খুলে ফেল ব্রাউসার, ই-বুকের বান্ডিল পড়ে ফেল ঝটাপট, যদি থাকে কিন্ডল
বইমেলা, মেলাবই, ফ্যাশানের মোচ্ছব ! মানুষের ঢল সেথা, শীতের ঐ উত্সব ।
এদিকে কৈছে তাঁরা গাছফাছ কেটোনা, অথচ ছাপিয়ে বৈ কিন্ডল কিনোনা ।
তাহলে তো পরিবেশ এমনিই দূষিত, ডিজিটাল বৈমেলা হয়ে যাক ত্বরিত!
নামীদামী ম্যাগাজিন অনলাইন সস্তা,বাড়িতে রাখতে জ্বালা, ভরে যায় বস্তা ।
News Week উঠে গেল বন্ধু তুমি জানো? অনলাইন পড় তাই ফেলে রাখো কেনো?
ছোট্টবেলা থেকে ছেলেমেয়েদের হাতে বই তুলে দেওয়ার থেকে ভালো উপহার আর কিছুই নেই । বুড়ো মানুষদের হাতে করে কাশীরামদাসের মহাভারত, কৃত্তিবাসী রামায়ণ কিম্বা কথামৃতের মত বই এর কথকতা শোনার মত ভালো অভিজ্ঞতা আর কিছুতেই হয়না । বইমেলায় ঘুরে ঘুরে দুষ্প্রাপ্য কিছু বই খুঁজে খুঁজে কিনতে খুব ভালোবাসি কিন্তু এত এত নতুন নতুন গল্প-কবিতার বই বাজারে সেগুলির পাঠক অপ্রতুল । বইপ্রকাশের ব্যাপারেও অর্থনৈতিক মন্দার কথা জানলাম এবারের দেশ পত্রিকা পড়ে । নতুন লেখক লেখিকার প্রতি কোনো রকম অসম্মান না করেই বলছি তারা আরেকটু কেন ইকোফ্রেন্ডলি এটিট্যুড নিয়ে অনলাইন ইবুক প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না । আর সর্বোপরি যে রাজ্যে শিল্পের হাহাকার, বেকারত্বের চিতকার এখনো সেখানে এত ধুমধাম করে বইমেলা না করে অনলাইন বই পড়ানোর ওয়ার্কশপ কিম্বা ওয়েব পত্রিকার প্রোমাশান করলে ভালো হত । রাজ্যের টাকা ঘুরে ফিরে রাজ্যেই আসছে । beyond border গেলে ভালো হত না কি ? নতুন লেখকদের বই মানুষ অনলাইন পড়ুক বিনিপয়সায় নয় ।মাত্র ১ টাকা করে দিক তারা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে । এতে লেখক অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছবেন । আর প্রকাশনার খরচও সামান্য সেখানে । তাই লেখকের হারাবার কিছু নেই । তাই বলে আমি যদি এখন বই প্রকাশ করি তবে আমাকে অনেকে গাল দেবেন কিন্তু আমার পাঠককুলের একাংশ বরিষ্ঠ মানুষেরা যাদের হাতে বই তুলে না দিলে তাঁদের প্রতি আমার ঋণ থেকে যাবে চিরকালের মত । তাই প্রিন্ট অন ডিমান্ড এর পথ বেছে নেওয়াই মঙ্গলকর । একসাথে পাবলিশারের মাধ্যমে ৪০০ কপি বই না ছেপে যখন যেমন দরকার ( মাত্র ১টিবই ও ছাপা যায় )তেমন ছেপে নাও । এতে লেখকের পকেট বাঁচে.. এমন অনলাইন সার্ভিস আছে বাজারে । দেশের অরণ্যমেধ যজ্ঞের বিরুদ্ধে এও আমার এক নীরব প্রতিবাদ ।
বইমেলা রমরমিয়ে চলছে খুব জাঁকজমক করে । আমিও যাই প্রতিবার, জানিনা এবার হবে কিনা । তবে এখন প্রচুর ডিসকাউন্টে অনলাইন বইপত্র কেনাকাটি করা আর ই-বুক পড়া এবং সর্বোপরি নামীদামী ম্যাগাজিন অতি সস্তায় সাবস্ক্রাইব করার এত সুযোগ তাই মনে হয় পরিবর্তন এল বলে । তবে প্রিন্ট ম্যাগাজিন বা বইয়ের চাহিদা থাকবে কিছু মানুষের জন্য যাঁরা কিন্ডল হাতে নিয়ে পড়তে পারেননা বা কম্পিউটার স্ক্রিনে বেশিক্ষণ বসতে পারেন না । শুনছিলাম " News Week" ম্যাগাজিন প্রিন্ট এডিশান বন্ধ করে দিয়েছে কিন্তু অনলাইন ভার্সান আরামে পড়া যাচ্ছে । তাই মন দিয়ে ব্লগ লিখে চলেছি শীতের দুপুরবেলায়, একটু একটু করে সাহস করে ব্লগ লিখে চলেছি ২০০৭ থেকে এই ভরসায় । দেশের অরণ্য-নিধন যজ্ঞের বিরুদ্ধে এও এক লড়াই আমার ।
এবারেই পড়লাম দেশ পত্রিকাতে :
"মুদ্রিত বইয়ের বিক্রি ক্রমশঃই নিম্নগামী । কাগজ-কালি গন্ধ থেকে অনেকটাই দূরে এখন "গ্রন্থের" অবস্থান । ই-বুক একটু একটু করে দখল করে নিচ্ছে বাজার । বিশ্বের নামী প্রকাশকরাও কমিয়ে দিচ্ছেন মুদ্রণ সংখ্যা । লেখকদের পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক দিতে ও তারা দ্বিধান্বিত । তাই স্বয়ং লেখকরাই ছাপাচ্ছেন নিজেদের বই । তবে এ পন্থা চটজলদি কোনো সমাধানের পথ যে দেখাচ্ছে তেমনটা নয় । পূর্ণ সময়ের লেখক - এই বৃত্তিও ক্রমক্ষীয়মান । পাশাপাশি আর-এক আশঙ্কা , লোকজন এবারও বইমেলায় ভীড় করবেন বটে , কিন্তু বই কিনবেন তো ? সব মিলিয়ে মুদ্রণ জগতহয়ত এখন প্রমাদই গুনছে"
দেশ পত্রিকা, ১৭ই জানুয়ারি ২০১৩, "ঘরে-বাইরে" কলম
শেষ ৮০র দশকে আমার যখন কলেজ বেলা তখন বইমেলা বাধ্যতামূলক ছিল । কারণ সব অনার্সের বই লাইব্রেরীতে পাওয়া যেতনা আর কিছু দুস্প্রাপ্য বিদেশী লেখকের টেক্সট বই সস্তায় পাব সেই আশায়, আর সাথে বন্ধুবান্ধবের জন্মদিনের উপহারে দিতে হবে সারাবছর ধরে , ছোট ভাইয়ের জন্য ছবির বই, মায়ের জন্য অমনিবাস । চলে আসছি, আবার মনে পড়ে গেল ঠাকুমার জন্য কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারতের জন্য বাবা খোঁজ নিতে বলেছিলেন । আবার বেরিয়ে আসব তখন মনে পড়ল দিদিমা বলেছিলেন কার যেন লেখা শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত পুঁথি শতছিন্ন হলেও যেন নিয়ে আসি কিনে । বই কেনা, নাড়াচাড়া, সব করে বন্ধুদের সাথে আড্ডা, খাওয়া দাওয়া সেরে ধূলো খেতে খেতে বাসে গিয়ে ওঠা ।
বিয়ের পর বইমেলা গিয়ে খোঁজ হল মাটিতে বসা তরুণ আর্টিস্টদের কাছ থেকে অরিজিনাল পেন্টিং কেনা আর কালীঘাট পটচিত্র, যামিনী রায় , নন্দলাল বসু, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামী ছবির পোষ্টার সংগ্রহ করা । ঘর সাজাতে হবে । নতুন ঘরবাঁধার জন্য বইমেলা । আরো কিছু টেরাকোটা শিল্পীর কাছ থেকে গিফট আইটেম কেনা ( তখন অন্যসময় এত সব টেরাকোটা পাওয়া যেত না ) ।
৯০ শুরুতে পুত্রকে নিয়ে হাতে বই তুলে দিতে হবে । বইপড়ার অভ্যাস করাতেই হবে । কিন্তু তা তো ইংরেজী বই । বাংলা উপেন্দ্র কিশোর, সুকুমার রায়, শরদিন্দু তো আমি পড়ে বাড়িতে তাকে শোনাই । তার এক একবার এক একটা সিরিজ চাই । কোনো বার ফেমাস ফাইভ, কোনো বার সিকরেট সেভেন্, কোনো বার নডি ...তারপর এল পুরো টিনটিন, এস্ট্রিকস...
ততদিনে বাড়ি সিলিকন-চিপময়তায় আচ্ছন্ন । কিন্তু ছেলে নাছোড়বান্দা । তার একহাতে চাই বই অন্যহাতে চাই গেমসিডি । সিডিও জায়গা করে নিল কোলকাতা বইমেলায় । মিলতে লাগল ফেলুদা, টেনিদা, ঘনাদার অনুবাদও । এ প্রজন্ম বাংলা পড়বেনা । কিন্তু আমার ছেলের কৈশোর যে অধরা থেকে যাবে তাই অনুবাদই সই । তখনো কোলকাতার ক্ষুধার রাজ্য সুপ্ত শিল্পীসত্তায় জেগে রয়েছে । কিন্তু ডিজিটালি । অর্কুটময় গদ্যে, ফেসবুকময় কবিতায়, ট্যুইটারময় সনেটে । যন্ত্রজালে জায়গা করে নিয়েছে কত কত উদ্বাস্তু ব্লগবসতি । দুইবাংলার পাবলিক এখন পড়ে কম, লেখে বেশী ।
এখন বইকেনার চেয়ে স্বরচিত বইপ্রকাশের পাবলিসিটিতে আত্মহারা তারা । বইমেলায় হারিয়ে যাচ্ছে শরদিন্দু, সুনীল শক্তিরা । নবপ্রজন্মের কাছে হ্যারিপটার বেশী পাত্তা পায় । ঠাকুমার ঝুলিতে ধূলোর আস্তরণ । আর বইয়ের পাশাপাশি অ-বইয়ের স্টলও নেহাত কম নয় । যে যার ঢাক পেটাচ্ছে জোরেজোরে । জিটকের চ্যাটবাক্সের হাতছানিকে উপেক্ষা করে কে যায় আর বইমেলায় ? বইপ্রেমীর পৃথীবি ফেসবুকময় । যারা যাচ্ছে তারা খাচ্ছে কিন্তু গিলছেনা । যারা পাচ্ছে তারা হেলায় হারাচ্ছে নীহাররঞ্জন-বিভূতিভূষণদের । আর কিছু খাচ্ছে প্রচন্ড ক্ষুধাতাড়নায় । কেউ কিনছে নতুন বইয়ের আলমারীতে অমুক সমগ্র, তমুক অমনিবাস সাজিয়ে রাখার জন্য । আর স্কুল কলেজ পড়ুয়াদের গুগলময় রাজ্যে বইমেলা নেহাতই একটা মিটিং গ্রাউন্ড । শীতে প্রেমঝারি জমে ক্ষীর ।
থরে থরে পসরা । বাঙালীর রসনা তৃপ্তির একমেবমদ্বিতীয়ম খোরাক বই । কিন্তু ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতা বেশী । ঠিক যেমন গানের সিডি বাজারে থরে থরে সাজানো কিন্তু শ্রোতার চেয়ে শিল্পী বেশি ।
আর দেখি টিভি চ্যানেলের উপছে পড়া স্টল । যে যার প্রোপাগান্ডা করে নিজের প্রোডাক্টের প্রোমোশান চালাচ্ছে কিন্তু বইবিক্রির বাণী সেখানে নীরবে নিভৃতে কাঁদছে । পাঠক-দর্শকের ভীড় সেখানেই । সেলিব্রিটির খোঁজে, হাতে হাত মেলানোর অপেক্ষায় । মানুষ যত না বই দেখছে তত বেশি কুইজ, অন্তাক্ষরি খেলছে বইমেলায় । টেলিভিশনে নিজের মুখটা দেখতে পাবে সেই আশায় । বেচারা বইসব!
লে ছক্কা ! হাতের কাছে ব্রহ্মাস্ত্র কপি-পেস্ট । বেকার পয়সা নষ্ট করা কেন ! দাদু ঠাকুমার আয়ু বেড়েছে । দাদু আর রামায়ণ পড়েন না কারণ ডিমেনশিয়া । ঠাকুমার চৈতন্যচরিতামৃত তাকে ধূলো খায় কারণ এলঝাইমারস । বাবার নেটেই সব পড়াশুনো হয়ে যায় কারণ সামনে খোলা ল্যাপটপ । মায়ের অনলাইন সব খবর মিলে যায় কারণ উপচে পড়া ডিজিটাল বন্ধুমহল । আর ছেলেপুলের বইমেলা যাওয়া হল নিছক আউটিং কারণ স্টেটাস সিমবল । কিন্তু তবুও সরস্বতীও আসেন এই সময়েই । তাই বইমেলাও আসবে তার নির্ঘন্ট মেনে । থিমও থাকবে একটা কিছু । নতুন নতুন বইতে উপচে পড়বে স্টল । কোলকাতা বইমেলা বেঁচে থাকবে তার ঐতিহ্য আর রাজকীয়তা নিয়ে কারণ বছরে বাঙালীর একটা কিছু বলার মত স্টেটাস আপডেট বইমেলা-উত্সব !
তবুও যদি বইমেলার হাত ধরে শিল্প আসত! তবুও যদি বইমেলার হাত ধরে কর্ম সংস্থান হত!
বইমেলা, মেলাবই, ফ্যাশানের মোচ্ছব ! মানুষের ঢল সেথা, শীতের ঐ উত্সব ।
এদিকে কৈছে তাঁরা গাছফাছ কেটোনা, অথচ ছাপিয়ে বৈ কিন্ডল কিনোনা ।
তাহলে তো পরিবেশ এমনিই দূষিত, ডিজিটাল বৈমেলা হয়ে যাক ত্বরিত!
নামীদামী ম্যাগাজিন অনলাইন সস্তা,বাড়িতে রাখতে জ্বালা, ভরে যায় বস্তা ।
News Week উঠে গেল বন্ধু তুমি জানো? অনলাইন পড় তাই ফেলে রাখো কেনো?
ছোট্টবেলা থেকে ছেলেমেয়েদের হাতে বই তুলে দেওয়ার থেকে ভালো উপহার আর কিছুই নেই । বুড়ো মানুষদের হাতে করে কাশীরামদাসের মহাভারত, কৃত্তিবাসী রামায়ণ কিম্বা কথামৃতের মত বই এর কথকতা শোনার মত ভালো অভিজ্ঞতা আর কিছুতেই হয়না । বইমেলায় ঘুরে ঘুরে দুষ্প্রাপ্য কিছু বই খুঁজে খুঁজে কিনতে খুব ভালোবাসি কিন্তু এত এত নতুন নতুন গল্প-কবিতার বই বাজারে সেগুলির পাঠক অপ্রতুল । বইপ্রকাশের ব্যাপারেও অর্থনৈতিক মন্দার কথা জানলাম এবারের দেশ পত্রিকা পড়ে । নতুন লেখক লেখিকার প্রতি কোনো রকম অসম্মান না করেই বলছি তারা আরেকটু কেন ইকোফ্রেন্ডলি এটিট্যুড নিয়ে অনলাইন ইবুক প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না । আর সর্বোপরি যে রাজ্যে শিল্পের হাহাকার, বেকারত্বের চিতকার এখনো সেখানে এত ধুমধাম করে বইমেলা না করে অনলাইন বই পড়ানোর ওয়ার্কশপ কিম্বা ওয়েব পত্রিকার প্রোমাশান করলে ভালো হত । রাজ্যের টাকা ঘুরে ফিরে রাজ্যেই আসছে । beyond border গেলে ভালো হত না কি ? নতুন লেখকদের বই মানুষ অনলাইন পড়ুক বিনিপয়সায় নয় ।মাত্র ১ টাকা করে দিক তারা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে । এতে লেখক অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছবেন । আর প্রকাশনার খরচও সামান্য সেখানে । তাই লেখকের হারাবার কিছু নেই । তাই বলে আমি যদি এখন বই প্রকাশ করি তবে আমাকে অনেকে গাল দেবেন কিন্তু আমার পাঠককুলের একাংশ বরিষ্ঠ মানুষেরা যাদের হাতে বই তুলে না দিলে তাঁদের প্রতি আমার ঋণ থেকে যাবে চিরকালের মত । তাই প্রিন্ট অন ডিমান্ড এর পথ বেছে নেওয়াই মঙ্গলকর । একসাথে পাবলিশারের মাধ্যমে ৪০০ কপি বই না ছেপে যখন যেমন দরকার ( মাত্র ১টিবই ও ছাপা যায় )তেমন ছেপে নাও । এতে লেখকের পকেট বাঁচে.. এমন অনলাইন সার্ভিস আছে বাজারে । দেশের অরণ্যমেধ যজ্ঞের বিরুদ্ধে এও আমার এক নীরব প্রতিবাদ ।
বইমেলা রমরমিয়ে চলছে খুব জাঁকজমক করে । আমিও যাই প্রতিবার, জানিনা এবার হবে কিনা । তবে এখন প্রচুর ডিসকাউন্টে অনলাইন বইপত্র কেনাকাটি করা আর ই-বুক পড়া এবং সর্বোপরি নামীদামী ম্যাগাজিন অতি সস্তায় সাবস্ক্রাইব করার এত সুযোগ তাই মনে হয় পরিবর্তন এল বলে । তবে প্রিন্ট ম্যাগাজিন বা বইয়ের চাহিদা থাকবে কিছু মানুষের জন্য যাঁরা কিন্ডল হাতে নিয়ে পড়তে পারেননা বা কম্পিউটার স্ক্রিনে বেশিক্ষণ বসতে পারেন না । শুনছিলাম " News Week" ম্যাগাজিন প্রিন্ট এডিশান বন্ধ করে দিয়েছে কিন্তু অনলাইন ভার্সান আরামে পড়া যাচ্ছে । তাই মন দিয়ে ব্লগ লিখে চলেছি শীতের দুপুরবেলায়, একটু একটু করে সাহস করে ব্লগ লিখে চলেছি ২০০৭ থেকে এই ভরসায় । দেশের অরণ্য-নিধন যজ্ঞের বিরুদ্ধে এও এক লড়াই আমার ।
এবারেই পড়লাম দেশ পত্রিকাতে :
"মুদ্রিত বইয়ের বিক্রি ক্রমশঃই নিম্নগামী । কাগজ-কালি গন্ধ থেকে অনেকটাই দূরে এখন "গ্রন্থের" অবস্থান । ই-বুক একটু একটু করে দখল করে নিচ্ছে বাজার । বিশ্বের নামী প্রকাশকরাও কমিয়ে দিচ্ছেন মুদ্রণ সংখ্যা । লেখকদের পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক দিতে ও তারা দ্বিধান্বিত । তাই স্বয়ং লেখকরাই ছাপাচ্ছেন নিজেদের বই । তবে এ পন্থা চটজলদি কোনো সমাধানের পথ যে দেখাচ্ছে তেমনটা নয় । পূর্ণ সময়ের লেখক - এই বৃত্তিও ক্রমক্ষীয়মান । পাশাপাশি আর-এক আশঙ্কা , লোকজন এবারও বইমেলায় ভীড় করবেন বটে , কিন্তু বই কিনবেন তো ? সব মিলিয়ে মুদ্রণ জগতহয়ত এখন প্রমাদই গুনছে"
দেশ পত্রিকা, ১৭ই জানুয়ারি ২০১৩, "ঘরে-বাইরে" কলম
শেষ ৮০র দশকে আমার যখন কলেজ বেলা তখন বইমেলা বাধ্যতামূলক ছিল । কারণ সব অনার্সের বই লাইব্রেরীতে পাওয়া যেতনা আর কিছু দুস্প্রাপ্য বিদেশী লেখকের টেক্সট বই সস্তায় পাব সেই আশায়, আর সাথে বন্ধুবান্ধবের জন্মদিনের উপহারে দিতে হবে সারাবছর ধরে , ছোট ভাইয়ের জন্য ছবির বই, মায়ের জন্য অমনিবাস । চলে আসছি, আবার মনে পড়ে গেল ঠাকুমার জন্য কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারতের জন্য বাবা খোঁজ নিতে বলেছিলেন । আবার বেরিয়ে আসব তখন মনে পড়ল দিদিমা বলেছিলেন কার যেন লেখা শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত পুঁথি শতছিন্ন হলেও যেন নিয়ে আসি কিনে । বই কেনা, নাড়াচাড়া, সব করে বন্ধুদের সাথে আড্ডা, খাওয়া দাওয়া সেরে ধূলো খেতে খেতে বাসে গিয়ে ওঠা ।
বিয়ের পর বইমেলা গিয়ে খোঁজ হল মাটিতে বসা তরুণ আর্টিস্টদের কাছ থেকে অরিজিনাল পেন্টিং কেনা আর কালীঘাট পটচিত্র, যামিনী রায় , নন্দলাল বসু, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামী ছবির পোষ্টার সংগ্রহ করা । ঘর সাজাতে হবে । নতুন ঘরবাঁধার জন্য বইমেলা । আরো কিছু টেরাকোটা শিল্পীর কাছ থেকে গিফট আইটেম কেনা ( তখন অন্যসময় এত সব টেরাকোটা পাওয়া যেত না ) ।
৯০ শুরুতে পুত্রকে নিয়ে হাতে বই তুলে দিতে হবে । বইপড়ার অভ্যাস করাতেই হবে । কিন্তু তা তো ইংরেজী বই । বাংলা উপেন্দ্র কিশোর, সুকুমার রায়, শরদিন্দু তো আমি পড়ে বাড়িতে তাকে শোনাই । তার এক একবার এক একটা সিরিজ চাই । কোনো বার ফেমাস ফাইভ, কোনো বার সিকরেট সেভেন্, কোনো বার নডি ...তারপর এল পুরো টিনটিন, এস্ট্রিকস...
ততদিনে বাড়ি সিলিকন-চিপময়তায় আচ্ছন্ন । কিন্তু ছেলে নাছোড়বান্দা । তার একহাতে চাই বই অন্যহাতে চাই গেমসিডি । সিডিও জায়গা করে নিল কোলকাতা বইমেলায় । মিলতে লাগল ফেলুদা, টেনিদা, ঘনাদার অনুবাদও । এ প্রজন্ম বাংলা পড়বেনা । কিন্তু আমার ছেলের কৈশোর যে অধরা থেকে যাবে তাই অনুবাদই সই । তখনো কোলকাতার ক্ষুধার রাজ্য সুপ্ত শিল্পীসত্তায় জেগে রয়েছে । কিন্তু ডিজিটালি । অর্কুটময় গদ্যে, ফেসবুকময় কবিতায়, ট্যুইটারময় সনেটে । যন্ত্রজালে জায়গা করে নিয়েছে কত কত উদ্বাস্তু ব্লগবসতি । দুইবাংলার পাবলিক এখন পড়ে কম, লেখে বেশী ।
এখন বইকেনার চেয়ে স্বরচিত বইপ্রকাশের পাবলিসিটিতে আত্মহারা তারা । বইমেলায় হারিয়ে যাচ্ছে শরদিন্দু, সুনীল শক্তিরা । নবপ্রজন্মের কাছে হ্যারিপটার বেশী পাত্তা পায় । ঠাকুমার ঝুলিতে ধূলোর আস্তরণ । আর বইয়ের পাশাপাশি অ-বইয়ের স্টলও নেহাত কম নয় । যে যার ঢাক পেটাচ্ছে জোরেজোরে । জিটকের চ্যাটবাক্সের হাতছানিকে উপেক্ষা করে কে যায় আর বইমেলায় ? বইপ্রেমীর পৃথীবি ফেসবুকময় । যারা যাচ্ছে তারা খাচ্ছে কিন্তু গিলছেনা । যারা পাচ্ছে তারা হেলায় হারাচ্ছে নীহাররঞ্জন-বিভূতিভূষণদের । আর কিছু খাচ্ছে প্রচন্ড ক্ষুধাতাড়নায় । কেউ কিনছে নতুন বইয়ের আলমারীতে অমুক সমগ্র, তমুক অমনিবাস সাজিয়ে রাখার জন্য । আর স্কুল কলেজ পড়ুয়াদের গুগলময় রাজ্যে বইমেলা নেহাতই একটা মিটিং গ্রাউন্ড । শীতে প্রেমঝারি জমে ক্ষীর ।
থরে থরে পসরা । বাঙালীর রসনা তৃপ্তির একমেবমদ্বিতীয়ম খোরাক বই । কিন্তু ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতা বেশী । ঠিক যেমন গানের সিডি বাজারে থরে থরে সাজানো কিন্তু শ্রোতার চেয়ে শিল্পী বেশি ।
আর দেখি টিভি চ্যানেলের উপছে পড়া স্টল । যে যার প্রোপাগান্ডা করে নিজের প্রোডাক্টের প্রোমোশান চালাচ্ছে কিন্তু বইবিক্রির বাণী সেখানে নীরবে নিভৃতে কাঁদছে । পাঠক-দর্শকের ভীড় সেখানেই । সেলিব্রিটির খোঁজে, হাতে হাত মেলানোর অপেক্ষায় । মানুষ যত না বই দেখছে তত বেশি কুইজ, অন্তাক্ষরি খেলছে বইমেলায় । টেলিভিশনে নিজের মুখটা দেখতে পাবে সেই আশায় । বেচারা বইসব!
লে ছক্কা ! হাতের কাছে ব্রহ্মাস্ত্র কপি-পেস্ট । বেকার পয়সা নষ্ট করা কেন ! দাদু ঠাকুমার আয়ু বেড়েছে । দাদু আর রামায়ণ পড়েন না কারণ ডিমেনশিয়া । ঠাকুমার চৈতন্যচরিতামৃত তাকে ধূলো খায় কারণ এলঝাইমারস । বাবার নেটেই সব পড়াশুনো হয়ে যায় কারণ সামনে খোলা ল্যাপটপ । মায়ের অনলাইন সব খবর মিলে যায় কারণ উপচে পড়া ডিজিটাল বন্ধুমহল । আর ছেলেপুলের বইমেলা যাওয়া হল নিছক আউটিং কারণ স্টেটাস সিমবল । কিন্তু তবুও সরস্বতীও আসেন এই সময়েই । তাই বইমেলাও আসবে তার নির্ঘন্ট মেনে । থিমও থাকবে একটা কিছু । নতুন নতুন বইতে উপচে পড়বে স্টল । কোলকাতা বইমেলা বেঁচে থাকবে তার ঐতিহ্য আর রাজকীয়তা নিয়ে কারণ বছরে বাঙালীর একটা কিছু বলার মত স্টেটাস আপডেট বইমেলা-উত্সব !
তবুও যদি বইমেলার হাত ধরে শিল্প আসত! তবুও যদি বইমেলার হাত ধরে কর্ম সংস্থান হত!