোগ বুড়ো মানুষদের !
কেবল
পুরোণো জিনিষ পত্র কে আঁকড়ে
পড়ে থাকা !
কত কি ঘটে
যাচ্ছে এ জগতে ,
কত
গ্লোবালাইজেশানের ঢেউ আছড়ে
পড়ছে শহরে,
টেলিকমিউনিকেশনের
কত অগ্রগতি হ'ল,
ইন্টারনেটে
কত কিছু হচ্ছে তবু এই মানুষ
গুলো পড়ে রয়েছে পুরোণো স্মৃতিকে
আঁকড়ে ধরে !
বড় বড় শপিংমলের
গ্রোসারী স্টোর গুলোতে যাবেনা
বাজার করতে ,
এস এম এস
পাঠাতে শিখবে না,
ইন্টারনেট
যেদিকে তার থেকে শত হস্ত দূরে
থাকবে এরা । পরমা মনে মনে দূষলো
তার বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ
দের
। নয়তো কেউ এই ভাঙা আয়নাখানা
এভাবে সযত্নে প্যাক করে শিকেয়
তুলে রাখে !
"আজ ফেলে
দেবই এই টুকরো গুলোকে,
যত্তসব
জঞ্জাল জমিয়ে রাখা "
লালচে হয়ে
যাওয়া কাগজের মোড়ক সরিয়ে
একখানা আর্শির ভাঙা টুকরো
বের করতে গিয়ে পরমার হাতটা
খুব জোরে কেটে গেল । সে যাত্রায়
আর চাপা দেওয়া গেল না ।ঘর বন্ধ
করে নীচে নেমে এল সে । মা কে
কিছুই বললনা এত সব । ডেটল দিয়ে
পরিষ্কার করে আয়োডিন লাগিয়ে
ব্যান্ড এড দিয়ে বারান্দায়
গিয়ে ভাবতে লাগল । আয়নায় কি
আছে, কেন
আছে ? সেই
কারণেই কি বাড়ির লোকজন সেই
আয়নার টুকরোগুলো ফেলতে পারেনি?
পরদিন
সকালবেলা কালীপুজোর ঠিক আগের
দিন । ভূত চতুর্দশী । আজ
প্যাটিপিসি আসবে । আসবে পরমার
দিদি পর্ণা তার ছেলেমেয়ে নিয়ে
। জামাইবাবু আসবে পুজোর দিন
সকালে । আর সকলেও আসবে ঐ দিন
। বেলা এগারোটা নাগাদ এলেন
প্যাটিপিসি । গঙ্গাজল রঙের
খোলের ওপর ইন্ডিগো ব্লু-রঙের
পেটা জরিপাড় ফুলিয়ার টাঙ্গাইল
শাড়ি পরে । সত্যি এখনো কি
সুন্দরী !
ছিমছাম
সাজগোজ । হাতে একগাছা করে
চুনীর চুড়ি পরা আর গলায় একটা
সরু চেন তাতে একটা ছোট্ট হীরের
স্বস্তিকা জ্বলজ্বল করছে ।
দূর থেকে গাড়ির আওয়াজ পেয়ে
দৌড়ে পরমা চলে গেল তার প্যাটিপিসিকে
রিসিভ করতে একতলায় ।
"কি
রে তোর হাতে কি হল পরী?"
পরমাকে
দেখেই বলে উঠলেন প্যাট্রিসিয়া
ওরফে পত্রলেখা । "
আরে ছাড়
ছাড় প্যাটিপিসি ,
কতদিন বাদে
এলে, আর
এসেই যত বাজে কথা "
পরমা বললে
। পরমাকে পরী বলে ডাকেন তিনি
। দুপুরের সকলে মিলে একসাথে
খেল চোদ্দশাক ,
রাঙাআলু-মূলো-বড়ি
দিয়ে কাঁচা তেঁতুলের টক,
ভেটকির
ফুলকপি দিয়ে কালিয়া আরো কত
কি সরমা রেঁধেছেন...
। প্যাট্রিসিয়া
প্রতিবারের মত বৌদির রান্নার
গুণকীর্ত্তণ করলেন । বারাসত
থেকে
মিষ্টি এনেছিলেন । সকলে খেল
। পর্ণার দুই ছেলেমেয়ের জন্য
বড় বড় ক্যাডবেরীর বাক্স ,
দুটো করে
স্পেশাল তুবড়ী আরো কত কিছু
মনে করে করে আনেন প্যাটিপিসি
সকলের জন্যে প্রতিবার । বিজয়ার
পরেই তো দাদার বাড়ি আসা আর
ভাইফোঁটা সেরে একেবারে ফেরা
। পয়সার অভাব নেই তার,
বাবা অনেক
নামী কোম্পানির কাগজ তার এই
আইবুড়ো মেয়ের নামে দিয়ে গেছেন
। সেই ব্লুচিপ কোম্পানির
শেয়ারের ডিভিডেন্ডের টাকায়
রাণির মত থাকেন তিনি । তার
আদরের ভাইঝি পরীর জন্যে প্রতিবার
সোনার কিছু আনেন । এবার তাকে
দিলেন একটা বিলাতী হাফ গিনি
। পর্ণার জন্যে একটা কাশ্মিরী
শাল, বৌদি
সরমার জন্যে শাড়ি,
দাদার জন্যে
ধুতি । বিয়েথা হয়নি তো কি
প্যাটিপিসির কর্তব্যজ্ঞান
ভীষণ । কার সাথে কি করে চলতে
হয়, সমবয়সী
বৌদির সঙ্গে কতটা মাত্রা রেখে
চলতে হয় এসব তার কাছ থেকে শেখার
মত । দুপুরের খাওয়াদাওয়ার
পর পরমা গেল তার প্রাণের
প্যাটিপিসির ঘরে একখাটে শুয়ে
গল্প করতে ।
সরমা
তাঁর বড় মেয়ে পর্ণা আর দুই
নাতিনাতনীকে নিয়ে শুতে গেলেন
। একলাটি এই জীবনটার
একঘেয়ে
অলস দুপুরগুলো গড়িয়ে পার হয়েছে
জীবনের অনেকগুলো বছর । এখন
নাতিনাতনি অন্ত প্রাণ তাঁর
। স্বামীকে পায়নি বেশি । জীবনের
অনেককিছু ভালোলাগা পারিবারিক
বন্ধু মিষ্টার সেনের সাথে
শেয়ার করেছেন তিনি। টিভিদেখার
ভালোমন্দে,
চায়ের
কাপে, কফির
পেয়ালায় । দুপুরবেলার মনখারাপগুলো
আছড়ে পড়েছে দক্ষিণের শোবার
ঘরের দেওয়ালে । সরমার হাতের
রান্নার যাদুর তারিফ করেছেন
তিনি । ভালোভালো গল্পের বই
এনে পড়িয়েছেন তিনি । সরমা
তাই বলে স্বামীকে কিছু কম
ভালোওবাসেননি সারা জীবন ধরে
। সরমা কুড়িয়েছেন সেই ভালোলাগার
নুড়ি পাথর আর আঁচলে ভরেছেন
মিষ্টার সেনের ভালোবাসার
আখরগুলি ।মিষ্টার সেন আজীবন
ব্যাচেলর হয়েই থেকে গেছেন ।
কিন্তু কাঁটাতারের বেড়া পার
হন নি কেউ ।শুধু দুপুরগুলো
ভরে উঠেছে বন্ধুতার আনুকুল্যে
। এলোমেলো হয়েছে বিছানার
ফুলফুল চাদর । ঘরের হালকা
গোলাপী লেসের পর্দা উড়েছে
আপন খেয়ালে । সুন্দরী সরমা
অবিন্যস্ত চুল আর এলোমেলো
শাড়ির আঁচল ঠিকঠাক করে আবার
এসে চায়ের জল চাপিয়েছে । বিকেলে
পরমাদের বাবা ফেরার আগেই ঘর
গুছনোয়,
চুলবাঁধার
পারিপাট্যে,
ঠাকুরঘরের
সন্ধ্যেপ্রদীপে সংসারের
চাকা ঘুরতে শুরু করেছে । মিষ্টার
সেনের প্রতি মায়ের এহেন
দুর্বলতা পরমার বাবার চোখ
এড়িয়েছে কিন্তু এক একদিন
মায়ের সাথে সেনকাকুর এই ঘনিষ্ঠতা
পরমার মত বুদ্ধিমতীর চোখ যে
এড়ায়নি তা নয় । কিন্তু মাকে
সেভাবে কখনো সন্দেহের চোখে
দেখেনি সে ।
বিকেলে
আবার সারাবাড়ি চোদ্দপ্রদীপ
দেওয়ার পালা । সব সলতে পাকানো,
পিদিমে তেল
দিয়ে অতবড় বাড়ির সব গলিঘুঁজি
দালান,
তুলসীতলা,
সে বাড়ির
চিলেকোঠার থেকে শুরু করে
গ্যারাজ অবধি । তারপর বারান্দায়,
ছাদের আলসেতে
মোমবাতি জ্বেলে সাজানো ।
"প্যাটিপিসি
, আচ্ছা
শোনো চিলেকোঠার ছাদের ঘরে
একটা এলুমিনিয়ামের বাক্স
দেখলুম ,
ওটা কার
ছিল গো? "
পরমা জিগেস
করল । প্যাট্রিসিয়া বললেন
"ওটা
আমার ইস্কুল যাবার বাক্স ছিল
রে, দাদা
মানে তোর বাবা নিয়েছে তারপর
আমাদের দিদি মানে তোর বড়পিসি
আর তার পর আমি ইস্কুল গেছি রোজ
ঐ বাক্সটা নিয়ে । আমাদের সময়
অমন গোদা স্যুটকেস নিয়েই
ইস্কুল যেতুম আমরা । দিদির
আর আমার সাথে সুখরাম যেত ঐ
বাক্স বয়ে নিয়ে । দাদা নিজেই
হাতে করে নিয়ে যেত"
"আর ঐ
বাক্সের মধ্যে ভাঙা আয়নার
টুকরো গুলো কেন রাখা আছে
প্যাটিপিসি?"
পরমা বললে
। "সে
অনেক কথা রে পরী । তুই বড় হয়েছিস
| এতদিনে
তোকে সব কথা বলার সময় এসেছে
। আমি তখন বেথুন সাহেবের কলেজে
পড়িরে । কোলকাতা তখন স্বাধীন
পশ্চিম বাংলার শহর । কিন্তু
বেশ কিছু আর্মেনিয়ানের বাস
তখনো ছিল এ শহরে । বৃটিশ কাউন্সিল
লাইব্রেরিতে যেতাম অনার্সের
বই আনতে । তোদের মত সব বই
আমরা কিনতাম না । সেখানেই আলাপ
আর্মেনিয়ান যুবক হেলমোজের
সাথে । এশিয়াটিক সোশাইটিতে
ইন্ডিয়ান হিষ্ট্রি নিয়ে
রিসার্চ করত হেলমোজ । এমনিতে
তখন আর্মেনিয়ানরা কোলকাতায়
ব্যাবসা করতে এসেছিল কিন্তু
এই হেলমোজ ছিল একদম দলছাড়া ।
চূঁচড়ো থেকে আসতো সে । ভালো
বাংলাও শিখে গেছিল । আর আমরা
তো ছোট থেকে ইংরেজী পড়ে এসেছি
। রীতিমত ডেভিড কপারফিল্ড,
শেকস্পিয়ার,
শেলী-কিটস
সব গুলে খেয়েছি তাই আমারো
অসুবিধে হতনা হেলমোজের সাথে
কথা বার্তা বলতে । যাইহোক
কিছুদিনের মধ্যেই দুজনে দুজনের
খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলাম
রে । "তো
বিয়ে করলে না কেন তোমরা
প্যাটিপিসি"
পরমা বললে
। "জানিস
? সেবার
বাবা-মা
মানে তোদের ঠাকুর্দা-ঠাকুর্মা
পশ্চিমে হাওয়া বদল করতে গেল
আমাদের দাদা মানে তোর বাবাকে
নিয়ে । দাদার বুকে জল জমেছিল
অনেক চিকিতসার পর ডাক্তার
বললে চেঞ্জে যেতে । মধুপুরে
আমাদের সেই ভুতুড়ে বাড়িতে
চেঞ্জে গেল সকলে । আমার বিএ
ফাইনাল ইয়ার তাই বুড়ো চাকর
সুখরাম আর পুরোণো সব কাজের
লোকজন নিয়ে আমি রয়ে গেলাম
বারাসতের বাড়িতে । হঠাত একদিন
বৃটিশ কাউন্সিলে হেলমোজের
সাথে দেখা হয়ে গেল । বাবা
আমাদের পুরোণো ড্রাইভার কেশবকে
বলে দিয়ে গেছিলেন । কেশববাবুই
আমাকে কলেজ,
লাইব্রেরী
নিয়ে যেত । আর তখন তো কলেজে
স্টাডি-লিভ,
কেবল সপ্তায়
একদিন যেতাম লাইব্রেরী তখন"
সেদিন
ছিল ভরা বর্ষার একটা মুখ কালো
করা গোমড়া দিন । দুপুরে লাইব্রেরী
যাবে বলে সব ঠিক করে রেখেছে
পত্রলেখা । কেশবকে গাড়ি বার
করতে বলেও গাড়ি করে গেলনা সে
। এসপ্ল্যানেড গেল বাসে করে
। তারপর আবার একখানা বাসে চেপে
বৃটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরী।
যথারীতি বহুক্ষণ বসে অপেক্ষা
করছে হেলমোজ তার বান্ধবী
প্যাট্রিসিয়ার জন্যে । এ কথা
সে কথার পর জানতে পারলো
প্যাট্রিসিয়া যে তার বাবা-ঠাকুরদার
যে বংশ পরম্পরায় ব্যাবসা রয়েছে
লোহালক্কড়ের,
সে গুলো
ট্রেডিং করে আর্মেনিয়ান
কোম্পানি হেলমোজ এন্ড গিবস
। এই কোম্পানির অংশীদার আবার
হেলমোজরা । প্যাট্রিসিয়াদের
কোম্পানি বারাসত কাস্টিং
এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসের
লোহার স্প্রিংলার লেদ মেশিনে
ঘষে ফাইন করে পাঠানো হয় হেলমোজ
এন্ড গিবস কোম্পানিকে যারা
এগুলি ট্রেডিং করে । আরো
কাছাকাছি এল তারা । হেলমোজ
তাদের বংশের দলছুট । এই আর্মেনিয়
যুবক ব্যাবসা বোঝেনা কিন্তু
রীতিমত ইন্ডিয়ান হিষ্ট্রি
নিয়ে চর্চা করে যেটা আকৃষ্ট
করেছিল একুশ বছরের তন্বী,
গৌরী
প্যাট্রিসিয়াকে । এই নিয়ে
বার দশেক এই লাইব্রেরীতে
হেলমোজ আর প্যাট্রিসিয়া মিট
করেছে । আদান প্রদান হয়েছে
তাদের মত এবং অমতের । তারপর
ছাব্বিশ বছরের হেলমোজ
প্যাট্রিসিয়াকে আরো জানতে
চেয়েছে । প্যাট্রিসিয়া বাড়িতে
বলেছে তার কথা । হেলমোজও বলেছে
তার বাড়িতে প্যাট্রিসিয়ার
কথা । এখন মানে সেই ভরাবর্ষার
দুপুর পালিয়ে ছুটে এসেছে তার
বান্ধবী শুধু তার জন্য । বইপড়ার
অছিলায় হাতে হাত ছুঁয়ে গেছে
অনেক বার ।আলতো ছোঁয়া লাগার
আবেশে আবিষ্ট হয়েছে দুটি মন
। এক অদ্ভূত ভালোলাগায় মেতে
উঠেছে তারা আর সহায় হয়েছে
প্রকৃতি। বাইরে বেরিয়ে তারা
দেখেছে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে
আর সেদিন গাড়ি নেই সাথে । সত্যি
সত্যিই হেলমোজের সাথে পথ চলতে
চেয়েছিল পত্রলেখা আর সোজা
বাড়ি এসেছে তাকে নিয়ে । সুখরামকে
ছুটি দিয়ে রেখেছে তার দিদিমণি,
হিন্দুস্তানি
আড্ডায় যেতে বলেছে । বাড়ির
সবসময়ের লোককে বলেছে চা আর
আলুর টিকিয়া বানিয়ে রেখে চলে
যেতে । সেদিনটা শুধু প্যাট্রিসিয়া
আর হেলমোজের একান্তে পাওয়ার
দিন । জীবনের প্রথম পুরুষের
স্পর্শ পেয়েছে পত্রলেখা আর
তারই মনের মত পুরুষ ;
রূপবান,
মেধাবী আর
রীতিমত বিত্তশালী। অর্থাত
সমানে সমানে কোলাকুলি!
বাবা-মা
আর যাই হোক অমত করবে না যদি
তারা বিয়ে করে । হেলমোজের
নাকে তখন পত্রলেখার একরাশ
কালোচুলের সুগন্ধীতেলের
হালকা গন্ধ,
কানে পত্রলেখার
একগোছা সোনার চুড়ির রিনরিন
, আর
চোখে শুধু বাংলাদেশের এক
মেয়ের একজোড়া টানা টানা চোখ
যার চোখের ঘন কালোপাতা গুলোয়
হারিয়ে
গেছে সে । উজাড় করে দিয়েছে তার
সবটুকু । উপুড় করে দিয়েছে
ভালোলাগা । দুহাত পেতে নিয়েওছে
সেই মেয়েটি সবটা । হেলমোজের
গোলাপী ঠোঁটজোড়া আরো চেয়েছে
। পত্রলেখা আরো দিয়েছে । যতক্ষণ
না আশ মেটে দুজনের । বাইরে
প্রচন্ড বৃষ্টি পড়ছে তখন ।
ফিরে চলে গেছে হেলমোজ তার
বাড়ি। পত্রলেখা এক গভীর
ভালোলাগার ঘোরে পড়াশুনো করে
চলেছে । মা বাবা ফিরে এসেছে
কয়েকদিন পর । পরীক্ষা শুরু
হয়ে গেছে তার । লাইব্রেরী
যাওয়া হয়নি আর । হেলমোজের
সাথেও দেখা নেই । মাস দুতিন
পর পত্রলেখা বুঝতে পেরেছে যে
সে সন্তানসম্ভবা । মা কে
জানিয়েছে । মা শোকে পাথর হয়ে
কয়েকদিনের মধ্যেই ম্যাসিভ
কার্ডিয়াক এরেস্ট হয়ে মারা
গেছেন ।পত্রলেখা দাদার মাধ্যমে
বাবার কাছে জানিয়েছে যদি
শীঘ্রই বিয়েটা দিয়ে দেন তারা
। কিন্তু বাবা তাকে বাধ্য
করেছেন ভ্রূণ হত্যা করতে ।
চুপিচুপি এবর্শান করে এসেছে
। তবুও বাবা হেলমোজের সাথে
বিয়ে দিতে চাননি । লোকলজ্জার
ভয়ে নষ্ট হয়ে গেছে তিন-তিনটে
তরতাজা জীবন । হেলমোজ এসেছিল
একদিন আবার পত্রলেখার কাছে
। বিএ পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে
তাই পত্রলেখাকে উইশ করতে আর
সাথে নিয়ে এসেছে চারটে আরমেনিয়ান
গোল্ড কয়েন আর সাথে একখানা
আর্মানি আর্শি । তার প্যাট্রিসিয়াকে
বলে গেছে "বিয়ে
আমাদের নাই বা হোল,
এই মিররে
রোজ এবং সারা জীবন তুমি আমাকে
দেখতে পাবে,
আমাদের
দেশে এটিকে বলে "মিরর
অফ রিয়েলিটি"
। তুমি যা
বাস্তবে দেখতে চাইবে,
আশা করবে
তাই ফুটে উঠবে এই আয়নায় । আমাকে
যখনই দেখতে চাইবে আমি এই আয়নায়
তোমার চোখের সামনে এসে দাড়াব
, তোমার
হয়েই থাকবো আমি সারা জীবন ।
আর এই মিররে উদ্ঘাটিত হবে
জীবনের কঠিনতম সত্য । যত্ন
করে রেখে দিও এটি । ফিরে যাব
দেশে কিন্তু আমার মনটা পড়ে
থাকবে এই মিররে । শুধু তোমার
জন্যে প্যাট্রি । আমি আবার
আসব ফিরে এই বাংলায়"|
ঠিকানা
দিয়ে গেছে আর চিঠি লিখতে বলে
গেছে |চিঠি
লিখেছে প্যাট্রিসিয়াও একসময়ে
অনেক গুলো । খুব সুন্দর কবিতা
লিখত হেলমোজ । সে গুলোকে বাংলায়
অনুবাদ করে রেখেছিল প্যাট্রিসিয়া
একসময় । তখনো যৌবন ছিল তার
শরীরে । একটু ভারীক্কি তবুও
নিটোল গড়ন । একটু আলগা বুড়িয়ে
যাওয়া তবুও লালিত্যের ছোঁয়া
ছিল শরীরে । আলমারি থেকে মাযের
বিয়ের লাল কড়িয়াল খানা বের
করে ঘোমটা দিয়ে লাল সিঁদুরের
টিপ পরে তাকিয়ে ছিল পত্রলেখা
সেই আর্মানি আর্শির দিকে ।
তার কেড়ে নেওয়া স্বপ্নগুলো
বেঁচে ছিল তখনো । মনে মনে
হেলমোজকেই স্বামীরূপে বরণ
করেছিল সে । কিন্তু সেই আর্শির
দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল
ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে । পত্রলেখা
দেখেছিল তার পেছনে তার মৃত
সিঁদুরপরা এয়োস্ত্রী মায়ের
করুণ মুখখানি । মা বললেন "বড্ড
কষ্টে আছি রে এখানে"।
সযত্নে তুলে রেখেছিল আয়নাখানি
। আর একদিন হেলমোজের জন্মদিনের
ভোরে তার আশার আয়নাখানির মধ্যে
হেলমোজকে জানিয়েছিল জন্মদিনের
শুভেচ্ছা । সাথে সাথে দেখেছিল
ভয়ঙ্কর
এক
দৃশ্য । ট্রেন এক্সিডেন্টে
আগের দিন হেলমোজ মারা গেছে ।
আর্শি শুনিয়েছিল সেই কথা আর
দেখিয়েছিল হেলমোজের রক্তাক্ত
মৃতদেহের ছবি । সাথে সাথে
প্যাট্রিসিয়া ছুঁড়ে ফেলে
দিয়েছিল আর্শিখানা আর টুকরো
হয়ে গেছিল তার আশার স্বপ্ন
গুলো সেই সাথে । তারপরদিনই
সেই আর্শির টুকরোগুলোকে কাগজে
মুড়ে এলুমিনিয়াম বাক্সে বন্দী
করে দাদার বাড়ির চিলেকোঠার
ছাদে রেখে এসেছিল নিজে গিয়ে
। তারপর থেকে কেউ খোলেনি সেই
বাক্স|এদ্দিনে
পরমা না হাত দিলে বুঝি আর কারো
নজরও পড়ত না ঐ বাক্সের ওপর ।
পরমা
অবাক বিস্ময়ে তার প্যাটিপিসির
দিকে তাকিয়ে বললে "ও,
তাই বুঝি
যতবার এই আর্শির টুকরো আমি
খুলতে গেছি ততবারই আমার কোনো
না কোনো বাধা আসছে,
বিপদের
সঙ্কেত দিচ্ছে ঐ আর্শি আমাকে
। আমার ঐ হাত কেটে যাওয়া,
বোলতা
কামড়ানো,
হোঁচট খেয়ে
পায়ের নখ উঠে যাওয়া,
রবাহুত
মিসড কল...
এ সবই কি
তাহলে ঐ অভিশপ্ত আর্শির
সতর্কীকরণ?"
"প্যাটিপিসি
তাহলে কেন রেখেদিলে ঐ আর্শিখানা
? আজ
তো হেলমোজও নেই আর ঐ আর্শি
দিয়ে তোমার কোনো কাজ ও হবে না
বরং অকাজ হবে"
"পারিনিরে
পরী, পারিনি,
আমি কিছুতেই
হেলমোজের দেওয়া ঐ আর্শিখানাকে
ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারিনি রে;
ওটা খোলার
কি দরকার ?
রেখে দে না
তুলে যেমনটি ছিল ঐ বাক্সবন্দী
করে । আমি মরে গেলে ফেলে দিস
জঞ্জালের গাদায়"
প্যাটিপিসি
বললে । আলোচনায় ছেদ পড়ল;
মা এসে ডাক
দিলেন "কৈ
রে তোরা ?
নে এবার,
সব চোদ্দপ্রদীপ
জ্বালার তোড়জোড় কর !
সন্ধ্যের
ঝুলেই সরাবাড়ি আলো দিতে হবে
যে"
পরমা
সলতে পাকাতে বসল,
চোদ্দপিদিম
দিল, বারান্দায়
মোমবাতি দিয়ে সাজাল । কিন্তু
মনে একটা খচখচ করা অনুভূতি
তার...কি
জানতে চাইবে সে,
কি দেখবে
সে ...কি
গল্প শোনাবে ঐ আর্শি তাকে !
সবশেষে
চিলেকোঠার দোরগোড়ায় প্রদীপ
দিতে দৌড়ে এল পরমা সেখানে ।
ভূত চতুর্দশীর রাত । নিশুতি
অন্ধকার নয় তবে আজ বেশ ছমছমে
লাগছে পরমার । একে একে বাক্সখুলে
একখানা করে আর্শির ভাঙা টুকরো
বের করতে লাগল তিন দশকের পুরোণো
কাগজের মোড়ক থেকে । সাহস করে
একটা বড় ভাঙা টুকরোর ওপর ধরল
সেই পিদিমের আলো আর দেখতে লাগল
কতকিছু । চমকে উঠল কিন্তু ভয়
পেল না । আজ তাকে জানতেই হবে
কত না জানা তথ্য হয়ত উঠে আসতে
পারে আয়নার মধ্যিখানে !পরমার
নিজের মুখ আর তার পেছনে একজন
বয়স্ক মানুষ,
সৌম্য-সুদর্শন
চেহারা,
আবছা
অবয়ব কিন্তু মুখটা পরিষ্কার
দেখছে পরমা আর তার কথাগুলিও
শুনছে স্পষ্ট...একি?
এনাকে
তো পরমা বিলক্ষণ চেনে । ইনি
তো সেনকাকু । বাবার বন্ধু
মিষ্টার সেন । তার মাথায় হাত
ছুঁইয়ে বলছেন"এতদিনে
এভাবে তোকে যে কতগুলো দরকারী
কথা বলতে হবে তা ভাবিনি আমি
। । বড় সাধ হয়েছিল তোকে দেখার
। আজ দেখা হয়ে গেল । তুই যাকে
বাবা বলিস সে তোর আসল বাবা নয়
। আমিই তোর আসল বাবা । আমি তোর
মাকে বড্ড ভালোবেসেছিলাম রে
!
ভুল
করেছিলাম হয়ত । হয়ত বা করিনি
। আমাকে ভুলে যাস তোরা ।
"না,
না,
না,”
পরমার
ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল আর
শুনতে পারলনা সে ।এক কঠিন
বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে
রয়েছে সে । আগামীকাল দীপাণ্বিতা
পুজোতেও তো প্রতিবারের মত
আসার কথা সেনকাকুর । একমূহুর্ত্ত
অপেক্ষা না করে সবকটা ভাঙা
আয়নার টুকরো সে ছাদের ওপর থেকে
বাড়ির পেছনের একটা পানা পুকুরে
ছুঁড়ে ফেলতে লাগল এক এক করে
। ভাঙা কাঁচের টুকরো ফালা হয়ে
কেটে গেল হাত ভেসে গেল হাত সেই
রক্তে,
চুঁইয়ে
চুঁইয়ে রক্ত পড়তে লাগল সালোয়ারের
কুর্তায় । ভূত-চতুর্দশীর
আসন্ন অমাবস্যার অন্ধকারে
ছেয়ে গেল তার মনের ভেতর ।কাল
অলক্ষী বিদায়ের আগেই বাড়ির
পুরোণো অলক্ষীর বিদায় হয়ে
গেল তখুনি সেই ভূত চতুর্দশীর
রাতেই |
৮ আগ, ২০১১
আজ ৭০তম ২২শে শ্রাবণ !
মেঘের কোলে রোদ হেসেছিল সেদিন, বৃষ্টি ছুটি নিল।
নাচের তালে তালে আমার শৈশব রঙীন তখন ।
রোদনভরা বসন্ত এসেছিল যেদিন, শীতের ছুটি হয়ে ।
তুমি দিলে গানের ইস্কুল, আমার মেয়েবেলা যখন ।
ঝর ঝর মুখর বাদর দিনে, আমার যৌবন উপবন সবুজ হয়েছিল ।
আমি তারেই খুঁজে বেড়াই তখন ।
এমনি করেই কেটে গেছে বিরহের বেলা ।
তাকিয়ে দেখি পশ্চিম আকাশে অস্তরাগের বিপুল তরঙ্গ ।
৪ আগ, ২০১১
চল্ যাই
চল্ মুন বেড়াতে যাবি
বৃষ্টির সাথে বসেআঁকোতে?
বৃষ্টি ফোঁটার ছবি আঁকার খেলাঘরে
বর্ষার জলে তুলি ডুবিয়ে মেঘ দুপুরে
সাতরঙা আলপনার আকাশে
চল্ মুন বেড়াতে যাবি
প্যাষ্টেলের শেডে?
কিম্বা অয়েল অন ক্যানভাসে,
চারকোলে কিম্বা কাদাজলে
একাডেমীতে, কেমোল্ড বা চিত্রকূটে
বৃষ্টির সাথে বসেআঁকোতে?
বৃষ্টি ফোঁটার ছবি আঁকার খেলাঘরে
বর্ষার জলে তুলি ডুবিয়ে মেঘ দুপুরে
সাতরঙা আলপনার আকাশে
চল্ মুন বেড়াতে যাবি
প্যাষ্টেলের শেডে?
কিম্বা অয়েল অন ক্যানভাসে,
চারকোলে কিম্বা কাদাজলে
একাডেমীতে, কেমোল্ড বা চিত্রকূটে
চল্ মুন ভিজতে যাবি
ভিক্টোরিয়ায় বা লেকের মাঠে?
ভরদুপুরে গড়িয়াহাটে
কচুরিপানায়, তেঁতুলগোলায়
সোঁদামাটির কদমতলায়, কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি ঝরায়
যেখানে বৃষ্টি আঁকছে একমনে, বসেআঁকোতে ..
ভিক্টোরিয়ায় বা লেকের মাঠে?
ভরদুপুরে গড়িয়াহাটে
কচুরিপানায়, তেঁতুলগোলায়
সোঁদামাটির কদমতলায়, কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি ঝরায়
যেখানে বৃষ্টি আঁকছে একমনে, বসেআঁকোতে ..
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)